• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৮৫ | জানুয়ারি ২০২২ | গল্প
    Share
  • চিরন্তনী : কোয়েল মিত্র মজুমদার



    পাঞ্জাবির খড়খড়ানি, কপাল বেয়ে নেমে আসা ঘাম আর চিটচিটে গরমকে উপেক্ষা করে ছেলেটা ষষ্ঠীর পুষ্পাঞ্জলির মন্ত্রে মনোনিবেশ করার চেষ্টা চালিয়ে যায়। আপনি চিনতে পারছেন ওকে? নিশ্চই পেরেছেন, না? ওই যে দোহারা লম্বা চেহারা, মাজা মাজা গায়ের রং, আর এক মাথা কোঁকড়া চুল? হ্যাঁ, ঠিক ধরেছেন, যার চশমার আড়ালে দুটো চোখ ঝকমক করে, যে আজও কেমিস্ট্রির বইয়ের তলায় লুকিয়ে জীবনানন্দ পড়ে? ঠাকুরের পা লক্ষ্য করে ফুল ছুঁড়ে দিয়ে ও এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে এবার। অঞ্জলির জন্য ফুল নিতে গিয়ে চোখ পড়ে যায় প্যান্ডেলের কোনায়। ঠিক ফ্যানের পাশেই দাঁড়িয়ে একটা মেয়ে। অচেনা মুখ, ওদের আবাসনের নয় মনে হচ্ছে। হালকা হলুদ শাড়ি, ঈষৎ বাদামি চুল পিঠ জুড়ে ছড়ানো, হাতে সরু চুড়ি। আরে! এই সেই জিনস টপে টিপটপ মেয়েটা না যে বাসস্টপে মোবাইলে অনর্গল কথা বলে যায়?

    আপনি ওই মেয়েটিকেও চিনতে পেরেছেন, না? পারবেনই তো। চেনেন তো ওকেও। আসুন, গল্পটা কোন দিকে এবার এগোয় দেখা যাক।

    তা আমাদের মেরুন পাঞ্জাবির তো অঞ্জলি দেয়া টেয়া শেষ। বেশ খিদে-খিদে পাচ্ছে, এই ভাবে সারা সকাল না খেয়ে থাকার তো অভ্যেস নেই। বোস-কাকিমা প্রসাদ বিলি করছেন, ও গিয়ে লাইনে দাঁড়াল। কাকিমার সঙ্গে একটু কথা বলে, প্রসাদের দোনা হাতে নিয়ে বেরিয়ে এল প্যান্ডেল থেকে। যা গরম! টেঁকা যাচ্ছে না ভিতরে। পাশের মাঠে গোল করে চেয়ার সাজিয়ে সৌম্য, রিমলি, টুপুররা গল্প করছিল। "এদিকে আয় ঋক" বলে ওকেও ডেকে নিল। এই পুজোর দিনগুলোই তো আবাসনের সবার সঙ্গে দেখাসাক্ষাতের অবসর। নইলে সারা বছর তো সবাই ছুটছে। যাক, ও দিক আড্ডা। আমাদের হলুদ শাড়ি কিন্তু বাড়ির পথে হাঁটা দিয়েছে আর সেটা মেরুন পাঞ্জাবি দেখেও নিয়েছে আড়চোখে। ওই তো বি উইংয়ের দিকে গেল। পিকলুকে কায়দা করে জিজ্ঞেস করে নিলেই হবে।

    আচ্ছা, এই ছেলেটা মেয়েটা করে গল্প বললে ঠিক জমে না, না? নাম হলে বেশ হয়।ছেলের নাম যে ঋক সেটা তো জেনেই গেছেন, এবার মেয়েটির নাম জানলেই হলো। ধরুন ওর নাম রাই, এই গল্পটা রাই আর ঋকের, বা আমাদের মধ্যে যে রাই আর ঋক লুকিয়ে আছে তাদের।

    তবে পিকলু অব্দি পৌঁছতে হলো না। তার আগেই দুপুরে প্রতিবেশীদের ব্যাপারে সদাউৎসাহী মা নতুন মুখ দেখে পাকড়াও করে আলাপ পরিচয় করে নিল। অন্য সময় হলে ঋক মাকে মিসেস মার্পল বলে ইয়ার্কি মারত, কিন্তু এখন আর কিছু বললো না।

    ওরা নতুন, বি উইংয়ের পাঁচতলায় সরকারদের ফ্ল্যাটটা কিনেছে। স্বামী, স্ত্রী, এক মেয়ে আর ছেলে। ছেলে ক্লাস টেন আর মেয়ে ইংলিশ অনার্স। “কী মিষ্টি দেখতে মেয়েটা।” মায়ের কথা শুনছি না ভান করে মোবাইলে মুখ আড়াল করে ছেলের কিন্তু শোনা হয়ে গেছে। এরপর? কী ভাবছেন, গল্প কোন দিকে যাবে? চেনা ছক নাকি নতুন কিছু? দাঁড়ান না। এত তাড়া করলে চলে? সবে তো ষষ্ঠী।

    ষষ্ঠীর সন্ধ্যে মানে মায়ের আবাহনের সঙ্গে সঙ্গেআনন্দের ঢাকে কাঠি পড়া। সবাই প্যান্ডেলে চেয়ার নিয়ে গোল হয়ে বসে। ঠাট্টা, ইয়ার্কি, সেলফি, টুকটাক খাওয়া সবই হলো। এর মধ্যে সেই মেয়ে বিন্তির পাশের ফাঁকা চেয়ারে ধপ করে বসে বেশ গপ্পো জুড়ে দিল। অন্য পাশ থেকে কান খাড়া করে ঋক শুনল যে তার ওয়েস্টার্ন ক্লাসিক বেশি পছন্দ। "আমি তো খুব বিটলস শুনি। তোমার কি পছন্দ?" পিকলুর সঙ্গে বব ডিলান, বারবারা স্ট্রেইস্যান্ড আর এলটন জন নিয়ে জমে উঠল তার আলোচনা। প্রচুর বই পড়ে সে। "ছোটবেলায় খুব হ্যারি পটার পড়তাম, এখন মুরাকামি বেশি পছন্দ,"--এক মাথা খোলা চুল ঝাঁকিয়ে ঘোষণা করল রাই।

    সবাই মিলে ফুচকা আর ভেলপুরি খেতে খেতে টুক করে অনাড়ম্বর হাই হ্যালো, বাসস্টপে দেখেছি গোছের কথার মধ্যে দিয়ে আলাপটাও হয়ে গেল ঋকের সঙ্গে। যদিও আমাদের লাজুক ছেলে বেশি কথা না বলে মাথা নাড়িয়ে সায় দিয়েই আলাপের প্রথম পর্ব উতরে দিল। তবে হ্যাঁ, মেয়ের ফুচকায় ঝাল খাওয়া দেখে তো তার চোখ কপালে। ওরে বাবা, এতো একটা গোটা বাগানের লঙ্কা এক বারে মুড়িয়ে খেয়ে নিতে পারে!

    হইহই করে সপ্তমী এসে গেল। পুজোর চারদিন ওরা সবাই প্যান্ডেলেই দু-বেলা ভোগ খায়। রান্না হালুইকর করে কিন্তু পরিবেশন করা আবাসনের কাকু জেঠু আর অল্পবয়সি ছেলেমেয়েদের দায়িত্ব। কখনো কাকিমারাও হাত লাগান। সবাই মিলে পাত পেড়ে খাওয়ার মজাই আলাদা। ঋকের বাবা তো এই সুযোগে নিজেদের ছোটবেলায় যৌথ পরিবারে একসঙ্গে থাকা-খাওয়া আর হরেক রকম মজার গল্প করে সুমধুর স্মৃতিগুলো ঝালিয়ে নেন। ঋকও হাত লাগায় বাবা আর ওর সমবয়সি বন্ধুদের সঙ্গে। বেশ লাগে পাঞ্জাবির হাতা গুটিয়ে ভোগের বালতি নিয়ে পরিবেশন করতে। প্রত্যেক বছর এই ভোগ পরিবেশন করা নিয়েই নানা রকম মজার ঘটনা ঘটে যেইগুলো নিয়ে ওরা সারা বছর ইয়ার্কি মারে। এই যেমন গত বছর লাল্টুকাকুর মোবাইল খিচুড়ির হাঁড়িতে পড়ে গিয়ে সে এক লন্ডভন্ড কাণ্ড। ছেলেরা এক জোট হয়ে হাতা খুন্তি ছানচা যে যা পেয়েছিল তাই দিয়ে গরম খিচুড়ির মধ্যে থেকে সেই মোবাইল উদ্ধার করার চেষ্টা করেছিল।

    আর এই বছর ভোগ পরিবেশন করার ফাঁকে রাইয়ের সঙ্গে আলাপটাও আরেকটু জমে গেল। বিকেলে মণ্ডপের পাশের মাঠে ছোট সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের সূচনা হলো পাড়ার কচিকাচাদের গান দিয়ে। তারপর হলো ফ্যান্সি ড্রেস প্রতিযোগিতা। প্রথমে সবাই শান্ত থাকলেও প্রাইজ দেয়ার পর দেখা গেল খুদে গান্ধী সব্জিওয়ালীর পেন্সিল বক্স হস্তগত করতে রীতিমতো সহিংস হয়ে উঠেছে আর সব্জিওয়ালী ঝাঁসির রানীর মতো পরাক্রম দেখিয়ে বেগুন এবং ঝিঙে নিয়ে লড়ে যাচ্ছে। বাবা-মায়েদের তৎপরতায় এই ঝগড়া বেশিদূর এগোল না। সাহাজেঠু সঠিক সময়ে চকোলেট দিয়ে সবাইকে শান্ত করলেন। সব্জিওয়ালী এবং গান্ধীজি হৃষ্টমুখে চকোলেট নিয়ে বাবা-মায়ের কোলে চড়ে বাড়ির দিকে রওনা দিলেন।

    এরপর বড়দের পালা। সি উইংয়ের কাকিমার গানের সাধা গলা তাই তাঁর পাকা জায়গা এই সব অনুষ্ঠানে। তবে এবারে কিন্তু ওঁকে যোগ্য সঙ্গত দিলেন আমাদের রাইয়ের বাবা আর তাই “সেদিন দুজনে দুলেছিনু বনে” জমিয়ে দিল সপ্তমীর রাত।

    অষ্টমী মানেই একটা জাঁকজমকপূর্ণ ব্যাপার। নানা রঙের ঢাকাই শাড়ি, সঙ্গে মানানসই গয়না, মাথায় ফুলের মালায় বঙ্গললনারা প্যান্ডেল কাঁপিয়ে দিচ্ছেন। তাঁদের পুরুষ সঙ্গীরাও কম যান কেন? তাই নানা রঙের এবং ডিজাইনের পাঞ্জাবি, রঙিন ধুতিতে বাঙালি পুরুষ ফ্যাশন স্টেটমেন্ট দিতে ব্যস্ত। এর ফাঁকে টুক করে ঋক রাইয়ের পাশে দাঁড়িয়ে যায় অঞ্জলি দিতে। রাই আজ ছিমছাম নীল তাঁতের শাড়িতে মোহময়ী। আর ঋক তার পছন্দের কমলা পাঞ্জাবি পরেছে। মা বলে ওকে নাকি এই রংটা দারুণ মানায়।

    অঞ্জলির পর ঋকই কথা তুলল, "কিরে যাবি নাকি ঠাকুর দেখতে?" রাই বেশ উৎসাহী হয়েই ওর সঙ্গে যেতে রাজি হলো। ওদের পাশের আবাসন আর পাড়ার কয়েকটা প্যান্ডেল দেখার প্ল্যান করল ওরা। রাই নতুন এই পাড়ায়, তাই ওর খুব ইচ্ছে এখানকার পুজোর "ফিল" নিতে। আর যতই হোক পুজোর সময়ে প্যান্ডেল হপিং করে সেলফি তুলে সোশ্যাল মিডিয়ায় ফটো না দিলে কি আর বন্ধু সার্কলে ওর মান থাকবে?

    কিন্তু বিধি বাম। বেরোনোর মুখে পিকলু, বিন্তি, সৌম্য, আর টুপাই এসে হাজির। অগত্যা সদলবলে বেরোনো হলো চারপাশের ঠাকুর দেখতে। দিনটা মন্দ কাটল না। সবার ভিড়ে লুকোচুরি করে রাইয়ের সঙ্গে কথা, পাশে পাশে হেঁটে যাওয়া। হাতের চুড়ির রিনিঝিনি, চুলের ঝাপটানি, আর মিষ্টি একটা গন্ধ ঘিরে থাকল ঋককে সারাক্ষণ।

    ঋক কো-এড স্কুলে পড়েছে, মেয়েদের নিয়ে আলাদা করে কোনো রহস্য ও বোধ করে না। ছোট থেকে অনেক মেয়ে বন্ধু ওর। কিন্তু এই পুজোর সময়ে চেনা মেয়েদের শাড়িতে, গয়নায়, সলাজ হাসিতে, হংসিনীর মতো হেঁটে যেতে দেখতে ওর বেশ লাগে। কমপ্লিট মেকওভার। এটা বোধহয় শুধু মেয়েদের পক্ষেই সম্ভব। আর হয়তো শাড়ির মতো একটা ভার্সাটাইল পোশাকের অবদান এই মেকওভার-এর পেছনে সব চেয়ে বেশি। তবে অন্য বারের মতো ঋক আর নিজের মনে দার্শনিক আলোচনায় ডুবে গেল না। ও রাইয়ের সঙ্গ উপভোগ করতে চাইছিল, পুজোর এই চারদিনের ছোট্ট অবসরটাকে মনের মাধুরী মিশিয়ে সুন্দর করে গড়ে তুলতে চাইছিল। ও জানে হাজার চেষ্টা করলেও এই পরিবেশ বা সুযোগ সারা বছরে আর পাওয়া যাবে না।

    অষ্টমীর সন্ধ্যা মানেই ঘ্যাম ব্যাপার। ঠাকুর দেখে ফিরতেই বোস-কাকিমা ওদের ধরলেন, "কিরে, তোদের আজকের প্ল্যান কী? কিছু বলছিস না কেন? ফাংশনে কী করবি?” ওরা তো কেউ মুখ খোলে না, "না কাকিমা, আজকে সাসপেন্স। রাতে চমকে দেব।"কাকিমা হেসে বললেন, "ভালো তো, তবে গতবারের মতো চমকিয়ো না।" শুনে একটা হাসির ছররা উঠল। আসলে গতবার ফাংশনে কেলেঙ্কারি হয়েছিল। সৌম্য ডায়ালগ ভুলে যাওয়াতে বিন্তি স্টেজের পাশ থেকে একটু বেশিই জোরে সৌম্যর গলা নকল করে প্রম্প্ট করে আর সেই নিয়ে দর্শকরা খুব হাসাহাসি করেছিল।

    অষ্টমী বলেই বোধহয় মাঠে একটু বেশি ভিড়। সবাই উৎসাহিত আজকের ফাংশন নিয়ে। প্রথমেই চমক--একটা ছোট নাটক করল ছোটরা প্লাস্টিক-দূষণ বন্ধ করার আর্জি নিয়ে। এর পর আরেকটু বড়দের পরিবেশনা, মজার নাটক - পুজোর গল্প। এই পাড়ারই পুজো কমিটির বিভিন্ন সদস্য এবং তাঁদের ভাবভঙ্গি নকল করে দিব্ব্যি গপ্পো ফেঁদেছে ওরা। অনেকেই নিজের ক্যারিকেচার দেখে আহ্লাদিত হলেন, একে অপরকে নিয়ে মজা করতেও ছাড়লেন না। রাইয়েরবাবা-মাও দিব্যি এই ভঙ্গিমা নকল করা দেখে অনেককে বেশ চিনতে পারলেন। এই সুযোগে সবার সঙ্গে ওঁদের আলাপও হয়ে গেল।

    নাটকের পর ওরা ফিউশন মিউজিকের একটা অনুষ্ঠান প্ল্যান করেছিল। শুরু হলো পুরোনো পুজোর গান দিয়ে-- “এক এককে” দিয়ে শুরু করে “আজি শঙ্খে শঙ্খে মঙ্গল গাও” হয়ে ওরা পৌঁছল স্বর্ণযুগের গানে। “ও মোর ময়না গো,” “ধিতাং ধিতাং বোলে,” "যা গেছে তা যাক" থেকে "কফি হাউসের সেই আড্ডাটা আর নেই"-- এই লম্বা সফরে ওদের সঙ্গে সমানে বড়োরা তাল মিলিয়ে গেলেন। বয়স্করা যখন নিজেদের সোনালি দিনের স্মৃতিতে বুঁদ ওরা টুক করে ঢুকে পড়ল নতুন দিনের গানে। “তখন তোমার একুশ বছর বোধহয়”-এর সুরের ধারায় মিশে গেল সুমনের “এক কাপ চায়ে আমি তোমাকে চাই।” অনুপমের “আমার চোখে ঠোঁটে গালে তুমি লেগে আছো”-র সঙ্গে দিব্ব্যি মিশ খেল “যখন কেউ আমাকে পাগল বলে”। সে এক অভূতপূর্ব দৃশ্য। ঝাঁকড়া চুলের পিকলুর সঙ্গে বিরলকেশ সত্তরোর্ধ ব্যানার্জী-জেঠু শ্যামল মিত্রের গানে মাতোয়ারা হয়ে মাথা দুলিয়ে তাল দিচ্ছেন। অনুষ্ঠানের শেষের দিকে বাঁধ ভাঙল যখন সবাই নিজের মতো করে এই গানের ভেলায় পাড়ি দিলেন। রাইয়ের “ভেঙে মোর ঘরের চাবি”-র তালে কাকিমারা খোলা মাঠে হাততালি দিয়ে নাচ শুরু করলেন। যে বোস-কাকিমা সাহা-জেঠিকে আড়ালে ন্যাকা বলেন তিনি সাহা-জেঠির হাত ধরেই ঘুরে ঘুরে নাচলেন।

    এভাবেই অষ্টমীর রাত মিলিয়ে দিল এই প্রজন্মের সঙ্গে গত প্রজন্মকে, ভেঙে দিল জেনারেশন গ্যাপ নামক সেই অদৃশ্য দেয়াল। এ ভাবেই আমাদের জীবনের প্রবাহ চলে, মিলে-মিশে এক হয়ে, সবার রঙে রং মিশিয়ে সবার সঙ্গে হর্ষ ভাগ করে নিয়ে।

    নবমী মানেই আনন্দ আর দুঃখের এক অদ্ভুত সংমিশ্রণ। হাসি-ঠাট্টা, অঞ্জলি দেওয়া, আর পুজোর হাজারো ব্যস্ততার মধ্যেও মনের কোণে উঁকি দিয়ে যায় বিসর্জনের ভাবনা। ঢাকও যেন বিষণ্ণ তালে বাজে। সবাই ভুলে যেতে চায় যে রাত পোহালেই বিসর্জন আর তাই আরো আঁকড়ে ধরে দিনটাকে। প্রত্যেক মুহূর্ত থেকে নিংড়ে নিতে চায় আনন্দ। উজাড় করে দিতে ইচ্ছে করে মন।

    আপনারা কী ভাবছেন, ঋক আর রাইয়ের কথা ভুলে গেছি। না না, আমাদের গল্প তো ওদের ঘিরেই।

    আমাদের প্রত্যাশামতো ঋক আর রাইয়ের বেশ ভাব হয়ে গেছে। ফোন নাম্বার আদান-প্রদান হয়েছে, ফেসবুকে ফ্রেইন্ডও হয়ে গেছে ওরা। ঋক রাইয়ের কাছ থেকে মুরাকামির বই ধার করে এনে পড়তে শুরু করেছে আর রাই ওর জীবনানন্দকে নিয়ে ভাবনাচিন্তাগুলো মন দিয়ে শুনছে। সন্ধ্যে বেলার ফুচকা খাওয়ার প্রতিযোগিতায় ও ওপেন চ্যালেঞ্জ দিয়েছে ঋককে। বেশ টেনশানে আছে ঋক এই নিয়ে। হেরে গেলে মানইজ্জত নিয়ে টানাটানি পড়ে যাবে পাড়ায়।

    নবমীর সকালে ঋকরা দুঃস্থ্ এবং পথশিশুদের মধ্যে বই আর জামাকাপড় বিলি করল। বাচ্চারা ওদের সঙ্গে অঞ্জলি দিল, ভোগ খেল। কচিকাঁচাদের কোলাহলে মুখর হল প্যান্ডেল। পাশের আবাসন থেকেও অনেকে যোগ দিলেন এই আনন্দযজ্ঞে। ওদের নিষ্পাপ মুখগুলো যখন নতুন জামা পেয়ে ঝিকিয়ে উঠল, অনেকে অপার বিস্ময়ে বইগুলো উল্টে-পাল্টে দেখছিল, তখন মনে হল ওদের খুশির ছোঁয়ায় মা দুর্গার মুখ ঝলমলিয়ে উঠেছে।

    নবমীর দুপুরে আবার স্পেশাল মেনু থাকে। পাঁঠার মাংস, পোলাও, চাটনি, আর পায়েস। কব্জি ডুবিয়ে খাওয়া যাকে বলে। খাওয়াদাওয়াটা এলাহি হওয়ার ফলে সন্ধ্যেবেলায় সবাই একটু দেরিতে মণ্ডপে এল। আর অদ্যই শেষ রজনী, তাই কারুর কোনো তাড়া নেই, সবাই মনে মনে চাইছে সময়ের চাকা যেন ধীরে চলে। আর নবমীর নিশি বলেই সবার সাজে বিশেষ ছোঁয়া। কেউ পরেছেন চান্দেরি তো কেউ বালুচরি। ঋক সেই এক কমলা রঙের পাঞ্জাবি পরল বলে মায়ের কাছে বকাও খেল। কী করে মাকে বোঝাবে যে রাই বলেছে এটা পরলে ওকে হ্যান্ডসাম লাগে!

    সন্ধ্যেবেলা আরতির পর সবাই তৈরি নবমী স্পেশাল এর জন্য - ওদের ধুনুচি নাচের অনুষ্ঠান এই অঞ্চলে বিখ্যাত।

    শুরু করলেন বয়স্করা ঢিমে তালে। এর পর যোগ দিল কাকিমা এবং কাকুরা। ঢাকের বোলে উত্তেজনার পারদ চড়ছে আর সবার পা তাল দিচ্ছে। দু-হাতে ধুনুচি নিয়ে ব্যানার্জি-জেঠুর নাচ শুরু হলো। আর থাকতে না পেরে তাঁর সঙ্গে ছোটরাও নেমে পড়ল ধুনুচি নিয়ে। যে যার মতো করে ধুনুচি নিয়ে নেচে চলেছে।

    এরই মধ্যে নবমীর আরতি শুরু হলো। ধূপের গন্ধে, ঢাক আর কাঁসরের আওয়াজে, ধুনুচির ধোঁয়ায়, মণ্ডপে এক আলো-আঁধারি পরিবেশ। সবার মুখ ঘামে আর খুশিতে চকচক করছে, আর এই সবকিছুর ওপর ভেসে উঠেছে মায়ের দুখানি চোখ। তিনি এখন অসুরদলনী নন, আটপৌরে মা, যিনি সন্তানের জন্য সদাচিন্তিত। মায়ের চোখ থেকে তাই রাগ নয়, ঝরে পড়ছে ভালোবাসা আর আশীর্বাদ - বরাভয় দিচ্ছেন তিনি - তোরা ভালো থাকিস।

    না চাইতেও দশমী এসে গেল। সবার চোখে বিচ্ছেদের ছায়া। ঢাক বেজে চলেছে, "ঠাকুর থাকবে কতক্ষণ, ঠাকুর যাবে বিসর্জন।” সকালে অঞ্জলি হলো, হোম-যজ্ঞ, খাওয়াদাওয়াও, কিন্তু কারুর যেন আর উৎসাহ নেই। পুজো কমিটির কর্তারা পরিশ্রম আর কাজের চাপের দোহাই দিলেও সবাই জানে কেন এই বিষন্নতা। আজ যে মা চলে যাবেন!

    কলেজ পড়ুয়ার দল নিজেদের মধ্যে গ্রুপ বানিয়ে শেষ বারের মতো মাঠে বসে আড্ডা দিল, প্রচুর ফটো তোলা হল আর শেষ চারদিনের নানা ঘটনা নিয়ে নিজেদের মধ্যে লেগ পুলিং করল। ছোটরা তো বন্দুক নিয়ে ক্যাপ ফাটানোয় ব্যস্ত। ওদেরই বোধহয় দুঃখবোধ কম। পুজোর ছুটি শেষ হলেই যে পরীক্ষা সে নিয়েও ওদের মাথাব্যথা নেই।

    বিকেলে বরণ হল, সিঁদুর খেলাও, ছেলে-মেয়েগুলো নিজেদের মতো করে মাকে প্রণাম জানিয়ে যার যা মনোবাঞ্ছা মায়ের কানে কানে বলল। ঋক কি ব্যাঙ্গালোরের বিখ্যাত আই টি কোম্পানিতে চাকরিটা পাবে? কী চাইল ও মায়ের কাছে? কেন বারবার রাইয়ের দিকে তাকাচ্ছিল? আজ আর রাই বেশি কথা বলছে না। চুপ করে দুর্গা ঠাকুরের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। জীবনে প্রথম ও এইভাবে পুজোয় অংশগ্রহণ করল, এত নতুন বন্ধু হল ওর। পুরোনো পাড়া ছেড়ে আসার জন্য আর কষ্ট হচ্ছে না তেমন। ও এখানে মানিয়ে নিতে শিখছে। মনটা ভরে আছে, তবুও কোথাও একটা ফাঁকা ফাঁকা ভাব, কেন কে জানে!

    সন্ধ্যে নামল। মাকে বিদায় দেওয়ার পালা এবার। ওরা সবাই বেরিয়ে পড়ল ট্রাকের পেছনে ভাসান দিতে। দূর থেকে দেখা যেতে থাকে ওদের, পায়ে পা মিলিয়ে ঋক, রাই, সৌম্য, পিকলু, আর বিন্তিরা চলেছে মাকে শেষ পথটুকু এগিয়ে দিতে।

    কী ভাবছেন, ঋক আর রাইয়ের গল্পের কী হল? আচ্ছা বলুন তো, সব গল্প কি পুজোর সঙ্গে সঙ্গেই শেষ হয়ে যায়? থেকে যায় না রেশ? ওদের গল্প হয়তো তেমনি। পরের বছর রাই চলে যাবে দিল্লি, ঋকহয়তো চাকরি পাবে বেঙ্গালুরুতে। যোগাযোগ থাকবে ফেসবুক আর টুইটারে। হয়তো পরের বছর পুজোর সময়ে ওরা ঘরে ফিরবে, এই শহরের টানে, মায়ের টানে। আর নিজেদের ভেতরের টানটুকুও বুঝে নেবে। ওদের গল্প চলবে, ঠিক যেমন আপনাদের অনেকের গল্প পুজোয় শুরু হয়েও এখনো শেষ হয়নি।



    অলংকরণ (Artwork) : অলংকরণ : রাহুল মজুমদার
  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments