তার যথেষ্ঠ কারণও আছে—যেখানে গজু সেখানে যে শ্রীপতিও থাকবে তা চোখ বন্ধ করেও বলে দেওয়া যায়। এক কথায় গজু যদি পিঠে হয় শ্রীপতি পায়েস, শ্রীপতি কড়াইশুঁটির কচুরি তো গজু ছোট ছোট গুলিআলুর দম, গজু ফিশ ফ্রাই তো শ্রীপতি হট এন সুইট টমেটো সস—এক বিনে অন্যকে মানায় না।
সেই ছবিটাই সবাই মেনে নিয়েছিল। স্কুলে গজু কোনো নিয়ম ভাঙলে (যেমন স্কুলের কম্পাউন্ড লাগোয়া মাধববাবুর আম বাগানে ঢিল মেরে আম পাড়া ছিল গজুর বাঁধা ধরা) নালিশ কানে এলে হেডু গজুর সাথে শ্রীপতিকেও কান ধরে ওঠবোস করার হুকুম দিতেন। কোনো রকমের কাঁইমাই, ‘আমি না স্যার’-এ কানই দিতেন না। মুখ তুলে দেখতেনও না টেবিলের ওদিকে কে আছে—গজু না শ্রীপতি। বাড়ি থেকে পালিয়ে ভোটের মিছিলে ভিড়ে যাওয়া শ্রীপতির ফেবারিট সময় কাটানোর মধ্যে পড়ত, শেষ পর্যায় যে জিলিপি-শিঙাড়া মিলত। অনেক বার বাড়ি ফিরতে দেরি হলে শ্রীপতির বদলে গজুকেই ওদের দুজনের বাবা-মা শাস্তি হিসাবে বারান্দার গ্রিল মোছার কাজে নারাণের সাথে লাগিয়ে দিতেন। বাড়ির সামনে দিয়ে যাতায়াত করা পাড়াতুতো কাকু-জেঠুরা মুখ টিপে হেসে আন্দাজ করে নিতেন গজু শাস্তিতে প্রক্সি দিচ্ছে। এহেন সার্বজনীন হেনস্থার পরও দেখা গেছে সন্ধ্যে হ’ব-হ’বর মুখে গা ঢাকা দিয়ে শ্রীপতি গজুর হাত ধরে টেনে নিয়ে মিছিলে পাওয়া লুচি আলুর দম বোঁদে ভাগ করে খাচ্ছে, পার্কের বেঞ্চিতে লুকিয়ে বসে।
সেই চিরাচরিত ছবিটাতে হঠাৎ একটা বড় চিড় ধরে গেল যেন। ২০২০র করোনা আবর্ত সব কিছুর সাথে গজু-শ্রীপতির এমন সম্পর্কটাকেও টেনে নিল চুম্বকের মত। অন লাইন ক্লাস শুরু হল। এক সাথে স্কুল যাওয়া বন্ধ, ওদের মুখ শুকোল। পার্কে মাস্ক পরে যাওয়া—ধ্যুত! তাতে আর কিসের সুখ। যত না খেলা তার বেশি হাত ধোও, পা ধোও, জামা প্যান্ট পাল্টাও। শনি রোববার এ-ওর বাড়িতে একটু ক্যারাম খেলা—ওইটুকুই। তাও চলছিল। কিন্তু গৌতম কাবেরী প্রমাদ গুনল যেদিন খুব ছোট্ট একটা কারণে গজু শ্রীপতির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে ওর টি শার্ট খামচে ঠায় দাঁড়িয়ে রইল। শ্রীপতি এলোপাথাড়ি কিল চড় চালিয়ে ফেললে। তারপর রাতে বাবা মায়েরা শুনলেন যে যার ঘরে সে কি ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্না! তবু পরদিন মুখ দেখাদেখি বন্ধ। গজু বারান্দা দিয়ে উঁকি মারে শ্রীপতিদের ফ্ল্যাটের দিকে কিন্তু বন্ধু বেরোলেই পুট করে পর্দার আড়ালে চলে যায়। বাবা মায়েরা অনেক বোঝাবার চেষ্টা করে শেষে প্রায় হাল ছাড়তে বসলেন—দুজনেই যে পাথরের মত অনড়!
একি চলতে দেওয়া যায়? গৌতম সাইকিয়াট্রিস্ট—রোজই তো হাজার ডিপ্রেসনে ভোগা রুগী ওঁর কাছে অসহায় হয়ে ছুটে আসে, কখনো একা, কখনো বাড়ির কারো সাথে। এবার সমস্যা নিজেদের দোরগোড়ায় উপস্থিত দেখে বাবা মায়েরা অস্থির হয়ে উঠল। সমস্যা তো বেশ বোঝাই যাচ্ছে। অত্যধিক নিয়মের বাঁধনে পড়া দুটি প্রাণের বিদ্রোহ। কিন্তু সমাধান?—ওষুধ তো নয়ই কাউন্সেলিংও এত ছোট বয়সে নয়—তাহলে?
এগিয়ে এলেন সেই স্নেহে ভরা শ্রীপতির ঠাম্মা, যাকে দুবেলা সবাই বলে ‘আপনিই তো আদর দিয়ে নাতিকে বাঁদর করেছেন—-’ আর সুবর্ণ মিটিমিটি হেসে বলে গেছেন, ‘তোমাদের হিংসা হচ্ছে বুঝি? সেই জন্যই তো বাড়িময় হিং এর গন্ধ পাচ্ছি—’ অগত্যা গৌতম কাবেরী সেখান থেকে পালিয়ে নিস্তার পেয়েছে।
গজু শ্রীপতির ঝগড়া ঝাঁটির পর ওরা দুজনেই যেন আরও শুকিয়ে গিয়েছিল। কোথায় সেই দুড়দাড় করে সিঁড়ি ভেঙে ছাদে গিয়ে ঘুড়ি লাটাইয়ের কমপিটিশন, গলা ফাটিয়ে ‘ভোঁ কাট্টা’ চিৎকার—সুবর্ণও আড়ালে নিঃশ্বাস ফেলেন, আর ভাবেন সমস্যার সমাধানটা কোথায়।
এই অবস্থার মাঝে সেদিন সকালে যখন সুবর্ণ রান্নাঘরে ইডলির তদারকি করছিলেন, শ্রীপতি রান্নাঘরে এসে ঠাম্মার ইডলি তৈরি দেখতে লাগল। হয়তো গজুর সাথে ঝগড়া হয়ে ফাঁকা ফাঁকা লাগছিল তাই। (শ্রীপতির দাদু স্নেহময় বহু বছর চেন্নাইতে থাকার দরুন সুবর্ণ ইডলি-ধোসা বেশ ভাল রপ্ত করেছিলেন। রান্নামাসি শিখে ফেললেও উনি সাম্বার নারিয়েল চাটনি তৈরির সময় দাঁড়িয়ে থাকতে ভালবাসতেন পূর্ণিমার পাশে। কতটা টক, কতটা ঝাল, মশলা দিলে ঠিক হবে প্রতিবারই বুঝিয়ে দিতেন।) নাতিকে দেখে চট করে কিছু ভেবে নিয়ে সুবর্ণ ওর মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, ‘পতু, আমি নারিয়েল চাটনিতে ছোঁক দিচ্ছি, তুই অল্প করে সাদা তেল ইডলি স্ট্যান্ডের খোপগুলোতে লাগা তো—’ শ্রীপতি ভারি অবাক হল—কিছুদিন আগেই তো ওমলেট ভাজতে এসে শুনতে হয়েছে ‘এই দ্যাখো, এক্ষুনি সব ফেলে ছড়িয়ে একাকার করবে, যা পারিস না তা করতে আসিস কেন বল তো?’ তবু ঠাম্মার কথামত হাত ধুয়ে (করোনার দয়ায় হাত ধোওয়া তো মজ্জাগত হয়ে গেছে) সাদা তেল অল্প করে নিয়ে ইডলি স্ট্যান্ডের খোপে খোপে মাখাতে লাগল। তারপর সুবর্ণ বড় হাতা করে ইডলি গোলা একটা খোপে দিয়ে বাকিগুলো ওকে ভরতে বললেন। এ তো একেবারে নতুন কথা পতুর কাছে। আগে আগে তো রান্নাঘরে ঢুকলেই সবাই বলত ‘যা যা গরমে আসিস না।’ তবু মন্দ না লাগতেও পারে এই ভেবে ও হাতায় করে ইডলি গোলা দিতে লাগল। ঠাম্মা কুকারে জল আর গ্রিড দিলেন। গ্যাস আভেন-এর আঁচ উঁচুতে রেখে কুকার বসালেন, ওয়েট দিলেন না। শ্রীপতি দেখেছে ভাত হতে কুকারে ওয়েট দিতেই হয় তাই ও বললে, ‘ওয়েট দিতে যে ভুলে গেলে?’
সুবর্ণ হেসে বললেন, ‘কেন দিলাম না জানিস? ওয়েট দিলে ভাপ বেরোবে না আর ইডলিও ফুলবে না।’
শ্রীপতির হঠাৎ যেন বেশ ভাল লাগতে লাগল। ও দেখল একটু পরে জোরে হিস হিস করে কুকার থেকে স্টিম উঠতে লাগল। ঠাম্মা তিন মিনিট মোবাইলে দেখে গ্যাস বন্ধ করলেন। আরও এক মিনিট পরে কুকারের ঢাকা খুলতেই তুলোর মত সাদা ইডলি উঁকি দিল। সাবধানে স্ট্যান্ড কুকার থেকে বার করে ছুরি দিয়ে ঘুরিয়ে গোল গোল ইডলি তুলে ক্যাসারলে ভরলেন সুবর্ণ। তারপর আর কি, নারিয়েল চাটনি দিয়ে ‘গরম গরম সাম্বার মে ডুবে ইডলি’র সদ্ব্যবহার।
অনেকদিন পর শ্রীপতির মনটা যেন হাল্কা হাওয়াতে দুলে উঠল। ইডলি বরাবরই ওর খুব প্রিয়, কিন্তু সেটা বানানোটা যে এত সহজ, এত সুন্দর কে জানত!
নিজেদের দোতলার বারান্দাটা যেন শ্রীপতির পৃথিবীর সেরা বলে মনে হয়। ড্রয়িং কাম ডাইনিং হল থেকে সোজা আনমনে বারান্দায় চলে আসা যায়, বিশাল ওয়াল টু ওয়াল সিলিং ছোঁওয়া তিন ভাগের দরজা দিয়ে, হোঁচট খাওয়ানো চৌকাঠের বালাই নেই। সেদিনও পতু ইডলি সাম্বার সাজানো ছোট খোপ থালা (ঠাম্মা মনে করেন যে খাবার যাতে মানায় তাতেই খেয়ে মজা) নিয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়াল, ইচ্ছে গজু বেরোলেই ভাবের সাদা ফ্ল্যাগ উড়িয়ে হাত নেড়ে দেবে। বন্ধুকে দেখেই আর সুযোগ না হারিয়ে চেঁচিয়ে ডাক দিলে ‘ইডলি খাবি তো চলে আয়।’
তক্কে তক্কে গজুও উঁকি মারছিল, শ্রীপতির হাত নাড়া দেখে মুচকি হেসে বলল ‘দাঁড়া, এক্ষুনি আসছি!’
আড়ালে থাকা সুবর্ণও খানিকটা হাঁপ ছাড়লেন।
পুনর্মিলন তো হল কিন্তু উদাসীনতা যেন আর কাটতে চায় না। ক্যারাম লুডো, মোবাইলে প্লে স্টোর খুলে গেম খেলা-–সবই যেন পানসে ঠেকছে। কমপিউটরের সামনে বসে কখনো তোতার মত আউড়িয়ে যাওয়া ‘এ বিম অফ লাইট শট ফ্রম দ্য টপ অফ আ কার উইল ট্রাভেল ইন আ স্ট্রেট লাইন বাট আ স্পার্ক ফ্রম আ পিস্টল শট ফ্রম আ কার টপ উইল ট্রাভেল ইন আ প্যারাবলিক কার্ভ ডিউ টু দ্য গ্র্যাভিটেশনল ফোর্স’, বা মহম্মদ ঘোরির ওপর রচনা লেখা—তাতে জ্ঞান নাহয় বাড়ল কিন্তু ক্লাসে ম্যাম একটু চোখের আড়াল হলেই কাগজের প্লেন ছোঁড়াছুঁড়ি, সেই-ই বা কবে ফিরবে?
দুই বন্ধুর ভাব হওয়ার কদিন পরের কথা—সুবর্ণ চারটের দিকে ব্লাউজে বোতাম বসাতে বসাতে ‘গোপাল ভাঁড়’ সিরিয়ালটা দেখতে দেখতে মিটিমিটি হাসছিলেন। পতু এসে ধপাস করে শুলো ঠাম্মার কোলে মাথা রেখে। উনি খানিক ‘করিস কি, করিস কি, ছুঁচ ফুটে যাবে যে’ বলে সেলাইঝাঁপি সরিয়ে রেখে নাতির মাথায় বিলি কেটে দিতে লাগলেন। সিরিয়ালের ফাঁকে তো কত অ্যাড থাকে। একটাতে পতু আর ওর ঠাম্মার চোখ আটকাল। ফেসবুকের অ্যাড-- ‘দিল খোলকে তো দেখো দুনিয়া তুমহারে সাথ হ্যায়।’ এটাতেই কখনো দেখায় বুড়ি দিম্মা পাঁপড়ের ব্যবসা করছেন, কখনো পুরনো বই দিয়ে ভ্রাম্যমাণ লাইব্রেরি হচ্ছে আরও কত কি। মোদ্দা কথা ফেসবুক মাধ্যমে অনেকের পরামর্শে অনেক সুরাহার পথ খুলে যাচ্ছে। পতুর বাবা মা, ঠাম্মা ফেসবুককে বিশেষ গুরুত্ব দেন না। কিন্তু হঠাৎই যেন পতু আর সুবর্ণ সজাগ হয়ে উঠল। দুজনেই সোজা হয়ে উঠে বসে ‘আমরাও তো কিছু করতে পারি—' বলেই দুজনে দুজনের ডান হাত মিলিয়ে তালি বাজিয়ে নিলে। পতু বললে, ‘আচ্ছা ঠাম্মা অন লাইনে অর্ডার নিয়ে একটা ছোট মাপের ইডলি সাপ্লাইয়ের ব্যবসা করলে কেমন হয়? পড়ার ফাঁকে ফাঁকে আমরাও তো এটা করতে পারি!’
সদা উৎসাহী চিরনবীনা ঠাম্মা সংগে সংগে বলে উঠলেন, ‘পারিই তো। তুই বোধহয় জানিস না মুম্বাইয়ে তোদের মত বা তোদের থেকে কিছু বড় এক ছেলে কেমন ভাবে ডাব্বাওয়ালাদের মারফত ক্যুরিয়ার সার্ভিস গড়ে তুলেছিল যা পরে পরে বিশাল এক ব্যবসা হয়ে দাঁড়ায়।’ পতু তিড়িং করে সোজা উঠে কাগজ পেন্সিল নিয়ে বসে গেল। মা-বাপি কেউ বাড়ি নেই, এই সুযোগ, নইলে তো সবেতে ঠান্ডা জল পড়ে যাবে। ঠাম্মা বললেন ‘দ্যাখ পতু, একদিনে বড় ব্যবসার কথা ভাববি না। কাস্টমর খুশি হলে আপনিই অর্ডারের সংখ্যা বাড়তে থাকবে।’
পতু চট করে বলে উঠল, ‘গজুটা কম্পিউটর ভাল বোঝে, ওকেই তাহলে বলি ফেসবুকে একটা একাউন্ট খুলে আমাদের প্রস্তাবটা সকলের কাছে রাখতে। গজুদের নীচের ফ্ল্যাটের অমিকাকু সফটওয়ের ইঞ্জিনীয়র, এ ব্যাপারে ওকে ভাল বুদ্ধি দিতে পারবেন। তুমি কী বলো ঠাম্মা? গজুর ওপর আর রাগ পুষে কিই বা করব?’
সুব র্ণ মুখ ফিরিয়ে ফিক করে হেসে সাথে সাথে বললেন, ‘তাই তো তাই তো, ভাব তো তোদের হয়েই আছে, বাকি যা দুঃখ একেবারে ধুয়ে ফ্যাল।’
সেটা ছিল ২০২১-এর গোড়ার কথা—-ভ্যাক্সিন আসব আসব করছে, স্কুলগুলো খুলবে কিনা তারও কিছু ঠিক নেই। স্থির হল পয়লা বৈশাখকেই টার্গেট করে অনলাইন অর্ডার নেওয়া শুরু হবে।
ঠাম্মা বললেন, ‘পতু, আগে চাল ডালের মাপটা জেনে নিতে হবে—-আমি এক কাপ চালের সাথে আধ কাপ গোটা বিউলির ডাল দিই, আর ভিজোবার আগে দশ-বারোটা মেথিদানা ফেলে দিই তাতে। চেন্নাইয়ের মিসেস আন্নামা বলেছিলেন তাতে শরীর ঠান্ডা হয়—’ পতু মন দিয়ে শুনছিল, বলে উঠল, ‘বেটে সোজাসুজি ইডলি করা যাবে?’ সুবর্ণ হেসে বললেন, ‘না রে বাবা, সকালে যদি চাল ডাল ধুয়ে ভিজতে দিই (জলটা চাল ডালের এক ইঞ্চি ওপর থাকলেই হবে) তবে বিকেলে বেটে রাতভর তাকে ফুলতে দিতে হবে। এইটাই একটু ভাবায়, বেশি ফুলতে দিলে টক হয়ে যায়, আবার একটু ঠান্ডা ভাব থাকলে গোলা ফোলে না; না ফুললে ইডলি হবে না।’
পতুর তো খুব চোখ কান খোলা, ও বললে, ‘বাজারে দেখেছি শিবুকাকুর দোকানে কেক বিস্কুটের সাথে ইডলি ব্যাটারও বিক্রি হচ্ছে। সেটা দিয়ে করলে কেমন হয়?’
ঠাম্মা বললেন ‘তাহলে তো অনেকটা ঝামেলাই থাকে না। কিনে এনে ফ্রিজে রাখা যাবে আর সকাল সকাল বার করে খানিক ফেলে রাখলে গোলা গরম হয়ে ইডলি তৈরি হয়ে যাবে অনায়াসে।’
পতুর যেন আর তর সয় না। বলে উঠল, ‘একটু ব্যাটার কিনে এনে পরীক্ষা করে দেখলে কেমন হয়?’ ‘আমার মনে হয় ভালোই হবে,’ ঠাম্মা জুড়ে দিলেন, ‘আমি যখন আজ বিকেলে পুজোর ধূপ বাতাসা কিনতে যাব কখন টাটকা ব্যাটার আসবে জেনে নেব, তুই সেইমত কিনে আনবি, পারবি তো?’ মাথা নেড়েই ঠাম্মাকে জড়িয়ে ধরে ও বললে, ‘যাই গজুর সাথে আলোচনা করে আসি, বিকেল তো হয়েই এল—’ তারপর একটা মাস্ক পরে বেরিয়ে গেল। পার্কে বসে শ্রীপতি গজুকে সব বুঝিয়ে বলে ফেসবুকে খবরটা পোস্ট করার ভার দিল। খানিক মাথা ঠোকাঠোকির পর অ্যাডটা এইরকম দাঁড়ালোঃ ‘রোজ রোজ ব্রেড কর্নফ্লেক্স খেয়ে আর পারছেন না? প্যানডেমিকে রান্নামাসিও নেই? ফুলকো নরম ইডলির জন্য আমাদের অর্ডার দিন নীচের এই ঠিকানায়—পয়লা বৈশাখ থেকে সাপ্লাই শুরু। আপনার দোরগোড়াতেই আমরা হাজির—।’ একটা ঠিকানাও লিখে দেওয়া হল।
কদিনের মন কষাকষি ভুলে দুটো প্রাণ যেন খুশিতে কলকলিয়ে উঠল। ঠিক হল বাবা-মাদের এখন জানানো হবে না। ওরা তো আগেই বলবে ‘এসবে পড়ার ক্ষতি হবে যে—’
সন্ধ্যের সময় সুবর্ণ চুপি চুপি পতুকে বললেন, ‘বেলা এগারোটার দিকে টাটকা গোলা পাওয়া যাবে, তখন গেলেই হবে।’
পরদিন পতু আড়াইশো গ্রাম ব্যাটার নিয়ে এল কারণ অল্প দিয়েই পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা ভাল। সুবর্ণ ফ্রিজে রেখে দিলেন, ভোর ভোর বার করে আটটার দিকে পতুকে নিয়ে রান্না ঘরে ইডলি স্ট্যান্ডে গোলা দিয়ে দিলেন। মিনিট দুই তিন পর ওমা সত্যি ঘরের ইডলির মতই কি তার থেকেও ভাল ইডলি তৈরি হল। সকলেই একটা করে পেল। গৌতম কাবেরীর বেরোবার তাড়া থাকে, তাও ওরা ‘বাঃ বেশ হয়েছে তো!’ বলে গেল। পতু আর ঠাম্মা চোখে চোখে হাসলে। পূর্ণিমামাসিও ভারি খুশি—খেতে তো বেশ লাগল আর বাটাবাটিরও ঝামেলা নেই। একটা ইডলি গজুর জন্য ছিল, খেয়ে ও তো আত্মহারা।
এরপর প্রায় এক মাস আরও হাত পাকাতে পাকাতে পয়লা বৈশাখও যেন হুস করে এসে গেল। অ্যাডের উত্তরে গোটা চার পাঁচ অর্ডার এল পাড়ার মধ্যে থেকেই। শ্রীপতি আর গজু ঠিক করলে সাইকেলেই পৌঁছে দেওয়া যাবে। অ্যাডে ওরা লিখেই ছিল সল্ট লেকের এফ ডি ব্লক থেকে অর্ডার এলে সাপ্লাই সম্ভব। অন্য ব্লক হলে নারাণদাদার ব্যাটারি রিকশোটা মাঝে মাঝে নেওয়া যাবে।
ঠাম্মা বললেন, ‘করোনার জেরে নতুন জামাকাপড় কেনা, বেড়াতে যাওয়া, রেস্তোরাঁয় খাওয়া; কিছুই তো হচ্ছে না—এই ছোট ব্যবসায় কিছু খরচ করলে তেমন কিছু গায়ে লাগবে না।’ তাই ঠিক হল থার্মোকলের খোপ থালা, প্লাস্টিকের চামচ, কাগজের ন্যাপকিন সব দেওয়া হবে, একেবারে নামী ফুড কোর্টের মত।
পয়লা বৈশাখ শ্রীপতি গজু দুরু দুরু মনে ওদের প্রথম ইডলি সাম্বার দিয়ে এল এফ ডি পার্কের কাছে এক বাড়িতে। বিকেলের মধ্যে ফেসবুকে উত্তর এল, ‘দারুণ হয়েছে, একেবারে বাড়ির মত, আর পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতায় তো দশে দশ—।' ইডলি টিমকে আর পায় কে! ভেবেচিন্তে ঠিক হল অনলাইন দোকানের নাম হবে ‘গজু’স এন’ শ্রীপতি’স’।
এরপর বেশ কমাস কেটে গ্যাছে। একদিন গৌতম ডিনার খেতে খেতে সুবর্ণকে জিগেস করলে, ‘আচ্ছা মা অমলেন্দু বলছিল ‘গজু’স এন শ্রীপ তি’স’ নামে অনলাইন ইডলি সাপ্লাই হচ্ছে, দারুণ স্বাদ, আমাদের দুটোর কাণ্ড নয় তো? তুমি কি কিছু জানো?’
সব শুনে গৌতম কাবেরী খানিক চুপ করে থেকে বললে, ‘মা তুমি আছ, দেখো যেন বাড়াবাড়ি না হয়, এখনও পড়াশোনা অনেক বাকি, ওরা তো এখনও দশই পার হয়নি।’
বাড়াবাড়ি যা হবার তা তো ভালোর জন্যই হল। দুই বন্ধু যেন আরও বাঁধা পড়ল একে অন্যের কাছে। উপার্জনের পথ পেয়ে আত্মবিশ্বাস গেল বেড়ে, ফলে পরীক্ষার খাতায় দেখা গেল ভাল গ্রেড, এল হাত ভরে মাস্টারমশাইদের প্রশংসা।
করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ে আবার দেশ ছটফট করছে। কোথাও আশার আলো নেই তেমন, ভ্যাক্সিন আসা সত্ত্বেও। এখন তো শুধু সিনিয়র সিটিজেন আর পঁয়তাল্লিশদের টিকাকরণ। ডাক্তার আর সাফাইকর্মীরা তার আগে পেয়েছেন। শ্রীপতি গজুর ভ্যাকসিন পেতে এখন অনেক দেরি। কিন্ত ওদের মুখের ঔজ্জ্বল্য এক বিন্দু কমেনি। জোর কদমে ওদের ইডলি ব্যবসা চলছে। রান্না ও প্যাকিংএর সময় সাবধানতায় খামতি নেই—আর পথেঘাটে কখনো বেরোলে সুখ্যাতই সুখ্যাত। যদিও তেমন বেরোনো আর কই হয়।
এর মধ্যে গৌতমের একটি ইন্টারন্যাশানাল পেপার পাবলিশ হল। বিষয় বেশিরভাগ সময় ডিপ্রেশন সারে কীসে, ওষুধে না ভালবাসায়? পেপারটি উৎসর্গ ছিল সুবর্ণের নামে। কারণ শ্রীপতির বাবা জানে মায়ের ওই প্রাণঢালা ভালবাসাই দুটি শুকোতে থাকা প্রাণকে আবার সবুজ করে তুলেছে।
একদিন সন্ধ্যে বেলা, বহু দিন পরেই বোধ হয় কাবেরী রান্না ঘরে চা করতে ঢুকে খোলা গলায় গেয়ে উঠল, ‘মোর ভাবনারে কী হাওয়ায় মাতালো, দোলে মন দোলে অকারণ হরষে—।’ আর গৌতম হসপিটাল ফেরত প্যান্ট-শার্ট ওয়াশিং মেশিনে দিয়ে পাজামা পাঞ্জাবি গলিয়ে পতুকে সরিয়ে মার কোলে মাথা রাখলে। সুবর্ণ মুখটা একটু ফিরিয়ে হাসার বদলে ভিজে চোখ মুছে নিলেন।