• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | Rabindranath Tagore | প্রবন্ধ
    Share
  • শব্দকূটে রবীন্দ্রনাথ : সুমিতা চক্রবর্তী

    "দিল্লি-প্রাসাদকূটে / হোথা বারবার বাদশাজাদার তন্দ্রা যেতেছে ছুটে।" -- খুব চেনা এই কবিতা পঙ্ক্তি। 'বন্দী বীর' কবিতার অংশ। রবীন্দ্রনাথের যে-সব কবিতা বিদ্যালয়ের প্রথম স্তর থেকে বারবার আবৃত্ত হতে থাকে ছাত্রদের কন্ঠে -- তাদেরই একটি। ছোটো ছেলেমেয়েরা হয়তো 'কূট' শব্দের ঠিক অর্থটি ধরতে পারে না পরিষ্কার ভাবে। তবে এটা তারাও বুঝেই নেয় যে, এখানে 'কূট' শব্দের অর্থ 'জটিল', 'দুরূহ' বা 'দুর্বোধ্য' জাতীয় কিছু নয়। বড়োরা অবশ্য জানেন যে 'কূট' শব্দের একাধিক অর্থের একটি হল 'শিখর'। 'পর্বত-শৃঙ্গ' অর্থেই সাধারণত ব্যবহৃত হয় শব্দটি। কিন্তু 'প্রাসাদ-শিখর' -- 'প্রাসাদের উচ্চতম মহল' হিসেবে শব্দটিকে ব্যবহার করতেও কোনো বাধা নেই। যদিও খুব যে বেশি ব্যবহার হয় শব্দটি এই অর্থে -- তা নয়। 'কূট' শব্দের আর এক অর্থ 'কক্ষ', 'ঘর'। এই অর্থটিও এখানে খুবই সরলভাবে লগ্ন। 'শিখর' আর 'কক্ষ' -- দুটি অর্থের সংমিশ্রণে রবীন্দ্রনাথ 'কূট' শব্দটির সুন্দর প্রয়োগ ঘটিয়েছেন এখানে।

    রবীন্দ্রনাথের কবিতায় যে-সব শব্দ আমরা পাই -- তা সাধারণতই দুর্বোধ্য নয়। শিক্ষিত বাঙালি যে-সব শব্দের সঙ্গে পরিচিত -- সেই বলয়ের মধ্যেই থাকে তাঁর রচনার শব্দ-ভাণ্ডার। তবু কখনই যে তিনি দুরূহ, আভিধানিক শব্দ ব্যবহার করেন না -- একথা বলা যায় না।

    কথ্য ভাষা আর লেখ্য ভাষার চরিত্র আলাদা। কথ্য ভাষার তুলনায় লেখ্য ভাষা সর্বদাই একটু বেশি মার্জিত, গম্ভীর, শোভন। শিক্ষিত বাঙালির লেখ্য ভাষায় তত্সম শব্দের প্রয়োগের অনুপাত যথেষ্টই। কথ্য ভাষায় সে-তুলনায় তদ্ভব, দেশি এবং বিদেশি শব্দের মিশ্রণ অনেক বেশি। আধুনিক বাঙালি কবিদের মধ্যে সুধীন্দ্রনাথ দত্ত আর বিষ্ণু দে প্রচুর অপ্রচলিত আভিধানিক শব্দ ব্যবহার করতেন। সুধীন্দ্রনাথের মতো 'মত্সর' (পরশ্রীকাতর), 'প্রমা' (জ্ঞান), 'নিপান' (চৌবাচ্চা), 'মত্কুন' (ছারপোকা), 'সুষির' (ছিদ্র), 'কির্মীর' (বর্ণময়) জাতীয় শব্দাবলি বিশেষ প্রয়োগ করেননি রবীন্দ্রনাথ। বিষ্ণু দে-র মতো 'অলাতচক্র' (প্রজ্বলিত অঙ্গার-চক্র), 'অপস্মার' (ভুলে যাওয়া) 'মাতরিশ্বা' (ব্রহ্মসত্তা-ব্যাপ্ত বায়ু), 'পৈশুন্য' (ক্রূরতা), 'স্তোম' (স্তব) -- এরকম শব্দও রবীন্দ্র- রচনায় খুবই কম।

    আবার গভীর ভাবময় কবিতায় একান্ত কথ্য শব্দ প্রয়োগের প্রবণতাও রবীন্দ্রনাথের তেমন ছিল না জীবনানন্দের মতো। 'হাড়হাভাতে', 'লবেজান', 'খড় নাড়া', 'বেবুন', 'খচ্চর' -- রবীন্দ্রনাথের কবিতায় পাব না।

    রবীন্দ্রনাথের কবিতার শব্দ-প্রয়োগ সম্পর্কে আমাদের যে ধারণা আর প্রত্যাশা তা রবীন্দ্রনাথ নিজেই গড়ে দিয়েছেন 'সন্ধ্যাসঙ্গীত' থেকে 'শেষলেখা' পর্যন্ত তাঁর কবিতা-সংকলনগুলির ভাষায়। প্রধানত তত্সম আর মার্জিত তদ্ভব শব্দের সম্ভারেই রূপ নিয়েছে সেই ভাষা। কবিতার চরিত্র অনুসারে দেশজ ও বিদেশি শব্দও আছে। তবে তাদের সংখ্যা প্রথম গোষ্ঠীর শব্দ-সংখ্যার চেয়ে অনেকই কম। রবীন্দ্রনাথের ব্যবহৃত তত্সম শব্দগুলির অর্থ সাধারণভাবে শিক্ষিত বাঙালির জানাই থাকে। ক্কচিৎ দু একটি শব্দের অর্থ জেনে নিতে হয় অভিধান খুলে। তেমন একটি শব্দের কথা আমরা সবাই জানি। 'ক্রন্দসী' শব্দের অর্থ 'ক্রন্দনরতা নারী' হয় কিন্তু 'উর্বশী' কবিতার -- 'ঐ শুন দিকে দিকে তোমা লাগি কাঁদিছে ত্রক্রন্দসী'-র 'ক্রন্দসী'-র অর্থ যে 'দ্যাবাপৃথিবী' -- আকাশ ও পৃথিবী ব্যাপ্ত সমগ্রতা -- তা-ও আমরা জেনে গেছি অনেকদিন -- প্রধানত তাঁর কবিতা থেকেই। এমন উদাহরণও কিন্তু রবীন্দ্রনাথের কবিতায় কমই।

    তবু আছে। আরও কিছু কিছু শব্দ আছে রবীন্দ্র-রচনায় যে-গুলির অর্থ শোনামাত্রই সর্বদা সকলের বোধগম্য হবে না। রবীন্দ্রনাথের ভাষার গতিশীলতা এত মসৃণ এবং মূল উপলব্ধির অনুভব এত পূর্ণ-উদ্ভাসিত হয় তাঁর ভাষায় যে অনেক সময় বাক্য-অন্তর্গত একটি শব্দের অর্থ-পরিগ্রহণে ঈষৎ সংশয় থাকলেও তা বিশেষ বাধা ঘটায় না। অভিধান খোলবার গবেষক-সুলভ নীরস তাগিদ কবিতা-পাঠকের রসতৃপ্তি প্রবাহে যায় হারিয়ে। সেই শব্দগুলিকে আমরা 'কূট' শব্দ বলব না কারণ কোনো কূটতা -- বা দুরূহতা সঞ্চার করে দেওয়া কবির অভিপ্রেত ছিল না। কিন্তু 'কূট' শব্দের 'ঘর' অর্থটি যদি মনে রাখি আমরা, তাহলে তো সেই সব শব্দকে বলতেই পারি 'শব্দকূট' -- শব্দের এক একটি ঘর। সেই ঘরগুলিতে পা ফেলে ফেলেই কবি এগিয়েছিলেন কবিতার পূর্ণ স্থাপত্য নির্মাণে। যদি চিনে নিতে না চাই প্রতিটি ঘর তাহলে কি কবির সৃষ্টি-প্রাসাদের প্রতি আমাদের অবহেলাই সূচিত হয় না ?

    'বর্ষামঙ্গল' কবিতার বিখ্যাত দুই পঙ্ক্তি -- "ঘনবনতলে এসো ঘননীল বসনা / ললিত নৃত্যে বাজুক স্বর্ণরসনা"। দ্বিতীয় পঙ্ক্তির শেষ শব্দ 'রসনা'-র মানে যে জিহ্বা নয়, এর মানে মেখলা -- কটি আভরণ তা-ও আমরা সম্ভবত আজ রবীন্দ্রনাথের কবিতা থেকেই জানব। আমাদের দৈনন্দিন ব্যবহার থেকে ঐ অলংকার আর শব্দ -- দুটিই অপসারিত হয়ে গেছে। যেমন বিস্মৃতিতে তলিয়ে গেছে 'পত্রলেখা' শব্দটি। 'সাগরিকা' কবিতায় -- "নীরব তব নম্র নতমুখে / আমারই আঁকা পত্রলেখা, আমারই মালা বুকে।" 'পত্রলেখা' শব্দের অর্থ চন্দন-কারুকার্য, চিঠি লেখার সঙ্গে কোনো যোগ নেই তার -- তা স্পষ্ট হয়ে যায় কবিতার অংশটি পড়লেই।

    একটি শব্দ পেয়েছি রবীন্দ্রনাথের কবিতায় -- 'অভিভব'। 'ভব' শব্দের অর্থ 'পৃথিবী', আর এক অর্থ এসেছে 'ভূ' ধাতু থেকে ক্রিয়াপদ হয়ে। যার অর্থ 'থাকা' -- 'স্থিরোভব'। 'বৈভব' শব্দটির অর্থ -- সামর্থ্য, ঐশ্বর্য, মহিমা। এসবের সাদৃশ্যে মনে হয় 'অভিভব' শব্দের অর্থও ঐশ্বর্য বা মহিমা-ব্যঞ্জক কিছু হবে। কিন্তু কবিতায় পড়ি -- "মরণ করি অভিভব / আছেন চির যে-মানব / নিজেরে দেখি সে পথিকের পথে"। মৃত্যুকেই যিনি মহিমা করে নিয়েছেন -- এমন একটা অর্থ ধরে নিতে নিতেও একবার অভিধান খুলে দেখি -- 'অভিভব' শব্দের অর্থ 'পরাজয়'। তখন পূর্ব-পঠিত একটি উপন্যাসের ছত্রের অর্থও সুপরিস্ফুট হয়। 'দুইবোন' উপন্যাসে আছে -- "কোনো কারণে যেদিন বিশেষ দেরি করে সেদিন ঊর্মির অভিমান দুর্ভেদ্য মৌনের অন্তরালে দুরভিভব হয়ে ওঠে।" 'দুরভিভব'-- যাকে পরাভূত করা কঠিন -- এই অর্থেই লিখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ।

    অত্যন্ত অপ্রচলিত, কেবলই অভিধানে থাকে এমন শব্দ প্রয়োগের প্রবণতা রবীন্দ্রনাথের ছিল না সত্যিই। কিন্তু কবিতার ভাববস্তু-সম্মত বক্তব্য প্রকাশ, যথাযথ চিত্রকল্প নির্মাণ, ছন্দ-রক্ষা -- ইত্যাদি কারণের যোগফলে যখন তেমন কোনো শব্দ কলমের মুখে এসেই গেছে তখন রবীন্দ্রনাথ যাথার্থ্যগুণ বিবেচনা করে শব্দটিকে রেখেই দিয়েছেন। পাঠকের অসুবিধে হতে পারে মনে করে বর্জন করেননি সেটিকে। তেমন একটি উদাহরণ দেখি -- "যে মন টলে, যে মন চলে, যাহারে ধরে রাখা দায়, / মেধাবী তারে করেন সিধা ইষুকারের তীরের প্রায়।" 'ইষু' শব্দের অর্থ ধনুকের তীর। 'তীর-প্রস্তুতকারী' -- এই হল 'ইষুকার' শব্দের অর্থ। খুবই আভিধানিক। মনে পড়ে না যে বাংলা কবিতায় এই শব্দটি আর কোথাও পাওয়া গেছে। মধুসূদনের 'মেঘনাদবধ কাব্য' - তে অবশ্য 'ইষু' শব্দের প্রয়োগ আছে।

    অনেক ফুলের নাম আছে রবীন্দ্রনাথের কবিতায়। তার কোনো কোনোটি আমরা হয়তো চোখেও দেখিনি। যেমন 'জাতি' -- "তুলিনু যূথী, তুলিনু জাতি, তুলিনু চাঁপাফুল" (সাগরিকা)। মল্লিকা, মালতী আর মাধবী বা মাধবিকা -- এই নামগুলি আমাদের যত চেনা -- সবসময়ে ফুলগুলি ততটা নয়। তবু শব্দগুলির মধ্যে দুরূহতা নেই কোনো। কিন্তু "চাহিয়া বঞ্জুলবনে কী জানি পড়িবে মনে / বসি কুঞ্জে তৃণাসনে শ্যামল কূলে !" -- এই পঙ্ক্তি-র বঞ্জুল-বনের পরিচয় জানতে আমাদের অভিধান খুলতে হয়। খুলে দেখি -- 'বঞ্জুল' হল অশোক ফুলের আর এক নাম। 'প্রজাপতির নির্বন্ধ' নাটিকাটিতে আছে একটি মধুর-সরস গান। সেই গানের একটি কলি -- "রুদ্ধ-কোরক-সঞ্চিত-মধু কঠিন কনক-কঞ্জিনী"। হঠাৎ শুনে মনে হতে পারে রুদ্ধ ঘরের সোনার চাবিই বুঝি 'কনক-কঞ্জিনী'। কিন্তু সংশয় জাগতে পারে 'কোরক' আর 'মধু' শব্দের সংলগ্নতায়। তারপর অভিধান বলে দেয় -- 'কঞ্জ' শব্দের অর্থ 'পদ্ম' আর 'কঞ্জিনী' তারই স্ত্রীলিঙ্গ।

    রবীন্দ্রনাথ নিবিড়ভাবে সংস্কৃত সাহিত্য পাঠ করেছিলেন। যে-সব শব্দ সংস্কৃত ভাষায় বহুল ব্যবহৃত তার কোনো কোনোটি বাংলা ভাষায় খুব স্বচ্ছন্দে চলেনি। যদিও একেবারে অপ্রচলিতও নয়। যেমন 'ছন্ন'। এই শব্দটি বাংলায় সাধারণত 'ছন্দ' শব্দের অপভ্রংশ রূপেই পরিচিত। যার খুব চেনা প্রয়োগ হল ছন্ন-ছাড়া। কিন্তু 'ছন্ন' শব্দের আর একটি অর্থ আচ্ছাদিত। 'ছায়াচ্ছন্ন', 'ধূলিচ্ছন্ন' প্রভৃতি সন্ধিকৃত শব্দে আমরা প্রয়োগটি পাই। রবীন্দ্রনাথ স্বতন্ত্র ভাবেও 'ছন্ন' শব্দের প্রয়োগ ঘটিয়েছেন অন্তত একবার -- "মগ্ন তোমার স্নিগ্ধ নয়ন দুটি / ছায়ায় ছন্ন অরণ্য-অঙ্গনে"।

    আরও বেশ কিছু অদ্ভুত ধরনের অপ্রচলিত তত্সম শব্দের প্রয়োগ আছে রবীন্দ্রনাথের কবিতায় ও গদ্যে। যেমন 'সৃপ্ত' কিংবা 'সাধ্বস'। প্রথমটি প্রযুক্ত হয়েছে কবিতায় -- "সৃপ্ত হয়ে পড়ে গেছে ধূসর সে কুন্ঠিত গোধূলি," -- অর্থ --'স্খলিত'। 'সাধ্বস' শব্দের অর্থ 'ভয়' বা 'ত্রাস'। 'ত্রস্ত-সংকুচিত' অর্থে শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে 'নষ্টনীড়' গল্পে -- "খাতাখানা চারুর হাতে দিয়া সাধ্বসে ভূপতি বাহিরে চলিয়া গেল।"

    'ভঙ্গ' শব্দের একাধিক অর্থ আছে। 'ভাঙা' অর্থ ছাড়াও 'বাধা দেওয়া' বা 'নিবৃত্ত হওয়া' (যেমন রণে ভঙ্গ দেওয়া) অর্থগুলির সঙ্গে আমরা পরিচিত। 'ভঙ্গ' শব্দের আরো একটি অর্থ 'চাতুর্য'। তার থেকেই এসেছে কুশলতা-জাতীয় অর্থ। 'শুভক্ষণ' (খেয়া) কবিতায় "পরিব অঙ্গে কেমন ভঙ্গে / কোন বরনের বাস।" -- প্রয়োগবিধির গুণে এখানে 'ভঙ্গ' শব্দের অর্থ দাঁড়িয়েছে 'স্টাইল'। 'ভঙ্গ' শব্দের আরো একটি অর্থ 'ঢেউ' -- 'তরঙ্গ-ভঙ্গ' শব্দ-বন্ধে থেকে গেছে এই অর্থটি। একবার রবীন্দ্রনাথ শব্দটিকে গ্রহণ করেছেন এই অর্থ -- 'পরিশেষ' গ্রন্থের একটি কবিতায় -- "আছি যেথা / সমুদ্রের / তরঙ্গে ভঙ্গিয়া উঠে উন্মত্ত রুদ্রের / অট্টহাস্যে নাট্যলীলা।"

    'ধ্বনিত' বা 'শব্দময়' অর্থে দুটি অচেনা শব্দ ব্যবহার করতে দেখেছি রবীন্দ্রনাথকে। একটি হল 'স্তনিত' -- "সমুদ্রস্তনিত পৃথ্বী, হে বিরাট, তোমারে ভরিতে / নাহি পারে,"। অপরটি হল 'ধমাত' -- "পথের কল্লোলে / নিয়ত ধ্বনিত ধমাত কর্ম-কলরোলে।"

    মঙ্গলবাদী কবি ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। মঙ্গলবাচক একাধিক শব্দ তাঁকে প্রয়োগ করতে দেখেছি। মঙ্গল অর্থে 'ক্ষেম' শব্দটি ভালবাসতেন তিনি। কিন্তু 'ময়স্কর' শব্দটির প্রয়োগ আছে একবারই 'শুভঙ্কর' অর্থে। কবিতায় নয়, অধ্যাত্ম-দর্শন-নিষিক্ত উপলব্ধির উচ্চারণে 'ধর্ম' নামের সংকলনটিতে -- "হে ভয়ংকর, হে প্রলয়ংকর, হে শংকর, হে ময়স্কর, হে পিতা, হে বন্ধু ..."।

    তত্সম শব্দের একটি কুশল প্রয়োগের কথা মনে পড়ছে। 'তুন্দ' শব্দের অর্থ পেট -- 'উদর'। স্ফীত-উদর অর্থে গণেশ ঠাকুরকে 'তুন্দিল' বলেছেন রবীন্দ্রনাথ। 'তুন্দিল' বিশেষণটি তৈরি করে নিয়েছেন নিজেই। 'সে' বইটিতে আছে তাঁর গণেশ বর্ণনা -- "তুন্দিলতনু গজানন"।

    ভাষাতত্ত্বের বই থেকে শিখেছিলাম আমাদের মুখের কথার 'হাতে নাতে চোর ধরা' আসলে হবে 'হাতে নোতে' কারণ 'নোত' শব্দটি তত্সম 'লোপ্ত্র' শব্দ-জাত -- যার অর্থ 'চোরাই দ্রব্য'। রবীন্দ্রনাথ একবার 'লোপ্ত্র' শব্দটি প্রয়োগ করেছেন প্রবন্ধে -- "সেই প্রবল জাতির নিকট পুন: পুন: আন্দোলন করিলেই লোপ্ত্রদ্রব্য ফিরিয়া পাওয়া যায়।"

    আর একটি অল্প-পরিচিত তত্সম শব্দ হল 'কুথা'। শব্দটির আক্ষরিক অর্থ হস্তী পৃষ্ঠের আস্তরণ। কিন্তু সংস্কৃত সাহিত্যেই কম্বল-জাতীয়, পেতে বসবার বা শোবার বস্ত্র রূপে শব্দটির প্রয়োগ দেখি। 'প্রাচীন সাহিত্য' গ্রন্থে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন -- " ... ক্ষিতিতলবিন্যস্ত কুথার উপর সখী পত্রলেখা সুষুপ্ত থাকে।"

    'অট্ট' শব্দটির একাধিক অর্থ আছে সংস্কৃত ভাষায়। প্রাসাদ, অন্ন বা খাদ্য এবং প্রবল উচ্চরব -- এই সবই বোঝায় 'অট্ট' শব্দে। 'প্রাসাদ' অর্থে 'অট্ট' শব্দের একটি প্রয়োগের সঙ্গে আমরা পরিচিত। তা হল 'অট্টালিকা'। 'খাদ্য' অর্থে 'অট্ট' শব্দ বাংলা ভাষায় প্রযুক্ত হয়েছে বলে মনে হয় না। 'উচ্চরব' অর্থটি ব্যবহৃত হয় 'অট্টহাস্য' শব্দে। কিন্তু তার বাইরে 'অট্ট' শব্দটির স্বতন্ত্র প্রয়োগ বাংলা ভাষায় তেমন দেখা যায় না। রবীন্দ্রনাথ কিন্তু পছন্দ করতেন শব্দটি। 'হাস্য' ছাড়াও অন্য শব্দের আগে 'অট্ট' শব্দটির প্রয়োগ ঘটিয়েছেন প্রায়ই। 'ঝুলন' কবিতায় লিখেছেন "যেন এ লক্ষ যক্ষশিশুর অট্টরোল।" 'প্রবল উচ্চ ধ্বনি' এই অর্থে চমত্কার প্রয়োগ আছে 'পুরস্কার' কবিতায় -- "কালি যে ভারত সারাদিন ধরি / অট্টগরজে অম্বর ভরি / রাজার রক্তে খেলেছিল হোরি / ছাড়ি কুলভয়-লাজে।" 'উচ্চধ্বনি' -- এই অর্থের অনুষঙ্গ বজায় রেখে 'ধ্বনি' অংশটি বাদ দিয়ে 'অট্ট' শব্দে কেবলই 'প্রবল' অর্থ ব্যঞ্জিত করে বিশিষ্ট একটি প্রয়োগ ঘটিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ 'পৃথিবী' কবিতায় -- "ডান হাতে পূর্ণ কর সুধা / বাম হাতে চূর্ণ কর পাত্র, / তোমার লীলাক্ষেত্র মুখরিত কর অট্টবিদ্রূপে"

    রবীন্দ্রনাথ দুটি একই জাতীয় স্ত্রীলিঙ্গ শব্দ নির্মাণ করেছিলেন তাঁর কৌতুক-পরিহাস-উজ্জ্বল মনের শৈল্পিকতায়। 'মংপু-বাসিনী' অর্থে মৈত্রেয়ী দেবীকে তিনি 'মাংপবী' সম্বোধন করতেন -- একথা আমরা জানি। শব্দটির গঠন সংস্কৃত ব্যাকরণ-সম্মত। যেমন মনু দনু-র সন্তান মানব ও দানব, তেমনই মংপু-র সন্তান মাংপব -- স্ত্রীলিঙ্গে 'মাংপবী'। অনুষঙ্গ-বর্জিত অবস্থায় শব্দটির অর্থগ্রহণ যে অসম্ভব তা বোধহয় মানতেই হবে আমাদের। আর একটি শব্দ হল 'মাশব' -- 'মশা-র সন্তান' অর্থে। 'খোকাবাবুর প্রত্যাবর্তন' গল্পের অনুকূল-পুত্র 'আনুকৌলা'-ও স্মরণীয়। 'প্রহাসিনী'-র এক জায়গায় আছে "মধুর মাশবী বেণু নীরব সহসা।"

    তত্সম শব্দের ক্ষেত্রেই রবীন্দ্রনাথের শব্দ-চয়ন-প্রতিভা যথার্থভাবে বিকশিত হয়েছে। প্রচলিত তদ্ভব এবং দেশজ শব্দের বহুল প্রয়োগও আছে তাঁর রচনায়। তবে সেগুলিকে বলব না কূট শব্দ। প্রচলিত অর্থেই প্রয়োগ সেগুলির। মানে বোঝবার জন্য ভাবতে হয় না বিশেষ। কিন্তু মাঝে মাঝে এক একটি চলিত শব্দের ব্যতিক্রমী প্রয়োগ করেন রবীন্দ্রনাথ যার ফলে আমাদের এক মুহূর্ত অন্তত থেমে পঙ্ক্তির অর্থটি ঠিকমতো সাজিয়ে নিতে হয়। 'ঘট' শব্দের অর্থ 'কলস'। এই শব্দটি তত্সম -- "ঘাট ছেড়ে ঘট কোথা ভেসে যায়" (নববর্ষা)। কিন্তু 'মস্তিষ্ক' বা 'বুদ্ধি' অর্থে 'ঘট' শব্দের একটি দেশজ নিদর্শনও আছে। রবীন্দ্রনাথ অন্তত দুবার দেশজ অর্থে 'ঘট' শব্দের প্রয়োগ করেছেন খুব পরিচিত দুটি কবিতায়। 'মস্তিষ্ক' থেকে মাথা ধরে নিয়ে তিনি 'ঘট' শব্দের অর্থ করেছেন 'কপাল' তথা 'ভাগ্য'। 'দুই বিঘা জমি' কবিতার উপেন তারই জমি জবর দখলকারী জমিদারের কাছ থেকে চোর অপবাদ শুনে ভাগ্য-বিড়ম্বনার গভীর নৈরাশ্য-জনিত নিরুপায় আত্ম-কৌতুকে ভেবেছিল -- "আমি শুনে হাসি, আঁখিজলে ভাসি, এই ছিল মোর ঘটে --"। 'ঘট' অর্থে ক্কচিৎ দেহাধার অর্থাৎ শরীরও বোঝায় চলিত প্রয়োগে। রবীন্দ্রনাথ আর একটি কবিতায় 'ঘট'-কে করেছেন 'হৃদয়' বা 'চিত্ত'। লিখেছেন 'নিষ্কৃতি' কবিতায় "স্নেহ মায়া কিছু কি নেই ঘটে।"

    'ভরা' শব্দের অর্থ 'পূর্ণ' বা 'পূর্ণ করা'। তার থেকেই দেশজ প্রয়োগে 'বোঝাই নৌকা' অর্থে 'ভরা' শব্দটিকে দেখতে পাই। 'ভরা-ডুবি'- এর অর্থ হল বোঝাই নৌকা ডুবে যাওয়া। রবীন্দ্রনাথের গানে ও কবিতায় নৌকা-চিত্রকল্পের বহুলতা আমরা দেখেছি। গীতবিতানের দুটি গানে 'নৌকা' অর্থে 'ভরা' শব্দের প্রয়োগ আছে। -- "ভরিল ভরা অরূপ ফুলে / সাজালো ডালা অমরাকূলে / আলোর মালা চামেলী বরণী / শুক্ল রাতে চাঁদের তরণী।" আর একটি পঙ্ক্তি হল -- "দেয়নি ধরা, হাসির ভরা দীর্ঘশ্বাসে যায় ভেসে।"

    একটি বিদেশি ফারসি শব্দের উল্লেখ করি। শব্দটি হল 'সেহা' -- অর্থ হিসেবের খাতা যা জমিদারের সেরেস্তায় ব্যবহৃত হত। 'সেহা' থেকেই এসেছে 'সেহানবিশ' বা 'সেহানবীশ' পদবি। রবীন্দ্রনাথ জমিদারও ছিলেন। 'সেহা'-র সঙ্গে ঘনিষ্ঠ পরিচয় ছিল। 'জীবনস্মৃতি'-তে লিখেছেন "কবিযশের পাকা সেহায় সেগুলি জমা হইতেছে ..."

    শব্দের প্রয়োগ দুরূহ হয়ে ওঠার একটা বড় কারণ এক একটি শব্দের একাধিক অর্থ থাকা। সাধারণত একটি অর্থ হয়ে ওঠে প্রধান। সেই অর্থেই আমরা অভ্যস্ত হয়ে যাই। অপর কোনো অর্থের মুখোমুখি হলে সহসা আমাদের আভ্যাসিক মনোগতি একটু বিচলিত হয়ে পড়ে। যেমন 'সন্দেশ' শব্দের মূল অর্থ সংবাদ হলেও এখন আনুষঙ্গিক মিষ্টান্ন অর্থটিই বাংলায় প্রচলিত। আজ সংবাদপত্রকে হঠাৎ 'সন্দেশপত্র' বললে এক মুহূর্ত থমকে যেতে হবে আমাদের। তেমনি একাধিক অর্থবাচক কোনো কোনো শব্দ ভিন্ন ভিন্ন অর্থে প্রযুক্ত হয়েছে রবীন্দ্র রচনায়। সবগুলিকেই খুব অচেনা বলা যায় না। তবু চেনা অর্থেরও বিভিন্ন স্তর সম্পর্কে সচেতন থাকতে হয় আমাদের। যেমন ধরা যাক 'পিনাক' শব্দটি। 'পিনাক'- এর অর্থ শিবের ধনুক, আবার শিবের বিষাণও। সেই সঙ্গে 'পিনাক' শব্দের আরও একটি অর্থ তার-বাদ্য। যে-কোনো তারের বাজনা নয়। শিব যখন প্রলয়ঙ্কর দেবতা তখন যে পিনাকে তিনি গুণ যোজনা করেন শর নিক্ষেপের জন্য অন্য সময়ে সেই পিনাকেই ভিন্ন তন্ত্রী যোজনা করে ঝংকার তোলেন সুরের। কল্পনাটি সূক্ষ্ম ও মনোহারী। সংঘর্ষ-কালে যা যুদ্ধের অস্ত্র, শান্তির সময়ে তা-ই প্রসন্ন মধুরতায় বেজে ওঠে। 'পিনাক' শব্দটি রবীন্দ্রনাথ 'ধনুক' আর 'বিষাণ' -- দুটি অর্থেই প্রয়োগ করেছেন। "প্রলয়পিনাক তুলি / করে ধরিলেন শূলী / পদতলে জগৎ চাপিয়া," (সৃষ্টি স্থিতি প্রলয়, প্রভাতসংগীত) -- এখানে ধনুক না বিষাণ খুব নিশ্চিত করে বলা যায় না। তবে শিবের যে দেহভঙ্গিটি কবিতার পঙ্ক্তিতে ফুটে উঠেছে তাতে মনে হয় ধনুকে তীরযোজনা করা বীরের মূর্তিই দেখতে পাই। 'শান্তিনিকেতন' গ্রন্থের এক জায়গায় রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন -- "মহেশ্বর যখন তাঁর পিনাকে রুদ্র নিশ্বাস ভরেছেন তখন মাকে কেঁদে বলতে হয়েছে 'যাও'।" এখানে নিশ্বাস ভরার উল্লেখে স্পষ্টতই 'পিনাক' মানে বিষাণ বা শিঙা। আবার গানে যখন কবি গেয়ে ওঠেন -- 'পিনাকেতে লাগে টঙ্কার' তখন স্পষ্টতই এই পিনাক বিষাণ নয় ধনুক অথবা তার বাদ্যযন্ত্র দুইই হতে পারে, টঙ্কার দেওয়া যায় দুটির ক্ষেত্রেই। তবে গানটির ভাষায় শান্তিকালের সুর নয়, প্রলয়কালের কলরোলই ধ্বনিত হয়। তাই 'পিনাক' অর্থে এখানে 'শিব-ধনু' অর্থ ধরে নেওয়াই সঙ্গত। শিবের সুর-যন্ত্র অর্থে রবীন্দ্রনাথ বোধহয় শব্দটি প্রয়োগ করেননি।

    সূক্ষ্মতর অর্থ-প্রচ্ছায়-ভেদ সূচক আরো একটি শব্দ আছে 'বেদন' বা 'বেদনা'। বাংলা ভাষায় 'দু:খ', 'মনের কষ্ট', 'হৃদয়-ব্যথা' ইত্যাদির অর্থ বোঝাবার জন্যই 'বেদনা' শব্দটির প্রয়োগ ঘটে। এই অর্থে রবীন্দ্রনাথ শব্দটি ব্যবহার করেছেন অজস্রবার। উদাহরণ নিষ্প্রয়োজন। কিন্তু 'বেদন' শব্দের আরো একটি অর্থ হল 'অনুভূতি'। বিশেষভাবে দু:খের অনুভূতি নয়। প্রগাঢ় সুখের, আনন্দের, রসের এবং কখনো কখনো ইন্দ্রিয়বেদী অনুভূতিকেও বলা হয়েছে 'বেদনা' বা 'বেদন'। এই অর্থেও রবীন্দ্রনাথ শব্দটিকে খুব কম প্রয়োগ করেননি কিন্তু আমরা সব সময়ে তা লক্ষ করি না। 'বিশ্বপরিচয়' গ্রন্থে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন 'অতিপেলববেদনাশীল জীবকোষগুলি'। এখানে ইন্দ্রিয়-গ্রাহ্য অনুভূতিই 'বেদনা' শব্দে বোঝাতে চেয়েছেন তিনি। সুপরিচিত একটি গানে পাই - "ফুলগন্ধ নিবেদন / বেদন সুন্দর মালতী তব চরণে প্রণতা।" এখানেও ঐ একই ইন্দ্রিয়বাহী সুখানুভবের নাম 'বেদন' -- দু:খানুভব নয়।

    রবীন্দ্রনাথের ব্যবহৃত একটি শব্দ নিয়ে আছে রীতিমতো তর্ক। 'দু:সময়' কবিতার সেই পঙ্ক্তি -- "এ নহে মুখর বনমর্মর গুঞ্জিত / এ যে অজাগর গরজে সাগর ফুলিছে।" 'অজাগর' -- কী এর মানে ? 'নিদ্রিত' অর্থাৎ 'জাগর নয় যা' এমন অর্থ হতে পারে। কিন্তু তাতে সমুদ্রের নিরন্তর গর্জনের ছবিটি ঠিকমতো ফুটে ওঠে কি না সন্দেহ। তবু কিন্তু 'অজাগর' অর্থে 'জাগ্রত নয়' এই অর্থই করেছেন কেতকী কুশারী ডাইসন। তিনি পঙ্ক্তিটির অনুবাদ করেছেন --

    "but the sea swelling with a slumber-snoring thunder" (I Won't Let You Go, New Delhi, U. B. S. Publishers, 1992, p. 118) তাঁর অনেকদিন আগে বুদ্ধদেব বসুও এই অর্থই করেছিলেন-- "It's not melodious woodlands but the leaps and falls / of an ocean's drowsy booming" (কবিতা, শততম সংখ্যা, জানুয়ারি, ১৯৬০)। রবীন্দ্রনাথ নিজে এই কবিতার অনুবাদ করেছিলেন -- 'দ্য গার্ডনার' সংকলনে সন্নিবিষ্ট আছে সেটি। তিনি 'অজাগর'- কে 'অজগর' তথা সর্প বলেই গ্রহণ করেছিলেন দেখতে পাই -- " ... that is the Sea swelling like a dark black Snake" | তর্ক শেষ হয়ে যেতে পারত এখানেই। হয় না যে, তার কারণ সত্যিই 'অজাগর' শব্দের পূর্বোক্ত দুটি অর্থই হতে পারে। এমনকি 'অজাগর'-এর আছে আরো একটি অর্থ। সংস্কৃত কলেজ থেকে প্রকাশিত ত্রিভাষিক অভিধানে 'অজাগর' শব্দের অর্থ পাই -- "Sleep removing drug" --'নিদ্রাহারক ওষধি'। 'অ' উপসর্গে সর্বদাই নঞর্থকতা বোঝায় না। মাঝে মাঝে 'অতিশয়িত' অর্থও বোঝায়। যেমন 'অপর্যাপ্ত' -- পর্যাপ্তের অধিক কিংবা 'অমূল্য' -- 'অমিত মূল্য'। 'অজাগর'-ও 'অতিশয় জাগ্রত' অর্থ বোঝাতে পারে বই কি ! বিশেষত 'নিদ্রাহারক' অর্থটিও যখন রয়েছেই। রবীন্দ্রনাথ কেন তাহলে 'Snake' লিখলেন ? বোধহয় সমগ্র অর্থটি পূর্ণ ব্যঞ্জনাসহ অনুবাদ করার সমস্যার কারণেই।

    সবশেষে একটি গানের প্রসঙ্গে আসি। বর্ষার একটি গানে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন 'বৃষ্টি নেশা ভরা সন্ধ্যাবেলা / কোন্‌ বলরামের আমি চেলা --"। বাউল বিশেষজ্ঞ সুধীর চক্রবর্তী মশাই অনুমান করেছেন এই বলরাম হতে পারেন বলরাম হাড়ি -- যিনি পিছিয়ে থাকা বর্গের ও তথাকথিত অন্ত্যজ বর্ণের মানুষের ধর্মগুরু হয়ে উঠেছিলেন সাধনা, বুদ্ধি ও ব্যক্তিত্বের জোরে। কিন্তু বোধহয় সেরকম নয়। এখানে পুরাণের বলরামকেই স্মরণ করেছেন কবি। 'কোন্‌ বলরামের' -- এই অভিব্যক্তির 'কোন্‌' অব্যয়টি তাত্পর্যময়। পুরাণে বলরামের দুটি রূপ। এক রূপে তিনি হলধারী অন্য রূপে আসবমত্ত। বৃষ্টিসিক্ত সন্ধ্যায় কবি ভাবেন কোন্‌ বলরামকে অনুসরণ করবেন তিনি। নববর্ষায় উল্লসিত কৃষকের মতো মহাকৃষক বলরামকে, অথবা কাব্যসৃষ্টির ও কবিকল্পনার নেশায় কাজ ভুলে যাওয়ার ক্ষণে আসব-আবিষ্ট বলরামকে। উত্তরও দিয়ে দেন কবি পরের পঙ্ক্তিতেই -- "আমার স্বপ্ন ঘিরে নাচে মাতাল জুটে।" চমত্কার প্রয়োগ এই বলরাম শব্দটির। ধর্মগুরু বলরাম হাড়ি-র সঙ্গে গানটির কোনো সংসক্তি লক্ষ করা যাচ্ছে না।

    রবীন্দ্রনাথ কবিতার ভাষায় স্বচ্ছন্দ গতিময় মসৃণতাই পছন্দ করতেন। দুরূহ, আভিধানিক, অপ্রচলিত শব্দের প্রতি আলাদা করে কোনো ঝোঁক ছিল না তাঁর। কিন্তু তিনি যে-সময়ের কবি ছিলেন সেই সময়ের বাংলা সাহিত্য ভাষায় অনেক শব্দই ব্যবহার করা যেত -- শিক্ষিত বাঙালির কাছে যেগুলি অপরিচিত ছিল না। আজকের বাঙালি পাঠকের কাছে ত্রক্রমেই সে-সব শব্দ দূরবর্তী হয়ে যাচ্ছে। রবীন্দ্রনাথের ব্যবহৃত শব্দাবলির একটি স্বতন্ত্র অভিধান প্রণয়ন করে রাখা এখনই বোধহয় প্রয়োজন।


    (শব্দকূটে রবীন্দ্রনাথ - আগামী তিন মাসের মধ্যে প্রকাশিতব্য আমার রবীন্দ্রনাথ গ্রহণে বর্জনে গ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত। প্রকাশক 'রত্নাবলী'।)

    পরবাস, ২৫-শে বৈশাখ, ২০০৭

  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments