হার্বাট স্পেনসার ছিলেন রবীন্দ্রনাথের থেকে একচল্লিশ বছরের বড়ো (জ. ২৭শে এপ্রিল ১৮২০)। রবীন্দ্রনাথের মতোই তাঁরও পারিবারিক পরিমণ্ডলে ছিল প্রচলিত ধর্মবিরোধিতা। স্থিত সমাজব্যবস্থার সমালোচনা, বিদ্রোহ। স্পেনসারের শিক্ষক-পিতা সুশৃঙ্খল প্রচল ধর্মব্যবস্থার থেকে, রাজনীতি ও সামাজিক কর্তৃত্ববিধান থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়েছিলেন। অনেকটাই দেবেন্দ্রনাথের মতো। স্পেনসারের বাবা ও কাকা তাঁর জন্য এমন এক শিক্ষাচর্চা চেয়েছিলেন যা পারিবারিক প্রতিবাদী মানসিকতা ও চিন্তনের স্বাধীনতার উপযোগী হবে। তাঁকে বিশেষ করে প্রকৃতি অধ্যয়ন এবং বিজ্ঞানের মৌল বিষয়ে আগ্রহী করে তোলার দিকে নজর দেওয়া হয়েছিল। এদিক দিয়ে রবীন্দ্র-ঐক্য শুধু ‘জীবনস্মৃতি’র পাতা উল্টে গেলেই চোখে পড়ে। স্পেনসারের বিজ্ঞানবীক্ষা ইঞ্জিনিয়ারিং শিক্ষায় তাঁকে ব্রতী করে। ১৮৪১ সাল পর্যন্ত বেশ কিছু বছর তিনি লন্ডন ও বার্মিংহ্যাম রেলওয়ের ইঞ্জিনিয়ার হিসাবে কাজ করেন। স্পেনসার ইঞ্জিনিয়ারিং বিদ্যাচর্চাসূত্রেই জীববিদ্যায় যেমন আগ্রহী হন তেমনি রেলপথের জোড় অংশে জমা জীবাশ্ম পরীক্ষা করতে গিয়েই বিবর্তন বিষয়ে আগ্রহী হয়ে ওঠেন।
রেলের পূর্তদপ্তর ছেড়ে সাহিত্য ও বিজ্ঞানচর্চায় মনোনিবেশ করলেন তিনি পঞ্চাশের দশকের কিছু আগেই। The Non-Conformist নামক পত্রিকায় The proper sphere of Government এই শিরোনামে কিছু পত্রপ্রবন্ধ লিখতে শুরু করেন। এই হল তাঁর প্রথম উল্লেখ্য রচনাগুচ্ছ, যাতে তাঁর ব্যক্তিত্ববাদের, অবাধ বাণিজ্যনীতির ধারণা প্রকাশ পায়, যা পরে বিকশিত হয়েছে Social Statics (১৮৫০) বইয়ের প্রবন্ধগুলিতে। ব্যক্তির অধিকার, রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপহীনতা প্রভৃতি বিষয়ে তাঁর মত পাওয়া যাবে এইসব প্রবন্ধে। এইসময়ই Economist নামের একটি পত্রিকার তিনি সহসম্পাদকও হন।
লেসলি পল বলেন — উনিশ শতকের শিক্ষিত মানুষের প্রাসঙ্গিক দর্শন রচয়িতা হিসেবে তাঁর অবদান অসামান্য। তাঁর কালের বিজ্ঞানের অগ্রগতিকে আত্মস্থ করে স্পেনসার অনিবার্য অগ্রগতির দর্শন গড়ে তোলেন যাতে আছে মানব মর্যাদা ও স্বাধীনতার প্রতি বিশ্বাস। (এ নিয়ে বিরোধী মতও আছে।) তবে তাঁর সিদ্ধান্তগুলির ভিত্তিগুলি নির্ভরযোগ্য ছিল না বলে মর্যাদা হারায়। তবু বলা চলে উনিশ-শতকী প্রগতি ও অধোগতি ধারণার উৎকৃষ্ট ও নিকৃষ্ট ধরনের যোগ্য প্রতিনিধি অবশ্যই তিনি।
১৮৫৭-তে প্রকাশিত Progress : Its law and cause প্রবন্ধে তিনি মানবসমাজ, প্রাণীসমাজ এবং প্রকৃতিজগতে বিবর্তনের অগ্রগতি নিয়ে আলোচনা করলেন। প্রকৃতির ধর্মই হল সরল থেকে জটিলে যাত্রা। এই মৌল নিয়ম যেমন মানব সমাজে তেমনি পৃথিবীর ভূতাত্ত্বিক বিবর্তনে, উদ্ভিদ ও প্রাণীজগতের উৎস ও অগ্রগতি সন্ধানেও লক্ষণীয়। ডারউইন তাঁর Origin of Species (১৮৫৯) গ্রন্থে যে স্বাভাবিক নির্বাচনের কথা বলেছিলেন তা হল স্পেনসারীয় বিবর্তনচিন্তার পূর্ণতাকামী রূপ। স্পেনসার উৎসাহের সঙ্গে ডারউইনীয় স্বাভাবিক নির্বাচনের নীতি মানবসমাজের আলোচনায় প্রয়োগ করে Survival of the fittest ধারণায় উপনীত হন। শুরু থেকেই স্পেনসার মানবসমাজ, জাতি-সম্প্রদায় এবং রাষ্ট্র সম্পর্কে কঠোর ফতোয়া পন্থী — ‘যদি তারা বেঁচে থাকার জন্য যথেষ্ট মাত্রায় সজ্জিত তাহলে তারা বাঁচবে, তাদের বাঁচা উচিত, কিন্তু যদি তারা যথেষ্ট মাত্রায় সজ্জিত না হয় তাহলে তাদের বিনাশ ঘটবে, তাদের বিনাশ ঘটাই ভালো।’ বিবর্তনের দৃষ্টিকোণ থেকে স্পেনসার শিক্ষা, মনস্তত্ত্ব, সমাজবিদ্যা, নীতিবিদ্যা বিষয়ে বিজ্ঞানসম্মত আলোচনা গড়ে তুলেছিলেন ক্রমে ক্রমে। সমাজতত্ত্বের বিজ্ঞানসম্মত আলোচনায় তাঁর যোগ্য পূর্বসূরী আগুস্ত কোঁত। সমসাময়িক আলোচকরা তাঁদের চিন্তাগত সামীপ্যের কথা তুললে তিনি কোঁতের কাছে তাঁর ঋণ অস্বীকার করেন। স্পেনসারের কথা হল নিম্নমান থেকে উচ্চমানে উন্নয়নে কাঠামোর একরূপত্ব থেকে কাঠামোর বহুরূপত্বে উন্নয়ন প্রক্রিয়া কাজ করছে। কোঁতের চিন্তা এরকম ছিল না। মানব ইতিহাসের উল্লেখযোগ্য পটবদলে আলো ফেলতে পারাতেই ইতিহাসের কার্যকারিতা। পরে ক্ষুব্ধ চিত্তে বলেছিলেন সেই ইতিহাসই কার্যত: মূল্যবান যা সমাজ বর্ণনা-সমৃদ্ধ। তুলনামূলক সমাজ বিষয়ে আলোকপাতই ইতিহাসের প্রকৃত কাজ। ইতিহাস চর্চার আধুনিকতায় এই ধারণা কাজের হয়েছে। ১৮৯৬ সালের মধ্যেই স্পেনসার বহুপঠিত, জনপ্রিয় লেখক, দার্শনিক-বৈজ্ঞানিক হিসাবে খ্যাত হন। স্পেনসার এই খ্যাতি পেলেও অ্যাকাডেমিক জগতে একান্ত অনীহ ছিলেন। লন্ডনের ইউনিভার্সিটি কলেজে মনোদর্শন ও তর্কবিদ্যার অধ্যাপক পদের আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান, প্রায় ৩২টি শিক্ষা জগতের সম্মান প্রদানের অধিকাংশ প্রত্যাখ্যান তাঁর মানসিকতার বিশিষ্টতা প্রকাশ করে। নানা বিতর্কমূলক রচনা লিখতে লিখতে পরলোকগমন করেন ৮৩ বছর বয়সে, ১৯০৩ খ্রিষ্টাব্দে।
স্পেনসারের সমাজচিন্তা বিষয়ে দু-একটি কথা বলা যাক। স্পেনসার বিবর্তনবাদী এবং ক্রিয়ামূলকতায় বিশ্বাসী। সমাজ কাঠামো তাঁর মতে সমাজক্রিয়ার ওপর নির্ভরশীল। ক্রিয়ার তারতম্যে অনুষ্ঠানের তারতম্য ঘটে। ইনকা এবং স্পার্টান মিলিটারি ব্যবস্থার উদাহরণ দিয়ে তিনি ব্যাপারটা বোঝান। মানবসমাজ মানব সহজাত প্রবৃত্তিপ্রসূত, এরকম ভাবতেন না স্পেনসার। তিনি মনে করতেন ব্যক্তির স্বভাব এবং ব্যক্তির ওপর প্রযুক্ত চাপ এ দুইই ঘটিয়ে তোলে সামাজিক সংঘটন। ব্যক্তিসমূহের সমষ্টি সামাজিক সুখসুবিধা গড়ে তোলে। প্রাণী ও মানুষের ব্যবহারের পার্থক্য তাঁর মতে গুণগত নয়, পরিমাণগত। স্পেনসার নিজেকে কখনও বস্তুবাদী ভাবতেন না। বরং তাঁর রচনায় এক Unknowable-এর কথা ছিল। তবে matter এবং energy দিয়েই জগৎ গঠিত এই কথাটায় তিনি খুব গুরুত্ব দিতেন। সংস্কৃতির বিবর্তনে তিনি অধিকতর গুরুত্ব দিয়েছিলেন energy-কেই। ম্যাটার ও এনার্জির পারস্পরিকতা নিয়ে তিনিই প্রথম গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা করেন। তিনিই প্রথম পর্যায়ের সমাজবিজ্ঞানী যাঁরা বলেছিলেন যে, গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির অবদান অপেক্ষা সমাজসংস্কৃতিগত শক্তির বিচারেই সংস্কৃতিকে যথাযোগ্য ব্যাখ্যা করা চলে। তাঁর কথাও যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ এবং আধুনিক যে, বড়োমাপের মানুষের সমাজ ও রাজনৈতিক সংস্থা গড়ে তোলা আদৌ ব্যক্তিইচ্ছা প্রসূত নয়। বরং সংঘটনই গঠনের মূলে কাজ করে। যুদ্ধ জটিল সমাজ ব্যবস্থার দ্যোতক, এ-বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণভাবে আলোচিত হয়েছে Principles of Sociology বইতে। সংস্থার ওপর পরিবেশের প্রভাবও তাঁর দ্বারাই আলোচিত। আর তিনি গুরুত্ব দেন অর্থনৈতিক বিষয়গুলিকে। যুক্তি দিয়ে দেখান নির্বাচিত প্রতিনিধির সরকার, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গড়ে ওঠে নগরের জনসংহতি থেকে, শিল্পী ও বণিক সম্প্রদায়ের বেড়ে ওঠা থেকে, উৎপাদন ও বাণিজ্যবৃদ্ধি থেকে।
তাঁর Principles of Sociology বইটির অনেকটা অংশ জুড়েই আলোচিত হয়েছে মানবসমাজের সমাজসংস্থার আদিমতা। এখানে তিনি আলোচনা করেছেন বিবাহপ্রথা, পরিবারগড়ন, সম্পত্তিধারণা প্রভৃতি নিয়ে। এখানেও তাঁর চিন্তা যথেষ্ট আধুনিক। এই বইতেই স্পেনসার ধর্ম বিষয়ে একটি তত্ত্ব (ভূততত্ত্ব) অবতারণা করেন। এই মতানুযায়ী প্রেতরূপে আবির্ভুত পূর্বপুরুষ পূজার মধ্যে ধর্মের উৎপত্তি। সর্বপ্রাণবাদ প্রকৃতপক্ষে এই প্রেতপূজা বা মৃত পূর্বপুরুষ পূজা থেকে গৃহীত। কারণ আদি মানুষ কল্পনা করত যে, তাদের মৃত পূর্বপুরুষরাই কতকগুলো প্রাকৃতিক বস্তুকে আশ্রয় করে বাস করে, এবং এ কারণেই নদী, গাছ, পাহাড় প্রভৃতি প্রাকৃতিক বস্তুগুলি পূজ্য। এ মতবাদ অবশ্য সমালোচিত হয়েছে। প্রথমত: প্রেতপূজা এবং ধর্ম এক নয়। দ্বিতীয়ত: প্রেতপূজাই সর্বপ্রাণবাদের একটি বিশিষ্ট রূপ এবং প্রেতপূজাকে আদিম ধর্ম বলা যায় না। ধর্মচেতনার মূলীভূত আত্মার অস্তিত্বে বিশ্বাস মানসিক বিবর্তনের অনেক উচ্চস্তরের বিশ্বাস। এইখানে স্পেনসারের ধর্মবিষয়ক আর একটি বক্তব্য তুলে ধরা যাক। বেঞ্জামিন কিড্ বলেছিলেন ধর্মের ভিত্তি ছাড়া সামাজিক নীতি টিঁকে থাকতে পারে না। (Social Evolution) অন্যদিকে হার্বার্ট স্পেনসার বলেন, ধর্মীয় বিশ্বাস ও অনুশাসন থেকে মুক্ত না হলে সামাজিক নীতিগুলি কখনই বিশুদ্ধ নীতি হয়ে উঠতে পারে না ও নিত্যপরিবর্তনশীল সমাজের প্রয়োজনও মেটাতে পারে না। টমাস হাক্সলিও এ ব্যাপারে স্পেনসারকে সমর্থন করেন তাঁর Evolutions and Ethics গ্রন্থে। স্পেনসার ধর্মের একটা অদ্ভুত সংজ্ঞা দিয়েছিলেন। তা হল — ‘ধর্ম হল একটি আনুমানিক ধারণা যা এই বিশ্বজগৎকে বুদ্ধিগম্য করে তোলে।’ কিন্তু এ মত গ্রহণযোগ্য নয়। স্পেনসার স্পষ্টত: বলেন — ধর্মতত্ত্ব বা ধর্মদর্শন অভিজ্ঞান সম্মত। তাঁর মতে এ দুয়ের আলোচনা-ক্ষেত্র স্বতন্ত্র। বিজ্ঞান চলে জ্ঞাত (known)-কে নিয়ে, ধর্ম চলে অজ্ঞাত বা অজ্ঞেয়-কে (the unknown and unknowable) নিয়ে। বিজ্ঞান আলোচনা করে প্রত্যক্ষগোচর (positive)-কে, সুনির্দিষ্ট জ্ঞানকে। কিন্তু ধর্ম চলে যায় অজ্ঞাত অন্ধকারাচ্ছন্ন পটভূমিতে। যেখানে বিচারধীন শ্রদ্ধাই ক্রিয়া করে। স্পেনসারের বিপরীতমুখী বক্তব্য হল— মানুষের বিচারবুদ্ধি যা সান্ত, তার জ্ঞানেই সীমাবদ্ধ, অথচ এই সান্তকে অতিক্রম করে যার অস্তিত্ব রয়েছে তার সম্পর্কেও বিচারবুদ্ধি অবহিত। অর্থাৎ সব জ্ঞানই আপেক্ষিক তবু আমরা পরমতত্ত্বের অস্তিত্ব সম্পর্কে অবহিত হতে পারি। এই সব চিন্তায় স্পেনসার অচিন্তনীয়কে (unthinkable) অকল্পনীয় (unimaginable)-র সঙ্গে গুলিয়ে ফেলেছেন।
হার্বাট স্পেনসার এবং তাঁর সমর্থকদের মতবাদ অভিজ্ঞতাবাদীদের মতবাদের অনুরূপ, তবে বিবর্তনবাদের পরিপ্রেক্ষিতে এই মতবাদ একটা নতুন রূপ পেয়েছে। তাঁদের মতে বিবর্তনের প্রাথমিক অবস্থায় দেশ ও কালের ধারণা অভিজ্ঞতা থেকেই পাওয়া, কিন্তু পরে এ ধারণা রূপান্তরিত হয়েছে সহজাত ধারণায়। সুতরাং দেশ ও কালের ধারণা যদিও বর্তমানে সহজাত ধারণা, তবু আসলে এ ধারণা পূর্বপুরুষদের কাছ থেকে বংশগত নিয়মানুসারে উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া।
অভিব্যক্তিবাদ বা বিবর্তনবাদ (Evolution) অনুসারে এই জগৎ একটা সরল অবস্থা থেকে ধীরে ধীরে বহুদিন ধরে পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে আজকের অবস্থায় এসে পৌঁছেছে। হার্বার্ট স্পেনসারের মতে ‘এই অভিব্যক্তি বা বিবর্তন প্রক্রিয়া সব সময়ই সহজ থেকে জটিল অবস্থায়, সদৃশ ও সমসাত্ত্বিক অবস্থা থেকে অসদৃশ অবস্থায়, অনির্দিষ্ট ও অসংবদ্ধ অবস্থা থেকে নির্দিষ্ট ও সুসংবদ্ধ অবস্থায় চালিত হয়।’ অভিব্যক্তি বা বিবর্তন পরিবর্তন সূচনা করে। কিন্তু এই পরিবর্তন এলোমেলো নয়। একটা নির্দিষ্ট ক্রম ধরে ধীরে ধীরে এই পরিবর্তন হতে থাকে। এই পরিবর্তনের মধ্যে শৃঙ্খলা আছে। বস্তুর অভিব্যক্তি কতকগুলো প্রথা অবলম্বন করে চলে।
স্পেনসারকে বলা যায় অজ্ঞেয়বাদী (Agnosticist)। স্পেনসার বলেন যে আমাদের জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা থেকে অনুমান করা যায় অসীম জ্ঞানের একটি আধার আছে। এ আধারকে চরম তত্ত্ব বলা যেতে পারে। তবে এ চরম তত্ত্ব অজ্ঞাত ও অজ্ঞেয়। তাকে জানবার কোনো উপায় নেই।
উনিশ শতকের সাতের দশক থেকে আমাদের দেশে মিল বেন্থাম প্রচারিত উপযোগবাদ এবং কোঁৎ ও মিল প্রচারিত ধ্রুববাদের (Positivism) প্রভাব দেখা যায়। এই দুই দর্শনই কিন্তু একই ভিত্তি থেকে উদ্ভূত। দুটোই ইন্দ্রিয়-প্রত্যক্ষবাদী চিন্তা এবং বিজ্ঞানসম্মত আলোচনার কথা বলে ও অলৌকিকত্বে অবিশ্বাসী। উপযোগবাদীরা বলতেন তাই হিতকর যা উপযোগী, এবং তাঁরা সুখের উচ্চ নিচ ভেদ করেন নি। অথচ মিল উচ্চতর সুখের কথা-ও বলেছিলেন। রবীন্দ্রনাথেও উচ্চতর সুখের কথা আছে। ধ্রববাদীরা নিয়মের রাজত্ব এবং জ্ঞানার্জনের একমাত্র পথ যে বিজ্ঞান, একথা বলেছেন। সত্যেন্দ্রনাথ রায় দেখান কোঁৎ ও রবীন্দ্রনাথের মানবধর্মের মধ্যে কোথাও কোথাও তফাৎ আছে। সেগুলি হল--ক) কোঁৎ এর মানবধর্ম ইন্দ্রিয়প্রত্যক্ষ সীমানায় স্থির, রবীন্দ্রনাথের সেটা নয়। খ) একটা সরাসরি বিজ্ঞান-প্রভাবিত ধর্ম হার্বার্ট প্রমুখ ডী-ইস্টরা যেমন বিজ্ঞান-অনুগামী ধর্ম প্রবক্তা। রবীন্দ্রনাথ বিজ্ঞান অনুপ্রাণিত হলেও বিজ্ঞান প্রভাবিত নন। গ) কোঁৎ এর ধর্মতত্ত্ব বুদ্ধি-প্রসূত। রবীন্দ্রনাথের হৃদয়-উৎসারিত। (রবীন্দ্রনাথের চিন্তাজগৎ, দর্শনচিন্তা: কৃষ্ণকঙ্কন ভট্টাচার্য, ভূমিকা পৃ. ৪৯) এইখানে আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্ধৃতি ব্যবহার করতে চাই--'সকলেই জানেন, নানা উৎসের নানা উপাদান একত্র মিশিয়ে স্পেনসার তাঁর সংশ্লেষাত্মক দর্শন বা Synthetic Philosophy গড়ে তুলেছেন। হিউমের অভিজ্ঞতাবাদ, কান্টের অজ্ঞেয়তার তত্ত্ব, অন্য ধারার অজ্ঞেয়তাবাদীর কাছ থেকে সংগ্রহ করা জ্ঞানের আপেক্ষিকতার তত্ত্ব, নীতির ক্ষেত্রে মিল-এর সুখবাদ ও হিতবাদ, ডারউইনের (১৮০৯) বিবর্তনবাদী জীববিজ্ঞান থেকে ক্রমবিবর্তনের তত্ত্ব, এইরকম নানা উৎসের নানা ধারা স্পেনসারের চিন্তায় এসে মিলিত হয়েছে। যথার্থ সংশ্লেষণ কতটা হয়েছে সেটা আমাদের প্রশ্ন নয়। আমাদের প্রশ্ন রবীন্দ্রচিন্তায় স্পেনসারের প্রভাব, আমরা জানি, স্পেনসার সমাজকে সজীব প্রাণীদেহের অনুরূপ সজীব সংগঠন হিসেবে দেখেছেন। এইরকম organic দৃষ্টিতে দেখা আমরা রবীন্দ্রনাথের চিন্তাতেও দেখতে পাই। রবীন্দ্রনাথের চিন্তায় স্পেনসারের সবথেকে বড়ো প্রভাব এসেছে স্পেনসারের সামগ্রিক বিবর্তনের তত্ত্ব থেকে, অর্থাৎ জগৎ ও জীবনের প্রত্যেক ক্ষেত্রে বিবর্তনের ক্রিয়াকে স্বীকার করে নেবার সামগ্রিক বিশ্বাস থেকে।’ (রবীন্দ্রনাথের চিন্তাজগৎ, দর্শনচিন্তা, ভূমিকা পৃ৬৫) রবীন্দ্র দর্শনও এক অর্থে সংশ্লেষাত্মক দর্শন--তবে স্পেনসারীয় অর্থে নয়। তাতে ভাববাদ ও বাস্তববাদ, সামগ্রিকতার ও ব্যক্তিসত্তার, সমকালীনতা ও চিরকালীনতার, প্রাচ্যদর্শন ও পাশ্চাত্ত্যদর্শন, বিজ্ঞান ও আধ্যাত্মিকতার সম্মিলনের প্রয়াস আছে।
আলোচনাসূত্রে দুজনের রাজনীতি-চিন্তা নিয়ে কিছু কথা বলা যেতে পারে। সরকার ও ব্যক্তির সম্পর্ক নিয়ে স্পেনসারের প্রথম আলোচনা The proper sphere of Government, লেখা শুরু (১৮৪২), তবে আরও খ্যাতিমান বই হল The Man versus the State (১৮৮৪)। এর ফাঁকে অন্যান্য বহু বিষয়ে তিনি চিন্তা করেছেন, বই লিখেছেন। এক জায়গায় লিখছেন — ভালো সরকার পরিচালনার নীতিসমূহ যে বইতে তা কি অবজ্ঞা করা উচিত? বরং রাষ্ট্রবিজ্ঞান এমন একটা বিষয় যা বেশী বেশী করে প্রশংসা ও অধ্যয়ন করা উচিত। (১৮৩৬-এ একটি পত্র প্রবন্ধ) স্পেনসার চেয়েছিলেন নাগরিকের অধিকার ও সম্পত্তিরক্ষায় ন্যায় প্রতিষ্ঠায় সরকার ভূমিকা নিক তবে তা যেন যথাযথ হয়। স্পেনসারের কাছে উপনিবেশ বিস্তার নয়, সন্ধিচুক্তি নয়; অন্য দেশের সঙ্গে মুক্তবাণিজ্য প্রয়োজন। আগ্রাসী যুদ্ধ ক্ষতিকর ও অপ্রয়োজনীয়। একাধিক পত্র প্রবন্ধে তিনি শিক্ষা ও স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে সরকারী হস্তক্ষেপের বিরোধী। জাতীয় শিক্ষানীতি চান না, কারণ তা মন ও মতামতের বৈচিত্র্য দেবে নষ্ট করে। তবে শিক্ষায় প্রতিযোগিতা থাকলে, মনে করেন বাড়বে উৎকর্ষ। শ্রমজীবী শ্রেণীর ভোটাধিকারে তাঁর আপত্তি ছিল না। স্পেনসার জোর দিয়েছিলেন সংকল্প অনুযায়ী ব্যক্তির কর্মে স্বাধীনতার। তবে তা যেন অন্যের স্বাধীনতা খর্ব না করে। Social Statics বইতেই তিনি পুরুষের মতো নারীর স্বাধীনতার পক্ষে ছিলেন, যদিও পরে এ মত বদলে গিয়েছিল। স্পেনসার বয়স্ক মানুষদের অসুস্থতা কালে সাহায্যের পক্ষ নিয়ে বলেন, তবে বয়স্কদের পূর্বে নিয়মিত কিছু জমা দিয়ে যেতে হবে। কিন্তু স্পেনসারের কিছু চিন্তা অনাধুনিক। Reformist Legislation, সমাজতন্ত্র, ট্রেড ইউনিয়ন, ধর্মঘট, (স্পেনসারের বিশেষ তাৎপর্যময় ন্যাচারাল শব্দ) তাই সমালোচ্য। এক্ষেত্রেও তাঁর যোগ্যতমের বেঁচে থাকার অধিকার-তত্ত্ব দরিদ্রবিরোধী হয়ে পড়ে। যাই হোক, তিনি সমাজের শিল্পগত উন্নয়ন চাইতেন যাতে ‘ব্যক্তি’ তার স্বাতন্ত্র্য রাখতে পারে, বিকাশলাভ করতে পারে। তাঁর কাছে ব্যক্তিমানুষ রাষ্ট্রের থেকে বড়ো। স্বপ্ন দেখতেন এমন এক সমাজ হবে যা ব্যক্তির অধিকার রক্ষা করবে, যুদ্ধ থাকবে না। তবে রাষ্ট্রে রাষ্ট্রে সংঘাত থাকবে। রাষ্ট্রে রাষ্ট্রে থাকবে প্রতিযোগিতা, যা ব্যক্তির গঠনে হবে সহায়ক। সে বিকশিত হবে স্বাধীনভাবে, সংগতির মধ্যে। রাষ্ট্রে সরকারী আধিপত্য কম গুরুত্বপূর্ণ এবং ব্যক্তির ভূমিকা বেশি গুরুত্বপূর্ণ হলে একদিন জাতীয় সীমানা ভেঙে বিশ্ব-ঐক্য বিকশিত হবে।
ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যবাদের ও উদার অর্থনীতির সমর্থক স্পেনসার বলতে চান যে সমাজ থেকে অকৃতার্থ ব্যক্তিসত্তার বিলোপ সম্প্রদায়ের উন্নতিই সম্ভব করবে। তাহলে দরিদ্রদের জন্য রাষ্ট্রের আর করণীয় থাকবে না। তাঁর অভিমত ব্যক্তিকে তার ব্যক্তিগত আগ্রহ অনুযায়ী চলতে দিলে অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ভালভাবে কার্যকরী হবে। তাই প্রতিদ্বন্দ্বিতায় যারা যোগ্যতম ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান বা অর্থনীতিগত সংস্থা তারাই টিঁকে থাকবে। এই সব মতামত আছে Social Statics (১৮৫০) এবং The Man versus the State (১৮৮৪) প্রভৃতি বইতে।
তিনি বিশ্বাস করতেন চরিত্রবৈশিষ্ট্যের উত্তরাধিকার ধারণায়। সংগঠনগত শক্তি আসে অবিশ্রাম শ্রম থেকে, যা ছাড়া সভ্য জীবন সম্ভব নয়, এ এক শক্তি যা উত্তরাধিকার সূত্রে আসে, সংগৃহীত হয়। কিছু কিছু সংস্কৃতিগত অদ্ভুতত্ব (যথা, গ্রীক মনের স্বাধীনচিত্ততা) জন্ম নেয় আভ্যন্তর মনস্তত্ত্বগত পার্থক্য থেকে। তবে তিনি বিশ্বাস করতেন না সম্প্রদায়গত ভিন্নতা কোনো যথার্থ মনস্তাত্ত্বিক ভিন্নতা আনে, বরং বিশ্বাস করতেন সংস্কৃতি ও পরিবেশগত পারস্পরিক ক্রিয়াই সাংস্কৃতিক সংঘটন গড়ে তোলে। এ চিন্তাকেও বলতে হবে আধুনিক।
রবীন্দ্রনাথ কোনো তাত্ত্বিক অর্থনৈতিক মডেল দেন নি, প্রচলিত তত্ত্বের কোনো নতুন প্রয়োগ সন্ধান দেন নি। তবে ধ্রুপদী অর্থনীতির মূল প্রতিপাদ্য বিষয়ে অবহিত ছিলেন। যুবক বয়সেই ভাবিত হয়েছেন অনুন্নত কৃষিনির্ভর দেশের দারিদ্র্যের সমস্যা নিয়ে। ভারতে ঔপনিবেশিক শোষণ প্রক্রিয়ার অসামান্য ছবি এঁকেছেন তাঁর মতো করে। রবীন্দ্রনাথ জমিদারী প্রথার বিলোপ নয়, উদারচেতা হিতাকাঙ্ক্ষী জমিদারের কল্যাণ প্রয়াসে আস্থাশীল। রায়তদের সুখদু:খ বা দারিদ্র্যমুক্তির ভাবনা করেছেন জমিদারি ব্যবস্থা অটুট রাখার কথা ভেবেই। ধনী দরিদ্রে অসামঞ্জস্যের কারণ ভাবতেন চিত্তের দৈন্য, আর রাষ্ট্রের দাক্ষিণ্যের ওপর নির্ভর করতে চাইতেন না। শিলাইদহ পর্বে ফসলের ব্যবস্থা, আমেরিকান ভুট্টার চাষ, মাদ্রাজি সরু ধান বা রেশম চাষ নিয়ে ভেবেছেন, চাষীদের সঙ্গে কো অপারেটিভ-এ চাষ, ব্যাঙ্কিং, চাষীদের স্বাস্থ্যকর বাসস্থান তৈরি, ঋণমুক্তি, শিক্ষার ব্যবস্থা, বৃদ্ধবয়সের সংস্থান ব্যবস্থা, রাস্তা, বাঁধ তৈরি, জলকষ্ট দূর ইত্যাদি নিয়ে ভেবেছেন। কৃষিবিদ্যার নতুন জ্ঞান অন্বেষণে পাঠিয়েছেন নিজের ছেলে ও জামাইকে। শ্রীনিকেতন পরিকল্পনার মূলে ছিল — ‘গ্রামবাসীর আত্মশক্তির উদ্বোধন ও শিক্ষার বিকিরণ’ ভাবনা। আত্মিক উন্নয়নে জোর দিয়েছিলেন। মহাজনের গ্রাস থেকে কৃষককে বাঁচানোর চিন্তা ছিল তাঁর। চেয়েছেন গ্রাম ও নগরের ভারসাম্য, যা অবশ্য ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যমূলক ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থার লোভকে নিয়ন্ত্রণের ওপর নির্ভরশীল। ধনতন্ত্রের নানা স্বরূপ দেখেছেন, সমালোচনা করেছেন আর বলেছেন আর্থিক অসাম্য থেকে মুক্তি মারকাটের বদলে খণ্ড খণ্ড শক্তির ঐক্য প্রতিষ্ঠায়। সমবায় প্রথার মধ্যে মানবমুক্তির ইঙ্গিতের কথাও আছে। ‘আজকের দিনে রবীন্দ্রনাথের অর্থনৈতিক চিন্তাভাবনার প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে আলোচনা করলে দেখা যাবে যে স্বাধীন ভারতের অর্থনৈতিক উন্নয়ন প্রয়াসে তাঁর চিন্তাভাবনা বিশেষ ছাপ রাখেনি। ..... তিনি শ্রীনিকেতনে যা করেছিলেন সারা দেশ জুড়ে তা হয় নি। সমবায় নীতির প্রসার ও কার্যকারিতা সম্বন্ধে তাঁর আশা পূর্ণ হয় নি। ..... রাষ্ট্রীয় প্রয়াস বর্জন করে তৃতীয় বিশ্বে কোনো অর্থনৈতিক উন্নয়ন সম্ভব হয় নি।‘ ('রবীন্দ্রনাথের অর্থনৈতিক চিন্তাভাবনা', কাননকুমার মজুমদার, রাতের তারা দিনের রবি)
শান্তিনিকেতন আশ্রম বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পূর্ব পর্যন্ত (১৯০১) কালে রবীন্দ্র সমাজচিন্তায় যুক্তিবাদ, ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য, নারীমুক্তি, মানবিক অধিকার ইত্যাদি ধারণা স্পষ্ট হয়েছে। এর পরের আট বছরে মেলে ‘বিজিত দেশে প্রবল ঔপনিবেশিকতা ও হীনমন্যতার টান’। স্থায়ী মূল্যসন্ধানী মানবতা এবং একই সঙ্গে ভারতীয় আত্মতায় আস্থা এ সময় স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এরপর ১৯০৮ থেকে ১৯২৫ সালের মধ্যে প্রাচ্যাভিমান বর্জন করে আধুনিকতার অভীপ্সা বড়ো হয়ে ওঠে। প্রাক শান্তিনিকেতন পর্বে তাঁর বক্তব্যে ফুটে ওঠে — ব্যক্তির অধিকার, সাম্য, ব্যক্তির স্বাধীনতায়। স্পেনসারও ব্যক্তির অধিকার ও স্বাধীনতাকে বেশ বড়ো একটা ভূমিকা দেন। পরিবারের মধ্যে সর্বপ্রকারের বশ্যতা ও পারিবারিক প্রভুত্ব, দাসত্ব নিয়ে রবীন্দ্রনাথ কিছু প্রশ্ন তোলেন, যেমন তুলেছিলেন স্পেনসার-ও। প্রচলিত শিক্ষাপদ্ধতির বিরোধিতা এবং প্রাচ্য ও প্রতীচ্য জ্ঞানচর্চার সম্মিলনের সাধনাও কোনো কোনো দিক থেকে স্পেনসারের সঙ্গে প্রতিতুলনার দিকে লোভী করে তোলে। শশধর তর্কচূড়ামণির অপবিজ্ঞান এবং উদ্ভট হিন্দুধর্ম রবীন্দ্রনাথকে আকৃষ্ট করেনি। বরং সামাজিক ক্ষেত্রে গতানুগতিকতা ও বিচার মূঢ়তার বিরোধিতা, প্রথা ও সংস্কারের অন্ধ দাসত্বের বিরুদ্ধে আক্রমণ, যুক্তি ও বিচারশীলতার সমর্থন আসছে ‘ভারতী’ পর্বের লেখালিখিতে। একটা সময়ে ছিল পাশ্চাত্যের প্রবলতার টান, আধুনিকতার টান এবং ঐতিহ্যের টান। হিন্দুত্বের ঘোরও ছিল। কিন্তু ক্রমশ: এল ভারত চেতনা এবং সামঞ্জস্য চেতনা। স্পেনসার এবং রবীন্দ্রনাথ দুজনেই যুক্তির প্রতি আস্থা, বিজ্ঞানের প্রতি আস্থা, ব্যক্তিমানুষের প্রতি শ্রদ্ধা, মানবমুক্তির প্রতি শ্রদ্ধায় দিয়েছেন আধুনিকতার পরিচয়। সম্প্রদায়গত বিরোধে সামঞ্জস্য বিধানের দুশ্চিন্তা এবং শিক্ষা ও রাষ্ট্রীয় ভাবনায় পরদেশীর আধিপত্য — এই দুটি ব্যাপারে অবশ্য দুজন চিন্তানায়কের সমবিচরণ ছিল না। এইখানে আমরা উল্লেখ করব যে, রবীন্দ্রনাথ নারীকে পুরুষের ভোগ্যবস্তু হিসেবে না দেখে ব্যক্তিত্ব বিকাশের মধ্য দিয়ে নারীর মনুষ্যত্ব লাভের কথা বলেছিলেন। অন্যদিকে দীর্ঘকাল রবীন্দ্র মানসে ইংরাজ সম্পর্কে, ইংরাজের ঐতিহাসিক ভূমিকা সম্পর্কে মোহ ছিল একথা যেমন সত্য, তেমন একথাও সত্য যে কোনো কোনো চিঠিতে ইংরাজদের সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন এবং ধনতান্ত্রিক সভ্যতার মূলোচ্ছেদের কথা স্পষ্টত: বলেছিলেন। (অমিয় চক্রবর্তীকে লেখা পত্র, ১৫ই নভেম্বর, ১৯৩৪) কিন্তু একথাও বলেছিলেন, সমাজ পুনর্গঠন করতে হবে civil society-র ভঙ্গিতে, স্বাধীনতা আসবে না টিঁকবে না ভিক্ষা মারফৎ, আর স্বাধীনতা পাওয়া আর রক্ষার জন্য মানসিক সামর্থ্য নির্মাণ একান্ত জরুরী।
রবীন্দ্রনাথের ধর্মচিন্তা স্থির নয়, চলতে চলতে বার বার বাঁক নিয়েছে। রবীন্দ্রনাথ ‘জীবনস্মৃতি’তে তাঁর অল্প বয়সে দু-ধরনের উন্মাদনার কথা লিখেছেন। সত্যেন্দ্রনাথ রায়ের ভাষায় তা হল — ‘নাস্তিক্যের বা নিরীশ্বরবাদের উন্মাদনা’ এবং ‘বিশ্বাসহীনের রসসম্ভোগের উন্মাদনা’। এ দুয়েরই পরিচয় আছে ‘চতুরঙ্গ’ উপন্যাসে। একটা যুগ আসে যখন সমগ্রতাসন্ধানী রবীন্দ্র-উপলব্ধিতে ধর্ম আসে গতিময় কর্মের রূপ নিয়ে। তিনি দেখেছেন পাশ্চাত্তে মানবপ্রেম মিলনেই সভ্যতার চলিষ্ণুতা। জ্যাঠামশাই জগমোহন উন্মাদনা-বর্জিত বিচারশীল, আত্মসচেতন, কর্তব্যনিষ্ঠ নাস্তিক। তার ধর্ম লোকহিতের। বোঝা যায়, তিনি পজিটিভজম দ্বারা উদ্বুব্ধ। অন্যদিকে লীলানন্দ স্বামীর মধ্যে আছে প্রেম ভক্তির উন্মাদনা। ভৌতবিজ্ঞানের কঠিন কার্যকারণের মধ্যে জগৎকে স্থাপন এবং তার বাইরে ঈশ্বরকে স্থাপন — ডী-ইস্ট দের কথা। তাঁরা একই সঙ্গে যুক্তিবাদী ও ঈশ্বরবিশ্বাসী। ‘তবু মোটামুটি বলা যায় যে হারবার্ট থেকে, বিশেষ করে জন লক্ থেকে এই তত্ত্ব একটা মতবাদের রূপ নিয়েছে। রুশো ভল্তেয়ার নিউটন হিউম মোটামুটি এঁরা সকলেই ডী-ইস্ট বলে গণ্য।’ (রবীন্দ্রনাথের চিন্তাজগৎ: ধর্মচিন্তা: সত্যেন্দ্রনাথ রায়ের ভূমিকা। পৃ:২৬) পজিটিভিজম লক বার্কলে হিউমের ‘ইন্দ্রিয় প্রত্যক্ষবাদী চিন্তাধারাই বিকাশমান ধরনের সম্প্রসারণ। এর প্রধান প্রেরণা সমাজকল্যাণ, সমাজমনের উন্নতি-বিধান, কুসংস্কার মুক্তি।’ এঁরা অতীন্দ্রিয়তাবাদ ও অলৌকিকতা বিরোধী।
এদের পরবর্তী হলেন উপযোগবাদীরা। দুতরফই বাঙালি বুদ্ধিজীবিদের সবিশেষ প্রভাবিত করেছেন। জগমোহন এবং শচীশ প্রসঙ্গে পজিটিভস্টদের কথা আছে। পজিটিভজম-সঞ্জাত বিজ্ঞানমুখিতা ও মানবমুখিতা রবীন্দ্রনাথের বোধকে সঞ্জীবিত করেছিল। রবীন্দ্রনাথ পৌত্তলিক ধর্মসাধনা, পৌত্তলিক ধর্মীয় স্বদেশসাধনা, ভক্তির নেশা--কোনোটাই পছন্দ করতেন না। বরং চাইতেন বহিরাঙ্গিক আবর্জনা ছিন্ন করে হিন্দুধর্মের নিত্য সম্পদের উদ্ঘাটন। আশ্রমিক দায়িত্বে ধর্মাচরণে তাঁর আনুগত্য থাকলেও কর্মিষ্ঠ মানবতার, বিশ্বমানবতা ও ভ্রাতৃত্ববোধের মানুষের ধর্মে উত্তরণ ঘটেছে ক্রমে, যার যাত্রা শুরু ঔপনিষদিক চিন্তা থেকে। আর এ বোধে ধার্মিক চলেন নিজ অন্তরঙ্গ ভাবনা বেদনার নির্দেশে, প্রাতিস্বিকতা ও নি:সঙ্গতা তার সম্বল। ঈশ্বর রবীন্দ্রের কাছে পান্থজনের সখা আর তিনি পথিক। এইখানে বলে নেওয়া যায় — রবীন্দ্র মানবধর্ম পজিটিভিস্টের মানবধর্ম নয়, এবং শেষ পর্যন্ত তিনি বাউলদের মতোই ব্রাত্য ও মন্ত্রহীন থেকে আলো ও ভালোবাসা ছড়াতে চান। বিশ্বপরিচয় (১৯৩৭)-এ রবীন্দ্রনাথ ‘নব্য প্রকৃতিতত্ত্বের’ কথা বলছেন, তিনি গড়ে নিচ্ছেন চৈতন্যের অভিব্যক্তির তত্ত্ব, কল্পনা করছেন জড়বিশ্বের সঙ্গে মনোবিশ্বের মূলগত এক ঐক্য, যে প্রসঙ্গে আমরা অভিব্যক্তিবাদীদের, এমনকি স্পেনসার এবং ডারউইনকে স্মরণ করতে পারি।
হার্বার্ট স্পেনসার ছিলেন রবীন্দ্রনাথের তরুণ বয়সে অন্যতম জনপ্রিয় চিন্তাবিদ। তাই রবীন্দ্রনাথ যে তাঁর রচনার প্রতি আকৃষ্ট হলেন, তাতে আশ্চর্যের কিছু নেই। বন্ধু প্রিয়নাথ সেনকে ১৮৯৯ নভেম্বরে লিখছেন — ‘আজ সন্ধের সময় যদি পার ত এস, বইগুলো নিয়ে যেয়ো এবং Herbert Spencer ও নতুন গল্পের বইটা এনো।’ ওই মাসেই আর একটি চিঠিতে প্রিয়নাথকে লেখেন--‘Herbert Spencer এবং Henry Harland নিশ্চয় পাঠাইয়ো।’
আরও জানা যাচ্ছে যে রবীন্দ্রনাথ তাঁর একত্রিংশ জন্মদিনে প্রিয় ভাইপো ভাইঝি সুরেন্দ্রনাথ এবং ইন্দিরা দেবীর কাছ থেকে হার্বাট স্পেনসারের অনেকগুলি বই উপহার পেয়েছিলেন। সে বইগুলি হল Essays: Scientific, Political and Speculative, Vol1 (1883), ওই Vol2 (1883), The Principles of Biology (1884), The man versus The State (1885), Political Institutions (1885), Ecclesiastical Institutions (1886) এবং Ceremonial Institutions (1889).
স্পেনসারের রচনার প্রতি বিশ্ববাসীর আগ্রহ গড়ে উঠেছিল ব্যাপকভাবে। তার কারণ স্পেনসার মানুষের চির-অভ্যস্ত মোহ-আবিষ্ট মতামতকে জীবতত্ত্ব, নৃতত্ত্ব এবং অন্যান্য বিজ্ঞানতত্ত্বের দ্বারা বিশ্লেষণ করে দৈব ও অপৌরুষের অবস্থান থেকে বাস্তব পৃথিবীতে নামিয়ে আনতে সচেষ্ট হয়েছিলেন। ‘বাল্মিকী প্রতিভা’ রচনাকালে রবীন্দ্রনাথ সংগীত বিষয়ে ভারতী পত্রিকায় পর পর তিনটি প্রবন্ধ লেখেন। সেগুলি হল — ‘সংগীত ও ভাব' (জৈষ্ঠ্য ১২৮৮), 'সংগীতের উৎপত্তি ও উপযোগিতা' (আষাঢ় ১২৮৮) এবং 'সংগীত ও কবিতা' (মাঘ ১২৮৮)। বিশ্বভারতী গ্রন্থবিভাগ সম্পাদিত ‘সংগীতচিন্তা’ বইএর শুরুতে ‘সংগীত ও ভাব’ নামে যে প্রবন্ধটি আছে তা ‘ভারতী’-তে প্রকাশিত ‘সংগীত ও ভাব’ এবং ‘সংগীতের উৎপত্তি ও উপযোগিতা’ প্রবন্ধ দুটির রবীন্দ্রকৃত সংশোধিত একত্রবদ্ধ রূপ। প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় একদা মন্তব্য করেছিলেন যে সংগীতের উৎপত্তি সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ হার্বার্ট স্পেনসারের মতের অনুগামী এবং তাঁরই প্রবন্ধ পাঠ করে তিনি গীতিনাট্য রচনায় উদ্বোধিত হয়েছিলেন। কিন্তু প্রশান্ত পাল বলছেন কথাটা ঠিক নয়। ‘সংগীত ও ভাব’ বেথুন সোসাইটিতে ৯ই বৈশাখ ১২৮৮ গানের উদাহরণ সহ পঠিত হয় এবং দ্বিতীয় প্রবন্ধটির গোড়াতেই রবীন্দ্রনাথ বলছেন যে, প্রথম প্রবন্ধটি লেখার পর হার্বার্ট স্পেনসারের রচনাবলী পাঠ করতে করতে, বিশেষত: The Origin and Function of Music (Frazer’s Magazine, oct 1857) পড়ার পর প্রবন্ধে অভিব্যক্ত মতের সঙ্গে তাঁর প্রবন্ধের মতের মিল দেখা যাচ্ছে। ‘বাল্মিকী প্রতিভা’ প্রথম অভিনয় হয় ১৬ই ফাল্গুন ১২৮৭ (২৬ ফেব্রুয়ারী, ১৮৮১), এই ফাল্গুনেই বই আকারে প্রকাশিত হয়। প্রশান্ত পাল বলেন “এই মন্তব্য থেকে বোঝা যায়, বাল্মিকী প্রতিভা রচনা ও অভিনয় এবং তারই সমর্থনে (আগাগোড়া সুর করে নানা ভাবকে গানের ভেতর দিয়ে প্রকাশ সহ অভিনয়) ‘সংগীত ও ভাব’ প্রবন্ধ রচনা করার পর রবীন্দ্রনাথ স্পেনসারের সংগীত বিষয়ক মতামতের সঙ্গে পরিচিত হন, সুতরাং বাল্মিকী প্রতিভা ও সংগীত সম্বন্ধে তাঁর প্রাথমিক ভাবনার উপর স্পেনসারের প্রভাব না থাকারই কথা। প্রথম প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথের বলার কথা ছিল এই যে, গানের কথাকেই গানের সুরের দ্বারা পরিস্ফুট করে তোলা কন্ঠসংগীতের মূল উদ্দেশ্য। ‘সংগীতের উদ্দেশ্যই ভাব প্রকাশ করা’। ‘আলাপেও সেইরূপ কেবল কতকগুলি সুর কন্ঠ হইতে বিক্ষেপ করিলেই হইবে না, যে-সকল সুরবিন্যাস দ্বারা ভাব প্রকাশ হয় তাহাই আবশ্যক’, এবং ‘গানের কবিতা পড়া যায় না, গানের কবিতা শুনা যায়’। দ্বিতীয় প্রবন্ধের প্রথমেই আসে সংগীতের শরীরগত কারণ ও তার উপযোগিতার স্পেনসারীয় ব্যাখ্যা। দুজনেই একমত যে - ‘আমাদের কন্ঠনি:সৃত বিভিন্ন স্বর বিভিন্ন মনোবৃত্তির শরীরগত বিকাশ’। আমাদের মনের ভাব গাঢ়তম তীব্রতম রূপে প্রকাশ করার উপায় হিসেবেই সংগীতের স্বাভাবিক উৎপত্তি। স্পেনসার বলেছিলেন সংগীত শুনে যে অব্যবহতি সুখ হয় সেটা সাধন করা সংগীতের কাজ। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ প্রশ্ন তোলেন সংগীতে কি কেবল আমোদ হয়? অলক্ষিত কোনো উদ্দেশ্য সাধিত হয় না? ‘ভালো সংগীত শুনিলে আমাদের হৃদয়ে যে একটি দূর অপরিস্ফুট আদর্শ জগৎ মায়াময়ী মরীচিকার ন্যায় প্রতিবিম্বিত হইতে থাকে, ইহাই তাহার কারণ। (অর্থাৎ ভবিষ্যৎ সুখ) এই তো গেল স্পেনসারের মত। এরপর রবীন্দ্রনাথ আশা করেন স্পেনসার অনুগামী হয়েই যে, এমন একদিন আসছে যখন আমরা সংগীতেই কথাবার্তা বলব। সভ্যতা তখন এতোদূর উন্নত হবে যে হৃদয়ের অঙ্গহীন রুগ্ন মলিনবৃত্তি গুলি পরিপূর্ণ সুস্থ ও সুমার্জিত হয়ে উঠবে। রবীন্দ্রনাথ দু:খ প্রকাশ করে বলেছেন, আমাদের দেশে সংগীত এমনি শাস্ত্রগত, ব্যাকরণত, অনুষ্ঠানগত হয়ে পড়েছে, স্বাভাবিকতা থেকে এত দূরে চলে গেছে যে, অনুভবের সঙ্গে সংগীতের বিচ্ছেদ হয়েছে, সংগীত কেবল সুরসমষ্টির কদম ও তাতে রাগরাগিণীর ছাঁচ মাত্র অবশিষ্ট আছে। ‘সংগীত ও কবিতা’ নামের প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথের বলার কথা হল, আমাদের ভাবপ্রকাশের দুটি উপকরণ - কথা ও সুর। সংগীত ও কবিতা ভাবপ্রকাশের দুটি অঙ্গ ভাগাভাগি করে নিয়েছে। তবে কবিতার মতো সংগীত ভাবপ্রকাশে উন্নতি করে নি। সংগীতের সাম্প্রতিক অবনতির কারণ - ‘অষ্টেপৃষ্ঠে বন্ধন, নিয়মের মধ্যে বাস’ এবং যত পরিশ্রম করেই গান রচনা হোক, পুরোনো রাগরাগিণীর নামে নামকরণ করা হয় ও রচয়িতার যশের লাঘব হয়। এই প্রসঙ্গে ‘জীবনস্মৃতি’র প্রাসঙ্গিক অংশ আমরা স্মরণ করি। তিনি লিখছেন - ‘সচরাচর কথার মধ্যে যেখানে একটু হৃদয়াবেগের সঞ্চার হয় সেখানে আপনিই কিছু না কিছু সুর লাগিয়া যায়। বস্তুত: রাগ, দু:খ আনন্দ, বিস্ময় আমরা কেবলমাত্র কথা দিয়া প্রকাশ করি না, কথার সঙ্গে সুর থাকে। এই কথাবার্ত্তার আনুষঙ্গিক সুরটাই উৎকর্ষ সাধন করিয়া মানুষ সংগীত পাইয়াছে। স্পেনসরের এই কথাটা মনে লাগিয়াছিল।" বিলাতে থাকার সময় রবীন্দ্রনাথ স্পেনসারের Data of Ethics (১৮৭৯ জুন) পড়েছিলেন একথারও উল্লেখ আছে ‘জীবনস্মৃতি’তে। ‘বাল্মিকী প্রতিভা’ গীতিনাট্যের ঢং স্পেনসারীয় চিন্তানুসারী অর্থাৎ ভাবের অনুগমন করতে গিয়ে তালটাকে খাটো করেছেন। কিন্তু অভিনয়মুখ্য হওয়ায় তালের এই ব্যতিক্রম শ্রোতাদের দু:খ দেয় না। এই নতুন পন্থায় উৎসাহ বোধ ক’রে এই শ্রেণীর আরও একটি গীতিনাট্য তিনি লিখেছিলেন সে সময়। তার নাম - কালমৃগয়া। ফিরে আসি প্রবন্ধ তিনটির কথায়। এই তিনটি প্রবন্ধ থেকে বোঝা যাচ্ছে স্পেনসার ও রবীন্দ্রনাথ সংগীতের নূতনতর সম্ভাবনার কথা ভেবেছিলেন। স্পেনসারের চিন্তার মধ্যে বিবর্তনবাদী ভাবনার প্রকাশ আছে। কাব্য চিত্র ভাস্কর্য অপেক্ষা শিল্প হিসেবে সংগীতকেই সর্বোচ্চ ভেবেছেন দুজনেই। তবে ভারতীয় সংগীতে ওস্তাদের মধ্যবর্তিতায়, রাগপ্রকাশের যান্ত্রিকতায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। সংগীতের সর্বাতিশায়ী স্বাধীনতা কামনায় স্পেনসার, রবীন্দ্রনাথ এবং শোপেনহাওয়ার সগোত্র। সংগীতের শরীরগত কারণ ও উপযোগিতার ব্যাখ্যা রবীন্দ্রনাথের মনোমত হয়েছিল, বলা হয়েছে। প্রশান্ত পাল আর একটি প্রেরণার কথা বলেছেন। রবীন্দ্রনাথের প্রবন্ধ দুটি লেখার কিছু আগে ১২৮৭ বঙ্গাব্দের ‘ভারতী’র শ্রাবণ, ভাদ্র, কার্তিক, অগ্রহায়ণ, পৌষ ও মাঘ সংখ্যায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়েছিল দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘স্বর রহস্য’ নামে দীর্ঘ প্রবন্ধ। এ প্রবন্ধটিও তাঁকে উৎসাহিত করতে পারে। প্রসঙ্গত: বলে নেওয়া যাক এই সময়, অর্থাৎ রবীন্দ্রতারুণ্যে এখানে অনেকেই পজিটিভিস্ট চিন্তার দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন। দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে কৃষ্ণকমলের এ নিয়ে বিতর্ক হয়েছে এবং রবীন্দ্রনাথ এ দুজনের প্রতিই অত্যন্ত সশ্রদ্ধ মনোভাব পোষণ করতেন।সঙ্গীতের নন্দনতত্ত্ব নিয়ে যখন কথা উঠল তখন আমরা বলে নিতে পারি সৌন্দর্যতত্ত্বের আর একটি ছোট্ট কথা। ‘সৌন্দর্যবোধ’ (১৩১৩ পৌষ) এবং ‘তত:কিম’ (১৩১৩ অগ্রহায়ণ) নামে রবীন্দ্রনাথের দুটি প্রবন্ধ আছে। দুটি প্রবন্ধেই বলা হয়েছে সংযম আমাদের মধ্যে জাগায় সৌন্দর্যবোধ, এবং সৌন্দর্যচেতনা জৈবিক সুখের সঙ্গে সম্পর্কহীন। আমরা দেখব স্পেনসারও বলছেন lifeserving function এর সঙ্গে যুক্ত না থাকাই aesthetic character of feeling প্রকাশে সাহায্য করে। প্রয়োজন অপ্রয়োজনের সঙ্গে যুক্ত থাকলে সুন্দর দূরে সরে যায় - একথাটা আবার রবীন্দ্রনাথও বলছেন নানাভাবে। বিমল মুখোপাধ্যায় মন্তব্য করেছেন যে সংযম ও সৌন্দর্যের সম্পর্ক বিষয়ে রবীন্দ্রনাথ হয়ত ভারতীয় নন্দন ধারণার দ্বারা চালিত হয়েছেন, কিন্তু কান্ট, শিলার, হার্বার্ট স্পেনসারের ভাববাদী নন্দনতত্ত্বে এ ব্যাপারটা আছে। (রবীন্দ্র নন্দনতত্ত্ব, পৃ. ১২৭) আসা যাক রবীন্দ্র খেলা-তত্ত্বে। ‘তথ্য ও সত্য’ প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ খেলা ও সাহিত্যসৃষ্টির পার্থক্য দেখালেন। শিলার প্রভৃতি রসজ্ঞগণ যাকে ‘প্লে’ বলছেন, রবীন্দ্রনাথের কাছে সেটাই ‘লীলা’। মনে রাখতে হবে শিলারের মতো স্পেনসারও ‘প্লে’ তত্ত্বের অন্যতম সমর্থক। এঁরা খেলা বলতে জৈবিক প্রয়োজন সাধন বোঝেন নি। খেলার সঙ্গে প্রয়োজন সাধনের সম্পর্ক নেই, সাহিত্যের সঙ্গে প্রয়োজনের সম্পর্ক নেই। তবুও আমরা লক্ষ্য করব সাহিত্যের এই প্রয়োজন ব্যতিরিক্ততার ওপর গুরুত্ব দিলেও রবীন্দ্রনাথে খেলা ও লীলার মধ্যে পার্থক্য করছেন। কিন্তু এ দুয়ের মধ্যেই আছে প্রয়োজন অতিক্রমী প্রয়াস যা আনন্দ বিধান করে। এদিক থেকে শিলার, স্পেনসার ও রবীন্দ্রনাথ শেষপর্যন্ত একই জায়গায় পৌঁছে যান। (রবীন্দ্র নন্দনতত্ত্ব, পৃ. ২০৭) বিমল মুখোপাধ্যায় বলছেন, খেলা আলোচনা সূত্রে রবীন্দ্রনাথ ‘তথ্য ও সত্য’ প্রবন্ধের ২য় ও ৩য় অনুচ্ছেদে যে সব উদাহরণ দিয়েছেন (কুকুর বিড়াল-এর আচরণ) তার সঙ্গে স্পেনসারের Principles of Psychology (Vol II) গ্রন্থের কিছু অংশের মিল আছে। (পূর্বোক্ত পৃ. ৩৪৯)
খেলা ও লীলা রবীন্দ্রনাথের কাছে সমার্থক নয়। তাঁর সাহিত্যতত্ত্ব লীলাবাদী কিন্তু ক্রীড়াবাদী নয়। রবীন্দ্রনাথ বলেন - ‘খেলার বৃত্তি আর প্রয়োজন সাধনের বৃত্তি মূলত: একই। ... খেলার ক্ষেত্র জীবনযাত্রা ক্ষেত্রের প্রতিরূপ’। (তথ্য ও সত্য, সাহিত্যের পথে) ডারউইন বা হার্বার্ট স্পেনসারের মতো সব কিছুকেই বিবর্তনবাদ দেখতে অভিপ্রায়ীরা রবীন্দ্রনাথের এ মন্তব্য মানতে পারেন, কিন্তু সাহিত্য বিষয়ে ভিন্নমত পোষণ করবেন। তাঁরা বলবেন খেলা এবং সাহিত্য দুটোই অভিন্ন জৈবশক্তির প্রকাশ, সবই জীবনযুদ্ধের অন্তর্ভুক্ত। তাঁরা বলবেন সাহিত্য মানুষের উদ্বৃত্ত শক্তির সৃষ্টি আর এই উদ্বৃত্ত শক্তি অজৈব নয়। রবীন্দ্রনাথ সাহিত্যকে উদ্বৃত্তশক্তির প্রকাশ মনে করলেও জৈবশক্তির, জীবনযাত্রা ক্ষেত্রের পরিচয় বলতে মানতে অরাজী। তাঁর কথায় সাহিত্য তো মানুষের বিশুদ্ধ যুক্তি, বিশুদ্ধ মনুষ্যত্বকে প্রকাশ করে, এ তার মনুষ্যত্বের অভিজ্ঞান। এ জন্যই রবীন্দ্রনাথ মানুষকে বলেন Angel of Surplus। দেখা যাবে নানা জাতের ক্রীড়াবাদের মধ্যে একমাত্র শিলারের ক্রীড়াবাদই বেশ কিছুটা রবীন্দ্র লীলাবাদের কাছাকাছি। দুজনেই খেলা ও লীলাকে মানব-স্বভাবের সঙ্গে একাত্ম করে দেখেছেন, দুজনেই মনে করছেন সৌন্দর্যবোধ মানুষের স্বধর্ম। তবে এই লীলাতত্ত্বও চলে গেছে শেষ জীবনের সাহিত্যবোধে এটাও মনে রাখতে হবে।
লোকেন্দ্রনাথ পালিতকে লেখা একটি পত্রাংশ ‘সাহিত্য’ গ্রন্থভুক্ত একটি উদ্ধৃতিকে এখানে সংযুক্ত করব, যাতে রবীন্দ্র মনোভাবটি স্পষ্ট। তিনি বলছেন - ‘জগৎ জড়যন্ত্র কিংবা আধ্যাত্মিক বিকাশ এ দুটো মতের মধ্যে কোনটা সত্য সাহিত্য তা নিয়ে তর্ক করে না--কিন্তু এইদুটো ভাবের মধ্যে কোন ভাব মানুষের স্থায়ী এবং গভীর আনন্দ সেই সত্যটুকুই কবির সত্য, কাব্যের সত্য। কিন্তু আমি যদি বলে থাকি দার্শনিক ও বৈজ্ঞানিক সত্যের উপযোগিতা নেই তবে সেটা অত্যুক্তি। আমার বলবার অভিপ্রায় এই যে, সাহিত্যের উপযোগিতা সবচেয়ে বেশি। বসন না হলেও চলে (অবশ্য লোকে অসভ্য বলবে) কিন্তু অশন না হলে চলে না। হার্বার্ট স্পেনসর উলটো বলেন। তিনি বলেন সাহিত্য বসন এবং বিজ্ঞান অশন।’ (রবীন্দ্র রচনাবলী, ৮ম খণ্ড, পৃ. ৪৭৩)।
আমরা লক্ষ করব রবীন্দ্রনাথের প্রথম পর্বের রোমান্টিক সাহিত্যভাবনা এবং সৌন্দর্যবিলাসী ভাব কেটে যায় এক সময়, তবে রবীন্দ্রনাথ সাহিত্যশিল্পে চিরকালই অপ্রয়োজনবাদী, তবে বলতেন সৌন্দর্য প্রয়োজনের ঊর্ধ্বে, কিন্তু মঙ্গলের ঊর্ধ্বে নয়। (সৌন্দর্যবোধ) সায়ান্স বা আর্ট দুটি চর্চার ক্ষেত্রেই তিনি নিরাসক্ত মনের পক্ষপাতী। (আধুনিক কাব্য) এইসঙ্গে এটাও শুনি তিনি সাহিত্যকে বিজ্ঞানধর্মী ও বিশ্লেষণাত্মক করে তুলতে চান না, তাতে স্বধর্মভ্রষ্ট হয় সাহিত্য। সাহিত্য মূলত: রসধর্মী। রবীন্দ্রনাথ দার্শনিক বা বৈজ্ঞানিক সত্যের উপযোগিতা অস্বীকার করেন না। কিন্তু আনন্দকেই সবথেকে বড়ো করে তুলতে চান। মানুষের মহিমাই তাঁর অনিষ্ট। এই সঙ্গে এটাও বলেন যথার্থ সাহিত্য সবসময়ই কল্যাণকর, তা সব সময়ই হিতসাধন করে। অভিব্যক্তিরাই সকলেই সভ্যতার অগ্রগতিতে জৈবতাকে গুরুত্ব দিয়েছেন। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ তাতে সায় দেন না। তিনি বিজ্ঞান বিজ্ঞান-লব্ধ সত্য এগুলোকে জানার কথা বলেন, কিন্তু সাহিত্য শিল্পকে তারও ওপরে স্থান দেন, সত্যের নির্যাস যেখানে আনন্দপুষ্প হয়ে ওঠে।
আবার আমরা ফিরে যাই ‘ভারতী’ পত্রিকার যুগে। ‘ভারতী’ পত্রিকায় বৈশাখ ১২৮৯ সংখ্যায় রবীন্দ্রনাথের একটি প্রবন্ধ বেরিয়েছিল। তার নাম - ‘দেবতায় মনুষ্যত্ব আরোপ’। এই প্রবন্ধটি লেখা হচ্ছে হার্বার্ট স্পেনসারের The use of Anthropomorphism প্রবন্ধটি অবলম্বনে। এখানে শতপথ ব্রাহ্মণ, ভাগবত, পুরাণ, গ্রীকপুরাণ, টমাস হেনরি হাক্সলির The Genealogy of Animals প্রবন্ধ প্রভৃতি থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে স্পেনসারের বক্তব্যের স্পষ্ট বিরোধিতাই করা হয়েছে। প্রবন্ধটির শেষে আছে স্পেনসারের Data of Ethics গ্রন্থের উল্লেখ। যা তিনি বিলাতে বসেই পড়েছিলেন, যেকথা আমরা জানতে পারছি ‘জীবনস্মৃতি’ পড়ে। এই ‘ভারতী’ পর্বেই আমরা পাচ্ছি ‘কাব্যের অবস্থা পরিবর্তন’ (ভারতী, শ্রাবণ ১২৮৮) নামে একটি প্রবন্ধ। যাতে স্পেনসারের মতই তিনি জাগতিক সর্বব্যাপারের মধ্যে লক্ষ্য করছেন অভিব্যক্তি। স্পেনসার যে unknowable এর কথা বলেন তা রবীন্দ্রনাথের অনেক লেখায় মেলে। আমি আপাতত: ওই ‘ভারতী’ পর্বের একটি উদাহরণ দিচ্ছি। ‘পুরাতনের নূতনত্ব’ নামে একটি ছোট্ট লেখা আছে (অচলিত সংগ্রহ, ২য় আলোচনা, পৃ. ৯) তাতে রবীন্দ্রনাথ বলছেন - ‘অতএব দেখা যাইতেছে জগতের সমস্ত দৃশ্যের মধ্যে অনন্ত অদৃশ্য বর্তমান’। এমন কথা শান্তিনিকেতন প্রবন্ধমালাতেও পাব।
ইতিপূর্বে আমরা সাধারণভাবে হার্বার্ট স্পেনসার ও রবীন্দ্রনাথের রাজনৈতিক চিন্তা নিয়ে সামান্য দু-একটি কথা বলেছি। আরও কিছু তথ্য সন্নিবেশ করে তাঁদের চিন্তার সাদৃশ্য ও বৈসাদৃশ্যের দিকে পাঠকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করা যাক।
১৫-ই ফেব্রুয়ারী ১৯০১ কার্জন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন ভাষণে ছাত্রদের নানা উপদেশ দিয়ে প্রাচ্যের অতিশয়োক্তি প্রবণতা নিয়ে কটূক্তি করেন। দেশীয় সংবাদপত্রে কার্জনের এই উক্তির প্রতিবাদ শুরু হয়। রবীন্দ্রনাথ দরবার ঘোষণা ও সমাবর্তন ভাষণের যথাযোগ্য প্রত্যুত্তর রচনা করেন ‘অত্যুক্তি’ নামক প্রবন্ধ, যা ‘বঙ্গদর্শন’ কার্তিক ১৩০৯ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়। এই প্রবন্ধেই রবীন্দ্রনাথ হার্বার্ট স্পেনসার এর Facts and Comments (১৯০২) গ্রন্থ থেকে বুয়র যুদ্ধের সময় ইংরেজ সাংবাদিকরা কিভাবে রাশি রাশি মিথ্যা ছড়িয়েছিল তার দৃষ্টান্ত উপস্থিত করেন। দক্ষিণ আফ্রিকায় বুয়র যুদ্ধ চলে প্রায় আড়াই বছর ১২ই অক্টোবর, ১৮৯৯ থেকে ৩১শে মে ১৯০২, পর্যন্ত। এই প্রসঙ্গে আমরা উল্লেখ করব রবীন্দ্রনাথের ‘রাষ্ট্রনীতি ও ধর্মনীতি’ প্রবন্ধটির কথা, যা নানা দিক দিয়ে পূর্বোক্ত ‘অত্যুক্তি’ প্রবন্ধের সঙ্গে যুক্ত। ‘অত্যুক্তি’ প্রবন্ধে যে মিথ্যার বেসাতি তার পুনরুল্লেখ আসে এই প্রবন্ধে। লেখক দেখান ‘রাষ্ট্রনৈতিক প্রয়োজন কিভাবে ন্যায়বিচারের ধর্মনীতিকেও বিকৃত করেছে’। এই বিকৃতি প্রসঙ্গ এনে আশঙ্কা করেন স্বদেশবাসী সম্পর্কে-- ‘ভয়ের কারণ এই যে, আমাদের মন হইতে ধ্রুবধর্মে বিশ্বাস শিথিল, সত্যের আদর্শ বিকৃত হইয়া যাইতেছে। আমরাও প্রয়োজনকে সকলের উচ্চে স্থান দিতে উদ্যত হইয়াছি। আমরাও বুঝিতেছি, পোলিটিকাল উদ্দেশ্যসাধনে ধর্মবুদ্ধিতে দ্বিধা অনুভব করা অনাবশ্যক।’ এখানে রবীন্দ্রনাথ বলছেন আধুনিক ধর্মশাস্ত্রে পলিটিকস সর্বোচ্চ। ‘পোলিটিক্যাল প্রয়োজনে সত্য কিরূপ বিকৃত হইয়া থাকে, অন্য প্রবন্ধে হার্বার্ট স্পেনসরের গ্রন্থ হইতে তাহার প্রমাণ উদ্ধৃত করা গেছে।' (রাষ্ট্রনীতি ও ধর্মনীতি, সমূহ, রবীন্দ্র রচনাবলী ৮ম, পৃ. ৫৯৮) আর একটি প্রবন্ধে বলছেন নৈতিক আদর্শ নিয়ে। ‘হার্বার্ট স্পেন্সর প্রভৃতি ইংরেজ দার্শনিকের মত এই যে, সভ্যতার তারতম্য অনুসারে নৈতিক আদর্শের তারতম্য কেবল যে অবশ্যম্ভাবী তাহা নহে, অভিব্যক্তির নিয়মে তাহা আবশ্যক। এই সকল মতের সত্যাসত্য অন্য সময় বিচার হইবে আপাতত এইটুকু বলতে পারি ইহার ফল আমাদের পক্ষে বড়ো পীড়াজনক।’ (রাজা ও প্রজা, সমূহ, পূর্বোক্ত, পৃ. ৫৪৫) ‘ঘুষাঘুষি’ নামে রবীন্দ্রনাথের একটি প্রবন্ধ পাওয়া যায়। তাতে বলছেন, শুকনো উপদেশ অপেক্ষা অভ্যাস দরকারি। ‘মারা উচিত বলিলেই মারা যায় না, মারা অভ্যাস করা চাই। যাহাদের ঘুষি প্রস্তুত হইয়া আছে, তাহারা শিশুকালে প্রতিবেশির ছেলেকে মারে, বিদ্যালয়ে সহপাঠীকে মারে, কলেজে gownsman হইয়া townsman কে মারো - এমনি করিয়া একেবারে এমন পাকিয়া যায় যে, তাহাদের ধর্মগ্রন্থের উপদেশ অরণ্যরোদনে পরিণত হয়’। এরপর লেখক স্পেনসার-এর Facts and Comments বইয়ের ৩০ পৃষ্ঠা থেকে বেশ কয়েক পংক্তির উদ্ধৃতি দেন, তারপর মন্তব্য করেন - ‘ইহা না হইয়া যায় না। চালের একটি খড় পোড়াইতে গেলেও সমস্ত চালে আগুন লাগে। কাড়াকাড়ি-ঘুষাঘুষিকে সমাজের সর্বত্র প্রচলিত করিলে তবেই আবশ্যকের সময় তাহা অনায়াস প্রাপ্য হয়’। (রবীন্দ্র রচনাবলী, ৮, পৃ. ৬১০) রবীন্দ্রনাথের এই শ্লেষগর্ভ মন্তব্যের মধ্যে শাসকশ্রেণীর প্রতি তীব্র সমালোচনা স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
রবীন্দ্রনাথের উপলব্ধির জগৎ নিয়েও নানা বিতর্ক উঠেছে, উঠছে। সুশোভন সরকার মন্তব্য করেছিলেন — ‘আমি নিজে মনে করি যে রবীন্দ্রনাথের চিন্তা ও কর্মের মধ্যে প্রগতিবিরোধী ধারণার অসদ্ভাব নেই, কিন্তু ব্যাপকভাবে দেখতে গেলে তাঁকে অগ্রগতির সহায়করূপেই স্বীকার করে নিতে হবে’। (রবীন্দ্রনাথ ও অগ্রগতি, প্রসঙ্গ রবীন্দ্রনাথ, সুশোভন সরকার, পৃ. ৩৪) এই প্রবন্ধেই সুশোভনবাবু বলেন রবীন্দ্রনাথ সরকার বা স্টেট থেকে সমাজ বা সোসাইটিকে সম্পূর্ণ পৃথক ভাবার চেষ্টা করেছিলেন। আজকে এই ‘সঙ্ঘবদ্ধ আত্মশাসিত জনসমষ্টি’তে আস্থা ইউটোপীয় অর্থাৎ অবাস্তব। বৈচিত্র্য বজায় রেখে ঐক্যসন্ধান শুধু ভারতে নয়, অন্য সভ্যতাতেও আছে এবং এ প্রয়াস সাফল্য পায় নি। তপোবনাশ্রিত শিক্ষাপদ্ধতি, পল্লীসংস্কারে মণ্ডলীবদ্ধ কয়েকটি কর্মীর উদ্যম এবং আদর্শ গ্রাম সংগঠন - এ সব চিন্তাও স্থায়ী কার্যকরী রূপ পায় নি। উদার হিউম্যানিস্ট রবীন্দ্রনাথের বিশ্বদর্শন কেতাবেই থেকে গেছে। রবীন্দ্রনিন্দিত উগ্র জাতীয়তাবাদ মাথা তুলেছে এ দেশে বহুকাল। সাম্রাজ্যবাদের ভিত্তিতে আর্থিক ও সামাজিক অভিঘাতকে পাত্তা না দিয়ে রিপুর তাড়নাকে কারণ দেখানো এবং চিত্তশুদ্ধির নিদানও কার্যকরী হয় নি। অন্যদিকে লেসলি পল মন্তব্য করেন, His (অর্থাৎ স্পেনসারের) failure to live on as a significant philosopher is due in part to the very qualities that made him acceptable to his own age, of which the rewriting of Bentham in evolutionary terms is an instance. নির্ভর করা বিজ্ঞান-তথ্য ও সত্যগুলির পরিবর্তন ও স্পেনসার প্রবর্তিত মতের জনপ্রিয়তা হ্রাসে কাজ করে। (Encycloedia Americana, Pg. 482) রবীন্দ্রনাথ ‘পার্সোনালিটির অন্তর্নিহিত প্রাণশক্তির বন্দনা করেছেন, কিন্তু সেই ব্যক্তিত্বের সাধনা এখন অল্পলোকের পক্ষেই সম্ভব’। (সু. সরকার, পূর্বোক্ত) পার্সোনালিটিকে বড়ো করে দেখেছিলেন, স্পেনসার-ও, কিন্তু য়ুরোপে তা সাফল্যময় করা ওই অল্পলোকের পক্ষেই সম্ভব।
অন্যদিকে রবীন্দ্রচিন্তারাজ্য নিয়ে যতটুকু মতভেদ থাক চিন্তাগ্রাহ্যতা যথেষ্ট। তাঁর সৃজনশীল অবদান নিয়ে অটুট থাকে বিস্ময়, তাঁর কবিতা, গল্প, উপন্যাস গান যেমন দেয় আধুনিকতার দোলা, চিত্রকলাও দেয় নব্যতার প্রেরণা। সাহিত্য, শিল্প, ধর্ম সর্বত্রই আছে গতির ও অগ্রগতির পরিচয়। পরিবর্তনের প্রবহমান স্রোতে তাঁর অন্তর সাড়া দিত নিশ্চয়ই। স্পেনসার ও রবীন্দ্রনাথ নানাসূত্রে তাই কাছে এসেছিলেন, আবার চলে গেছেন ভিন্ন পথে। যে বিপুল সত্য আছে তাঁদের রচনায়, সেটাই হয়ে উঠবে চিন্তা ও বিচারের পাথেয়। স্পেনসারের পরলোকগমনের পর ম্যাঞ্চেস্টার গার্ডিয়ান-এ লেখা হয়েছিল — ‘When socialism begins to produce reaction ... Spencer’s political writings will be a mine of arguments for the critics of paternal government’. একথা রবীন্দ্রচিন্তার ক্ষেত্রেও সমভাবে প্রযোজ্য।