• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | Satyajit Ray | প্রবন্ধ
    Share
  • সত্যজিৎ রায়, পরশুরাম এবং চারমিনার : ইন্দ্রনীল দাশগুপ্ত

     


    বাংলার সাহিত্যিকদের মধ্যে সত্যজিৎ রায়ের চেয়েও কম বিরূপ সমালোচনা কি পেয়েছেন কেউ? যদি কেউ থাকেন তো তিনি পরশুরাম। এমনকি বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো 'হোলি কাউ' এর গায়েও দু-চারটে কালো ছোপ বের করে ফেলতে ছাড়েননি সমালোচকরা। সত্যজিৎ রায় আর পরশুরামকে বাংলার পাঠক যেরকম অকুন্ঠভাবে ভালোবেসেছে সেরকম দেখা যায় না।

    সত্যজিৎ রায় আর পরশুরামের লেখকজীবনের মধ্যে কিছু কিছু উল্লেখযোগ্য সাদৃশ্য আছে। দুজনেই চল্লিশ বছর বয়সের পর গল্প লেখায় হাত দেন। দুজনেই অল্প সময়ের মধ্যে অভূতপূর্ব জনপ্রিয়তা লাভ করেন। দুজনেই 'বাজিনাং শতহস্তেন'র মতো সিরিয়াস কবিতা থেকে যথাসম্ভব দূরে অবস্থান করেছেন। পরশুরামের কোনো উপন্যাস নেই। সত্যজিৎ রায়ের ফেলুদা সিরিজের গল্পগুলোকেও উপন্যাস না বলে বড়ো গল্পই বলা উচিত। দুজনেই সাহিত্যিক হিসেবে পরিচয় পাওয়ার আগে অন্য পেশায় সাফল্য লাভ করেছিলেন। বাংলায় কোনো গল্প না লিখলেও সত্যজিৎ রায়কে অস্কার-পুরস্কৃত চলচ্চিত্রকার হিসেবে সবাই চিনত। পরশুরামও চলন্তিকার প্রণেতা এবং বাংলা ভাষার পণ্ডিত হিসেবেই খ্যাতি পেতে পারতেন।

    বাংলা সাহিত্যের একটা বড়ো রাস্তা আছে যেখানে সাধারণত লেখকরা ঢোকেন ছোটোখাটো সাহিত্যপত্রিকার গলি ধরে। নিয়মিতো সময়ের ব্যবধানে পশ্চিমদিক থেকে আধুনিকতার যে জোয়ার আসে, অল্পবয়সে একটা স্বঘোষিত 'আধুনিক' সাহিত্যগোষ্ঠী বা কবিতাপত্রিকার সঙ্গে জড়িয়ে পড়তে পারলে সেই বেনোজলের ধাক্কায় ছোটো গলি থেকে মেনরোডে উঠে পড়ার ভালো সম্ভাবনা। পরশুরাম বা সত্যজিৎ এই পথ মাড়াননি। এঁদের লেখায় 'আধুনিক' বলতে কিছু ছিল না। 'নতুন ভাষা', 'আঙ্গিক' 'পরীক্ষা-নিরীক্ষা' ইত্যাদি যেসব শব্দ লিটিল ম্যাগাজিনের লেখক ও কবিদের রিজিউমে-কে শক্তিশালী করে তা লেখক সত্যজিৎ রায় বা পরশুরামের জীবনচরিতে ব্যবহার হবে ভাবা কঠিন।

    সত্যজিৎ রায় আর পরশুরামের লেখার স্টাইলে একটা এমন মিল আছে যা তাঁদের সাহিত্যিক জীবনযাপন ও অভিজ্ঞতার সাদৃশ্য থেকে এসে থাকতে পারে বলে আমার মনে হয়। কোনো সাহিত্য 'আন্দোলনে'র সঙ্গে যুক্ত না-থাকার ফলে এঁদের গদ্য হল সহজ, 'ক্লাসিকাল' গদ্য। তাতে চমকে দেবার মতো কিছু নেই। উপরন্তু শব্দব্যবহারে দুজনেই সংরক্ষণবাদী। (সত্যজিৎ রায়ের গদ্যে তো প্রতিটি সংলাপ নিখুঁত কোটেশান চিহ্নের ভিতর বসানো। তার আগে বা পরে কমা। এই সাহেবি পাংচুয়েশান বঙ্কিম, রবীন্দ্রনাথ বা বুদ্ধদেব বসুর লেখায় পাওয়া যায়। ব্যবহার করেন জনপ্রিয় লেখক শংকরও। করতেন না বা করেন না মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, পরশুরাম, মনোজ বসু এবং সুনীল, শীর্ষেন্দু বা শক্তি।) কিন্তু যেটা আমার সবচেয়ে বেশি লক্ষণীয় বলে মনে হয় তা হল কীভাবে দুজনে আগাগোড়া কবিত্ব এবং উচ্ছ্বাসের আসঙ্গ সভয়ে এড়িয়ে গেছেন। বাংলার কজন লেখক সম্পর্কে এই দাবি করা যায় যে তাঁদের গদ্যরচনাবলী ঘেঁটে একটাও উচ্ছ্বাসবহুল বা 'কাব্যিক' বাক্য বের করা যাবে না? এটাকে রাবীন্দ্রিক উত্তরাধিকার বললেও ঠিক হয় না। চৈতন্যদেবের সময় থেকেই ভাবের জল ও বাষ্প আমাদের ভাষা ও সাহিত্যকে স্যাঁৎসেতে করে রেখেছে। সত্যজিৎ রায়ের সব লেখা আমার পড়া নেই, একসঙ্গে সংকলিতও হয়নি। কিন্তু পরশুরাম রচনাবলীর মতোই তা ঘেঁটে কেউ এক আউন্স ভাবাবেগও বের করতে পারবেন না বলে আমার বিশ্বাস।

    ভাবালুতার বদলে পরশুরাম বেছে নিয়েছিলেন হাস্যরস আর অদ্ভুতরসের এক চাঙ্গায়নী মিশ্রণকে যার জুড়ি শুধু বাংলা কেন ইংরেজিতেও পাওয়া দুষ্কর। ত্রৈলোক্যনাথের মধ্যে এই গুণ ছিল। কিন্তু পরশুরামের মতো পরিমিত মিনিমালিস্ট গদ্য লিখতেন না ত্রৈলোক্যনাথ। পরশুরামের মতো গদ্য - যেখানে কোনো চরিত্র আঁকার মধ্যেই একটার পর একটা সূক্ষ্ম রসিকতা হয়ে যায় - বাংলার আরো একজনের কলমে সম্ভব হত। সেই লেখক হলেন সত্যজিৎ রায়ের ঠাকুরদা উপেন্দ্রকিশোর যিনি ছোটো ছোটো ছেলেমেয়েদের হাতেও চুড়ান্ত আণ্ডারস্টেটমেন্টের অস্ত্র তুলে দিতে দ্বিধা করতেন না। ('গুপী একটা গান গাইতে পারত।') পরশুরাম বা উপেন্দ্রকিশোরের লেখার আর একটা মিল হল যে এঁরা এমন সব চরিত্র বা শব্দ বাংলায় এনে ফেলেছেন কমিক স্টিরিওটাইপ হিসেবে সাহিত্যে যাদের একটা স্থায়ী জায়গা হয়ে গেছে। যেমন মজন্তালি সরকার, ইড়িমিড়িকিড়ি বাঁধন, লালিমা পাল বা হুতাশ হালদার। কিম্বা 'Zআনতি পারো না'র মতো শব্দবন্ধ। সুকুমার রায়ের লেখাতেও এই বৈশিষ্ট্য ছিল। সত্যজিতে নেই। সত্যজিতের লেখায় সেন্স অব হিউমারও অন্য, চাপা ধরনের। লেখক শেষ মুহূর্তে কমেডি থেকে সরে গল্পগুলোকে অ্যাডভেঞ্চারের দিকে নিয়ে গেছেন মনে হয়। একটা উদাহরণ দিচ্ছি - 'অঙ্কস্যার, গোলাপীবাবু আর টিপু' গল্পটা ধরা যাক। ব্যতিক্রমী শিক্ষক নিয়ে শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের একটা দারুণ মজার গল্প আছে - 'ভুসুক পণ্ডিত'। তাতে যে ধরনের কমিক পরিস্থিতি রয়েছে গোলাপীবাবুর ক্ষেত্রেও তা সহজেই তৈরি হতে পারত। ভুসুক পণ্ডিত আসলে একটা রোবট। সে পাঠশালা চালায়। তার টিকিও আছে এবং ছাত্রেরা হোভারক্রাফ্টে চেপে সেই টিকি কাটতে আসে। অন্যদিকে গোলাপীবাবু ভিন-গ্রহের প্রাণী। গোলাপীবাবুর তিনটে জিভ, অতিপ্রাকৃতিক সব ক্ষমতা। কিন্তু সে ক্ষমতা অপব্যবহারের কথা ভাবলেও তাকে প্রায়শ্চিত্তের জন্য দূর কোনো গ্রহে কারো একটা উপকার করে আসতে হয়। এই বিচিত্র, ক্ষমতাবান ও গোবেচারি চরিত্রকে নিয়ে অনেক কমিক সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও সত্যজিত্‌ গল্পটাকে চট করে অ্যাডভেঞ্চারের পরিণতি দিয়ে শেষ করে দিয়েছেন। লালমোহনবাবু, নকুড়বাবু প্রভৃতি যে-কটা কমিক চরিত্র সত্যজিৎ রায়ের গল্পে আছে তাদেরও সংলাপ গতানুগতিক। 'উট কি কাঁটা বেছে খায়?' সত্যজিতের বেস্ট জোক। পরশুরাম বা এমনকি উপেন্দ্রকিশোরের সূক্ষ্ম হাস্যরস কিন্তু এর চেয়ে কয়েক ধাপ উঁচুতে।

    বিখ্যাত লেখক আর. কে. নারায়ণ সত্যজিৎ রায়ের গল্প (মানে গল্পের অনুবাদ) সম্পর্কে মন্তব্য করেছিলেন যে সে-লেখা বড্ড সিনেম্যাটিক বলে তাঁর ভালো লাগে না। সত্যজিৎ নিজেও বলেছেন যে গল্পে কোনো চরিত্রের প্রথম আবির্ভাবের সময় তার একটা বর্ণনা দেওয়া দরকার। নইলে পাঠক নিজেই মনে মনে একটা চেহারা কল্পনা করে নেয়। পরে সেটার সঙ্গে লেখকের কল্পনার সঙ্গতি নেই দেখা যেতে পারে। শুধু চরিত্র নয়, চিত্রনাট্যের মতোই যেকোনো দৃশ্যে পারিপার্শ্বিকের একটা ছোটো বর্ণনা ফেলুদার গল্পগুলোতে প্রায়ই থাকে। ফলে গল্পগুলো অনেক সময়েই সিনেমার মতো চোখের সামনে ঘটতে দেখা যায়। নিচে সত্যজিৎ রায় আর পরশুরামের বই থেকে কয়েকটা চরিত্রের বর্ণনা দেওয়া হল। আশা করি কোনটা কার লেখা অনুমান করতে পাঠকের অসুবিধা হবে না।

    [বাপের সঙ্গে বেশ মিল আছে চেহারায়। বিশেষ করে চোখে আর নাকে। বয়স চল্লিশ-পঁয়তাল্লিশ হবে, মাথার চুল এখনো সবই কাঁচা, গোঁফ-দাড়ি নেই, ঠোঁট দুটো অসম্ভব রকম পাতলা। ]

    [গায়ে স্লিপিং সুটের পাজামার উপর একপাশে বোতামওয়ালা আদ্দির পাঞ্জাবি, পায়ে হরিণের চামড়ার চটি, আর দুহাতের আঙুলে অনেকগুলো আংটি। হাইট মাঝারি, দাড়ি গোঁফ কামানো, মাথায় চুল বেশি নেই, রং মোটামুটি ফরসা, আর চোখ দুটো ঢুলু ঢুলু - দেখলে মনে হয় এই বুঝি ঘুম থেকে উঠে এলেন। বয়স কত হবে? পঞ্চাশের বেশি নয়। ]

    [দ্বিতীয় ভদ্রলোকটিকে বহুকাল থেকে আমাদের পাড়ায় দেখে আসছি। এঁর বয়স এখন প্রায় পঁয়ষট্টি, ফরসা রং, স্থূলকায়, একটু বেশী বেঁটে। পনর বত্সর আগে এঁর কালো গোঁফ দেখেছি, তার পর পাকতে আরম্ভ করতেই বার্ধক্যের লক্ষণ ঢাকবার জন্য কামিয়ে ফেলেন। সম্প্রতি এঁর চুল প্রায় সাদা হয়ে গেছে, কিন্তু চামড়া খুব উর্বর, টাক পড়েনি। এই সুযোগে ইনি এখন আবক্ষ দাড়ি-গোঁফ এবং আকন্ঠ বাবরি চুল উত্পাদন করে ফেলেছেন, তাতে চেহারাটি বেশ ঋষি ঋষি দেখাচ্ছে। বোধহয় ইনি যোগশাস্ত্র, থিয়সফি, ফলিত জ্যোতিষ, ইলেক্ট্রোহোমিওপ্যাথি প্রভৃতি গূঢ় তত্ত্ব চর্চা করেন। এঁকে ভরদ্বাজবাবু বলব। ]


    সত্যজিৎ রায়ের মতো পরশুরামের গল্পেও চেহারার বর্ণনা প্রচুর আছে। প্রথমজনের ক্ষেত্রে তার কাজ হল চেহারাটাকেই চেনানো। ঘুরেফিরে বয়স, হাইট, রং আর চুলের সবরকম পারমুটেশান সত্যজিৎ রায়ের লেখায় পাওয়া যাবে। পরশুরামের ক্ষেত্রে সেটা আরেক ধাপ এগিয়ে এক-আধটা খামখেয়ালের খবর দিয়ে রাখে। সত্যজিৎ চরিত্রের বর্ণনায় এতটা সতর্ক হওয়া সত্ত্বেও সেগুলো তেমন সবলভাবে আঁকা নয়। বিশেষ করে ফেলুদার গল্পে, মগনলাল মেঘরাজ প্রভৃতি কয়েকটা ব্যতিক্রম আর ফেলুদা, লালমোহনবাবু ইত্যাদি স্থায়ী চরিত্রগুলোকে বাদ দিলে কথাটা আরো খাটে। এর একটা ফল হল এই যে অধিকাংশ পাঠক ফেলুদার একই গল্প বারবার পড়েও খুব শিগ্গির আবার ভুলেও যান। পরশুরামের প্লট এত চরিত্রনির্ভর যে সেই জীবন্ত চরিত্র ও তাদের সংলাপের মাইলস্টোনগুলোই গল্পটাকে মনে রাখতে সাহায্য করে।

    পৃথিবীর দুজন নামকরা কল্পবিজ্ঞানের লেখক এইচ. জি. ওয়েল্স্‌ আর জুলে ভার্নের তুলনা করতে গিয়ে স্প্যানিশ ভাষার লেখক বোরহেস একটা অদ্ভুত কথা বলেছিলেন। তাঁর মতে জুলে ভার্নের গল্পগুলো বড্ড বেশি বাস্তবানুগ। টুয়েন্টি থাউজ্যাণ্ড লীগ্স্‌ এর সাবমেরিন পরবর্তী কালের নিউক্লিয়ার সাবমেরিনের হুবহু ভবিষ্যত্বাণী। কিন্তু এইচ. জি. ওয়েল্স্‌-এর গল্পে আছে অবাস্তব সব আইডিয়া - যেমন মাধ্যাকর্ষণমুক্ত গাড়ি বা ইনভিজিবল ম্যান। কল্পবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে বিশ্বাসযোগ্যতা নয়, কল্পনার অবিশ্বাস্য দৌড়ই বোরহেসের মতে সাহিত্যের আসল উপাদান। এইদিক দিয়ে দেখলে সত্যজিৎ রায়ের শঙ্কুকাহিনীর সাহিত্যমূল্যও কম নয়। রোবুর মতো কয়েকশো টাকায় তৈরি স্টিকিং প্লাস্টারে জোড়া যন্ত্রমানুষ থেকে মিরাকিউরলের মতো ওষুধ (যা দিয়ে সব সারে কিন্তু সর্দি সারে না) শুধু অবাস্তব নয়, তার মধ্যে ঘনাদার মতো ব্যাপক গুল্পের গন্ধ আছে। কল্পবিজ্ঞানের সঙ্গে এরকম বিশুদ্ধ কমিক সাহিত্যের ব্লেণ্ড বিদেশের জাঁদরেল লেখকদের লেখাতেও আমি খুব একটা দেখিনি। আবার কিছু কিছু শঙ্কুকাহিনী, যেমন 'একশৃঙ্গ অভিযান' আমাদের কল্পনাকে এমনভাবে মুক্ত করে দেয় যে তাদের কল্পবিজ্ঞানের ক্লাসিক বলা উচিত।

    ফেলুদা আর শঙ্কুর গল্প ছাড়া সত্যজিৎ রায় আর যা ছোটোগল্প লিখেছেন তার মধ্যে অলৌকিক ও অতিপ্রাকৃতের প্রাধান্য। সাহিত্যের এই প্রাচীন ধারা বা জেনরে সত্যজিৎ রায় নতুন কিছু যোগ করে থাকলে তা এখনো আমার নজরে পড়েনি। তাছাড়া এই সাহেবি ও সিরিয়াস অতিপ্রাকৃত-সাহিত্যকে আমার বিদেশি লেখার অনুবাদ বলে মনে হয়। এটাকে ঠিকমতো না নিতে পারা হয়ত আমার নিজেরই মনোযোগের অভাব।

    আমার মনে হয় সাহিত্যিক সত্যজিৎকে বাঙালিরা সবচেয়ে বেশি মনে রাখবে ফেলুদার গল্পের জন্যই। সাহিত্য হিসেবে ফেলুদার বই তার সঠিক দাম এখনো পায়নি। নিছক অ্যাডভেঞ্চারের বই হিসেবে বাজারে তার কদর। কিন্তু একদিন তুলনামূলক সাহিত্যের ক্লাসে ফেলুদার প্রথমদিকের গল্পের অধ্যায় ধরে ধরে আলোচনা হবে। বোঝানো হবে বাংলার নিজস্ব গোয়েন্দাকাহিনীর মধ্যে ব্যোমকেশেরও উপরে ফেলুদার স্থান। এবং কারণ তার সাহিত্যমূল্য। সত্যজিৎ এবং পরশুরামের লেখা উচ্ছ্বাস আর বাহুল্যের সেই প্রভাব থেকে মুক্ত যা শরদিন্দুর ব্যোমকেশকাহিনীগুলোকে কোথাও কোথাও অত্যধিক নাটকীয় করে দিয়েছে। ফেলুদার গল্পের শেষে খলনায়ক খলনায়িকাকে চুমুর সঙ্গে সায়নাইড পাস্‌ করছে ভাবা যায়?

    এছাড়া ফেলুদার গল্পের মধ্যে রয়েছে গোয়েন্দাগল্প লেখার মূল্যবান কিছু কাঠামো বা টেমপ্লেট। এই প্রসঙ্গে বলা যায় যে সত্যজিৎ রায় এবং পরশুরাম দুজনেই এত কম সময়ের মধ্যে এত ভালো ছোটোগল্প লিখতে পেরেছেন টেমপ্লেট ব্যবহার করেই। পরশুরামের বহু গল্পের কাঠামো অবিকল এক ধরণের। পুকুরের ধারে, পার্কের বেঞ্চে বা ঘরোয়া আসরে বসে কোনো মধ্যবিত্ত ও মধ্যবয়স্ক ভদ্রলোক আচমকা একটা ভয়ংকর বিদ্ঘুটে গল্প বলতে আরম্ভ করেন। গল্পের শেষে শ্রোতারা যখন নমস্কারান্তে বিদায় নিচ্ছে তখন যে জগত্টা আসে সামনে - সেখানে সবই সুস্থ, স্বাভাবিক এবং সাধারণ। এই দ্বিতীয় জগৎ থেকে গল্পের ভিতরে যে গল্পটা আছে সেটার উপর কয়েকটা সরস মন্তব্য করা হয়। মনস্তত্ববিদরা হয়ত বলবেন দুই বিপরীত জগতের মধ্যে অন্তত একটার সঙ্গে পাঠকের সহমর্মিতা তৈরি হয়ে যায়। যে কারণেই হোক - টেমপ্লেটটা কমিক এফেক্ট তৈরি করার এবং পাঠকের হৃদয়ে প্রবেশ করার পক্ষে অব্যর্থ।

    ফেলুদার গল্পে যে টেমপ্লেটগুলো আছে তা নিয়ে অন্তত একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডাক্তারি থিসিস থাকা উচিত। দুর্ভাগ্যবশত, গল্পের কাঠামো নিয়ে গবেষণা যে সাহিত্যের পক্ষে স্বাস্থ্যকর, বাংলায় এখনো সেটা ততটা স্বীকৃত নয়। যেদিন হবে সেদিন ফেলুদার সঙ্গে এক টেবিলে বসে চারমিনার ধরাবার মতো এলেমওয়ালা আরো কিছু বাঙালি গোয়েন্দা পাওয়া যাবে। ফেলুদার কোনো সফল গল্পের দৃশ্য ধরে ধরে কেউ যদি একটু নেড়েচেড়ে নেয়, কাঠামোটা রেখে নতুন চরিত্র, নতুন স্থান, কাল ও পাত্র যোগ করে, আংটির জায়গায় অ্যান্টিক আর ঠাকুরদা'র জায়গায় বন্ধুর কাকা বসিয়ে দেয় তাহলে সেটা একটা আনকোরা নতুন রহস্যের গল্পই হয়ে যেতে পারে।

    শেষ প্রসঙ্গ হল চারমিনার। ফেলুদার গল্প ছোটোদের জন্য প্রায় বুক অব নলেজের মতো তথ্যসমৃদ্ধ হলেও কিছু কিছু বিষয়ে আর এই যুগে ছোটোদের উপযুক্ত নয়। ছোটোদের বইতে একজন সিগারেটখোর রোলমডেল রাখলে অ্যামেরিকার মতো দেশে হয়ত মামলা করেই লেখককে পথে বসিয়ে দেওয়া যায়। এছাড়া ফেলুদা বেআইনি বিদেশী মুদ্রার ব্যবহার অনুমোদন করছে এবং খুনীকে ক্ষমা করছে এমন দৃষ্টান্তও আছে। নতুন ফেলুদার মধ্যে যদি এরকম ত্রুটি থাকে তাহলে সেগুলোকে ত্রুটি বলে চিনিয়ে দেবার একটা চেষ্টাও যেন থাকে। পেরেন্ট এবং কনজিউমার হিসেবে লেখকদের কাছে এই আবেদন জানিয়ে রাখছি।

    [প্রথম ও দ্বিতীয় উদ্ধৃতি ফেলুদা থেকে। গল্পের নাম 'ঘুরঘুটিয়ার ঘটনা' আর 'শেয়াল দেবতা রহস্য'। তৃতীয়টা পরশুরামের। গল্পের নাম 'শোনা কথা'। ]
    Published November 15, 2002
  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments