বাংলা ছোটগল্পের রাজাধিরাজ রবীন্দ্রনাথ। কলেজস্ট্রীট কফি হাউসের শনিবারের সন্ধ্যার কাপ্তেনরা না মানলেও আমি মানি। গত কয়েক দশক ধরে রবীন্দ্র গল্প পড়েছি, পড়িয়েছি, শহরে ও গ্রামে, শান্তিনিকেতনে, রবীন্দ্রনাথকে নিত্য অনুভব করতে করতে। হাতে পড়েছিল পূর্বসূরী অধ্যাপক পশুপতি শাসমল ব্যবহৃত সমগ্র গল্পগুচ্ছ, তাঁর তথ্য-চিহ্নিত। এসব আজ স্মৃতি মাত্র। রবীন্দ্রনাথের প্রথম যুগের গল্প ‘পোস্টমাস্টার’ নিয়ে এই চৈত্র-বৈশাখে দু-চার কথা বলি।
একটু গৌরচন্দ্রিকা করে নিই। ট্যালেন্ট থাকলেই গল্পকার হওয়া যায় না। I know a lot of talented ruins (জেমস বল্ডউইন); যথার্থ কথাকার হতে গেলে চারটি শৃঙ্খলা মানতে হবে — কল্পনা করা, পর্যবেক্ষণ, পাঠ আর লেখার চর্চা। (স্টিফেন কখ) লিখতে গেলে কতো ফ্যান্টাসি ঘুরে বেড়ায় ভাবনার চারিধারে মথ-এর মতো, তাকে দেখতে ও ধরতে, বাতিল করতে জানা চাই। কোনটা নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে কাজে লাগবে বোঝা চাই। এবার, স্মরণ। ম্যারিয়ান মুর বলতেন লেখক ঘুরে বেড়ায় কল্পনার বাঙানে, তাতে ব্যাঙ লাফাচ্ছে। কল্পনা ও স্মরণ অঙ্গাঙ্গীবদ্ধ। এখানে বলা যাক ‘হিতবাদী’ পত্রিকা যুগের দ্বিতীয় গল্প — ‘পোস্ট্মাস্টার’। রবীন্দ্রনাথ বলেন — ‘সাধনা বাহির হইবার পূর্ব্বেই হিতবাদী কাগজের জন্ম হয়। ... সেই পত্রে প্রতি সপ্তাহেই আমি ছোটগল্প সমালোচনা ও সাহিত্য প্রবন্ধ লিখতাম। আমার ছোটগল্প লেখার সূত্রপাত ঐখানেই।’ (পদ্মিনীমোহন নিয়োগীকে লেখা চিঠি, ২৮ ভাদ্র, ১৩১৭) পিতার নির্দেশে হৃদয় অরণ্যে বিচরণরত কবি জমিদারী দেখভাল করতে শিলাইদহ, পতিসর, সাজাদপুর, কালিগ্রাম যান। তিনটি পরগণা নিয়ে ঠাকুর পরিবারের জমিদারী। শিলাইদহ থেকে সাজাদপুর যাতায়াতের উপায় বর্ষাকালে নৌকো, শুকনো সময়ে পালকি, ঘোড়া। প্রথম তিনটি স্থানই রবীন্দ্রকল্পনার পুষ্টিসাধনে সাহায্য করেছে। রবীন্দ্রনাথ সাধারণত: ‘পদ্মা’ বোটে করেই পতিসর যেতেন। সাজাদপুরেই কুঠিবাড়ী। পদ্মা তীরবর্তী। সাজাদপুরের কুঠির নীচের তলাতেই ডাকঘর। দক্ষিণে গোপীনাথজীর মন্দির, কুঠিবাড়ীর উত্তরে পদ্মাপারে খেয়াঘাট, পাশে দাতব্য চিকিৎসালয়। জমিদারী দেখতে গেলে খাতাপত্র দেখতে হয়, লোকজনের সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ করতে হয়, অভাব অভিযোগ প্রার্থনা শুনতে হয়।
ফিরে আসি পূর্ব প্রসঙ্গে। এক লেখক বলছেন — যা নেওয়া হয় সরাসরি জীবন থেকে, তাকে লেখার বাস্তবতার মাপে সাজাতে হয়। (ফিলিপ রথ) একথায় ফিরব পরে। হেমিংওয়ের একটা খাটিয়া ছিল — যেখানে শুয়ে শুয়ে আধভুলে যাওয়া স্মৃতি নিয়ে খেলতেন। কবি এইলিন সিম্পসন-ও ঠিক এই কথা বলেন। স্মরণের সেই অংশই গৃহীত হওয়া উচত যা গড়ে তুলবে innate harmonies. (ভ্লাদিমির নবোকভ) এবার পর্যবেক্ষণ কথা। দেখতে হবে প্রত্যক্ষ জগতের অনুপুঙ্খ, বেশিটাই নিজের চোখে। তবে কিছু খেয়াল না-করা ব্যাপার অনুভব গড়ে তুলতে সাহায্য করে। চেকভের এক জীবনীকার বলছেন ১৮৮৭-তে চেকভ ব্ল্যাক সি-র পাশে একটি শহরে (Taganrog) পুনর্বার গিয়েছিলেন, যেখানে তার সুখহীন শৈশব কেটেছে। ফিরে আসার আগে বোন মারিয়াকে কথা দেন বড়ো বড়ো চিঠি লিখবেন এই বেড়ানো নিয়ে। এই স্মৃতির টানেই লেখা — The Steppe. বাঙালী পাঠকের মনে পড়বেই পদ্মাপারের জীবন নিয়ে বড়ো বড়ো চিঠি লিখেছেন রবীন্দ্রনাথ ভাইঝি ইন্দিরা দেবী চৌধুরানীকে। (ছিন্নপত্র) প্রমথনাথ বিশী দেখান শিলাইদহ পর্বের কথায় আছে অনেক গল্পের বীজ। যেমন — পোস্টমাস্টার (৩টি চিঠি), ছুটি, মেঘ ও রৌদ্র, নিশীথে, ক্ষুধিত পাষাণের কিছু উপাদান। এই গল্পবীজ পরে শিল্প স্পন্দনে এসেছে গ্রহণে বর্জনে। চেকভ বা রবীন্দ্রনাথ এই পথে গড়ে তোলেন focu. এবার পঠনপাঠন কথা। আমি তো পাঠকই হতে চাই--বলেন টনি মরিসন। আর স্টিফেন কিং বলেন যে-লেখক বলে আমার বই পড়ার সময় নেই সে সমর্থ লেখক হতে পারে না। কোয়েটজি, গর্দিমার, পামুক অন্তত তিনজন কথাকারের বিস্ময়কর পাঠ আগ্রহ আমাদের অনেকের জানা। রবীন্দ্রনাথের অধ্যয়ন নিয়ে বই লিখেছেন অধ্যাপক উজ্জ্বল কুমার মজুমদার। কিন্তু আরও কতো অনুল্লিখিত বইয়ের কথাও জানা যায়, আঁচ করা যায়। একাকী গায়কের নহে তো গান গাহিতে হবে দুইজনে (গায়ক ও শ্রোতা) রবীন্দ্রনাথ যেমন বলেছেন পার্সি লাবকও বলেছেন। আর দরকার কবিতা পড়া (রে ব্র্যাডবেরী); কারণ কবিতা তোমার অনুভবের পেশীকে নমনীয় করবে। মতি নন্দী কবিতা পড়তেন, জ্যোতিরিন্দ্র নন্দীও। সবশেষে — লেখা। লেখো, লেখো, লেখো — আঙুল ভেঙে যাক — চেকভ বলছেন — মজার আর দু:খের, ভালো আর মন্দ — লিখে যাক। অনেকে জানেন — শিলাইদহে পদ্মা বোটে থাকাকালীন এক এক সময় রবীন্দ্রনাথ সকাল দুপুর সন্ধে লিখছেন আর লিখছেন। আদেশে রেখে যাওয়া হত — এক বাটি মুসুর ডাল। অনেক সময় তাও খাওয়া হত না। মার্কেজ-এর একশত বর্ষের নি:সঙ্গতা লেখার সময়ের পড়া আর লেখার ঢেউ-এর খবর এমনই। সত্যই A writer’s life is hard.
না:, পাঠকের ধৈর্যের ওপর আর অত্যাচার নয়। ‘পোস্টমাস্টার’ আমার গল্পগুচ্ছে ঠাসা ৩ পৃষ্ঠা। কল্পনা নিঙড়ে মোদ্দা প্রসঙ্গটি হল — কলকাতার এক বাঙালী যুবক ডাকমাস্টার হয়ে এসেছে সুদূর পল্লীতে, পদ্মাতীরে। ভীত, একাকী, প্রতিকূল রুচির জগতে কাজের মেয়ে রতন। ম্যালেরিয়া হয়ে আতঙ্কিত এই যুবক বদলির প্রার্থনা করে। না হলে ইস্তফা দেবে। ফেরা সম্ভব হল। রতনের সঙ্গে এই সামান্য দিনে একটা ‘সম্পর্ক’ গড়ে ওঠে।
সে দাদাবাবুর সঙ্গে তাদের বাড়িতে যেতে চায়। উত্তর — ‘সে কী করে হবে’। ফিরে যাবার ব্যগ্রতায় বালিকার দু:খ তাকে বিচলিত করে নি। এবার দেখি ছিন্নপত্র — ‘বাতিটি জ্বালিয়ে টেবিলের কাছে কেদারাটি টেনে বইখানি (কালিদাসের রঘুবংশ) হাতে যখন বেশ প্রস্তুত হয়ে বসেছি হেনকালে কবি কালিদাসের পরিবর্তে এখানকার পোস্টমাস্টার এসে উপস্থিত।’ যখন সাজাদপুর কুঠিবাড়ির একতলাতেই ‘পোস্ট অপিস’ ছিল তখন লেখক তাঁকে প্রতিদিন দেখতে পেতেন এবং এক দুপুরে এই দোতলায় গল্পটি লেখেন। পত্রিকায় লেখাটি বেরুতে পোস্টমাস্টার বাবু ‘বিস্তর লজ্জামিশ্রিত হাস্য বিস্তার’ করেছিলেন। রবীন্দ্রের পর্যবেক্ষণ — ‘বেশ নানারকম গল্প করে যান, আমি চুপ করে বসে শুনি। ওরই মধ্যে ওঁর আবার বেশ একটু হাস্যরসও আছে।’ এই লোকটিকে ‘বেশ লাগত’। জমিদারের আগ্রহেই বাড়ির একতলার ঘরে ডাকঘর। তখন নীলকরদের দিন শেষ। ফলে গল্পে যে গোমস্তা ইত্যাদি কর্মচারীর কথা আছে, তারা জমিদারীর কর্মচারী। বাস্তবের আত্মভোলা, বাতিকগ্রস্ত, গল্পবাগীশ, কিছুটা মজার পোস্টমাস্টারকে রবীন্দ্রনাথ বদলে অমিশুক, কবি, ঘরকুনো করে নিয়েছেন। তবে বাস্তবের ও গল্পের নায়ক কলকাতার কাছের ছেলে, অবিবাহিত, গণ্ডগ্রামে অস্বস্তি বোধ করে। বাস্তব লোকটির খাদ্যপ্রিয়তা বা মাইনে কম পাওয়া নিয়ে অভিযোগ, নানা তদ্বির নিয়ে লেখকের সঙ্গে আলোচনা গল্পে বাদ গেছে। নীলকর, মাইনে কম ইত্যাদি প্রসঙ্গ গল্পকে অন্য দিকে টান দিত। সংসারের খুঁটিনাটি নিয়ে আলোচনা চলে এসেছে রতনের সঙ্গে কথাবার্তার মধ্যে। গল্পের রতন বারো তেরো বছরের পিতৃমাতৃহীন অনাথা বালিকা, বাস্তবে রতন একজন অনাথা বিধবা, যাকে জমিদারের অনুরোধে রান্নাবান্নার জন্য ঠিক করে দেওয়া হয়। সমসাময়িক সমাজ ও বাস্তব লোকটির সম্ভাব্য বিপন্নতা এলে আবার গল্প অন্যদিকে চলে যেত। তাই লেখক রতনের বয়স কমিয়ে স্নেহময়ী কিশোরী রূপে তার দুঃখকে বর্ণনা করেছেন। বয়স্ক রতন থাকলে রতন ও পোস্টমাস্টারের দুঃখ অন্যরকম হত, এমন গল্প কম লেখা হয় নি। কিশোরী রতনের দুঃখ তাই কাব্যিক, ব্যঞ্জনাময়। ‘এই নিতান্ত নিঃসঙ্গ প্রবাসে ঘনবর্ষায় রোগকাতর শরীরে একটুখানি সেবা পাইতে ইচ্ছা করে। তপ্ত ললাটের উপর শাঁখাপরা কোমল হস্তের স্পর্শ মনে পড়ে। এই ঘোর প্রবাসে রোগযন্ত্রণায় স্নেহময়ী নারীরূপে জননী ও দিদি পাশে বসিয়া আছেন, এই কথা মনে করিতে ইচ্ছা করে।’ এই অনুভব পোস্টমাস্টারের, লেখকেরও, কারণ লেখকও তখন ঘোর প্রবাসে, রোগকাতর শরীরের কষ্ট স্বাভাবিক। মৃণালিনীর সঙ্গে রবীন্দ্রের বিয়ে ১২৯০ (ইং ১৮৮৩ ডিসেম্বর) আলোচ্য গল্প তার আট বছর পরে লেখা। গল্পের নায়ককে করা হল অবিবাহিত। গল্পের পোস্টমাস্টার বদলির আদেশ পেয়ে চলে যায়, বাস্তবে রবীন্দ্রনাথ কার্যভার ত্যাগ করে অন্যত্র যান। প্রমথনাথ বিশী মন্তব্য করছেন — ‘লোকটি ও কবি দুজনেই প্রবাসী, ঐখানে দু’জনের হৃদয় স্পর্শ করে। দুজনেরই স্বজন-বিচ্ছেদ-বেদনা।’ (শিলাইদহে রবীন্দ্রনাথ, পৃ. ৪২) প্রমথবাবু খাঁচার পাখি ও বনের পাখির কথা তোলেন। একটু অসঙ্গত কল্পনা। রবীন্দ্রনাথ বলেন — ‘এই জমিদারী দেখা উপলক্ষ্যে নানা রকমের লোকের সঙ্গে মেশার সুযোগ হয় এবং এই থেকেই আমার গল্প লেখারও শুরু হয়। (শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথ, জিতেন্দ্রলাল বন্দ্যোপাধ্যায়, সুপ্রভাত, ভাদ্র ১৩৯৬) অন্যত্র বলছেন — ‘গ্রাম্যজীবনের পথচলতি কুড়িয়ে পাওয়া অভিজ্ঞতার সঞ্চয় সাজিয়ে লিখেছি গল্প।’ (প্রভাত গুপ্ত, প্রবাসী বৈশাখ ১৩৪৪) কিংবা ‘পল্লীপ্রকৃতির সঙ্গে আমার চোখে চোখে পরিচয় হয়েছিল’; (হেমন্তবালাকে পত্র) ‘আমার রচনাতে আছে পল্লী পরিচয়ের অন্তরঙ্গতা।’ (প্রবাসী, বৈশাখ ১৩৪৭) গল্পগুচ্ছ ১ম ও ২য় খণ্ডের নানা গল্পে এই কথা প্রমাণিত — ‘গল্পে বাস্তবের অভাব কখনো ঘটে নি।’ তবে রবীন্দ্র ভালোভাবেই জানেন — ‘গল্প ফটোগ্রাফ নয়। যা দেখেছি যা জেনেছি তা যতক্ষণ না মরে গিয়ে ভূত হয় ... গল্পে তাদের স্থান হয় না। ফিলিপ রথ, রবীন্দ্রমাপের লেখক নন অবশ্যই, উপলব্ধি একই — What’s taken directly from life, helps to place and fix a book’s level of reality’ এবং specific situation অনুযায়ী উপাদান গ্রহণ বা বর্জন করতে হয়। বাস্তবে পোস্টমাস্টার ‘নানারকম গল্প’ করতেন, লেখক শুনতেন, কিন্তু গল্প সাজাতে গিয়ে গ্রহণ বর্জন চলে। মাস্টারের তামাকপ্রিয়তা, প্রস্তুত স্নানের জল, এসব ছিল। নিজে রেঁধে খেত, বাস্তবের সঙ্গে ফারাক। মাকে মনে পড়ার কথা, রতনের ছোটভাইয়ের কথা, পোস্টমাস্টারের ভাই, মা, দিদির কথা একটা অনুষঙ্গ তৈরি করে, ‘তোকে আমি একটু একটু করে পড়তে শেখাব’ একথা অনুষঙ্গের সম্পর্ক বয়নের মাত্রা বাড়ায়। কিন্তু — ‘কালই যাচ্ছি’; রতন একথা শুনে সঙ্গে যেতে চায় উত্তর পায় — 'সে কি করে হবে।' নির্মম বাস্তব। ‘আমার জায়গায় যে লোকটি আসবেন, তাকে বলে দিয়ে যাব তিনি তোকে আমারই মতন যত্ন করবেন’, এভাবে ব্যক্তিসম্পর্ক মুহূর্তে নৈর্ব্যক্তিক হয়ে যায় — ‘আমি যাচ্ছি বলে তোকে কিছু ভাবতে হবে না’ — এ কথা হয়ে ওঠে প্রত্যাশার কপোলে আঘাত। পোস্টমাস্টার এবার পাঠকের যাবতীয় সহানুভূতি হারায়। জীবনের এই নির্মমতা অনেক পরে প্রেমেন্দ্র মিত্রের ‘তেলেনাপোতা আবিষ্কার’ গল্পে আছে। দুটি ক্ষেত্রেই লালিত আশার আকস্মিক অপমৃত্যু।
এটা ঠিকই যে পোস্টমাস্টার চরিত্রে ‘কোনো বিস্ময়কর স্বভাবগত জট বা রহস্য নেই; তাকে রক্তমাংসের সহজ পরিচিত মানুষ হিসেবে আঁকা হয়েছে।’ (ক্ষেত্র গুপ্ত)। ক্ষেত্রবাবু আমাদের দেখান গল্পের নায়ক ‘কখনো কখনো দুটো একটা কবিতা লিখিতে চেষ্টা করেন’ যাতে তরুকম্পন ও মেঘ দেখে জীবন সুখে কেটে যায়। কিন্তু তার বাস্তব বিপরীত — সেখানে গোয়াল ঘরের ধোঁয়া, ঝিল্লির ডাক, নেশাখোর বাউলের খোল করতাল বাজিয়ে উচ্চৈস্বরে গান। এই বৈপরীত্যের আয়রনি গল্পগুচ্ছে অন্যত্রও আছে। আর একটি সিচুয়েশন লেখক রচনা করেছেন — এক বর্ষার দুপুরে রৌদ্রে ভিজে ঘাস ও গাছপালা থেকে ওঠা গন্ধ যেন ‘ক্লান্ত ধরণীর উষ্ণ নিশ্বাস’ আর পাখির একটানা সুরের নালিশ একাকীত্বকে তীব্রতর করত। ছিন্নপত্রে একাকীত্ব, নিবিড় প্রকৃতির সান্নিধ্য রবীন্দ্রের কাছেও তেমনি। রোদে ভেজা ঘাসের গন্ধ, ‘ক্লান্ত ধরণীর উষ্ণ নিশ্বাস’, ‘পাখির সুরের নালিশ’, ‘রৌদ্র উন্মোচিত মেঘস্তর’ রবীন্দ্রের চিত্রায়ণের অপূর্ব দক্ষতার নিদর্শন। এই অকারণ বেদনা নিঃসন্দেহে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের যা ‘পাগল’ প্রবন্ধেও ব্যক্ত। এভাবে ক্ষণকালে লেখক-ভাবনা নায়ক-ভাবনা একত্র চলায় এগোয়। গল্পান্তে যে ‘বিশ্বব্যাপী বৃহৎ অব্যক্ত’ বেদনা তা ছিন্নপত্রে, গল্পে, কবিতায় শান্তিনিকেতন প্রবন্ধমালায় ব্যক্ত হয়েছে। খণ্ডের মধ্যে অখণ্ড, ক্ষুদ্রের মধ্যে বৃহতের আবিষ্কার রবীন্দ্র মানসলোকের মৌল ধর্ম। পদ্মা এ গল্পে আড়াল থেকে মাত্রা যোগ করেছে। পদ্মা না থাকলে পোস্টমাস্টার বা লেখকের বেদনা আবেদন পেত না। একই বেদনাকে ভিন্ন ক্ষেত্রে দেখার ইচ্ছা রবীন্দ্রনাথের, তাই পোস্টমাস্টার গল্পের আত্মীয়স্বজন বিচ্ছিন্নের বেদনা বছরখানেক পরে লেখা ‘ছুটি’ গল্পেও ব্যক্ত — প্রমথ বিশী একথা বলেন ‘রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্প’ বইটিতে। রবীন্দ্র-গল্পে লিরিক আবেদনের কথা অনেকসময় বলা হয়। পোস্টমাস্টারের কবিতা লেখা, একাকীত্বের বেদনা, ছুটির দিনের মধ্যাহ্নে ভাবের উদয়, মেঘস্তর দেখা ইত্যাদিতে লিরিকত্ব আছে এবং শেষ দুই অনুচ্ছেদে লিরিকত্ব চূড়ান্ত। কিন্তু টোট্যাল অ্যাপ্রোচে সামাজিক বাস্তবতা অপেক্ষা লিরিক্যালিটি অধিক। গল্পগুচ্ছের বৈশিষ্ট্যই তাই। প্রায় অধিকাংশ গল্পেই গীতিকবিত্ব বড়ো হয়ে ওঠে, যদিও সমাজবাস্তব চেতনা অনেক গল্পে স্পষ্ট, ঠিক আগের গল্পে (দেনা পাওনা) যেমন। আবার পরের দুটি গল্পে (গিন্নি, রামকানাইয়ের নির্বুদ্ধিতা) তা নেই। একটা ফ্যান্সি আছে ৩য় অনুচ্ছেদে তা হল — নগরাগত ডাকবাবু যদি আরব্য উপন্যাসের দৈত্য কৃপায় অট্টালিকা ও প্রশস্ত রাজপথ পায় রাতারাতি তাহলে নবজীবন পেতে পারে। এই ফ্যান্সি অবশ্য এ গল্পে প্রশ্রয় পায় নি, যা পেয়েছে ‘ক্ষুধিত পাষাণে’।
গল্প শেষের ঠিক আগের অনুচ্ছেদে একটি চমৎকার চিত্রকল্প আছে। তা হল — ‘বর্ষাবিস্ফারিত নদী ধরণীর উচ্ছ্বলিত অশ্রুরাশির মতো চারিদিকে ছলছল করিতে লাগিল’; হৃদয় মধ্যে জাগল বেদনা। নদীতরঙ্গ ও উচ্ছ্বলিত অশ্রুর তুলনা বা সমুদ্রজলে ক্ষুধিত দৈত্য কল্পনা রবীন্দ্রনাথের অন্য লেখায় আছে। কিন্তু বেদনা পোস্টমাস্টারের? আর প্রত্যাবর্তনের অসম্ভবত্ব (তখন পালে বাতাস পাইয়াছে ইত্যাদি) ‘অতিথি’ গল্পে পুনরায় ফিরে আসে। আসলে এ বেদনা, অশ্রুউচ্ছ্বসিত অবস্থান রতনের। জীবনে বিচ্ছেদ অনিবার্য একথাও রবীন্দ্রনাথ স্পষ্টত: অস্পষ্টত: অনেকবার বলেছেন। রতনের মনোভঙ্গের বেদনা — ‘হায় বুদ্ধিহীন মানবহৃদয়’ ইত্যাদিতে প্রকাশ। যা সে সময়ের বা কিছু আগের ইংরেজি গল্পের স্টাইল। বিশেষত: শেষ অনুচ্ছেদ না থাকলে ক্ষতি ছিল না। ক্ষেত্র গুপ্তের-ও এটা ‘স্বতোৎসারিত’ মনে হয় নি। আনোয়ার পাশা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন এই না পাওয়ার বেদনার, অশ্রুজলের পিছনে বাস্তবের কোনো ব্যাপার ছিল না। রতন কিশোরী না হয়ে বাস্তবের বয়সী হলে তা হতে পারত। জলের মাছকে ডাঙায় তোলার চিত্রকল্প পোস্টমাস্টার এবং ফটিক দুজনের ক্ষেত্রেই প্রযুক্ত, ‘বধূ’ কবিতাতেও তাই। প্রশান্ত কুমার পাল বলেছেন এই ‘গল্পটি বাস্তব ও কল্পনার একটি চমৎকার সংমিশ্রণ’ যা রবীন্দ্রনাথ নিজেও বলেছেন অনেক পরে। কথাটার নানা অর্থ হতে পারে। বাস্তব অভিজ্ঞতা ও গল্পের প্রয়োজনে কল্পনা ব্যবহারও হতে পারে। কাজী আবদুল ওদুদ বলেছিলেন হিতবাদী যুগের ‘একমাত্র মহাপ্রাণ গল্প’। কথাটির মধ্যে অতিশয়োক্তি আছে। বরং নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের মন্তব্য শিরোধার্য — ‘প্রায় ঘটনাবিহীন, ইঙ্গিতধর্মী, ব্যঞ্জনাময় এই গল্প সেকালের বাংলা সাহিত্যে সম্পূর্ণই অভিনব।’ এ তাঁর ‘পরমতম সিদ্ধি’। নারায়ণবাবু দেখেছেন এ গল্পে প্রকৃতি যেমন পোস্টমাস্টার ও রতনকে মিলিয়েছে তেমনি ঘটেছে বিচ্ছেদ।
গোপিকানাথ রায়চৌধুরী এই গল্পটির প্রকরণ সম্পর্কে কতকগুলি চমৎকার মন্তব্য করেছেন। সেগুলি একে একে হাজির করি। (উৎস: রবীন্দ্রনাথ: ছোটগল্পের প্রকরণশিল্প) আলোচক বলতে চান ছোটগল্পে শুকনো আবরণের তলায় নিহিত থাকে কবিতার তীব্র সুবাস। (পৃ. ৫) রবীন্দ্রনাথের গল্প তার উৎকৃষ্ট নিদর্শন। মোপাসাঁর গল্পে সাধারণত থাকে একটা আকর্ষক আখ্যান। কিন্তু এমন কিছু গল্প আছে যা আধুনিক, যা plotless fiction, রবীন্দ্রনাথের অনেক গল্পই তাই। তাঁর চমকহীন সমাপ্তির গল্প — পোস্টমাস্টার, একরাত্রি, ছুটি, অতিথি। বিদায় মুহূর্তে নৌকায় উঠে পোস্টমাস্টারের মন ব্যথাতুর রতনের জন্য, আবার ‘পৃথিবীতে কে কাহার’, অন্যদিকে রতন ভাবে যদি ‘দাদাবাবু ফিরে আসে’, একেই তিনি বলেন suggesting continuity-র স্বাক্ষর। (পৃ. ২৪) ‘পোস্টমাস্টার’ গল্পের পটভূমিতে আছে একটি ‘অতি সামান্য গ্রাম’ এবং সে গাঁয়ের এক ছোট্ট পোস্ট আপিস — জায়গাটি অপেক্ষাকৃত নির্জন, কাছে পানাপুকুর, চার পাড়ে জঙ্গল। এই পরিবেশ ও বর্ষা ঋতু আবহকে করে তুলেছে অর্থবহ। সময়বাহিত নির্জনতা। গল্পের শুরুতেই এই দুটি চরিত্রকে ঘিরে সময়ের এই বিষণ্ন পশ্চাদগামি প্রবণতা। লক্ষণীয় — নিত্যবৃত্ত অতীতকালের প্রয়োগ (রাত হইয়া যাইত, রাঁধিতে ইচ্ছা করিত না, রতন রুটি সেঁকিয়া আনিত ইত্যাদি) রতন যখন পোস্টমাস্টারের চলে যাওয়ার কথা শুনল তখন এক অসামান্য চিত্রকল্পের ব্যবহার (জীর্ণ চাল ভেদ করে মাটির সরায় টপ টপ করে বৃষ্টির জল পড়তে লাগল)। জীর্ণ জীবন মাটির সরার, ছোট্ট মলিন জীবন রতনের, অন্যদিকে সকালে মাস্টারের নৌকো ভেসে যাওয়া, ভাসমান পথিক হৃদয়, শ্মশান, আস্তে আস্তে পালে বাতাস — বিচ্ছেদের গতিপ্রাপ্তি। (পৃ. ৫৩-৫৫) পাঠক লক্ষ্য করবেন নদী পরিবেশের প্রয়োগশিল্প অন্তত ১১টি গল্পে, যার মধ্যে পোস্টমাস্টার ২য় গল্প। পরিবেশ কখনও শুধু অলঙ্করণ করে, কখনও অপরিহার্য। রবীন্দ্রগল্পে দ্বিতীয়টি বেশী। চেকভ প্রসঙ্গে আর্নল্ড বেনেট বলেন সেখানে জীবনসত্য আসে magnificent commonplace world থেকে। রবীন্দ্রনাথের গল্পেও তাই। পরিবেশের সঙ্গে জীবনের নানামুখী যোগ সাধনের অনন্য শিল্পদক্ষতার প্রকাশ রবীন্দ্রনাথে। এ গল্পে তার নিদর্শন মেলে। এখানে চাকরি ছেড়ে কলকাতা অভিমুখে নদীপথে যাত্রা আর রতন সম্পর্কে তার ভাবনা মিলেমিশে যায় — এখানেই শেষ দুই অনুচ্ছেদের সার্থকতা। (পৃ. ৮০ - ৮২) ফ্র্যাঙ্ক ও'কোনর ছোটগল্পে চরিত্রের নিঃসঙ্গতার চেতনার কথা বলেন; পোস্টমাস্টার ও রতনের মাধ্যমে তা চমৎকার অভিব্যক্ত। যারা ও'কোনর কথিত সেই submerged people--পোস্টমাস্টার, ফটিক, রাইচরণ, দেনাপাওনা ও জীবিত ও মৃতর গ্রাম্য বধূ বা বাল্য বিধবা। (পৃ. ৯৩)
একটু ঘুরিয়ে প্রমথ বিশী বলেছেন পদ্মা না থাকলে পোস্টমাস্টারের বেদনা ফুটে উঠত না। নারায়ণবাবু পুশকিনের একই নামের একটি গল্পের কথা তুলেছেন। বিষয়ের দিক থেকে গল্প দুটির মধ্যে কোনো সাদৃশ্য নেই — তবু কোথায় যেন একটু সম্পর্ক পাওয়া যায়। দুটিরই মূল কথা বিচ্ছেদ বেদনা, পুশকিনের পোস্টমাস্টার কন্যা বিরহে অতিরিক্ত মদ্যপানে প্রায় আত্মহত্যা করেছে, রবীন্দ্রনাথের গল্পে মানুষের পরিবর্তে প্রকৃতি এসে রতন আর পোস্টমাস্টারকে বিছিন্ন করে দিয়েছে। তবে এই মিল যথার্থ নয় এমন কথাও কেউ কেউ বলেছেন।
ছোটগল্পের অপরিহার্য শর্ত নিয়ে আজ পর্যন্ত অনেক আলোচনা হয়েছে। আমার মনে হয় — ছোটগল্প চেনার প্রধান বৈশিষ্ট্য — আদ্যন্ত suggestiveness বা সাংকেতিকতা। ‘টেল’ জাতীয় গল্পে বিশদ করার প্রবণতা থাকে, আদর্শ ছোটগল্পে তা সচেতনভাবেই বর্জন করা উচিত। তবে যুগ ভেদে, কাল ভেদে, দেশ ভেদে এই সাংকেতিকতার পরিমাণ কম বেশী হতে পারে। কিন্তু চাই সাংকেতিকতা। ‘পোস্টমাস্টার’ গল্পটি প্রথম যুগের গল্প। কিন্তু লেখক এই সাংকেতিকতা আয়ত্ত করতে সমর্থ হয়েছেন। গল্পর সূচনা নগরাগত প্রথম চাকুরে অবিবাহিত যুবকের কিছু পরিচয়, ধীরে কাজের মেয়ের সঙ্গে পরিচয়, পারস্পরিক পরিচয়, অসুস্থতা, বদলির প্রার্থনা, বিরূপ আবহ থেকে বিদায় — এই তো গল্প। প্রথম কয়েকটি পঙ্ক্তিতেই ডাঙায় তোলা জলের মাছের সঙ্গে পোস্টমাস্টারের ‘দশা’র কথা। বিপন্ন মানুষটির ফ্যান্সি আরব্য উপন্যাসের অলৌকিকতা সহযোগে নগরের সামীপ্য। পোস্টমাস্টারের অনুরোধেই কাজের মেয়ে ঘরের মেয়ে হিসেবে বাবা, ছোট ভাই, মিছামিছি মাছধরা খেলার স্মৃতি জাগায়। গোয়ালের ধোঁয়া, ঝিল্লির ডাক, নেশাখোর বাউলের উচ্চৈঃস্বরে গান আর নীলকুঠির গোমস্তারা কর্কশ বাস্তবের উপকরণ। এর বৈপরীত্যে কাব্যকল্পনার আশ্রয়। ক্লান্ত ধরণীর উষ্ণ নিশ্বাস, পাখির সুরের নালিশ, মেঘস্তর দেখা — এইসব ‘ভাবের উদয়’ তার পরিবর্ত বাঁচার সামগ্রী, যদিও কবিত্ব ও কার্কশ্যের দ্বন্দ্ব মুখ্য ভূমিকা নেয় নি। তবে বর্ষা যে জাগরণের ঋতু — রবীন্দ্র উপলব্ধি এ গল্পেও কাজ করেছে। রতনের মনে বাল্যতা জাগানো আর অসুস্থতায় মাস্টারের মনে নিকটজনের ‘কোমল হস্তের স্পর্শ’ আনা হয় পরিস্থিতির চাপে। পড়তে শেখানোর প্রস্তাব-ও উদ্দীপক। রতনের জননী পদ গ্রহণে বসিল, আনিল, খাওয়াইল, জাগিয়া রহিল, রাঁধিয়া দিল, শতবার জিজ্ঞাসা করিল ক্রিয়াপদ ব্যবহারের হঠাৎ ভিন্নতা এক ধাপ ঘনিষ্ঠতার দ্যোতক। যুক্তঅক্ষর শেখার মুহূর্তে সম্পর্ক সহসা বিযুক্ততার পথ ধরে। সংলাপ নয়, বর্ণনা এ গল্পে মুখ্য। আকস্মিক প্রত্যাশা ভঙ্গের অশ্রুজল অসামান্য ভাষা ব্যবহারে ব্যক্ত — ঘরের চাল ভেদ করে টপটপ করে বৃষ্টির জল পড়া। এখানে লক্ষ্য করতে হবে ঘরের জীর্ণ চাল রতনের জীর্ণ জীবন, মটির সরা তার অতি তুচ্ছ জীবন, বৃষ্টির জল অশ্রুজল প্রকাশক। কতকটা এমন অসামান্য সাংকেতিকতা আছে ‘চোখের বালি’তে আহত বিনোদিনীর সামনে প্রজ্জ্বলন্ত মোমের উল্লেখে। মনে পড়ে ড. জিভাগো উপন্যাসে নিঃসঙ্গ নায়কের যন্ত্রণা মোমবাতির প্রজ্জ্বলনে।
অনাথা কিশোরী যখন স্নেহলতা গড়ার স্বপ্ন দেখছিল তখন সঙ্গে যাবার অনুরোধ ‘তা কি করে হবে’ সংলাপে চুরমার হয়, পরবর্তী মাস্টারকে আমারই মত যত্ন করার কথা বলে দিয়ে যাব — আঘাত তীব্রতর করে। ঘনিষ্ঠতা এক ধাক্কায় যান্ত্রিকতায় পর্যবসিত হয়। তাই অভিমান — কাউকে কিছু বলতে হবে না। ‘অবাক’ হওয়া ডাকবাবুর কল্পনাশূন্য অপদার্থতার প্রকাশক। চলে যাবার সময় ‘কিছু দিয়ে গেলুম’ পুনরায় আঘাত। রতনের দুঃখের তীব্রতা রবীন্দ্রনাথ নিজে বললেন না, রতনের এক দৌড়ে পালানো — সেই অসামান্য telling নয়, showing যা ওয়েন বুথ বলছেন অনেককাল পরে। বর্ষা-বিস্ফারিত নদী হয়ে ওঠে রতনের তীব্র দুঃখের সাংকেতিক প্রকাশে ‘উচ্ছলিত অশ্রুরাশি’ — এই সাংকেতিকতা রবীন্দ্রনাথ সেই বয়সে কিভাবে রপ্ত করলেন তাই ভাবি। জীবনকে নদীপ্রবাহ ভাবা, বিচ্ছেদ ও মৃত্যুকে জেনেও তাকে চিরস্থায়ী মনে না করা গল্পগুচ্ছে অনেক আছে। বিদেশী গল্পে, চেকভের প্রতিভা দ্যুতিতে তেমন বোধহয় পেয়েছি। পরিত্যক্ত কথাটি লেখক ব্যবহার করলেন না, বললেন চোখের জলে কেবল রতনের ঘুরে বেড়ানোর কথা। ভাবাবেগ না যুক্তিশাস্ত্র, জড়িয়ে ধরা না হারানো — এও রবীন্দ্রনাথ বলেন গল্পে নানাভাবে। গল্পজীবনের প্রথম পর্যায়েই সাংকেতিকতার এই আশ্চর্য নৈপুণ্য আমাকে অন্তত বারংবার বিস্মিত করে যায়। এটাও আমার মনে হয়, ছোটগল্পের শিল্পত্ব প্রশ্নে গল্পগুচ্ছের ১ম দুটো খণ্ডের কিছু গল্প নির্দ্বিধায় স্থান করে নিতে পারে। পরের পর্যায়ের গল্প কিছু মানুষের প্রিয়, কিন্তু পূর্ব পর্যায়ের গল্প বহু মানুষের প্রিয়।