বুদ্ধদেব বসুর সাথে প্রথম পরিচয়, আমার যখন ক্লাস এইট। সেটা আশির দশকের মাঝামাঝি। আয়ুর হিসেবে বুদ্ধদেব অবশ্য অন্তরিত সেই সত্তরের গোড়াতেই, আমার জন্মেরও আগে। তবে স্রষ্টারা বাঁচেন সৃষ্টি বেয়েই ; তাই আমার সাথে তাঁর সেদিনের আলাপে কোনো বাধা ছিল না।
আমাদের পাঠ্য ছিল পাণ্ডুলিপি, বুদ্ধদেবের কবিতা, নতুন পাতা কাব্যগ্রন্থে বেরিয়েছিল। তেমন বিখ্যাত নয়, অনেকেই নাম শুনলে মনেও করতে পারবেন না এক ছত্র, বুদ্ধদেবও স্থান দেননি তাঁর স্ব-সম্পাদিত আধুনিক বাংলা কবিতা সংকলনে। তাছাড়া পাঠ্যের ওরা কাজ করে, রূপসী বাংলা, মধ্যাহ্নে প্রভৃতি নানা হেভিওয়েট কবিতার ভিড়ে পাণ্ডুলিপি হারিয়ে ছিল প্রায় নির্বাকেই। আর কবিতা পড়ানোর নামে যে রস-মেধ যজ্ঞ চলত আমাদের ক্লাসে, তা'তে অনেক সহপাঠী ও পাঠিনীর কাব্যের প্রতীপে আজীবন টীকাকরণ হয়ে গিয়েছিল। এসব সত্বেও বা হয়ত এসবের জন্যই, পাণ্ডুলিপি আমাকে অদ্ভুত টেনেছিল।
কাব্যটির বিষয় একেবারেই অকাব্যিক। লেখকের সাথে প্রকাশকের মোলাকাত্, একটি পাণ্ডুলিপিকে ঘিরে। লেখকের কাছে পাণ্ডুলিপি তার অনেক মন, মনন ও মগজের নির্যাস, অনেক অনুভূতির বিভূতি। প্রকাশক তাকে চাখছে মুনাফার তূলায়, অনেক কৌটিল্য, খানিক অবজ্ঞা, খানিক অবিশ্বাস মিশিয়ে বলছে, `এ-বই আপনার চলবে তো?'? সৃষ্টির সেই শিব মুহূর্তগুলি ফিরে আসছে লেখকের মনে, দীর্ণ করছে, তার সব-সুখ-দুখ-মন্থন-ধন ক্লিন্ন হচ্ছে বেসাতিতে। মনে হল পাণ্ডুলিপি বিস্ফারিত হবে, শুচিতার প্রতিজ্ঞায়, লোভের প্রতিবাদে। তেমন কিছুই হল না। প্রকাশক বিক্রির বাঁটোয়ারায় মেপে চলল পাণ্ডুলিপিকে।
তখন আমাদের উঠতি বয়স, চোখে মনে রঙ ধরছে সবে, ক্লাশরুমের জানালা দিয়ে বালিগঞ্জ প্লেসের বাড়িগুলোর ঝাঁ-ঝাঁ ছাদ আর টিভি অ্যান্টেনায় কাকেদের সি-স' খেলাও বেশ রোম্যান্টিক লাগে। কবিতায় প্রিয়া-টিয়াদের দেখা পেলে মন্দ লাগে না। পাণ্ডুলিপি পড়ে ক্লাসের অনেক বোদ্ধাই বিধান দিল, কি সব আধুনিক আজগুবি কবিতা, যেন এই শাদা পাতাগুলো দিয়ে ছোট একটি সূর্য আমি তৈরী করেছি, / একটি সূর্য, আমারই প্রাণে জ্বলন্ত !
পাণ্ডুলিপি পড়তে গিয়ে খটকা এল, বই লেখা ব্যাপারটাকে যেমন ঠিক মনে করেছিলাম, তা কি তবে নয়? লিখে ফেললেই হয়ে যায় না, দর কষাকষিও চালাতে হয়, রবীন্দ্রনাথকেও কি হত? এসব ভাবলাম তখন। তারপর গত প্রায় দু'দশক ধরে যতবারই ভেবেছি পাণ্ডুলিপির কথা ততবারই আশ্চর্য হয়েছি, অনুভূতির অভিনবতায়, ব্যথার ঘনত্বে। সৃষ্টিকে পসরা করতে হয় পৃথিবীর অধিকাংশ স্রষ্টাকে, প্রকাশকরা অনেক ক্ষেত্রেই পরিবেশক থাকেন না, হয়ে যান দালালও, বিকিকিনির ব্যাকরণ মানতে হয় সৃজনীকেও, পেটের দায়। কিন্তু এই মানার যে যন্ত্রণা, আপন মনের মাধুরীকে জনপেয় মদিরার পাত্রে ঢালার তোড়জাড়, তার ছাপ রয়ে যায় সৃজনের কোন কানাচে? কবিদের কাজ হয়ত অনেক, বোধহয় প্ল্যাটোই বলেছেন, তাঁরা প্রØংএট ; কিন্তু তাঁরাই একমাত্র যাঁরা মানুষের ব্যথা বোঝেন এবং তা বিশ্বে বিকীর্ণ করেন। যে-যন্ত্রণায় আধুনিক সব স্রষ্টা যুক্ত, তাই ফুটিয়েছেন বুদ্ধদেব, একত্রিশ লাইনের সামান্য এক কাব্যে। এটা যেদিন বুঝলাম, বুদ্ধদেবকে মনে হল নেহাৎ কাছের মানুষ। তখনও তাঁর আর বিশেষ কিছু লেখাই পড়িনি।
ত্রক্রমান্বয় মানলে বলতে হয়, এবং একটু লজ্জা নিয়েই, আবারও বুদ্ধদেবের সাথে সাক্ষাৎ সেই পড়ার বইয়ে। বাংলা বই পড়ি না তখনও তেমন, ইংরেজি এবং বিশেষত পি জি উডহাউসের আলোলিক গদ্যে মশগুল। শ্রেণীর সিঁড়িতে আরেক ধাপ এগিয়েছি, তাঁর বিখ্যাত গল্প এবার, রবীন্দ্র-রচনাবলী । খুবই পরিচিত, অনেকেই হয়ত পড়েছি, দূরদর্শনে অভিনীতও হয়েছে। ১৯৬১ সনের পটভূমি, দেশজুড়ে উত্সব, রবীন্দ্র-জন্মশতবর্ষ। তবে ইতিমধ্যেই যে রবি ঠাকুর শুধুই ঠাকুর হয়ে চালান হয়ে গেছেন আলমারিতে, রেক্সিনে মোড়া রচনাবলীর ধূলার আরতিতে, সেই আবিষ্কার এক ভাবালু যুবকের, গ্রাম থেকে যে সবে এসেছে শহুরে বড়লোক আত্মীয়ের বাড়িতে। রবীন্দ্রনাথের বই তার কাছে মহার্ঘ, তাঁর সাহিত্যের পিপাসা তার আকন্ঠ। আমরা যখন পড়েছিলাম গল্পটা, বিষয়টি তখন খানিক ক্লিশে হয়ে এসেছে। তবুও বেশ নাড়িয়েছিল আমায়। আর মনে পড়েছিল পরেও। এই ক'বছর আগে, দক্ষিণ কলকাতার এক সম্ভ্রান্ত গৃহে শুনছিলাম বাংলাকে ভালবাসার গান। গৃহকর্তা বাঙালির নব-উন্মেষ'এর একজন হোতা, মাঝে মধ্যেই শাঁসালো অতিথি ডেকে বাড়িতে বাংলা-সভ্যতার চাষ করতেন। এঁর কন্যা আমাদের কলেজ আলো করতেন আর কলেজ ম্যাগাজিনের সাম্মানিক সম্পাদিকা ছিলেন। কন্যার আবার রক্তকরবী খুব কিউট লেগেছিল; নাটক রক্তকরবী।
তারপর বইমেলা থেকে কিনলাম বুদ্ধদেবের কবি রবীন্দ্রনাথ । রবীন্দ্রনাথ তখন ত্রক্রমশ জড়াতে শুরু করেছেন আমায়, বিশেষত কবিতায়। ভাষার ঝঙ্কার, ভাবের রণন মায়াবী, তবে তবু, থেকে থেকে মনে হয় ধরার থেকে অধরাই থেকে গেল বেশি। কথায় কথায় কে একজন বাত্লেছিলেন, কবিতা পড়তে শিখতে হয়, শুধুই অক্ষর পরিচিতিতেই হয় না। সেসব ভেবেই কিনে ফেললাম বইটা, কৃশকায় এক খণ্ড, ভারে ও দামে আমার আওতার মধ্যে। অনেক আলোচনা, অনেক ভাল-লাগা, অনেক বিশ্লেষণ ছিল সে বইতে। কবিতার তত্ত্ব নিয়ে নেড়েছেন বুদ্ধদেব কি অনায়াস সহজিমায়, রবীন্দ্রনাথ নিয়ে তাঁর মুগ্ধতা ভরে রেখেছে প্রতিটি বাক্য, তবু বক্তব্যের পথে তা বাধা হয়নি, আবার একবারও মনে হয়নি কলেজের লেকচারের কচকচি। অনেক কবিতার কথাই ছিল সে বইতে, তবে এখনো মনে আছে খেয়া' র অনাবশ্যক কবিতাটির প্রসঙ্গ। কি নরম নিপুণতায় বুদ্ধদেব চিনিয়েছেন একটি কবিতা, তাকে দেখতে, বুঝতে ও ভালবাসতে। এবং কবিতার কথাগুলি পেরিয়েও যে অমর্ত্যের আনাগোনা, যার জন্যই কবিতা কবিতা, তার পানে পাঠকের চোখ খুলে দিয়েছেন। এ-কবিতায় স্তবকে স্তবকে যে অন্ধকার ঘনায়মান, যা গোধূলি, সন্ধ্যা, রাত্রি বেয়ে আমাদের নিয়ে চলে বোধির এক অজানা মোহনায়, সেখানে দেউটি তব হেথায় রাখো বালা, ফিরে ফিরে আসা এই অনুজ্ঞা বহু প্রশ্নের প্রেরক। চরাচর চলছে যে মহাজাগতিক মন্ত্রে, তা চেতন মানুষের সব চিন্তার প্রতিই বিবিক্ত, সেখানে দীপালি শুধু জড় নক্ষত্রের বিকিরণ। সেই ব্যবস্থায় আলো বা আলোর আর্তি, অবান্তর। মহাপৃথিবীতে মানুষ তার সমস্ত আশ্লেষ, আবেগ, আশা নিয়েও নিরালম্ব, নির্বীর্য, নির্বান্ধব। খানিক আশ্চর্য ও আহত হয়ে বুদ্ধদেবের লেখা পড়ে বুঝলাম এটি এমনই এক কবিতা, যা সরাসরি চ্যালেঞ্জ জানায় রবীন্দ্রনাথের অনন্ত আশাবাদীতার ইমেজকে।
পাণ্ডুলিপি, রবীন্দ্র-রচনাবলী ও কবি রবীন্দ্রনাথ পড়ে বিভোর হলাম ঠিকই, কিন্তু বুদ্ধদেব সম্বন্ধে ধারণাটা নানা নতুনত্বের গোলকধাঁধায় গুলিয়ে গেল। বুদ্ধদেব কি কবি, নাকি গল্পকার, নাকি প্রাবন্ধিক, নাকি এসব ছাড়াও আরো অন্য কিছু? আসলে কি তিনি?
এই কি তিনি'র জিজ্ঞাসাতেই আমার বুদ্ধদেবের সন্ধান। তা আজও চলছে। তারই খানিক ধারাবিবরণী এই নিবন্ধে।
কবি বুদ্ধদেব বসুর সোচ্চার আত্মপ্রকাশ বন্দীর বন্দনা কবিতার মাধ্যমে। এটি তাঁর প্রথম কবিতা নয়, পড়লেই বুঝতে পারা যায় এর আবেগ যতই স্বত:স্ফূর্ত হোক, এর পেছনে রয়েছে অন্তত কিছুদিনের অনুশীলন। বালক-কিশোর বয়স থেকেই কবিতা বুদ্ধদেবেকে টেনেছে, পড়েছেন প্রচুর, লেখার মক্সোও শুরু হয়েছে যেন অবধারিত ভাবেই। কিন্তু এই প্রথম যেন নিজের গলা খঁংউজে পাওয়া, বলার মত কিছু একটা বলতে পারা।
ধীরে-ধীরে, অসমমাত্রিক লাইনের পর লাইন, মিলছুট, চলন একটু ভারি, বেরিয়ে এলো এল যুবকের জবানবন্দি, এক শাপভ্রষ্ট দেবশিশুর আত্মঘোষণা। ... শেষ উক্তিটি কাগজে লিখেই আমার অনুভূতি হ'লো -- এটা ঠিক, এটা হয়েছে, এটা সত্যি। মানে, এটা বানানো নয়, আওয়াজের কুচকাওয়াজ নয়, নয় রবীন্দ্রনাথের বা সত্যেন্দ্র দত্তের বদহজমজনিত উদগার -- এখানে আমার কিছু বলার ছিলো, এই প্রথম আমি নিজের গলায় কথা বলতে পারলাম। ... আমার বয়স তখন সতেরো পেরিয়ে আঠারো চলছে ; আমার ছেলেবেলার এখানেই সমাপ্তি। [১]
যেকোনো কবির জীবনে এই গলা খঁংউজে পাওয়া এক যুগান্তের ঘটনা। বুদ্ধদেব তার সাথে শৈশবেরও অবসান মিলিয়েছেন, তা হয়ত এই কবিতার উপজীব্যের জন্যই। ছোটবেলা থেকে বড়বেলায় পৌঁছনোর যে প্রক্রিয়া, ধাপে ধাপে নানা উপসর্গ ও তাদের উপশম পেরিয়ে, বহু ব্যথা, বিভোরতা ও ব্যত্যয়ের বিনিময়ে জীবনের যে পরের স্তরে উত্তরণ, তার এক ইস্তেহার এই কবিতা। (একটু সতর্ক থেকেই ছেলেবেলা থেকে বড়বেলায় লিখলাম না, কারণ আজকাল মেয়েবেলার যুগ, ছেলেবেলা ভীষণ সেক্সিস্ট শব্দ।) বাসনার বক্ষোমাঝে কেঁদে মরে ক্ষুধিত যৌবন, / দুর্দম বেদনা তার স্ফুটনের আগ্রহে অধীর.. বা বিধাতা, জানো না তুমি কী অপার পিপাসা আমার/ অমৃতের তরে। / না হয় ডুবিয়া আছি কৃমিঘন পঙ্কের সাগরে, / গোপন অন্তরে মম নিরন্তর সুধার তৃষ্ণায় / শুষ্ক হ'য়ে আছে তবু।... বা তুমি মোরে দিয়েছো কামনা, অন্ধকার অমারাত্রি-সম, / তাহে আমি গড়িয়াছি প্রেম, মিলাইয়া স্বপ্নসুধা মম। [২] -- ইত্যাদি ছত্র একদিকে যেমন প্রাত্যহিক তেমনি চিরন্তন। যৌবনযন্ত্রণায় যারা জ্বলেছি এবং জ্বালিয়েছি, তাদের সবার মুখপত্র যেন কবি এখানে। তবে এই যন্ত্রণার অভিষেক ও অভিঘাত বদলেছে আজকের জীবনে, প্রযুক্তির দৌলতে তথ্যের খোলা হাটে যাদের জন্ম ও জায়ন, তাদের কাছে এই বার্তা আসে হয়ত অনেক আগেই, হয়ত বোঝবারও আগে। তাই আশ্লেষ আরো কুটিল, সংশয় আরো ঘন, বিস্ময় আরো জটিল। রবীন্দ্রনাথের এই বয়সের কবিতায় যেখানে প্রেমের আকাশী আলপনা, অপরূপ এবং প্রায় অবিশ্বাস্য, তার পাশাপাশি বুদ্ধদেবের বন্দীর বন্দনা, একেবারে ঘর ও ঘরের ভিতরের ; অনেকটাই কাছের।
কলকাতা থেকে ট্রেনযোগে মাদ্রাজের পথে চিল্কা হ্রদ হঠাৎ চিকচিকিয়ে ওঠে, রেল-লাইনের অতি নিকটে, সমান্তরালে। যখন দেখেছিলাম, তখনও চিল্কায় সকাল পড়িনি, এবং যখন পড়লাম তারপরে আর সে দৃশ্য দেখার সুযোগ হয়নি। দেশকালের দুটি বিচ্যুত বিন্দুকে একই রেখায় টেনে এনে যখনই ভেবেছি, চিল্কায় সকাল ছঁংউয়ে গেছে। কী ভাল আমার লাগলো আজ এই সকালবেলায় / কেমন করে বলি। যেন একেবারে আটপৌরে মুখের কথা, হয়ত দেখতে দেখতেই অজ্ঞাতে, অস্ফূটে বলে ওঠা। তারপর আসে নির্মল আকাশ, সূর্যের বন্যা, স্বপ্নাহত রূপোলি জল, দু:সাহসী প্রজাপতি, "তোমার" চোখে কম্পমান কত মৃত্যু, কত জন্মের চিরকালীন না-বলা-বাণী। এখানে শুধুই মানুষ আর প্রকৃতি, অপার, অগাধ, অশোক। এই কবিতায় নেই কোনো ধাক্কা, যেমন প্রজাপতির পাশে চিলের আগমন, বা চিল্কার জলে ক্লেদ-রক্ত-কৃমি ; শুধুই লিরিক্যাল কাব্যও যে আধুনিক হতে পারে তা প্রমাণের সাহস রেখেছেন বুদ্ধদেব।
বর্ষায় ব্যাঙের ফুর্তি। বৃষ্টি শেষ, আকাশ নির্বাক ; / উচ্চকিত ঐকতানে শোনা গেল ব্যাঙেদের ডাক। প্রথম ছত্রেই বেশ জোরদার ঘোষণা, রবীন্দ্র-ধুত্তোর যুগ, গহন রাতে শ্রাবণধারা পড়িছে ঝরে, / কেন গো মিছে জাগাবে ওরে ইত্যাদির বহু আলোকবর্ষ পরে। প্রাণের নিরন্তর প্রেরণা কবি দেখছেন এক অদ্ভুত অনুষঙ্গে, মণ্ডুক এখানে যেন মহাকাল আর মহাপৃথিবীর দ্যোতক। ওরা কাজ করে’ তে যারা বয়ে নিয়ে চলছিল সভ্যতার ধ্বজা তাদের থেকেও আরো অনেক মূলক স্তরে ব্যাঙ বেঁচে থাকে, জ্বালিয়ে রাখে ব্রহ্মাণ্ডের বাঁচার বাতি। বিজ্ঞানের বিধানে যেমন ঘৃণিত, ক্লীববিহারি আরশোলাও থেকে যেতে পারে পারমাণবিক প্রলয়ের পরেও ; এই ধরনের প্রাণ তাদের নিরন্তর নির্বোধি দিয়ে মরণের মহিমাকে অস্বীকার করে চলে। মধ্যরাত্রে রুদ্ধদ্বার আমরা আরামে শয্যাশায়ী, / স্তব্ধ পৃথিবীতে শুধু শোনা যায় একাকী, উত্সাহী / একটি অক্লান্ত সুর ; নিগূঢ় মন্ত্রের শেষ শ্লোক -- / নি:সঙ্গ ব্যাঙের কন্ঠে উত্সারিত - ক্রোক, ক্রোক, ক্রোক। [৩]
বাংলাসাহিত্যে সার্থক এলেজির সংখ্যা বেশি নয়। বিরাট ব্যক্তিত্বের প্রয়াণে লেখা হয়েছে কিছু কবিতা, যেমন নজরুলের রবিহারা, কিন্তু টেনিসনের ইন মেমোরিয়াম -এর মত, আপাত: সাধারণ মানুষের মৃত্যুকেও কাব্যে মহীয়ান করে তোলা হয়নি তেমন। কোনো এক মৃতার প্রতি এক উজ্জ্বল ব্যতিক্রম। সম্প্রতি শ্রীঅশোক মিত্রের আত্মজৈবনিক আপিলা চাপিলা পড়ে জানলাম এই কবিতার প্রেরণা বুদ্ধদেবের অত্যন্ত পরিচিত এক বন্ধু-পত্নীর মৃত্যুতে। মৃতাকে এখানে জানার সুযোগ হয় না, কবিতার মধ্যে কোনো ফেনিত বিশেষণে তাঁকে চেনানোর চেষ্টাও নেই, নেই শোকের উদ্বেল ব্যঞ্জনা। আর নেই স্মৃতির অমরত্বের অসমসাহসী ও অর্থহীন অঙ্গীকার। ব্যক্তির বৃত্ত থেকে একটি সত্তা নিষ্ক্রান্ত হয়ে মিলিয়ে গেল বিশ্বের মাঝে, এই শিব সত্যকে কবি দেখেছেন, ব্যথার আরশিতে। যিনি নেই, তবে ছিলেন ; তাঁর থাকা, হোক সে ক্ষণিকের, আমাদের ছঁংউয়ে যায়। হ্রস্ব কবিতা, পুরোটাই উদ্ধৃত করি --
'ভুলিব না' -- এত বড় স্পর্ধিত শপথে / জীবন করে না ক্ষমা। তাই মিথ্যা অঙ্গীকার থাক। / তোমার চরম মুক্তি, হে ক্ষণিকা, অকল্পিত পথে / ব্যপ্ত হোক। তোমার মুখশ্রী-মায়া মিলাক, মিলাক / তৃণে-পত্রে, ঋতুরঙ্গে, জলে-স্থলে, আকাশের নীলে। / শুধু এই কথাটুকু হৃদয়ের নিভৃত আলোতে / জ্বেলে রাখি এই রাত্রে -- তুমি ছিলে, তবু তুমি ছিলে। [৪]
কবি বুদ্ধদেবের ব্যাপ্তি বিরাট, কয়েকটি প্রক্ষিপ্ত উদ্ধৃতিতে তাঁকে চেনা যায় না। কবিতা ব্যাপারটাই এমন, তাকে বোঝানোর চেষ্টা বৃথা। ব্যক্তিবিশেষে হয় বাজবে, নয় বাজবে না। তবে একথা বলা চলে, সমসাময়িকদের থেকে বুদ্ধদেবের শৈলী স্বতন্ত্র। তাঁর কবিতায় নেই সুধীন্দ্রনাথের অদ্ভুত, অসাধারণ (এবং অবশ্যই খটোমটো) ভাষার বিচ্ছুরণ, নেই জীবনানন্দের নিগূঢ়, নিদারুণ বিশ্ব, মানব ও মৃত্যুবোধ, নেই বিষ্ণু দে'র বিবিধ সঞ্চয়ের (বিশেষত রবীন্দ্রনাথের) রসায়ন। নেই আধুনিকত্বের কোনো সোচ্চার ঘোষণা, কোনো প্রগল্ভ বিদ্রোহ। যেন অত্যন্ত অনায়াসে, অবলীলায় অতীতকে পেরিয়ে, রবীন্দ্রনাথের আসমানী উপস্থিতিকে স্বীকার ও শ্রদ্ধা করে, নিজের পথে হেঁটেছে বুদ্ধদেবের কবিতা। আগের ঐতিহ্যকে পরিপাক করে, কিন্তু সবরকম কালাপাহাড়ি পরিহার করে বুদ্ধদেব লিখেছেন, একান্ত নিজের মতন। তাঁর কাব্যে গড়ার আনন্দ, শুধুই ভাঙার আস্ফালন নয়।
বুদ্ধদেবের একটি ছোটগল্পের উল্লেখ আগেই করেছি। এবার তাঁর দুটি উপন্যাসের আলোচনা করব। একটি ভাত পরীক্ষা করেই পুরো হাঁড়ির সম্বন্ধে নিদান দেওয়া যায়, কিন্তু সাহিত্যের ক্ষেত্রে এ পলিসি মূঢ়তা। বিদ্যাধর সূরজপ্রসাদ নঈপাল তাঁর নোবেল বক্তৃতায় বলেছিলেন, I said earlier that everything of value about me is in my books. I will go further now. I will say I am the sum of my books. Each book, intuitively sensed and, in the case of fiction, intuitively worked out, stands on what has gone before, and grows out of it. [৫] লেখকের সব বইই সমান দরকারি তাঁর নিজের চর্যায়, তাই ইচ্ছামত দুটি বই তুলে এনে কোনো থিওরিতে উপনীত হওয়া উচিত নয়। এখানে তিথিডোর এবং রাত-ভ'রে-বৃষ্টি আমার নিজের ভাল-লাগায় রাঙা। তাই তাদের নিয়েই লিখছি। কোনো মতেই এরা রিপ্রেজেন্টিটিভ স্পেসিমেন নয়, তেমন কিছু হয়ও না।
তিথিডোর বৃহৎ উপন্যাস, কিন্তু বৃহৎ ক্যানভাস নয়। প্রেক্ষিত যদিও এমন বর্তমানে যা'তে ইতিহাসের অনেক উপকরণই আছে। জমে-ওঠা দ্বিতীয় মহা-যুদ্ধ, জাপানী আগ্রাসনের ভয়ে কম্পিত মহানগর, রবীন্দ্রনাথের শিখা প্রজ্বলন্ত, কম্পমান, এবং অবশেষে নির্বাপিত, সাম্যবাদের স্বপ্নে বঁংউদ কিছু যুবক, এবং স্বাতী -- রাজেনবাবুর কণীনিকা। স্বাতীর জন্ম থেকে উদ্বাহ, মুখ্যত এই সময়কে ঘিরেই বেয়ে উঠেছে গল্প। গল্প তেমন কিছু নয়। শৈশব, কৈশোর, যৌবন ছঁংউয়ে চলেছে জীবন স্বাতীর, তার বাবা, দিদিরা, দাদা যে-যার নিজের বৃত্তে পাশাপাশি চলেছেন। মা আগেই প্রয়াত। স্বাতীর সেন্সিটিভিটি আস্তে আস্তে বিকশিত হয়, প্রকৃতি, প্রণয়, পুরুষের প্রতি। আর পাঁচটা সাধারণ মেয়ের মতই, প্রচলিত অভিঘাত, পরিচিত অভিব্যক্তি। নেই কোনো হালের কুমারিবেলার গনগনে অভিজ্ঞতা, বা বিষময় আশ্লেষ। আজকের যুগে বসে পড়তে পড়তে তাই প্রতি মুহূর্তেই মনে হয়েছে, তেমন কিছু ঘটছে না কেন, কোনো ঘুর্ণি এসে স্বাতীকে দেহে-মনে নাড়িয়ে-উড়িয়ে দিক না, কোনো গভীর অপ্রত্যাশিত অথচ দারুণ কাঙ্খিত কিছু। কিছইংউ হয় না। প্রবীর মজুমদার স্বাতীকে চায়, এবং প্রগাঢ় প্রতিপত্তি সত্বেও শুধুই স্বাতীর দিদির মাধ্যমে পাণিপ্রার্থনা জানায়। তারপর নাকচ হয়ে গিয়ে স্বাতীর বিয়েতে গাড়ি পাঠায় এবং দেঁতো হাসি হেসে নিমন্ত্রণ-রক্ষা করতে যায়। সত্যেন রায় শিক্ষিত, শীলিত, নম্র, খানিক নিড়বিড়েও ; স্বাতীর হৃদয়ের পথে তার আনাগোনা ইংরেজি ও বাংলা কাব্যের সাঁকো বেয়ে। শেষ পর্যন্ত স্বাতীকে সে'ই পায়।
সব লেখকের প্রায় সব লেখার মধ্যেই আত্মজৈবনিক উপাদান থাকে; ইংরাজ রস-সাহিত্যিক জেরোম কে জেরোম বলেছিলেন, একমাত্র একজনকে নিয়েই লেখা যায়, তা হল নিজেকে। রবীন্দ্রনাথের মৃত্যর দিনের যে স্পর্শী বর্ণনা তিথিডোর -এ আছে, তা বুদ্ধদেব-এর প্রত্যক্ষ উপলব্ধির'ই নির্যাস। আমাদের কবিতাভবন -এ সেই শূন্যতা, রিক্ততার দিনটির কথা লিখছেন :
পড়ন্ত বেলায় রৌদ্রপ্লাবিত এসপ্ল্যানেড : কাজ ফেলে দিয়ে সকলেই আজ রাস্তায় -- শামলা পরা উকিল-ব্যারিস্টার, আলখাল্লায় খ্রীস্টান সন্ন্যাসী, পীত বসন, গৈরিক বসন, জনসাধারণ ; প্রায় মনে হয় উত্সব, কোনো মিছিল - কিন্তু মিছিল নয়, লোকেরা ছুটছে এলোমেলো, দিগ্বিদিকে, যেন উদভ্রান্ত, কোথায় যাবে কি করবে দিশে পাচ্ছে না। .... মনে পড়ে অজিত চক্রবর্তীকে, বোধহয় ফিরতি পথে দেখা হ'য়ে গেলো তাঁর সঙ্গে, ব্রিস্টল হোটেলে বসে দু-জনে পান করলাম দু-গ্লাশ শেরি অথবা ভের্মুথ -- কেন হঠাৎ চিরন্তন চায়ের বদলে সুরা তা বলতে পারবো না, তখনও আমি অ্যাল্কহল সেবনে অভ্যস্ত হইনি -- কিন্তু বোধহয় সেইজন্যই, এই দিনটিকে আমার কোনো বিশেষ আচরণের দ্বারা চিহ্নিত করার জন্য। [৬]তিথিডোরের আগুয়ান আধুনিক কবি, ধ্রুব দত্ত'ও তো সেদিন উস্কো-খুস্কো চুল নিয়ে দিক্ভ্রান্ত হয়ে একলা রেস্তোর্ঁরায় মদ্যপান করছিলেন। আর বাস'এ স্বাতীর পাশে বসা পনেরো বছরের মেয়েটি, অনুমতি না নিয়েই খবরের কাগজের স্পেশাল এডিশন নিল স্বাতীর হাত থেকে, "তার চোখ নড়তে লাগল উপর থেকে নিচে, আর সেই চোখ থেকে টপটপ করে পড়তে লাগল কালো-কথা-ছাপানো কাগজটার উপর, ছাপাখানার কাঁচা-কালি মুছে মুছে দিয়ে। " [৭] তিথিডোর যেন রবীন্দ্রনাথের প্রয়াণ আরো প্রত্যক্ষ করে তোলে, আরো কাছের, আরো ব্যথার।
এমন বৃহৎ ঘটনার প্রেক্ষিতে যেমন, তেমনি মামুলি আটপৌরে আয়নাতেও তিথিডোর মনকে ছঁংউয়ে যায় বারে বারে। স্বাতী-সত্যেনের বিয়ের উত্সব সকলকেই দুলিয়ে দিয়ে যায়, নিজেদের আশা-অবস্থা নির্বিশেষে। সব পারিবারিক আনন্দানুষ্ঠানের যে মহিমা আছে, যা আমাদের বর্তমানের খিন্নতা ম্লান করে দেয়, ক্ষণিকের জন্য হলেও ; "... আর নিখিলের হঠাৎ মনে হল কারখানায় পেরেক ঠোকে তাতে কী ... কোনো ভয় নেই, কোনো দু:খ নেই, সে সব পারে, তার সব আছে।..." [৮] শৈশবে পিতৃহারা সত্যেনের মামাতো ভাই নিখিল, সংসারের দায় তার উপর। সত্যেনের সংস্কৃতি-শীলন থেকে নিখিল অনেক দূরে, তবু তার প্রণয় ও পরিণয় নিখিলকেও বাহ্যজীবনের বাইরেটা দেখিয়ে দেয়। এক পলকে।
ভাষার ব্যবহার স্বচ্ছ, সাবলীল ও সাধারণ। নবজাতক পড়ে স্বাতীর মনের ভাব, যা হয়ত একটি বিশেষ বয়সে আমাদের সকলের উপরেই রবীন্দ্রনাথের অভিঘাত, বোঝানো হয় কয়েকটি আশ্চর্য সরল বাক্যে। ... ‘নবজাতক’ খুলে বসল, এখানে ওখানে চোখ বুলিয়ে এলোমেলো পাতা ওল্টাল কয়েকবার। তারপর হঠাৎ অন্য কথা ভুলে গিয়ে পড়তে লাগল কবিতা। একটির পর একটি, শান্তি নামল মনে। যেসব গল্প এ-কদিন ধরে সে পড়েছিল, তার আশ্চর্য পাগলামির পরে এ যেন এক আরো আশ্চর্য শান্তি, ঝড় অন্ধকার আর অসহ্য বিদ্যুত থেকে বেরিয়ে সে যেন চলে এল এমন এক দেশে যেখানে সব আলো, সব ভাল, সব সুন্দর। ... [৯] সত্যেনের নিদানে ইত্যবধি স্বাতী মোঁপাসা ও টলস্টয়ের স্বাদ-গ্রহণ করছিল।
তিথিডোর পড়ে আরেক আবিষ্কার, সংলাপের শৈলী । কথা এখানে ভাষ্যের সাথে মিলে মিশে একাকার, কোনো যতিচিহ্ন দিয়েও আলাদা করা নেই। পড়তে যেমন তরল, বুঝতেও তেমনই। তবে কথোপকথনের বিভঙ্গ যেন বড়ই একমাত্রিক, বিভিন্ন চরিত্র তাদের হাজার বিভিন্নতা নিয়েও একই স্বরগ্রামে, একই উচ্চারণে কথা বলে চলেছে। রবীন্দ্রনাথ বুদ্ধদেবের যেদিন ফুটল কমল বইটির প্রসঙ্গে বলেন, পড়তে পড়তে খটকা লেগেচে পদে পদে তোমার ভাষায়। অনেক স্থানেই বাক্যের প্রণালী অত্যন্ত ইংরেজি। মনে মনে ভাবছিলেম, এখনকার যুবকযুবতীরা সত্যিই কি এমনতরো তর্জ্জমা করা ভাষাতেই কথাবার্ত্তা কয়ে থাকে ! অন্তত আমার অভিজ্ঞতায় তো আমি এতটা লক্ষ্য করি নি। কথাবার্ত্তার এ রকম কৃত্রিম ঢংটাতে রসভঙ্গ হয় কেননা তাতে সমস্ত জিনিষটার সত্যতাকে দাগী করে দেয়। [১০] ইংরেজি বাক্যগঠনের শৃঙ্খল থেকে তিথিডোর অনেকটাই মুক্ত, এবং সত্যকে দাগিয়ে দেওয়ার মত ভীষণ ব্যাপার খঁংউজে পাইনি, তবে সংলাপের ধারা যেন বেশি সরল বলেই খানিক বিভ্রান্তিকর। বইটির একেবারে শেষের অনুচ্ছেদ লেখা এক অপরিচিত কলমে, দাঁড়ি, কমার মত বিভাজক পাংচ্যুয়েশন পরিহার করে শুধুই কিছু খণ্ড, প্রক্ষিপ্ত, শব্দের বর্ণালী, তারা কখনও ঘটনা, কখনও চিন্তা, কখনও শুধুই শব্দ। যেন কোনো জয়েসীয়
stream of consciousness জাতীয় নিরীক্ষা চালাচ্ছিলেন বুদ্ধদেব এই পৃথুলা উপন্যাসের উপান্তে এসে।আর তিথিডোরের এই দৈর্ঘ্য খানিক বিচলিত করে আমায়। খুব লম্বা বই চিরকালই আমার কাছে সম্ভ্রমের হলেও, স্বস্তির নয়। অবশ্যই ব্যাতিক্রম আছে, যেমন গোরা । তবে তিথিডোরের থীম বা থীমহীঁনতা নিয়ে ৩২৮ পৃষ্ঠার বয়ন যেন অনেকটাই বেশি, বইটির সংহতি এতেই বেশ ব্যাহত হয়ে যায়। তবে এই ঘাটতি পুরোপুরিই পূরণ হয়েছে আমার পরের আলোচ্য বইটিতে। তিথিডোর আর তার মাঝে দুই দশকের ব্যবধান, এবং সেই বইটি বুদ্ধদেবের লেখক জীবনের প্রান্তিক পরিণতির রচনা। শ'খানেক পৃষ্ঠারও কম তার কলেবর, কিন্তু বক্তব্যের ঘনত্বে ও অ্যানালিসিসের গহনতায় তুলনাহীন।
যেসব স্রষ্টা ধারাবাহিক ভাবে সৃষ্টিকার্যে নিয়োজিত থেকেছেন জীবনের এক প্রান্ত থেকে আরেক পর্যন্ত, তাঁদের অনেকের সৃষ্টির বাহ্যিক আয়তনে এক অদ্ভুত বিবর্তন দেখা যায়। অনেক জায়গা, অনেক শব্দ, অনেক বর্ণ থেকে সরে এসে, অল্প পরিসরে আশ্রয় মেলে ; উচ্চারণ থেকে অভিব্যক্তিই হয়ে ওঠে বড়। রবীন্দ্রনাথের স্রোতস্বিনীর মত কাব্যের অনর্গল উত্সার, নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ, বসুন্ধরা এবং আরো অনেক কবিতায় দুকূল ছাপিয়ে উপচে উঠে পাঠিককে অতিরিক্ত ভাবে ও ভাষায় সময়ে সময়ে অসাড় করে ; একই কবি ত্রক্রান্তিলগ্নের কাছে এসে লেখেন, ছোট্ট, মেদবিবর্জিত কিছু ছত্র, প্রথম দিনে সূর্য / প্রশ্ন করেছিল / সত্তার নূতন আবির্ভাবে -- / কে তুমি। / মেলেনি উত্তর । যে কথা কথারও অতীত, তাকে ধরা যায় যেন এই অনন্য বাক্সংযমে। তেমন বিঠোভেন'এরও প্রাথমিক সৃষ্টি বৃহৎ সময়ের ক্যানভাসে আঁকা প্রচণ্ড স্বরগ্রামের গনগনে আরতি, স্রষ্টা যেন খঁংউজে চলেছেন অসংখ্য শব্দের অরণ্যে নিজের সিদ্ধি, অসহ্য তাড়নায় সুর-অসুরের সংঘাত আগুন ছড়াচ্ছে শ্রোতার মনেও। কিন্তু শেষের পর্বে এই সুরকার
quartet, quintet প্রভৃতিতে স্বল্প বাদ্যের সমাহারে প্রকাশ করছেন অপরূপ দ্যোতনা। তিথিডোর থেকে রাত ভ'রে বৃষ্টি’ র মাঝের যে চর্যা, সেখানেও হয়ত এই একই মার্জন কাজ করেছিল বুদ্ধদেবের লেখক সত্তায় ; সেই অনন্য economy of form তাঁর আয়ত্তে এসেছিল, যা বড় স্রষ্টাকে বিরাট স্রষ্টায় পৌঁছে দেয়।রাত ভ'রে বৃষ্টি'র ব্যাপারে সবথেকে আলোচিত দিকটি নিয়ে আর আলোকপাতের প্রয়োজন দেখি না। শিল্পসৃষ্টিকে নিষিদ্ধ করার কারণ-অকারণ নিয়ে চর্চা নিষিদ্ধকারীদেরই অযথা স্বীকৃতি জানানো। চিরকাল এঁরা ছিলেন, থাকবেনও ; যদিও প্রতিবারই নতুন করে মনে হয়, এ যুগে তারাই জন্ম নিয়েছে আজি / মন্দিরে তারা এসেছে ভক্ত সাজি। আশার কথা, আজকের ইন্টারনেটে'এর যুগে ফতোয়া দিয়ে কন্ঠরোধের চেষ্টা ঔজবুক্যেরই সামিল, যদিও তেমন চেষ্টার খামতি নেই। সম্প্রতির সব থেকে সাড়া জাগানো ব্যান্ড বাংলা বই'ও তো আন্তর্জালে বিরাজমান, শুধু পেড়ে নেওয়ার অপেক্ষায়। তবে একটা মজার কথা বলা যেতে পারে। বুদ্ধদেবেরই কোনো রচনায় পড়েছিলাম, তাঁর প্রথম দিকের এরা আর ওরা এবং আরো অনেকে উপন্যাসের কোনো ছাপানো কপি তাঁর কাছে নেই, লাল-বাজার না ঐরকম কোনো পুণ্যস্থানে শাস্ত্রমতেই সব কপির সত্কার হয়েছিল, আদিরসের অভিযুক্তিতে। সেখানে হাজিরা দিয়ে ফেরার পথে স্বপক্ষের কনিষ্ঠ উকিল লেখককে বলেন যে নিজের জন্য এক কপি তিনি বাঁচিয়ে রেখেছেন, বাড়ি গিয়ে রসিয়ে পড়বেন।
রাত ভ'রে বৃষ্টি ত্রিকোণ প্রেমের গল্প। দ্বিকোণ প্রেমটা সব থেকে স্বাস্থ্যসম্মত ও সুবিধার হলেও, তা নিয়ে গল্প পাকানো যায় না। এই প্রিন্সিপলটা প্রতিপন্ন করতে কলেজের এক বন্ধু পলিগন্যাল প্রণয় নিয়ে কাহিনী লিখেছিলেন একবার (ঠিক মনে নেই, তবে ছকটা বোধহয় চতুর্কোণিক বা পঞ্চকোণিক ছিল); কিন্তু কলেজ-ম্যাগাজিনের সম্পাদকীয় পর্ষৎ তা নাকচ করে, অতিরিক্ত আদিরসের কারণে। ওই রসের উপাদান রাত ভ'রে বৃষ্টি তে অনেকে খঁংউজে পেয়েছেন, তবে মনোজ্ঞ পাঠক মাত্রেই স্বীকার করবেন, আদিতা এখানে প্রথম ও শেষ কোনো কথাই নয়।
রাত ভ'রে বৃষ্টি তে তিনটি মূল চরিত্র, মালতী, জয়ন্ত ও নয়নাংশু। অবশ্য অপর্ণাও এসেছে আনাচে-কানাচে, তবে তা নেহাতই পার্শ্বিক প্রয়োজনে। ঘটনাপ্রবাহ প্রায় নেই বললেই চলে, থাকলেও তার গতি অত্যন্ত শ্লথ। গল্পের গণ্ডিতে সময়ের পরিসর অল্প, কিন্তু সময়কে এখানে বার বার এগিয়ে, পিছিয়ে, থামিয়ে দিয়ে তৈরি করা হয়েছে যেন কালচ্যূত কোনো বুদ্বুদ। সাইকোলজিকাল নভেল বলে যা সাধারণত পরিগণিত হয়ে থাকে, তার কিছু উপাদান আছে এই উপন্যাসে, তবে নিছক তাই আছে বললে কম বলা হয়। এটি একটি উপন্যাস'ও নয় হয়ত, ইংরেজিতে যাকে নভেলা বলা হয় অনেকটা সেই রকম। (নভেলার বাংলা বড়গল্প যথাযথ নয় আমার মতে, কারণ গল্প আর উপন্যাসের তারতম্য শুধুই দৈর্ঘ্যের নয়।) মনস্তাত্বিক বিশ্লেষণ এখানে মুখ্য হলেও সেটাই সবটা নয়, আকস্মিক কাব্যময়তা হঠাৎ ছঁংউয়ে যায়। কবি ও গদ্যকার বুদ্ধদেব মিলে, মিশে গেছেন একেক জায়গায়, আমাদের মনন ও মরমে দোলা লাগে যেন একই সঙ্গে। রাত ভ'রে বৃষ্টি এমনই এক বই, যা নিয়ে অ্যাকাডেমিক আলোচনা করা যায় না, কেউ সেই অসাধ্যসাধন করে ফেললেও তা মুখ্যতই বৃথা হবে। এ বই নিজে পড়বার এবং ভাববার ; পড়তে পড়তে মালতী, নয় জয়ন্ত নয় নয়নাংশু করোর না কারোর সঙ্গে নিজের মিল যেন পাওয়া যাবেই, এমনই অসাধারণ মুন্সিয়ানায় চরিত্রায়ন সম্পন্ন হয়েছে। সাংসারিক প্রাত্যহিকতার পর্দার আড়ালে লুকোনো অনেক মনোবিহার এখানে উঠে এসেছে অনন্য সাধারণতায়, যা আমরা চিনতে পারি, বুঝতে পারি, কিন্তু সাধারণ্যে স্বীকার করতে কুন্ঠিত হই।
সম্প্রতি আমার এক বন্ধু তাঁর নবোঢ়া পত্নীকে রাত ভ'রে বৃষ্টি পড়তে দিয়েছিলেন । দাম্পত্যের অরুণ ঊষায় এ বই তেমন যুত্সই কিনা তা নিয়ে তর্ক উঠতে পারে, তবে বন্ধুটি ছিলেন লিবারেল, মুখে তো বটেই, মনে-প্রাণেও হয়ত। তা সেদিন একথা সেকথার পর জানালেন যে বইটি তাঁর স্ত্রীর অত্যন্ত ভাল লেগেছে, এবং নয়নাংশুর সাথে স্বামীর বেশ মিল পেয়েছেন। সাদৃশ্যের কথাটা উচ্চারণের সময় সিগারেটের লাইটার জ্বালানোর বিভঙ্গে মুখটা ঢাকা ছিল বন্ধুর, তাই ব্যাজার না ফিলসফিকাল তা বোঝার আগেই আমি বলে ফেললাম, তোরও কি নিজেকে নিখিলেশ-নিখিলেশ লাগে নাকি? অজান্তেই কথাটা বলে ফেলেছিলাম, বন্ধু বিষম খাওয়াতে বেশ অনুতাপ হল।
ঘরে বাইরে আর রাত ভ'রে বৃষ্টি র মধ্যে মিল মেলা শক্ত নয়। ঘরে বাইরে যেমন ত্রক্রমান্বয়ে আত্মকথার ভিতর দিয়ে এগিয়ে চলেছে, রাত ভ'রে বৃষ্টি ও পুরোটাই উত্তম পুরুষের জবানী। প্রধান চরিত্র কয়েকটি নিজেদের অতীত-ভবিষ্য, আশা-নিরাশা, ঘাত-প্রতিঘাত অকপটে তুলে ধরছে পাঠকের সামনে, কোনো ভাষ্যকার তাদের একই গ্রন্থিতে গেঁথে দিচ্ছেন না। সে কাজটা যে পড়ছে তার। অবশ্য জয়ন্ত'র পরিচয় রাত ভ'রে বৃষ্টি তে মুখ্যত প্রতিফলিত, সরাসরি তার সংকল্প-সংশ্লেষের সাথে আমাদের সাক্ষাৎ অল্পই। এবং ঘরে বাইরে র মত কোনো বিরাট ক্যানভাসে ব্যক্তিগত বেদনা বিলীন হবার সুযোগ এখানে নেই। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী নাগরিক সমাজের চিত্র রাত ভ'রে বৃষ্টি তে আঁকা হয়েছে অসাধারণ বাস্তবতায়, কিন্তু তা ছোট ছোট মানুষের ছোট ছোট অস্তিত্ব। স্বদেশী, বন্দেমাতরম, দাঙ্গা, নেই এমন কিছুই, যা নিমেষের জন্য মানুষকে টেনে নিয়ে বিরাটের মধ্যে ফেলে ব্যক্তিজীবনকে তুচ্ছ করে দেয়। শেষে নেই কোনো আগুন যা বিমলার মত মালতীকে পুড়তে সুযোগ দিল, নিখিলেশকে গভীর রাত্রের বিপন্নতার মধ্যে ঝাঁপাতে প্রবুদ্ধ করল। সন্দীপের নিষ্ক্রমণের মতোও কোনো ঘটনা এখানে ঘটল না, ক্ষুদ্র জীবন ক্ষুদ্রতাতেই আছড়ে, আঁকড়ে বেঁচে থাকল, অ্যামিবার মত। তার মাঝে মাঝেই হয়ত অমর্ত্যকে পাওয়া যাবে ক্ষণিকের জন্য, মনে হবে সব ঠিক, সব ভালো, সব আলো। যেমন এক সন্ধ্যার চণ্ডালিকা, নয়নাংশু-মালতীকে নিয়ে গেল অতল জলের আহ্বানে, বিভোর হল দুজনেই, বলল, আশ্চর্য ! আশ্চর্য ! অত সহজ, সরল, মাঝে-মাঝে সেন্টিমেন্টাল -- কিন্তু হঠাৎ এক-একটা-ঝাপটে কোন উঁচুতে উঠে যায়। [১১] সেই উঁচুও নিমেষের, জানে দুজনেই, তবুও কাঁপিয়ে যায়। আবার অবধারিত প্রত্যাবর্তন, সংশয়, সঙ্কট, বিরাগ, বৈপরীত্যের চোরাবালিতে।
রাত ভ'রে বৃষ্টির শেষে ভোর হয়। "ওঠো নয়নাংশু, তাকিয়ে দ্যাখো আজকের এই ঝকঝকে দিনটির দিকে তোমাদের এই নতুন জীবনকে অভ্যর্থনা জানাও।" [১২] কেমন সকাল? জয় হোক নব অরুণোদয়... এসো অপরাজিত বাণী, অসত্য হানি --- / অপহত শঙ্কা, অপগত সংশয়? তা হয়ত নয়। এই ভোর জীবনের প্রবহমানতার প্রতীক। দ্য শো মাস্ট গো অন। ব্যাক্তিজীবন ছারখার হয়ে যেতে পারে, হয়ে গেলেও বেঁচে থাকতে হবে, "... একটা হাত কাটা গেলেও বেঁচে থাকে মানুষ, একটু ফুসফুস নষ্ট হ'লেও বেঁচে থাকে ----...।" [১৩] বুদ্ধদেব শেষ করলেন রাত ভ'রে বৃষ্টি এমনই ব্যঞ্জনায়, যেখানে আলো জ্বলল না, আবার নিভলও না, জ্বলা-নেভার মাঝে দোলায়মান হয়েই রইল। যেমন থাকে সবার সাধারণ জীবন। আবার রাত হবে, বৃষ্টিও আসবে ভ'রে। তারপর সকালও হবে হয়ত, যতদিন সূর্য বেঁচে থাকে। তারপর সূর্যও শেষ হবে একদিন।
এই শেষের প্রসঙ্গে আরেকটি বইয়ের কথা এসে পড়ে ; সেটি আবার অধুনা ঐশ্বরিক স্পর্শে বেশ পপুলার হয়েছে। চোখের বালি। কবিতা পত্রিকার আষাঢ় ১৩৮৭ সংখ্যায় রবীন্দ্র-রচনাবলীর তৃতীয় খণ্ডের সমালোচনা প্রসঙ্গে বুদ্ধদেব বসু, চোখের বালি বিষয়ে লিখেছেন, ".... কিন্তু "চোখের বালি" সম্বন্ধে একটি আপত্তি জানাতেই হয়, বইটির সমাপ্তি অতি দুর্বল। সত্যি বলতে, শেষ পাতাটি প'ড়ে বিশ্বাসই হ'তে চায় না যে এখানেই, এই জোড়া-তালি দেয়া প্রাণহীন রফাতেই এ তীব্র উপাখ্যানটির শেষ ..... " । [১৪] আর মোহনার মুখে মহানদী রবীন্দ্রনাথ, ২৮শে জুন, ১৯৪০ সালে লেখেন বুদ্ধদেবকে চিঠিতে, তোমাদের কবিতায় চোখের বালির সমালোচনার শেষ অংশে যে মন্তব্য দিয়েছ তা পড়ে খুব খুশি হয়েছি। চোখের বালি বেরবার অনতিকাল পর থেকেই তার সমাপ্তিটা নিয়ে আমি মনে মনে অনুতাপ করে এসেছি, নিন্দার দ্বারা তার প্রায়শ্চিত্ত হওয়া উচিত। [১৫] রাত ভ'রে বৃষ্টির শেষে তাই হয়ত বুদ্ধদেব সব দৌর্বল্য পরিহার করে, কুঠারের ফলার মত নির্মম রোদকে নিয়ে এসেছেন, যা সব মানে, সব জানা আলোর মত পরিষ্কার করে দেয়। নেই কোনো ম্যাড়মেড়ে মাঙ্গলিকতা, শুভবুদ্ধির আজগুবি উদয়ন বা "জোড়া-তালি দেয়া প্রাণহীন রফা"। আছে নির্মোক বাস্তব।
রাত ভ'রে বৃষ্টি বুদ্ধদেব লেখেন তাঁর লেখক জীবনের উপান্তে। যে থীম নিয়ে এবং যে আঙ্গিকে তিনি লিখেছেন এ বই, তার ভিতর যেমন আছে এক অনন্য এক্সপেরিমেন্টেশন তেমনই অফুরান সাহসিকতা। এই সাহস নিজেকে ভাঙার সাহস, নিজের সাহিত্যকীর্তির সীমানাকে আরও এগিয়ে নিয়ে যাবার সাহস, অজানা পথে। লব্ধপ্রতিষ্ঠ সাহিত্যিকরা অনেকেই এই রিস্ক নিতে চান না, ইমেজ ও বাজার হারানোর ভয়। বুদ্ধদেবের লেখক জীবনের নিরিখে রাত ভ'রে বৃষ্টি র টাইমিং আমাকে অনেকটাই মনে করিয়ে দিয়েছে রবীন্দ্রনাথের ল্যাবরেটরি গল্পের কথা। তাঁর আশি বছরের জন্মদিনের কাছাকাছি লেখা, শেষ ছোটগল্পগুলির অন্যতম। এ গল্প না পড়লে রবীন্দ্রনাথকে জানা অনেকটাই বাকি থেকে যায় ; এবং তিনি আধুনিক কতটা ও কিনা সেই তর্কেরও খানিক দিশা মেলে।
বুদ্ধদেব সম্বন্ধীয় ইত্যবধির আলোচনায় বারবার এসে পড়েছেন রবীন্দ্রনাথ। সেটা স্বাভাবিক, রবীন্দ্রনাথ বাঙালির, বিশেষত একটি যুগের বাঙালির ইতিহাস-কৃষ্টি-কল্পনা জুড়ে ছিলেন ও থাকবেন। তবে বুদ্ধদেবের সাথে রবীন্দ্রনাথের সম্পর্ক বেশ অনন্য ; এবং তার পরিচয়ের ভিতরে বুদ্ধদেবের কৃত্যের সন্ধানও নিহিত আছে।
উত্তর-রৈবিক যুগের প্রথম কন্ঠস্বর রবীন্দ্রনাথ নিজেই, এ কথা বুদ্ধদেব বলেছেন অকপটে। আধুনিক বাংলা কাব্যের অন্যতম দিশারি বুদ্ধদেব লিখছেন, ... The progenitors of this poetry had the dubious luck of being born Rabindranath's contemporaries: dubious, for the incalculable advantage of being alive and young when Rabindranath was alive and gloriously ageing also brought in its train certain serious and rather peculiar problems. I do not know that any single poet in history so completely permeated the language and the literature of his country and his time as Rabindranath in his later years. Inevitably and rightly, young poets were steeped in him; but what was neither inevitable nor right was that many, instead of journeying with him and in him, were lead to use him as an anchor. For these, it was impossible not to imitate Rabindranath, and it was impossible to imitate Rabindranath. [১৬]
বুদ্ধদেবের সাথে রবীন্দ্রনাথের সম্পর্ক বহুকৌণিক। এক দিকে তাঁরা ছিলেন প্রগাঢ় ব্যক্তিগত স্নেহ-শ্রদ্ধার বন্ধনে আবদ্ধ। দেখা সাক্ষাৎ হয়েছে অনেকবার, চিঠিপত্রেও যোগ ছিল নিয়মিত। সেই সম্পর্কের খতিয়ান বুদ্ধদেব রেখে গেছেন বহু লেখায়। আমরা যারা রবীন্দ্রনাথকে দেখিনি, পরের আরো যারা দেখবেন না, তাদের কাছে বুদ্ধদেবের সব পেয়েছির দেশে যেমনই এক অসামান্য ঐতিহাসিক দলিল, তেমনি অশেষ রসের আকর। এই বইতে শুধু রবীন্দ্রনাথ নন, তাঁর চারপাশে বিকীর্ণ হত যে আশ্চর্য বাতাবরণ, তাও উঠে এসেছে অপূর্ব কাব্যিকতায়। সব পেয়েছির দেশে এক সূর্যাস্তের বর্ণনা, সেখানে অস্তরাগের হাজার বর্ণে মিলে গেছে বহু ঊষা ও বহুতর মধ্যাহ্ন।
ব্যক্তিগত সংযোগের বাইরেও রবীন্দ্রনাথ ও বুদ্ধদেব যুক্ত ছিলেন সৃষ্টির চিরন্তন আত্মীয়তায়। একই ভাষার, একই কৃষ্টির সাহিত্যিক তাঁরা, কিন্তু দুই প্রজন্মের, দুই যুগের। বাঙালির কাছে, বিশ্বের কাছে রবীন্দ্রনাথকে ইন্টারপ্রেট করায় বুদ্ধদেবের অবদান বিপুল। রবীন্দ্র-জন্মশতবর্ষে বহু দেশে বুদ্ধদেব বক্তৃতা করেছেন আমন্ত্রিত হয়ে, তারই সংকলন
Tagore : Portrait of A Poet প্রভৃতি বই।হাওড়া কি অন্য কোথাও ঠিক মনে নেই, একটা ছোট-মতন সাহিত্য-সম্মিলনে আমাকে একজন বললেন, আপনি যা লেখেন তা বুঝতে আমাদের কোনো কষ্ট হয় না, বেশ ভালোও লাগে। কিন্তু রবিবাবুর লেখা মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝতে পারি না -- কি যে তিনি লেখেন তা তিনিই জানেন। ভদ্রলোকটি ভেবেছিলেন তাঁর এই কথা শুনে নিজেকে অহংকৃত মনে করে আমি খুব খুশি হব। আমি উত্তর দিলুম, রবিবাবুর লেখা তোমাদের তো বোঝবার কথা নয়। তিনি তো তোমাদের জন্য লেখেন না। আমার মত যারা গ্রন্থকার তাদের জন্যে রবিবাবু লেখেন, তোমাদের মত যারা পাঠক তাদের জন্যে আমি লিখি। [১৭]
শরত্চন্দ্রের এই মন্তব্যের মধ্যে রবীন্দ্রনাথের লেখার সম্বন্ধে একটা বড় সত্য অত্যন্ত স্পষ্টভাবে ব্যক্ত আছে। সাধারণ পাঠকের কাছে রবীন্দ্রনাথকে সঞ্চরণের কাজটি বুদ্ধদেব সারা জীবন ধরে করেছেন পরম নিষ্ঠায়।
|
আরো উদ্ধৃতি অবান্তর। এইরকম প্রায় অতুল ভক্তিমুখর ছত্র ছড়িয়ে আছে অনুজ কবিদের বহু চিঠিতে। মনে রাখা দরকার এই স্তুতি কোনো নিছক স্তাবকবৃন্দের নয়, (তেমন মানুষও রবীন্দ্র-পরিমণ্ডলে অল্প ছিলেন না) এমন কথা তাঁরাই বলছেন যাঁদের প্রধান ব্রত ছিল রবীন্দ্রোত্তর নতুনত্বের সন্ধান ও চর্চা। এই চিঠিগুলি পড়তে পড়তে অনুজ কবিদের মনের ভাব একটি ইংরেজি শব্দে চিহ্নিত করা যায়,
overawed । অস্তায়মান সূর্যও তখনও তাঁদের চোখ ও মন ধাঁধিয়ে দিচ্ছে।রবীন্দ্রনাথের বুদ্ধদেবকে লেখা ছত্রিশটি চিঠি গ্রথিত হয়েছে এখানে, বুদ্ধদেবের রবীন্দ্রনাথকে লেখা, উনচল্লিশটি। ব্যক্তিগত কুশল বিনিময় আছে একান্ত আন্তরিকতায়, আছে কবিতা পত্রিকার জন্য প্রার্থিত লেখার তত্ব-তল্লাশ, আছে বুদ্ধদেবের সদ্য প্রকাশিত রচনার সম্বন্ধে রবীন্দ্রনাথের মন্তব্য, এবং সমসাময়িক নানা বিষয়ে বিতর্ক নিয়ে মতের আদানপ্রদান। বন্দেমাতরং গানটির জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে উপযোগিতা নিয়ে রবীন্দ্রনাথ বুদ্ধদেবের ভিতর মত-পার্থক্য হয়েছে, তার ছায়া পড়েছে তাঁদের চিঠিতে, "স্লোগান-এর কথা উল্লেখ করেছ, বন্দেমাতরং এই বাক্যটিতে আছে স্লোগান, -- কন্গ্রেস তাকে এবং তার সঙ্গে আরো কিছু ডালপালা ন্যাশনাল সংগীতের কেয়ারিতে রোপণ করেছে সুতরাং ও নিয়ে তর্ক তুললে বৃথা উত্তেজনা প্রকাশ করা হয়। .... তুমি আমাকে গাল দাওনি। কিন্তু তাই যথেষ্ট নয় তুমি আমাকে বুঝিয়ে দাও। .... " [২০] অন্য প্রসঙ্গে বুদ্ধদেব ব্যাকুল হয়ে লিখেছেন রবীন্দ্রনাথকে পাছে তিনি ক্ষুণ্ণ হন, "অমৃতবাজার পত্রিকাটি আমি নিয়মিত দেখিনে ; লোকমুখে শুনলুম ঐ পত্রিকায় একটি খবর বেরিয়েছে যে আমি নাকি এক বক্তৃতায় বলেছি বাংলা সাহিত্যের অধ:পাতের জন্য রবীন্দ্রনাথই দায়ী। কথাটা এত হাস্যকর যে এর প্রতিবাদ করাও বৃথা--..।" [২১]
তবে এইসব ছাড়িয়েও আছে কিছু অ্যাবস্ট্র্যাক্ট আলোচনা, যা সাহিত্যের চিরন্তন ধারার সাথে যুক্ত। রবীন্দ্রনাথের এই চিঠিগুলির অংশবিশেষ কবিতা পত্রিকার তত্কালীন সংখ্যায় প্রবন্ধ আকারেও প্রকাশিত হয়েছে। এখানে রবীন্দ্রনাথ বুদ্ধদেবের মধ্যে ব্যবধান নেই এক প্রজন্মের, নেই ফারাক দুই সম্পূর্ণ ভিন্নমুখী সৃষ্টি আঙ্গিকেরও। বুদ্ধদেব লিখছেন, "আমার কাছে -- প্রত্যেক আধুনিক বাঙালি লেখকের কাছে -- কিন্তু বিশেষ করে আমার কাছে আপনি দেবতার মত। আপনার কাছ থেকে আমি ভাষা পেয়েছি। সে-ভাষা আপনার পছন্দ হয় না। আমারই দুর্ব্বলতা, অক্ষমতা। উত্স-স্রোত স্বচ্ছ, বিশুদ্ধ -- আমি কি তাকে ঘোলাটে ক’রে তুলি আমার বেসামাল ইংরেজি শিক্ষা দিয়ে? কিন্তু তর্ক করবো না ; শুধু এই সুযোগ গ্রহণ করছি আপনাকে আমার অন্তরের গভীরতম ধন্যবাদ জানাবার-- আপনি আমাকে ভাষা দিয়েছেন ব'লে।" [২২] নিজের ভাষা যে একান্তই নিজের তা প্রমাণ করতে আজকের যুগের সাহিত্যিকদের তত্পরতা কম নয়, যেকোনো প্রাইজ পেলেই তো সোরগোল শুনি, উনি একেবারেই নতুন ভাষা বানিয়েছেন। সেখানে বুদ্ধদেবের এমন অকপট ঋণস্বীকার তাঁর অসাধারণ সততাকে চিনিয়ে দেয়। যে কাব্যের পথ তাঁর থেকে বেঁকে গেছে অনেকটাই, রবীন্দ্রনাথ তার সম্বন্ধে মত দিয়েছেন চোখা শব্দচয়নে, এবং তারই সঙ্গে খানিক অন্তর্লীনা অভিমানেও, "তোমরা কবিতার নতুন পথ তৈরি করতে লেগে যাও -- আমার পথ চলে গেছে কোন বেঠিকানায়। সেদিকটাতে তোমাদের পণ্যের ব্যবসায় তোমরা তুলে দিয়েছ। নতুন ব্যবসায়ের হিসাব-নিকাশী এখনো দেখা দেয়নি, মনে মনে লাভের অঙ্ক কষে চলেচ, আশা করি মহাজনী জমে উঠবে -- এতকালের সমস্ত খাতাপত্র বাতিল করে দিয়ে। তোমাদের পথটা বিশেষ দুর্গম বলে বোধ হচ্চে না, যদি সঙ্কোচ না থাকত তোমাদের দলে ভিড়তে পারতুম। মুদ্রাভঙ্গী অভ্যাস করা শক্ত নয়। কিন্তু তার আরোপিত মূল্যকে বিশ্বাস করা শক্ত। বিস্তর কবি পাবে, যারা মুদ্রাভঙ্গী করতে করতে সাহিত্যের পথে শোভাযাত্রা করবে -- শোভা হবে কিনা আমাদের পক্ষে বলা শক্ত।" [২৩]
২৪ মে, ১৯৪১ রবীন্দ্রনাথ বুদ্ধদেবকে যে চিঠি লেখেন তা'তে এমন এক আত্মজৈবনিক উপাদান আছে যা প্রায় অন্য কোনো লেখাতেই মেলে না। "আমরা যে ইতিহাসের দ্বারা একান্তই চালিত একথা বারবার শুনেছি এবং বারবার ভিতরে ভিতরে খুব জোরের সঙ্গে মাথা নেড়েছি। এ তর্কের মীমাংসা আমার নিজের অন্তরেই আছে যেখানে আমি আর কিছু নই -- কেবলমাত্র কবি সেখানে আমি সৃষ্টিকর্তা সেখানে আমি একক, আমি মুক্ত। বাহিরের বহুতর ঘটনাপুঞ্জের দ্বারা জালবদ্ধ নই। ঐতিহাসিক পণ্ডিত আমার সেই কাব্যস্রষ্টার কেন্দ্র থেকে টেনে এনে ফেলে যখন, আমার সেটা অসহ্য বোধ হয়। একবার যাওয়া যাক কবি-জীবনের গোড়াকার সূচনায়।" [২৪]। তারপর রবীন্দ্রনাথ নির্মম ঋজুতায় এঁকেছেন তাঁর স্বীয় বিবর্তনের রূপরেখা, সেখানে ঘটনা নয়, বড় হয়েছে তাঁর আত্মিক অনন্যতা। দীর্ঘ চিঠি, খাপছাড়া উদ্ধৃতিতে ধরা যায় না। পাঠককে অনুরোধ করি তা নিজে পড়ে দেখতে।
রবীন্দ্রনাথ সারা জীবনে এমন কোনো সাহিত্যসঙ্গী পান নি, যাঁর সাথে সখ্যের ভিতর দিয়ে, তর্কের ভিতর দিয়ে, সংশ্লেষের ভিতর দিয়ে একে অপরে হয়ে উঠবেন আরো ঋদ্ধ। তাঁর আকাশপ্রতিম প্রতিভার নিরিখে তেমন বন্ধু পাওয়া হয়ত সহজ ছিল না। কিন্তু গ্যেটে তো পেয়েছিলেন শীলারকে, আর শীলার গ্যেটেকে। বুদ্ধদেব রবীন্দ্রনাথের এই ফাঁক ভরাট করেছিলেন সাধ্যমত, মহাকবির জীবনের শেষ এবং সবথেকে স্মরণীয় দশকে। এইখানেই রবীন্দ্রনাথ-বুদ্ধদেবের সম্পর্ক এক অতুলনীয় মাত্রা পেয়ে যায়।
আসলে আমার মনে হয় রবীন্দ্রনাথ ও বুদ্ধদেবের সৃষ্টিজগতে এক অন্তর্নিহিত মিল আছে। স্রষ্টাদের হয়ত দুভাগে ভাগ করা যায়,
expressionists এবং evolvers ; স্ফূরক এবং বিবর্তক। সুকান্ত, নজরুল বা টেনিসন, এঁরা প্রথম গোত্রের। প্রকাশের উদ্বেল উচ্ছ্বাসে, সৃষ্টিসুখের উল্লাসে এঁরা মাতোয়ারা, ফেনিল ঘূর্ণিতে এঁদের সৃষ্টি চলে খানিক বৃত্তাকারে। লক্ষণীয়, সুকান্ত অকালে প্রয়াত, নজরুল বেঁচে থেকেও অনেকদিন স্তব্ধ স্থবির, এবং টেনিসন সম্মানিত দীর্ঘ জীবনের অধিকারী। আয়ুর এমন তারতম্য সত্ত্বেও এঁদের লেখায় নেই তেমন ত্রক্রম পরিবর্তনশীলতা, নেই নিরন্তর বদলের ছাপ। ঝর্নার মত ঝাঁপিয়ে, ছাপিয়ে তাঁদের সৃষ্টিশীলতার চারণ। অন্যদিকে বিবর্তকেরা বয়ে যান নিজেদের ভেঙে ভেঙে, তাঁদের ভাব ও ভঙ্গিতে নতুনত্বের ছটা প্রতি পদে, এবং হয়ত অনিবার্য কন্ট্র্যাডিক্শনেরও। তাঁদের এক সত্তার মধ্যে অনেক সত্তার সন্নিবেশ, উত্স থেকে মোহনায় তাঁরা চলেন মহানদীর মত, বহু শাখায় পুষ্ট হয়ে এবং বহু ধারায় প্রেরিত হয়ে। রবীন্দ্রনাথ ও বুদ্ধদেব দুজনেই evolver । ভীষণ মনোনিবেশে তাঁদের কয়েকটি বই পড়ে ফেললেই তাঁদের বোঝা হয়ে যায় না, তাঁরা উদ্ঘাটিত হন ত্রক্রমে ত্রক্রমে, পাঠকের নিজের চর্যার সাথে তাল মিলিয়ে।
ইংরেজিতে যাকে নন-ফিক্সন বলা হয়, তার বাংলায় তর্জমিত শব্দবন্ধ কি হতে পারে, অ-গল্প? তেমন প্রচলন নেই, তবে বিশ্বসাহিত্যের অনেকটাই জুড়ে আছে যে নন-ফিক্সন, তাতেও বুদ্ধদেবের চারণ অবাধ। সাহিত্যের এই ক্ষেত্রে মূলত অ্যানালিসিসের প্রাধান্য বেশি, বহুল তথ্য ও তত্ত্ব সংহত করে বিশেষ ধারা ও ধারণায় পৌঁছনো এবং পাঠককেও সেই বোধির পথে চালিত করা, এই হল লক্ষ্য। শুধু প্রবন্ধ বললে পুরো বলা হয় না, কারণ এই শব্দটির ভিতরে কেমন যেন পাণ্ডিত্যের ঝনঝনানি উঁকি মারে; অথচ নন-ফিকসনের ভিতরে অবাধ আচরণ কল্পনার, সরসতার এবং প্রাজ্ঞতার।
এই নন-ফিক্সন প্রসঙ্গে মনে পড়ল, কলকাতার পুরোনো পাড়ার এক প্রতিবেশী, অত্যন্ত সজ্জন লোক, রিটায়ার করে এক ভক্তিব্যবসায়ীদের দলে ভল্যান্টিয়ারি করতেন। একদিন হন্তদন্ত হয়ে আমাকে রাস্তায় ধরে বললেন, আচ্ছা, তুমি তো সায়েন্সের ছেলে, নন-ম্যাটার বলে কিছু জান? আমি যথাসম্ভব সবিনয়ে সাইকেলটা থামিয়ে ভাবুক মুখে বললাম, আজ্ঞে দাদু, আমার তো তেমন পড়াশোনা নেই, তবে নন-ম্যাটার তো ঠিক মনে পড়ছে না, সম্প্রতি অ্যান্টে-ম্যাটার বলে কি একটা বাজারে উঠেছে, সেইটা কি ...? না না, অ্যান্টিতে হবে না, আসলে অমুক গুরু বলেছেন, ব্রহ্মই বস্তু, বাকি সব অবস্তু, তাই ভাবছিলাম, অবস্তুকে নন-ম্যাটার দিয়ে ইন্টারপ্রেট করলে সায়েন্সের সাথে একটা ব্রীজ করা যেত, ওঁর বাণীর।
যাইহোক, নন-ফিকসন বুদ্ধদেব লিখেছেন অজস্র ; তার অনেক নানা বইয়ে সংগৃহীত, আবার অনেক হয়ত আজও ইতস্তত ছড়ানো রয়েছে। ত্রি বিশং ধী ষ্ণশংংত্র ষ্ণশছযয এমন একটি বই যা একবার পড়লে শেষ হয় না, বহুবার পড়লেও না। শিরোনামের অসাধারণত্ব ছড়িয়ে আছে বইয়ের প্রতিটি অক্ষরে। বুদ্ধদেব বইটিকে বলেছেন, A Review of Modern Bengali Literature । এ শুধু রিভিউ নয়, এবং আধুনিক শব্দটিও ভণিতা মাত্র, কারণ বাংলা সাহিত্যের অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যত সবেরই আনাগোনা এখানে, আলোর মত। বুদ্ধদেবের মতামতের সাথে সব ক্ষেত্রে একমত না হওয়া গেলেও, তাঁর অন্তর্দৃষ্টি চমকে দিয়ে যায়। রবীন্দ্রনাথ প্রসঙ্গে লিখছেন, ".. .. in his boyhood or youth he displayed no prodigious talents, no revolutionary fire; he obeyed conventions and followed his elder; he was rather slow, rather dim and timid. If he died at Keat's age, he would have been a minor poet of the anthologies, taking his turn with twenty others; at Shelley's, a fascinating figure whom poets and scholars would be constantly 'discovering'; if his life had closed at fifty, or seventy even, he would not have meant to us as much as he does. His death, at eighty, has been premature, for he was still changing, still growing. Throughout his life, he has grown like some great tree, slowly, inperceptibly, with gentle passivity." [২৫] এই সবই আমাদের জানা, কিন্তু এই বীক্ষা আমাদের চিনিয়ে দেন বুদ্ধদেব। এমন পারস্পেক্টিভ চেনাতে পারেন তিনিই।
আবার আরেক জায়গায়, বাংলা ভাষার প্রসঙ্গে লিখছেন,
... The one inherent and practically irremediable weakness of Bengali is its lack of verb-roots. This, too, verse can circumvent and even turn into an advantage, but prose has no way out. What we envy English most is its inexhaustible capacity for turning nouns and adjectives, whatever their origin, immediately into verbs. Bengali is so verb-shy that for a great number of actions we have no choice but to use the root 'to do' or 'to be' after the appropriate nouns, and the writer who wishes to avoid monotony has to have its wits about him all the time...." [২৬] বাংলা এবং ইংরেজি দুই ভাষাতে অপার দক্ষতা থাকলে তবেই এমন সিদ্ধান্তে পৌঁছনো সম্ভব। ভাষাকে এমন ভালবাসা সাম্প্রতিক সাহিত্যিকদের ভিতর বিরল ; যদিও তাঁরা আজকাল অনেকেই বাংলা-বাঁচাও ইত্যাদি আন্দোলনের শরিক।An Acre of Green Grass পড়ে আমার খানিক আক্ষেপও হয়েছে। দুটি কারণে। প্রথমত:, এ বই পড়লে বোঝা যায় ইংরেজিতে লেখার সম্ভাবনা বুদ্ধদেবের ভিতর কতটা ছিল, যা হয়ত তাঁর বাংলা লেখার তলায় অনেকাংশেই চাপা পড়ে যায়। তাঁর সমসাময়িকদের ভিতর সাহিত্যে সব্যসাচী হবার ক্ষমতা ছিল আরো দুয়েক জনের, যেমন অন্নদাশংকর বা সুধীন্দ্রনাথ, তবে এঁরা কেউই ইংরেজিতে লেখায় তেমন মনোনিবেশ করেননি। সমবয়স্কদের মধ্যে নীরদচন্দ্র চৌধুরী বাংলা এবং ইংরেজি দুই সাহিত্যেই স্বাক্ষর রেখেছেন, যদিও তাঁর ইংরেজি লেখার ব্যাপ্তি ও প্রকর্ষ আরো উঁচুতে। দ্বিতীয়ত:, এই বইয়ের সম্প্রসারিত সংস্করণ বুদ্ধদেব লিখলেন না কেন? An Acre- এর প্রথম প্রকাশ ১৯৪৮ সালে, অত:পর বাংলা সাহিত্য বয়েছে অনন্য ও অজস্র ধারায় ; তার সম্বন্ধে বুদ্ধদেবের ইংরাজি আলোচনা থেকে আমরা বঞ্চিত হলাম, যা অবাঙালি অনুরাগীদের কাছে বাংলাসাহিত্যের প্রধান পরিচায়ক হতে পারত।
সাহিত্য সম্বন্ধীয় আলোচনায় বুদ্ধদেবের অপার সাবলীলতা আমাদের মুগ্ধ করে। ফর্ম, টেকনিক ইত্যাদি অত্যন্ত ভারি বিষয়ও তিনি সাধারণ পাঠকের বোধিগম্য করে তোলেন যেন অনায়াস স্বাচ্ছন্দ্যে। জীবনানন্দের কবিতার কথা -ও কবিতাপ্রেমীদের বিশেষ দরকারি বই, কিন্তু সেখানে আলোচনার গাঢ়তা ও বাক্যগঠনের জটিলতা অনেক ক্ষেত্রেই যেন বিভ্রান্তিকর। তাঁর পদ্যের গহনতা জীবনানন্দের গদ্যকেও প্রায়ই দুর্গম করে তোলে। অন্যদিকে বুদ্ধদেবের লেখা নদীর মত গতিময়।
মহাভারতের কথা -র রচনাকাল ১৯৭১-৭৪। মহাকাব্যের বিশ্লেষণ বললে বড়ই কম বলা হয়, এই বইটি নিজেই প্রায় মহাকাব্যিক। সাহিত্য, দর্শন, ধর্ম ও ভাষাতত্বের এমন সংশ্লেষ যেকোনো দেশের সাহিত্যেই বিরল। এই বই পড়ে জেনেছি, বুঝেছি অনেক, আবার বুঝিনিও অল্প নয়। মহাভারতের কথা পাঠকের কাছ থেকেও অনেকটা আশা করে, প্রাজ্ঞতা ও শীলনের। অন্য অনেক ক্ষেত্রে না-বোঝা বিমুখতা জারিত করে; কিন্তু এ বই অদ্ভুত সম্মোহনী, পাতার পর পাতার গম্ভীর, ভারি অথচ সরস আলোচনা যেন এক নি:শ্বাসে শেষ করতে ইচ্ছা করে। মহাভারতের কথা থেকে প্রক্ষিপ্ত উদ্ধৃতি বাতুলতা, এই বইয়ের সার্থকতা তার সমগ্রতায়। এমন বই লেখার জন্য যে প্রগাঢ় লেখনীশক্তির প্রয়োজন, জীবনের একেবারে শেষে এসে তা বুদ্ধদেবের পুরোপুরিই ছিল। এবং এই কারণেই তাঁর চলে যাওয়া অকালে। প্রতিভা বসুর মহাভারতের মহারণ্যে এ-বইয়ের দৃষ্টিকোণ থেকে খানিক ভিন্নধর্মী, এবং তা পড়ে আমার কাছে বুদ্ধদেবের বিশ্লেষণ আরো স্পষ্ট হয়েছে।
বুদ্ধদেবের আত্নজৈবনিক রচনা, আমার ছেলেবেলা, আমার যৌবন এবং অসমাপ্ত আমাদের কবিতাভবন । লেখকের জীবন শুধু বাইরের নয়, আবার শুধু ভিতরেরও নয়। এ-দুয়ের মাঝে নিশ্চয় আছে কোনো মিল এবং সেই মিল যেমন করে মিলেছে ভিতর বাইরের আলো বেড়ে গেছে ইত্যাদি আশ্চর্য পঙ্ক্তিতে (নাকি ছত্রে) ঠিক তেমন করেই বুদ্ধদেব মিলিয়েছেন তাঁর হয়ে ওঠার গল্পে। এখানে ঘটনার বর্ণনা এসেছে অনায়াসে, কিন্তু তার সাথে নিজের বিবর্তনের ছায়াও পড়েছে সরল স্বচ্ছতায়। পিতা-মাতার সঙ্গবঞ্চিত ছেলেবেলা তাঁর ভরে ছিলেন দিদিমা-দাদামশাই, তাঁর শৈশবের সারল্য, কৈশোরের কৌণীকতা ও যৌবনের যন্ত্রণা, সবই ছাপিয়ে উঠেছে বুদ্ধদেবের প্রতিভার নিরন্তন বিকাশ। তারপর বিবাহ সংসারিকতার ভিতর দিয়ে তিনি বয়ে চলেছেন, যোত্রের প্রয়োজনে কলমকে ছোটাতে হয়েছে রেসের ঘোড়ার মত, রীপন কলেজে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে জীবিকার দায় কাটিয়েছেন ক'টি বছর। স্বধর্মের প্রতি কি প্রবল প্রতীতি মানুষকে এমন পরিস্থিতির ভিতরেও স্থির রাখে, সৃষ্টিশীল রাখে, ভেবে অবাক হতে হয়। আমারা যারা উঙ্ছবৃত্তিতে মথিত থেকেও বাঁচবার আশা রাখি, প্রতিনিয়ত মস্তক ও মগজ বিক্রয় করেও মননকে আগলাতে চাই, তাদের এই বই পাঠ্য। এই তো সেদিন একজন চিন্তাশীল বন্ধুকে তাঁর প্র্যাক্টিকাল ও প্রতিষ্ঠিত কাকা বললেন, তা প্রমোশন-টমোশন মিস্ করছ না তো, তুমি তো আবার লেখ-টেখ ! শেষের কথাগুলি প্রায় স্বগতে, যেন কোনো গর্হিত অন্যায়ের প্রসঙ্গ। বাড়ি এসে বুদ্ধদেবের এই সব লেখা হাতড়ে ছিলেন, বন্ধুটি। যেটা আমার কাছে বিরাট বিস্ময়, বুদ্ধদেবের অনেক লেখাই হয়ত পারিশ্রমিকের হাতছানিতে, কিন্তু সেখানে নেই কোনো কম্প্রোমাইজের ছায়া। জন স্টুয়ার্ট মিল্'এর সিনিক্যাল উক্তি,
the writings by which a man can live are not those that themselves live [২৭] বুদ্ধদেবের ক্ষেত্রে খাটে না। তিনি বেঁচেছেন এবং তাঁর লেখাও বেঁচেছে তাঁকে ছাড়িযে।এই বইগুলি পড়লে আরেকটি ব্যাপার খুব স্পষ্ট হয়ে ওঠে, নিজের বিশ্বাস ও ধারণার মাটিতে বুদ্ধদেব কতটা সৎ ও ঋজু ছিলেন। ইংরেজিতে যাকে
integrity বলা হয়, তার প্রকাশ প্রতিটি পঙক্তিতে। আমার যৌবন'এর দশম পরিচ্ছেদে লিখছেন, "বোধহয় সন্ত্রাসবাদেরই প্রভাবে, ঢাকার ছেলেরা অনেকেই খুব বিবেকানন্দ পড়ছে তখন, কিন্তু যে-ছেলেকে তার দশ বছর বয়সে আঁকড়ে ধরেছিলেন রবীন্দ্রনাথ, আর এইমাত্র যাকে কাঁপিয়ে দিয়ে গেছে 'জেইন আয়ার,' 'উদারিং হাইট্স' সে কী করে বিবেকানন্দে কান পাতে?" আরো লিখেছেন, কেমন করে দিলীপ কুমার রায়'এর সাথে তাঁর প্রগাঢ় স্নেহ-শ্রদ্ধার সম্পর্ক, চিরতরে মুছে গিয়েছিল, দিলীপ কুমারের কবিতা সম্পর্কে বুদ্ধদেবের অকপট ও অপ্রিয় মতামত জানানোর জন্য। আজকাল যেখানে লেখকদের পলিটিক্যালি কারেক্ট হওয়া ভীষণ জরুরি, সেখানে বুদ্ধদেবের ব্যতিক্রম আমাদের চমকে দেয়।
বুদ্ধদেব নিজের সৃষ্টিশীলতার চর্চার পাশাপাশি আরেক ধরনের কাজের সঙ্গে যুক্ত থেকেছেন যার গভীর প্রভাব বাংলার সাহিত্যসেবী এক বা একাধিক প্রজন্মের উপর। নিজের সাহিত্যজীবনের প্রায় সব পর্যায়েই বুদ্ধদেব পত্রিকা সম্পাদনায় জড়িত ছিলেন, এবং সেখানে তাঁর ভূমিকা শুধু সম্পাদকেরই ছিল না, তিনি ছিলেন এক মুভমেন্টের অগ্রণী। প্রগতি, কবিতা, বৈশাখী ইত্যাদি পত্রিকা চলেছে তাঁর ঐকান্তিক উত্সাহে এবং অনেক ক্ষেত্রে নিজের খরচেও। বাংলার সাধারণ্যে কবিতা-রুচিকে প্রতিষ্ঠিত করার পিছনে বুদ্ধদেবের অবদান অপরিসীম ; আজ যারা সেলিব্রিটি পোয়েট, দু-দশটা প্রাইজ পেয়ে সভা-সমিতিতে বাণী দিয়ে বেড়ান, তাঁদের বর্তমানের অস্তিত্ব অনেকটাই বুদ্ধদেবের একার অধ্যবসায়ের ফসল।
বুদ্ধদেব সম্পাদিত কোনো পত্রিকার সংখ্যা আমার হাতে নেওয়ার সুযোগ হয়নি, সম্প্রতি পুন:মুদ্রিত কবিতা'র রবীন্দ্র-সংখ্যা ছাড়া। এই সংখ্যা প্রকাশের সময় রবীন্দ্রনাথ বর্তমান, এবং কবিতার সংখ্যায় তিনি উপস্থিত প্রথম পাতাতেই, দুর্বল, বিপর্যস্ত, ভাঙা হাতের একটি স্বাক্ষর। তাও শুধু নামটি, পদবীর দেবত্বও যেন মুছে গেছে, জরাজর্জর দেহের দৈন্যে। বইটি খুলেই, এই পাতা ঝাঁকিয়ে দিয়ে যায়, মনে পড়ে যায় মহাভারতের উপান্তে, অর্জুনও একদিন গাণ্ডীব তুলতে পারেননি, এক জীবনের ধনুর্চর্চার কীর্তিতে, ক্লান্তিতে। এই সংখ্যার লেখার আয়োজন অপূর্ব, এবং যা দেখে আশ্চর্য হতে হয়, প্রায় সব লেখাতেই নির্মেদ অ্যানালিসিসের মেজাজ ও চর্চার নতুন দৃষ্টিকোণ। রবীন্দ্রনাথ লেখেন বুদ্ধদেবকে, মে ১৮, ১৯৪১ সালে, "আমাকে অবলম্বন করে এবারকার কবিতা পত্রিকায় সাহিত্য সম্বন্ধে যে সকল আলোচনা প্রকাশিত হয়েছে তেমন সুসম্পূর্ণ ও সুবিচারিত প্রবন্ধ ইতিপূর্বে কোনো বাঙলা পত্রিকায় আমি দেখিনি, এ আমার পক্ষে বিস্ময়জনক।" [২৮] রবীন্দ্রনাথের বিস্ময় মূলত আলোচনা তাঁকে নিয়ে নয় বলে, তাঁর সাহিত্য নিয়ে বলে, এবং তা বাংলায় বলে। আজকের যারা বেস্টসেলার লেখকদের মোটকা "পিরিয়ড" উপন্যাসে পড়ে রবীন্দ্রনাথকে চেনেন, বা পেশাদার গবেষকদের উদ্ভট থীসিস নেড়ে, তারা একবার কবিতা পত্রিকার এই কৃশকায় সংখ্যাটি হাতে নেবেন।
সমসাময়িক লেখকদের সম্বন্ধে বুদ্ধদেবের আগ্রহ প্রবাদপ্রতিম। জীবনানন্দের কাব্যকে ভাল লাগতে শিখিয়েছেন আমাদের, অনেকটাই বুদ্ধদেব। অন্যরাও তাঁর দৃষ্টির অগোচরে ছিলেন না ; এক চিঠিতে লিখছেন, "... 'কবিতা' পত্রিকার মারফৎ সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কবিতা আপনার হয়তো দু'একবার চোখে পড়েছে। তিনি সম্প্রতি 'পদাতিক' নাম দিয়ে একটি কবিতার বই বের করেছেন, একখানা বই আজ আপনাকে পাঠানো হ’লো। আমি নিজে সুভাষের কবিতার বিশেষ অনুরাগী, এত অল্প বয়েসে এতখানি শক্তির প্রকাশ আমার তো বিস্ময়কর মনে হয়। বইখানা আপনার কেমন লাগলো তা জানতে পারলে সুভাষ শুধু যে উত্সাহিত হবেন তা নয়, হয়তো তাতে তাঁর আত্মশুদ্ধিরও সুযোগ মিলবে।..." [২৯] চিঠির প্রাপক রবীন্দ্রনাথ। সমসাময়িক কবির প্রতি কতটা সহমর্মিতা থাকলে, এমন চিঠি লেখা যায়।
বুদ্ধদেবের এই অবদান স্মরণ করেছেন উদারমনা সমসামিয়করাও। লীলা মজুমদার তাঁর পাকদণ্ডী বইতে লিখেছেন, "সন তারিখের কথা বলতে পারব না, বুদ্ধদেব ইতিমধ্যে তার জীবনের শ্রেষ্ঠ কাজ সকলের অজানিতে শুরু করে দিল। সে কাজ বলতে কোনো আশ্চর্য রচনার কথা ভাবছি না। এ তার চেয়েও বড় কাজ। বুদ্ধদেব নানা ভাবে আধুনিক বাংলা সাহিত্যের গোড়া পত্তন করে গেছে। আমাকে বহু তরুণ কবি বলেছেন, বুদ্ধদেবের কাছেই তাঁরা প্রথম উত্সাহ ও সহযোগিতা পেয়েছেন। .... আমি সর্বদাই বলি আমার লেখক হয়ে ওঠার মূলে আমার বন্ধু বুদ্ধদেবের হাতও আছে। কত জায়গায় সে আমার শিশুসাহিত্য সাধনা, আমার বাংলা ভাষা বিষয়ে সহানুভূতিশীল মন্তব্য করেছে, এ কথা ভুলবার নয়।" [৩০]
নিজের লেখার বাইরেও বুদ্ধদেব এই ভাবে বিস্তৃত হয়েছেন একটি যুগে, একটি কালে।
বুদ্ধদেব সম্পাদিত আধুনিক বাংলা কবিতা আমার প্রবাসজীবনের বিশেষ অবলম্বন। কোনো কাব্য সঙ্কলনই সম্পূর্ণ হতে পারে না, কারণ কাব্য ব্যাপারটাই একটি গমন, গন্তব্য নয়। তত্সত্ত্বেও বুদ্ধদেবের প্রয়াসে এই সঙ্কলন অধিকভাবে প্রতিনৈধিক, এবং সেইখানেই তার সার্থকতা। আমাদের ভুললে চলবে না, রবীন্দ্রনাথের নেতৃত্বেও এমন একটি সঙ্কলনের কাজ হয়েছিল, কিন্তু তার চয়ন সম্বন্ধে বিদগ্ধ ও সাধারণ পাঠকের মনে সংশয়ের অবকাশ অল্প ছিল না।
গত শতাব্দীর দ্বিতীয় দশক নাগাদ বাংলা সাহিত্যে শ্লীল-অশ্লীল নিয়ে ঘোরতর দ্বন্দ্বের উদয় হয়। মূলত নবীন ও প্রবীণদের মধ্যে, এবং শনিবারের চিঠি প্রভৃতি পত্রিকার অনুঘোটনায়। আজকের যুগে এমন দ্বৈরথ বেশ হাস্যকর ; বাংলা সংস্কৃতির পুরোধা পত্রিকার কবিতা অধ্যায় খুললে তো অ্যানাটমিকাল আলোচনা ছাড়া প্রায় কিছুই চোখে পড়ে না। তবে সে যুগে, দু পক্ষ ছিল টগবগে, তরুণ তুর্কীরা আধুনিকের পূজারি, বিপরীতে রক্ষণশীলরা। এই ঘূর্ণাবর্তের অগ্রভাগে ছিলেন বুদ্ধদেব, অবশ্যই নবীনদের পক্ষে। তর্ক-বিতর্ক, যুক্তি-অযুক্তির ধূমায়ন এত বেড়ে ওঠে যে শেষ পর্যযন্ত সাহিত্যের সুপ্রিম কোর্টে মকদ্দমা ওঠে শুনানির জন্য, জোড়াসাঁকোয়ে জড় হন, বাদী ও বিবাদী পক্ষ। বুদ্ধদেবের নিজের ভাষায়, "... Some well-meaning and optimistic persons, themselves outside any literary circle, appealed for arbitration to Rabindranath, who was finally persuaded to preside over a conciliatory meeting. Two sessions were held at the Jorasanko house, the two 'parties' as well as the neutrals strongly represented, and Rabindranath, for whom the occasion of the meeting could mean but little, spoke in his flute like voice on fundamental principles, later developing his remarks into two essays entitled 'The Form of Literature' and 'Literary Criticism', which produced a fresh controversy, and one so confused and confusing that the hoped-for conciliation looked remoter than ever.." [৩১]
একই শুনানির বিপরীত পক্ষের মন্তব্য শোনা যাক,
"... we heard that Tagore had expressed a wish to call a meeting of both the sides at his house and hear our arguments. We were invited to go. At first both Mohit Babu and I were semewhat hesitant. We thought that it might be a trap or even an ambush. But finally we revised our opinion, thinking that if we did not go we would be condemned by default......After some others had spoken I took up the debate. But I do not think I spoke well at all. I was not then used to public speaking or debate, however cavalier-like I might have been with my pen. The only adavantage on our side was that our enemies spoke even worse. Their main spokesman was a young writer from Dacca, who spoke with the strong accent of his city. Tagore did not say anything, but only listened with an impassive face." [৩২]ঢাকার উঠতি লেখকের পরিচয় সহজেই অনুমেয়। উপরের উদ্ধৃতি নীরদচন্দ্র চৌধুরীর আত্মজীবনীর দ্বিতীয় খণ্ড থেকে। অন্যত্র নীরদচন্দ্র বুদ্ধদেবের সাহিত্য প্রতিভার সুযোগ্য স্বীকৃত দিয়েছেন।
বুদ্ধদেব বসুর উপর এই নিবন্ধ শেষে এসেও অসমাপ্ত রয়ে গেল। এর কারণ বা কৈফিয়ত শিরোনামেই দিয়েছি। সন্ধান কখনও ফুরোয় না, বুদ্ধদেব বসুদের মত স্রষ্টাদের নিয়ে তো নয়ই। বাদ রইল অনেক কিছুই, তাঁর নাটক, তাঁর বহুতর গল্প-উপন্যাস-কবিতা-নন্ ফিকসন, এবং আরো বহু কিছু। তাঁর চর্যাপদে আমাদের ও আমার চারণ চলবে সারা জীবন।
… he has not created a Sakuntala or Faust, a Commedia or War and Peace; we seek in vain for a 'master-piece', a single work that contains him so to say, on which we can lay our hand and say we have him. His effect is gradual and cumulative; you have to go back and forth .... to get what he can give. [৩৩]রবীন্দ্রনাথের প্রসঙ্গে বুদ্ধদেব।
এবং এই একই আলোকপাত প্রায় অব্যর্থ তাঁর নিজের ক্ষেত্রেও। বুদ্ধদেবকে পাওয়া যায় না তাঁর কোনো একটি রচনার মধ্যে বা শুধুই তাঁর রচনাসমগ্রের মধ্যে।
তাই আলোচনার অন্তেও সন্ধান জেগে থাকে।
॥ তথ্যপঞ্জী ॥
[১] আমার ছেলেবেলা - বুদ্ধদেব বসু, এম. সি. সরকার অ্যাণ্ড সন্স প্রা: লি:, প্রথম প্রকাশ : মার্চ ১৯৭২, চতুর্থ প্রকাশ : মে ১৯৯৭ - পৃষ্ঠা ১১২
[২] আধুনিক বাংলা কবিতা - বুদ্ধদেব বসু সম্পাদিত, এম. সি. সরকার অ্যাণ্ড সন্স প্রা: লি:, প্রথম প্রকাশ মার্চ ১৯৫৪, পুনর্মুদ্রণ জুলাই ১৯৯৮ [আ: বা:] - পৃষ্ঠা ১৪৩-১৪৫
[৩] আ: বা: - পৃষ্ঠা ১৪৮
[৪] আ: বা: - পৃষ্ঠা ১৪৯ [৫]
[৫] V.S.Naipaul - Nobel Lecture - http://www.nobel.se/literature/laureates/2001/naipaul-lecture-e.html
[৬] আমাদের কবিতাভবন - বুদ্ধদেব বসু, বিকল্প, প্রথম প্রকাশ নভেম্বর ২০০১ - পৃষ্ঠা ৪৬
[৭] তিথিডোর - বুদ্ধদেব বসু, নিউ এজ পাবলিশার্স প্রা: লি:, ষষ্ঠ সংস্করণ ডিসেম্বর ২০০০ [তি:] - পৃষ্ঠা ২০৮
[৮] তি:- পৃষ্ঠা - ৩২৪
[৯] তি: - পৃষ্ঠা - ৮২
[১০] চিঠিপত্র, ষোড়শ খণ্ড - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বিশ্বভারতী গ্রন্থনবিভাগ, প্রকাশ পৌষ ১৪০২, [চি:] - পৃষ্ঠা ১২১
[১১] রাত ভ'রে বৃষ্টি - বুদ্ধদেব বসু, এমি.সি.সরকার অ্যাণ্ড সন্স প্রা: লি:, প্রথম প্রকাশ : এপ্রিল ১৯৬৭, সপ্তম মুদ্রণ জানুয়ারি ১৯৯০ [রা:] - পৃষ্ঠা ৫২
[১২] রা: - পৃষ্ঠা ৯১
[১৩] রা: - পৃষ্ঠা ৯১
[১৪] চি: - পৃষ্ঠা ৩৮৯
[১৫] চি: - পৃষ্ঠা ১৪৭-১৪৮
[১৬] An Acre of Green Grass - Buddhadeva Bose, Papyrus, Published 1948, Reprint 1997 [Acre] - Page 56
[১৭] কল্লোল যুগ - অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত, এমি.সি.সরকার অ্যাণ্ড সন্স প্রা: লি:, প্রথম প্রকাশ : আশ্বিন ১৩৫৭, অষটম প্রকাশ : শ্রাবণ ১৪০৫ - পৃষ্ঠা ১০৮
[১৮] চি: - পৃষ্ঠা - ১৩
[১৯] চি: - পৃষ্ঠা - ১১১
[২০] চি: - পৃষ্ঠা - ১৩৫
[২১] চি: - পৃষ্ঠা - ১৮৬
[২২] চি: - পৃষ্ঠা - ১৬৫
[২৩] চি: - পৃষ্ঠা - ১৪০
[২৪] চি: - পৃষ্ঠা - ১৫৫
[২৫] Acre - Page 13
[২৬] Acre - Page 73
[২৭] The Intellectual In India - Nirad C Chaudhuri, Associated Publishing House, First Published 1967, Reprinted 1967 - Page 57
[২৮] চি: - পৃষ্ঠা - ১৫৪
[২৯] চি: - পৃষ্ঠা - ১৯৫
[৩০] পাকদণ্ডী - লীলা মজুমদার, আনন্দ পাবলিশার্স প্রা: লি:, প্রথম সংস্করণ জানুয়ারি ১৯৮৬, চতুর্থ মুদ্রণ আগস্ট ২০০১ - পৃষ্ঠা ২৮১
[৩১] Acre - Page 81-82
[৩২] Thy Hand, Great Anarch ! - Nirad C Chaudhuri, Addison-Wesley Publishing Compny Inc. First Printing, July 1988, First US Edition. - Page 229
[৩৩] Tagore : Portrait of A Poet - Buddhadeva Bose, Papyrus, Published : 1962, Enlarged Edition : 1994 - Page 27
Published May 15, 2004