• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ১ | জুন ১৯৯৭ | মজলিশ
    Share
  • দ্বারে দ্বারে দ্রুম : রঞ্জন ঘোষাল


    ভেনেজুয়েলার কারাকাস শহরের নগরপাল আইন জারি করেছেন, যে প্রতিটি বাড়ির, তা গেরস্তবাড়ি, অফিসবাড়ি, ফ্ল্যাট বাড়ি, যাই হোক না কেন- সামনে অন্তত: দুটি পাম্‌, য়ুক্যালিপটাস বা তজ্জাতীয় নয়নশোভন সমুন্নত বৃক্ষরোপণ আবশ্যিক, এবং তা লালনপালনও করতে হবে বাড়ির মালিককে। কারাকাস পুনরায় সবুজশোভিত হয়ে উঠুক, বিলক্ষণ এই তাঁর প্রয়াস।

    ব্যাঙ্গালোর শহরের পুরপিতা এই বিবরণী জ্ঞাপন করে জলের গ্লাসে একটি বিনীত চুমুক মারলেন। তারপর আমাদের উপহার দিলেন একটি নিরুপম ক্ষমাহাস্য।

    - আমাদের শহরে আমরা নাগরিকদের নির্দেশ দিয়েছি অবাঞ্ছিত, বৃদ্ধ, নিষ্কর্মা গাছগুলিকে কেটে মুড়য়ে উৎপাট করে দিতে। শহরে গত দুই দশকে গাছের সংখ্যা ভয়ংকর-ভাবে বেড়ে গেছে। প্রতিটি রাস্তাই যখন অমুক বীথি, কি তমুক আভিন্যু- বীথিকিচ্ছিরি ব্যাপার একখানা। হ্যালোজেনের স্ট্রীট লাইট জ্বালিয়েও কোনো রাস্তাকে উজালা করা সম্ভব হচ্ছে না। ফলে রাহাজানি- বৃত্তি- ধারী ও ছেনতাইশিল্পীদের উৎসাহ বাড়ছে। আবার ওদিকে ধরুন, বেশি গাছপালায় শ্বাসরুগীদেরও কষ্ট। উদ্ভিদ্‌ উৎকৃষ্ট ক্লোরোফিলের ভয়ংকর বায়ো- কণা বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে। এ-সবের ফলাফল ভেবে দেখেছেন?

    সত্যি-ই আমরা তলিয়ে ভেবে দেখি নি। ঠিক- ই তো। এতো সবুজের সমারোহ দিয়ে হবে টা কী? বৃক্ষরোপণ আর সবুজায়ন ক’রে ক’রে একটা শহর গত দশবছরে কি রকমভাবে হেদিয়ে গেছে, নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন। ব্যাঙ্গালোর শহরের বৈশিষ্ট্য-ই ছিলো, ঝাঁকে-ঝাঁকে, পালে- পালে সাজানো হৃদয়হারা মনোলোভা কতো না সব বাংলোবাড়ি। আর এখন দেখুন, সব বাড়ির পোর্টিকো বলুন, সামনের ফেন্সিং বলুন, ঝুপসি গাছে গাছে একেবারে ঢাকা পড়ে গেছে। আর গাছ তো নয়, দ্রুমরাক্ষস যেন একেকটি। পুঁততে না পুঁততে মহীরুহ।

    পুরপিতা বলছিলেন- মুড়িয়ে দিন মশাই, মুড়িয়ে দিন। উদ্যান শহর- ব’লে একসময় নাম ছিল ব্যাঙ্গালোরের। এখন কি দাঁড়িয়েছে দেখুন! স্রেফ জঙ্গল- অ্যাামাজনিয়ান জঙ্গল। রাস্তায় গাড়িচাপা পড়ে নয়, একদিন বন্য জানয়ারের পেটে গিয়েই ভবলীলা সারতে হবে আমাদের। তারপর একটু পরিসংখ্যান ও দিলেন। - শহরে সাবালক বৃক্ষ সাড়ে পনেরো মিলিয়ন, মানে এক এক কোটি পঞ্চান্ন লক্ষ। তারা ফী-বছর মাটি থেকে শুষছে ষাট কোটি গ্যালন জল। ফলে ভূ, নিম্নস্থ জলের লেভেল নেমে যাচ্ছে প্রতি পাঁচ বছরে সতেরো ফুট করে। গ্রীষ্মকালে শহরের জলকষ্টের অথা সবাই জানেন। ক্ষীণাক্ষী কাবেরীর জল বয়ে এনে তো তামাম শহরবাসীর নাওয়া-খাওয়ার প্রয়োজন মেটানো যায় না! তা সুধী নাগরিকেরাই বলুন, নলকূপ খুঁড়তে খুঁড়তে একদিন এদিককার পাইপ পৃথিবী ওফোঁড় করে অ্যামেরিকা পৌঁছে যাবে অথচ আমাদের জলের কলসী ঠন্‌ঠন্‌ করে কাষ্ঠহাসি হাসবে, সেইটে আপনারা চান, নাকি বিদেয় করবেন এই সব কাষ্ঠরসিক তরুবরেদের? -

    সভাস্থ সকলে নড়েচড়ে বসলেন। সমস্যাটা মামুলি মনে হচ্ছিল প্রথমটায়। এখন দেখা যাচ্ছে এর মূল অনেক গভীরে। কেউ কেউ বললেন যে শহরটা নবীন হলেও এখানকার বৃক্ষদোষটা তো অনেক প্রাচীন। জনমানসে তাদের একটা স্থান ও ভূমিকা তৈরি হয়ে আছে। তাবৎ গাছ কেটে লোপাট করে দেওয়ার ব্যাপারটা আমরা র‍্যাশনালি মেনে নিতে পারলেও ইমোশনালি অ্যাকসেপ্ট করে নিতে অসুবিধে হতে পারে। অনেকে ইকলজির প্রশ্নও তুললেন। তাতে একজন পুরপ্রধান বললেন- রেখে দিন মশাই ইকলজি। ইকলজি করতে হয় শহরের বাইরে গিয়ে করুন। লাউ- কুমড়োর মত বাঘ-সিঙ্গির চাষ করুন, কলকারখানার চাক্কা জ্যাম করে দিন, বন-মহোৎসব করুন। যা- ইচ্ছে- তাই করুন, কিন্তু আরে বাবা, শহরের মানুষেরাও তো কষ্টের জীব, না কী? তাদের একটু হাত-পা ছড়িয়ে, আলোয়-হাওয়ায়, তেলে- জলে বাঁচতে হবে না?

    কর্মব্যপদেশে ব্যাঙ্গালোরের বাসিন্দে হলেও আমরা কেউ কেউ যারা কলকাতা- বাঁকুড়ার লোক, তারা গৃহপালিত গাছ সম্পর্কে হয়তো একটু বেশিমাত্রায় সংবেদনশীল। অনিকেত দাস- মজুমদারের বাড়ি আবার হাবড়ায়। বেশ পুকুর বাগান নিয়ে সাবেকি বাড়ি। ছোটবেলায় সে মাদার গাছে দোলনা বেঁধে ঝুলেছে। পাকা গান, কাঁচা করমচার স্বাদ জানে। হেনা, শিউলি, আমমুকুলের গন্ধে মানুষ- ও গলাটা খাঁকরে নিয়ে বললো- স্যার, ইয়ে করা যায় না? ধরুন ফলন্ত ফুলন্ত গাছেদের যদি এই কেটে- লোপাট- স্কীম থেকে এক্‌সক্লুড করা যায়-

    পুরসচিব বললেন- হ্যা, হ্যান,সে তো একশোবার। সেইজন্যেই তো, শহরের যে দুটি প্রধান ফুস্‌ফুস্‌- লালবাগ আর কাশবনপার্ক- সেখানে সব থাকছে। ফল থাকছে, ফুল থাকছে, কাগ থাকছে, কোকিল থাকছে, সাপ, ব্যাঙ, কাঁকড়াবিছে, ডেঁয়ো পিঁপড়ে- সব মিলে একটা সাংবচ্ছরিক মোচ্ছব তো লেগে থাকবেই। সেখানে মাঝে মাঝে ফ্লাওয়ার শো, অতিকায় কুমড়ো, কাঁঠাল, কাঁকুড়ের প্রদর্শনী- এ- সব- ও হোক। আর আপনারা নাগরিকেরা যদি চান- ফাইবার-গ্লাসের কল্যাণে আজকাল কতো কীই না হচ্ছে- বেশ এমন আর্টিফিশিয়াল লাইফ-সাইজ গাছপালা দিয়ে একটা স্কাই- লাইন যে বানানো যায় না এমন নয়। তারপরে ধরুন….

    একজন উদ্বিগ্ন হয়ে জিগ্যেস করলেন- আচ্ছা, আমরা যারা টবে গাছ- ফাচ করছি, বনসাই- টনসাই?

    পুরপিতা সোৎসাহে বললেন- হ্যাঁ, ওগুলো রেখে দিন। বেঁটে বেঁটে করে রাখুন- ছোটোছোটো করে। বেশি বাড়তে দেবেন না, বুঝলেন? গোড়ার দিকের ওই বৃদ্ধিমূল না কি বলে, ওটাকে কেটে ফেলে তারপর আগায় জল ঢালতে থাকুন বারোমাস।




    অলংকরণ (Artwork) : খ, ম, মনিরুজ্জামান
  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments