

আনন্দবাজার পত্রিকা য় প্রতি সপ্তাহেই একটি 'বেস্টসেলারে'র তালিকা প্রকাশিত হয় কলকাতার বিভিন্ন বইয়ের দোকানে যে-সমস্ত বইয়ের বিক্রি সর্বাধিক তারই তালিকা সেটি কথাসাহিত্য ও অন্যান্য এই দুই পর্যায়ে দুটি তালিকা প্রকাশিত হয়। কথাসাহিত্য বা ফিকশন-এর তালিকায় সপ্তাহের পর সপ্তাহ যে লেখকের কোনও না কোনও বইয়ের নাম শীর্ষস্থান অধিকার করে থাকে তিনি কিন্তু কোনো ইদানীন্তন সাহিত্যসম্রাট ন'ন -- তিনি চিত্রপরিচালক সত্যজিৎ রায়।
অতএব বাংলা গদ্যসাহিত্যে তিনি যে প্রথম জীবনে বিশেষ আগ্রহী ছিলেন না, তাতে আশ্চর্য হওয়ার বিশেষ কারণ দেখি না। বাংলাসাহিত্য সত্যজিৎ স্বেচ্ছায় আগেই পড়তে শুরু করলেও বইয়ের অলংকরণের কাজ করতে গিয়ে তাঁকে বাংলা গদ্য পড়তে হতো, কবিতাও পড়তে হতো। সম্ভবত জীবনানন্দের কাব্যগ্রন্থের প্রচ্ছদ ও অলংকরণ করতে গিয়েই সত্যজিৎ প্রথম তাঁর কবিতা পড়েন। পাঠক-পাঠিকার নিশ্চয় মনে আছে যে অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রাজকাহিনী র যে বিখ্যাত প্রচ্ছদটি বাঙালির কাছে অবিস্মরণীয়, সেটিও সত্যজিতের সৃষ্টি বইটির ভিতরের অলংকরণও তাঁরই। পথের পাঁচালী র সংক্ষিপ্ত কিশোর সংস্করণ আম আঁটির ভেঁপু র অলংকরণ করতে গিয়েই যে পথের পাঁচালী কে চলচ্চিত্রায়িত করবার কথা প্রথম মনে হয়, তা তো আজ ইতিহাস। তবে 'পূর্ণাঙ্গ' পথের পাঁচালী সত্যজিৎ আগেই পড়েছিলেন, নাকি আম আঁটির ভেঁপু পড়বার পর চলচ্চিত্রায়নের উদ্দেশ্য নিয়েই তিনি ওই উপন্যাসটি পড়েন তা আমার জানা নেই এ-ব্যাপারে সত্যজিৎ কিছু লিখে গিয়ে থাকলে তা আমার
দৃষ্টিগোচর হয়নি।
সন্দেশ পত্রিকা খুব বেশি মূলধন নিয়ে শুরু করা যায়নি। সেই কারণে প্রতিষ্ঠিত সাহিত্যিকদের লেখার সঙ্গে সত্যজিৎ ও রায়পরিবারের অন্যান্যরা নিয়মিত এই পত্রিকায় লিখতেন শুধুমাত্র প্রতিষ্ঠিত লেখকদের লেখা প্রকাশ করে পত্রিকা চালানোর সামর্থ্য প্রকাশকদের ছিল না। সত্যজিতের লেখা প্রথম থেকেই জনপ্রিয় হওয়ায় তাঁকে বেশি লিখতেই হতো। অল্পবয়স থেকেই একদিকে যেমন এমিল গ্যাবোরিও থেকে আর্থার কোনান ডয়েল পর্যন্ত ডিটেকটিভ গল্প উপন্যাস বিস্তর পড়েছিলেন, তেমন অন্যদিকে বিংশ শতকে সায়েন্স ফিকশন যা লেখা হয় তারও অধিকাংশেরই মনোযোগী পাঠক তিনি ছিলেন আর্থার সি. ক্লার্ক, রে ব্রাডবেরি ও অন্যান্য লেখকদের কল্পবিজ্ঞানভিত্তিক সাহিত্য তাঁকে প্রোফেসর শঙ্কুর কাণ্ডকারখানা নিয়ে লিখতে অনুপ্রাণিত করেছিল।
লিখতে শুরু করার অল্প কিছুদিনের মধ্যেই প্রোফেসর শঙ্কু নামে একটি সংকলন প্রকাশিত হয় ফেলুদাসিরিজের প্রথম বই বাদশাহী আংটি প্রকাশিত হয় ১৯৬৯ সালে প্রকাশক আনন্দ পাবলিশার্স। তবে ফেলুদা-তোপসেকে নিয়ে প্রথম গল্পের নাম ফেলুদার গোয়েন্দাগিরি যা পরে এক ডজন গপ্পো বইটিতে প্রকাশিত হয়। লালমোহন গাঙ্গুলীর চরিত্রটির আবির্ভাব ঘটে আরো পরে, সোনার কেল্লা উপন্যাসে।
-- এক ডজন গপ্পো বইটির বিবিধ বিষয়ের ছোটোগল্পগুলিতে : এই গল্পগুলির মধ্য দিয়ে পাঠকককূল এক অতিশক্তিধর গদ্যশিল্পীর সঙ্গে পরিচিত হ'ন। আমার বিশ্বাস, ফেলুদা ও প্রোফেসর শঙ্কু জনপ্রিয় চরিত্র হলেও, অলৌকিক, ভৌতিক ও কৌতূকময় বিষয় নিয়ে সত্যজিৎ যে ছোটোগল্পগুলি লেখেন সেগুলির সাহিত্যিক মূল্য অধিক স্থায়ী। এক ডজন গপ্পো ও
আরো এক ডজন -এ প্রকাশিত সেপ্টোপাশের ক্ষিদে, খগম, বাদুড় বিভীষিকা, শিবু আর রাক্ষস, পটলবাবু ফিল্মস্টার, নীল আতঙ্ক, রতনবাবু আর সেই লোকটা'র মতো গল্প বাংলাসাহিত্যে বিরল এই গল্পগুলিকে ঠিক কিশোরসাহিত্যের পর্যায়ে ফেলা যাবে না মনে আছে, আমার পরিচিত বহু প্রাপ্তবয়স্ক মানুষকে এই গল্পগুলি বহুবার পড়তে দেখেছি। শৈলী, ও ঘটনার বিন্যাসের দিক থেকে বাংলায় লিখিত শ্রেষ্ঠ ছোটোগল্পগুলির মধ্যে এগুলিকে স্থান দিতে আমি রাজি। যদিও জানি এ-ব্যাপারে কিছু বিতর্কের অবকাশ আছে। অ্যাম্ব্রোজ্ বিয়র্সের লেখার সঙ্গে সত্যজিৎ পরিচিত ছিলেন কিনা জানি না, তবে এডগার অ্যালান পো'র গল্পগুলির প্রায় সমতুল্য কিছু যদি লেখা হয়ে থাকে তবে তা সত্যজিতের গল্পগুলিই।
ছোটোগল্পের জমজমাট স্বল্প-পরিসরে সাসপেন্স তৈরির ব্যাপারে আজও সত্যজিৎ অপ্রতিদ্বন্দ্বী। শুধু তাই নয়, পটলবাবু ফিল্মস্টার গল্পে যে-ধরনের ঠশধত্রঠব হাস্যরসের উপস্থিতি দেখি, তাও বাংলায় বেশ বিরল।
আবারো আনন্দবাজারের বেস্টসেলারের তালিকার দিকে তাকানো যাক। গল্প-উপন্যাসে সত্যজিতের বই ছাড়া কিশোরদের জন্য লেখা অন্য কোনো লেখকের বই নিয়মিত থাকে না সেখানে ফেলুদা-শঙ্কুর প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী সেই সময় , প্রথম আলো ইত্যাদি বিপুলবপু উপন্যাস, যা পড়বার পক্ষে যেমন উপাদেয়, না-পড়ে বাড়ির বাইরের ঘরে সাজিয়ে রাখবার পক্ষেও তেমনই উপযুক্ত। কিন্তু, বাণিজ্যিক দিক থেকে ফেলুদা-শঙ্কুও জয়ী, আজও, সপ্তাহের পর সপ্তাহ, মাসের পর মাস।
মনে রাখতে হবে প্রথম বাংলা গদ্য প্রকাশিত হয় ১৮০১ সনে অথচ ব্রিটিশ বঙ্গে আসবার আগে বাংলা পদ্য ও গীতিকাব্য অবশ্যই ছিল, কিন্তু গদ্য ছিল না। বাংলা গদ্য ইংরেজি গদ্যের প্রভাবে মূলত সংস্কৃতকে আশ্রয় করে সৃষ্ট হয়। আগেই বলেছি, শৈশব থেকেই সত্যজিৎ ইংরেজি সাহিত্য বিস্তর পড়েছিলেন। যাঁরা তাঁর ইংরেজি গদ্যগ্রন্থ চণ্ণশ যঠত্স্য, মচ্ংঠশ যঠত্স্য ও
ংঔষ্ হৃংছশয গঠঞচ্ ংঋংইণ্ণ পড়েছেন তাঁরা জানেন তাঁর ইংরেজি গদ্য কতোটা বলিষ্ঠ ও প্রাঞ্জল। এই লেখাগুলি পড়তে গিয়ে আমার বার বার মনে হয়েছে যে, সত্যজিতের ইংরেজি গদ্যের জ্ঞান তাঁর বাংলা গদ্যরচনায় সাহায্য করেছিল। যাঁরা প্রথম দুই প্রজন্মের বাংলা গদ্যলেখক অর্থাৎ রামমোহন রায়, রামরাম বসু, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর -- তাঁরা সকলেই শৈশব, কৈশোর ও প্রথম যৌবনে বাংলা গদ্যের থেকে ইংরেজি গদ্যই বেশি পড়েছিলেন বঙ্কিমচন্দ্র সম্বন্ধেও এ-কথা অনেকাংশে সত্য। রবীন্দ্রনাথের প্রজন্ম থেকে বঙ্কিমচন্দ্রের গদ্য শিক্ষিত বাঙালিসমাজে সর্বজনপাঠ্য হয়। অতএব ইংরেজি গদ্যের উপর কোনো বাঙালি লেখকের দখল যে তাঁর বাংলা গদ্যরচনায় প্রভাব বিস্তার করতে পারে তা বুঝতে অসুবিধা হয় না। এই ব্যাপারটি বিস্তারিতভাবে তুলে ধরলাম কারণ সত্যজিতের সমসাময়িক বা পরবর্তী সাহিত্যিকদের মধ্যে কারুর গদ্যেই ইংরেজি গদ্যের বিশেষ প্রভাব দেখিনি সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়কে তাঁর স্যাটায়ার-ধর্মী লেখায় কিছুটা ব্যতিক্রম বলা যায়। বাংলাগদ্যের বয়স আজ দু'শ বছর, ইংরেজি গদ্যের পাঁচশ' বছর এই দীর্ঘতর ইতিহাসের জন্য ইংরেজি গদ্যের স্থিতিশীলতা, বিস্তার ও শব্দভাণ্ডারের বৈচিত্র্য কিছুটা বেশি সত্যজিতের গদ্যের যে সাবলীলতা ও ন্যাকামি-বিবর্জিত ঋজুতা, তার উত্স অনেকটাই ইংরেজি গদ্যে তাঁর গভীর অভিনিবেশ।
তবে সায়েন্স ফিকশনে সত্যজিতের লেখাকে প্রথম স্থানটি ছেড়ে দিতে হবে। তাঁর সমসাময়িক অনেক সাহিত্যিক সায়েন্স ফিকশন লিখেছেন ঠিকই, তবে প্রোফেসর শঙ্কুর মতো একটি স্থায়ী চরিত্র কেউই সৃষ্টি করতে পারেননি। সত্যজিৎ ইংরেজি সায়েন্স ফিকশন বিস্তর পড়েছিলেন কল্পবিজ্ঞানভিত্তিক রচনায় সিদ্ধহস্ত হয়ে উঠতে তাঁর বেশিদিন লাগেনি।
চলচ্চিত্র পরিচালনা ও অবসরে বাংলা কিশোরসাহিত্য রচনায় সত্যজিৎ এতোটাই ব্যস্ত থাকতেন যে ইংরেজি গদ্যরচনায় বিশেষ সময় দিতে পারতেন না। অথচ তাঁর চণ্ণশ যঠত্স্য, মচ্ংঠশ যঠত্স্য বা শেষ জীবনে রচিত ংঔষ্ হৃংছশয গঠঞচ্ ংঋংইণ্ণ যিনি পড়েছেন তিনিই জানেন সেই গদ্যের মহিমা। আমি তো বলবো নন-ফিকশন-এ নীরদচদ্র চৌধুরী বাদে আর কোনো ভারতীয় সত্যজিতের মতো সুঠাম ইংরেজি গদ্য লিখতে পারেননি। আমি বহু ভাবনা-চিন্তার পর এ-কথা লিখলাম, নানাযুগের ইংরেজি গদ্য পড়বার যাবতীয় অভিজ্ঞতার উপর ভিত্তি করে। সত্যজিতের গদ্যের ভারসাম্য ও ঋজুতা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ংঔষ্ হৃংছশয গঠঞচ্ ংঋংইণ্ণ বইটিতে যে
রস্মৃতিরোমন্থন আছে তা অতি সহজেই অতিপেলবতার দিকে ঝুঁকতে পারত, কিন্তু সত্যজিতের ইংরেজি-জ্ঞান এতো প্রখর ছিল যে গদ্য কখনো বলিষ্ঠতা হারায়নি। ইংরেজিতে যাকে "উইট" বলে, এই গদ্যের প্রায় প্রতিটি বাক্যেই তা বিদ্যমান। আমার ক্ষোভ : সত্যজিৎ ইংরেজিতে আরো অনেক কিছু লিখে যেতে পারতেন। শেষবয়সে শরীরের দৌর্বল্যের জন্য যখন চলচ্চিত্র পরিচালনার কাজ কঠিন হয়ে পড়েছিল, তখন হয়তো ইংরেজি লেখার দিকে মন দিতে পারতেন কিন্তু জীবনের শেষ পাঁচবছরে সভ্যতা সম্বন্ধেই কিছু গভীর সংশয় মনে বাসা বেঁধেছিল, আগন্তুক -এ যার প্রকাশ। নতুন করে আর গদ্যশিল্পীর জীবন আরম্ভ করা সম্ভব হয়নি।