• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | Rabindranath Tagore | প্রবন্ধ
    Share
  • আজকের ‘রবিয়ানা’ : পৃথা কুণ্ডু



    বার এসে গেল পঁচিশে বৈশাখ। রবীন্দ্রজয়ন্তী এখন আর নিছক ছুটির দিন নয়, ‘পালনীয় দিবস’। কিছু না কিছু করতে হবে ছেলেমেয়েদের নিয়ে। সব স্কুল-কলেজেই বোধহয় এক অবস্থা। বিষয় ঠিক হয়েছে ‘একুশ শতকে রবীন্দ্রনাথের প্রাসঙ্গিকতা’। সপ্তাহব্যাপী চলবে অনুষ্ঠান, আলোচনা সভা — ইত্যাদি ইত্যাদি। সব বিভাগকেই অংশগ্রহণ করতে হবে।

    মহানগরীর ‘বড়’ বা ‘ভাল’ কলেজ বলতে সাধারণত যেগুলোকে বোঝায়, আমাদের কলেজ তাদের মধ্যে পড়ে না। ছাত্রীরাও ‘সাধারণ’। ‘এদের দ্বারা কিছু হবে না’ কথাটা সহকর্মীদের নিজেদের মধ্যেই চলে, আড়ালে-আবডালে । খারাপ লাগে। যাই হোক, ইংরিজি-পড়া ছাত্রীদের কাছে কথাটা তুললাম। ‘কী করা যায় তোমরাই বল’। সবাই পরস্পরের মুখের দিকে তাকাচ্ছে; এ ওকে ঠেলছে। একজন বলল, ‘ম্যাডাম, সিনেমায় রবীন্দ্রসংগীত...’

    — ‘ভালো, কিন্তু নতুন কী হল? বাংলায় সেই পঙ্কজ মল্লিকের আমল থেকে চলছে, তারপর হেমন্ত। হিন্দিতেও অনেক গান রবীন্দ্রসঙ্গীতের সুরে করা হয়েছে পঞ্চাশের দশক থেকেই। এমন কিছু ভাবা যায় না, যেটা এই ক’বছরে...

    মেয়েদের গুঞ্জন বাড়ল। কিছু একটা ওরা বলতে চাইছে, কিন্তু...

    — আহা বলই না, কি ভাবছ?

    একজন উঠল, ‘লাস্ট কয়েক বছরে তো — হোয়াটসঅ্যাপ, ফেসবুক...’

    পাশ থেকে খোঁচা দেয় বন্ধু — ‘যাহ্, ফেসবুক আর রবীন্দ্রনাথ — কি বলিস!’

    — ‘বলুক না। এই, কি ভেবেছ তুমি বল’।

    মেয়েটি বলে, ‘হোয়াটসঅ্যাপ, ফেসবুক ইত্যাদিতে রবীন্দ্রনাথ-এর ‘কোটস্’ —কোনটা কত বেশি চলে — উইশ করতে, প্রতিবাদ জানাতে, ঝগড়া করতে — সেটা নিয়ে একটা পোস্টার বানালে কেমন হয়’?

    — বাঃ, খুব ভাল হয়। আর কিছু?





    উৎসাহ পেয়ে আর এক দল কলকলিয়ে ওঠে, তারা রবীন্দ্রনাথকে পিডিএফ-এ ডাউনলোড করে পড়া — এই নিয়ে প্রজেক্ট করবে। ইন্টারনেট-প্রযুক্তি বুঝি না তেমন। তবু মনে হল, ডাউনলোড মানে তো অনেক উপরের স্তরে ভাসমান তরঙ্গকে নামিয়ে এনে কাজে লাগানো — এ যেন ‘তাই তো প্রভু হেথায় এল নেমে/ তোমারি প্রেম ভক্তপ্রাণের প্রেমে’। মন্দ কি!

    আলোচনা গড়িয়ে যায় আড্ডায়। যথারীতি দেরি করে ঢোকে আর এক্ মেয়ে। প্রত্যেকদিন বকুনি খায়, ক্লাসের বাইরে রাখতে হয় কিছুক্ষণ। সেদিন আর ওসব কিছু না। একেবারে সাদর আমন্ত্রণ — এসো এসো আমার ঘরে এসো । আড্ডার বিষয় শুনে সেও যোগ দেয় সোৎসাহে। হিন্দিভাষী এক ছাত্রী বলে ওঠে, প্রাইমারি স্কুলে পড়ার সময় সব ফাংশনে কেবল ‘ফুলে ফুলে ঢলে ঢলে’ আর ‘আমরা সবাই রাজা’ শুনে শুনে বিরক্তি লাগত। সত্যি তো, স্কুলস্তর থেকেই বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আমরা যেন চাপিয়ে দিতে চাই, কোন গান, কোন কবিতা্ —ঠিক কতটুকু কোন বয়সের পক্ষে ‘নিরাপদ’ রবীন্দ্রচর্চার নৈবেদ্য হতে পারে। কেন এই বন্ধন? উদার আকাশের নিচে, গাছের তলায় যিনি পাঠ দেবার কথা বলেছিলেন, তাঁরই কপালে এত কড়াকড়ি!

    মেয়েটির বন্ধুরা বলল, ‘কেন, আরও কত ভাল ভাল গান আছে, শুনে দেখিস দারুণ লাগবে। বিশেষ করে ‘আমার পরাণ যাহা চায়...’ আজও এ গান তাহলে ভাল লাগে ওদের। আমাদেরও লাগত, এখনও লাগে। তারও আগে...

    মেয়েদের বলেছি, ‘তোমাদের পরাণ যা চায়, তাই কর। ভালবেসে কর’। ওরা চার্ট পেপার কিনেছে, রং-তুলি — তার সাথে মিলবে স্ক্রিনশট আর পিডিএফ। খুব আনন্দে কাজ করছে সব্বাই । কলেজের কালচারাল কমিটির সদস্য হওয়ার সুবাদে মেয়েদের নিয়ে এদিক-ওদিক কুইজ, ডিবেট, প্রবন্ধ-প্রতিযোগিতা, তাৎক্ষণিক বক্তৃতা — এসব করাতে হয়, কখনও কিছুটা জোর করেই। অনেকে আবার জানতে চায়, ফার্স্ট-সেকেন্ড না হতে পারলেও, এমনি পার্টিসিপেট করার জন্য সার্টিফিকেট পাবো তো? এই কাজের ক্ষেত্রে কিন্তু একজনও জানতে চাইল না সার্টিফিকেটের কথা। আর কোন বিষয় নিয়ে তো এমন করে উৎসাহে ফুটতেও দেখিনি ওদের। ভাবছি, নিজেদের আধমরা অবস্থাকে ঘা মেরে বাঁচাতে পারি না, একটু সবুজ হতে পারি না আবার, ওদের সাথে একটু হাত লাগিয়ে?

    বালখিল্য ব্যাপার মনে হচ্ছে? হুজুগ? তাই হোক না কটা দিনের জন্য। শান্তিনিকেতনের স্মৃতি নিয়ে লিখতে গিয়ে সৈয়দ মুজতবা আলী সাহেব তো সেই কবে বলে গেছেন —


    আমার গুরুর আসন-কাছে
    সুবোধ ছেলে কজন আছে
    অবোধ জনে কোল দিয়েছেন
    তাই আমি তাঁর চেলা রে।
    ‘রাবীন্দ্রিক’ বা ‘রৈবিক’ না-ই বা হল, আমাদের এই ‘রবিয়ানা’ নিয়ে কাটুক না একটা সপ্তাহ। এভাবেই যে বড় আপন করে পাচ্ছি আমরা, আমাদের রবীন্দ্রনাথকে।
  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments