যমুনা নদীর তীরে যে যুবতী মেয়েটি একা বসে ছিল তার পরনের বসন অর্ধসিক্ত। বালিতে যা-ই সে আঁকুক না কেন জল এসে বারবার খেলাচ্ছলে মুছে দিচ্ছে। সহসা পিছনে একটি তরুণ কন্ঠস্বর শোনা যায়।
—রাধা তুমি ডেকেছিলে নাকি? হঠাৎ এই অবেলায়?
রাধা নামের যুবতীটি উঠে দাঁড়াতেই বোঝা যায় সে বেশ দীর্ঘাঙ্গিনী। মাথায় যুবার প্রায় সমান। বয়সে নিশ্চয়ই বড় কেননা যুবকের দেহ থেকে সবে কৈশোরের ছাপগুলি মুছেছে। যুবতী সেদিকে চেয়ে উত্ফুল্ল হয়ে বলল—কৃষ্ণ, এসেছিস? আয় মরি।
তারপর তাদের মধ্যে এরকম কথোপকথন হয়েছিল।
কৃষ্ণঃ এই বলতে ডেকেছিলে বর্ষা-বাদলের এই দিনে?
রাধাঃ—কেন? এ কি কম কিছু? আশ্চর্য, লাগছে না তোর ভালো?
দ্যাখ, আমি খুলে ফেলছি সব কাপড়—সাবধান, চোখ সরাবি না—
এই দুই বুকে তুই মুখ রেখে যমুনার জলে
আজকে আমার সাথে ডুবলে পাবি অমৃতের আলো।
কৃষ্ণঃ আবার তোমার মাথা বিগড়েছে, যাও ঘরে ফিরে
জানাজানি হয়ে গেলে এবার ঘটবে কেলেঙ্কারি
তোমার তো ভয় নেই, মাথা কাটা যাবে যে আমারই
লক্ষীটি—রাত্রে তো আসছোই মধুবনে কিম্বা নদীতীরে?
রাধা শুধু হাসলেন—একটুও রাগলেন না। দ্রুত হাতে বস্ত্র বিসর্জন করতে উদ্যত হয়ে দাঁড়ালেন জলে। বললেন—তোর জন্য দ্যাখ কী না ত্যাগ করতে পারি। কুল মান সব গেছে—লজ্জা, যা তাকেও দিচ্ছি ছেড়ে।
—না, না লজ্জা ছাড়বে কেন? আহা লজ্জা থাকা কি দোষের?
আঁতকে উঠে বলল যুবা। কুল মান—তাও গেছে নাকি?
বলোনি তো আগে কৈ? না, না এতো তোমার রোষের
কথা। আচ্ছা বলো রাধা কীভাবে তোমার মন রাখি?
চলো তবে শম্বুকের পুকুরে কাল সবাই চড়িভাতি করব।
রাধাঃ না তুই আমার সঙ্গে আয়—আমরা জলে ডুবে মরব।
রাধা তাঁর পরিধেয় বস্ত্রটি হাওয়ায় যেই দিলেন উড়িয়ে
কৃষ্ণ হাঁ হাঁ করে ছুটলেন সেই দিকে
ধূর্ত মেঘ নেমে এল কালো হাতে রাধার পুড়িয়ে
দিতে মুখ, টেনে নিতে কৃষ্ণকে দূর অন্তরীক্ষে।
কৃষ্ণের বিপাক দেখে রাধা হো হো করে হেসে উঠলেন। ততক্ষণে মেঘের হাত তাঁর মুখে কয়েক পোঁচ কালি লাগিয়ে দিয়েছে। দুর্ধর্ষ কৃষ্ণ অবশ্য একটু পরেই সহর্ষে জল থেকে মুখ তুলে বললেন—পেয়েছি। রাধা সাঁতরে এসে কৃষ্ণকে বুকে জড়িয়ে বললেন – আমিও পেয়েছি। আয় এবার মরি।
কৃষ্ণঃ ডুবব? কিন্তু কেন? তোমার কি বাঁচতে লাগছে না আর ভালো
বৃন্দাবনে?
রাধাঃ না, ভীষণ ভালো লাগছে, বৃন্দাবন মধু, এর ধুলো
এর পথ ঘাট মধু, মধুর এর বাতাস, প্রিয় নদীতীর,
আমবন, এমনকী ভালোবাসছি শ্বশুরের কুলও।
সেজন্যই মরতে চাই কৃষ্ণ। ভুল বুঝিস না। এরকম ভালো
আর কখনও লাগেনি হয়ত কারো।
এই ভালো লাগাতেই তো মরে গিয়ে ডুবতে হয় আরো।
কৃষ্ণ জল থেকে উঠে রাধার হাত ছাড়াবার চেষ্টা করলেন। নদীস্রোত দুজনকে টেনে নিচ্ছিল পিছনে। কৃষ্ণ সবলে রাধাকে টেনে তুললেন বালির উপর। থপ করে বসিয়ে কাপড়টা জড়িয়ে দিলেন ভালো করে। বললেন—আরে মরে তো বোকারা। আমরা মরতে যাব কোন দুঃখে। জীবনে এখনো কত কী দেখার বাকি। হিমালয় দেখা হয়নি আমাদের। দেখা হয়নি সাগর। আমার অনেক দিনের ইচ্ছে দুজনে মিলে পম্পা সরোবরের পদ্মফুল দেখতে যাব।
রাধা উদাস হয়ে বললেন—কৃষ্ণ তুই নাকি দ্বারকার রাজা হবি? আমাকে তো একদিনেই ভুলে যাবি তাহলে।
কৃষ্ণ জিভ কেটে বললেন—পাগল হয়েছ? ওসব উড়ো কথায় কেউ কান দেয়? কংস জানতে পারলে যাচ্ছেতাই হবে। যাদবগুলো যেমন গোঁয়ার তেমনি গাধা। একটা কিছু রটিয়ে দিলেই হল। বরং কংস ব্যাটাকে খুশি করতে পারলে একটা বড় সভাসদ কি সামন্ত হয়ে বসা যায়। তখন তোমাকে আমার কাছ থেকে কাড়ে কে?
রাধার মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। তিনি বললেন—সত্যি? তুই আমাকে সঙ্গে নিয়ে যাবি?
কৃষ্ণঃ তবে? শুধু তোমাকে কেন—ললিতা আর চন্দ্রাবলীকেও নিয়ে যেতে পারি যদি চাও। তোমার সখিরা তোমার সাথেই থাকুক। দ্বারকার না হতে পারি, এই গোষ্পদতুল্য মথুরা-বৃন্দাবনের অধীশ্বর নিশ্চয়ই হতে পারব।
রাধা ঠোঁট উলটে বললেন—তুই রাজা হলে আমার কী? আমি তো আর রানি হতে পারব না।
কৃষ্ণ বললেন—কেন? তুমিই তো হবে আমার রানি। যমুনার তীরে তোমার একটা ছোট্ট প্রাসাদ থাকবে। বেশি নয়—এই ধরো দৈর্ঘ্যে প্রস্থে সহস্র পায়ের একটা নিভৃত উদ্যান। লোকে বলবে রাধারানির ঘাট। সেখানে তোমার শ্বশুরবাড়ির লোকেরা ঢুকতে গেলে দৌবারিক গাঁট্টা মারবে মাথায়। অবশ্য—এসব তখনই সত্যি হয় যদি আয়ান ঘোষের মায়া কাটাতে পারো। কে জানে তখন হয়ত তার খোঁচা খোঁচা দাড়ির স্পর্শের জন্য মন ব্যাকুল হয়ে উঠবে তোমার। খাঁচা ভেঙে পালাবে তার খাটিয়ায়।
রাধা কপট ক্রোধে চোখ পাকিয়ে বললেন—যা তা বলিস না কেষ্টা। তুই জানিস না আমি কাকে চাই?
কৃষ্ণও কপট হতাশার ভান করে বললেন—দেবা ন জানান্তি স্ত্রীয়াশ্চরিত্রম। আমরা তো কোন ছার?
অমনি দেখতে দেখতে রাধার কন্ঠস্বর বাষ্পরুদ্ধ হয়ে এল। তিনি বললেন—তুই একথা বলতে পারলি কৃষ্ণ? আর তোর জন্য আমি কী না ছাড়তে বাকি রাখলাম?
কৃষ্ণ দেখলেন রাধার দুই চোখে টলটল করছে জল। কৃষ্ণের দৃষ্টি থেকে তা আড়াল করার রাধা চোখ সরিয়ে নিচ্ছেন। আঁচল খসে বেরিয়ে পড়েছে পয়োধর। ফর্সা কাঁধ দুখানি এবং সুঠাম পাদুটি আকর্ষণ করছিল কৃষ্ণকে, তিনি হো হো করে হেসে উঠে বললেন—এতেই চোখের জল বেরিয়ে গেল? এত যে দুর্বল সে আবার আত্মহত্যা করবে? আচ্ছা বলো তোমার কী চাই। আগামী আশ্বিনের মেলা থেকে কী এনে দেব তোমায়?
রাধা একটুখানি সময় নিলেন ধাতস্থ হতে। তারপর বললেন—তুই কি সত্যি আমাকে ভালোবাসিস কৃষ্ণ?
কৃষ্ণ বললেন—এটা একটা প্রশ্ন হল? না, আমি আসলে ভালোবাসি তোমার শাশুড়িকে। তোমার সঙ্গে শুধু রঙ্গ করতে আসি।
রাধা চোখ মুছে বললেন—তাহলে তোর কাছে শুধু দুটো জিনিস চাওয়ার আছে আমার। তা কি চাইতে পারি আজ?
কৃষ্ণ বললেন—নিশ্চয়ই।
রাধা বললেন—না দিতে পারলে বল, চাইব না।
কৃষ্ণ বললেন—প্রাণ আর মন দুটোই তোমাকে দিয়েছি রাধা। এর পর আর কী চাইবে তুমি? এখনই চাও।
তখন রাধা বললেন—
ধর যদি চাই দ্বারকার তুই হবি না রাজা
যাবি না কোথাও ত্যাগ করে এই বৃন্দাবনের
জন্মভূমিকে—যেখানে রাধার গিয়েছিল কুল—
আর সে রাধাকে সঙ্গে রাখবি নিজের করে?
রাধা যখন বালির চরে দাঁড়িয়ে একথা বলছিলেন তখন তাঁর খোলা চুলের উপর মেঘের ফাঁক দিয়ে এসে পড়েছিল আলো। সিক্ত বসন ভেদ করে ফুটে উঠেছিল গুরুভার নিতম্বের রেখা। কৃষ্ণর মনে হল এই বর্তমানের কাছে ভবিষ্যতের রাজ্যপাট তুচ্ছ। তাছাড়া ওই নরবানর কংস বেঁচে থাকতে দ্বারকার ধারে কাছে যাওয়াও নিরাপদ নয়। রাজা তো দূরের কথা, রাজভৃত্য হবার সম্ভাবনাও নেই। ছেলেবেলায় গোয়ালার ছেলেদের মধ্যে নাম করার জন্য দুচারটে বোলচাল দিয়ে ফেলেছিলেন বলে কি প্রাণ বিপন্ন করতে হবে? দ্বারকার দুর্গম ও বিপজ্জনক পথ রাধার জন্য ছেড়ে দিতে হলে বিন্দুমাত্র সংকোচ হবে না তাঁর। সহাস্যে কৃষ্ণ বললেন—এর বদলে যদি একটা চুম্বন আমার পুরস্কার হয় তো তথাস্তু।
হঠাৎ গম্ভীর হয়ে রাধা বললেন—সত্যি করে বলো শ্যাম। তিন সত্যি করে বলো তুমি আমাকে ফেলবে না। কৃষ্ণও টপাস করে রাধার কোমর জড়িয়ে ধরে বললেন—সত্যি, সত্যি, সত্যি।
এরপর মেঘ আবার মাথা নিচু করে নেমে আসছিল বনে। কৃষ্ণ রাধার শরীর নদীর বালিতে মিশিয়ে দিয়ে নিজেও মিলিয়ে যেতে লাগলেন তার মধ্যে। মেঘ ও নদীর প্রতিবাদের ব্যর্থ গর্জনে লুপ্ত হয়ে যাচ্ছিল আর সমস্ত শব্দ।
এরও অনেকক্ষণ পর যখন সূর্য নেমেছে পাটে, আকাশের ভেজা পাখিরা একে একে ফিরতে শুরু করেছে তাদের বাসায়, কৃষ্ণের ঘুমন্ত দেহ পড়েছিল উষ্ণ বালির শয্যায়। রাধা একা উঠে খোঁপা বাঁধলেন। নীল বস্ত্রটি আবার পরলেন ভালো করে। ভূমি থেকে তুলে নিলেন চুড়ি, হার, দুল ও পায়ের মল। তারপর হাঁটুর বয়সী ননদের ছেলে কৃষ্ণকে মনে মনে প্রণাম করে বললেন—আজ সকালে মনে হয়েছিল এর বেশি সুখ হয় না কোনোদিন। কিন্তু এখন একবেলার মধ্যেই মনে হচ্ছে আমি আরও সুখী। জানি তুমি মিথ্যে বলোনি শ্যাম। কিন্তু আনন্দের পরেই আসে বিষাদ। তাই কোনো ভবিষ্যতের উপর লোভ করি না আর। ছেলেবেলার বন্ধন যদি ছিঁড়ে যায়, কীর্তি যদি তোমায় নিয়ে যায় এখান থেকে দূরে—তাহলে নিজেকে দোষ দিও না। সেই পথ আমার জন্য নয়। তোমাকে সব প্রতিজ্ঞা থেকে আমি মুক্ত করে দিলাম।
—একদিন তুমি হবে দ্বারকার রাজা। আমাকে সঙ্গে নিয়ে যেতে চাইলেও তখন আমি কি যেতে পারব? আমার রাজমহিষী হবার যোগ্যতা নিয়ে কথা উঠবে না? আমি কি তোমাকে সেই লোকনিন্দার অংশ নিতে বলব? কাকে বলব আমি তোমার দ্বারে গিয়ে পিতার মতো আমার জন্য আশ্রয় ভিক্ষা চাইতে?
—কারণ অগ্নির সম্মুখে দান না করলে যাকে গ্রহণ করা যায় না সেই কন্যা আমি। আমার এই দেহ, যার জন্য তুমি ছিলে উত্সুক, তার নেই নিজের উপর অধিকার। যদি কখনো তোমার প্রাসাদে গিয়ে দেখা চাই, হয়্তো তুমি স্বয়ং সিংহাসন থেকে আসবে নেমে। সবাইকে অবাক করে ধুইয়ে দেবে আমার পা। কিন্তু তাতে কি মুছে যাবে আমার পরিচয়? পূর্বের মত কুমারী হব আমি?
—যার সম্ভাবনা তোমার হর্ষ বর্ধন করে, সে ভবিষ্যৎ তোমাকে দিলাম। তার জন্য কোনো উদ্বেগ স্থান পায় না আমার মনে। তোমার থাকুক রাজ্যপাট। তোমার হোক এক সহস্র মহিষী। রাজাধিরাজের সম্মান তুমি পেতে পারো। দশ দিকে নাম হবে তোমার। স্বর্ণমুদ্রার লোভে তোমার নামে কাব্যরচনা করুক পণ্ডিতরা। প্রজারা তোমাকে বলবে ভগবান। তোমার কীর্তি ও যশের কাহিনী অক্ষয় হয়ে থাকুক। যাদের তুমি ভালোবাসবে তাদের ভালো বলে চিনবে লোকে। তোমার শত্রুদের যুগ যুগ ধরে ধিক্ বলবে সাধুগণ। এমনকী তোমার জন্যই আমার কলঙ্কের কথাও হয়ত জানবে ভূভারতের ধনী ও দরিদ্র মানুষ। পারলে সে কাহিনীতে আমার সবচেয়ে সংক্ষিপ্ত উল্লেখের অনুমতি তুমি দিয়ো।
—তবু কোনোদিন যদি শুধু আমার কাহিনী লিখবার কৌতূহল হয় কোনো দূর দেশের কবির, তাহলে সে যেন কোনো লোল ও বৃদ্ধ ঋষি না হয়। তাকে দেবার মতো স্বর্ণমুদ্রা নেই আমার। তাকে আপ্লুত করার জন্য থাকবে না তোমার মতো বিদ্যা, বুদ্ধি ও জয়ের সম্ভার। তার জন্য থাকবে শুধু আমার ভালোবাসার অভিশাপ।
—আমি যেন হই তার লজ্জাহীন কৈশোরের রাধা। সে যেন কোনোদিন যশের গৌরবমালা না পায়। তার স্কন্ধে না পড়ে যেন কীর্তিমান বার্ধক্যের ভার। সে যেন আমার মতো যৌবনেই বাঁচে এবং মরে।
এই বলে ঘুমন্ত কৃষ্ণকে ছেড়ে রাধা নামের এই যুবতীটি ধীরে ধীরে নেমে গেল যমুনার জলে। এই তার হাঁটু ডুবল। এই কোমর। এই বুক। আস্তে আস্তে এখন ডুবে যাচ্ছে তার চোখ ও কপাল।