• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | Rabindranath Tagore | প্রবন্ধ
    Share
  • ঘরে বাইরে প্রেম : মধুপর্ণা মুখোপাধ্যায়

    যুগ পালটেছে, রুচিও। তবু রবীন্দ্রনাথকেই শুনছি আমরা, কেননা তিনি বিপন্ন সময়ের একমাত্র আশ্রয়। হীনতা থেকে বেরিয়ে আসার যে পথ দেখিয়েছেন তিনি, সেই হীনতা মুখোশ বদলে ফিরে আসে বারবার। তাই প্রত্যয়ী অস্ত্র চেয়ে রবীন্দ্রনাথেরই দ্বারস্থ হই। আবিষ্কার করি আয়ুধ। ‘ঘরে বাইরে’র রাস্তায় হেঁটে সেখানেই পৌঁছতে চাওয়া।

    ।। ১ ।।

    আত্মকথন রীতি, চলিত ভাষা আর বৈপ্লবিক জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে নিখিলেশ-বিমলা-সন্দীপের টানাপোড়েন ‘ঘরে বাইরে’ উপন্যাসের বিষয়। দাম্পত্য প্রেম, স্বদেশ প্রেম আর আত্ম প্রেমের ঘেরাটোপ ভেঙে চরিত্রগুলি পায়ের তলায় মাটি পেল কেমন করে তা-ই আমাদের আলোচ্য।


    দাম্পত্য প্রেম        স্বদেশ প্রেম             আত্ম প্রেম
    নিখিলেশ            নিখিলেশ                নিখিলেশ
    বিমলা                বিমলা                  বিমলা
                           সন্দীপ                  সন্দীপ

    নিখিলেশ-বিমলার দাম্পত্যে পূজা আর নিবেদন বেশি। দু-জনেই নিজের নিজের প্রেমের অর্ঘ্য সাজিয়ে রেখেছে। এক্ষেত্রে মায়ের সতীত্বের যশ বিমলাকে পরোক্ষে নিয়ন্ত্রণ করেছে। তাই কল্পনার রাজপুত্র বাস্তবে না মিললেও রাজবাড়ির বধূ হিসেবে বিমলা নিজের মর্যাদার অধিকার বুঝে নিতে দেরি করেনি। সময়ের প্রেক্ষিতে তার অতিরিক্ত পাওয়া ছিল স্বামীর অখণ্ড প্রেম। বস্তুত নিখিলেশের উদার প্রেমের আলোতেই বিমলার ব্যক্তিত্বের বিকাশ। মিস গিল্‌বির কাছে অধ্যয়ন, আধুনিক পোশাক আর মত প্রকাশের স্বাধীনতা তাকে চিরাচরিত অন্তঃপুরের রান্নাঘরে বাঁধতে পারেনি। যদিও বড়ো-জা, মেজো-জা এমনকী সন্দীপ সম্পর্কে তার অতি সচেতন দৃষ্টিতে ধরা পড়া অসঙ্গত আচরণগুলো নিয়ে বিমলা যখনই নিখিলেশকে সতর্ক করতে চেয়েছে, ততবারই ব্যর্থ হয়েছে আর স্বামীর দৃষ্টিতে ছোটো হয়ে যাবার লজ্জা, সেই সঙ্গে নারীসুলভ ক্ষোভ নিজের মধ্যে চেপে রাখতে বাধ্য হয়েছে। ঠিক এই জায়গায় সে বিচ্ছিন্ন হয়েছে নিখিলেশের থেকে। তার এই একলা মনের পরিসর বেড়েছে স্বদেশীর নামে সন্ত্রাসবাদী আন্দোলনের আঁচে।

    বিমলা সেই প্রজাতির মেয়ে যে-মেয়েকে জোরের সঙ্গে কিছু দেখালে সে দেখে। স্বদেশীর নামে যে ধ্বংসলীলা সে সময় শুরু হয়েছিল তার উন্মাদনা গ্রাস করেছিল বিমলাকে। মনে করে নেব বিমলা সন্তানবতী নয়। তাই তার অবসর দেশের নামে যেন লিখে দিয়েছে সে। চেয়েছে বিলিতি শাড়ি পুড়িয়ে দিতে। কিন্তু আশ্চর্য এই ঢেউ আছড়ে পড়বার আগে নিখিলেশ যখন স্বদেশি ব্যাংক বা স্বদেশি জাহাজের ব্যাবসা কিংবা স্বদেশি কলম বা স্বদেশি সাবান বানাবার চেষ্টা করে বারবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তখন বিমলার চোখেই খাটো হয়েছে। কারণ নিখিলেশের কাজ নীরব কাজ— সেই নিস্তরঙ্গ ভরা জলে ডুব দেওয়ার মানসিকতা বিমলার ছিল না। সঙ্গীর অভাবে বিমলা যখন অবচেতনে অস্থির সেইসময় স্বদেশি আন্দোলনকে আশ্রয় করেই সন্দীপের প্রবেশ বিমলার বাহিরমহল থেকে অন্দরমহলে:

    “পাড়ায় বর আসছে, তার বাঁশি বাজছে, তার আলো দেখা দিয়েছে, অমনি মেয়েরা যেমন ছাতে বারান্দায় জানলায় বেরিয়ে পড়ে, তাদের আবরণের দিকে আর মন থাকে না, তেমনি সেদিন সমস্ত দেশের বর আসবার বাঁশি যেমনি শোনা গেল মেয়েরা কি আর ঘরের কাজ নিয়ে চুপ করে বসে থাকতে পারে! হুলু দিতে দিতে শাঁখ বাজাতে বাজাতে তারা যেখানে দরজা জানলা দেয়ালের ফাঁক পেলে সেইখানেই মুখ বাড়িয়ে দিলে!”
    অন্যদিকে নিখিলেশ আগাগোড়া আদর্শবাদী। আদর্শ আর বাস্তবের নিত্য সংঘাত সে তার সামাজিক অবস্থানের জন্যই অনেকখানি এড়িয়ে চলতে পেরেছে। কিন্তু যে নিখিলেশ বারবার বিমলাকে বলেছে ‘স্ত্রী বলেই যে তুমি আমাকে কেবলই মেনে চলবে, তোমার উপর আমার এ দৌরাত্ম্য আমার নিজেরই সইবে না। আমি অপেক্ষা করে থাকবো, আমার সঙ্গে যদি তোমার মেলে তো ভালো, যদি না মেলে তো উপায় কী!’ — সেই প্রেমের প্রশ্নেই জীবনে তীব্র সংকটের মুখোমুখি হয়েছে সে।

    দাম্পত্যপ্রেমে নিখিলেশের মধ্যে সম্পূর্ণ নিবেদন ছিল। কিন্তু বিমলার প্রকৃতি যেখানে তার সঙ্গে মেলেনি, স্বাভাবিকভাবেই সেই জায়গায় নিখিলেশও একা হয়ে গেছে। কিন্তু যে মানুষের ঘর ও বাইরে দু-জায়গাতেই আসা যাওয়া তার বোধহয় কোনো এক মহলের না পাওয়ার বেদনা ভোলবার পথ থাকে:

    “ধৈর্যের’পরে বিমলের ধৈর্য নেই। পুরুষের মধ্যে সে দুর্দান্ত, ক্রুদ্ধ, এমন-কি, অন্যায়কারীকে দেখতে ভালোবাসে। শ্রদ্ধার সঙ্গে একটা ভয়ের আকাঙ্ক্ষা যেন তার মনে আছে।... উৎকটের উপরে ওর অন্তরের ভালোবাসা।”
    নিখিলেশের বিমলা সম্পর্কে এই বিশ্লেষণ যথাযথ। মূলত এই তুচ্ছতা থেকে বিমলাকে বার করে মুক্ত আকাশের আস্বাদ দেওয়াতেই নিখিলেশ তাকে কলকাতায় আনতে চেয়েছিল। কিন্তু বিমলার মনে হয়েছে— ‘কলকাতায় আমরা কে তা জানিনে, অন্য কজনই বা তা জানে? আমাদের মান সম্মান ঐশ্বর্যের পূর্ণ মূর্তিই এখানে।’ বিশেষ করে তার মনে হয়েছে — ‘যাঁরা চিরদিন এমন শত্রুতা করে এসেছেন তাঁদের হাতে সমস্ত দিয়ে-থুয়ে চলে যাওয়া যে পরাভব।’ বুঝতে অসুবিধে হয় না প্রকৃতিগত ভাবে বিমলা আর নিখিলেশ স্বতন্ত্র। কেবল দাম্পত্য বা সতীত্বের তকমা দিয়ে একই ছাদের নিচে তাদের অবস্থান। কিন্তু সত্যিই কি তাই! বিমলার আত্মজাগরণে নিখিলেশের কি কোনোই ভূমিকা ছিল না।

    এখানেই প্রয়োজন পড়ে সন্দীপের। বিমলার মতোই ভাসাতে ও ভাসতে প্রবৃত্তি তার। মুখে স্বদেশির বুলি। অথচ ফার্স্ট ক্লাসে জার্নি কিংবা দামি সিগারেট ব্যবহারে তার ঘাটতি নেই। সন্দীপ মনে করে:

    “ছ’টা যে রিপু আছে তার মধ্যে প্রথম-দুটো এবং শেষ-দুটো হচ্ছে পুরুষের, আর মাঝখানের দুটো হচ্ছে কাপুরুষের।”
    উড়নচণ্ডী জীবনে জোরদার বাঁচা তার জীবনের লক্ষ্য। সকলকে মাতিয়ে তুলতে তার জুড়ি মেলা ভার। চরিত্রের ম্যাগনেটিজম তার ষোলো আনাই কব্জায় আছে। তাই যে বিমলার সন্দীপের ফোটোগ্রাফ দেখে মনে হয়েছিল — ‘উজ্জ্বলতা আছে বটে, কিন্তু চেহারাটা অনেকখানি খাদ মিশিয়ে গড়া — চোখে আর ঠোঁটে কী-একটা আছে যেটা খাঁটি নয়।’ সেই বিমলাই সন্দীপের বক্তৃতা শুনে উদ্দীপিত হয়েছে। তার একলা চলা মনটা দোসর খুঁজে পেয়েছে। সন্দীপের ‘প্রত্যেক কথায় ঝড়ের দমকা হাওয়া’ বিমলার ‘ঘর’কে দুলিয়ে দিয়েছে:
    “আমি কি তখন রাজবাড়ির বউ? আমি তখন বাংলাদেশের সমস্ত নারীর একমাত্র প্রতিনিধি, আর তিনি বাংলাদেশের বীর।”
    নিখিলেশ বিমলাকে দেবীর আসন দিয়েছিল, পূজারি ছিল সে একাই। কিন্তু বিমলার যে সত্তা পুজো পায়নি সেই ক্ষুধার্ত অবদমিত সত্তাই নিজেকে আবিষ্কার করল নতুন আলোয় —
    “আমি স্পষ্ট অনুভব করতে পারলুম, আমার মুখের দিকে চাওয়ার পর থেকে তাঁর ভাষার আগুন আরো জ্বলে উঠল। ইন্দ্রের উচ্চৈঃশ্রবা তখন আর রাশ মানতে চাইল না— বজ্রের উপর বজ্রের গর্জন, বিদ্যুতের উপর বিদ্যুতের চম্‌কানি। আমার মন বললে, আমারই চোখের শিখায় এই আগুন ধরিয়ে দিলে। আমরা কি কেবল লক্ষ্মী, আমরাই তো ভারতী।”
    বিমলার বয়ানে তিনটি মন্তব্য এক্ষেত্রে জরুরি মনে হয়:

    ১. ‘স্ত্রীলোকের ভালোবাসা পূজা করেই পূজিত হয়’
    ২. ‘আর একটু মন্দ হবার মতো তেজ আমার স্বামীর থাকা উচিত ছিল’,
    ৩. ‘সন্দীপবাবু কি আমার মধ্যে দেশের এই জাগ্রত শক্তিকে দেখতে পাবেন? না মনে করবেন এ একজন সামান্য মেয়েমানুষ, তাঁর এই বন্ধুর ঘরের গৃহিণীমাত্র’ — বস্তুত এই তিনটি ধাপ নজর করলেই বিমলার ঘর থেকে বাইরে আসার মনস্তাত্ত্বিক কারণ অনুসন্ধান সম্ভব। বিমলা যে বীরকে স্বামীর আসনে দেখতে চেয়েছিল সেই বীরের আস্ফালনটুকু ছিল সন্দীপের মধ্যে। তাই সীমায়িত পরিচয় অতিক্রম করে যাওয়ার এক তীব্র আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়েছে বিমলার মধ্যে, ‘পাওয়ার সুযোগের চেয়ে দেওয়ার সুযোগের দরকার’ যে অনেক বেশি ছিল। দেওয়ার সুযোগ যখন এল তার মনে হয়েছে নিজের অত্যন্ত একটা ক্ষতি করতে পারলে তবেই যেন সেই আনন্দের উৎসাহবেগ সহ্য’ করা সম্ভব। সন্দীপ পাকা শিকারি। তাই শিকারকে চিনে নিতে ভুল করেনি বিন্দুমাত্র। বুঝেছে শক্তির স্তুতিতেই দেশপ্রেমের আঘ্রাণ মিশিয়ে বিমলাকে কব্জা করা সম্ভব। নারীকে বশ করবার এহেন প্রবণতা তার নতুন নয়। বিমলাও ক্রমশ সন্দীপের মন্ত্রে দীক্ষিত হয়েছে স্তুতির মাদক পান করে—

    “আমি মানুষ, আমার লোভ আছে, আমি দেশের জন্যে লোভ করব; আমি কিছু চাই যা আমি কাড়ব-কুড়ব। আমার রাগ আছে, আমি দেশের জন্যে রাগ করব; আমি কাউকে চাই যাকে কাটব-কুটব, যার উপরে আমি আমার এতদিনের অপমানের শোধ তুলব। আমার মোহ আছে, আমি দেশকে দিয়ে মুগ্ধ হব; আমি দেশের এমন একটি প্রত্যক্ষ রূপ চাই যাকে আমি মা বলব, দেবী বলব, দুর্গা বলব, যার কাছে আমি বলিদানের পশুকে বলি দিয়ে রক্তে ভাসিয়ে দেব। আমি মানুষ, আমি দেবতা নই।”
    বিমলার এই জাগরণ প্রভাবিত হলেও, একটা সময়ের পর ক্রমশ বোঝা গেছে সন্দীপের সঙ্গেও জীবনের রেখাটা মাঝেমাঝেই অসমান্তরাল হয়ে যাচ্ছে। বিশেষ করে অমূল্যকে বিমলা অতিরিক্ত গুরুত্ব দেওয়ায় সন্দীপের প্রতিক্রিয়া আর বিমলার নিজের ঘর থেকে ‘সোনার টাকা’ চুরির বৃত্তান্ত সন্দীপ সম্পর্কে ঘোরটা অনেকটাই কাটিয়ে দিয়েছে। এখানেই শুরু হয়েছে বিমলার অন্তর্দ্বন্দ্ব—
    “কিন্তু আমাকে এমন করে নিবিয়ে ফেলে সন্দীপের লাভ হল কী? এই পাঁচ হাজার টাকা? কিন্তু আমার মধ্যে পাঁচ হাজার টাকার চেয়ে বেশি কিছু ছিল না কি? ছিল বৈকি। সেই খবরই তো সন্দীপের কাছে শুনেছিলুম, আর সেই শুনেই তো আমি সংসারের সমস্তকে তুচ্ছ করতে পেরেছিলুম। আমি আলো দেব, আমি জীবন দেব, আমি শক্তি দেব, আমি অমৃত দেব, সেই বিশ্বাস, সেই আনন্দে দুই কূল ছাপিয়ে আমি বাহির হয়ে পড়েছিলুম।”
    বিমলা তখন ঘরেতে কুলিয়ে উঠছিল না। বাইরে বিস্তারিত হয়ে নিজের মহিমা নিজেই আস্বাদন করতে চাইছিল। দাম্পত্যপ্রেম থেকে স্বদেশপ্রেম আর সেখান থেকে আত্মপ্রেমের চৌকাঠে দাঁড়িয়ে প্রথম একক মানুষ হিসেবে নিজেকে উপলব্ধি করতে পেরেছে সে। যে মানুষ— সম্মান, সম্ভ্রম, মর্যাদা আর ভালোবাসার দাবিদার। অমূল্যর কাছে বিমলা এই দুর্লভ আসন যখন পেয়েছে, তখনই বোধহয় স্পষ্ট হয়েছে সন্দীপের মেকি স্তুতি। কিন্তু নেশা তো জ্বালা ধরানো। পুড়বে জেনেও ডানার অঙ্গীকার— “শ্রেয়ের পথ আবার বন্ধ হয়ে গেল, প্রেয়সী নারী এসে মাতার স্বস্ত্যয়নের ঘরে তালা লাগিয়ে দিলে।... একটা উলঙ্গ পাগলামি আবার হৃৎপিণ্ডের উপর দাঁড়িয়ে নৃত্য শুরু করে দিলে।... এই কি আমার স্বভাব! কখনোই না। ... অপদেবতা কেমন করে আমার উপর ভর করেছে। আজ আমি যা-কিছু করছি সে আমার নয়, সে তারই লীলা।”

    বিমলা আপ্রাণ শুদ্ধ হতে চাইছে তার সংস্কার অনুযায়ী। কিন্তু নিজের দেওয়া অধিকার ফিরিয়ে নেওয়ার পথ যে তার জানা নেই। চরম বেদনার মুহূর্তে নিখিলেশের সাহচর্য সত্ত্বেও বিমলার ঘরে ফেরা হত না, যদি না সন্দীপের মধ্যে সর্বনাশা ‘কিন্তু’ এসে ঢুকত।

    ‘মাস্টার-মশায়’ সত্যদ্রষ্টা। নিখিলেশকে বলেছিলেন, ‘সন্দীপ অধার্মিক নয়, ও বিধার্মিক। ও অমাবস্যার চাঁদ; চাঁদই বটে, কিন্তু ঘটনাক্রমে পূর্ণিমার উল্টোদিকে গিয়ে পড়েছে।’ সন্দীপ মনে করে, ‘লাভ করবার স্বাভাবিক অধিকার আছে বলেই লোভ করা স্বাভাবিক। কোনো কারণেই কিছু থেকে বঞ্চিত হব প্রকৃতির মধ্যে এমন বাণী নেই।’ তার বিশ্বাস, ‘যে শক্তিতে এই মেয়েদের পাওয়া যায় সেইটেই হচ্ছে বীরের শক্তি— অর্থাৎ বাস্তব জগৎকে পাবার শক্তি।... বার বার দেখলুম, আমার সেই ইচ্ছের কাছে মেয়েরা আপনাকে ভাসিয়ে দিয়েছে; তারা মরবে কি বাঁচবে তার আর হুঁশ থাকেনি।’

    সোজা-সাপটা চলা, বলাতেই সন্দীপ অনন্য। নির্ভেজাল স্তুতির মধ্যে দিয়ে বিমলাকেও বড়শিতে গেঁথেছিল। বিমলাও বুঝি মরতেই চেয়েছিল। কিন্তু যে বিমলা সন্দীপের আবেশ থেকে বেরতে পেরেছিল, বুঝি তার কাছেই সন্দীপের প্রেম জয়ী হয়েছে। স্বভাবসিদ্ধ ভাষায় তাই সন্দীপ বলেছে:

    “বন্দেমাতরম্ নয়— বন্দে প্রিয়াং, বন্দে মোহিনীং! মা আমাদের রক্ষা করেন প্রিয়া আমাদের বিনাশ করেন। বড়ো সুন্দর সেই বিনাশ। সেই মরণনৃত্যের নূপুরঝংকার বাজিয়ে তুলেছ আমার হৃৎপিণ্ডে। এই কোমলা সুজলা সুফলা মলয়জশীতলা বাংলাদেশের রূপ তুমি তোমার এই ভক্তের চক্ষে এক মুহূর্তে বদলে দিয়েছ।... প্রিয়া, প্রিয়া, প্রিয়া! দেবতা স্বর্গ ধর্ম সত্য সব তুমি তুচ্ছ করে দিয়েছ।”

    ।।২।।

    বাংলার যে সন্ধিক্ষণে ‘ঘরে বাইরে’ লেখা সেই সময়টার কথাও স্মরণ করা দরকার। শ্রাবণ ১৩৬৭ সংখ্যার ‘উত্তরা’ পত্রিকায় ‘রবীন্দ্রনাথের ঘরে বাইরে’ প্রবন্ধে অবনীনাথ রায় লিখছেন:

    “গান্ধীজির অহিংসবাদ তখনো অজ্ঞাত। বাংলাদেশে তখন সন্ত্রাসবাদ(terrorism)চল্ছে— ইংরাজদের কঠিন শাসনের নিগড় থেকে দেশ-মাতৃকাকে উদ্ধার করতে হবে এই হ’ল পণ। গোলাগুলি নেই— গোলাগুলি সংগ্রহ করতে হবে— প্রয়োজন হলে বিদেশ থেকে আমদানি করতে হবে। টাকাকড়ি নেই— যার আছে তার কাছ থেকে লুঠ করতে হবে। এর মধ্যে ন্যায় অন্যায় কিছু নেই— আগে দেশোদ্ধার, তারপরে অন্য চিন্তা। এই মনোভাব নিয়ে সতেরো বছরের ছেলে ক্ষুদিরাম হাসিমুখে ফাঁসির মঞ্চে চড়ে গেল। তারা নিশ্চয় ভাবেনি যে ঐ রকম মড়ার(??) ফলে দেশোদ্ধার হয়ে যাবে— তারা ভেবেছিল নিরুপায়ের যা একমাত্র উপায়— প্রাণ দেওয়া, সেটা তারা দিতে পারে। তাতে দেশোদ্ধার না হোক, দেশের লোকের মনে যে ক্লীবত্ব এবং ভীরুতা জমাট বেঁধে বসেছে সেটা কেটে যাবে।

    বন্দেমাতরম্‌—এর এই মন্ত্র যখন দেশের লোকের মনো-বীণায় ঝঙ্কৃত হচ্ছে, দেশের জন্য প্রাণ দেওয়া যখন একটা তুচ্ছ ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে, সেই সময় রবীন্দ্রনাথ লিখলেন ‘ঘরে-বাইরে’।”

    দেশের তৎকালীন আন্দোলনের আবেগমথিত পথ এই উপন্যাসে বহন করছে সন্দীপ। আর পথের ভালোমন্দ বিশ্লেষণ করে অহিংস সত্যের রাস্তা দেখিয়েছে নিখিলেশ। বলার অপেক্ষা রাখে না নিখিলেশের বক্তব্য রবীন্দ্র ছায়া অনুসারী। তার কাছে দেশ বড়ো, কিন্তু সত্য তার চেয়েও বড়ো। সেই সত্যের বলি চড়িয়ে দেশের প্রকৃত উপকার সম্ভব নয়।

    ইতিহাসের পদচিহ্নের দিকে তাকালে বলা দরকার— ১৯০৩-এর ডিসেম্বরে রিসলের পত্রে বঙ্গ-বিভাগ পরিকল্পনা সরকারি ভাবে প্রকাশিত হবার পর ১৯০৪-এর জানুয়ারি পর্যন্ত প্রায় ৫০০ সভা সমিতি অনুষ্ঠিত হয়েছিল। ১৯০৫-এ পূর্ববঙ্গের জেলায় বঙ্গভঙ্গ প্রস্তাবের বিরুদ্ধ-স্বর সোচ্চার হয়ে উঠলে লর্ড কার্জন পূর্ববঙ্গে গিয়ে মুসলমান সম্প্রদায়কে সরকারি প্রস্তাবের পক্ষে আনতে চান। ঢাকার নবাব সলিমুল্লাহর আস্থাভাজন হন এই বলে যে বাংলা দ্বিখণ্ডিত হলে মুসলমান সম্প্রদায় বিশেষ সুযোগ সুবিধা ভোগ করবে। এইভাবে শাসনতান্ত্রিক সুবিধার অজুহাতে বঙ্গভঙ্গের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবার স্বপক্ষে যুক্তি দেখানো হলেও মূলত লর্ড কার্জন বিভাজনের নীতি অবলম্বন করে জাতীয়তাবাদী চেতনায় উদ্বুদ্ধ হিন্দু বাঙালিকে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ে পরিণত করতে চাইছিলেন। এই বিষয়টিকে উপলক্ষ্য করেই এল স্বাদেশিকতা। বাংলা ভাগের উদ্যোগ চলতে থাকলে প্রতিবাদে এল নতুন জাতীয় আন্দোলন ‘বয়কট’। ১৯০৫-এ নদিয়া জেলার জনৈক চন্দ্রকান্ত পাল বিদেশি চিনি ব্যবহার করেছিলেন বলে তাঁর জ্ঞাতিরা, ধোপা, নাপিত ও পুরোহিত তাঁকে বর্জন করেছিল। একটু এগিয়ে ১৯১৫-য় দেখি কুমিল্লা জিলা স্কুলের প্রধান শিক্ষক শরৎচন্দ্র বসু ছাত্রদের পুলিশের কাছে ধরিয়ে দিতেন বলে বিপ্লবীরা তাঁকে হত্যা করে। এই দলের অন্যতম সদস্য ছিলেন অতীন্দ্রমোহন রায়। ওই বছরই ২৩ জানুয়ারি উত্তরবঙ্গের রংপুরের কুরিগ্রাম মহকুমার কুরুল গ্রামে ডাকাতি করে যুগান্তরের কর্মীরা পঞ্চাশ হাজার টাকা সংগ্রহ করে। আর ২ ফেব্রুয়ারি কলকাতার গার্ডেনরিচে বার্ড কোম্পানি থেকে আট হাজার টাকা লুট করে বিপ্লবীরা। ১২ ফেব্রুয়ারি স্বদেশিরা সাউথ ইণ্ডিয়া জুট মিলের আঠারো হাজার টাকা লুট করে। ২২ ফেব্রুয়ারি ফের বার্ড কোম্পানির আঠারো হাজার টাকা লুট হয়।

    উপন্যাসে এই দমকা হাওয়ায় হরিশ কুণ্ডু পঞ্চুর বিলিতি কাপড়ের বস্তা পুড়িয়ে দিয়ে একশো টাকা জরিমানা করলে নিখিলেশের ফৌজদারি মামলার পরামর্শে সন্দীপ হরিশ কুণ্ডুর পক্ষ নেয়। তার বিশ্বাস ‘দেশকে যেদিন লুট করে নিয়ে জোর করে আমার করতে পারব সেই দিনই দেশ আমার হবে।’ ‘রিয়ালিটির পৃথিবী’তে তাঁর আস্থা। সোচ্চার দেশপ্রেমকে আশ্রয় করেই তার জীবনে এসে পড়েছে ‘ইস্পাতের তলোয়ারের মতো শাম্লা’ বিমলা। বাইরের উচ্ছ্বাস গড়তে শুরু করেছে সন্দীপের ভিতরঘর। এজন্যই তার মতো ‘মাংসাশী জীব’ও একান্তে স্বীকার করেছে ‘বিমল-নিখিলকে নিয়ে আমার জীবনের এই-যে একটা অধ্যায় জমে উঠেছে এর ভিতরেও অনেকটা ঢাকা পড়েছে। ঢাকা পড়ত না যদি আমার মধ্যে আইডিয়ার বালাই না থাকত।’ কেননা ‘আপনাকে বঞ্চিত করার পথে চলা যে পাগলামি, একথা মুখে যতই বলি এটাকে একেবারে উড়িয়ে দেবার সাধ্য নেই।’

    এই সন্দীপ নিজের কাছেই নতুন আবিষ্কার। ধর্মের ধুয়ো, দেশের ধুয়ো দিয়ে যে পৃথিবীতে কর্তৃত্ব করতে চেয়েছে, লোককে পরিচালনা করতে চেয়েছে কথায় এবং কাজে— তার থেকে এ-সন্দীপ অনেক আলাদা। এখানে তার প্রেমের জয়। তাই বিমলার গয়নার বাক্স আর সোনার টাকা শেষ পর্যন্ত ফিরিয়ে দিয়ে গেছে সে। দেশের পরিস্থিতি তখন আরও উত্তপ্ত। নিখিলেশ দাঙ্গার প্রেক্ষিতে সন্দীপকে নির্দেশ দিয়েছে তার বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে।

    নিখিলেশ গোটা উপন্যাসে খোলা আকাশের ভূমিকা নিয়েছে। মুক্তিই তাঁর একমাত্র অভীষ্ট। বাঁধন ছাড়া যে বাঁধন তাতেই তাঁর আস্থা। যা কিছু শুভ তাতেই তার বিশ্বাস। তাই যে-মেজো বউয়ের সংকীর্ণতা ধরা পড়েছে বিমলার দৃষ্টিতে, সেই মহিলাকেই ‘মেজোরানীদিদি’ হয়ে নিখিলেশের মনে আশৈশব সম্পর্কের দাবি নিয়ে হাজির হতে দেখা যায়। এমনকী টাকাকড়ি ঘর-দুয়ারের ভাগ নিয়ে, ছোটোখাটো সামান্য সাংসারিক খুঁটিনাটি নিয়ে বিমলার সঙ্গে, নিখিলেশের সঙ্গে তার ঝগড়া-মনোমালিন্যও নিখিলেশের প্রতি ভালোবাসার দাবি দাখিল করতে না পারার ফল হিসেবে পাঠকের কাছে স্পষ্ট হয়। স্নিগ্ধ যাপনে অভ্যস্ত বিমলা হঠাৎ কাল বৈশাখীর আচমকা আক্রমণে চঞ্চল হলেও, জীবনের শুভ বোধ, আস্থার প্রতি শেষ পর্যন্ত অবিচল থাকতে পেরেছে বোধহয় নিখিলেশেরই জন্য আর কতকটা তার তথাকথিত ‘সতীত্বের’ অহংকারে। নিখিলেশেরও উত্তরণ দেখিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ। ‘আইডিয়াকে’ চাপিয়ে দেওয়া যায় না কারুর উপর, গ্রহণ-বর্জনের মধ্যে দিয়ে প্রত্যেকেই আসলে স্বতন্ত্র সত্তা। এই সত্য হাতেকলমে বুঝেছে নিখিলেশ। বিমলাকে হারানোর আশঙ্কার সময় পিসতুতো বোন মুনুর হাতে খেতে চেয়েছে সে, কারণ— ‘মুনু আপনার হৃদয়ের অমৃতে গরিবের ঘরটিকে স্বর্গ করে রেখেছে। সেই লক্ষ্মীর হাতের অন্ন একবার খেয়ে আসবার জন্য আমার সমস্ত প্রাণ আজ কাঁদছে। ... ওগো পবিত্র, জগতে তোমার পবিত্র পায়ের ধুলো আজও নিঃশেষ হয়ে যায়নি।’ এই ‘পবিত্র’ আসলে ‘আইডিয়াল’। অধরাকে মর্ত্যের মাটিতে বিমলার মধ্যে সন্ধান করেছিল নিখিলেশ। কিন্তু তার মনেও হয় কোথাও কিন্তু না হয় ভালোবাসার প্রতি অতিরিক্ত আস্থা ছিল যার জন্য বিমলাকে বলতে পেরেছিল, ‘সত্যের মধ্যে আমাদের পরিচয় যদি পাকা হয় তবেই আমাদের ভালোবাসা সার্থক হবে।’ মুনুও যদি বিমলার মতো জীবন বা পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যেত, জোর দিয়ে কি বলা যায় যে সেও তথাকথিত সতী-লক্ষ্মীই থাকত। আত্মআবিষ্কার এই সমাজকথিত তকমার চেয়ে বড়ো নয় কি! ভালোবাসা কোনো চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত নয়। ভালোবাসা উপযুক্ত আধারসন্ধানী। সেই আধার অনেক ওঠাপড়ার মধ্যে দিয়ে প্রেমের সলতেটুকু নিবিয়ে না ফেললে সেটাই বোধহয় বড়ো প্রাপ্তি। মনের ওপর দাবি চলে না। ‘ঘরেবাইরে’র সঙ্গে একই বছর প্রকাশিত ‘চতুরঙ্গ’তেও এই বিষয়ে সচেতন ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। দামিনী একই সঙ্গে শচীশ আর শ্রীবিলাসকে জীবনে জায়গা দিতে পেরেছে তাই। উপন্যাসে নিজের শেষ আত্মকথায় নিখিলেশও উপলব্ধি করেছে— “আজ সন্দেহ হচ্ছে, আমার মধ্যে একটা অত্যাচার ছিল। বিমলের সঙ্গে আমার সম্বন্ধটিকে একটা সুকঠিন ভালোর ছাঁচে নিখুঁত করে ঢালাই করব, আমার ইচ্ছার ভিতর এই একটা জবরদস্তি আছে। কিন্তু মানুষের জীবনটা তো ছাঁচে ঢালবার নয়।”

    যেখানে নিখিলেশ বলেছে — “স্ত্রী! এই কথাটিকে যে আমার জীবনের যা-কিছু মধুর, যা-কিছু পবিত্র, সব দিয়ে বুকের মধ্যে মানুষ করেছি। একদিনও ওকে ধুলোর উপর নামাইনি।” সেখানে ‘স্ত্রী’ শব্দটি আর বিমলা যে এক নয় এই উপলব্ধিটুকু বাকি ছিল। স্ত্রীসত্তায় বিমলা আংশিক। কিন্তু যেখানে বিমলা বাইরে থেকে ঘরে ফিরেছে সেখানেই সে সম্পূর্ণ— “আমি লোভী— আমি আমার সেই মানসী তিলোত্তমাকে মনে মনে ভোগ করতে চেয়েছিলুম, বাইরের বিমল তার উপলক্ষ হয়ে পড়েছিল। বিমল যা সে তাইই— তাকে যে আমার খাতিরে তিলোত্তমা হতেই হবে এমন কোনো কথা নেই।”

    তবে স্বদেশপ্রেম নিখিলেশের ষোলোআনা পরিণত—

    “ভারতবর্ষ যদি সভ্যতার জিনিস হয় তা হলে ওর মধ্যে মুসলমান আছে।”

    কিংবা—

    “ ভয়ের শাসনের সীমা কোন্‌ পর্যন্ত সেইটের দ্বারাই দেশের মানুষ কতটা স্বাধীন জানা যায়। ... কিন্তু মানুষ নিজে কী কাপড় পরবে, কোন্‌ দোকান থেকে কিনবে, কী খাবে, কার সঙ্গে বসে খাবে, এও যদি ভয়ের শাসনে বাঁধা হয় তা হলে মানুষের ইচ্ছাকে একেবারে অস্বীকার করা হয়। সেটাই হল মানুষকে মনুষ্যত্ব থেকে বঞ্চিত করা।”
    এই ধরনের বক্তব্যে তাঁর দৃষ্টির স্বচ্ছতা ধরা পড়ে। একবিংশের দিনে প্রতিবেশী দেশে, এমনকী স্বদেশেও মত এবং মতবাদ চাপিয়ে দেওয়ার হিড়িকে রবীন্দ্রনাথের এই চেতনায় যেকোনো শুভবোধ আজও নিশ্চিত আস্থা রাখবে। দাঙ্গার খবরে নিখিলেশ কাঙ্ক্ষিত ‘ঘরে’ ফেরার মুহূর্তে অনায়াসে ‘বাইরে’ ছুটেছে মনেরই তাগিদে। আসলে তার মধ্যে আত্মপ্রচার নেই, আছে আত্মবিশ্বাস। তাই হয়তো, তাকে বোঝবার মানসিকতা স্বদেশি-মাতাল মানুষের ছিল না। যুক্তির রাস্তা আটকায় আবেগ। আবেগকে কিছুক্ষেত্রে প্ররোচিত করে কিছু মানুষের সুবিধাবাদ। বয়কটের যুগে রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং অহেতুক ক্ষোভের মুখোমুখি হয়েছিলেন। ‘ঘরে বাইরে’তে যেন তার যোগ্য জবাব দিয়ে নিখিলেশ তথা নিজেরই গভীর স্বদেশপ্রেমকে প্রতিষ্ঠা দিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ।

  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments