সকালের নরম ও মর্মভেদী রোদের আলোয় আলোকরেখা হয়ে ফুটে ওঠে মাকড়সার জাল। এমনই ঝকমকে রূপ তার যে, মনে হতে পারে বিনিসুতোর মালায় গাঁথা আলোকিত জীবনের ছবি। সেই রোদ এসে পড়ে এই মাটিতে। তখন মাটি হয়ে ওঠে আলোর পথ। আলো আসার আরও অনেক পথ আছে এখানে। কিন্তু এই মাটিতে প্রথম রোদ ঐভাবে পড়ে। পড়ে, আর সরীসৃপ-রোদ এঁকেবেঁকে বাগানের মাটিতে আলোরফুল ফুটিয়ে তোলে। গড়িয়ে যায় ওদিকে, গড়িয়ে আসে এদিকে। আহা, আলো...। তখন এই বাগান হেসে ওঠে যেন। ঠাকমার ‘সাধের বাগান’। এ হল আমাদের মাটি—ঠাকুমার মাটি— উর্বর মাটি—ভূমি। যে মাটিতে গাছের বীজ পড়তে-না-পড়তেই কলা ফুটে অঙ্কুর বেরোয়।সন্ধ্যার আঁধারে ‘নিম্ন-খাল’ থেকে কচ্ছপ উঠে এসে রেগুলার যে মাটির নুন চেটে খায়। নেমে যায় তারপর। আমরা এখন সেই মাটিতেই দাঁড়িয়ে। আমি আর আমার ঠাকুমা। ...ইতাদি নানা কথা বলতে বলতে ঠাকুমা বলে, ‘এইমাটি আসলে মাটি নয়—বাগান নয়—এ হল আমার ভিটেটুকু।’
শুনে আমি কথা বলতে বলতে চুপ করে শুনে গেলুম। মনে পড়ল বিজনের কথা। শুনেছি বিজন খুব যাত্রা ভালোবাসে। কিছুদিন আগে বিজন বিয়ে করেছে। বাড়িতে এখন সম্পর্কে-সম্পর্কে ডামাডোল চলছে।
খালকে এই যে ‘নিম্ন-খাল’ বলে ডাকা—এই নাম আমার দাদুর দেওয়া। ছোট থেকেই শুনে আসছি খালের এইরূপ নাম। দাদু বলে, ‘একটি খাল কখন নিম্ন-খাল হয়? না, যখন সে নীচু হয়ে নীচ দিয়ে গড়িয়ে যায় নীচের দিকে। কোনও পাড় থাকে না তার। থাকে ঢাল। আর সেই ঢাল বেয়ে উঠে আসে কচ্ছপ। কানকো বেয়ে আসে কইমাছ। আরও কত কী সমুদ্রপ্রাণী আসে, কে বলতে পারে!’ এই ছিল দাদুর উত্তর।
‘তারপর?’
‘সেই খাল নীচে গড়াতেই থাকে আর গড়াতেই থাকে। শেষে সেই খাল নদী থেকে একটা পায়রা হয়ে ওঠে!’
দাদুর এহেন কথা আমরা হতবাক!
বিজনের ব্যাপারে অনেকদিন আগের একটি কথা আমার মনে পড়ে। সেবার গ্রামে গেছি, দেখি বিজন একটি খাতা দিয়ে দৌড়াদৌড়ি করছে। বললাম, কী ব্যাপার রে, খাতা বগলে ছুটোছুটি করছিস কেন?’ বিজন তখন ক্লাস টেন-এ পড়ে। শুনেছি সে পড়াশুনোয় অতি সাধারণ।সে বলে, ‘পালা লিখছি ছোড়দা।’ ‘তুই কি যাত্রা করিস নাকি?’ সে ঘাড় নাড়ে। ওর মা বলে, ‘সারাদিন ঐ নিয়েই থাকে।’
এই এলাকায় একসময় আমাদের গ্রামের খুব সুনাম ছিল ভালো ভালো পালা নামানোর জন্য। সেই সময়ের উল্লেখযোগ্য পালা ছিল ‘সোনাইদিঘি’ যা লোকের মুখে মুখে ফিরত। সেই পালায় অভিনয় করে আমাদের গ্রামে খ্যাতিমান হয়েছিল সারা তল্লাট জুড়ে। কার্তিক মুদি, নীলমাধব বাঁক, পুরাণ ঠাকুর, দুলাল কাজি, যামিনী হাজরা ও চাঁদু মুদি। আরও একটি যুগান্তকারী পালা ছিল ‘দেবী সুলতানা’। খুব নাম-ডাক ছিল এইসব এমেচার অভিনেতাদের। এদের যাত্রা দেখতে দূর-দূর গ্রামের মানুষ আসত। সেবারেই শুনলুম আমাদের গ্রামের যাত্রার সেই হারানো গৌরব বিজন ফিরিয়ে আনতে চায়।
ঠাকুমা বলছে বটে ‘ভিটেটুকু’;কিন্তু আমাদের ভিটেমাটি এদিকে তো নয়—ওদিকে। হাঁ, খালপাড়ে আমাদের বাড়ি বটে, তবে ভিটের নামমাত্র এদিকে কিছু নেই। আমাদের উঠোন যেখানে শেষ হচ্ছে, সেখানে একটা বাঁশবন ছিল। একদা দুটি শেয়াল সেখানে সুখে বসবাস করত, শুনতে পাই। সন্ধেবেলা পড়তে বসে যখন ঢুলতুম, শেয়ালেরা যেন আমাদের ঘুম থেকে ডাকার জন্য ডাকত। বাঁশবনের দক্ষিণে, কিছু আজেবাজে গাছের সহিত আগে আমাদের খাটা পায়খানাটা এদিকেই ছিল। সঙ্গে ছিল কয়েকটি তেঁতুলগাছ। দীর্ঘ উচ্চতার না-হলেও বেশ ঝামরি-ঝুমরি গাছ ছিল সেগুলি। কিন্তু বেশিরভাগ তেঁতুল—হয় ভোয়া তেঁতুল—নয়ত বা পোড়া তেঁতুল—ফলত সে তেঁতুল কেউ খেত না। তাছাড়া ছিল জম্মের টক! না-খাবার আরও একটি কারণ ছিল, তেঁতুলের ছায়ায় খাটা পায়খানার উপস্থিতি। ফলে ‘অচ্ছুত’ ওদিকটা প্রয়োজন ছাড়া বাড়ির লোক যেমন মাড়াত না, তেমনি ওখানের কোনও ফল-পাকুড় মুখে তুলত না। ফলে ফল পাকলে হনুমানের উৎপাত লেগেই থাকত।
এদিকে এখন কানাঘুসো শোনা যাচ্ছে, এই খালকে পুরাতন অবস্থানে গরমেন্ট ফিরিয়ে নিয়ে যাবে আবার। ফলে খাল বুজিয়ে যারা ঘরবাড়ি গড়ে তুলেছে, কিংবা কোনও পশুখামার, তাদেরই চিন্তা। আমাদের বাড়ির লোকের চিন্তাভাবনা কিছু নেই ওসব নিয়ে। দখল করা জায়গায় কেবল বড় বড় গাছ আছে। যদি সত্যি তেমন কিছু হয়, গুজবের হাওয়ার সঙ্গে বাস্তবের বাতাস মিলে যায়, সব গাছ কেটে ফেলা হবে, বিক্রি করে দেওয়া হবে। বাড়ির লোক খুশি, বেশ কিছু পয়সা ঢুকবে ঘরে। হ্যাঁ, কেবল ‘বিজন-কাণ্ড’ নয়, ঠাকুমাকে দেখাও গ্রামে আসার একটি কারণ। গ্রামের প্রতি টান—ঠাকুমার প্রতি টান। তাই আসা... আসি...মাঝে মাঝে গ্রামের বাড়িতে। জহর বলছিল, ‘আমেচার দলে এই মুহূর্তে সেরা অভিনেত্রী ও। ওর বাবাও যাত্রাদলে কাজ করেছে। পেশাদার। এই মেয়েটিও ইচ্ছে করলেও পেশাদার দলে অভিনয় করতে পারত। মেয়েটি ইচ্ছে করেই পেশাদার না করে এমেচার দলে অভিনয় করছে।’ আমি বলি, ‘মেয়েটার নাম কি?’ জহর বলে, ‘কুঙ্কু হালদার। মেয়েটি ভালো অভিনয় করে। ভালো গান গায়। বাজারে চাহিদা আছে। ও নায়িকা রোলে অভিনয় করে, রেট তিন হাজার টাকা। ওদের মধ্যে কমজনই আছে যারা ভালো চরিত্রের হয়। ওদের তো অনেক রাত ঘাঁটতে হয়।’
ঘাড় ফিরিয়ে এদিক-ওদিক তাকাই। দেখি সমস্তটা। চারিদিকে জগত-চরাচর জেগে আছে। আমাদের ভিটের পুরোটা আগে এতখানি ছিল না। এর মধ্যে বহু আগে ছিল কাঙালির ঘর। আর এক বহুরূপী বাস করত এখানে। এঁদের দুজনের প্রচুর গল্প ছেলেবেলায় দাদু-ঠাকুমার মুখে শুনেছি। তাদের একজনের ভিটে নগদ পয়সায় কিনে নেওয়া হয়, ও একজন ছেড়ে চলে যায়। সে হল বহুরূপী, সে ছিল আজন্ম-নিরুদ্দেশ। ফলে সেই ভিটেখানাও বিনা খরচে আমাদের হয়ে গেল। খালের পারে একখানা বাঁশের ঘাট ছিল। নারকেল গাছের গুঁড়ি ফেলা থাকত। সেই ছিল আমাদের এখানে নৌকা-ঘাট। সেসব আমরাই দেখিনি, কবেই চুকেবুকে গেছে—আহা নৌকা-ঘাট।
ঠাকুমার তবে কি মাথা খারাপের রোগ ধরল? ভারি চিন্তার কথা!বিজনের কাণ্ডকি ঠাকুমাকে ভাবায়? জহর বলছিল, ‘মেয়েটির বাজার আছে। বিজন হয়ে গেছিল ওর ব্যাগ বইবার লোক। বিজন ভালো অভিনয় করত। ওর নেতৃত্বেই তোদের গ্রামে এমেচার যাত্রাপালা অভিনয় হত। ঐ সবাইকে ডেকে-হেঁকে এনে অভিনয় করাত। মোহ...মোহ...’
এখন নাকি ঠাকুমার মাথার ভেতর সেইসব নৌ-ঘাট, নৌকারা পাক দেয়। নৌকা চলাচল করে। নৌকা চেপে দাদু ওপার থেকে এসে দেখা করে যায়। বাড়িতে উপস্থিত বাকিরা সকলেই এমনি বলে। বয়সের ফলে মাথা-পাগলা রোগ ধরছে ঠাকুমার। ফলে ঠাকুমাকে কেউ আর ঘাঁটায় না। ঠাকুমা এদিকটা নিয়ে পড়ে থাকে। এখানেই থাকে। আগে যেটা আমাদের গোয়ালঘর ছিল, গরুর পাট তুলে দিয়ে এখন সেখানে ঠাকুমার জন্য বিছানা পাতা, তক্তোপোস পাতা। ওদিকে সংসার বয়ে যায়।
ঠাকুমা বলে, ‘নৌকায় চেপে দাদু এল। আর সেই নৌকায় চেপে ঠাকুমা চলল মার্টিন রেল ধরতে...’
হ্যাঁ, এখন আমরা অবাক হই ঠাকুমার কথায়। পাড়ার লোকে হয় না। ঠাকুমার সঙ্গেই তাদের যাবতীয় ভাবসাব। ফলে এই যে ঠাকুমা দুম করে বলে দিচ্ছে, এ পাঁদার নয়—খালপাড় নয়—বাগান নয়, এই মাটি হল আমার ভিটেটুকু—তাইতে মনের মধ্যে ধন্দ জাগে। হচ্ছে কী ব্যাপারটা? খালপাড় থেকে অনেকটা ওদিকে আমাদের বাড়ি, উঠোন শেষ হয়ে গেছে সেই কবে—তবু ঠাকুমা নিজের ভিটে এদিকে টেনে আনে কেন? ওদিকটাকে তবে কি ঠাকুমা নিজের আবাসস্থল বলে মনে করে না? এই মাটিটুকুই এখন ঠাকুমার ভিটে, ঠাকুমার সবটুকু? সেই কবেকার দিনের অচ্ছুত সেই জায়গাটা এখন নিজের বাড়ির থেকেও এতটাই আপনার ঠাকুমার কাছে? তবে কি আগে এখানে কিছু ছিল? পুরানো কোনও স্মৃতি এভাবেই ঘুরেফিরে আসে ঠাকুমার অবচেতন মনে, যেখান থেকে অচ্ছুত ভূমি ভিটে হয়ে যায়?
আমার সেজোকাকার ছেলে বিজন যাত্রাপার্টির নায়িকা কুঙ্কু হালদারকে বিয়ে করেছে। এই নিয়ে চারিদিকে মুখোরোচক আলোচনা। বিজন তারচেয়ে দশ বছরের বড় বউকে নিয়ে জনাইতে ভাড়া থাকে। জহর বলছিল, ‘তখন তোদের গ্রামে বছরে তিনবার যাত্রাপালা হত। ভাইফোঁটার পরের দিন, শ্মশানকালীর পুজোয়—চৈত্রমাসে, আর শিবরাত্রিতে। এখন সব বন্ধ। আমাদের গ্রামে বছরে একবার হত, এখন আর হয় না। আমি চেষ্টা করছি, কিন্তু একার দ্বারা সব হয় না। ‘বিজন সঙ্গে ছিল। ও বলত, জহরদা, আমি আছি, তুমি পালা নামাও। কিন্তু এমন কাণ্ড করল যে ওর আর মুখই দেখতে আমার ইচ্ছে হয় না!’
পাঁদারের এখানে বসে একদিকে যেমন খাল, এপার-ওপার চোখে পড়ে; তেমনি আমাদের বাড়ি টপকে দেখা সোজ উত্তরে তাকালে দেখা যায় শেফালি-মামনিদের বাড়ি, ওদের বাড়ির আনাচকানাচে অবস্থিত পরপর সব তেঁতুল গাছদের। গ্রামের দিকে হয় কি, তেঁতুল গাছ জমা রাখা হয়। আমাদের গ্রামের নাম, যা অনেক আগেই কথায়-কথায় বলেই দিয়েছি—ছোটচৌঘরা—গ্রামেও জমা রাখা হয়। আশপাশের যত গ্রাম, বাঘাটি-বড়চৌঘরা-গণেশপুর-বাদেশোলা—সর্বত্রই একই চিত্র। গাছ জমা দিয়ে দেওয়া। আমাদের পাড়ার শেফালিরা তাদের পাঁচখানা যে গাছ আছে—ঘরে, বাইরে, বাগানে, খালধারে—জমা রাখে। মামনিদেরও তিনখানা গাছ জমা রাখা হয়। চেনা লোকেরাই আসে প্রতিবার, নতুন করে চুক্তি হয়। গেছুড়েদের সঙ্গে চুক্তি হয় তিন বছরের। যা ফল ফলবে তারা সবই তুলে নিয়ে যাবে। বদলে গাছ-মালিক টাকা পাবে।
সব শুনে জহর বলছিল, ‘তোর ঠাকুমার বয়স কত হল রে?’
‘নব্বই।’
‘আমরা অদ্দিন বাঁচবনা—কী বল!’
‘একদিন আয় তুই।’
আমাদের প্রাচীন সেই তেঁতুল গাছদুটি নিয়েও সেইসব ভাবা হয়েছিল। দাদু-ঠাকুমা বলত, ‘এইসব গাছ কি আজকের রে, কবেকার—কতদিনের! পুরাতন মানুষের মতন তারা পুরানো হয়ে গেছে!’
ফলে তেমনভাবে আর কচি পাতা আসে না। আর তাই, নিজেদের গাছ ফেলে রেখে শেফালিদের তেঁতুলগাছের কচি পাতা আমরা নুন মাখিয়ে খেতাম সেই কোন ছেলেবেলায়।
কিন্তু আমাদের গাছ দুটিতে ফল তেমন ধরে না বলে গাছ-জমাদার-রা আমাদের গাছ নিয়ে তেমন উৎসাহ দেখালো না। গাছ কেটে ফেলা হল। ততদিনে উঠোনের একধারে, ভিটে থেকে যথেষ্ট দূরত্ব রেখে আমাদের পাকা পায়খানা ঘর গড়ে উঠেছে। ফলে অচ্ছুতের তকমা ঘুচতে শুরু করল পাঁদারের। আর এই অবসরে কখন যেন জায়গাটা ঠাকুমা আপনার করে নিল।
আর যেই গাছ কাটা হল, বাঁশবাগান তুলে ফেলা হল—জায়গাটা হঠাৎ করে যেন ফাঁকা হয়ে গেল। মিতা লাগিয়ে সাফ-সুতরো করা হল। খেয়ালবশে ঠাকুমার হাতে গাছ লাগানো শুরু হল তখনই। প্রথমে লাগানো হল একটা আমড়া গাছ। অমলেন্দুদের আঁদার-পাঁদার থেকে তুলে এনে মিতারাই গাছটা লাগিয়ে দিয়েছিল। ওদের পাঁদারে অনেকরকম গাছ আছে। গাছটা একটু একটু করে বড় হতে লাগল। জহর ঘাঁটি বলল, ‘শুয়োরটা যে অমনি করবে, বুঝতে পারিনি! যাত্রা-পার্টির মেয়েদের নাকি অনেকগুলি ‘ঠেক’ থাকে। যাত্রা শেষ হয়ে যায় রাত একটা নাগাদ। তারপর কোথা যাবে? কারও না কারও বাড়িতে থাকতে হয়। সেই হিসেবে এদিক-ওদিক কিছু কিছু জায়গা আছে, যারা তাদের ‘হ্যাজবেন্ড’ হয়ে যায়। এই মেয়েটির বিয়ে তিনখানা, বিজনকে ধরে।’
এখন সেই আমড়া গাছের মাঝের ডালটিতে বসে একটি বুনো পায়রা ঝিমোয়। পরিষ্কার, ঝকঝকে, চালের মাথা টপকে, শেফালিদের তেঁতুলগাছের পাকা তেঁতুল, ভুয়ো তেঁতুল ছুঁয়ে রোদ নামে মাটিতে আর মাটি শুষে নেয় তাকে। ঠাকুমা রোদ দেখে, গাছপালা দেখে। দেখে কচুরিপানার দামের ভেতর থেকেও মাছ খুঁজে নেবার প্রাণান্তকর চেষ্টা মাছরাঙার। বৌরিগাছের একটা ডালে, যে ডাল ঝুঁকেছে জলের প্রতি, মনে হয় কচুরিপানার দিকে, সেই ডালে বসে থাকে পাখিটা। সারাদিন এইসব নিয়েই থাকে ঠাকুমা।
ঠাকুমা বলে, ‘নিম্ন-খাল নীচে গড়ায় আর নীচে চলে যাওয়া মানুষ উপুরে উঠে আসে।’
‘হা হতোম্মি!’ বলে বাড়ির লোক মাথা চাপড়ায়। ঠাকুমা বলে, ‘এইভাবেই নৌকারা উঠে আসে জলতল থেকে।’ শুনে মনে হয়, হ্যাঁ, দাদুকে ভুলে গেছি আমরা।
এই মাটিটুকু নিয়েই দিন কেটে যায়। এখানে গাছ বসাচ্ছে, ওখানে আগাছা তুলছে। এখানে খুপরি করে আগাছা তুলছে ওখানে সাপের গর্ত বোজাচ্ছে। বাড়ির পাঁদারটুকু নিয়েই এখন তার নিজের সংসার, নিজের ভিটে। আমড়া গাছটার দিকে অপলক তাকিয়ে থাকে। বোঝা যায় গাছটার বড় হওয়া এখনও বিস্মিত করে তাকে, এই বয়সেও। বিড়বিড় করে বলে, ‘কত ফুল এসেছে দেখ! ফল পাকার পর কি সুন্দর ঝরে ঝরে পড়বে সেই অঘ্রানে।’
জহর ঘাঁটিও তাদের বাঘাটি গ্রামে এমেচার যাত্রা করে। আমার বন্ধু হলেও যাত্রার কারণে বিজনের সঙ্গে একটা আলাদা ব্যাপার ছিল তার। জহর বলে, ‘তোদের গ্রামের ‘যাত্রা-ব্যাপার’টা বিজনই ধরে রেখেছিল।’ ওর সঙ্গে সঙ্গে তোদের চৌঘরা গ্রামে যাত্রার যে উত্থানের স্বপ্ন আমরা অন্যান্য গ্রামের যাত্রাপ্রেমীরা দেখেছিলাম, তা মাঠে মারা গেল!’
এখানে নানান গাছপালা করেছে ঠাকুমা। আম-জাম-আতা-লিচু-জামরুল-কাঁঠাল-নারকেল—কী নেই! সকালে উঠে চা-পর্ব সেরে সেই যে পাঁদারে এসে বসল ঠাকুমা, ঘরের পানে যাবে সেই দুপুরে, ভাত খাবার সময়। তার আগে সারাক্ষণ চইচই করবে গাছপালাগুলোর সঙ্গে। কথা বলবে। আর এখানে আসবে চাঁদুর মা। সে আসে রাস্তা টপকে, অমলেন্দুদের পাঁদার দিয়ে। সঙ্গে কোলে করে নিয়ে আসবে তার ঘরের একটি কচি ছাগল। এই গ্রামে সে একাই ঠাকুমার বন্ধু, যে ঠাকুমার মত এখনও জীবিত আছে। সে আনে পান। বাটা করে নয়, সাদা আঁচলে গিঁট বেঁধে। দুজনে মিলে পান খায় আর রাজ্যের গল্প করে। অতীতের গল্প, ভূতের গল্প।
তবু ঠাকুমা ভয় পাবে এই মাটিটুকু নিয়ে। যে তার এই খালপাড়ের বাগানে আসে, সকলকেই বলে, ‘সরস্বতী নদীকে কেটে বের করা হচ্ছে শুনলুম। আচ্ছা, সব বুজে যাওয়া নদী যদি এইভাবে বের করে নেওয়া হয়—মানুষ তবে কোথা বাস করে?’ এইভাবে আমাদের পাড়া, গ্রাম ও মানুষজনরা বয়ে চলে।
হ্যাঁ, গ্রাম তো এমনি হয়।
এমনিই...
কেবল এই এইসব বড় বড় গাছ? তা নয়। পাঁদারের একদিকে দাঁড়া কেটে বসানো আছে বেগুন, টমাটো, ঢেঁড়স, পালং—যা সিজনে যা ফলে তাই লাগায় ঠাকুমা। মাটি ভরে ওঠে। এর-তার জমির মাটি, ওর-তার দেওয়াল-ভাঙা মাটি, ও-পাড়ার বাউনদের কুলো-ফেলা-ছাই, ছবির মায়ের ইঁদুরে-তোলা মাটি—এইভাবে কার-না-কার থেকে ঠাকুমা মাটি সংগ্রহ করেছে ও এখনও করে চলেছে তার কোনও ঠিক নেই। আমি দেখতে পাচ্ছি, হ্যাঁ, ঐ তো, নীচু হয়ে খালের দিকে হেলে পড়া গড়ানে এই মাটির ওধারে একতাল গোবর রাখা আছে। নিশ্চয় চাঁদুর মা বা জলধরের বউ কুড়িয়ে এনে রেখেছে ঠাকুমার কথায়।
এখন ঠাকুমার ভয়, এই মাটিটুকু নিয়ে। এই মাটিটুকু থাকবে তো? মাঝে মাঝে শুনি নতুন করে আবার খাল কাটা হবে। খালের ভেতর থেকে খুঁজে বের করা হবে কৌশিকী নদীকে। আমার এইসব গাছপালা তারা সব এসে কেটে দেবে না তো? ঠাকুমা নাকি এখন পাড়ায় পাড়ায় লোককে ডেকে বলে, ‘কোমর বাঁধো সব, লড়াইয়ের দিন এসে পড়ল। খালকে খুঁড়ে ফেললে আমাদের সকলের ভিটে-মাটি-চাঁটি হয়ে যাবে—থু থু থু!’
কেউ মানে, কেউ বিশ্বাস যায় আবার কিছুজন হাসে। বলে, ‘মাথা খারাপ হয়ে গেছে তোমার।’ ঠাকুমা বলে, ‘যখন খুঁড়বে, ভিটে দিয়ে নৌকা চলবে, বুঝবে তখন ভিটেহারা হবার জ্বালা!’
ডাকপাখি আসে দুপুরে। তখন একটানা ডেকে চলে ঘুঘু। আমার পায়ের নীচে খুপরি করে উস্কে দেওয়া মাটির আলগা অংশ। নরম ঢেলা পায়ের চাপে চুরচুর হয়ে যাচ্ছিল। খালের ওপারের বাঁশবন থেকে একজড়া ডাহুক ডেকে চলেছে পালা করে। ওরা এপারে আসে দুপুরে। দুটি নারকেল গাছকে জুড়ে এই জাল রচনা করেছে একটি মাকড়সা।
হ্যাঁ, এই তিনদিন ধরে এমনিই দেখছি আমি। তিনদিন ধরে গ্রামে বাস করছি। রোজ সকালে এই পাঁদারে চলে আসতে হয় আমায়। জহর বলে, ‘বিজন আমাকে খুব দাদা-দাদা করত। অভিনয়টা ভালোই জানে বিজন। কিন্তু ও যে এমন একটা কাণ্ড ঘটাবে...। তোর ঠাকুমা কী বলছে?’
নারকেল গাছগুলো সব নতুন। এই বছর ফল দিচ্ছে। গেছো ইঁদুর সেই কচি ফল ফুটো করে জল খায়। ফল ঝরে পড়ে মাটিতে। পাশে দুটি কিশোরী গাছ, যারা সবে ফল দিচ্ছে। বড় বড় পাতা মেলছে বাতাসে। তার শীর্ষ লম্বা ও সরু পাতাটিতে, যেটি এখনও ঠিকমতো খোলেনি, সেখানে থেকে নেমেছে মাকড়সার জাল—রোদ পড়ে ঝকঝক করছে।
বেশ লাগে এই নীরবতা। একটা একাকিত্ব বোধ জাগে। মাটির উপর দিয়ে, মাথার ভিতর দিয়ে একদল কালো পিঁপড়ে যেন সার বেঁধে হেঁটে যাচ্ছে।
মুখে আফশোসের শব্দ করছিল ঠাকুমা আর ইটের স্তূপের পাশ থেকে, মাটির আড়াল থেকে, ছোট ঝোপের ভিতর থেকে ইঁদুরে নষ্ট করা কচি ডাব নিচু হয়ে কুড়িয়ে নিচ্ছিল। বলছিল, ‘একটাও রাখবেনে রে, একটাও থাকবে নে এঁদের জ্বালায়! কত ডাব-নারকেল হত; ফেলে-ছড়িয়ে খেতে পারতিস তোরা।’
এরপরেই ফিরে আসে মাটির কথা। হ্যাঁ, এই যে মাটি আমাদের, এখানে ঠাকুমা মাটি ফেলে ফেলে খালপাড় বাড়িয়েছে। ফলে হচ্ছে কী, খাল সরু হচ্ছে কিন্তু ভরাটের ফলে গাছপালা হচ্ছে। ঘর হবে না ওখানে, পাঁদারে গাছ হয় , ঘর হয় না। ঠাকুমা বলে, ‘বুলবুলি, দোয়েল, মাছরাঙা, বউকথাকও—সে যে কত রকমের পাখি রে ভাই, তাদের লীলেখেলা যদি দেখতিস তুই—কী বলব আর—যেন গাছ করিছি আমাদের জন্যই নয়—ওদের জন্য—যেন পাখিসবের নিজেদের গাছ এগুলি—এমন সব রব করে দুকুরে—বিছানায় শুয়ে আড় হয়েও জানালা দিয়ে দেখি তাদের কীর্তিকলাপ!’
বিজনের কারণে বাড়ির লোক মুখ লুকিয়ে থাকে। বিজন ওর মায়ের নামে থানায় ডায়েরি করেছে। ওর বার্থ সার্টিফিকেট ও কলেজ পাশের সার্টিফিকেট ওর মা দিচ্ছে না—এই কারণে।
একটু থেমে ঠাকুমা আবার বলতে থাকে, ‘হয়তো এঁদের জন্যই আমি ভগমানের ডাক পাই না, ভগমানকে মনের মধ্যে পাই না—খুঁজি না-দেখি না। ভগমান বাইরে থাকে, আমার মনের মধ্যে এইসব পাখিরা হু হু করে ডেকে যায়। হ্যাঁ, পাখি, বনবেড়াল, ভাম, শেয়াল—কি আসে না-আসে এখেনে? জন্তুদের যেন আড়তখানা হয়ে গেছে এখানে। আমি তাই এই মাটির নাম দিছি—সাধের বাগান।’
ঠাকুমা বলে, ‘এখন আর গেরামে গাছ বাইবার লোক মেলে না। তোকে যে দু-চারখানা ডাব খাওয়াব, সে ভাগ্য করলুম নি। গাছে বাইতে পারে পিন্টু, সে আবার গাছ থেকে পড়ে শুয়ে আছে। বাড়ির ছেলেরা তো কেউ গাছে চড়া শিখল না!’
হ্যাঁ, শুনেছি পিন্টু আসে গান গাইতে। এখানে বসেই সে গান গেয়ে শোনায়। ‘বামাখ্যাপা’র গান।
এই খালে আগে শালতি চলত। নৌকা ভরে ধান, পাট চলে যেত কালীপুর হয়ে সোজা আন্দুল। সেই কালীপুরে সরস্বতী নদীকে খুঁড়ে বের করা হচ্ছে। আন্দুলের ওদিকেও কাজ চলছে। ফলে লোকজনের মনে অসন্তোষ বাঁধছে, ঘর বাড়িতে ফাট ধরছে, নানা জায়গায় হুজ্জোতি চলছে।
বিজনের কারণে ওর মাকে থানায় যেতে হয়েছে। সেজকাকা বাইরে থাকে। তাই সঙ্গে গেছে ছোটকাকা। বিজন এমনি কাণ্ড ঘটাবে, বাড়ির কেউ বুঝতে পারেনি।
জহর একসময় পার্টি করত। কৃষকসভা দেখত। এখন প্রাইমারিতে মাস্টারি পেয়ে পার্টিতে সেভাবে সময় দিতে পারে না। তবে জলার ধারে, বাঁধের উপর সে সপ্তাহে একবার কৃষকদের নিয়ে সভা করে। আমি তাকে ফোন করলাম। ফোনে সে বলল, ‘হ্যাঁ-রে অবন্তী, এমন একটা কথা শোনা যাচ্ছে বটে, তবে সরকারি নির্দেশ আসেনি। সত্যি-মিথ্যে জানি না—লোকে বলা-কওয়া করছে—আসলে সরস্বতী নদীকে খুঁড়ে বের করার সময় থেকেই এইরকম গুজব বাতাসে উড়ছে। এর কতটা সত্যি কতটা মিথ্যে বলা খুব শক্ত!’
‘তুই আসবি নাকি একবার?’
‘দেখব, চেষ্টা করে।’
‘তোর সঙ্গে কথা বললে ঠাকুমা হয়তো খানিক শান্তি পেত।’
বিজন বউ নিয়ে এ বাড়িতে এসেছিল। তাকে তৎক্ষণাৎ ভাগিয়ে দেওয়া হয়েছে। তখন বিজন গলা তুলেছিল, ‘এই বাড়িতে আমারও অধিকার আছে।’ বাড়ি কার? ঠাকুমার। দাদু গত হবার পর বাড়ি-সম্পত্তি-জমজমা যা আছে—সবই ঠাকুমার নামে। এই ভিটেতে কি এসে উঠবে যাত্রা-করা, আগে দুটি বিয়ে করা, যাত্রার নায়িকা?
ন’কাকা বলে, ‘ঐ যাত্রাউলী এসে বাড়ি থেকে সবাইকে তাড়াবে। ও-ই ভিটের দখল নেবে। বিজনকে সাইড করে বাড়িতেই ব্যবসা চালাবে! মদের আসর বসবে। হই-হল্লা হবে। ছোট, তুই বাড়ি বেচে দে!’
এই বাগানে ঠাকুমার জন্য একটা চেয়ার পাতা থাকে। এতক্ষণ ধরে চারিদিক ঘুরে-ঘুরে এবার যেন একটু ক্লান্ত বোধ করে ঠাকুমা। বসে সেই চেয়ারটায়। চেয়ার হল ইটের। গোটা পনেরো ইট সাজিয়ে তৈরি এই চেয়াত। চেয়ারে বসে একটা হাঁফ ছেড়ে বলে, ‘তুই বিশ্বেস যাবি কিনা জানি নে, ঐ গাছটার নীচে তোর দাদু এখনও এসে দাঁড়ায়। সেদিনের সেই নৌকা চেপেই আসে সে। ঐ নারকেল গাছটার কথা মনে আছে কিনা তোর, জানি না। তুই তখন ছোট। পায়খানাটা থেকে অনেকটা দূরে তোর দাদু এই গাছখানা বসিয়েছিলে। তোকে বললে, গাছটার গোড়ায় বেশ করে নুন ঢেলে দে। তুই অমনি করলি কি, রান্নাঘর থেকে নুনের ডিপেটা নেসে উজাড় করে ঢেলে দিলি। সেই গাছ এখন কত ফল দেয়। ঐ দেখ, কী সুন্দর নধর-কান্তি ডাব ঝুলে আছে। তোর দাদু মাঝে মাঝে আমার সঙ্গে কথাটথাও কয়। নিম্ন-খালের টান এড়ানো কী সহজ কথা!’
‘তোর দাদু ঠিক তেমনি আছে জানিস! একমাথা সাদা চুল, পরনে ধুতি-পাঞ্জাবি। কেবল একটু যা রোগা লাগে। শেষ কয়মাস খুব ভুগল তো! বলে কি জানিস, চণ্ডীতলার মহালক্ষ্মী হলে চন্দ্রাবতী দেবীর একখানা ভালো বই এয়েছে, চল, দুজনে মিলে গিয়ে দ্যাখে আসি। যদি বলি, পয়সা কই, অমনি সে বলে, সে মার্টিন রেলের গার্ডের হাতে এক পাই গুঁজে দিলেই হল।’
আমরা শহরে থাকি। চলে গেছি অনেকদিন। মাঝে মাঝে আসি। দু-তিন দিন থাকি। ঠাকুমাকে দেখে যাই। গ্রাম দেখি। পুরাতনের সঙ্গে নতুনকে মেলাতে চেষ্টা করি। স্মৃতি ছুঁতে আসি। যেমন ঠাকুমা ছুঁয়ে থাকে নিজের ভিটেটুকু।
রোদ উঠে গেছে অনেকটা উপরে। এখন আর মাটিতে নয়, গাছের পাতায় গড়াচ্ছে তারা। আরও বেলা গড়ালে রোদ উঠে যাবে আকাশের মাথায়।
ঠাকুমা সকালে কি খায়?
এতটা বেলা হল—রোদ উঠে গেল—কী খাবে ঠাকুমা?
বাড়িতে এখন কেবল বিজন...বিজন...বিজন!
আর ভয়!!!
যাত্রাউলী বউ, যার প্রথম পক্ষের একটি ছেলে আছে দশ বছরের, সে এসে ভিটেতে উঠবে, সকলকে ভিটেছাড়া করবে— । ভিটেটুকু-মাটিটুকু হারানোর ভয়ে—ভিটেমাটি অপবিত্র-অচ্ছুত হবার কারণে বাড়ির সবাই থরহরি কম্পমান! কী হবে? কী করবে বিজন এবার?
বিজন আর ওর বউ যাত্রা করেই সংসার চালায়। জহর বলে, ‘তোর ঠাকুমা কী বলছে রে...? এখন বিজন গ্রামে-গ্রামে, ক্লাবে-ক্লাবে ঘুরে পালার অর্ডার ধরে। পালা নামায়, পালা করে। সম্ভবত ওরা দুজনে মিলে একটা যাত্রাদল গড়বে। সেদিন আমার সঙ্গে দেখা হয়েছিল... গোপালপুরে যাত্রা দেখতে গেছি, বিজন এসেছিল। আমাকে বলল, কি জহরদা, ভালো আছ? আমি কোনও উত্তর করিনি, মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছি!’
বিজন কেমন এমেচার যাত্রা করে, অভিনয় করে—আমি দেখিনি কোনোদিন। কেবল জানি, সময়ের সঙ্গে মানুষের ভিটেটুকু-মাটিটুকু-স্বপ্নটুকু কেমন বদলে যায়।