প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন? মানে পাথরের মূর্তিও আছে না কি পলিমাটির দেশে? “কেন?” মেজমামা বললে, “এই বড়ুদ্দেশেই তো রয়েছে। চলে যা, গুরুদাসদাদের পাড়ার ভেতর দিয়ে কামদেবনগর। একটু গেলেই দেখবি একটা বট গাছের নীচে রয়েছে পাথরের সূর্যমূর্তি। ক্যামেরাটা নিয়ে যাস।”
বড়ু বা বহড়ু দক্ষিণ-২৪ পরগনার একটি গ্রাম। লক্ষ্মীকান্তপুর লাইনে শিয়ালদা থেকে ৪৪ কি.মি.। ইষ্টিশানের গায়ে অবশ্য লেখা আছে ‘বহরু’। বাইরে নাম যদিও জয়নগরের, বহড়ুর লোকেদের ধারণা মোয়া নাকি বড়ুর-ই বেশি ভালো!
বেরিয়ে পড়লাম মামাতো ভাই রাজুকে নিয়ে। মেজমামা, মানে ওর জেঠুর কাছ থেকে রাজু বুঝে নিল কোথায় কোথায় যেতে হবে। ঘোষেদের সাবেকি আমলের বাড়ির পাশের পুকুরে লাল-সাদা শালুক আর টোকাপানা কুয়াশার চাদর প্রায় খুলে ফেলেছে শীতের নরম রোদ্দুরের ছোঁয়া পেয়ে। কিছুদূর যেতে না যেতেই রাস্তা হয়ে এল ক্রমশ সরু, দু-পাশে বাড়ির সংখ্যাও কম। তারপরে একটা মোড় নিতেই পথ যেন মনের আনন্দে হঠাৎ ঝাঁপিয়ে পড়ল—উন্মুক্ত ধানক্ষেতের বুকে। খেজুর পাতায় শিরশির শব্দ শীতের হাওয়ার। জিরেন-কাটের রসের হাঁড়ি নামানো হয়ে গেছে। শিউলিরা নলেন গুড় বানাবে। কিছু মৌমাছি ভন্ভন্ করছে গাছের চাঁছা গায়ে চুঁইয়ে পড়া রস খেতে। এই বেলায় সেটা প্রায় তাড়ি হতে চলেছে। এক ঝলক তীব্র মাদক গন্ধ।
আর একটু হাঁটতেই চোখে পড়ল বট গাছ একটা। নীচে বেদী মত-ও রয়েছে। কিন্তু পাথরের মূর্তি কোথায়? পাশে একটা টালি-ছাওয়া ঘর। রোদ্দুরে দাঁড়িয়ে দাঁতন করছিলেন একজন। জিগ্যেস করতে অবাক হয়ে গিয়ে তিনি জানালেন যে হ্যাঁ, আমরা ঠিক জায়গাতেই এসেছি বটে, কিন্তু সে মূর্তি তো নেই, সে নাকি অনেকদিন হল চুরি হয়ে গিয়েছে। সে কী? একেবারে চুরি হয়ে গেল? আমার হাতে ক্যামেরা লক্ষ করে প্রশ্ন করলেন আমি কোন খবরের কাগজ থেকে আসছি কি না। তারপরে গলা নামিয়ে বললেন যে চুরি হবার কিছুদিন বাদেই নাকি বাংলা-তে (“বাংলা” একটা জায়গা, মাইল ছয়েক উত্তরে) একটা মন্দিরের পাশের পুকুর থেকে শোনা যায় এই মূর্তিটাই উঠেছেন। উনি বা ওঁর চেনাশোনা কেউ অবশ্য দেখেননি স্বচক্ষে এক-ই মূর্তি কি না। মনটা একটু খারাপ হয়ে গেল। এই গ্রামের একটা গুরুত্বপূর্ণ ইতিহাসের সাক্ষ্য হয়তো হারিয়ে গেল চিরদিনের মত।
“ঠাকুরের ফটক তুলবেন? ওই তো পাশে মনসা রয়েছেন। তুলুন।”--টালি ছাওয়া ঘরটার দিকে আঙুল তুলে দেখালেন। উনি হাঁক পাড়তেই এক-মাথা ঘোমটা দিয়ে এক মহিলা এসে দরজা খুলে দিলেন। গোবর-লেপা মেঝের এক কোণে মনসার মূর্তি। আমিও ফটো তুলে একটু গল্প করে আবার বেরিয়ে পড়লুম রাস্তায়। রাজু বললে যে এবারে নেয়েপাড়ায় যাওয়া যাক।
আগের রাস্তা দিয়ে কিছুটা ফিরে এসে অন্য একটা রাস্তা ধরে নেয়েপাড়া। দু-পাশে ঘন সবুজ গাছের সমারোহ। শীতের শুকনো ধুলোর হাল্কা আস্তরণ পাতায় পাতায়। এদিক-ওদিক বাড়ির উঠোনে উনুন জ্বালিয়ে বিরাট ঢালাই লোহার কড়াইতে খই ভাজা হচ্ছে। সদ্য তোলা ফসল, কণকচুর ধানের খই। মোয়া সীজ্ন্। চারিদিকে গন্ধে একেবারে ম’ ম’ করছে।
নেয়েপাড়ায় একটা বিশাল প্রাচীন বকুল গাছের নীচে বাঁধানো বেদী। সেই ঢাকিদের কোন চিহ্ন দেখলুম না। বিশ্রাম করছে হয়তো। জাঁতাল হবে গভীর রাত্রে। আগের বছরের কয়েকটা পুরোনো বারা বা দক্ষিণদ্বার। উবুড় করে রাখা ঘটের উপরের দিকটা মুকুটের মতো হলে যেমন দেখতে হয়, তেমন। ইতিমধ্যেই রাস্তায় গাছের নীচে কয়েক জায়গায় দেখেছি। পাশে একটা পাথরের স্তম্ভের অংশ পড়ে আছে। বড়ুর গঙ্গা থেকে উঠেছিল অনেকদিন আগে। যাক, ইতিহাসের চিহ্ন তবু কিছু রয়েছে এখনো। এই বারা থেকেই নাকি গ্রামের নাম বহরু। মতান্তরে বড়ুক্ষেত্র বা দ্বিজক্ষেত্র থেকে বড়ু।
এর পর? একটুখানি গিয়েই বাস-রাস্তা। কলুর মোড় থেকে কানাইয়ের মোড়। কাছেই “বহড়ু শ্যামসুন্দর পাব্লিক লাইব্রেরী ও ফ্রী রীডিং রুম (স্থা: ১৯১২)”। তার পিছনেই একটা পুকুরের পাশে জামরুল গাছের নীচে বিবি-মা’র থান। জনশূন্য-- গছের ছায়া আর পাতার মর্মরে শান্তি নিঃশব্দে নিবিড়। বাস-রাস্তার কোলাহল থেকে হঠাৎ এসে মনে হয় যেন সময় এখানে থেমে গিয়েছে। দেখে বোঝা যায় কিন্তু যে সাত-বিবি অবহেলিতা নন। পুজোআচ্চা পান।
আবার বাস-রাস্তায় ফিরে আসা। হাইস্কুলকে (স্থা: ১৮৫৬) ডানদিকে ফেলে বহড়ু বাজার। গুড়-হাটা শেষ, নেতিয়ে শুয়ে থাকা দু-একটা নেড়ী-কুকুর ছাড়া বাজার এখন খাঁ-খাঁ করছে। আর একটু এগিয়েই বাঁ-দিকে একটা চালাঘর। ওখানেই আছেন ধর্মরাজ। আশপাশের চালাঘরগুলোর থেকে বোঝা যায় না এটার কোন বিশেষত্ব আছে বলে। এখানেও দরজা বন্ধ। বলতে একজন তাড়াতাড়ি এসে দরজা খুলে দিলেন। ফটো তুলে এবার হাঁটা “ঢিবের-হাটের” দিকে দক্ষিণ পাড়ায়।
বাস-রাস্তা থেকে কাছেই এক বড় গাছের নীচে এবার রীতিমতো পাকা ঘর। বড়-খাঁ গাজীর খান। পাশেই মুসলমান গেরস্তবাড়িতে জিগ্যেস করলুম দরজা খোলা যাবে কি না। কিন্তু অনেক ডাকাডাকি করেও যার কাছে চাবি আছে তাঁকে পাওয়া গেল না। জানলা থেকেই তুলতে হলো ছবিটা এবার। পরিষ্কার ঘর, সদ্য রং করা দুটি সুবেশ যোদ্ধার মত মূর্তি পরস্পরকে সাহচর্য দিচ্ছে। ঘরের কোণে ঝুল জমেছে।
ব্যস! এবারে মামার বাড়ি ফেরা। বাড়ির কাছেই মামাদেরই বাবাঠাকুর। বাবাঠাকুর দক্ষিণ-২৪ পরগনায় বহু জায়গাতেই দেখেছি। এই গ্রামেই আর একটা অন্তত বিশাল বড় বাবাঠাকুর আছেন।
জয়নগর-মজিলপুরেরই শ্রী গোপেন্দ্রকৃষ্ণ বসুর চমৎকার বইটা পড়ে বুঝেছিলুম কীভাবে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে লোকাচার ও সংস্কৃতি গ্রাম বাংলার দেবদেবীদের আঁকড়ে ধরে বয়ে যাচ্ছে। দু-ঘন্টাও মাত্র লাগেনি বোধহয় আমাদের এই লৌকিক দেবদেবীদের ছবিগুলি তুলতে। কিন্তু অবাক লাগল আমার এই ভেবে যে এতদিন ধরে আমি এদের অনেকের অস্তিত্বই জানতুম না। নিত্য চলার পথের ধারেই লুকিয়ে আছেন গ্রামীণ লজ্জায়।
সেদিন বিকেলেই গেলুম জয়নগরের শান্তি-সংঘে। বাস-রাস্তার পাশেই বেশ পুরোনো লাইব্রেরী। উপরের তলায় ছোট্ট একটি ঘর, নারকেল ছোবড়ার তৈরি কার্পেট পাতা মেঝেতে। পরিপাটিভাবে সাজানো—যদিও সংগৃহীত জিনিসের পক্ষে অপরিসর। স্থানীয় মনীষীদের ছবি, সংঘের সঙ্গেই যুক্ত একজনের আঁকা। এখানকারই প্রয়াত কালিদাস দত্ত ছিলেন সুন্দরবন অঞ্চলের ইতিহাসের গবেষণায় অগ্রণী। তাঁর নিজের বিরাট সংগ্রহ দিয়ে গেছেন কলকাতার আশুতোষ মিউজিয়ামে। এই ছোট্ট সংগ্রহশালাটি আশা করা যায় এই আঞ্চলিক সংস্কৃতির ইতিহাস রক্ষার ও গবেষণার গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহ্য বজায় রাখবে। স্পষ্টতই এই চেষ্টা আমাদের সকলের সাহায্যের দাবী রাখে। বড়ুরই প্রাচীন জমিদার, বোসের বাড়ির শ্যামসুন্দর মন্দিরের দেওয়ালচিত্রের কিছু ফটো এখানে সযত্নে রাখা আছে। আমি তুলেছিলুম কয়েক বছর আগে। দেড়শো বছরেরও পুরোনো আর পশ্চিমবঙ্গে অপেক্ষাকৃত বিরল এই শিল্পের নিদর্শন বলতে শুধুমাত্র কয়েকটি ফটোই অবশিষ্ট আছে জেনে কষ্ট হয়। কেননা, এবারে জানলুম যে মন্দিরের সেই দেওয়ালচিত্র বলতে গেলে প্রায় সবই সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে গেছে।
লৌকিক দেবতার বিষয়ে আরও জানতে ইচ্ছুক হলে নীচের বইগুলি ও এতে দেওয়া অন্য গ্রন্থগুলি পড়ে দেখতে পারেন:
১) গোপেন্দ্রকৃষ্ণ বসু: “বাংলার লৌকিক দেবতা” ২য় সং: ১৯৮৭ (দে’জ পাব্লিশিং)
২) আশুতোষ ভট্টাচার্য্য: “ফোক্লোর অফ্ বেঙ্গল”: ১৯৭৮ (ন্যাশানাল বুক ট্রাস্ট)
৩) প্রসিতকুমার রায়চৌধুরী: “আদি গঙ্গার তীরে”: ১৯৮৮ (মিত্র ও ঘোষ পাবলিশার্স)