• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | Satyajit Ray | প্রবন্ধ
    Share
  • সাঙ্গীতিক পরম্পরা - উপেন্দ্রকিশোর, সুকুমার, সত্যজিৎ : অলকা দত্ত



    বাংলার কৃষ্টিজগতে রায় পরিবারের সৃজনশীল অবদান সূদুরপ্রসারী । পরপর তিনপুরুষে প্রবাহিত এমন আশ্চর্য প্রতিভার ধারা সত্যিই বিস্ময়কর ও বিরল ।

    মনে পড়ে সেই কোন ছোটোবেলায় টুনটুনির বই -এর সব মনমাতানো গল্প পড়ে আনন্দে আত্মহারা হতাম । সুন্দর ইলাস্ট্রেশন সহযোগে লেখা রূপকথার গল্প, সন্দেশ পত্রিকায় প্রকাশিত নানারকম লেখা এক নি:শ্বাসে শেষ করে ফেলতাম । রবীন্দ্রনাথের নদী কবিতার পাশে পাশে অনবদ্য সুন্দর আঁকা দেখে আশ্চর্য হয়ে যেতাম । এইসবের স্রষ্টা উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী (১৮৬৩-১৯১৫) -- ছিলেন সত্যজিৎ রায়ের ঠাকুরদা । পরবর্তী পর্যায়ে আবোল তাবোল, হযবরল, বহুরূপী ও আরো কত কিছুর স্রষ্টা সুকুমার রায়কেও পেয়েছি তাঁরই পুত্ররূপে । তারও পরে ফেলুদা সমগ্র ও অন্যান্য নানান গল্প এবং অসাধারণ সব চলচ্চিত্রের স্রষ্টা হিসাবে পেলাম সুকুমার-পুত্র সত্যজিত্কে । তিন প্রজন্ম ধরে মুদ্রণশিল্প, শিশুসাহিত্য, চিত্রবিদ্যা, ফোটোগ্রাফি চর্চায় এঁরা শিশু থেকে বৃদ্ধ পর্যন্ত সবাইকে অনাবিল আনন্দে মজিয়ে রেখে গেছেন । আবার দেখি যে এ সবের পাশাপাশি সঙ্গীতেও এদের তিন প্রজন্মের পরম্পরা নদীর মতো বয়ে চলে এসেছে ।

    উপেন্দ্রকিশোরের প্রতিভা ছিল বহুমুখী । আঁকা, লেখা, ছাপাখানার কাজ ইত্যাদির পাশাপাশি গানেও যে তাঁর কতখানি অনুরাগ ও অনুশীলন ছিল তা বিভিন্ন লেখা থেকে আমরা জানতে পারি । সত্যজিৎ লিখেছেন -- "তাঁর বহুমুখী প্রতিভার পরিচয় তাঁর লেখায়, গানে, ছবিতে, মুদ্রণের কাজে ছড়িয়ে আছে । বিজ্ঞান ও শিল্পের আশ্চর্য সমন্বয় ঘটেছিল উপেন্দ্রকিশোরের মধ্যে । বেহালার পাশাপাশি পাখোয়াজ বাজিয়েছেন তিনি, ব্রহ্মসঙ্গীত রচনার সঙ্গে সঙ্গে মুদ্রণের কাজে মৌলিক গবেষণা চালিয়েছেন ।" পৌত্রের এই সশ্রদ্ধ স্মরণের পথ ধরে আমরা পিছনে তাকিয়ে উপেন্দ্রকিশোরের সাঙ্গীতিক প্রতিভা সম্বন্ধে কিছু জানতে পারি ।

    উপেন্দ্রকিশোর মৃদঙ্গাচার্য মুরারিমোহন গুপ্তের প্রিয় শিষ্য ছিলেন । পাখোয়াজ, হারমোনিয়াম, সেতার, বাঁশি, বেহালা বিভিন্ন যন্ত্র বাজানোয় তিনি বিশেষ পারদর্শী ছিলেন । ছোটোদের প্রতি স্বাভাবিক আগ্রহবশত তিনি গান লিখতেন ও তাদের জন্য সান্ডে স্কুলের আদলে নীতিবিদ্যালয় স্থাপন করে সেখানে গান শেখাতেন । উপেন্দ্রকিশোরের বেহালা বাজানো খুবই আকর্ষক ছিল । আদি ব্রাহ্মসমাজের গানের সঙ্গে তিনি নিয়মিত বেহালা বাজাতেন । কলেজে পড়ার সময় থেকেই তিনি গান শেখানো ও বাদ্যযন্ত্র মেরামতির কাজ শুরু করেন । এক্ষেত্রে তাঁর শৈল্পিক ও বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের সমন্বয় চোখে পড়ে । ডোয়ার্কিন হারমোনিয়ামের সঙ্গে আমরা প্রায় সকলেই অলপবিস্তর পরিচিত । দ্বারকানাথ ঘোষের প্রতিষ্ঠিত বিখ্যাত এই ডোয়ার্কিন নামও তাঁরই দেওয়া ।

    উপেন্দ্রকিশোর সঙ্গীত ও যন্ত্রসঙ্গীত বিষয়ে কিছু গ্রন্থ রচনা করেছিলেন । তাঁর রচিত ংএ বহালা-শিক্ষা হারমোনিয়াম-শিক্ষা প্রকাশিত হয় ১৯০৪ ও ১৯০৫ খৃষ্টাব্দে । সঙ্গীত বিষয়ে কিছু অমূল্য লেখাও তিনি লেখেন । সেকালের প্রসিদ্ধ সঙ্গীতবিষয়ক পত্রিকা সঙ্গীত প্রকাশিকা -র সঙ্গে তিনি যুক্ত ছিলেন । রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়ের প্রবাসী পত্রিকাতেও তিনি সঙ্গীত সম্বন্ধে কিছু তথ্যপূর্ণ নিবন্ধ প্রকাশ করেন । স্বরলিপির মাধ্যমে উপেন্দ্রকিশোর বহু গানের সুর সংরক্ষণ করার চেষ্টা করেছেন । তাঁর এই প্রচেষ্টার জন্য তখনকার দিনে প্রচলিত বেশ কিছু গানের সুর হারিয়ে যায়নি । কিছু কিছু গানের সুরকারের হয়ত নাম জানা যায়নি, কিন্তু তার সুর রক্ষিত হয়েছিল । এমনই একটি স্বদেশী গান -- কামিনী রায়ের `তোরা শুনে যা আমার মধুর স্বপন ।' উপেন্দ্রকিশোর তাঁর হারমোনিয়াম শিক্ষা গ্রন্থে গানটি স্বরলিপিসহ প্রকশ করেছিলেন । তিনি ছিলেন রবীন্দ্রনাথের সমবয়সী ও বন্ধুপ্রতিম । শোনা যায় রবীন্দ্রনাথের কিছু গানের স্বরলিপি পাশ্চাত্যের স্টাফ নোটেশান-এর নিয়মে সংকলিত করেন ।

    উপেন্দ্রকিশোর নিজে যেখানে রচনাকার ও সুরকার, সেই ব্রহ্মসঙ্গীতগুলির ভাষা, ভাব ও সুর অত্যন্ত মর্মস্পর্শী । এই গানগুলিতে সুরের ক্ষেত্রে তাঁর বৈশিষ্টের পরিচয় পাওয়া যায় । তাঁর রচিত কয়েকটি ব্রহ্মসঙ্গীত বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য । `জাগো পুরবাসী ভগবত প্রেমপিয়াসী', `জয় দীনদয়াময় নিখিল ভুবনপতি', `বল দেখি ভাই এমন করে' ইত্যাদি । `জাগো পুরবাসী' গানটি এখনও প্রতি বছর মাঘোত্সবের সময় সমবেতভাবে গাওয়া হয়ে থাকে । এ গানটির কথা ও সুরের অপূর্ব সমন্বয় ভগবৎ আরাধনার ভাবটিকে উজ্জ্বল করে তোলে । মনে হয় উপেন্দ্রকিশোরের সঙ্গীতপ্রতিভার শ্রেষ্ঠ প্রকাশ ঘটেছে এই গানটিতে ।

    লেখা, রেখা ও সঙ্গীতের সুষমায় উপেন্দ্রকিশোর ছিলেন এক বর্ণময় ব্যক্তিত্ব । এই তিনটি সৃষ্টি তাঁর মধ্যে যেন এক হয়ে গিয়েছিল । ১৯১৫ খৃষ্টাব্দে তাঁর অকালপ্রয়াণ ঘটে । কিন্তু পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যে তাঁর প্রতিভা সঞ্চারিত হতে থাকে ।

    পিতার এই বিচিত্র গুণাবলীর উত্তরাধিকার নিয়ে সুকুমার রায়ের জন্ম ১৮৮৭ সালে । কথিত আছে, উপেন্দ্রকিশোর রবীন্দ্রনাথের "রাজর্ষি"র বালকের নামে পুত্রের ডক নাম রেখেছিলেন তাতা । লেখা, আঁকা, গানের প্রতি অনুরাগ, সন্দেশ পত্রিকা চালানো ইত্যাদির মধ্যে দিয়ে তাঁর অসাধারণত্বের পরিচয় ত্রক্রমশ প্রকাশ হতে থাকে । তাঁর লেখনী থেকে উত্সারিত অবিমিশ্র হাস্যরস বাংলা কবিতাকে উজ্জ্বল করে তুলল । প্রথমে হাসির গান তিনি গানের রাজ্যে প্রবেশ করলেন । তাঁর বোন পুণ্যলতা চক্রবর্তী স্মৃতিকথায় লিখেছেন -- `ভাইবোনেদের জন্মদিনগুলো দাদার হাসির গান ও অভিনয়ে জমকালো হয়ে উঠল । কলেজ ছাড়ার কিছুদিনের মধ্যে তিনি ননসেন্স ক্লাব প্রতিষ্ঠা করেন । এই ক্লাবের জন্য তিনি দুটি নাটক লিখলেন -- ঝালাপালা লক্ষণের শক্তিশেল । ভাষাকে অবলম্বন করে কৌতুকরসের সৃষ্টি সুকুমার সাহিত্যের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য । এই দুটি নাটকের জন্য সুকুমার বেশ কিছু হাসির গান লিখলেন । লক্ষণের শক্তিশেল নাটকে রামায়ণের কিছু চরিত্রকে মহাকাব্যের জগৎ থেকে নামিয়ে এনে তামাসার মোড়ক লাগানো হয়েছে । নাটকের গানগুলির কথা মজার তো বটেই, সুরও খুবই আকর্ষক । এই নাটকটির গানের মধ্যে `আসিছে রাবণ, বাজে ঢক্কাঢোল', `তবে রে রাবণব্যাটা' ইত্যাদি গানগুলি শুনতে ও গাইতে -- দুইই ভাল লাগে । সত্যজিৎ লিখেছেন -- "সঙ্গীত রচয়িতা হিসাবে সুকুমারের প্রথম পরিচয় এই `লক্ষণের শক্তিশেলে ।' সহজ সুরে সহজ ছন্দে রচিত গানগুলি নাটকের হাস্যরসকে ঘনীভূত করে ।"

    হাসির এই সুন্দর গানগুলির পাশাপাশি সুকুমার কিছু ব্রহ্মসঙ্গীতও লেখেন । তাঁর সঙ্গীত সৃষ্টির এই দিকটি হযত কিছুটা অজানা রয়ে গেছে । প্রেমের মন্দিরে তাঁর আরতি বাজে, নিখিলের আনন্দগান ইত্যাদি গানে তাঁর প্রাণের গভীর সঙ্গীত রস উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছে । প্রেমের মন্দিরে গানটি ব্রাহ্মবিবাহ অনুষ্ঠানে একটি বিশেষ গান হিসেবে স্থান করে নিয়েছে । উপেন্দ্রকিশোরের সমগ্র পরিবারই ছিলেন রবীন্দ্র অনুরাগী । সুকুমার ছিলেন রবীন্দ্রনাথের তরুণ ভক্তদের মধ্যে অন্যতম । রবীন্দ্রনাথের গানের ভাষা ও সুর তাঁকে বিশেষভাবে প্রভাবিত করত । এই দুইটি গানে তা লক্ষ করা যায় । সত্যজিৎ রায়কে একবার উল্লেখ করতে শুনেছি যে নিখিলের আনন্দ গান গানটি পরিচিত রবীন্দ্রসঙ্গীত শ্রাবণের ধারার মতো সুরে গেয় । অন্যদিকে রবীন্দ্রনাথ নিজেই যখন সুকুমার রায়ের আবোল তাবোলের "গান জুড়েছেন গ্রীষ্মকালে ভীষ্মলোচন" কবিতায় সুরারোপ করেন, তখন সেও এক অনন্য ঘটনা হয়ে দাঁড়ায় ।

    উপেন্দ্রকিশোর ও সত্যজিতের মতো গানের জগতে সুকুমারের অবদান হয়ত ততটা ব্যাপক ছিল না । তার প্রধান কারণ তিনি ছিলেন অত্যন্ত স্বল্পায়ু । তাঁর মৃত্যু এমন অকালে না হলে গানের ভাণ্ডার নি:সন্দেহে তিনি আরো সমৃদ্ধ করে যেতেন । মাত্র ছত্রিশ বছর বয়সে ১৯২৩ খৃষ্টাব্দে তাঁর মৃত্যু হয় । তিনি যখন খুব অসুস্থ, রবীন্দ্রনাথ তাঁকে দেখতে যান এবং সেই সাক্ষাত্কার সম্বন্ধে পরে বলেছিলেন যে মৃত্যুর সাথে তাঁর পরিচয় অল্প নয়, কিন্তু আসন্ন মৃত্যুকে এমন স্থিরচিত্তে গ্রহণ করতে তিনি খুব কম মানুষকেই দেখেছেন ।

    আবোল তাবোলের শেষ কবিতার শেষ কয়েক ছত্রে আছে --

    আদিমকালের চাঁদিম হিম
    তোড়ায় বাঁধা ঘোড়ার ডিম
    ঘনিয়ে এল ঘুমের ঘোর
    গানের পালা সাঙ্গ মোর ।

    হাসি ও গান চিরতরে শেষ হয়ে যাবার মুহূর্তের এই ছত্রগুলি সম্বন্ধে সত্যজিৎ লিখলেন -- "জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে উপস্থিত হয়ে এমন রসিকতা আর কোনো রসস্রষ্টার পক্ষে সম্ভব হয়েছে বলে আমার জানা নেই ।"

    সত্যজিৎ রায়ের আড়াই বছর বয়স যখন সুকুমার রায়ের জীবনদীপ নির্বাপিত হয় । সত্যজিতের এক পিসি মাধুরী মহলানবীশের কথায় আমরা জানতে পারি যে অসুস্থ অবস্থায় বিছানার পাশে দাঁড়ানো ছোট্ট মানিককে তিনি সুর করে গান শোনাচ্ছেন -- মেঘের কোলে কোলে যায় রে চলে দুষ্ট ছেলে । সত্যজিতের গানের পাঠের হয়ত এইখানেই শুরু । খুব ছোটৌবেলা থেকেই তাঁর গানের প্রতি আকর্ষণ । সারাক্ষণ গান শুনতে চাইতেন । চমত্কার সব ওয়েস্টার্ন মিউজিক-এর রেকর্ড শুনতেন । পিয়ানোতেও হাত লাগিয়ে টুং টাং করে বাজিয়ে যেতেন । অর্গ্যান বাজিয়েও সুর তোলার চেষ্টা করতেন । একটু বড়ো হতে বেঠোফেন, মোত্সার্ট শুনে মশগুল হয়ে যেতেন । তাঁর পাশ্চাত্য ধ্রূপদী সঙ্গীতের সংগ্রহ ছিল বিপুল । ভারতীয় শাস্ত্রীয়সঙ্গীতেও সত্যজিতের জ্ঞান ও চর্চা সর্বজনবিদিত । সঙ্গীত ছিল তাঁর সব কাজের অনুপ্রেরণা ও সাথী ।

    মা সুপ্রভা রায়ের ইচ্ছায় সত্যজিৎ শান্তিনিকেতনে `কলাভবনে' আসেন । সেখানে এসে সঙ্গীত সম্পর্কে তাঁর ধারণার প্রসার ঘটে । এই সময় রবীন্দ্রসঙ্গীত শোনারও যথেষ্ট অবকাশ হয় । শান্তিনিকেতনের আকাশে বাতাসে ছড়িয়ে থাকা গান তাঁর মনে চিরকালীন আসন করে নেয় ।

    পরবর্তীকালে একজন সফল চলচ্চিত্রকার হিসেবে সত্যজিত্কে আমরা পেয়েছি । বিভিন্ন ছবিতে সঙ্গীত ও বাদ্যযন্ত্রের অসাধারণ প্রয়োগ আমরা উপভোগ করেছি । তাঁর প্রথমদিকের ছটি ছবি ছাড়া আর সব ছবিতেই তিনি সঙ্গীত পরিচালনা করেছিলেন । গুপী গাইন বাঘা বাইন হীরক রাজার দেশে ছবির গীতিকার তিনিই ছিলেন । গুপী গাইন .. ছবির গানগুলিতে কথা ও সুরের মেলবন্ধন অতি সুন্দর । দক্ষিনী সুর থেকে শুরু করে সাধারণ লোকসঙ্গীতের সুরের ব্যবহারে ছবিটি সুরসৃষ্টির দিক দিয়ে অসাধারণ হয়ে উঠেছে । হীরক রাজার দেশে ছবিতে সত্যজিৎ তাঁর তত্কালীন সমাজচেতনা অসাধারণ রূপকের মাধ্যমে ব্যক্ত করেন । এই ছবিতে যে গানগুলি তিনি রচনা করেছিলেন তাতে তাঁর অনন্য কবিত্বের প্রকাশ হয়েছে ও একই সঙ্গে সুরের জাদুতে মানুষকে আচ্ছন্ন করেছে । এখানে ছড়ার ব্যবহারে খুব সূক্ষ্ম ব্যঙ্গের প্রকাশ ঘটেছে -- অথচ সবটারই অপূর্ব সুর ।

    সত্যজিৎ চলচ্চিত্রে রবীন্দ্রসঙ্গীতের ব্যবহার করেছেন খুব সুন্দরভাবে । কিছু কিছু ছবিতে গান যেন মনে দাগ কেটে যায় । মনের অব্যক্ত ভাব, বেদনা মূর্ত হয়ে ওঠে । যেমন মনে পড়ে কালপুরুষ মহাপুরুষ ছবিতে যে পথে আমি যে গেছি বারবার গানটার প্রয়োগ । তেমনি কাঞ্চনজঙ্ঘা ছবিতে কুয়াশাচ্ছন্ন পাহাড়ি প্রকৃতিতে বসে থাকা লাবণ্যের কন্ঠে এ পরবাসে রবে কে হায় । আগন্তুক-এ অনিলার কন্ঠে বাজিল কাহার বীণা গানটি মনমোহনের পরিচয় উদ্ঘাটন পরীক্ষাসভার শ্বাসরুদ্ধকারী পরিবেশকে টেনশনমুক্ত করে এক মুহূর্তে মনকে কোন অনির্বচনীয় লোকে পৌঁছে দেয় । শাখা প্রশাখাংএ তও সত্যজিৎ তাঁর আজন্ম ভালবাসার বিদেশী সঙ্গীত শুনিয়েছেন প্রশান্তর প্রিয় রেকর্ড বাজানোর মাধ্যমে এবং বেঠোফেনের প্যাস্টোরাল সিম্ফনির সুরধুনী নিজকন্ঠে প্রশান্তর মুখে দিয়েছেন ।

    রক্তধারার ছন্দে যে সঙ্গীতবোধ ও গভীর অনুরাগ সত্যজিৎ পেয়েছিলেন তা অনন্যসাধারণ । তাঁর মাও খুব ভাল গাইতে পারতেন ও মামার বাড়িতে গানের প্রতিভার প্রাচুর্য ছিল । তাঁর নিজেরও খুব সুরেলা ও ভরাট গলা ছিল । যেকোনো মিউজিক টেক-এর সময় গাইয়ে ও বাজিয়েদের তিনি নিজে গেয়ে নির্দেশ দিতেন -- সেও এক বিরল ঘটনা । আমরা তাঁর নিজের জলদগম্ভীর গলায় গান শোনার অপূর্ব সুযোগ পেলাম শেষ ছবি আগন্তুকে । এই ছবিতে মনমোহনের হয়ে তিনি গাইলেন -- অন্ধজনে দেহো আলো, মৃতজনে দেহো প্রাণ । তারপরের প্রশ্ন -- কে দেবে আলো, কে দেবে প্রাণ ?

    শিল্পের একই ধারায় পর পর তিন পুরুষের সৃষ্টির স্ফূরণ পৃথিবীর ইতিহাসে আর প্রায় নেই বললেই চলে । আমাদের প্রত্যাশা ভবিষ্যতে এই পরম্পরার প্রকাশ আরো এগিয়ে চলবে ।
    Published October 31, 2002
  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments