রবীন্দ্রনাথ শুধু বাংলা বা ভারতবর্ষের বিশিষ্ট কবি নন, সারা বিশ্বে তাঁর ব্যক্তি ও রচনার অভিঘাত নানাসময়ে নানাভাবে দেখা গেছে। ফ্রানসিসকো গারফিয়াস, যিনি হিমেনেথের অনূদিত রবীন্দ্রসাহিত্য সম্পাদনা করেছেন, তিনি বলেছিলেন, 'রবীন্দ্রনাথের আর্বিভাব স্পেনের কবিতার ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত'। আপাতদৃষ্টিতে মন্তব্যটি বিস্ময় সৃষ্টি করতে পারে, কিন্তু মন্তব্যের পশ্চাত্পট একেবারে ফাঁকা নয়। ষাট ও সত্তর দশকেও স্পেনে ছিল 'প্রেমিও দ পোয়েজিয়া রবীন্দ্রনাথ তাগোরে' নামের পুরস্কার, কোনো একজন স্পেনীয় কবিকে তা দেওয়া হত। স্পেনে কিছু নাট্য প্রতিষ্ঠান আছে যা রবীন্দ্র নামাঙ্কিত। কোস্টারিকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র Alfonso Chacon R. রবীন্দ্রনাথ ও লাতিন আমেরিকান সাহিত্য নিয়ে গবেষণামূলক বহু আলোচিত প্রবন্ধ লিখেছেন, ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের দুজন বড়ো দার্শনিক ও চিন্তাবিদ্ Emma Gamboa এবং Roberto Brenes M রবীন্দ্র শিক্ষাচিন্তার ব্যাপক প্রয়োগ করছেন, ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃতজ্ঞ Sol Arguello এক দশকেরও বেশি সময় রবীন্দ্রনাথ বিষয়ে সেমিনার দিচ্ছেন, কুড়িটি সেমেস্টারে তিনি রবীন্দ্রনাথ পড়াচ্ছেন, বিশ্লেষণ করছেন, রবীন্দ্রনাটক অভিনয়ের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। সবচেয়ে বড়ো কাজটি Jose Pas Rodriguez -এর, যিনি মাদ্রিদের অনতিদূরে এক বিশাল গ্রন্থাগার গড়ে তুলেছেন, যাতে প্রায় কুড়িহাজার রবীন্দ্র এবং রবীন্দ্র বিষয়ক গ্রন্থ সংগৃহীত হয়েছে। তিনি রবীন্দ্র শিক্ষাচিন্তার তুলনামূলক প্রেক্ষিত নিয়ে পি.এইচড়ি. করেছেন, রবীন্দ্রনাথের ডাকঘর ও অন্যান্য কয়েকটি নাটক অভিনয় করিয়েছেন, তার কিছু ছবি আমি দেখেছি। পাস জানিয়েছেন, এখনো শিশু এবং ডাকঘর বই দুটির জনপ্রিয়তা অক্ষুণ্ণ। কেন এই জনপ্রিয়তা, তাঁরা এই দুটি বইকে কিভাবে ব্যাখ্যা করছেন, বাঙালি রসজ্ঞদের ব্যাখ্যার সঙ্গে তার মিল অমিল কোথায় এসব নিয়ে তুলনামূলক কৌতূহল চর্চার সুযোগ তৈরি হয়েছে বলে মনে হয়।
রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে বিভিন্ন সময়ে বেশ কিছু কবিতা লেখা হয়েছে স্পেনীয় ভাষায়। যেমন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পুরস্কার প্রাপ্ত (১৯৮৫) হোসে লোপেজ মার্তিনেজ লেখেন - 'তোমার শব্দের পদচিহ্ন' , যার দ্বিতীয় অনুচ্ছেদ — 'আমি জন্মাতে চাই / বোলপুরের পাশে তোমার আশ্রম / শান্তিনিকেতনের কবিতার মধ্যে, / যাতে একা একা / তোমার নিসর্গ আর / তোমার মনীষা থেকে / আবিষ্কার করতে পারি / কবিতার ভাষা। ' বিখ্যাত কবি রাফায়েল আলবের্তি ১৯২৪-এ লিখেছিলেন 'রবীন্দ্রনাথের প্রতি', — 'আমাকে আঁকতে দাও নীলে / মানচিত্রের সমস্ত সমুদ্র / আর তুমি আমায় সম্ভাষণ করো / জলের বুকে ভোরের উদ্ভাসিত গানে ....।' Juan Perez Creus লিখেছিলেন - 'স্পেন - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রতি - একটি এলিজি' যাতে রবীন্দ্রনাথকে বলা হয়েছিল - 'কবিদের কবি'। Jose Maria Peman লিখেছিলেন - 'স্তোত্রায়ন, স্পেন থেকে'। কেতকী কুশারী ডাইসন Nacion পত্রিকা থেকে ১৯২৪ এর দুটি কবিতার উল্লেখ করেন, Carmen A Latino এবং Margarita Abella Caprile র দুটি কবিতার অংশ। হিমেনেথ শুধু রবীন্দ্রনাথ অনুবাদ করেননি, তিনি এই অনুবাদ সূত্রে অন্তত ১৬টি রবীন্দ্র প্রসঙ্গিত কবিতা রচনা করেন। এগুলি বাঙালির কাছে সুপরিচিত, শ্যামাপ্রসাদ গাঙ্গুলী ও শিশির কুমার দাশ রচিত 'রবীন্দ্রনাথ ও স্পেন' বইটির সৌজন্যে। ১৯৪৫ এ নোবেল প্রাপ্ত গাব্রিয়েলা মিস্ত্রাল রবীন্দ্রনাথকে শ্রদ্ধার্পণ করে কয়েকটি কবিতা ও একটি অন্তত: গদ্যরচনা উপস্থিত করেন। কবিতার একটি অংশ - 'তুমি, আমার প্রভু, ক্ষমা করো এমন কথায়। ওদের ছিল তৃষ্ণা, আমারও ছিল তৃষ্ণা, তাকালাম স্বচ্ছতা ও অমলিনতা নিয়ে তোমার দিকে লিলি ফুলের পাপড়ির মতো।' অথবা - 'এই ছোট্ট ফুলটিকে নাও তুলে। ভয় হয় এ যাবে শুকিয়ে, ঝরে যাবে এর পাতা সেও যাবে পড়ে আর ধুলোর সঙ্গে যাবে একাকার হয়ে।' হিমেনেথ এবং মিস্ত্রালের মৌলিক কবিতাতে রবীন্দ্র কবিতার অনুরণন শোনা যায় - সমালোচকরা এমন বলে থাকেন।
পাবলো নেরুদার সর্বাধিক জনপ্রিয় কবিতার বই 'কুড়িটি প্রেমের কবিতা ও একটি হতাশার গান', যাতে ১৬নং কবিতাটি রবীন্দ্রনাথের একটি বিখ্যাত গান ('তুমি সন্ধ্যার মেঘমালা, তুমি আমার সাধের সাধনা, / মম শূন্যগগন বিহারী।') অবলম্বনে লেখা। এ নিয়ে কিছু অবাঙ্ছিত বিতর্ক উপস্থিত করেন Pablo de Rokha এবং Vicente Huidobro। নেরুদা রবীন্দ্রনাথকে দেখে (১৯২৭) শ্রদ্ধাপ্লুত চিত্তে লেখেন - 'ঠাকুরের মতো এতো ভালোভাবে আর কেউ পোশাক পরতে পারেন না, আমি তাঁকে দেখেছি, আর সাদা রঙের নিমা পরিহিত, তিনি যেন স্বংয় ঈশ্বর-পিতা'। আর একজন নোবেল পুরস্কার প্রাপ্ত Octavio Paz বলেন - রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে লাতিন আমেরিকার সম্পর্ক - multiple, Complex এবং Passionate। তিনি এক প্রবন্ধে বলেন - রবীন্দ্র কবিতা মৌলিক এবং অদ্ভুত ও বিস্ময়বহ। গান্ধী ও রবীন্দ্রনাথের তুলনা করে বলেন, দুজনের মধ্যে সাদৃশ্য, বৈসাদৃশ্য দুইই আছে। রবীন্দ্রনাথ যেন কবি ও সন্তের মধ্যে কথোপকথন সম্ভব করেছিলেন। তবে, রবীন্দ্রনাথ - 'চিন্তক ছিলেন না, ছিলেন এক মহান কলাকার।' ১৯২০ থেকে ১৯৩০ এর মধ্যে তিনি স্পেনীয় জগতে শুধু সাহিত্যগত নয় ব্যক্তিগত প্রভাবও বিস্তার করেছিলেন। রবীন্দ্ররচনায় প্রতিমুহূর্তে চলেছে আত্ম ও বিশ্বের মধ্যে বাক্বিনিময়, তাঁর লেখায় পাওয়া যাবে সনাতন ভারতীয় উপাদান এবং পশ্চিমী উপাদানের পারস্পরিক প্রবেশ। (Los Manuscritos de Tagore) স্পেনীয় কবি ফেদেরিকো গার্সিয়া লোরকা বিশের দশকের মাঝামাঝি আকৃষ্ট হয়েছিলেন স্পেনীয় মিস্টিক, আগস্টিন-এর আত্মস্বীকারোক্তি, গয়টের ফাউস্ট, ভারতীয় দর্শন এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতায়। ১৯২১ এর প্রথম দিকে তিনি সময় পেলেই হিমেনেথ দম্পতীকে সাহায্য করছিলেন রবীন্দ্রনাথের সম্ভাব্য আগমন বিষয়ক আয়োজনে। তিনি এবং বুনুয়েল 'বিসর্জন' নাটকের অভিনয়েও অংশ নেবার তোড়জোড় করছিলেন। (LorCa : A Dream of Life - Leslie Stainton, Pg. 24, 78) এটাও অনেকেরই জানা যে ১৯১৮ থেকেই রবীন্দ্রনাথের স্পেন সফরের ইচ্ছাপ্রকাশ, চিঠিপত্র আদানপ্রদান, তোড়জোড় চলছিল। হিমেনেথ দম্পতির খুবই আশা ছিল রবীন্দ্রনাথ আসবেন— হোটেলে থাকার ব্যবস্থা, সম্বর্ধনার আয়োজন, রবীন্দ্রনাটকের রিহার্সাল সবই প্রস্তুত ছিল। কিন্তু কোনো অস্পষ্ট কারণে রবীন্দ্রনাথের স্পেন সফর হয়ে ওঠেনি। রবীন্দ্রনাথের লাতিন আমেরিকা সফরের কথাটাও সংক্ষেপে এখানে বলে নেওয়া যাক। ১৯২৪ এ কলকাতায় পেরুর রাজদূতাবাসে রবীন্দ্র-অভ্যর্থনা হয়, তাঁকে আমন্ত্রণ জানানো হয় আয়াকুচো বিজয়ের উত্সবে যাবার জন্য। তিনি রওনা হন। পেরুর সঙ্গে চিলির সম্পর্ক ভালো ছিল না। পেরু এ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ চাইছিল আর্জেন্টিনার।
রবীন্দ্রনাথ বুয়েনোস আইরস পৌঁছান ৬ই নভেম্বর, ১৯২৪। জাহাজে উঠে রবীন্দ্রনাথকে সম্বর্ধনা জানান নানা প্রতিষ্ঠানের গণ্যমান্যগণ, তাছাড়া দর্শন বিভাগ, শিক্ষা বিভাগের গণ্যমান্যরা ছিলেন। সম্বর্ধনা সমিতির সভাপতি ছিলেন Ricardo Rojas। রবীন্দ্রনাথ অসুস্থতাবশত: আর পেরু যেতে পারেন নি। অগত্যা প্রায় দুমাস তিনি আর্জেন্তিনাতে কাটান, ভিক্তোরিয়া ওকাম্পোর আতিথ্যে Miralrio বাড়িতে। আর্জেন্তিনার নানা স্থান তিনি পরিদর্শন করেন, বহু তরুণ লেখক শিল্পীর সঙ্গে তিনি পরিচিত হন। রবীন্দ্রজীবনে এই আর্জেন্তিনা সফর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। 'পূরবী' কাব্যের কয়েকটি উল্লেখযোগ্য কবিতা এখানে রচিত হয়, 'পূরবী' যাঁকে উত্সর্গ করা হয় সেই 'বিজয়া' হলেন ওকাম্পো। এখানেই তাঁর চিত্ররচনার ব্যাপকতার সূত্রপাত। এখানে বলে রাখা দরকার ভিক্তোরিয়া ওকাম্পো ছিলেন Sur পত্রিকার সম্পাদিকা, নারী আন্দোলনের মুখপাত্রী। তাঁর বন্ধুদের মধ্যে ছিলেন ওর্তেগা ই গ্যাসেট, কাইজারলিং, রবীন্দ্রনাথ। তিনি শান্তিবাদী, গান্ধীপন্থী, ফ্যাসিবাদ বিরোধী। তাঁরই উদ্যোগে রবীন্দ্র শতবার্ষিকীতে (১৯৬১) সান ইসিদ্রো-র একটি রাস্তা রবীন্দ্রনাথের নামে চিহ্নিত হয়, ডাক বিভাগ থেকে শতবর্ষ উপলক্ষে বিশেষ ডাকটিকিট বার করা হয়। শতবর্ষ অনুষ্ঠানে তিনি জনসভায় ভাষণ দেন, রবীন্দ্র-বিষয়ক আলোচনার অপরিহার্য কথক ছিলেন, স্পেনীয় 'ডাকঘর' এর অভিনয় হয় তাঁর নিজস্ব তত্ত্বাবধানে। রবীন্দ্রনাথকে উপলক্ষ করে তিনি অনেকগুলো প্রবন্ধ রচনা করেন। তাঁর আত্মজীবনীর নানা খণ্ডে, গান্ধী ও কাইজারলিং বিষয়ক রচনাতেও রবীন্দ্রপ্রসঙ্গ চলে আসে। তাঁর সেইসব রচনা থেকে দু'একটি মন্তব্য পেশ করা যাক। যেমন—রবীন্দ্ররচনা হচ্ছে হৃদয়ের স্বাস্থ্যের পক্ষে সবচেয়ে তৃপ্তিজনক। অতীত ভারতের ধ্যান উদ্ভাস-এর পরিচয় পাবার জন্য 'সাধনা' বক্তৃতামালা গুরুত্বপূর্ণ। 'গীতাঞ্জলি' পাঠের, অনুভবের জন্য প্রয়োজন বয়স নিরপেক্ষ এক আত্মিক সচেতনতা ও সূক্ষ্মবোধ। ওক্তাভিয়ো পাজের মতো তিনিও রবীন্দ্র-গান্ধী চিন্তার তুলনা করতে গিয়ে বলেন—রবীন্দ্রনাথ পূর্ণতাকে দেখেছেন বিশ্ববিষয়ে, শিল্পকর্মে, সৃষ্টিতে। যদিও তিনি শিক্ষাব্রতী, সন্তপ্রতিম ব্যক্তিত্ব তথাপি গোটা পৃথিবীর রাজনৈতিক আন্দোলন তাঁকে ভরে রাখত নিরন্তর উত্কন্ঠায়। 'ঘরে বাইরে' উপন্যাসটি ওকাম্পোর প্রিয়। তিনি মনে করেন এ উপন্যাসের মূল্য কখনো নষ্ট হয় না। তাঁর মতে রবীন্দ্রচিত্রকলায় ধরা পড়েছে রচয়িতার স্বভাবের 'দ্বৈধ', সুন্দর আর প্রজ্ঞার মিলন সেখানে। হোয়াকিন গোনজালেজ কৃত 'কবীর' দোঁহার রবীন্দ্রকৃত অনুবাদের স্পেনীয় অনুবাদ প্রসঙ্গে ওকাম্পো বলেন—অধ্যাত্মতত্ত্বকে ঠিক এইভাবেই তো বুঝতে চাই আমরা।
এবার অন্য কয়েকজনের প্রসঙ্গে যাওয়া যাক। Graciela de la Lama তাঁর 'রবীন্দ্রনাথ ও মেক্সিকো' প্রবন্ধে জানান আজকের মেক্সিকোয় রবীন্দ্র রচনা পাঠ চলছে, নানা গবেষক রবীন্দ্র রচনা নিয়ে গবেষণা চালাচ্ছেন। তাঁদের মধ্যে Gabriel Zaid অগ্রণী। অতীত পর্যালোচনা করে তিনি জানান, রবীন্দ্রনাথকে মেক্সিকোবাসীর কাছে পরিচয় করিয়ে দিতে সবচেয়ে বেশি অবদান যাঁর তিনি Jose Vasconcelos। তিনি ওয়াশিংটনে থাকার সময় বিপ্লবী মেক্সিক্যানদের সঙ্গে যেমন যোগ রাখতেন, তেমনি ভারত বিষয়ে প্রচুর পড়াশুনো করতেন। শিক্ষামন্ত্রী হবার পর (১৯২১-২৪) রবীন্দ্র অনুবাদ, রোলাঁর গান্ধী অনুবাদ, রবীন্দ্ররচনা নানা গ্রন্থাগারে, বিদ্যালয়ে ছাত্র শিক্ষকদের মধ্যে প্রচারে আগ্রহী হন। বিশেষত: রবীন্দ্র শিক্ষাদর্শে তাঁর গভীর আগ্রহ ছিল। El Maestro (১৯২১) পত্রিকায় তিনি রবীন্দ্র শিশুসাহিত্য অনুবাদ ছাপান। ১৯২৩ এ প্রকাশিত Estudios indostanicos বইতে ভারতীয় ধর্ম দর্শন নিয়ে আলোচনা করেন। B. Cano কৃত গীতাঞ্জলির অনুবাদ, চিত্রা (চিত্রাঙ্গদা)র অনুবাদ এবং রবীন্দ্র কৃত কবীরের শত দোঁহার স্পেনীয় অনুবাদ (ভাসকোনসেলোস) তাঁর মারফৎ মেক্সিকোবাসীদের মধ্যে আগ্রহ বিস্তার করে।
আর একজন নিবেদিতপ্রাণ রবীন্দ্রভক্ত Joaquin V. Gonzalez (১৮৬৩ - ১৯২৩), যিনি ওকাম্পোর আগে ভালোবাসার বার্তা ছড়িয়ে দেন স্পেনীয় জগতে। তিনি রবীন্দ্রনাথের 'সাধনা' বই সম্পর্কে বলেন, এ হল প্রেমের কথায় পূর্ণ, যা সম্বিতের পূর্ণতার স্বরূপ। রবীন্দ্রনাথ কবীর এর অনুবাদে কবীর-এর আত্মাকে পাত্রান্তরিত করেছেন, যে দর্শন যাবতীয় দ্বন্দ্বের নিরসন ঘটনায়। একমাত্র প্রেমের মধ্যেই মানুষ পায় অপরিবর্তনীয় ঐক্য আর দ্বৈততা। মিষ্টিক প্রেমে আছে স্বর্গীয় শুদ্ধতা, যা মানবতার দ্বারা হয় ফলবতী। অন্ধ যারা তারা এই প্রেমকে যুক্তির আলোকে দেখবার আশা করে, কারণ যুক্তিই বিচ্ছিন্নতার কারণ হয়।
স্পেনের চিন্তাবিদ ওর্তেগা ই গ্যাসেট এর কথাও অবশ্যই আমাদের বলতে হবে। রবীন্দ্র দর্শনের মূল্যায়নকারীদের মধ্যে তিনি অবশ্যই একজন। তাঁর তিনটি রবীন্দ্র বিষয়ক প্রবন্ধ Un poeta indo প্রকাশিত হয় মাদ্রিদের El Sol পত্রিকার জানুয়ারি, ফেব্রুয়ারি ও মার্চ ১৯১৮ সংখ্যায়—খোলা চিঠির আঙ্গিকে। তাঁর কাছে রবীন্দ্রনাথ শুধু কোনো জাতীয় বা ধর্মীয় কবি নন, রবীন্দ্রনাথ সর্বজনীন দর্শনের প্রবক্তা। রবীন্দ্রের গীতিকবিতায় আছে বিশ্বজনীনতা, বিভিন্ন ডালে বসা পাখির গানের মতো। রবীন্দ্র বাস্তবের সঙ্গে কিছুটা অবাস্তবকে মিশিয়েছেন। রবীন্দ্র দর্শনে তিনি লক্ষ করেছেন মানব ও ঈশ্বর ধারণার সমন্বয়, যা আশা ও জীবনবোধে স্পন্দিত। 'ডাকঘর' ওর্তেগার বিশেষভাবে ভালো লাগে, নাটকের শেষে রাজার চিঠির জন্য যে প্রত্যাশা, 'আমির' যে প্রত্যাশা, তাতে যুগপৎ আনন্দ ও বিষাদ মিশে আছে। রবীন্দ্র-রচনায় আছে শান্তভাব, বিপুল চাঞ্চল্যহীনতা আর রবীন্দ্রকবিতা বিগত কালের সাঙ্গীতিক জাগরণের প্রতিভূ হয়ে জাগরুক থাকবে।
আর্জেন্তিনার বিশিষ্ট সাহিত্যিক Jorge Luis Borges যৌবনে রবীন্দ্ররচনা সম্পর্কে ছিলেন বিরূপ, যেমন, তাঁর মনে হয়েছিল রবীন্দ্ররচনা মধুর মতো মিষ্টি, তাঁর কবিতায় lyric tension নেই, আদৌ verbal economy নেই, ইমেজগুলো সব typical। কিন্তু পরবর্তীকালে রবীন্দ্রনাথের বহু ঝড় তোলা জাতীয়তাবাদ বিষয়ক বক্তব্যে সুর অনেকটা নরম। Borges বলেন—রবীন্দ্রনাথের ব্যক্তিগত ভালোবাসা আছে ইংল্যাণ্ডের প্রতি কিন্তু সে দেশের রাজনৈতিক শাসকবৃন্দ ভারতকে শাসন করবে এটা সহ্য করতে পারেন না। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য সংস্কৃতি সমন্বিত এই মানুষটি জানেন ইংরেজ ও বাঙালিকে কিভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হয়। রবীন্দ্রনাথের এবংবিধ রচনায় আছে আত্মার অসীম সম্ভাবনা বিষয়ক এশীয় অস্ত্যর্থক ধারণা।
আর্জেন্তিনীয় বিদুষী, ওকাম্পো সংগ্রহালয়ের অধিকর্তা Maria Renee Cura ওকাম্পো, রবীন্দ্রনাথ, গান্ধী মিশিয়ে আলোচনা করেছেন। তিনি বলেন এই দুই ভারতীয় দেশ ও বিশ্বকে দেখেন এক sacred impulse থেকে। ভারতের বিশ্বকল্যাণ লক্ষ্য রূপায়িত হতে পারে এই দুই চিন্তাবিদের দ্বারা। La Nacion পত্রিকায় ১৯২৪ সালের ২রা নভেম্বর তিনি লিখেছিলেন The pleasure of reading Rabindranath Tagore, যেখানে বের্গসঁ প্রসঙ্গ আসে, প্রুস্ত ও রবীন্দ্রনাথ পাঠ বিষয়ে মন্তব্য থাকে। রবীন্দ্রপ্রসঙ্গে 'সাধনা' বইটির উল্লেখে তিনি নান্দনিকতা ও ধর্মীয়তার সমন্বয় লক্ষ করেন। 'চিত্রাঙ্গদা,' ওকাম্পোর মতো তাঁরও প্রিয় বই।
বিদগ্ধ জনের মতে স্পেনে রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে প্রথম প্রবন্ধ লেখেন পেরেস্ দে আইয়ালা, 'লা ত্রিবুনা' পত্রিকায় ১৯১৩-র শেষদিকে। হয়তো ভিসেন্তে রিস্কোর রবীন্দ্র-বিষয়ক বক্তৃতা তার আগে। তখনও হিমেনেথ দম্পতীর রবীন্দ্র অনুবাদ প্রয়াসের সূত্রপাত হয়নি। এমিলিও গাস্কো কোন্তেল ১৯৬১তে এবং বিখ্যাত ঔপন্যাসিক এমিলিয়া পার্দো বাজান রবীন্দ্রনাথকে পাঠকের দৃষ্টিতে আনেন, প্রথমজন অনুবাদে। এরপর নানা সময়ে নানা জন রবীন্দ্র রচনা পাঠে, অনুবাদে, মূল্যায়নে প্রবৃত্ত হয়েছেন। সেগুলো সবসময়ই সপ্রশংস নয়, সেটা স্বাভাবিকও নয়। এমন জনদের একটা তালিকা - হেসুস আলসিনা, মানুয়েল মাচাদো, এদুয়ার্দো গোমেজ, ওস য়ালদো সোয়ানসিনি, Edouardo Gomez de Baquero, Jose de la Serna , এউগেনিও দেওরস, রামোন গোমেস দে লা সের্না, দিয়েস - কানেদো, রিকার্ডো গুইয়োন, হোয়াও ভিসেন্তে ভিকুয়েইরা, হোয়াকুইনা গাল্লেগো, লুই লেওন প্রমুখ।
রবীন্দ্র সার্ধজন্মশতবর্ষ উপলক্ষ্যে এইসব রচনা, মন্তব্য প্রভৃতি সংকলিত হওয়া দরকার। তাহলে স্পেনীয় ভাষাভাষীদের মতামত বিচারের একটা সুযোগ পাওয়া যাবে। গবেষণার নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হবে।
পরবাস, ২৫-শে বৈশাখ, ১৪১৭, May 9, 2010
অলঙ্করণ: নীলাঞ্জনা বসু