• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৮৫ | জানুয়ারি ২০২২ | গল্প
    Share
  • ত্রাণ ট্যুরিজ়ম : সিদ্ধার্থ মুখোপাধ্যায়



    প্রলয় ল্যাপটপের ডালা খুলে বসেছিল। মোবাইল ফোনের হটস্পট থেকে ল্যাপটপ কানেক্ট করে মেল চেক করল। প্রোফেসর সোম তাড়া দিচ্ছেন থিসিস লেখার জন্য। সেজন্য রেফারেন্সগুলো ডাউনলোড করা দরকার। দুর্বল নেটওয়ার্ক, কখন উদয় হয়, কখন নিজের ইচ্ছা মত বিদায় নেয়, তার ঠিক নেই। একটানা কাজ করা এক রকম অসম্ভব। আপাতত গত চার-পাঁচ বছরের কাজগুলোকে গুছিয়ে এক জায়গায় তুলে রাখছে প্রলয়। কলকাতা ফিরে গিয়েই ড্রাফট থিসিস লেখায় হাত দেবে। মোবাইলটা দু’-বার রিং হয়ে কেটে গেল। প্রলয় চোখের কাছে তুলে দেখল কমলের মিসড কল। ঘরের মধ্যে থেকে চেঁচিয়ে বলল, “হাসি, যাওয়ার সময় বারান্দার আলোটা নিভিয়ে দিয়ে যাস।”

    মেয়েটার নাম হাসিনা, মুসলমান পাড়ায় থাকে, প্রলয় ডাকে হাসি। সবার রাতের খাওয়া হয়ে গেলে হাসি বাসনপত্রগুলো এক জায়গায় গুছিয়ে রেখে বাড়ি যায়। স্কুলটা চরের শেষপ্রান্তে। আদিবাসীদের বস্তি পেরিয়ে মুসলমান পাড়া, তারপর হিন্দুদের। লোকবসতি শুরু হওয়ার পর থেকে নয়-নয় করে এই দোখনের চর অন্তত খান দশেক নির্বাচনী প্রচার দেখে ফেলেছে। প্রতি নির্বাচনের আগেই রাজনৈতিক দলগুলো বৈদ্যুতিকরণের মুলো দেখিয়ে যায়। গত নির্বাচনের আগে অবশ্য রাজ্য-সরকার তাড়াহুড়ো করে পোল গেড়ে, তার ঝুলিয়ে ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছে দিয়েছিল। নির্বাচন কাটতে না-কাটতেই ঝড়ের প্রকোপে সেসবের দফারফা হয়েছে। গলায় তার জড়িয়ে অর্ধেক পোল মুখ থুবড়ে পড়েছে। হিন্দু, মুসলমান সব পাড়াই বিদ্যুৎ-হীন। আক্ষরিক অর্থে, মানুষ যে তিমিরে ছিল সেই তিমিরেই।

    সে-ও হয়ে গেল প্রায় মাসখানেক। ভোটের চাপ নেই, বিদ্যুৎ-পর্ষদ গড়িমসি করে এতদিনে সবে এই স্কুলবাড়িটায় বিদ্যুৎ-সংযোগ পুনর্বহাল করেছে। লকডাউনের জন্যে স্কুলের কাজকর্ম বন্ধ, দিনের বেলা স্কুলবাড়ির বাঁধানো চত্বরেই ‘কম্যুনিটি কিচেন’ চালায় প্রলয়। বাচ্চা ছেলেমেয়েগুলোও বাপ-মায়েদের সঙ্গে রান্নাবান্না যোগাড়পাতিতে হাত লাগায়। অন্তত একবেলার ভরপেট খাওয়া নিশ্চিত। প্রলয় নিয়ম করে দিয়েছে সন্ধেবেলা পড়তে এলে রাতের খাওয়াটাও জুটবে। তাই অন্ধকার নামতে না-নামতে ক্লাসঘরের সামনের টানা বারান্দায় ঝুলপড়া বাল্বের ম্যাড়মেড়ে হলুদ আলোর নিচে বাচ্চাগুলো বই খুলে বসে পড়ে। প্রলয় টুকটাক অঙ্ক দেখিয়ে দেয়, পড়া বুঝিয়ে দেয়। তারা উসখুস করে, জুলজুল করে বারবার ঢাকনা দেওয়া তরকারির ডেকচির দিকে তাকায়।

    ইউনিভার্সিটিতে হাজিরা দেওয়ার বাধ্যবাধকতা নেই। পাঁচ মাস হয়ে গেল পিএইচডির কাজ শিকেয় তুলে প্রলয় মালতীবালা প্রাইমারি স্কুলের একটা ক্লাসঘরে তক্তাপোষের ওপর ম্যাট্রেস বিছিয়ে পড়ে আছে। নিত্যানন্দ সাঁপুইয়ের বদান্যতায় নদীর ধারে একতলা স্কুলবাড়ি। মাঝিমাল্লাদের বস্তি নদীর পাড় ঘেঁষে, স্কুলের পিছন দিকে ফাঁকা জঙ্গুলে জমি, মাছের ভেড়ি। ভেড়ির মালিক নিত্যানন্দ থাকে বাসন্তীতে, তারই মায়ের নামে স্কুল। সরকারি অর্থানুকূল্য যা আসে তার কতটা নিত্যানন্দর পকেটে ঢোকে আর কতটা কর্মীদের, তার হিসেব খুব একটা সরল নয়। ফলত গত পাঁচ মাসে শিক্ষক থেকে করণিক কেউই বিশেষ এমুখো হয়নি। একমাত্র দারোয়ান সন্তোষ রয়ে গেছে, বেচারার অন্য কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই বলে। সে কাছেই থাকে, দরকারে-অদরকারে হাজিরা দেয়।

    কমল অবশ্য গাঁটের কড়ি খর্চা করে, নৌকো ভাড়া নিয়ে বার দুয়েক ঘুরে গেছে। হেডমাস্টার কমলবিকাশ সাধুখাঁ প্রলয়ের ছোটবেলার বন্ধু, নিত্যানন্দর দূর সম্পর্কের ভাইপো। বহুদিন যোগাযোগ ছিল না। বছর তিনেক আগে কোলকাতা বইমেলায় দেখা হয়েছিল। পৃথিবীতে ‘দোখনের চর’ বলে যে একটা জায়গার অস্তিত্ব আছে সে কথা তার মুখেই প্রলয় জানতে পারে। কমল সজনেখালিতে বাসা নিয়ে থাকত। অতিমারীর আগে পর্যন্ত সেখান থেকেই লঞ্চে যাতায়াত করে চাকরি করত। জেটি নেই বলে লঞ্চ অবশ্য দোখনের চর পর্যন্ত আসে না। শেষদিকে কিছুটা নৌকোয় আসতে হয়। ভাঁটি থাকলে প্যান্ট গুটিয়ে কাদা ভেঙে পাড়ে উঠতে হয়। লকডাউন হবার পর কমল প্রলয়কে ফোন করে বলেছিল, “বাচ্চাগুলোর জন্য কিছু করতে পারিস? বেচারাদের মিড-ডে মিলটাও বন্ধ হয়ে গেল।”

    প্রলয় জিজ্ঞেস করেছিল, “তুই থেকে যাচ্ছিস না কেন?”

    কমল বলেছিল, “আমার দম নেই রে। তাছাড়া মা-বুড়িকে কে দেখবে? সকালে কোথাও গেলে ডায়াপার পরিয়ে বেরোতে হয়। দিনের বেলাটা একটা কাজের মেয়ে কোনওমতে সামলে দেয়। রাত্তিরে না ফিরলে মুশকিল।”

    ‘কম্যুনিটি কিচেন’ চালানোর খরচাপাতি সংগঠন জোগায়। লকডাউনের মধ্যেও নিয়মিত চাল, ডাল, কাঁচা আনাজ, মশলাপাতির সরবরাহে কখনও ঘাটতি পড়েনি। পাহাড় থেকে খাঁড়ি পর্যন্ত পুরো পশ্চিমবঙ্গেই সংগঠনের স্বেচ্ছাসেবীরা উদয়াস্ত কাজ করে চলেছে। প্রলয়ের দায়িত্ব হল তদারকি করা। সবকিছু ঠিকঠাক চলছে কি না নজর রাখা। তাতেও পরিশ্রম কম নয়। সুষম বন্টনের বিষয়টা মানুষের মাথায় ঢোকাতেই মাথার ঘাম পায়ে পড়ে যায়। আধপেটা খেয়ে দিনাতিপাত করা এই মানুষগুলোকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। দরকার থাক বা না-থাক, মানুষ প্রজাতির বিটকেল মগজটাই তৈরি হয়েছে বেঁচে থাকার জন্য রসদ মজুত করতে। কখন কী কাজে লাগে কে বলতে পারে! সঞ্চয় জরুরি।

    কানের গোড়ায় একটা মশা ভনভন করছে। প্রলয় হাত নাড়ল। এখানকার একেকটা মশা ছোটখাটো পাখির সাইজের। রাতে মশারি টাঙিয়ে না শুলে আট-দশটা মশা অনায়াসে একটা মানুষকে চ্যাংদোলা করে তুলে নিয়ে যেতে পারে, সকালে ভেড়ির ধারে ঘুম ভাঙবে। ফোনটা আবার বাজল। কমল। বলল, “কাল আসছি রে, সঙ্গে দু’জন গেস্ট আসবে। আমি ফিরব, ওরা থাকবে। তোর পাশের ঘরটা সাফ-সাফাই করিয়ে রাত্তিরে শোবার বন্দোবস্ত করে রাখিস। সন্তোষকে বলিস বালিশ, গদি, তক্তাপোষ জোগাড় করে এনে দেবে।”

    প্রলয় অবাক হল, এই সময় গেস্ট! তাও এই ধ্যাদ্ধেড়ে গোবিন্দপুরে? জিজ্ঞেস করল, “কারা? তোর সেই নেত্যকাকুর চেনাজানা নাকি?”

    কমল বলল, “না, না, আমারই বন্ধু। জেভিয়ারে পড়ছি যখন... জানিসই তো পকেট ঢনঢন, বিপু মানে বিপ্রদাসের ঘাড় ভেঙে টিফিন করতাম প্রায় দিনই। ও অবশ্য কিছু মনে করত না। বড়লোকের ব্যাটা, বয়সেও আমাদের থেকে কিছুটা বড়। এখন শখ চেপেছে বাদাবনে দাতব্য করার। তাই আমাকে ধরেছে। ছোট হাতি বোঝাই করে কম্বল নিয়ে আসছে। সঙ্গে গার্লফ্রেণ্ড। আসল ধান্ধা ত্রাণ ট্যুরিজ়ম, বকলমে সুন্দরবন দর্শন।”

    প্রলয় একটু বিরক্ত হল, নতুন উপদ্রব। বলল, “ক’দিন থাকবে?”

    কমল বলল, “জানি না, ঠিক করে কিছু বলেনি। তবে ওই গড ফোরসেকেন জায়গাটায় দেখবার মতন আছেটাই বা কী? হাসি-হাসি মুখ করে দান-ধ্যানের ফটো তুলতে, ধরে নে বড় জোর দিন দুই-তিন, তার মধ্যেই নির্ঘাত রস শুকিয়ে যাবে।”

    শীত পড়তে শুরু করেছে। ট্যুরিজ়িম-মুরিজ়িম যাই হোক, কম্বলগুলো কাজে আসবে। প্রলয় ভাবল, আসুক না, ক্ষতি কী! চালচুলোহীন মানুষগুলোর যদি উপকার হয়।

    ।।২।।

    বিপ্রদাসের গার্লফ্রেন্ডের নাম শ্রীময়ী। তার গায়ের রং টকটকে ফর্সা, গোলগাল চেহারা। মেয়েটি আদুরে বেড়ালের মত ন্যাকা স্বভাবের। বাংলা সিরিয়ালে বোনের রোল করে। বিপ্রদাসের চেহারা ঠিক উলটো, পোড়া কাঠের মত। আড়ালে-আবডালে বন্ধুরা দু’জনের নামের আদ্যক্ষর মিলিয়ে ওদের জুটিকে ‘বিশ্রী’ বলে ডাকে। কানে এলেও বিপ্রদাস গায়ে মাখে না। সে জানে পকেটে যতদিন পয়সা আছে শ্রীময়ী থেকে ধীময়ী সব সুন্দরী মেয়েরাই তাকে প্রশ্রয় দেবে, সেটাই জগতের নিয়ম। নৌকো থেকে নামার সময় বিপ্রদাসের পা টলে গেল। কমল ধরে না ফেললে কাদার ওপর মুখ থুবড়ে পড়ত। সকাল-সকাল গদখালি পর্যন্ত উজিয়ে বিপ্রকে আপ্যায়ন করে আনতে গিয়েছিল কমল। লকডাউনে ভিড় কম, আপত্তি করার মত লোক নেই, গদখালিতে লঞ্চে চড়ার পর থেকেই বিপ্রদাস ঢুকুঢুকু চালাচ্ছিল। তাকে লঞ্চ থেকে নৌকায় ‘ট্রান্সফার’ করার সময় যথেষ্ট বেগ পেতে হয়েছে। নেহাত চেনা নৌকো, কম্বলের বস্তাগুলোর সঙ্গে সবান্ধবী বিপ্রদাসকে ঠেলেগুঁজে নৌকোয় তুলতে সনাতন মাঝি হাত লাগিয়েছিল।

    প্রলয়ের পাশের ঘরে বিপ্রদাসদের থাকার বন্দোবস্ত করে রেখেছিল সন্তোষ। তক্তাপোষের ওপর কাপাসের গদি পেতে, পরিষ্কার চাদর বিছিয়ে বিছানা তৈরি করে রেখেছিল। বিপ্র ঘরে ঢুকেই তার ওপর কাদামাখা জুতো সুদ্ধু পা তুলে শুয়ে পড়ল। কিছুক্ষণের মধ্যেই এত জোরে তার নাক ডাকতে লাগল যে বারান্দা থেকেও শোনা গেল। কমল হাসিকে ডেকে বলল, “যা, গিয়ে দেখ একবার, ম্যাডামের কিছু লাগবে কি না।”

    হাসি এবং আরও দু’-একজন সামনের বছর মাধ্যমিক দেবে। মেয়েটা পড়াশুনোয় ভাল। কমল প্রলয়ের কাছে খোঁজ নিচ্ছিল ছেলেমেয়েগুলো ঠিকমত তৈরি হচ্ছে কি না। অবশ্য পরীক্ষা যে হবেই তার কোনও নিশ্চয়তা নেই। বারান্দায় পাতা বেঞ্চিতে বসে দেওয়ালে পিঠ দিয়ে দুই বন্ধু টুকটাক খোশগল্প করছিল। ক্লাসঘরগুলো পাকা, বারন্দার ওপরে করোগেটেড লোহার পাতের ছাউনি। সদ্য দুপুরের রোদ বাঁকা হয়ে এসে পড়ছিল ওদের পায়ের পাতায়। শ্রীময়ী এসে সামনে দাঁড়ালো, মুখ-চোখ ধুয়ে, চুল আঁচড়ে এসেছে। বলল, “কমলদা, তোমাদের চরে বুনো জন্তু-জানোয়ার আসে না?”

    কমল বলল, “সাপখোপ আছে, দু’-চারটে শেয়ালও আছে, সন্ধের দিকে দলবেঁধে হাঁক পাড়ে কখনও-সখনও।”

    শ্রীময়ী ভুরু বাঁকিয়ে চোখ ঘুরিয়ে বলল, “আর বাঘ? বাঘ নেই?”

    “তারা সচরাচর এদিকে আসে না।দক্ষিণ রায়ের খাস তালুক হল কোর এরিয়া। বাঘ দেখতে হলে তোমাদের পারমিট নিয়ে সেখানে যেতে হবে। ভাগ্য ভাল হলে দর্শন পাবে,” কমল হেসে বলল। প্রলয়দেখল, শ্রীময়ী হতাশ হল। সুন্দরবনে এসে বাঘের কাঁধে হাত রেখে ছবি তুলে না নিয়ে গেলে লোকে কী বলবে? ফিরে গিয়ে আত্মীয়-স্বজনের মুখ দেখাবার জো থাকবে না।

    বিপ্রদাসের যখন ঘুম ভাঙল বেলা গড়িয়ে রোদ ঝিমিয়ে পড়েছে। বিশেষ অতিথিদের খাতিরে আজ মাছের দু’তিন রকম পদ রান্না হয়েছে। প্রথম পাতে লাউ-চিংড়ি, তারপর মুগ ডালের সঙ্গে চুনো মাছ ভাজা, মধ্যিখানে মুখ বদলানোর জন্য যগ্যি-ডুমুরের ডালনা, শেষে ভাঙন মাছের ঝোল। এ অঞ্চলে ডুমুর, লাউ পাওয়া দুষ্কর। কমল গদখালির কোন বেপারিকে বলে কোলকাতা থেকে আনিয়েছে। একটু মুখবদল।

    অবশ্য মাছের অবস্থাও সঙ্গিন। গত কয়েক বছর নদীনালা থেকে পরিমাণ মত মাছ উঠছে না। উষ্ণায়নের কারণে মাছের ঝাঁক গভীর জলে চলে যাচ্ছে। প্রজননের সময় বদলে যাচ্ছে। বোঝার ওপর শাকের আঁটি - প্রশাসনের নির্লিপ্তিতে নদীর জলে মিশে যাচ্ছে তীরবর্তী কল-কারখানার অশোধিত বর্জ্য। শুধু সুন্দরবনে নয় প্রলয় খবরের কাগজে পড়ছিল, অন্ধ্র উপকূলেও মাছের অভাবে জেলেদের গ্রাম খালি হয়ে যাচ্ছে। এখন অবশ্য লকডাউনের কল্যাণে কল-কারখানা বন্ধ, দূষণ কিছুটা কম। মাছেরা ফিরে আসতে শুরু করেছে। নৌকো নিয়ে বেরোলে মাছ হয়তো উঠবে। কিন্তু সে মাছ কিনবে কে? কোলকাতায় চালান প্রায় বন্ধ। পচা মাছ ফেলে দিতে হবে। সে আর এক ঝামেলা।

    বিপ্র যা খেল তার থেকে ছড়াল বেশি। এই রকম অপচয় দেখলে প্রলয়ের গা রি-রি করে। অন্য কেউ হলে অন্তত ঝেঁঝে দুটো কথা বলতো, এক্ষেত্রে কিছু করার নেই। খাওয়া-দাওয়ার পর শুরু হল কম্বল বিতরণ এবং আনুষঙ্গিক বাধ্যতামূলক ‘ফটো সেশন’, প্রকৃতপক্ষে কালোকুলো মানুষগুলোর প্রতি করুণা প্রদর্শনের স্মারক সংগ্রহ। শ্রীময়ীর হাবভাব দেখে মনে হচ্ছিল আউটডোর শ্যুটিং করতে এসেছে। দানপর্ব সাঙ্গ হলে কমল বলল, “এবার আমি যাই রে। ফিরতে ফিরতে রাত হয়ে যাবে।”

    কমলকে নৌকোয় তুলে দিয়ে এসে প্রলয় দেখল বিপ্রদাস আবার তক্তাপোষের ওপর লম্ববান হয়েছে আর শ্রীময়ী মোবাইল নিয়ে খুটখাট করছে। তাকে দেখে বলল, “ও প্রলয়দা, তোমাদের এখানে নেটওয়ার্ক পাওয়া যায় না কেন? ছবি পোস্ট করতে পারছি না যে।”

    প্রলয় বলল, “নদীর ধারে এক জায়গায় ভাল নেটওয়ার্ক ধরে, কাল সকালে তোমায় নিয়ে যাব। তখন না-হয়… এখানে বসে ছবি আপলোড করতে বছর ঘুরে যাবে।”

    শ্রীময়ী হাল ছেড়ে দিয়ে বসে পড়ল।

    সন্ধে ঘন হতে না হতেই বিপ্রদাস পুনর্বার বোতল খুলে বসল। সঙ্গে করে কার্ডবোর্ডের বাক্স ভরে জ্বালানি নিয়ে এসেছে। সপ্তাহ খানেকের আগে তার ভাণ্ডার শেষ হবে বলে মনে হয় না। প্রলয় বারান্দা থেকে শুনতে পেল বিপ্র স্খলিত গলায় গান ধরেছে - সুন্দরী গো, দোহাই, দোহাই, মান কোরো না… তার নেশা চড়ছে। ছেলেমেয়েগুলো মুখ চাওয়া-চাওয়ি করছিল। তাদের আজ তাড়াতাড়ি ছুটি দিয়ে দিল প্রলয়। তারা হুল্লোড় করতে করতে রাতের খাওয়া শেষ করে পালাল। এমন সুযোগ রোজ আসে না। স্কুলবাড়ি নিস্তব্ধ হয়ে এলে প্রলয়কে কাছে ডেকে, কথাটা পাড়ল বিপ্রদাস, “ভায়া, তোমাদের সনাতন মাঝিকে বলো না, একদিন কোর এরিয়ায় নিয়ে গিয়ে বাঘ-টাঘ দেখিয়ে আনতে।”

    হাজারবার বোঝালেও এরা বুঝবে না, ব্যাপারটা অত সহজ নয়। প্রলয় উঠে আসছিল। তার হাত ধরে টেনে বসিয়ে বিপ্র বলল, “আসলে বুঝলে কিনা তোমাদের এই বোনটির খুব শখ… সুন্দরবনে এসে বাঘ না দেখে ফিরে যাবে?”

    প্রলয় ভাবল, বলিহারি শখ! আর এতই যদি শখ পারমিট নিয়ে আসতে পারত। মুখে বলল, “পারমিট ছাড়া ফরেস্ট ডিপার্টমেন্ট কোর এরিয়ায় যেতে দেয় না। তাছাড়া দেখব বললেই তো বাঘ সেজেগুজে এসে সামনে দাঁড়াবে না।”

    বিপ্র চোখ টিপে বলল, “আরে ভায়া, পারমিশন-ফিশন নিতে তো অনেক টাইম লাগবে। লকডাউনের মধ্যে পাওয়া যাবে কিনা ভগাই জানে। অন্য উপায় বাৎলাও। টাকাপয়সা নিয়ে ভেবো না, যা লাগে দেব। তুমি শুধু যাওয়ার ব্যবস্থাটা করে দাও। কী, পারবে না?"

    প্রলয় কেঠো গলায় বলল, “না।"

    ।।৩।।

    রের দিন সকালে ঘর থেকে বেরিয়ে প্রলয় দেখল শ্রীময়ী বারান্দায় বসে রয়েছে। ওকে দেখেই এক গাল হেসে বলল, “প্রলয়দা, নদীর ধারে নিয়ে যাবে বলেছিলে…”

    প্রলয় বলল, “এক মিনিট, তৈরি হয়ে আসছি। বিপ্র কোথায়?”

    শ্রীময়ী বলল, “সে ভোঁসভোঁস করে ঘুমোচ্ছে। এত সকালে তার ঘুম ভাঙ্গে না।”

    নদীর পাড় ঘেঁষে দু’জনে হাঁটছিল। প্রসাধনহীন শ্রীময়ীকে দেখে আজ অতটা কৃত্রিম লাগছিল না। গতকাল জিনস-টপে ছিল, অন্যরকম দেখাচ্ছিল, আজ সে একটা সাধারণ সালোয়ার কামিজ পরে এসেছে। সকালের রোদ এখনও চড়েনি। শিশির ভেজা গাছগাছালির ফাঁক দিয়ে হলুদ আলো বিচ্ছুরিত হয়ে ইকিড়-মিকিড় আঙুল চালাচ্ছিল শ্রীময়ীর পিঠে বুকে। সে গুনগুন করে একটা সুর ভাঁজছিল। একটা খেজুর গাছের নিচে দাঁড়িয়ে প্রলয় বলল, “ট্রাই করে দেখো, পাও কিনা!”

    শ্রীময়ী বোধহয় অন্যমনস্ক ছিল, বলল, “কী?"

    প্রলয় বলল, “কী আবার? নেটওয়ার্ক… কাল বলছিলে ফটো আপলোড করতে পারছ না।”

    “ও হ্যাঁ, তাই তো, দেখি দাঁড়াও,” শ্রীময়ী গিয়ে একটা পাথরের ওপর বসল। ভাঁটির সময়, চার-পাঁচটা নৌকো কাদার ওপর আলগোছে পড়ে রয়েছে। তাদের একটার ভাঙা গলুইয়ের ওপর নিঃসঙ্গ এক মাছরাঙা চুপ করে বসে আছে। সরকারি ত্রাণের কিছু টাকা লোকজনের হাতে এসেছিল ঝড়ে বিধ্বস্ত বাড়িঘর মেরামতের জন্য। কিন্তু নৌকো সারাই ত্রাণের আওতায় পড়ে না। অনেক জেলেই তক্তা-ভাঙা নৌকো ঘাটে বেঁধে বসে আছে, মাছ ধরতে যেতে পারছে না। প্রলয় ভাবল বিপ্রকে একবার বলে দেখলে হয়, যদি কিছু ক্যাশ দিতে পারে।

    এই জায়গাটায় সত্যিই ভাল নেটওয়ার্ক ধরে, টুংটাং করে জমে থাকা নোটিফিকেশন ঢুকছে ফোনে। প্রলয়ও হাতের মোবাইলে চোখ নামাল। দেখল আবহাওয়া দপ্তর ঝড়ের পূর্বাভাস দিয়েছে। বঙ্গোপসাগরে আবার নিম্নচাপ ঘনাচ্ছে। আজকাল ঝড়ের উপদ্রব বেড়ে গেছে। কারণ সেই উষ্ণায়ন। বলা কওয়া নেই, আচমকা চাপ-চাপ মেঘ উড়ে এসে চরাচর অন্ধকার করে দেয়। এলোমেলো হাওয়া দেয়। বৃষ্টি শুরু হয়। সব ঝড়েরই একটা করে জমকালো নাম থাকে। এই ঝড়টার কি এখনও নামকরণ হয়েছে? প্রলয় খুঁজছিল। হঠাৎ তাকে চমকে দিয়ে ক’টা টিয়া পাখি উড়ে গেল ট্যাঁ-ট্যাঁ করতে করতে।

    শ্রীময়ী উঠে দাঁড়িয়ে সেলফি তুলছিল। তার মাথার পিছনে ঝকঝকে নীল আকাশ, মেঘের চিহ্নমাত্র নেই। আবহাওয়া দপ্তর হয়তো ভুল বার্তা দিয়েছে, প্রায়শই দেয়। এমনও হতে পারে ঝড়টা উড়িষ্যার দিকে ঘুরে গেছে।

    “ও প্রলয়দা, জলে নামি একটু?” শ্রীময়ী অনুনয় করে বলল।

    এইসব আদিখ্যেতা দেখলে প্রলয়ের ব্রহ্মতালু চুলকোয়। গম্ভীর হয়ে বলল, “জলে কুমির-টুমির থাকতে পারে, না নামাই ভাল।”

    সাধারণত এদিকের নদীনালায় কুমির আসে না। আসলেও ন’-মাসে, ছ’-মাসে, পথ ভুলে। তবে এই সব শহুরে আদেখলেদের ভয় দেখালে এমন কিছু দোষের হবে না। শ্রীময়ী বলল, “ওরে বাবা…"

    প্রলয় সুযোগ নিল, বলল, “কথায় বলে বাদা অঞ্চলে ‘জলে কুমির, ডাঙায় বাঘ’। তোমরা বাঘ দেখব, বাঘ দেখব করে হেদিয়ে মরছ, সত্যি-সত্যি বাঘের সামনে পড়লে পালাতে পথ পাবে না। ভাল চাও তো ওসব মতলব ছাড়ো।”

    শ্রীময়ী বলল, “আমি না গো। বিপ্র।”

    প্রলয় ভুরু তুলল, “সে কী? আমি তো ভাবলাম তোমারই বেশি উৎসাহ।”

    শ্রীময়ী গোঁজ হয়ে বলল, “না, না… বাঘ দেখতে যাবে বলে ওই পাগলামি করছে। মিছিমিছি আমার নামে চালাচ্ছে।”

    প্রলয় বলল, “নৌকো করে কোর এরিয়ায় বাঘ দেখতে যাওয়া কিন্তু ভীষণ রিস্কি। ওকে বোঝাও।”

    শ্রীময়ী হাত নেড়ে বলল, “আমি তো যাব না-ই বলেছি। সে শুনলে তো! মাথার পোকা নড়লে তাকে বোঝায় কার সাধ্য?”

    ফেরার পথে শ্রীময়ী বলল, “তোমাদের এই চরটা এত সুন্দর ইচ্ছে করে পার্মানেন্টলি থেকে যাই।”

    প্রলয় হেসে বলল, “তাহলে বিপ্রর কী হবে?”

    শ্রীময়ী হাসল না, কথার জবাবও দিল না। অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নিল।

    ফিরে এসে ওরা দেখল বিপ্র নেই। কাউকে কিছু বলে যায়নি, কেউ বলতে পারল না সে কোথায় গেছে। প্রলয়ের বসে থাকলে চলে না। সে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। রান্নার জন্য ভাঁড়ার থেকে মেপেজুপে কাঁচামাল বার করে দেওয়া, কারা কারা রান্নার কাজে হাত লাগাবে তার একটা বিলি-বন্দোবস্ত করা, কাজকর্মের ভাগ নিয়ে কাজিয়া সামলানো… কোথা দিয়ে যে সময় কেটে যায় বোঝা যায় না। শ্রীময়ী এসে পিছনে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করল, “আমি কিছু হেল্প করব?”

    প্রলয় বলল, “না, না…"

    বিপ্রদাস যখন ফিরল রোদ মাথায় চড়েছে। এসেই বলল, খুব খিদে পেয়েছে, খেতে দাও।বিপ্র, প্রলয় আর শ্রীময়ী একটু আলাদা হয়ে একটা টেবিলে খেতে বসেছিল। প্রলয় বিপ্রকে জিজ্ঞেস করল, “সকালে কোথায় বেরিয়েছিলে, দেখিনি।”

    বিপ্র বলল, “এই... চারদিকটা দেখে এলাম,” একটু চুপ করে থেকে বলল, “ভাবছিলাম এখানে একটা রিসর্ট খুললে কেমন হয়!”

    প্রলয় হাঁদার মত তাকিয়ে বলল, “রিসর্ট? এখানে? কে আসবে?”

    বিপ্রদাস বিজ্ঞের মত হেসে বলল, “শনিবার সকালে গদখালি থেকে প্রাইভেট লঞ্চের ব্যবস্থা থাকবে। জনগণ এসে সকালে মাছভাত, রাত্তিরে মুর্গি-মাটন সাঁটিয়ে, রোববার ফিরে যাবে। ঠিকঠাক মার্কেটিং করতে পারলে দেখবে ভিড় উপচে পড়ছে।”

    প্রলয় বলল, “কোথায় রিসর্ট বানাবে? চরে জায়গা কোথায়? শুধু তো জঙ্গল আর জলাজমি।”

    বিপ্র বলল, “কেন, তোমাদের এই স্কুলবাড়ি... প্লটটা তো চমৎকার। একদম নদীর ধারে, বিকেলের দিকে নৌকোবিহারের বন্দোবস্ত রাখা যাবে, লোকে মাল খেতে খেতে সূর্যাস্ত দেখবে। কমলের কাকা জমির মালিক না? কথা বলে দেখি, যদি রাজি থাকে।”

    বলে কী লোকটা! কাঁকলাসের মত চেহারা কিন্তু দুর্বুদ্ধির ডিপো। প্রলয় ক্ষুব্ধ গলায় বলল, “আর স্কুলটার কী হবে? বাচ্চা ছেলেমেয়েগুলো কোথায় যাবে?”

    বিপ্র হাত দিয়ে মাছি তাড়ানোর মত করে প্রলয়ের কথা উড়িয়ে দিল, বলল, “আরে লোকাল লোকেরা রিসর্টে কাজ পাবে, বালবাচ্চা নিয়ে খেয়ে-পরে থাকবে। পড়াশুনো করে এই মর্কটগুলো কী রাজ্য উদ্ধার করবে শুনি!”

    প্রলয়ের গা জ্বলছিল। ইচ্ছা করছিল সামনে বসা লোকটার গালে ঠাঁটিয়ে একটা চড় মারে। নেহাত কমলের বন্ধু বলে পারল না। রাগ চেপে কোনওমতে খাওয়া শেষ করে উঠে গেল। নিজের ঘরে ঢুকে, দোর দিয়ে, একটা বই নিয়ে তক্তাপোষের ওপর লম্বা হল।

    চোখ লেগে এসেছিল। বাজ পড়ার শব্দে চটকা ভাঙল প্রলয়ের। জানলার বাইরে তাকিয়ে দেখল আকাশে মেঘ জমতে শুরু করেছে। তড়িঘড়ি উঠে বসল। বেশি বৃষ্টি হলে ভাঁড়ার ঘরের ছাদ থেকে জল পড়ে। প্লাস্টিক লাগাতে হবে। বাইরে এসে দেখল সন্তোষ দু-চারজন লোক জুটিয়ে, মই লাগিয়ে, ছাদে উঠে কাজ শুরু করে দিয়েছে। নিজের ঘরে ফিরে আসছিল, চোখ মুছতে মুছতে পাশের ঘর থেকে বেরিয়ে শ্রীময়ী জিজ্ঞেস করল, “প্রলয়দা, বিপ্রকে দেখেছ?”

    প্রলয় খোঁজ নিয়ে জানল খাওয়ার পর থেকে বিপ্রদাসকে আর কেউ দেখেনি। সে আবার চুপিসাড়ে উধাও হয়েছে। হাওয়ার বেগ বাড়ছিল, টিপটিপ করে বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল। সন্ধে নাগাদ ঝড়-বৃষ্টি ঠেলে সনাতনের বৌ এসে বলল, সনাতন নাকি তার হাতে একগোছা নোট গুঁজে দিয়ে কোলকাতার দাদাবাবুকে নৌকোয় চাপিয়ে বাঘ দেখাতে নিয়ে গিয়েছিল... ফেরেনি।

    ।। ৪।।

    প্রলয় সনাতনের বৌকে বলল, “দিদি, তুমি এবার ফিরে যাও। ঝড় আরও বাড়বে। এই অন্ধকারে, দুর্যোগের মধ্যে খোঁজখবর করা যাবে না। মোবাইলও চলছে না। কাল দিনের আলো ফুটলে না-হয়… ”

    সনাতনের বৌ অনিচ্ছা সত্ত্বেও বাড়ির পথ ধরল। শ্রীময়ী হাতে মোবাইল নিয়ে বারান্দায় বসে ছিল। তার বুকের ভেতরটা কাঁপছিল। বিকেল থেকে অনেকবার বিপ্রকে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছে। প্রতিবারই শুনেছে বিপ্রর ফোন স্যুইচ অফ। প্রলয় পাশে এসে বসল। শ্রীময়ী ধরা গলায় বলল, “এখন কী হবে, প্রলয়দা?”

    প্রলয় বলল, “কী আর হবে? হঠকারীর মত কাজ করলে তার ফল ভুগবে। বিপ্র তো আর বাচ্চা ছেলে নয়।”

    শ্রীময়ী প্রায় কেঁদে ফেলল, নাক টানতে টানতে বলল, “আমার খুব আশঙ্কা হচ্ছে গো, কিছু বিপদ-আপদ হল না তো!”

    হাওয়ার দাপট বাড়ছিল। পুরনো স্কুলবাড়ির দেওয়ালে ধাক্কা খেয়ে, ফাঁকফোকর দিয়ে বয়ে যেতে যেতে বেঁধে রাখা জানোয়ারের মত গোঁ-গোঁ শব্দ করছিল। প্রলয় বলল, “ভেবো না, ঝড় উঠেছে দেখে সনাতন নিশ্চয়ই কোনও ঘাটে নৌকো ভিড়িয়েছে।”

    প্রলয়ের কথা শেষ হল না, ভাঁড়ার ঘরের ছাদে লাগানো প্লাস্টিকের শিটটা একদিকের দড়ি ছিঁড়ে উড়তে শুরু করল। কিছুক্ষণ হাওয়ার সঙ্গে যুঝল। তারপর হাল ছেড়ে রাক্ষুসে ঘুড়ির মত গোঁত্তা খেয়ে স্কুলবাড়ির বাউন্ডারি ওয়াল পার করে অন্ধকার আকাশে মিলিয়ে গেল। সন্তোষ চলে গেছে। বাচ্চাগুলোও আজ কেউ আসেনি। প্রলয় দৌড়ল, যদি কিছু ব্যবস্থা করা যায়। ছাদ ফুটো হয়ে যেখানে জল পড়ছে তার নিচে একটা বালতি বসিয়ে দিল। কিছুক্ষণের জন্য রেহাই, উপচে পড়লে আবার অন্য একটা খালি বালতি।

    কাছেই কোথাও একটা বাজ পড়ল। স্কুল বিল্ডিংয়ে জ্বলে থাকা আলোগুলো একবার দপদপ করে উঠল। ফিরে এসে দেখল শ্রীময়ী তখনও মুখ কালো করে বারান্দায় বসে আছে। বৃষ্টির ছাট আসছিল, প্রলয় বলল, “চলো, ভেতরে গিয়ে বসি।”

    শ্রীময়ী এসে প্রলয়ের ঘরেই বসল, তক্তাপোষের পাশে, হাতল-ভাঙা একটা চেয়ার টেনে। চারদিকে তাকিয়ে বলল, “বাবা, তোমার ঘরে কত বই! খুব বই পড়তে ভালবাস বুঝি?”

    প্রলয় কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল, “তাছাড়া এই পাণ্ডববর্জিত জায়গায় করবই বা কী? ফোনে টাইমপাশ করব সে উপায়ও তো নেই।”

    বারান্দার শেডের ওপর বৃষ্টি শব্দ শুনে মনে হচ্ছিল কোনও পাগল তবলচি মাথা ঝাঁকিয়ে তবলায় বোল তুলছে। সেই বোলের না আছে নিয়ম না শৃঙ্খলা। শ্রীময়ী কান পেতে শুনে বলল, “কেউ কি দরজায় ধাক্কা দিচ্ছে?”

    প্রলয় বলল, “নাহ, হাওয়ার দরজা-জানলা নড়ছে, ঝড় আরও বাড়বে।”

    প্রলয়ের কথা রাখার জন্যই যেন ঝড় আরও ফুঁসে উঠল। আর সঙ্গেসঙ্গে ফুস করে পাওয়ার অফ হয়ে গেল। ওভারহেড লাইন বলে ঝড় উঠলে দুর্ঘটনা এড়ানোর জন্য পর্ষদ লোড শেডিং করে দেয়। প্রলয়ের অভ্যেস আছে, শ্রীময়ী আঁতকে উঠল, এমন নিকষ অন্ধকার আগে কখনও দেখেনি। প্রলয় মোবাইলের আলো জ্বালিয়ে বলল, “উঠো না। পড়ে-টড়ে যাবে। আমি হ্যারিকেন নিয়ে আসছি।”

    প্রলয় হ্যারিকেন আনতে বাইরে গেল। অন্ধকারটা যেন গিলে খেতে আসছে, মোবাইলটা যে কোথায় রাখল! শ্রীময়ী চারদিক হাতড়েও পেল না। অন্ধের মত বসে থাকতে থাকতে হঠাৎ মনে হল, প্রলয় যদি আর ফিরে না আসে। পরমুহূর্তে নিজেকে বোঝাল, ধ্যুস, এই ঝড়বৃষ্টি মাথায় নিয়ে যাবে কোথায় ছেলেটা? আর কেনই বা যাবে? সাড়া নেওয়ার জন্য গলা তুলে শ্রীময়ী বলল, “তোমাদের ইনভার্টার নেই?”

    প্রলয় হাতে হ্যারিকেন দুলিয়ে ফিরে এল। শুকনো হেসে বলল, “এখানে ইনভার্টার? কেরোসিন জোটাতেই প্রাণান্ত হয়।”

    একটা স্টুল টেনে তার ওপর হ্যারিকেনটা রাখল প্রলয়। শ্রীময়ীর ভারী বুকে নিচের থেকে আলো পড়ল। একটা আলগা চটক আছে মেয়েটার। এমনিতেও স্তিমিত আলোয় খেঁদিপেঁচি সব মেয়েকেই মোহময়ী লাগে, ডানাকাটা পরি মনে হয়। মনে হয় রক্ত-মাংসর নয়, এঁটেল মাটি দিয়ে গড়া পুতুল। ছেলেমানুষের মত খেলার ছলে ছুঁয়ে দেখতে ইচ্ছা হয়। সেভাবে দেখলে মেয়েটা পুতুল ছাড়া আর কি? বড়লোক বন্ধুর কথায় শোয়-বসে, তার মনোরঞ্জন করে। নিজের কোনও ইচ্ছে-অনিচ্ছে নেই। বিনিময়ে নিশ্চয়ই কিছু না কিছু সুবিধে আদায় করে।

    প্রলয়ের মনে বিতৃষ্ণা ফিরে আসছিল। এর থেকে যারা সবুজ কাঠের পাল্লার দরজার সামনে দাঁড়িয়ে পথচলতি মানুষকে ডাকাডাকি করে, পয়সা নিয়ে শরীর বেচে, তারা অনেক সৎ। অন্তত তাদের সতীপনা দেখানোর দায় থাকে না। প্রলয় চোখ ফিরিয়ে নিতে গিয়েও থেমে গেল। হ্যারিকেনের কাঁপা-কাঁপা আলোয় শ্রীময়ীর শরীরের আনাচ-কানাচে ঘনকৃষ্ণ ছায়ারা নাচন-কোঁদন জুড়েছে। যেন একদল সাঁওতাল রমণী হাতে হাত জড়িয়ে মাদলের তালে-তালে পা মেলাচ্ছে। তাদের নিয়মিত নাচের মুদ্রা থেকে উঠে আসছে দলা ঘাস আর বুনো ফুলের গন্ধ। দীর্ঘদিন একা একা থাকা, প্রলয়ের মাথার মধ্যে একটা উপোসী জন্তু আড়মোড়া ভাঙছিল। প্রলয় তাকে শাসন করল। শ্রীময়ীর বোধহয় একটু অস্বস্তি হল। সে ওড়নাটা বুকের ওপর টেনে নিল। প্রলয় ভাবল, ভাবখানা দেখো, যেন অনাঘ্রাতা কুসুম! হাত লাগালেই মুচ্ছো যাবেন। মুখে বলল, “রাত্তিরের খাওয়া সেরে নিলে হয়। কেরোসিনের স্টক বাড়ন্ত। কারেন্ট কখন আসবে ঠিক নেই।”

    শ্রীময়ী বলল, “বারান্দায় বসে খাব কী করে? বৃষ্টির ছাট লাগবে তো।”

    প্রলয় বলল, “আমি ঘরে নিয়ে আসছি। তুমি বোসো।”

    আচমকা একটা বিকট শব্দ এল। যেন কাছেই কোনও কিছু ভেঙে পড়ল। শ্রীময়ী ভয়ার্ত গলায় বলল, “ও কী? ও কীসের শব্দ?”

    প্রলয়ও ঠিক বুঝতে পারল না। বলল, “উত্তরের বারান্দার এক জায়গায় শেড আলগা হয়ে ঝুলছিল। সময়মত সারানো হয়নি। সেটা মনে হয় খুলে পড়ল,” উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “যাই, একবার দেখে আসি।”

    শ্রীময়ী প্রলয়ের হাত চেপে ধরল, “না, আমায় একা ছেড়ে যেয়ো না। আমার খুব ভয় করছে।”

    প্রলয় দেখল শ্রীময়ীর দু’-চোখে অনুনয়, হাতের পাতা কনকনে ঠান্ডা। বলল, “ভয়ের কী আছে? আমি যাব আর আসব।”

    শ্রীময়ী বলল, “না, যেয়ো না, প্লিজ! আমি একা থাকতে পারব না।"

    নাগালের মধ্যে উন্মুখ নারী-শরীর পেলে কার না মতিভ্রম হয়! নাকি তৃষ্ণা আর বিতৃষ্ণা একই মুদ্রার এপিঠ আর ওপিঠ? প্রলয় আচমকা নিচু হয়ে শ্রীময়ীর ফুটে থাকা ঠোঁটে দাঁত বসাল। যেন দেখার জন্য শ্রীময়ী কীভাবে রিয়্যাক্ট করে? শ্রীময়ী কি আশ্চর্য হল? প্রলয় সোজা হয়ে দেখল শ্রীময়ী তার দিকে অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। প্রলয় তার হাত ধরে টান দিল। চেয়ার থেকে তুলে তক্তাপোষের ওপর নিয়ে গিয়ে বসাল। শ্রীময়ী আপত্তি করল না। করলেই বা কে শুনত? প্রলয়ের তলপেটের পেশিতে টান ধরছিল। শরীর এক বিচিত্র বস্তু। কখন যে কী চায়, নিজেই জানে না। সে দু’-হাতে শ্রীময়ীর কাঁধ ধরে কাছে টেনে তার পরিপূর্ণ বুকের মধ্যে মুখ গুঁজল।

    “প্রলয়দা, কী করছ? ছাড়ো,” শ্রীময়ী দুর্বল ভাবে বাধা দিল। প্রলয় পাত্তা দিল না। ততক্ষণে তার হাতের টানে শ্রীময়ীর জামার পিঠ থেকে একটা একটা করে হুক ছিঁড়ে পড়ছিল। প্রথমে গা থেকে কামিজ খসে পড়ল। তারপর বক্ষবন্ধনী। প্রলয় ক্রমশ শ্রীময়ীর শরীরের ওপর উঠে আসছিল। টাল সামলাতে না পেরে শ্রীময়ী তক্তাপোষের ওপর হেলে পড়ল। নেহাত দেখার কেউ ছিল না, না-হলে হ্যারিকেনের হলুদ আলোর মধ্যে শ্রীময়ীর নগ্ন শরীরের ওপর ঝুঁকে পড়া অবয়বটাকে দেখে মনে হত অবিকল একটা মাংসলোলুপ বাঘ, পেশল, ডোরাকাটা… কোর এরিয়া থেকে সহজ শিকারের সন্ধানে বেরিয়ে স্কুলবাড়িতে ঢুকে পড়েছে।

    * * *

    পরের দিন সকাল থেকে শ্রীময়ী থমথমে মুখ করে ঘুরে বেড়াচ্ছিল। প্রলয় দু’-একবার কথা বলার চেষ্টা করল। সে শুধু মাছের মত নিথর চোখ তুলে তাকাল, কথার জবাব দিল না। প্রলয়ের সন্দেহ হল শ্রীময়ী হয়তো সত্যি-সত্যিই মাছ হয়ে গেছে। উষ্ণায়ন সহ্য করতে না পেরে জলের গভীরে নেমে যাচ্ছে।

    সনাতন ফিরল সন্ধেবেলা। ততক্ষণে ঝড় থেমে ফুটফুটে জ্যোৎস্না উঠেছে। সে কিরে কেটে বলল, তার কোনও দোষ নেই, বিপ্র তাকে জবরদস্তি নিয়ে গিয়েছিল। দাদাবাবু বলেছিল বটে, কিন্তু সে কোনোক্রমেই কোর এরিয়ায় যেত না। এদিক-ওদিক ঘুরে ফিরে আসত। ঝড় আসবে সে কথা সে বিলকুল জানত না, জানলে নৌকো নিয়ে বেরোত না। ঝড় ওঠার পর সামলাতে পারেনি, হাওয়ার ঠেলায় নৌকো উল্টে গিয়েছিল। বিপ্র কোথায় তলিয়ে গেছে সে জানে না। কোনওমতে নৌকো সোজা করে এক আঘাটায় নিয়ে গিয়ে বেঁধেছিল। বনবিবির দয়ায় জান বাঁচিয়ে ফিরেছে।

    বিপ্রদাস ফিরল দু’-দিন পর। বিধ্বস্ত...পোশাকে কাদার দাগ, ট্রাউজার হাঁটুর কাছে ছেঁড়া। কী হয়েছিল, কোথায় ছিল… তাকে জিজ্ঞেস করে কোনও সদুত্তর পাওয়া গেল না। চুপচাপ ব্যাগ গুছিয়ে শ্রীময়ীকে সঙ্গে নিয়ে সে ফেরার তোড়জোড় করছিল। যেন চর ছেড়ে পালাতে পারলে বাঁচে। শ্রীময়ী যেতে রাজি হল না, বলল, দোখনের চর জায়গাটা তার বেশ ভাল লেগে গেছে। আরও কিছুদিন সে এখানে থেকে যেতে চায়। তাছাড়া সে থাকলে, কাজে কর্মে হাত লাগালে, প্রলয়ের একটু সুবিধে হবে। আর তো মাত্র কটা দিন। পৃথিবীটা আবার ঠিক আগের মত বাসযোগ্য হয়ে যাবে। ‘কম্যুনিটি কিচেন’ চালানোর দরকার পড়বে না। হাসি এবং তার বন্ধুরা মাধ্যমিক পাস করে যাবে। তখন না-হয় প্রলয়ের সঙ্গেই সে কোলকাতা ফিরে যাবে।



    অলংকরণ (Artwork) : অলংকরণ: রাহুল মজুমদার
  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments