• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৮৫ | জানুয়ারি ২০২২ | গল্প
    Share
  • বিধুবাবুর স্বপ্ন : প্রসূন দত্ত






    মধ্য কলকাতার আমহার্সট স্ট্রিটের অধুনা নাম রাম মোহন সরণী। এই রাস্তায় শ্রদ্ধানন্দ পার্ককে বাঁ-দিকে রেখে বৌবাজার স্ট্রিটের দিকে হাঁটতে থাকলে বাঁ-দিকে আসবে ডাফরিন হাসপাতাল। অতটা না গিয়ে কিছুটা আগেই ডান দিকে চোখে পড়ে একটা সরু গলি, নাম সিদ্ধেশ্বর চন্দ্র লেন। গলির মুখে ডান দিকে একটা মন্দির আর তার পাশে দুটো বাড়ি ছেড়ে বিধুবাবুর বাড়ি। গলির আর পাঁচটা বাড়ির মতই জরাজীর্ণ ছোট দোতলা বাড়ি। পৈতৃক বাড়ি। বিধুবাবুর ভাই নেই। একটা বোন আছে। বিয়ে হয়েছে কাছেই আরপুলি লেনে। সম্পত্তির ভাগ তিনি নেন নি। তাই বাবার অবর্তমানে বিধুবাবুই বাড়ির মালিক।

    বিধুবাবুর বয়স মাসখানেক আগে পঁয়ষট্টি পেরিয়েছে। সরকারি বিভাগে কেরানির চাকরি করতেন। নিরাপদ দশটা-পাঁচটার কলম পেশা আর গুলতানি করার চাকরি। ট্রামে বাসে ভিড়ের ধকল ছাড়া আর কোনো হ্যাপা ছিল না। মাইনে কম ছিল, একঘেয়েমি ছিল তবে শান্তি ছিল। নিম্ন মধ্যবিত্ত বাঙালি কেরানিদের উচ্চাকাঙ্ক্ষা বড় একটা থাকে না। অল্পেই এনারা খুশি। বিধুবাবুও ব্যতিক্রম ছিলেন না। ছেলে নেই। দুই মেয়ে। এদের ভালমত বিয়ে দেওয়াই ছিল তাঁর একমাত্র আকাঙ্ক্ষা। দিয়েও ছিলেন। দুই জামাই ইঞ্জিনিয়ারিংএ ডিপ্লোমা করেছে। একজন মেকানিক্যাল আর অন্যজন ইলেক্ট্রিক্যাল। দুজনেই এন টি পি সি-তে, বড় রামাগুন্ডম আর ছোট কোরবা বিদ্যুৎকেন্দ্রে। বড়জামাই সূত্রে ছোটকে পাওয়া। বিধুবাবু দুটো জায়গাই সস্ত্রীক দেখে এসেছেন। দেখে এসেই মনে মনে পণ করেছেন আর কখনও যাবেন না। সিদ্ধেশ্বর চন্দ্র লেনের বাসিন্দা বিধুবাবুর ওই ধ্যাধ্ধেড়ে গোবিন্দপুর দুটো পছন্দ হয় নি।

    বিধুবাবু যে দফতরে কাজ করতেন সেখানে উপরি রোজকার মানে ঘুষ নেবার সুযোগ ছিল অনেক। বিধুবাবু ছিলেন সৎ, তা ছাড়া ঘুষ নেওয়ার সাহসও তার ছিল না। বিধুবাবুর স্ত্রী এ-সবের বিন্দুবিসর্গ জানতেন না। টানাটানির সংসারে বিধুবাবুকে কথা শোনাতেন বটে, তবে খোসমেজাজে ছিলেন। পাড়ার মহিলারা প্রায়ই দুপুরের খাওয়া সেরে নরেশ দত্তের রোয়াকে আড্ডা দিতেন। পরচর্চা পরনিন্দা চলত। এই আড্ডায় সামিল হয়ে বিধুবাবুর স্ত্রী এটা বুঝেছিলেন কমবেশি সবারই সংসার চলে কষ্টেসৃষ্টে। তাই হিংসে করার কেউ ছিল না। বরং নিজের একটা মাথা গোঁজার ঠাঁই থাকায় ভাড়াটেদের তুলনায় নিজেকে ভাগ্যবানই ভাবতেন।

    বাদ সাধলেন শশাঙ্কবাবু। বিধুবাবুর অফিসে কেরানির কাজ করে বছর দেড়েক আগে অবসর নিয়েছেন। বিধুবাবুর চেয়ে বয়সে ছোট। তিনি হঠাৎ এক রবিবারের বিকেলে এক বাক্স সন্দেশ হাতে করে নিজের গৃহিণীকে নিয়ে হাজির। ট্যাক্সিতে এসেছেন। নিজের পরনে গরদের দামি পাঞ্জাবি, বৌ পরেছেন শিফনের শাড়ি। সল্টলেকে নতুন বাড়ি করেছেন। গৃহপ্রবেশের নিমন্ত্রণ করতে আসা। দুই মহিলার মেয়েলি আলোচনায় শশাঙ্কবাবুর স্ত্রী গর্বের সঙ্গে জানিয়ে দিলেন উনি যে হার দুল বালা চুড়িগুলো পরে এসেছেন, সবই সোনার, তাও নাকি বৌবাজারের সেনকোর।

    সল্টলেক আর সেনকো নিয়ে ঘন্টাখানেক বকবক করে, বিধুবাবুর বৌয়ের ব্লাড প্রেশার কিছুটা বাড়িয়ে, চা-বিস্কুট খেয়ে শশাঙ্কবাবুরা চলে গেলেন। তারপর বৌ বিধুবাবুর ক্লাস নিলেন। একই অফিসে কেরানি হয়েও বয়সে ছোট শশাঙ্কবাবুর এত টাকা হয় কী করে তা জানতে চাইলেন। জেরার মুখে বিধুবাবুকে স্বীকার করতেই হল এটা ঘুষের টাকা। এতে ফল বিপরীত হল। বিধুবাবুকে শুনতে হল তিনি এক ডাহা আহাম্মক। সামান্য ঘুষ নেবার মুরোদ নেই, বিয়ে করার সখ ছিল। বিধুবাবুর বৌ চাকদার মেয়ে। ওঁর বাবা সিদ্ধেশ্বর চন্দ্র লেনের বাড়ি আর সরকারি চাকরি দেখে গর্বের সঙ্গেই কিন্তু মেয়ের বিয়ে দিয়েছিলেন। সেনকোর জ্বালায় সেসব ভুলে মেরে দিয়ে এই অপদার্থ লোকটার সঙ্গে বিয়ে দেওয়ায় নিজের বাবাকেও দুষলেন বিধুবাবুর বৌ। সত্যিই তো সেনকোর সোনার জমকে বিধুবাবুর সততার মূল্যই বা কতটুকু! বৌকে অবশ্য দোষ দেওয়া ঠিক নয়। গা ভর্তি গয়না ওঁরও ছিল। বিয়েতে বাপেরবাড়ি থেকে পাওয়া। দুই মেয়ের বিয়েতে কাজে এসেছিল। বিধুবাবুকে কিনতে হয় নি। উল্টে বৌকে গয়না গড়িয়ে দেবার কোনো প্রতিশ্রুতিই উনি রাখতে পারেন নি। মাইনের টাকা, সংসার খরচ আর সোনার দাম এই তিনটেতে কোনো সামঞ্জস্য কখনই হয় নি।

    আর সব উপরি রোজকার না থাকা সাধারণ সরকারি কেরানিদের মত বিধুবাবুর সামান্য পুঁজি জমত ব্যাংক কি পোস্ট অফিসের খাতায়। একটা বিমা করিয়েছিলেন এল আই সি থেকে। নিয়মিত প্রিমিয়াম দিতেন। মেয়েদের বিয়ে দিয়ে জমা টাকা তলানিতে এসেছিল। অবসর নেবার পর পাওয়া বিমার টাকার অবস্থাটা সামান্য শুধরেছিল। প্রতিবেশী গদাইবাবুর ছেলে অপু তখন সদ্য মিউচুয়্যাল ফান্ডের এজেন্ট হয়েছে। তার চাপাচাপিতে একটা নামকরা ইকুইটি ফান্ডে হাজার পাঁচেক টাকা লাগিয়েছিলেন। শেয়ার বাজারের ওঠানামা বোঝা বিধুবাবুর সামর্থ্যের বাইরে। মাস ছয়েক বাদে হঠাৎ করে বাজার নেমে গেল। অপু বলল, জ্যাঠা নামা বাজার আবার উঠবে আরও হাজার পাঁচেক লাগান। অপু ঠিকই বলেছিল। বিধুবাবু কান দেন নি। ওঁর লাগানো আগের পাঁচ হাজার তো তখন চার হাজার একশো! শেয়ার বাজারে বীতশ্রদ্ধ হয়ে অপুকে কয়েকটা কথা শুনিয়ে দিলেন। বাজার আরও পড়ে গেল। অপুর সবিনয় অনুরোধ প্রত্যাখান করে ইকুইটি ফান্ডের ইউনিট বিক্রি করে পেলেন তিন হাজার আটশো। নির্ঝঞ্ঝাট বিধুবাবু আসলে ঝুঁকি নেবার মানুষ নন। মাস গেলে পেনসনের টাকাটা আসে। সরকারি ব্যাংকে ফিক্সড্ ডিপোসিট, সুদ পান। বাড়ির একতলাটায় একাই থাকেন পুরোনো ভাড়াটে ডাক্তার মাইতি। ভাড়া বেশি নয় তবে কখনো বকেয়া থাকে না। মাইতি ডাক্তার অসুখবিসুখ হলে দেখেন। ঔষধ দেন। সবই বিনা পয়সায়। সব মিলিয়ে সামান্য আয়ে বিধুবাবুর কুলিয়ে বাড়িয়ে চলে যায়।

    চাকরি থেকে অবসর নিয়ে বিধুবাবুর হাতে অনেক সময়। মেয়েদের তো অনেক বছর আগেই বিয়ে হয়ে গেছে। বৌ ঘরের কাজ মহিলামহলে গুলতানি আর পাশের মন্দিরের কাজে পুরো দিনই ব্যস্ত। মন্দিরের কাজ যে একেবারেই নিঃস্বার্থ তা বলা যায় না। প্রসাদের ফল মিষ্টির অংশ বাড়িতে আসে বৈকি। বিধুবাবু বাজারহাট করেন, টিভি দেখেন কাগজ পড়েন আর রেডিওয় গান শোনেন। বিকেলে কাছে শ্রদ্ধানন্দ পার্ক বা আর একটু দূরে কলেজ স্কোয়ারে হাঁটতে যান। কয়েকজন বন্ধু আছে পাড়ায়। হরেন মুকুজ্জের মনিহারির দোকান পাশের গলি মধুগুপ্ত লেনে। পটল তরফদার কম্পাউন্ডার। কমল নস্কর কাছেই জগবন্ধু লেনে কোচিং ক্লাস চালান। রবিবার সন্ধ্যে বেলায় এঁরা বিধুবাবুর বাড়িতে তাস খেলতে আসেন। টোয়েন্টি নাইন। বিধুবাবুর সময় ভালই কাটে।

    শশাঙ্কবাবুর গৃহপ্রবেশের নেমন্তন্ন খেয়ে ফেরার পর থেকে বিধুবাবুর বৌ মন্দিরের কাজে আরও বেশি জড়িয়ে পড়লেন। কথায় কথায় উপোসতিরেস আগেও ছিল, আরও বেড়ে গেল। হয়ত ভগবানের কৃপায় হঠাৎ বড়লোক হবার স্বপ্ন দেখতেন। সেই স্বপ্ন সত্যি হল না। মধ্য কলকাতার আর পাঁচটা পাড়ার মত এখানেও এল ডেঙ্গুর প্রবল প্রকোপ। বিধুবাবু প্রথমে, তার পর ওঁর বৌ আক্রান্ত হলেন। ডাক্তার মাইতির চেষ্টায় বিধুবাবু সুস্থ হলেন বটে কিন্ত বিধুপত্নী ধরাধাম ত্যাগ করলেন। বিধুবাবুর একা থাকার সময় এল। মাঝে মাঝে আরপুলি লেনে বোনের বাড়ি যান। কখনো বোনও আসেন, তবে কমই। কাজের মেয়েটা আগের মতই দুবেলা আসে। বাসন মাজা, ঘরদোর পরিষ্কার রান্নাবান্না সবই ও করে। বিধুবাবুর দৈনন্দিন জীবন আগের মতই ছিল। তবে কেউ আর কথায় কথায় দোষারোপ করে না, কথা শোনায় না বা খোঁটা দেয় না। তবুও এই নিঃসঙ্গতায় বিধুবাবু কষ্ট পান।

    দিনে বা রাতে বিছানায় শুলেই বিধুবাবু অনায়াসে ঘুমিয়ে পড়তেন। এই আলসেমির জন্য বৌ প্রায় কথা শোনাতেন। মানুষটা আর নেই। রাগারাগি করার কেউ নেই। তবু তেমন ঘুম আর আসে না। দুপুরে ভাতের পর চোখটা জড়িয়ে এলেও সারা রাত এপাশ-ওপাশ করে ভোরের দিকে অনেক কষ্টে নিদ্রাদেবী প্রসন্ন হন। অনিদ্রার কারণে অম্বল আর বদহজম। মাইতি ডাক্তার দেখলেন। মেডিকেল কলেজের এক বড় ডাক্তার দেখলেন। শরীরে বিশেষ কোনো গোলমাল ধরা পড়ল না। মাইতি ডাক্তার বললেন দিনে ঘুম বন্ধ করুন। দিনে রুটি রাতে ভাত খান। রাতে শোবার সময় সামান্য ঘুমের ঔষধ।

    ঘুমের ঔষধে কাজ হল। অনিদ্রার কষ্ট আর রইল না। কিন্তু এক নতুন অভিজ্ঞতার সূত্রপাত হল। বিধুবাবু প্রতি রাতেই স্বপ্ন দেখেন। স্বপ্নের জগৎ একেবারেই আলাদা। এখানে বিধুবাবু বড় সুখী মানুষ। দুঃখকষ্টের লেশমাত্র নেই। তাই ঘুম ভেঙে বাস্তবে ফিরেই ওঁর মন খারাপ হয়ে যায়। ভাবলেন ঘুমের ঔষধ একটু বেশি খেয়ে ঘুম আর স্বপ্ন দুটোই বাড়িয়ে নেবেন। মাইতি ডাক্তারকে এই ইচ্ছার কথা জানাতে উনি তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে মৃদু ধমক দিলেন। ঔষধগুলো ডাক্তারই বিনামূল্যে এনে দেন। তাই বিধুবাবু স্বপ্ন বাড়াবার ইচ্ছেটা স্থগিত রাখলেন।

    একদিন বিধুবাবুর বাড়িতে তাসের আড্ডা চলছে। যথারীতি হরেনবাবু, পটলবাবু আর কমলবাবু উপস্থিত। নরেশ দত্ত এসে হাজির। ইনি এ পাড়ার বেশ অবস্থাপন্ন মানুষ। কলেজ স্কোয়ারের গায়ে হকার্স কর্নারে শাড়ির দোকান আর গোটা ছয়েক হাতে টানা রিকশার মালিক। মাঝে মাঝে এই আড্ডায় আসেন। নমাসে-ছমাসে পাঁচজনে মিলে সেন্ট্রাল এ্যভিনিউর এক বারে পেগ দুয়েক করে মদ খান। বিলটা সবাই সমান ভাগে চুকিয়ে দেন বটে তবে নরেশবাবু ছাড়া টাকার অংকটা সকলেরই গায়ে লাগে। বোতল আর বাদাম ভাজা কিনে কারোর বাড়িতে বসে খেলে আমোদ আর টাকার সাশ্রয় দুটোই হয়। বিধুবাবু ছাড়া বাকি সবার বৌ আছে। তাই ওঁদের বাড়িতে বসা সম্ভব নয়। বিধুবাবুও গাঁইগুঁই করছেন দেখে নরেশবাবু এক লোভনীয় প্রস্তাব দিলেন। বিধুবাবুর বাড়িতে মাসে বার দুয়েক মদ খাওয়া হবে; বিনিময়ে উনি বিনা পয়সায় খাবেন। আড্ডায় নরেশবাবু বোতল নিয়েই আসেন। একবার তো মাইতি ডাক্তারও বিনা নিমন্ত্রণে ঢুকে এসে পেগ দুয়েক টেনে ছিলেন।

    মদ তো মাসে দুবার। স্বপ্ন রোজই। স্বপ্নে বিধুবাবু অতীতে বিচরণ করেন। স্কুলে অংকে কাঁচা ছিলেন। তার জন্য চড়চাপড়, কানমোলা, নিলডাউন, ওঠবোস ইত্যাদি হেনস্থা তো বটেই অনেক অপমানকর শব্দবাণ সহ্য করতে হয়েছে। এখন স্বপ্নে সেই অংকের মাস্টার জগদীশবাবুকে অংক শেখান। আশ্চর্য জগদীশবাবু একই রকম রয়ে গেছেন। সেই মাথায় টাক, চোখে মোটা চশমা, আধপাকা দাড়িগোঁফ, ময়লা ধুতির ওপর রঙচটা হাফশার্ট আর তাপ্পি দেওয়া চিনেবাড়ির চটি। তবে অংকে ভীষণ কাঁচা। এই বয়স্ক লোকটাকে বকাঝকা মারধোর তো করা যায় না, তাই বিধুবাবু শান্ত মাথায় ধৈর্য রেখে শেখান।

    জ্যোৎস্না নামে মেয়েটা পাড়ায় নতুন এসেছিল। কাছেই একটা মেয়েদের স্কুলে পড়ত। দেখতে খুব একটা আহামরি বলা যায় না তবে বিধুবাবুর চোখে লেগেছিল। শুধু চোখেই নয় মনেও ধরেছিল। সামনের বছর মেয়েটা হায়ার সেকেন্ডারি দেবে, বিধুবাবুও তাই। খোঁজ নিয়ে জেনেছিলেন মেয়েটা পড়াশোনায় ভাল। ফার্স্ট সেকেন্ড হয়। ওদিকে বিধুবাবু ফেলের ভয়ে কুঁকড়ে থাকেন। মেয়েটা বিধুবাবুর বাড়ির সামনে দিয়ে হেঁটে স্কুলে যায়। বিধুবাবুরও স্কুলে যাবার সময়। দূরত্ব বজায় রেখে অনুসরণ করে ঘোরাপথে স্কুলে যান। ঐটুকুই। দুএকদিন পাড়ার আশপাশে বারকয়েক হঠাৎ চোখাচোখি হয়েছিল বটে, কথা বলার সুযোগ হয় নি। রেজাল্ট মামুলি হলেও বিধুবাবু হায়ার সেকেন্ডারি পাস করে বাড়ির কাছেই একটা কলেজে ভর্তি হলেন। বি কম পাসকোর্স। মেয়েটা প্রত্যাশামত প্রেসিডেন্সিতে ইতিহাসে অনার্স। ও বন্ধুদের সঙ্গে কফি হাউস আসত। বিধুবাবুও যেতেন কফি হাউসে ক্লাসের ছেলেদের আড্ডায়। মেয়েটাকে দেখার আশায়। বারকয়েক দূর থেকে দেখেছিলেন বটে। আলাপ করার সাহস হয় নি। কলেজের পড়া শেষ হলে মেয়েটা দিল্লিতে পড়তে গেল জে এন ইউ-তে। ওদের পরিবারও পাড়া ছেড়ে বাগুইহাটি কি উল্টোডাঙ্গা কোথায় যেন চলে গেল। চোখের দেখার ইতি হল। তবে বাস্তবে যা কিছুই ঘটুক না কেন স্বপ্ন আলাদা জগৎ। সেখানে জ্যোৎস্না বিধুবাবুর প্রেমিকা। কফি হাউসে বসে সিগারেটের ধোঁয়া ছড়িয়ে প্রেমের সূত্রপাত। তারপর ইডেন, আউটরাম, বোটানিকাল, ইকোপার্ক কোনো জায়গাই বাদ গেল না। চুটিয়ে প্রেম। তবে শালীনতা ছিল, চুমুটুমুর বেশি নয়। বিধুবাবুর এক স্কুলের বন্ধু ডাক্তার হয়ে প্রেমিকাকে নিয়ে লাইট হাউসে এ মার্কা ইংরিজি সিনেমা দেখে পার্কস্ট্রিটে ব্লুফক্সে জম্পেস ডিনার করার গল্প শুনিয়েছিলেন সেই কত বছর আগে। স্বপ্নে জ্যোৎস্নার সান্নিধ্যে বিধুবাবুর ওই সুপ্ত অভিলাষ পূর্ণ হল। যদিও লাইট হাউস আর ব্লুফক্স দুটোরই অস্তিত্ব আজ বিলুপ্ত। তবে আশ্চর্য, জ্যোৎস্না আজও সেই হায়ার সেকেন্ডারি। সেই শ্যামবর্ণা, ছিপছিপে, পাতলা ঠোঁট, চুলে বিনুনি, কানে দুল, নাকে নাকছাবি, কাঁধে ঝোলা, ছাপা শাড়ি আর পায়ে চটি। বিধুবাবু অবশ্য নিজেকে দেখতে পান না।

    চশমাটা পুরনো হয়ে গিয়েছিল। প্লাস পাওয়ার। মাস কয়েক হল খবরের কাগজ পড়তে অসুবিধেই হচ্ছিল। পাওয়ার বেড়েছে। খরচের ভয়ে চোখের ডাক্তার দেখান নি। শেষে খরচের ধাক্কাটা নিতেই হল। চশমাটা বিধুবাবু নিজেই ভাঙ্গলেন। কারণ সেই স্বপ্ন। কম বয়সে উনি ছিলেন ফুটবল পাগল। গড়ের মাঠে মোহনবাগানের হয়ে গলা ফাটিয়েছেন। বিপক্ষ অবশ্য হাওড়া ইউনিয়ন, উয়াড়ি বা বড়জোর টালিগঞ্জ। মহমেডান বা ইস্টবেঙ্গল নয়। বড় খেলার টিকিট কখনই পান নি। খেলার বাসনা ছিল বৈকি কিন্তু ভাগ্য বিরূপ। খেলাধূলাতেও বিধুবাবু কোনো কাজের ছিলেন না। যদিও ডাংগুলিটা নেহাৎ মন্দ খেলতেন না, সেই দক্ষতার কোনো মূল্য উনি কখনোই পান নি। স্কুলে খেলার মাঠ ছিল না। প্রতিবছর প্রেসিডেন্সির মাঠে স্পোর্টস হত। অংশগ্রহণ বাধ্যতামূলক। অনিচ্ছুক বিধুবাবু প্রতিবারই একশ মিটার দৌড়ে শেষ দিক থেকে প্রথম হতেন। সেই বিধুবাবু স্বপ্নে শুধু দৌড় কেন সব খেলাতেই বাজিমাত করেন। ক্রিকেটে ছক্কার পর ছক্কা আর ফুটবলে গোলের পর গোল। সৌরভের মত সার্ট খুলে উল্লাসও বাদ যায় নি। সেদিনটা ছিল ফুটবলের। চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ইস্টবেঙ্গলের বিরুদ্ধে পাঁচ নম্বর গোলটা ব্যাকভলি মেরে করার সাফল্যে বাড়াবাড়ি উল্লাস। হাতের আচমকা ধাক্কায় খাটের ধারে নড়বড়ে টুলটা মেঝেতে ধপাস। টুলের ওপরে রাখা চশমার কাঁচ দুটো ভেঙ্গে চুরমার। এই ঘটনার অভিজ্ঞতায় বাধ্য হয়ে বিধুবাবু টুলটাকে নিরাপদ দূরত্বে রাখার সিদ্ধান্ত নিলেন।

    অফিসের বড়কর্তা ডব্লু বি সি এস। ছোকরা অফিসার। কোট প্যান্ট পরে দরজা বন্ধ কাঁচের ঘরে বসেন। ওপরতলায় ওই ঘরে বিধুবাবু যান নি। ডাকও আসে নি কখনো। কেরানিদের প্রতি বড় অফিসারের উন্নাসিকতা নিয়ে বিধুবাবুর মাথাব্যথা ছিল না তা ঠিক, কিন্তু মনের মধ্যে কোনো অব্যক্ত বেদনা ছিল নিশ্চয়ই। স্বপ্নে তাই প্রায়ই বিধুবাবু বড়কর্তা। পরনে ধুতি, বুশ সার্ট আর জহর কোট। কাঁচের ঘরে এক্সিকিউটিভ চেয়ারে বসে সামনের দেওয়ালে বিশাল আয়নায় নিজেকে দেখে বেশ তৃপ্তি পান।। অফিসারটা অবশ্যই কোট প্যান্ট পরে কেরানিদের ঘরে বিধুবাবুর চেয়ারে বসে কলম পেশে। এই স্বপ্ন কিন্তু লম্বা হয় না। ঘুম ভাঙ্গতেই বিধুবাবুর মন খারাপ হয়ে যায়।

    বৌ ষতদিন বেঁচে ছিলেন ঝগড়া হত। বলা বাহুল্য এক তরফা। বৌ বলতেন, বিধুবাবু শুনতেন। উত্তর দিয়ে ঝগড়া বাড়াবার চেষ্টাই করেন নি কখনো। চাপা রাগের আগুন জ্বলত। ইচ্ছে করত ঝগড়ুটে সহধর্মিণীর মেদবহুল ফর্সা গালে ঠাস করে একটা চড় কষিয়ে ঝাল মেটাতে। সে সাহস হয় নি। স্বপ্নেও বৌ দাপটে ঝগড়া করেন। আশ্চর্যের কথা সেখানেও বিধুবাবু হাত ওঠাবার সাহস কুলিয়ে উঠতে পারেন নি। বরং বৌএর জন্য গয়না কেনেন। সেনকো, পি সি চন্দ্র, তানিস্ক কিছুই বাদ দেন না। বৌ তবুও হাতে টাকা কি কুটকুট করছে. আহা দরদ যেন উথলে পড়ছে ইত্যাদি কথা শুনিয়ে নতুন রকম ঝগড়া করেন। টাকার উৎসটা স্বপ্নে বোঝা যায় নি। স্বপ্নেও কিন্তু বিধুবাবু উৎকোচ নেন নি।

    মাঝে মাঝে বিধুবাবু স্বপ্নে ভবিষ্যৎ দেখতে পান। দেখার ভিত্তিতে ভবিষ্যদ্বাণীও করেন। তবে কয়েকটা হুবহু মিললেও বেশিরভাগই সত্যি হয় না। একটা ক্রিকেট ম্যাচে ভারতের জেতার সম্ভাবনা প্রায় শূন্য ছিল বলা যায়। বিধুবাবু বললেন ভারত সতেরো রানে জিতবে আর তাই হল। বাংলার নির্বাচনে এক বিশেষ নেতার হারার ভবিষ্যদ্বাণী অবশ্য ডাহা ফেল। বন্ধু কমল নস্কর শেয়ার বাজারে কেনা-বেচা করেন। স্বপ্নে বিধুবাবু তিনমাস পরের খবরের কাগজ দেখে এক নামকরা ঔষধ কোম্পানির শেয়ার দর কমলবাবুকে জানান। দামটা দ্বিগুণ হবে তাই কমলবাবু নিজের সীমিত সামর্থে কিছু টাকা লাগালেন। তার পরই কোম্পানির আর্থিক কেলেঙ্কারির কথা ফাঁস। শেয়ারের দাম প্রায় অর্ধেক। কমলবাবুর মাথায় হাত।

    সেদিন পাঁচজনের মদের আড্ডায় হরেন মুকুজ্জে আসতে পারেন নি। নরেশ দত্ত যথারীতি বোতল এনেছিলেন। পটলবাবু এনেছিলেন মধুগুপ্ত লেনের দীনবন্ধুর দোকানের আলুর চপ। একটা পেগ আর গরম গরম দুটো চপ উদরস্থ করে বিধুবাবু গতকাল রাতে দেখা ওঁর লেটেস্ট স্বপ্নটার কথা জানালেন। সেই স্বপ্নের মোদ্দা কথা হল বিধুবাবু ধরাধাম ত্যাগ করেছেন। পারলৌকিক ক্রিয়ার পর মাছমুখির দিনে পাঁচ বন্ধু আর মাইতি ডাক্তার খেতে বসেছেন। পাতে পেল্লায় সাইজের ডিম ভরা ইলিশের পেটি। শুনে বন্ধুরা হেসে উড়িয়ে দিলেন। বিদ্রুপ আর তাচ্ছিল্যের হাসি মিশিয়ে কমলবাবু বললেন, বিধু, ভবিষ্যৎ দেখা ছেড়ে দাও বাপ। তোমার কথায় শেয়ার বাজারে কত টাকার খেসারত দিতে হল ভোলো নি নিশ্চয়ই। বিধুবাবু থমকে গেলেন। মনে মনে পণ করলেন স্বপ্নে দেখা ভবিষ্যতের কথা আর বলবেন না। সেদিন হরেন মুকুজ্জে না আসায় বোতলটা শেষ হয় নি। পেগ দুয়েক বেঁচে ছিল। বিধুবাবুর শিকে ছিঁড়েছিল কেননা অবশিষ্টটা ওঁরই প্রাপ্য ছিল।

    পরের দিন সকালে হুলুস্থূল কান্ড। নটায় কাজের মেয়েটা এসে বেশ কয়েকবার কলিং বেল টেপার পর বিধুবাবু দরজা খোলেন নি। কখনো এরকম হয় নি। ভয় পেয়ে মেয়েটা মাইতি ডাক্তারকে খবর দেয়। পাড়ার কয়েকজনকে সাক্ষি রেখে উনি দরজা ভেঙে ঘরে ঢোকেন। বিধুবাবুর বন্ধু কম্পাউন্ডার পটল তরফদার কোনো কাজে মাইতি ডাক্তারের কাছে এসেছিলেন। উনিও উপস্থিত ছিলেন। শোবার ঘরে বিধুবাবু খাটে শুয়েছিলেন। তবে বেঁচে ছিলেন না। খাট থেকে ফুট তিনেক দূরে একটা রং চটা টুলের ওপর ট্যাবলেটের স্ট্রিপ, চশমা আর জলের গ্লাস। টুলের নিচে মদের প্রায় নিঃশেষ বোতল। মাইতি ডাক্তার গোনাগুনতি ঘুমের ট্যাবলেট দিতেন বিনা পয়সায়। অবশিষ্ট ট্যাবলেটের সংখ্যা দেখেই বুঝে গেলেন ব্যাপারটা। মদের ঘোরে বেশি ঘুমের ট্যাবলেট গিলে ফেলেছেন। ফিসফিস করে পটল তরফদার এই রকমই কিছু বলতে চেয়েছিলেন। ইঙ্গিতে ওঁকে থামিয়ে দিয়ে গম্ভীরমুখে দেহ পরীক্ষা করে ঘোষণা করে দিলেন স্বাভাবিক মৃত্যু। ঘুমের মধ্যে হার্টফেল। ডেথ সার্টিফিকেট লিখে দিলেন। পাড়ার লোকজন যারা এসেছিলেন তাদের কয়েকজন বললেন বৌ মারা যাবার পর মদ ধরাটাই বিধুবাবুর কাল হল। অন্যরা বললেন ভাগ্যবান মানুষ, কোনো রোগ নেই কোনো কষ্ট নেই, শান্তির মৃত্যু। কোরবা আর রামাগুন্ডাম থেকে মেয়ে-জামাইদের আসতে দিন দুএক দেরি হল। মাইতি ডাক্তার নিজের খরচে ফ্রিজার বক্সের ব্যবস্থা করে দিলেন।

    নিমতলা ঘাটে দাহ সংস্কারে মাইতি ডাক্তার গিয়েছিলেন। বিধুবাবুর মদ খাওয়া আর তাস খেলার বন্ধুরাও গিয়েছিলেন। সেখানেই কথা হল। সবাই একমত। বিধুবাবু মদের নেশায় বিভোর হয়ে একটু বেশি স্বপ্নের আশায় সংযম হারিয়ে ফেলেছিলেন। ঘুমের ঔষধে নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারেন নি। আত্মহত্যার প্রবৃত্তি ওঁর ছিল না।

    মাছমুখির দিন মাইতি ডাক্তার, হরেন মুকুজ্জে, পটল তরফদার, কমল নস্কর আর নরেশ দত্ত একসঙ্গে খেতে বসেছিলেন। প্রত্যেকের পাতে ডিমভরা ভাজা ইলিশের ত্রিকোনা বড় পেটি। বিধুবাবুর ভগ্নিপতির আনুকূল্যে এই ইলিশ। নিজে বৌবাজার গিয়ে কিনেছেন বিধুবাবুর অনেক পছন্দের এই মাছ। মাছের পেটি দেখে বন্ধুদের স্মৃতিতে ভেসে উঠল বিধুবাবুর ভবিষ্যদ্ববাণী। কমলবাবু কান্না চাপতে পারলেন না। অন্যরাও চোখ মুছলেন।

    খাওয়াদাওয়া সেরে বিধুবাবুর বাড়ি থেকে বেরিয়ে আমহার্স্ট স্ট্রিটের ফুটপাথে দাঁড়িয়ে বন্ধুরা স্মৃতিচারণ করছিলেন। হরেন মুখুজ্জে দার্শনিক ভঙ্গিতে বললেন, কমবেশি দিনের তিন ভাগের এক ভাগ আমরা ঘুমিয়ে কাটাই। বিধু তো এই ঘুমের মধ্যে স্বপ্নের জগতে বাস্তবের জাঁতাকল থেকে মুক্তি পেতে চেয়েছিল। কে জানে শেষের স্বপ্নটা কি ছিল?

    অলংকরণঃ রাহুল মজুমদার
  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments