• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ১ | জুন ১৯৯৭ | প্রবন্ধ
    Share
  • মাগুরা থেকে মানিকগঞ্জ : খ, ম, মনিরুজ্জমান

    সম্প্রতি বাংলাদেশের পার্লামেন্ট জাতীয় সংসদের একটি উপনির্বাচন হয়ে গেল মানিকগঞ্জে। বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিএনপিদলীয় সংসদ সদস্যের মৃত্যুতে এই উপনির্বাচনের প্রয়োজন হয়। বিএনপি মনোনীত প্রার্থী উপনির্বাচনে জয়ী হয়েছেন।

    ৩৩০ সদস্যের সংসদে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের স্বস্তিপ্রদ সংখ্যাগরিষ্ঠতা আছে। একটি আসনের নির্বাচনের ফলাফল সংসদের ব্যালান্স অফ পাওয়ার কে তাৎপর্যপূর্ণভাবে প্রভাবিত করতে পারার কোন সম্ভাবনা ছিল না।

    তা সত্ত্বেও পর্যবেক্ষক মহল গভীর উৎকন্ঠা ও আগ্রহ নিয়ে এই নির্বাচনের দিকে নজর রেখেছিলেন। বাংলাদেশের রাজনৈতিক গতিপ্রকৃতির উপর এই নির্বাচনের প্রভাব সম্পর্কে কোন সন্দেহ ছিল না। কেন, তা বাংলাদেশের নির্বাচনের নিকট ইতিহাস পর্যালোচনা করলেই বোঝা যাবে।

    বাংলাদেশে নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হবার নিদর্শন খুব বেশি নেই। এমনকি সামরিক একনায়কতন্ত্রের আমলে যে প্রতিপক্ষহীন ‘হ্যাঁ- না’ গণভোট বা রেফারেন্ডাম হয়েছিল তাতেও পাইকারিভাবে জাল ভোট প্রদানের অভিযোগ উঠেছিল। প্রথম এওটি মোটামুটি নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ১৯৯১তে, গণ-আন্দোলন জেনারেল এরশাদের শাসনের অবসানের পর। সে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল এরশাদ সরকারের উত্তরসূরী একটি নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে। বিএনপি সে যাত্রায় সব চেয়ে বেশি আসনে জয়ী হয় এবং জামাতে ইসলামির প্রাথমিক সহায়তায় খালেদা জিয়া সরকার গঠন করেন।

    দেশ-বিদেশের পর্যবেক্ষক, সংবাদ মাধ্যম এবং সর্বোপরী ভোটপ্রদানকারী জনগণের দৃষ্টিতে এই নির্বাচন অভূতপূর্ব রকমের অনিয়মযুক্ত ছিল। কেবল শেখ হাসিনা, বিজিত আওয়ামী লীগের নেতা, তাঁর অতি তীব্র দৃষ্টিশক্তি দিয়ে সে নির্বাচনে “সূক্ষ্ম কারচুপি” আবিষ্কার করেছিলেন। তাঁর অভিযোগ সেদিন অনেকের কাছেই অতি স্থূল মনে হয়েছিল।

    ১৯৯১-এর নির্বাচনের আগেই কোন কোন মহল থেকে প্রস্তাব ও দাবী উঠেছিল পরবর্তী একটি দীর্ঘ সময়ের জন্য নির্বাচন নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে করার বিধান প্রস্তুতের জন্য। দুই বড় দল তখন ক্ষমতায় যাবার স্বপ্নে বিভোর থাকায় সেই প্রস্তাবকে গুরুত্ব দেয়নি।

    বিরোধী দলের আসনে বসে আওয়ামী লীগের টনক নড়ে এবং তাঁরা পরবর্তী নির্বাচন নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে করার দাবী তোলেন। স্বভাবতই বিএনপি সে দাবীর বিরোধিতা করে। প্রাথমিক ভাবে আওয়ামী লীগের দাবীর প্রতি তেমন জন সমর্থন বা সহানুভূতি দৃষ্টিগোচর হয় নি। বিএনপির ক্ষমতাকালে চারটি মেট্রোপলিটন নগরের মেয়র নির্বাচনে বিরোধী দলীয় (আওয়ামী লীগ) প্রার্থীরা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দুটি নগর ঢাকা ও চট্টগ্রামের মেয়র পদে বিজয় লাভ করেন। এখানে উল্লেখযোগ্য যে ১৯৯১-এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগ প্রার্থীরা রাজধানী ঢাকার একটি আসনেও নির্বাচিত হননি।

    জনমত অনুযায়ী মেয়র নির্বাচন কারচুপি বিহীন ছিল এবং বাংলাদেশের মত দেশেও দলীয় সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন হতে পারে এরকম একটি প্রতীতি জন্ম নিচ্ছিল। তবে খোদ ক্ষমতাসীন দলের মধ্যে বোধ হয় নির্বাচনের ফলাফল অস্বস্তিদায়ক ছিল।

    এর পরে মাগুরার একটি নির্বাচনী এলাকার আওয়ামী লীদ দলীয় সাংসদের মৃত্যুজনিত কারণে উপনির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। দীর্ঘদিনের আওয়ামী আধিপত্যের অবসান ঘটিয়ে এ আসনে এবার নির্বাচিত হলেন ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থী। বাংলাদেশের বেসরকারি সংবাদ মাধ্যমগুলিতে উপনির্বাচনে ব্যপক অনিয়ম ও কারচুপির খবর প্রকাশিত হয়। আওয়ামী লীগ তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে এবং নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে পরবর্তী নির্বাচন সমূহ অনুষ্ঠানের বিধানের জন্য আন্দোলন জোরদার করে। জন সহানুভূতি এবার অনেক অনুকূলে চলে আসে।

    মাগুরার এই ত্রুটিপূর্ণ নির্বাচন বিএনপির কাল হয়ে দাঁড়ায়। এককালের সহযোগী জামাতসহ বিরোধী দল সমূহের যুগপৎ আন্দোলন প্রচন্ড গতি লাভ করে। বিরোধী দলগুলির বয়কটের মুখে বিএনপি একটি এক দলীয় নির্বাচনী প্রহসনের মাধ্যমে ক্ষমতায় দ্বিতীয় দফা অনুষ্ঠিত থাকার চেষ্টা চালায়।

    তবে শেষ পর্যন্ত আন্দোলনের মুখে সরকার বাধ্য হয় মাথা নোয়াতে, এবং বাংলাদেশের ইতিহাসে দ্বিতীয় বারের মত একটি নিরপেক্ষ নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। প্রথম্বারের মত এবারের নির্বাচনও দেশী-বিদেশী পর্যবেক্ষকদের প্রশংসাধন্য হয়। এবার বিজয়ী হয় শেখ হাসিনার আওয়ামী লিগ। আগের বারের মত এবারও বিজিত দলের নেতা নির্বাচনে কারচুপি আবিষ্কার করলেন। নির্বাচনের অব্যবহতি পরের উপনির্বাচনগুলো বিএনপি বর্জন করে।

    নতুন সরকারের এযাবৎ এক বছরের শাসনকালে বিএনপি সরকার হঠানোর আন্দোলনের পাঁয়তাড়া চালিয়ে আসছে, তবে জন সমর্থন অনুকূল নয়। বিএনপি বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে পরীক্ষা চালিয়ে যাচ্ছে, যদি কোন একতা জনগণের মর্মে স্থান পায় সেই আশায়।

    মানিকগঞ্জের উপনির্বাচনের গুরুত্ব এই প্রেক্ষিতে বিচার করতে হবে। নির্বাচনী এলাকাটি বিএনপির শক্ত ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত (যেমন মাগুরা ছিল আওয়ামী লিগের ঘাঁটি)। সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থে বিএনপির এক গুচ্ছ দাবী নির্বাচন কমিশন মেনে নেওয়ার পর বিএনপি উপনির্বাচনে অংশ নিতে সম্মত হয়। শাসক দল ক্ষমতার অপব্যবহার করে নির্বাচনের ফলাফল প্রভাবিত করার লোভ সম্বরণ করতে না পারলে মাগুরা নির্বাচনের পরবর্তী আরেক দফা অস্থিতিশীলতায় আক্রান্ত হতে পারতো বাংলাদেশ। সংবাদপত্রের ভাষ্য অনুযায়ী নির্বাচন যে শুধু নীতিসিদ্ধ ভাবে হয়েছে তাই নয়, যথেষ্ট শান্তিপূর্ণ ভাবেও অয়েছে। নির্বাচনকালীন গোলযোগ-দাঙ্গার কোন খবর পাওয়া যায়নি, যদিও বাংলাদেশের নির্বাচনে তা নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপার। নির্বাচনের পরে অবশ্য পরাজিত আওয়ামী লীগ প্রার্থী সমর্থকরা কিছু বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে বলে জানা যায়।

    বিএনপিকে অভিনন্দন নির্বাচনে অংশ নিয়ে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক রাজনীতির ক্ষেত্রে অবদান রাখার জন্য, এবং নির্বাচনে বিজয় লাভের জন্য। সরকারকে অভিনন্দন নির্বাচনকে সুষ্ঠু ভাবে সম্পন্ন হতে দেবার জন্য। সর্বোপরি মানিকগঞ্জের জনতাকে অভিনন্দন নির্বাচনের দু মাস আগে পর্যন্ত যে লোকটি প্রাক্তন স্বৈরশাসক এরশাদের ঘনিষ্ঠ সহযোগী ছিল, সেই কর্ণেল [Col.] মালেককে নির্বাচিত না করার জন্য। এই দলবদলকারী সুবিধাবাদী লোকটিকে দল স্থান দিয়ে নির্বাচনে মনোনয়ন দেবার জন্য আওয়ামী লিগ যেমন ধিক্কার পাবার যোগ্য, তাকে নির্বাচিত না করার জন্য মানিকগঞ্জের ভোটারবৃন্দ তেমনি প্রশংসার দাবীদার।
  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments