• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৮৫ | জানুয়ারি ২০২২ | ছোটদের পরবাস | গল্প
    Share
  • গণেশবাবার গল্প : অচিন্ত্য দাস



    সে অনেকদিন আগেকার কথা, তখন স্কুলে দশ কি এগারো ক্লাশে পড়ি। হোস্টেলে থাকতাম আর আমাদের একটা ফুটবল টীম ছিল। অনেক জায়গায় খেলতে যেতাম, খুব মজা করতাম।

    সেবার মেদিনীপুরের একটা গ্রামে আমাদের খেলতে ডাকল ওদের হোস্টেলের বিরুদ্ধে। খড়গপুর লাইনের ঝাড়গ্রাম স্টেশনে নামলাম সকলে। ওরাই বাসের ব্যবস্থা করেছিল। অনেকটা রাস্তা, তারওপর জঙ্গলের ভেতর দিয়ে যেতে হবে। সন্ধে নামতে বেশি দেরি নেই, সময়টাও আবার বর্ষাকাল তাই আমরা সকলে তাড়াতাড়ি বাসে উঠে পড়লাম – বাসও ছেড়ে দিল।

    দেখলাম বাস এবং রাস্তা ভারি মানানসই। বাসটা এতই লজঝড়ে যে মনে হচ্ছে এইটাই তার শেষযাত্রা, আর টিঁকবে না। সামনে যে সরু লম্বা জমিটা দেখা যাচ্ছে তা যদি রাস্তা হয় তাহলে লাঙল দেওয়া ধানখেত কাকে বলে? আর আমাদের ড্রাইভারমশায় নিশ্চয় ফরমুলা ওয়ান রেসের ড্রাইভার ছিলেন আগে। কী জোরে যে বাস চলছে! এই ত্র্যহস্পর্শে যা হবার তাই হলো।

    রাস্তার ধারে একটা গর্তে পড়ে বাস প্রায় উল্টে যায় আর কি। আমরা ‘গেল গেল’ করে চেঁচিয়ে উঠলাম। ড্রাইভারমশায় কোনোরকমে বাস সামলে একটা গাছের সঙ্গে লাগিয়ে থামিয়ে দিলেন। ভাগ্যিস গাছটা ছিল তাই বাস উল্টে যায়নি। ড্রাইভারদাদা আমাদের মধ্যে এসে ভ্রু-কুঁচকে বললেন –“বুঝেছি, এইজন্যই হয়েছে। সব মোটাগুলো বাঁ-দিকে বসেছে, ‘লোড’ বেশি হয়ে গেছে। এই মোটা ছেলেরা, সবাই ডান-দিকে এসে বসো, রাস্তার বাঁ-দিকে এরকম গর্ত আরো অনেক আছে।”

    আমরা অনিলদার দিকে তাকালাম। অনিলদাই আমাদের খেলতে নিয়ে যাচ্ছিলেন, মানে আপাতত আমাদের অভিভাবক। অনিলদার চোখের ইশারায় ভয় ভয়; তা-ই করলাম। সুধীর মোটাসোটা ছেলে, চুপ করে বসে ছিল। ড্রাইভারদাদা ওকে হাত ধরে অন্যদিকে বসিয়ে দিলেন। সুধীর বেচারি আমতা আমতা করে বলছিল-–“আমি আবার মোটা নাকি? হোস্টেল থেকে ছুটিতে যখনই বাড়ি যাই মা বলে – ইস, কত রোগা হয়ে গেছিস…”

    ড্রাইভারদাদা নিজের খুপরিতে গিয়ে ইঞ্জিন চালু করলেন। চোঁ চোঁ শব্দ হলো বটে কিন্তু গাড়ি একচুলও নড়ল না। তিনি নেমে গর্তে পড়া চাকার অবস্থা দেখলেন, তারপর বললেন – এই সব খেলোয়াড়রা, তোমাদের শক্তির পরিচয় দাও দেখি… বাস ঠেলে রাস্তায় তুলতে হবে।

    অনেক চেষ্টা হলো, কিন্তু বাসের মনে হলো খুব অভিমান হয়েছে। সে এক ইঞ্চিও নড়ল না। যে সময়ের কথা হচ্ছে তখন মোবাইল বলে কিছু ছিল না যে পট করে গাড়িটানার ক্রেন কিংবা জনাবিশেক লোককে জোগাড় করা যাবে। এই বুনো রাস্তায় কি আমাদের পড়ে থাকতে হবে? আর একটা ‘সুখবর’ পাওয়া গেল ড্রাইভারদাদার কাছে। এ রাস্তায় দিনে একটাই বাস চলে, সে বাস অনেক আগেই চলে গেছে। আর সামনে নাকি রাস্তা ঘন বনের ভেতর দিয়ে গেছে – হেঁটে গেলে ভয়ের ব্যাপার থাকতে পারে। অনিলদা রাজি হলেন না।

    অবস্থা যখন এই, তখন দেখলাম একটা বুড়ো লোক আসছে। হাট থেকে ফিরছিল বোধহয়। সে বাস আর আমাদের দেখে দাঁড়িয়ে পড়ল।

    “কী হয়েছে?”

    ড্রাইভারদাদা খিঁচিয়ে উঠলেন, “চোখ নেই নাকি তোমার, দেখতে পাচ্ছ না? কটা লোক জোগাড় করে আনতে পারবে?”

    “লোক দিয়ে হবে নি। গণেশবাবাকে খবর দাও।”

    “গণেশবাবা? সে আবার কে?”

    “এই তো এই জঙ্গলের ভেতরে ভাঙা মন্দির আছে, সেখানে থাকে।”

    “সে কী করবে?”

    “দ্যাখোই না কী করে।”

    “তার ডেরা চিনব কী করে?”

    “হুঁ, দু-তিনজন এসো আমার সঙ্গে, বেশি দূর নয়।”

    সেরকম ভরসা না হলেও অনিলদা, আমি আর কমল লোকটার সঙ্গে চললাম। যাচ্ছেতাই অবস্থা। জঙ্গল তেমন ঘন নয় তবে যেখানে-সেখানে বিচ্ছিরি রকমের কাদা। যাইহোক একটু গিয়ে একটা ছোট্ট ভাঙাচোরা মন্দির দেখা গেল। লোকটি একটু দূর থেকে ভক্তিভরে ডাকল “গণেশবাবা, গণেশবাবা…”

    দু-তিন বার সাধনা করতেই গণেশবাবার আর্বিভাব। একটা বেঁটে, রোগা, হাড়জিরজিরে লোক। মাথায় জটা, বুক অবধি দাড়ি। এ কী করবে ভেবে পেলাম না। যা বলার লোকটিই বলল। বাস আটকে গিয়ে ছেলের দল বিপদে পড়েছে, এইসব।

    সবটা শুনে গণেশবাবা আবার ভেতরে ঢুকল। বেরিয়ে আসতে দেখলাম হাতে একটা ছোট থলি। তারপর গণেশবাবাকে সঙ্গে নিয়ে আমরা সকলে আবার মাঠঘাট পেরিয়ে বাসের কাছে ফিরে এলাম।

    গণেশবাবার চেহারা দেখে না ড্রাইভারদাদা না আমদের ফুটবল দলের মধ্যে কোনোরকম উৎসাহ দেখা গেল। তালপাতার সেপাই বলে একটা কথা আছে। তালপাতার সাধু বলে যদি কোনো কথা থাকত তাহলে সে হতো এই গণেশবাবা।

    গণেশবাবা কাদায় আটকে যাওয়া চাকাটা দেখল তারপর আমাদের দিকে তাচ্ছিল্য ভরে তাকাল। যেন বলছে – এটা ঠেলে তুলতে পারলে না, আর তোমরা নাকি ফুটবল খেলোয়াড়! এত বিপদেও আমাদের হাসি পেয়ে গেল – লোকটা পাগল নাকি!

    গণেশবাবা এবার থলি থেকে কী একটা বার করে কাউকে কিছু না বলে বনের ভেতরে মানে বড়বড় গাছের আড়ালে কয়েক পা ঢুকে গেল।

    তীব্র একটা বাঁশির শব্দে আমরা চমকে উঠলাম। গণেশবাবার ওটা তাহলে একটা বাঁশি! চার-পাঁচবার বাজাবার পর বেশ খুশি-খুশি মুখে এসে আমাদের হাত নেড়ে বুঝিয়ে দিল, আমরা সকলে যেন তফাতে সরে যাই। ছেঁড়া গেরুয়া জামাটার হাতা গুটিয়ে এমন করে দাঁড়ালো যেন বলতে চায় – দ্যাখ তোরা, আমি কী করি।

    মিনিট পাঁচেক হয়েছে কি হয়নি, বনের ভেতর থেকে একটা ধপধপ আওয়াজে তাকিয়ে দেখলাম বিরাট একটা হাতি আসছে। হাতিটা কাছে আসতে গণেশবাবা তার শুঁড়ে হাত বুলিয়ে আদর করল। হাতিটাও বেশ মাথাটাথা নেড়ে আদর খেল খানিকক্ষণ। গণেশবাবা ড্রাইভারদাদাকে বলল গাড়িতে উঠে স্টিয়ারিং ধরতে। গজরাজ দেখলাম বুদ্ধিমান, কিংবা হয়তো এরকম কাজ প্রায়ই করে থাকে। সোজা বাসের পেছনে মাথা লাগিয়ে ঠেলা মারল! হাতির গায়ের জোর বলে কথা! ঝরং-ঝরং ঘড়ঘড় শব্দ করে বাস উঠে গেল রাস্তায়। ড্রাইভারদাদা নেমে এল।

    কৃতজ্ঞতা কথাটা ড্রাইভারদাদার অভিধানে ছিল না। বললেন, “অ্যাঁ, দিলে তো আমরা বাসটা তেবড়ে, যত্নআত্তি করে ‘নতুনের’ মতো রেখেছিলাম গাড়িটাকে!… ঠিক করাতে এখন অনেক খরচার ব্যাপার…”

    বাসের পেছন দিকটা একটু তেবড়ে গিয়েছিল বটে।

    গণেশবাবা বলল, “হ্যাঁ, খরচা আছে। চার কাঁদি কলা, এক ঝুড়ি আম আর নারকোল খাওয়াতে হবে একে। দেড়শ টাকা ছাড়ো।”

    “বাস তেবড়ে দিলে, উল্টে আবার হাতির খোরাক চাইছ! একটা পয়সাও দেব না।”

    গণেশবাবা ঠান্ডা গলায় বলল, “তাহলে একে বলেছি এক লাথি মেরে বাস উল্টে দিয়ে যাক।”

    ড্রাইভারদাদা বেজার মুখে পকেট খুঁজে কুড়িটা টাকা বার করল। অনিলদা দিল, আমরা দিলাম। একশ কুড়ি হলো। গণেশবাবা টাকা আর হাতি নিয়ে চলে গেল।

    তারপর? তারপর আর কি।

    ক’ গোলে জিতেছিলাম ঠিক মনে নেই, কিন্তু মেডেল পাবার সময় আমরা যে ‘হিপ হিপ হুররে’ না বলে ‘গণেশবাবার জয়’ বলেছিলাম সেটা স্পষ্ট মনে আছে।



    অলংকরণ (Artwork) : অলংকরণঃ রাহুল মজুমদার
  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments