সাহিত্যের ভাষা আর চলচ্চিত্রের ভাষা আলাদা - এই সিদ্ধান্তে যদিও কোনোই সংশয় নেই, তবু এ-বিষয়ে আমাদের দৃষ্টিকোণ আমরা আগেই স্পষ্ট করে নিতে চাই । কেবলই `আলাদা' বললে বোধহয় সম্পূর্ণ ঠিক বলাও হয় না ।
সাহিত্য ভাষা-মাধ্যমের শিল্প এবং যে-কোনো শ্রুতি-শিল্পের মতোই তার অবস্থান ও বিস্তার সময়ের পরিসরে । চলচ্চিত্র মিশ্র মাধ্যমের শিল্প । এখানে ধ্বনি, ভাষা, দৃশ্য রং এবং গতির সংবেদনা একত্রে ব্যবহৃত হয় । চলচ্চিত্রের অবস্থান তাই একই সঙ্গে সময়ের এবং দৈশিকতার বিস্তারে । `স্পেস' আর `টাইম' দুটির প্রতিই একই সঙ্গে দৃষ্টি রাখতে হচ্ছে চলচ্চিত্রকারকে । একেবারে প্রথম যুগের চলচ্চিত্র প্রসঙ্গে সত্যজিৎ রায় বলেছিলেন - "লুমিয়েরের তোলা এই ট্রেনের ছবি ছিল নাটক ও কাহিনী বিবর্জিত সাধারণ দৈনন্দিন ঘটনার সামিল । এর কিছু পরেই ত্রক্রমে ছবিতে গল্প বলা শুরু হয় এবং এই গল্প বলা থেকেই সিনেমার ভাষা একটা বিশিষ্ট চেহারা নিতে শুরু করে ।" ( বিষয় চলচ্চিত্র, কলকাতা, আনন্দ, দ্বিতীয় মুদ্রণ, ১৯৭৬, পৃ. ২)
সিনেমাতেও `গল্প বলা' ব্যাপারটা যে গুরুত্বপূর্ণ -- তা কিন্তু সত্যজিৎ রায়ের উক্তিতেই আমরা বুঝতে পারি । খুব আধুনিক সিনেমাও, কোনো-না-কোনো ভাবে একটি গল্পের রূপরেখা ধরে রাখে । যখনই চলচ্চিত্রে এসে যাচ্ছে একটি কাহিনী -- তখনই এসে যাচ্ছে সময়ের পরিসরে তার বিস্তার । কোনো কোনো সিনেমা আধঘন্টাতেই শেষ হয়ে যাচ্ছে । কোনো সিনেমার জন্য লাগছে দুই থেকে তিন ঘন্টা । কোনো চলচ্চিত্র আবার চার-পাঁচ ঘন্টার কমে যথার্থ ব্যাপ্তি পাচ্ছে না । সময়ের পরিসরের গুরুত্বটা এতেই বোঝা যায় ।
ভাষা-শিল্পেও কিন্তু আছে দৈশিক পরিসরের ব্যবহার । লেখক যখনই কোনো দৃশ্য বা বস্তুর বর্ণনা করেন তখনই সেই দৃশ্যকে বিন্যস্ত করতে হয় স্থানিকতার পটে । যদিও সেই স্থানিকতার রূপ পাঠককে মনে মনেই দেখতে হয় । প্রত্যক্ষ দৃশ্যরূপে নয়, দৃশ্যরূপের অভিজ্ঞতার স্মৃতির সাহায্যে । সেই দেখাটা কিন্তু আবশ্যিক । তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাঁসুলিবাঁকের ইতিকথা পাঠ করা কেমন করে সম্ভব সেই কাহারদের আবসস্থল, সেই অর্ধচন্দ্রাকৃতি ভূমি, সেই বাঁশবন, সেই রূপোলি নদীটিকে না দেখে ? কপালকুণ্ডলাংঔ পড়তে গেলে সেই অরণ্য, সেই সমুদ্র সেই শ্মশান, সেই প্রবাহিত গঙ্গা-তরঙ্গ -- দেখতেই হবে ।
আমরা যা বলতে চাইছি তা এই -- সাহিত্য আর চলচ্চিত্রের মধ্যে মাধ্যম ও প্রয়োগের পার্থক্যটাই শেষ কথা নয়, সাদৃশ্যের জায়গাও কিছু কিছু আছে । সবাক যুগের চলচ্চিত্র ভাষার ওপর খুবই নির্ভরশীল । সত্যজিৎ রায় একটি প্রবন্ধে বলেছেন -- "চিত্রপরিচালকের হাতে তথ্য পরিবেশনের যতরকম উপায় আছে, তার মধ্যে দুর্বলতম হল কথা । দৃশ্য বা ধ্বনির সাহায্যে কাজ না হলেই চিত্রনাট্যকার তথা পরিচালক কথার আশ্রয় গ্রহণ করেন ।... শক্তিমান পরিচালকের প্রধান গুণ হল বাক্যের সাহায্য না নিয়েও দৃশ্যকে বাঙ্ময় করে তোলা ।" (`রঙিন ছবি', বিষয় চলচ্চিত্র, পূর্বোক্ত সংস্করণ, পৃ. ৭৫) । এই কথার পরও কিন্তু মনে হয়, চলচ্চিত্রে ভাষা-প্রয়োগের কৌশলকে `দুর্বলতম' বলাটা কিছু অসতর্ক উক্তি । চলচ্চিত্রে সুন্দর সংলাপ নির্মাণ তার কারুকৃতিরই একটি দিক । একান্ত নাচার না হয়েও কথাকে সুন্দর করে সাজিয়ে দেওয়ার দৃষ্টান্ত আমরা সত্যজিৎ রায়ের চলচ্চিত্র-নির্মাণেও পেয়েছি । সুকুমার রায়ের পুত্র বিশেষভাবেই বাক্কুশল ছিলেন এবং ভাষার মধ্যে লুকোনো নানান মজাকে বার করে আনতেন তাঁর গল্পে -- বিশেষত গোয়েন্দা-গল্পে । তেমনি চলচ্চিত্রেও । এমনকি কখনো কখনো চলচ্চিত্রে তাঁর ভাষার প্রয়োগকে একান্ত জরুরি (ফাংশনাল) বলে মনে হয় না, অলংকরণমূলক (ডেকোরেটিভ) বলেও মনে হয় । শাখা প্রশাখা চলচ্চিত্রের `টাং টুইসটার' খেলা স্মরণীয় । যেমন চারুলতা চলচ্চিত্রে চারু ও অমলের কথোপকথনের মধ্যে ব-এর অনুপ্রাস চম্কানো শব্দ-বিন্যাস `অমল - আগে বর্ধমান, তারপর বিয়ে, তারপর বিলেত, তারপর ব্যারিস্টার... তারপর ব্যাক টু বেঙ্গল - বাপ্ বাপ্ বলে - বায়রন টু বঙ্কিম - বাবু বঙ্কিমচন্দ্র ।
চারু - আর বৌঠান ? বিশ্রী ? বেহা... চারু নিজেকে সামলে নেয় ।" (চিত্রনাট্য `চারুলতা' সত্যজিৎ রায়, এক্ষণ, অক্টোবর, ১৯৮২)
রবীন্দ্রনাথের গল্পে এ ধরনের কোনো বাগবিন্যাস আমরা পাই না । `কথা'-কে চলচ্চিত্রের দুর্বলতম উপাদান বলে মনে করলে ঘরে বাইরে -র মতো এতটা ভাষা আর ভাষা-নির্ভর উপন্যাস চলচ্চিত্র নির্মাণের জন্য নির্বাচন করতেন কি সত্যজিৎ রায় ? কত অজস্র কথায় ভরা ঐ চলচ্চিত্র ! কত বেশি ভাষা-নির্ভর !
তবুও চলচ্চিত্র যেহেতু প্রধানত দৃশ্যে পরিস্ফুটিত, আর সাহিত্য বাচনে - কাজেই উভয়ের মধ্যে মাধ্যমে, শৈলী আর প্রয়োগগত পার্থক্য আছেই । আমরা কেবল এইটুকুই বলতে চাই - পার্থক্যের দেয়াল নিশিছদ্র নয়, যাতায়াতের রাস্তা খোলা আছে অনেক ।
আসছি আর একটি প্রসঙ্গে । সব শিল্প নির্মাণেই একটি অভিপ্রায় থাকে, যদিও একই অভিপ্রায় থাকে না । একই মাধ্যমে নির্মিত দুটি শিল্পরূপের মধ্যে অভিপ্রায়গত ভিন্নতা থাকতে পারে । যেমন কপালকুণ্ডলা আর আনন্দমঠ -এর বলবার কথাটি সম্পূর্ণ আলাদা । আবার অশোক রুদ্র যখন একটি তীব্র প্রবন্ধ লিখে (`শিল্পীর স্বাধীনতা', পরিচয়, শারদীয় ১৩৭১ সেপ্টেম্বর-অক্টোবর ১৯৬৪) অভিযোগ করেছিলেন যে, সত্যজিৎ রায় রবীন্দ্রনাথের `নষ্টনীড়' গল্পের মূল অভিপ্রায় থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছেন চারুলতা চলচ্চিত্রে তখন সত্যজিৎ রায় বারবার বোঝাতে চেয়েছিলেন যে ঐ গল্প এবং আলোচ্য চলচ্চিত্র - দুটি শিল্পকর্মেরই দৃশ্যরূপ আলাদা হলেও দুটিরই `থীম' অর্থাৎ অভিপ্রায় অ-পৃথক । সত্যজিৎ রায় লিখেছিলেন "ছেলেমানুষি কল্পনার জগৎ থেকে রূঢ় বাস্তবের জগতে নেমে এসেছে দুজনেই । এটাই বড় কথা । এটাই নষ্টনীড়ের থীম । আমার মতে চারুলতায় এ-থীম অটুট রয়েছে ।" (`চারুলতা প্রসঙ্গে', বিষয় চলচ্চিত্র, পূর্বোক্ত সংস্করণ, পৃ. ৫৯) । সাহিত্য ও চলচ্চিত্রের মাধ্যম আলাদা, সংরূপও পৃথক - তবুও তাদের অভিপ্রায়গত সাদৃশ্যের কথাই বলেছেন সত্যজিৎ রায় ।
এখন আমরা একটি প্রশ্নের মুখোমুখি হব । কোনো বিশিষ্ট সাহিত্যিকের সুপরিচিত একটি ভাষা-শিল্পরূপ অবলম্বন করে যখন কোনো চলচ্চিত্র নির্মিত হবে সেখানে যদি দুটি শিল্পকর্মের অভিপ্রায় আলাদা হয়ে যায়, `চলচ্চিত্রের ভাষা আলাদা' এই দোহাই দিয়ে সেই পরিবর্তন, সেই `থিমেটিক চেঞ্জ' আমরা কি সমর্থন করব ?
এক শিল্পী রবীন্দ্রনাথ । অপর শিল্পী সত্যজিৎ রায় । দুজনেরই আছে পৃথক ও নিজস্ব জীবন-উপলব্ধি । জীবন-উপলব্ধির নিজস্বতা থাকার জন্য খুব প্রতিভাবান মানুষ হবার প্রয়োজন হয় না । আমাদের মতো সাধারণ মানুষেরও প্রত্যেকেরই জীবন উপলব্ধি হয় `নিজস্ব' । একজনের অভিজ্ঞতা ও অনুভূতি আর একজনের মনের মধ্যে `কপি' হয়ে প্রবেশ করে না কখনো । যে-কোনো সাহিত্যকৃতি অবলম্বন করে প্রতিটি পাঠক নিজস্ব পাঠকৃতি গড়ে তোলেন - এই মতটি এখন প্রায় সর্বস্বীকৃত । কোনো দুজন পাঠকের পাঠকৃতি সম্পূর্ণ একরকম হয় না । সাহিত্য পঠনও এক স্বতন্ত্র সৃষ্টি পাঠকের দিক থেকে । এই দাবি মেনে নেবার পর, একটি সাহিত্যরূপ অবলম্বন করে চলচ্চিত্র-নির্মাতাও একটি নিজস্ব শিল্পকৃতি গড়ে তুলবেন তাঁর নির্মাণে । এ ব্যাপারে খুব বেশি আপত্তি আমরা করতে পারি না । তবুও আপত্তি ওঠে । কেউ-না-কেউ আপত্তি তোলেন । তারও একটা কারণ আছে ।
কোনো পাঠক বা নাট্যকার বা চলচ্চিত্রকার যখন একটি সাহিত্য-রূপবন্ধ অবলম্বন করে নিজস্ব পাঠকৃতি গড়ে নেবেন তখনও কিন্তু সেই নিজস্ব ব্যাখ্যা-সংবলিত সংগঠনটি তাঁকে তুলে আনতে হবে লেখক প্রদত্ত সংরূপটির অভ্যন্তর থেকেই, তাকে অস্বীকার করে নয় । যেখানে তা অস্বীকৃত হচ্ছে সেখানে তার যৌক্তিকতার প্রতিষ্ঠা তর্কাতীত হবে না কিছুতেই । একটি কৌতুক-সরস গল্প আমরা দৃষ্টান্তরূপে ব্যবহার করতে পারি ।
রামচন্দ্রের বনবাসের আদেশ দেওয়া হলে রাম যখন বনে গেলেন তখন ভরত শোকার্ত হয়েছিলেন । জ্যেষ্ঠ ভ্রাতার প্রতি শ্রদ্ধা ব্যক্ত করবার জন্য তিনি নিজে রাজ-সিংহাসনে না বসে রামের পাদুকা নিয়ে এসে তা স্থাপন করেছিলেন সিংহাসনে এবং নিজে সিংহাসনের পদতলে বসে বল্কল ধারণ করে রাজ্য পরিচালনা করেছিলেন চৌদ্দ বছর - এমনই কথিত আছে রামায়ণে । কিন্তু এই বিবরণ থেকে এক পাঠক পৌঁছেছিলেন ভিন্নতর এক ব্যাখ্যায় । তিনি বলেছিলেন - ভরত যে রামের এত অনুরাগী তার কোনো প্রকৃত প্রমাণ নেই রামায়ণ-কাহিনীতে ।
ভরত সিংহাসন এবং রাজ্যের অধিকার ত্যাগ করেন নি । চৌদ্দ বছর ধরে রাজ্যের রাজা হয়েই ছিলেন । রামচন্দ্রকে বনবাসে যাওয়া থেকে বিরত করেননি তিনি । উপরন্তু তাঁর পাদুকাটি নিয়ে এসেছিলেন হয়তো-বা বনপথে রাম যাতে পায়ে কাঁটা ফোটার কষ্টটাও ভোগ করেন - সে জন্যেই । গল্পটির মূল রস কৌতুক । কিন্তু পাঠকের এই ব্যাখ্যা তাঁর নিজস্ব হলেও রামায়ণের ঘটনা-ধারাকে যদি বাল্মীকির নিজস্ব কথন ও ব্যাখ্যা থেকে বিচ্ছিন্ন করে নেওয়া যায়, তাহলে এমন একটি সিদ্ধান্তে পাঠক পৌঁছতেও পারেন । সে ক্ষেত্রেও, ভরত যে রামের পাদুকা চেয়ে এনেছিলেন - কবি প্রদত্ত এই ঘটনা, - এই নির্মাণ থেকে বিচ্যুত হবার তাঁর কোনো উপায় নেই । নিজস্ব ব্যাখ্যা পাঠক দিতে পারেন, কিন্তু কাব্য-কাহিনী নিজে উদ্ভাবন করতে পারেন না ।
এই গল্পটিতে পাঠক ঘটনা উদ্ভাবন করেন নি কিন্তু তাঁর প্রদত্ত ব্যাখ্যায় রামায়ণ-কাহিনীর পরম্পরাগত অভিপ্রায় পরিবর্তিত হয়ে গেছে । একজন চলচ্চিত্র-নির্মাতা লেখক-রচিত মূল কাহিনী থেকে সরে আসতে পারেন দুটি ক্ষেত্রেই । ঘটনা ও দৃশ্য উদ্ভাবনের ক্ষেত্রে এবং অভিপ্রায়েরও পরিবর্তনে । বিতর্কটা এখানেই, একজন বড়ো সাহিত্যিকের সৃষ্টির যে মর্মকথা, চলচ্চিত্রকার তাঁর নিজস্ব নির্মাণে যদি লেখকের সেই সৃষ্টিকে অবলম্বন করেন তাহলে সেই মর্মকথাটি পরিবর্তিত করবার অধিকার তাঁর আছে কিনা । কিংবা অধিকারের প্রশ্ন যদি নাও তোলা হয়, সেই পরিবর্তনে চলচ্চিত্রটি মূল কাহিনীটির চেয়ে ভালো হয়েছে কিনা - এই বিতর্ক এক্ষেত্রে থাকবেই ।
এবার আমরা কিছু দৃষ্টান্তের উল্লেখে আসব । সীমাবদ্ধ থাকব রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্প এবং সত্যজিৎ রায় ও তপন সিংহ নির্মিত চলচ্চিত্র-রূপের ক্ষেত্রে । প্রসঙ্গত অন্য দু-একটি চলচ্চিত্রের কথাও এসে যাবে ।
গল্প থেকে চলচ্চিত্র -এই প্রক্রিয়ার ক্ষেত্রে কয়েকটি পরিস্থিতির উদ্ভব হতে পারে :
১. এমন হতে পারে যে, লেখকের যা অভিপ্রায়, চলচ্চিত্রটিতেও সেই একই অভিপ্রায় ব্যক্ত করেছেন পরিচালক এবং চলচ্চিত্র নির্মাণের ক্ষেত্রেও সেই একই দৃশ্যাবলী এবং ঘটনাধারা কাহিনীর মতোই অনুসরণ করেছেন বিশ্বস্তভাবে । চলচ্চিত্রকারের নিজস্ব উদ্ভাবন খুবই কম । অথবা প্রায় কিছুই নেই । এ ধরনের নিদর্শন ভালো চলচ্চিত্রে বিশেষ দেখা যায় না । পূর্ণেন্দু পত্রী নির্মিত স্ত্রীর পত্র কে কিছুটা এ জাতীয় দৃষ্টান্ত বলা চলে । চলচ্চিত্রটি `ফ্ল্যাশ ব্যাক'-এ উপস্থাপিত । রবীন্দ্রনাথের গল্পটিও তাই । পূর্ণেন্দু পত্রী কিছু কিছু দৃশ্য সংযোজন করেছিলেন । এক ভৃত্যের অতি সংক্ষিপ্ত এক ভূমিকায় রুদ্রপ্রসাদের অনবদ্য অভিনয় ও সংলাপ-উচ্চারণ যে কোনো দর্শকের স্মৃতিতে অক্ষয় থাকবার মতো । বিন্দুর পাগল স্বামীকেও দৃশ্য-পরিকল্পনার গুণে একটি বিশিষ্ট চরিত্র দিয়েছিলেন তিনি । যদিও এই চরিত্রটির পরিকল্পনায় ঋত্বিক ঘটক নির্মিত অযান্ত্রিক চলচ্চিত্রটির দু-একটি দৃশ্যের স্মৃতি ব্যবহৃত হয়েছিল বলে মনে হয় । পূর্ণেন্দু পত্রীর স্ত্রীর পত্র চলচ্চিত্রে রবীন্দ্রনাথ রচিত মূল গল্পের অভিপ্রায়ের অন্যথা হয়নি এতটুকুও । গল্পের অনুসরণেও তেমন কিছু হেরফের হয়নি । অথচ চলচ্চিত্রটি যথেষ্ট সংবেদী হয়েছিল । অজয় কর পরিচালিত মাল্যদান চলচ্চিত্রটির কথাও বলা চলে । রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্পের প্রায় বিশ্বস্ত অনুসরণ ছিল সেখানেও । আবার অনেক সময় বিশ্বস্তভাবে মূল গল্পের অনুসরণ করে গেলেও চলচ্চিত্ররূপে তা তেমন ভালো হয় না অথবা খুবই সাধারণ মানের হয় । এমন দৃষ্টান্ত বাংলা চলচ্চিত্রের জগতে অনেক আছে । শরত্চন্দ্রের বহু ছোটো উপন্যাস থেকে এ জাতীয় অতি সাধারণ চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে ।
২. গল্প থেকে চলচ্চিত্র নির্মাণের প্রয়াসে দ্বিতীয় পরিস্থিতি হতে পারে এই যে, লেখক যা বলতে চেয়েছেন চলচ্চিত্রকারও মোটের উপর তাই-ই বলতে চেয়েছেন । তবে বলবার শৈলী হয়ে গেছে অনেকখানি আলাদা । সেখানে অনেকখানি উদ্ভাবন আছে চলচ্চিত্র পরিচালকের । বিতর্কটা সবচেয়ে বেশি ওঠে এখানেই । এই প্রসঙ্গে আমরা রবীন্দ্রনাথের `নষ্টনীড়' আর সত্যজিৎ রায়ের চারুলতা সম্পর্কে একটু বিস্তৃত আলোচনা করব । কারণ এই চলচ্চিত্রটি অবলম্বনে অশোক রুদ্রের অভিযোগ -"... যেহেতু তিনি (সত্যজিৎ রায়) `নষ্টনীড়' গল্পের প্লট এবং থীম দুই-ই বদলেছেন তখন সমস্ত ঘটনা এবং সমস্ত সংলাপও তাঁর নিজেকেই নতুন করে লিখতে হয়েছে" ( পরিচয় , সেপ্টেম্বর-অক্টোবর ১৯৬৪) । অথচ সত্যজিৎ রায় বলেছেন যে দুটি শিল্প-সংরূপেরই অ-পৃথক `থীম অটুট রয়েছে ।'
আমরা প্রথমে অন্য একটি গল্প উদাহরণ হিসেবে গ্রহণ করব । রবীন্দ্রনাথের `পোস্টমাস্টার' আর সত্যজিৎ রায় নির্মিত চলচ্চিত্র পোস্টমাস্টার - এই দুটির মধ্যে মূল বক্তব্যের তেমন কোনো পার্থক্য নেই । যদিও ছিদ্রান্বেষী সমালোচক বলতে পারেন গল্পের রতনের চেয়ে ছবির রতনের বয়স কম গল্পের শেষ দৃশ্যের বর্ষা বিস্ফারিত নদীটি ছবিতে প্রদর্শিত হয়নি - ইত্যাদি । কিন্তু রবীন্দ্রনাথের গল্পের মূল কথাটি ছিল - একটি শহরের ছেলে গ্রামে এসে কিছুতেই নিজের মনকে বসাতে পারল না । গ্রামের একটি বালিকা তাকে সম্পূর্ণ হৃদয় দিয়ে গ্রহণ করেছিল, একান্ত আপনজন বলে নির্ভর করেছিল তার ওপর । সেই মেয়েটির হৃদয় পোস্টমাস্টার যুবকটি অনুভবও করেছিল । একমাত্র তাকেই ছেড়ে যেতে কষ্ট হয়েছিল তার । তবু সে চলে গিয়েছিল । নিজের দু:খের অতলতায় নিমজ্জিত হয়েছিল বালিকা রতন । গল্পের এই মর্মবস্তু সত্যজিৎ রায় নির্মিত চলচ্চিত্রেও অপরিবর্তিত আছে । বস্তুত, এই চলচ্চিত্রটিতেই সত্যজিৎ সর্বাধিক রবীন্দ্রানুসারী বলে মনে হয় । এখানে সত্যজিৎ রায় একটি পাগলের চরিত্র উদ্ভাবন করেছেন । সে সোজা হয়ে চলতে পারে না, তার পোশাক উন্মাদের মতোই । তার দৈহিক রূপ অ-সুন্দর । তাকে দেখলে ভয় হওয়া স্বাভাবিক যদিও প্রকৃতপক্ষে তাকে ভয় করবার কিছু নেই । এই পাগল চরিত্রটিকে সত্যজিৎ ব্যবহার করেছেন অত্যন্ত কৌশলে । গ্রামের প্রকৃতি-নিবিড় দৃশ্যরূপের মধ্যে এই পাগলটিকে আপাত দৃষ্টিতে কু-দর্শন এবং প্রক্ষিপ্ত বলে মনে হয় । কিন্তু সত্যজিৎ রায় এই উন্মাদের অস্তিত্ব ব্যবহার করে গ্রামটির সঙ্গে পোস্টমাস্টারের প্রকৃত সম্পর্ক যেন উদ্ঘাটিত করে দিয়েছেন । শহরের ছেলে গ্রামে এসেছে চাকরি নিয়ে । গ্রামে তার ভালো লাগে না একটুও । যদিও গ্রামের অধিবাসীরা গল্প করে আর গান-বাজনার আসর বসিয়ে তাকে আপন করে নিতেই চেয়েছিল । সর্বোপরি ছিল রতনের নিবিড় হৃদয় । তা সত্ত্বেও গ্রাম সেই যুবকটির কাছে আপন হয়নি । গ্রাম তার কাছে অচেনা, অ-বন্ধু এবং কিছুটা ভীতিকর থেকে গেছে । গ্রামের এই পাগলটি যেন সেই পোস্টমাস্টারের সঙ্গে গ্রামের প্রকৃত সম্পর্কের চিত্রটিকে তুলে ধরে । তাকে গ্রামের কেউই ভয় পায় না, কেবল শহর থেকে আসা পোস্টমাস্টারটি ভয় পায় । তার গ্রাম ছেড়ে যাবার পথে একদিকে থাকে রতন, অন্যদিকে সেই অদ্ভুত দর্শন, অপ্রিয়দর্শন পাগল । শহরের যবুকটি রতনকে ছেড়ে যেতে কিছুটা দু:খবোধ করেছিল, কিন্তু গ্রাম ছেড়ে যেতে তার কষ্ট হয়নি । রবীন্দ্রনাথ এরকমই দেখিয়েছেন, সত্যজিৎ রায়ও দেখিয়েছেন তাই । চলচ্চিত্রকারের অবকাশ নেই লেখকের মতো ব্যাখ্যা করে দেবার । সত্যজিৎ রায়ও নাগরিক যুবকটির সঙ্গে গ্রামের প্রকৃত দূরত্বের বিষয়টি ভাষায় বিশ্লেষণ করতে পারেন নি । সে জায়গায় তাঁর উদ্ভাবিত এই পাগল সমগ্র উপলব্ধিটিকে যথার্থভাবেই ধারণ করেছে বলে মনে হয় । মনে রাখতে হবে, `পোস্টমাস্টার' গল্পটিতে এই যুবকই প্রধান চরিত্র । যে নাগরিক, গ্রাম যার কাছে, রতনের মতো কোনো কোনো হৃদয় থাকা সত্ত্বেও প্রকৃতপক্ষে ঐ পাগলটির মতোই অস্বস্তিকর এবং অপরিচিত । `পোস্টমাস্টার' গল্পের এই পাগল চরিত্র সত্যজিৎ রায়ের প্রতিভার নির্মাণ ।
`নষ্টনীড়' ও চারুলতা -র আলোচনায় আসা যাক । একথা বোধহয় অস্বীকার করা যাবে না যে দুটি শিল্পরূপেরই অন্তিম দৃশ্যে দুই শিল্পীর অভিপ্রায় একই আছে । পার্থক্যের জায়গা যদি কোথাও থাকে তা চরিত্র-পরিকল্পনায় নিহিত । কিন্তু শেষ দৃশ্যে রবীন্দ্রনাথ এরকম দেখিয়েছেন যে, স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কে পারস্পরিক নির্ভরতার মূল বন্ধনসূত্র ছিন্ন হয়ে গেলেও তারা দুজনেই পরস্পরের জন্য বেদনাবোধ করেছে এবং কাছে আসবারও চেষ্টা করেছে । কিন্তু কাছে আসবার কথা ভাবলেও ভূপতি ও চারুর মন মেলাবার পথ খুঁজে পাচ্ছে না । এই উপলব্ধিকে দৃশ্যে ধরবার জন্য সত্যজিৎ রায় দেখিয়েছেন দুজনের হাত কাছাকাছি এগিয়ে এসেও মিলতে পারছে না । এটা খুবই যথাযথ হয়েছে, বলা যায় খুবই সুস্পষ্ট । কোথায় যেন একটু সূক্ষ্মতার অভাবই আছে । যতবারই চারুলতা দেখেছি ততবারই এ-কথাটি আমার মনে হয়েছে । মনের মিল বা অমিল বোঝাবার জন্য দুটি হাত এসে মিলে যাওয়া অথবা না-মেলা এ যেন একটু স্থূল রুচির পরিকল্পনা । এক ধরনের বিবাহের আমন্ত্রপত্র দেখা যেত এক সময়ে - সেখানে নর-নারীর মিলনের প্রতীক রূপে মিলিত হাতের ছবি ছেপে দেওয়া হত । মূল গল্পের অন্তিম অভিপ্রায় এতে যথাযথ রইল ঠিকই কিন্তু চলচ্চিত্ররূপে দৃশ্যটি যে সত্যজিৎ রায়ের প্রতিভার উপযোগী হয়েছে - এমন কখনোই মনে হয় না ।
তার পরেও সত্যজিৎ রায় সেই অ-মিলিত হাতের উপরে লিখে দিলেন- `নষ্টনীড়' । ভাষার ওপর এই অহেতুক দুর্বলতা কেন একজন চলচ্চিত্র-নির্মাতার ? হয়তো `নষ্টনীড়' লেখাটির নক্শা ও `লেটারিং' সুন্দর করে করা হয়েছে - সেই দৃশ্যরূপের সৌন্দর্য দিয়ে দর্শককে একটু আকৃষ্ট করার চেষ্টা । সত্যজিৎ রায় যে বিজ্ঞাপনের জগৎ থেকে চলচ্চিত্রের জগতে এসেছিলেন তার সুফল যেমন ফলেছে তাঁর নির্মাণে, ক্কচিৎ দুর্বলতাও প্রকটিত- এটি একটি নিদর্শন ।
প্রসঙ্গত একটি কথা, রবীন্দ্রনাথের গল্পের `নষ্টনীড়' নাম এবং সত্যজিৎ রায়ের চলচ্চিত্রের ঐ সমাপ্তি-লিখন - দুটিই কিছু সংশয় জাগাতে পারে । ভূপতি আর চারুলতার নীড় কোনোদিনই সেভাবে গড়ে ওঠেনি । ভূপতি এরকম ভাবত যে তার নীড় আছে কিন্তু প্রথমত, সে ভুল ভাবত । দ্বিতীয়ত, নিজের কর্মব্যস্ততার মধ্যে চারুলতার নৈ:সঙ্গ্যের স্বরূপ বোঝবার ক্ষমতাও তার ছিল না । রবীন্দ্রনাথ এরকমই লিখেছেন । চারুলতাও কোনোদিন ভূপতির মন বোঝবার চেষ্টা করেনি । এমনকি যখন অমলের প্রতি তার মনোভাব ভূপতির কাছে স্পষ্ট হয়ে গেছে তখন ভূপতির সর্বস্ব হারানোর কষ্ট এবং বিশ্বাস-হারানো রিক্ত মুখচ্ছবির দিকে চারুলতা তাকিয়েও দেখেনি । ভূপতির ঘরে চারুলতার নীড় কোনোদিনই ছিল না । চারুলতার মনে ভূপতিরও কোনোদিন নীড় গড়ে ওঠেনি । যে নীড় নেই তা নষ্ট হবে কেমন করে ! অনুপ্রাস-ঝংকৃত নামটি শুনতে যত সুন্দর ততটা যেন সুপ্রযুক্ত নয় । সত্যজিৎ রায় এই নামটিকে, এই নামের ভাষাকে বাড়াবাড়ি রকমের প্রাধান্য কেন চলচ্চিত্রের শেষে দিলেন তা ঠিক বোঝা যায় না ।
সাহিত্যিকের পরিকল্পিত `থীম' এবং `অভিপ্রায়' অক্ষুণ্ণ রেখেই প্রতিভাবান চলচ্চিত্র-নির্মাতা মাঝে মাঝে এমন দৃশ্য উদ্ভাবন করতে পারেন যেখানে তাঁর নিজস্ব প্রতিভার উজ্জ্বলতা বিকীর্ণ হয় । সে-সব দৃশ্য আমরা ভুলতে পারি না কোনোদিন । এমন একটি দৃশ্য আছে তপন সিংহ পরিচালিত কাবুলিওয়ালা -তে । সেখানে শিশু মিনির নাচ ও গানের একটি টুকরো অংশ আছে যা দূরে দাঁড়িয়ে দেখেছে কাবুলিওয়ালা এবং স্নেহের আনন্দে আপ্লুত হয়ে যাচ্ছে । গল্পে এই নাচ-গানের বিবরণ নেই । চলচ্চিত্রে আছে বলে গল্পের মূল ভাব, রস বক্তব্য কিছুরই হানি ঘটেনি । অথচ ছবিটির দৃশ্য-সৌন্দর্য, শ্রুতি-নন্দনতা, হার্দ্যতাগুণ এবং মাধুর্য বেড়েছে অনেকখানি । চারুলতা ছবির তেমন একটি স্মরণীয় দৃশ্য চারুলতার অপেরা গ্লাস চোখে দিয়ে রাস্তা দেখা । সত্যজিৎ রায় একটি বাল্যস্মৃতিকথা রচনা করেছেন - নাম যখন ছোট ছিলাম । সেই বইয়ে আছে কয়েকটি পুরোনো বাড়ির বর্ণনা যেগুলিতে বালক বয়সে কখনো কখনো বাস করেছেন সত্যজিৎ । সে-সব বাড়িতে থাকত নক্শা-করা মেঝে, লাল-নীল কাচ বসানো জানলা, চওড়া বারান্দা । তেমনই একটি বাড়ির সদর দরজার ফুটোর সামনে ঘষা কাচ ধরলে বাইরের দৃশ্য খুদে আকারে আর উল্টোভাবে ছায়া ফেলত সেই কাচে । অনেক দীর্ঘ গ্রীষ্ম-দ্বিপ্রহর কাচখণ্ডের ওপর ভেসে ওঠা চলন্ত পথ-দৃশ্যমালা দেখে কাটিয়েছিলেন বালক সত্যজিৎ । চারুলতা -র অনুপম প্রথম দৃশ্যটি সেই স্মৃতির শিকড় থেকে উঠে এসেছে । এই দৃশ্যে একই সঙ্গে ধরা পড়েছে চারুলতার নি:সঙ্গতা আর তার সহজ জীবন উপভোগের মন, তার অনাবিল কৌতুকপ্রাণতা - মোটা লোকটিকে বারবার দেখার মজাটা তার চোখেমুখে ফুটে ওঠে । আবার এই দৃশ্যেরই প্রবহমানতায় অপেরা-গ্লাস দিয়ে যখন যে অপসৃয়মান ভূপতিকে দেখতে থাকে - ভূপতি ধীরে ধীরে বেরিয়ে চলে যায় তার দৃষ্টির বৃত্ত থেকে - তখন এই চলচ্চিত্রের অমোঘ এক্সপোজিশন এই সংকেত দৃশ্যটিতে নির্ভুলভাবে ফুটে ওঠে ।
চারুলতা -র আর একটি অপরূপ দৃশ্য চারুলতার দোলনায় দোলার ছবি । মূল গল্পে দোলনায় দোলা তো নেইই - এমনকি দোলনারই কোনো উল্লেখ নেই কোথাও । কিন্তু চলচ্চিত্রে দোলনার সেই উড়ান, প্রতিটি দোলে আগের চেয়ে আরো একটু উঁচুতে উঠে যাওয়া - সেই আত্মবিশ্বাসদীপ্ত খুশির উজ্জীবন - যেন চারুর মনের বাঁধনগুলিকে, তার ইনহিবিশনকে আলোড়িত, আলগা আর মুক্তপক্ষ করে দিচ্ছে । এ-দৃশ্য ভোলা যায় না সহজে । গল্পে চারু ও অমলের মনের নৈকট্য এসেছে হাসি-খেলার মধ্যে দিয়েই । সেখানে বাগানের পরিকল্পনা আছে । কিন্তু এই বাগানের দোলনায় এমনভাবে চারুর দোলা আর বসে থাকা দেখিয়েছেন সত্যজিত্- সেখানেই চারু যে অমলকে তার দেহ-মন সমর্পণের দিকে এগিয়ে চলেছে তা সূক্ষ্মভাবে কিন্তু বেশ তীব্রভাবেই বোঝা যায় ।
সহসা আমরা দোলনায় বসা চারুর সংলাপ শুনতে পাই - `রেফ দিলে না ?' তারপর ক্যামেরা সরে এসে দেখায় অমলকে । মাদুরে বসে অমল খাতায় কিছু লিখছে । `স্বর্ণমণ্ডিত উপলখণ্ড' লেখার সময়ে বাদ পড়ে গেছে `রেফ' । দূর থেকে সেই অপেরা গ্লাস দিয়ে চারু লক্ষ করছিল তার লেখা - এতক্ষণ ধরে । এই সংলাপ ও দৃশ্যটিতে দর্শক অনুভব করেন অমলের প্রতি চারুর মনোযোগের নিবিড়তা ও নিবিষ্টতা । অমল একটু চকিত হয়ে `রেফ' বসিয়ে দেয় । তীক্ষণ কাঁটার মতো উঁচিয়ে থাকা `রেফ' । চারু আর অমলের সম্পর্কের গোপন বিপদ-সংকেত । এক অনবদ্য দৃশ্য উদ্ভাবন ।
অমলের কাছে চারুর দেহ-মনের সমর্পণের কথা বলছিলাম । দেহের ব্যাপারটা খুব সাবধানে পাশ কাটিয়ে গেছেন রবীন্দ্রনাথ । নারী ও পুরুষের সম্পর্কের দৈহিকতার দিকটি ভাষায় প্রকাশ করবার ব্যাপারে তাঁর একটু শুচিবায়ুতা ছিল । `নষ্টনীড়' গল্পে চারুর একাকীত্ব প্রসঙ্গে তার সন্তানহীনতার দিকটি একবারও উল্লেখিতই হয়নি । ভূপতি চারুর মনের চাহিদার প্রতি কিছুটা উদাসীন ঠিকই কিন্তু চারুকে সে ভালোবাসে । যতই লিবারেল ইনটেলেকচুয়াল আর পত্রিকা-পাগল হোক, শরীরের স্বাভাবিক চাহিদা ভূপতির না থাকবার কোনো কারণ নেই । কাজেই এই দম্পতি কেন নি:সন্তান তা বোঝা যায় না । সেকালের হিসেবে চারুর বয়সে সন্তানহীন থাকবার কথা নয় । সেকালের সমাজ বিষয়টিকে ভুলে থাকতে দেবে বলেও মনে হয় না । তবু রবীন্দ্রনাথের গল্পে সন্তান সম্পর্কিত কোনো ইঙ্গিতও কোথাও নেই । চারুলতা চলচ্চিত্রে আছে - খুব সূক্ষ্ম এক ঝলক - তবু আছে । সেই দৃশ্যেও সেই দোলনায় বসে, অপেরা-গ্লাস হাতে চারুলতাকে দেখি । `চারুলতা' চিত্রনাট্য থেকে সত্যজিৎ রায়ের লিখনে প্রসঙ্গটিকে দেখা যাক --
"চারু গুন গুন করতে করতে ধীরে ধীরে দোলনায় দোলে । সে আবার অপেরা গ্লাস চোখে লাগায় । ...চারুর দৃষ্টি পাশের বাড়ির বারান্দায় গিয়ে থেমে যায় ।চলচ্চিত্রে ব্যাখ্যা করবার অবকাশ না থাকলেও চিত্রনাট্যে সত্যজিৎ রায় এখানে একটু ভাষ্য-রচনা না করে পারেননি ।মায়ের কোলে একটি বাচ্চা । মা তাকে দোল দিয়ে খেলাচ্ছে ।
বাচ্চাটি খিল খিল করে হাসে ।
দৃশ্যটি কিছুক্ষণ ধরা যাক, তারপর আমরা চারুর মুখ দেখতে পাই । তার চোখে সতৃষ্ণ চাউনি । তার দোলনা থেমে গেছে, থেমে গেছে গুনগুনানিও ।চারু ধীরে আবার তার অপেরা গ্লাস চোখে লাগায় ।
অমলের মুখ - খুব কাছ থেকে দেখা যাচ্ছে ।
চারু স্তব্ধ । অপেরা গ্লাস তার চোখ থেকে নেমে আসছে অমলের প্রতি তার মনোভাব উপলব্ধি করে সে নিজেই যেন শঙ্কিত ।" ( এক্ষণ, অক্টোবর, ১৯৮২)
সত্যজিৎ রায় স্পষ্টতই এখানে চারু ও অমলের মানসিক সম্পর্কের মধ্যে, অন্তত চারুর মনে শারীরিক কামনার একটি সূত্র প্রবেশ করিয়ে দিয়েছেন - তার সন্তান-আকাঙ্খা ও অমলের প্রতি তার প্রীতি যেন শুরু করেছে মিশে যেতে । চলচ্চিত্রে অমলের বুকে মাথা রেখে চারুলতাকে কাঁদতে দেখেছি আমরা । কেন চারুলতার সন্তান নেই - সে -প্রশ্নের কোনো জবাব আমরা পাই না রবীন্দ্রনাথের গল্পে । সত্যজিৎ রায় কি এজন্য ভূপতিকেই দায়ী করেছেন - অতি মৃদুভাবে ? এই বাক্যবিহীন দৃশ্যটি রবীন্দ্রনাথের গল্পের ওপর একটু সংযোজন । তবে তা কেন্দ্রীয় `থীম' থেকে খুব বেশি সরে এসেছে- এমন বলা যায় না । যদিও মানতেই হয় যে, রবীন্দ্রনাথের গল্পে নেই এমন এক বিন্দু অনুভূতি এখানে চলচ্চিত্রটিতে মিশিয়ে দিয়েছেন সত্যজিৎ রায় ।
৩. গল্প থেকে চলচ্চিত্র হবার পথে আরো একজাতীয় পরিবর্তন আমরা দেখতে পাই । লেখকের রচনা অনেক সময়ে একক অভিপ্রায়সম্পন্ন হয়ে থেমে থাকে না । মূল অভিপ্রায়ের আশেপাশে কোনো কোনো অপ্রধান বক্তব্য, দেশ ও কালের প্রেক্ষিতগত কোনো সঞ্চারীভাব ঘিরে থাকতে পারে গল্পটিকে । তাতে গল্পের স্বাদ ও ব্যঞ্জনা একটু স্তর-সমন্বয়িত হয়, একটু জটিল কিন্তু সেই শৈল্পিক জটিলতা ধী-সম্পন্ন পাঠক ও দর্শককে তৃপ্ত করে অনেক বেশি । গল্পের অন্তর্গত সেরকম কোনো পার্শ্বিক অভিপ্রায়কে এবং আপাত অপ্রধান ব্যঞ্জনাকে চলচ্চিত্রকার, নিজস্ব শিল্প-সংরূপের শর্ত মেনে, অনেক বেশি প্রাধান্য দিতে পারেন । কখনো কখনো এর ফল হতে পারে খুব ভালো এবং অতীব তাত্পর্যপূর্ণ । একদিক থেকে চারুলতা -য় ঠিক তাই হয়েছে ।
এই কাহিনীর ঘটনাকাল ১৮৭৯-৮০ সাল । সময়টির সামান্য উল্লেখ আছে রবীন্দ্রনাথের গল্পে । ভূপতির রাজনীতি-সচেতনতা ও দেশ সম্পর্কিত বোধ, ভূপতির বহির্বিশ্ব সমীক্ষণ, তার পত্রিকা করা - এই সব কিছুকেই একটু পরিহাসের সুরে উল্লেখ করেছেন রবীন্দ্রনাথ । কিন্তু সত্যজিৎ রায় সম্পূর্ণ বর্জন করেছেন সেই পরিহাস । তিনি অনেক বেশি গুরুত্ব দিয়ে উপস্থাপিত করেছেন উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধের শিক্ষিত বাঙালির মনোভাবের বিশিষ্টতা ।
উনিশ শতকের বাঙালি - যে ব্রিটিশ শাসনের গণতান্ত্রিকতায় আস্থা রাখে আবার জাতীয় চেতনার আকাঙ্খাতেও স্পন্দিত হয় । ভূপতির গম্ভীর স্থিতিশীল রাজনৈতিক চিন্তার ওপর অমলের কন্ঠে উচ্চারিত আনন্দমঠ -এর ঝংকার ধ্বনিত হয় - `হরে মুরারে' বাঙালির দ্বিধাগ্রস্ত রাজনৈতিক ভাবনা ফুটিয়ে তোলে এই দৃশ্য । আবার বাঙালি মধ্যবিত্তের খণ্ডিত আদর্শ, তার বিলেতমুখী মনোভাব - `বর্ধমান, বিয়ে, বিলেত, ব্যারিস্টার'- অমলের এই সংলাপে প্রস্ফুটিত । ইংল্যাণ্ডের নির্বাচনে গ্ল্যাডস্টোনের বিজয় উপলক্ষে ভূপতির বাড়িতে পার্টি, সেই পার্টিতে রামমোহনের প্রতি শ্রদ্ধা আর নিধুবাবুর টপ্পার প্রতি আগ্রহ এক নি:শ্বাসে ব্যক্ত হওয়া - অতি যত্নে সমস্তটার দৃশ্যরূপ পর্দার বুকে ফুটিয়েছেন সত্যজিৎ রায় । ভূপতির নিষ্ফল জীবন যেন এক ব্যক্তিগত মানুষের অন্ত:শূন্যতাই নয় - ব্রিটিশ শাসিত ভারতের, উনিশ শতকীয় বঙ্গীয় নবজাগরণেরই এক ভিতরের ছবি । যে-জাগরণ উপরিতলের স্তরে পালিশ করা কিন্তু ভিতরে দুর্বল, অসহায়, অপূর্ণ । রবীন্দ্রনাথের লেখার পরিহাসের সুরেও ঐ অপূর্ণতা, ঐ অন্ত:সারশূন্যতার প্রতিই ইঙ্গিত ব্যক্ত হয়েছে । সত্যজিৎ রায় তাকে ব্যপ্তি ও গাঢ়তা দিয়েছেন ।
সম্পূর্ণ বিপরীত একটি উদাহরণ আমরা দেখি তপন সিংহ কৃত `অতিথি' গল্পের চলচ্চিত্র-রূপে । রবীন্দ্রনাথের গল্পটি স্পষ্টতই ত্রিমাত্রিক । একদিকে আছে কিশোর তারাপদ-র চরিত্র-নিসর্গের উন্মুক্ততায়, নদী-প্রবাহের মতো চলিষ্ণুতায়, হাওয়ার চাঞ্চল্যে, গানের সুরের আবেশে, ধাবমান অশ্বের গতিশীলতায় সমর্পিত এক প্রাণ । অন্যদিকে আছে একটি ঘরোয়া গল্প । সুদর্শন, অনাথ ব্রাহ্মণ কিশোরটিকে জামাতা করতে চান জমিদার । জমিদারের মেয়ের সঙ্গে তার মন জানাজানির পালা উভয়েরই বয়:সন্ধিকালের দুর্জ্ঞেয়তায় জটিল হয়ে ওঠে । গল্পের এই দুটি দিক চমত্কারভাবে গতিময় দৃশ্যে, ধ্বনিতে ও বাক্যে চিত্রায়িত করেছেন তপন সিংহ । কিন্তু রবীন্দ্রনাথের গল্পে তারাপদ সম্পর্কে আর একটি উক্তিও বার বার প্রযুক্ত হয়েছে । রবীন্দ্রনাথ বারবার বিশেষভাবে বলেছেন - সে ব্রাহ্মণ । গল্পটি থেকে কয়েকটি অংশ উদ্ধার করছি -
১. কাঁঠালিয়ার জমিদার মতিলালবাবু সপরিবার দেশে যাচ্ছিলেন- "এমন সময় এক ব্রাহ্মণ বালক আসিয়া জিজ্ঞাসা করিল..."শেষ উদ্ধৃতিটিতে `ব্রাহ্মণ' শব্দটি নেই । কিন্তু এখানেই উপনিষদের `চরৈবেতি' মন্ত্রের মূর্ত ধারক হয়ে উঠেছে তারাপদ । সেই ব্রাহ্মণ্য সমাজ প্রণীত শাস্ত্র-বাণী তার মধ্যে দিয়েই ব্যক্ত হয়েছে । সে কখনও বাঁধা পড়বে না সে-জন্যই । রবীন্দ্র-মানসে ব্রাহ্মণ্য বিষয়ে যে মোহময়তা, শ্রদ্ধা ও আদর্শের ধারণা ছিল তারই নিষেকে গল্পটি কিন্তু ভিন্নতর এক তৃতীয় মাত্রা পেয়েছে । এটি কেবলই এক সরল, নিসর্গ-প্রাণ ও বন্ধন-অসহিষ্ণু কিশোরের গল্প হয়েই থেকে যায়নি । কিন্তু তপন সিংহ তাঁর নির্মিত চলচ্চিত্রটিকে ঠিক তাই করেছেন । ব্রাহ্মণত্ব সংক্রান্ত ঐ সমগ্র ব্যঞ্জনাটি বর্জন করেছেন তিনি । আমাদের মনে হয়, ভালোই করেছেন । একালের প্রেক্ষিতে নির্মিত একটি চলচ্চিত্রে ব্রাহ্মণত্ব ধারণা সম্পর্কিত সমস্ত অভিপ্রায়টিকে অল্প সময়ের মাপে কাটা একটি চলচ্চিত্রে ফুটিয়ে তোলা খুব কঠিনও হত যেহেতু এই ধারণার জড় সুপ্রাচীন কাল থেকে বাহিত হয়ে আসছে । ভাষা-শিল্পে এক পংক্তিতে লিখে দেওয়া যায়- `লক্ষ লক্ষ বর্ষ তার চক্ষের পলক নহে'- চলচ্চিত্রে সময়ের হিসেব আরো অনেক প্রত্যক্ষীভূত করা দরকার । সেখানে ঐতিহ্য পরম্পরার সারাত্সার তুলে আনা খুবই কঠিন । তাছাড়াও যা আগে বলেছি, ব্রাহ্মণত্বের প্রতি মুগ্ধতাবেশ জাগাতে পারে - এমন শিল্পরূপের নির্মাণ আজকের পৃথিবীতে প্রাসঙ্গিকও নয় । অতিথি অত্যন্ত প্রতিভাদীপ্ত একটি সৃষ্টি না হলেও একটি সহজ মনভরানো, সুকান্ত চলচ্চিত্র হয়ে উঠেছে ।
২. "গৌরবর্ণ ছেলেটিকে বড়ো সুন্দর দেখিতে । ... অনাবৃত দেহখানি সর্বপ্রকার বাহুল্যবর্জিত, যেন সে পূর্বজন্মে তাপস-বালক ছিল এবং নির্মল তপস্যার প্রভাবে তাহার শরীর হইতে শরীরাংশ বহুল পরিমাণে ক্ষয় হইয়া একটি সম্মার্জিত ব্রাহ্মণ্যশ্রী পরিস্ফুট হইয়া উঠিয়াছে ।"
৩. "মার্জিত পৈতার গোছা বক্ষে বিলম্বিত ।"
৪. "অন্নপূর্ণা (মতিলালবাবুর স্ত্রী) পরম স্নেহেই এ ব্রাহ্মণ বালককে তাহার ঘরের কথা, তাহার আত্মীয় পরিজনের সংবাদ জিজ্ঞাসা করিতে লাগিলেন..."
৫. "এই সুন্দর ব্রাহ্মণ বালকটির আতিথ্য গ্রহণে ঔদাসীন্য অন্নপূর্ণাকে ঈষৎ পীড়া দিতে লাগিল ।"
৬. "বালকের কাছে সে সম্পূর্ণ স্বাভাবিক বালক অথচ তাহাদের হইতে শ্রেষ্ঠ ও স্বতন্ত্র, বৃদ্ধের কাছে সে বালক নহে অথচ জ্যাঠাও নহে, রাখালের সঙ্গে সে রাখাল অথচ ব্রাহ্মণ ।"
৭. "স্নেহ, প্রেম-বন্ধুত্বের ষড়যন্ত্র বন্ধন তাহাকে চারিদিক হইতে সম্পূর্ণ রূপে ঘিরিবার পূর্বেই সমস্ত গ্রামের হৃদয়খানি চুরি করিয়া একদা বর্ষার মেঘান্ধকার রাত্রে এই ব্রাহ্মণবালক আসক্তিবিহীন উদাসীন জননী বিশ্বপৃথিবীর নিকট চলিয়া গিয়াছে ।"
৮. "তারাপদ এই অনন্তলীলাস্বরবাহী বিশ্বপ্রবাহের একটি আনন্দোজ্জ্বল তরঙ্গ ভূতভবিষ্যতের সহিত তাহার কোন বন্ধন নাই - সম্মুখাভিমুখে চলিয়া যাওয়াই তাহার একমাত্র কার্য ।"
`ক্ষুধিত পাষাণ' গল্পের চলচ্চিত্র-রূপ দেবার কাজে তপন সিংহ রবীন্দ্রনাথের গল্পটির আভিপ্রায়িক দ্বিমাত্রিকতাকে দৃশ্যায়িত করবার সময়ে ঘরের পরিবর্তন ঘটিয়ে দিয়েছিলেন বেশ গুরুত্বপূর্ণভাবে । প্রাচীন ও পরিত্যক্ত প্রাসাদের ঘরের কোণে, অলিন্দে, সরু গলিপথে, ঝরোকায়, সুড়ঙ্গে, কল্প-ঐতিহাসিক পরিবেশের মধ্যে ছড়ানো ছিল যে-রহস্যমায়া তার আবেদনকে রবীন্দ্রনাথ করে তুলেছিলেন সার্বজনিক । অর্থাৎ যে-কোনো লোককেই গ্রাস করতে পারত সেই মায়া । সেজন্যই রবীন্দ্রনাথ `তুলোর মাশুল আদায়কারী'-র অতি সাধারণ পরিচয়টি একাধিকবার উল্লেখ করেছেন গল্পে । গল্পটিতে তাছাড়াও উল্লেখিত হয়েছে এক ইরানি ত্রক্রীতদাসী । তারও একটা কোনো গল্প আছে - অ-কথিত, অনুমানসাপেক্ষ । অনির্দেশ্য রহস্যময়তার এক ব্যঞ্জনা গড়ে তোলাই প্রধান উদ্দেশ্য ছিল রবীন্দ্রনাথের । কিন্তু তপন সিংহের চলচ্চিত্র রূপে সেই ত্রক্রীতদাসীর গল্পটাই পল্লবিত হয়ে প্রধান স্থান জুড়ে বসেছে । তুলোর মাশুল আদায়কারী যুবকটি যেন পূর্বজন্মে সেই ইরানি নারীরই প্রেমিক ছিল - এইভাবে সাজানো হয়েছে গল্পটি । তপন সিংহের ক্ষুধিত পাষাণ নায়ক-নায়িকা কেন্দ্রিক একটি বিশিষ্ট `গল্প' হয়ে উঠেছে - কিছুটা সরে এসেছে মূল রচনার সীমা-মুছে-যাওয়া সার্বজনিকতা থেকে । গল্পের দূরবিস্তারী ব্যঞ্জনাটি কিছুটা গেছে হারিয়ে । তপন সিংহের ক্ষুধিত পাষাণ একটি মনোরম ও দৃষ্টিসুখসঞ্চারী চলচ্চিত্র হলেও রবীন্দ্রনাথের `ক্ষুধিত পাষাণ' গল্পের সূক্ষ্ম শিল্পিতা তাতে কতটা সঞ্চারিত হতে পারেনি ।
৪. চলচ্চিত্র-নির্মাতা কখনো কখনো লেখকের রচনার অভিপ্রায় সম্পূর্ণই বদলে দিতে পারেন এবং সেই অনুযায়ী কাহিনীর পরিবর্তন ঘটাতে পারেন । যেমন তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের সপ্তপদী উপন্যাসের পরিণতি অংশ পুরোপুরি বদলে দিয়ে কৃষ্ণেন্দু আর রিনা ব্রাউন-এর মিলন দেখানো হয়েছে চলচ্চিত্রে । উপন্যাসে আছে দরিদ্র-সেবক ধর্মযাজক কৃষ্ণস্বামী (কৃষ্ণেন্দু) কুষ্ঠ-রোগীর সেবা করতে করতে নিজেও রোগাক্রান্ত হয় আর চলে যায় দূর সমুদ্র-তীরের এক নিরাময় আবাসে । তার আগে উন্মার্গগামিনী কিন্তু অন্তরে অসহায়, একা রিনাকে সুস্থ করে তোলবার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছে সে । কিন্তু পরে রিনার সঙ্গে দেখা হয়েছে তার পূর্ব প্রেমিক জন ক্লেটন-এর । ক্লেটন-এর যত্নে সুস্থ হয়ে উঠেছে সে । যে-সুস্থতার প্রথম বীজটি রোপণ করেছিল কৃষ্ণস্বামী অনেকদিন আগে । জন ও রিনা দেখতে এসেছে কৃষ্ণস্বামীকে । ঈশ্বরের বিধান, মানুষের জীবন আর মানবিক করুণাধারার উপলব্ধিতে শেষ হয়েছে উপন্যাস । উত্তমকুমার প্রযোজিত ও অজয় কর পরিচালিত হওয়া সত্ত্বেও চলচ্চিত্র-রূপের লঘুতায় সাধারণ পাঠক-দর্শকের মন থেকে মূল কাহিনীর গভীরতা যেন হারিয়ে গেছে কিছুটা ।
এমন সম্পূর্ণ বৈপরীত্য, যা মূল কাহিনীর সামগ্রিক অভিপ্রায়কেই ক্ষুণ্ণ করে, সাধারণত দেখা যায় না রবীন্দ্র-রচনার চলচ্চিত্রায়ণের ক্ষেত্রে । তবু কোথাও কোথাও চলচ্চিত্র-নির্মাতা লেখকের কাহিনীগত অভিপ্রায়ের আংশিক পরিবর্তন ঘটাতে পারেন । তাতে দুটি শিল্প-সংরূপের স্বাদের পার্থক্য ঘটে যেতে পারে । সেই পরিবর্তন খুব জরুরি ছিল কিনা - উঠতে পারে এই প্রশ্ন । অশোক রুদ্র `মণিহারা' গল্পটির চলচ্চিত্র-রূপের ক্ষেত্রেও আপত্তি তুলেছিলেন । সেই আপত্তি অংশত বক্তব্যের পরিবর্তনের কারণেই । মূল গল্পে মণিমালিকার অলংকার নিক্কণিত প্রেত-কায়া ফণিভূষণের কাছে আসে ফণিভূষণের ব্যাকুল প্রার্থনার টানেই । তা ফণিভূষণের একাগ্র চিত্তের ভ্রান্তিও হওয়া সম্ভব - এভাবেই লিখেছেন রবীন্দ্রনাথ । কিন্তু সত্যজিৎ রায়ের চলচ্চিত্ররূপে দেখা যায় মণিমালিকার প্রেতাত্মা একটি নতুন গয়নার আকর্ষণে ফণিভূষণের কাছে এসেছে । যে গয়নাটি তাকে দেবে বলেছিল ফণিভূষণ । ফণিভূষণের মনের ভাবটা সত্যজিৎ রায়ের চলচ্চিত্রে প্রেম-সম্মোহ নয়, অনেকটা ভয়-বিহ্বলতা মেশানো আকর্ষণের কাছাকাছি । গহনা-পরা কংকালের হাতের দৃশ্য-চমকটা ও তজ্জনিত ভীতি-শিহরণ সত্যজিৎ রায়েরই কল্পিত, রবীন্দ্রনাথের গল্পে তা সেভাবে ছিল না । অশোক রুদ্রের মতের খুব বেশি বিরোধিতা না করে আমরা বলতে পারি - মণিহারা গল্পের নায়ক এক পত্নীপ্রেমিক, সরলচিত্ত, জমিদার যুবক নায়িকা এক অলংকারপ্রিয়া নারী । মনের মিল তাদের হয়নি, ফণিভূষণের ভালবাসা সত্ত্বেও । বাস্তব বুদ্ধিহীন এবং ঈষৎ অস্বাভাবিক মণিমালিকা তার গহনা নিয়ে ফণিভূষণের কাছ থেকে চলে যেতেই চেয়েছিল । দুর্ঘটনায় তার মৃত্যু হয়েছে । ফণিভূষণের ক্লান্ত, বিপর্যস্ত, বিভ্রান্ত ও রিক্ত-ব্যাকুল চিত্তে, নির্জনে তার স্মৃতি অলৌকিক সত্তার রূপ ধরে ফিরে আসে । এই মূল কাহিনী-কাঠামো অক্ষুণ্ণ আছে সত্যজিৎ রায়ের চলচ্চিত্র-রূপে । সরে আসার অংশ অল্পই । তবু গল্প ও চলচ্চিত্রের অন্তিম রস পরিণাম তথা শৈল্পিক অভিপ্রায় একটু আলাদা হয়ে গেছে সত্যিই ।
তপন সিংহ কাবুলিওয়ালা র চলচ্চিত্র রূপে শেষ অংশে দেখিয়েছেন যে, রহমত্কে দেশে ফিরে যাবার টাকা, কন্যার বিবাহের প্রস্তাবিত ব্যয় থেকে বাঁচিয়ে, দেবার প্রস্তাব মিনির মায়েরই । কিন্তু মূল গল্পে বাড়ির মেয়েদের আপত্তি উপেক্ষা করে মিনির বাবাই সেই টাকা দিয়েছিলেন । এই পরিবর্তনে চলচ্চিত্রটির সার্বিক আবেদন বেড়েছে, অথচ মূল রস ক্ষুণ্ণ হয়নি ।
তুলনায় `সমাপ্তি' গল্পের চলচ্চিত্ররূপের একাংশে সত্যজিৎ আরো গুরুত্বপূর্ণ আভিপ্রয়িক পরিবর্তন ঘটিয়েছেন বলে মনে হয় । মনে হয়, এটা তিনি করেছেন, বেশ ভেবেচিন্তে, সচেতন ইচ্ছায় । প্রথমে বলে নেওয়া যায়, `সমাপ্তি' গল্পের নায়কের নাম `অপূর্ব' কিন্তু তাকে সত্যজিৎ রায় করেছেন `অমূল্য' । এই পরিবর্তনটি ঘটনাচক্রে করতে কিছুটা বাধ্য হয়েছিলেন তিনি । তিন কন্যা মুক্তি পায় ১৯৬১-তে । তার দু'বছর আগে ১৯৫৯ সালে মুক্তি পেয়েছিল অপুর সংসার । সেই ছবিতেও নায়কের নাম অপূর্ব এবং ভূমিকাভিনেতাও সেই একই সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় । প্রথম নায়কের স্মৃতি দ্বিতীয় নায়কের ভূমিকা দর্শনের ক্ষেত্রে দর্শকচিত্তে কিছু বাধা ঘটাতেও পারে - এমন ভেবেছিলেন সত্যজিৎ রায় । অন্তত অপুর সংসার -এর নায়কের নামের কারণেই যে সমাপ্তি -র নায়কের নাম পরিবর্তন করেছিলেন - এ স্বীকৃতি তাঁর নিজেরই ।
কিন্তু এই পরিবর্তন সামান্যই - তাত্পর্যপূর্ণও নয় । আমরা বলছি সমাপ্তি চলচ্চিত্রের শেষ দৃশ্যের কথা । তরুণ নায়ক নবীন কিশোরী পত্নীকে কাছে পেয়েছে অনেক ভুল বোঝাবুঝির পর । তারা যে-মুহূর্তে একান্ত হতে চাইছে, চাইছে দুজনকে ঘিরে এক নির্জনতা - সেই মুহূর্তে মা উঠে আসছেন সিঁড়ি দিয়ে । হাতে তাঁর ঘরে-ফিরে-আসা প্রবাসী পুত্রের জন্য সাজানো জলখাবার । দরজা বন্ধ হয়ে গেল মা দাঁড়িয়ে রইলেন, থালা হাতে, সিঁড়িতে । এরকম হওয়া যে অস্বাভাবিক তা নয়, বরং খুবই স্বাভাবিক । সংসার তৈরি হয় এরকম ছোট ছোট স্বাভাবিক নিষ্ঠুরতা দিয়েই । কিন্তু রবীন্দ্রনাথের গল্পটা ছিল কিছুটা অন্যরকম । সেখানে মৃন্ময়ীকে পিতৃগৃহে রেখে অপূর্ব (সিনেমায় অমূল্য) যখন কলকাতায় চলে গেছে তখন স্বামীর বিরহে বালিকা মৃন্ময়ী একটু একটু করে পরিণত হয়েছে অনুরাগিণী কিশোরীতে । ওদিকে অপূর্বর মা-ও, ছেলে তাঁর ওপর রাগ করে বৌকে বাপের বাড়ি রেখে গেছে বলে দু:খিত ও অনুতপ্ত । এই সময়ে মৃন্ময়ী নিজের ইচ্ছেয় ফিরে এসেছে শ্বশুরবাড়িতে । ম্লানমুখে শাশুড়িকে প্রণাম করে দাঁড়িয়েছে সে । রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন- "শাশুড়ি তত্ক্ষণাৎ তাহাকে বক্ষে চাপিয়া ধরিলেন । মুহূর্তের মধ্যে উভয়ের মিলন হইয়া গেল ।"
তারপর গল্পে দেখা যায় - অপূর্বর মা পুত্রবধূকে নিয়ে চলে এসেছেন কলকাতায় । তাঁরই চেষ্টায়, তাঁরই অপরিমেয় স্নেহে কিশোরী বধূ নির্জন কক্ষে স্বামীর সঙ্গে মিলিত হয়েছে । এভাবে এতটা দেখালে চলচ্চিত্র ভাবাবেগাক্রান্ত হয়ে পড়তে পারে - এমন সম্ভাবনা নিশ্চয়ই ছিল । চলচ্চিত্র-পরিচালক ভিন্ন দৃশ্য উদ্ভাবন করতেই পারতেন, সংহত সাবয়বতায় অনুভবটিকে তুলে আনবার জন্য । সত্যজিৎ রায় এমনভাবেও তো দৃশ্য-বিন্যাস করতে পারতেন যেখানে পুত্র ও পুত্রবধূর মিলন-নীড়ে শাশুড়িকে স্পষ্টতই বিচ্ছিন্ন বা অতিরিক্ত মনে হবে না । তিনিও হবেন তাদেরই সুখের অংশীদার । এমনও কি হয় না কখনো ? রবীন্দ্রনাথ তো তাই দেখিয়েছিলেন । গল্পেরও শেষ অংশ এটা, চলচ্চিত্রটিরও শেষ দৃশ্য । তাই এটা যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ । বিবাহিত পুত্র তার বধূকে নিয়ে যে-জীবন গড়বে - জননী সেখানে সর্বদাই অতিরিক্ত - সংসারের এই প্রত্যাশিত এবং ক্লিশে প্যাটার্নটাই অনুসরণ করলেন সত্যজিৎ । যদি রবীন্দ্র অভিপ্রায়কেই দৃশ্যে অনুবাদ করতেন - খুবই কি ক্ষতি হত ? চলচ্চিত্রের ঐ শেষ দৃশ্য - হাতে থালা, সিঁড়িতে দাঁড়ানো মা-এর সামনে দরজা বন্ধ হয়ে যাওয়া - এখানে রবীন্দ্রনাথের গল্পকে নিশ্চিত লঙ্ঘন করেছেন সত্যজিৎ রায় । তা ভালো হয়েছে কিনা - সে বিতর্ক চলতেই থাকবে ।