পূরবীর পাণ্ডুলিপি রবীন্দ্র পাণ্ডুলিপিমণ্ডলে তুলনারহিত - কবিতার কাটাকুটি থেকে নকশা গড়ে তোলার যে অভ্যাস রবীন্দ্রনাথের আগেও ছিল এই পাণ্ডুলিপিতেই তা নতুন উদ্দীপনায় সভাবিত করেছে চিত্রকলার জগতে তাঁর পদক্ষেপের সূত্রপাত। এই পাণ্ডুলিপির দ্বিমুখী গুরুত্ব - কবিতা আর ছবি। বর্তমান নিবন্ধে পাণ্ডুলিপির অভিনব চিত্ররূপটিতে আলো ফেলতে চেষ্টা করেছি। কবির চিত্তলোকে লীলাময়ের শরিক হওয়ার জন্য আর্তি, শিল্পীসত্তার প্রবল মুক্তি-পিপাসা - ক্লান্তিকর কর্মবন্ধনের প্রাচীর টুটে কবিতায়, ছবিতে উৎসারিত হয়েছে। দুটি শিল্পমাধ্যমের অন্তর্লীন সৃজনকেন্দ্র সেখানে মিলে যায়। একদিকে নিজের ভিতর থেকে ফলে উঠছিল চিত্রী রবীন্দ্রনাথের অঙ্কুর - তাতে নববারি সেচন করেছে সমকালীন বিশ্বের চিত্রকলার নানা আন্দোলনের প্রাণবন্ত অভিঘাত।
ভারতশিল্পের বিষয়ে কবির যে অতৃপ্তিগুলি জমে উঠছিল তা এই বিশেষ কালবৃত্তে অনুকূল প্রেরণার হাওয়া পালে লাগিয়ে কবিকে নতুন এক শিল্পলোকের রহস্যময় উপকূলে পৌঁছে দিতে চলেছে। কালিকলমের কাটাকুটি বিচিত্র মূর্তি ধরছে এক অনিবার্য তাগিদে। কখনো কবি হাতে তুলে নিয়েছেন রঙিন মোমপেন্সিল। এই তাগিদই তাঁকে রংতুলির জগতে নিমগ্ন করেছে কিছুকাল পরে। জীবনের অন্ত্যপর্বে চিত্রশিল্পী রবীন্দ্রনাথ সতেজে আত্মপ্রকাশ করেছেন। পূরবীর অত্যাশ্চর্য রেখাবিভোর পাণ্ডুলিপির পাতায় পাতায় ভবিষ্যৎ চিত্রকরকে সন্ধান করেছি।
পাণ্ডুলিপির পাতায় কাটাকুটিগুলিকে ঢেকে নকশা গড়ে তোলার অভ্যাস রবীন্দ্রনাথের অনেক দিনের। প্রতিমাদেবী জানিয়েছেন, 'তাঁর লেখা কাটার পদ্ধতি একটি নতুন নক্সার আলপনা তৈরি করে তুলত, এই ছিল তার বিশেষত্ব। [১] আলপনাধর্মী এই কাটাকুটিগুলি পুরনো পাণ্ডুলিপির পৃষ্ঠায় আমরা দেখেছি। পূরবীর যুগে কিন্তু রেখা সমূহের জন্ম আর যাত্রা স্পষ্টত ভিন্ন চারিত্র্য নিচ্ছে, নিজের পরিসর বাড়িয়ে রূপগত পরিবর্তনে তা চলেছে ছবি হয়ে ওঠার পথে। কাটাকুটিগুলিকে ঢাকা দেওয়াটা যেন গৌণ হয়ে যাচ্ছে, আসল হয়ে দাঁড়াচ্ছে রেখার লীলাকে মুক্তি দিয়ে অস্ফুট যে-সব রূপ কলমের মুখে ভিড় করে আসছে তাদের প্রকাশ করা। চিত্রভাষার মর্মসত্য যেন তাঁর আয়ত্তে চলে আসছে। আলো-অন্ধকারের ঘাত-প্রতিঘাতে যেমন বস্তুজগৎ ফুটে ওঠে আমাদের চোখের সামনে, ছবিও তেমনি গড়ে ওঠে আলো-ছায়া কালো-সাদার ঘাত-প্রতিঘাতে। রেখার মধ্যে ধরা পড়ে আলো-ছায়ার এই চঞ্চলতা। পূরবী পাণ্ডুলিপির চিত্রচর্চায় কবির সাহসী আঙুল এই কঠিন কোমল রেখার চরিত্রকে নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসছে। সঞ্চরমান রেখাগুলি সংশোধনগুলিকে ছেয়ে লতার মতো সরীসৃপের মতো রহস্যময় মূর্তি ধরছে। কী প্রাণবন্ত তাদের ভঙ্গিমা।
এই পাণ্ডুলিপি কলারসিকের ঔৎসুক্য এবং মুগ্ধতার বিষয় হয়ে রয়েছে। ফরাসি কলাসমালোচক অঁরি বিদোর কলমে পাচ্ছি এর একটি মনোজ্ঞ বিশ্লেষণ। বাংলা অক্ষরে লেখা পাণ্ডুলিপির ইরেজারগুলিকে লক্ষ্য করে তাঁর মনে হয়েছে:
"These corrections took the form of horizontal crossing out, with thin threads of white between the black lines. This delicate surface of black striped with white was enclosed by him in an outline like a Cartouche. Sometimes it extended over to lines. It was then as though the cartouche had become a capital. It was finished at the top by a torus which rested on an ogre, but if the lower line of erasure extended towards the left, the general form changed again. It stretched out into a beak or a keel, and behold, a bird was flying towards the west." [২]
পাণ্ডুলিপির পৃষ্ঠায় পৃষ্ঠায় কাটাকুটিগুলি যেন দ্বীপের মতো চেহারা ধরছে লক্ষ্য করেছেন বিদো। এই দ্বীপগুলি বিচিত্র আয়তনের, কখনো তারা পৃষ্ঠার একধারে পুঞ্জিত, কখনো পাতা জুড়ে ছড়িয়ে আছে, জলের উপরে মাথা তুলে যেন এই সব দ্বীপমালা ভেসে বেড়াচ্ছে, সুছাঁদ, তন্বী লিপির বন্ধনে তারা যুক্ত--
"Tagore had joined up these islands of erasures, not by dead straight lines but by soft and flowing curves which seemed almost to breathe and the stylised erasures and linking curves made between them a single arabesque with masses and disconnections, nerves and flexures, all obeying organic law." [৩]
রবীন্দ্রনাথের হস্তাক্ষরের বিখ্যাত সুষমার সঙ্গে আমরা সকলেই পরিচিত। এই হস্তলিপি সুপরিমিত, সুসমঞ্জস, নিখুঁত রূপের ঢেউ তুলে লাইনের পর লাইনে গড়িয়ে যায়। তাই যখনি একটি শব্দকে, বা শব্দবন্ধকে সংশোধন করতে হয় একটা অসুন্দর বাধা খাড়া হয়ে উঠে সম্পূর্ণ লেখার ভারসাম্যটিকে নষ্ট করতে চেষ্টা করে। কবির সৌন্দর্যবোধে তাতে ঘা লাগে, তিনি সুন্দরের মধ্যে দেখতে চান 'বিরোধহীন সুষমা'। তাঁর মন তখন মেতে ওঠে হারিয়ে যাওয়া ভারসাম্যকে পুন:প্রতিষ্ঠার কাজে। যতক্ষণ না সেই কাজ সম্পূর্ণ হচ্ছে যেন শান্তি নেই। এই প্রচেষ্টা পৃষ্ঠাগুলিতে গড়ে তোলে বিচিত্র আকৃতির মেঘপুঞ্জ, বক্রচঞ্চু পাখি, জটিল কৌণিক নকশা। স্টেলা ক্রামরিশ লক্ষ্য করেছিলেন পাণ্ডুলিপির চিত্রচর্চার স্পষ্ট বিবর্তন রেখা:
"They are drawn with the delicacy and precision of the written letters. These early drawings are calligraphy in the true sense of the word which is 'beautiful writing' and they take their origin from writing.
The 'graphs' had their own insistence. They detached themselves from the writing and joined their ambient lines into conclusive shapes, that of a vase, for instance, altogether full of ornament which builds it up with the stroke of the pen as the potter's wheel compels the clay. These independent islands of design are arisen from the waves of Calligraphy. They stayed on. They developed in many directions and grew in size and variety of texture and contents." [৪]
রক্তকরবী নাটকের পাণ্ডুলিপির একটি পৃষ্ঠায় বিশু আর ফাগুলালের সংলাপের পাশাপাশি একটি আলংকারিক জান্তব রূপ গড়ে উঠেছে লাল ও কালো কালিতে। রক্তকরবীর অন্যান্য পাণ্ডুলিপিতেও আঁকিবুকি দেখা যায় আর পূরবীর পাণ্ডুলিপি তো এর সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য নিদর্শন। অন্যান্য কাব্যগ্রন্থের পাণ্ডুলিপিতেও এই চর্চা পরবর্তীকালে চলেছে। লক্ষণীয় যে নাটক এবং বিশেষ করে কবিতার পাণ্ডুলিপিতেই ইরেজারগুলি বিচিত্র আকৃতি নিচ্ছে, গদ্যের পাণ্ডুলিপিতে এরা আসেনি তা নয় তবে তুলনায় খুব কম। যাত্রীর পাণ্ডুলিপিতে দুএকটি নকশা দেখা দিয়েছে, অন্যত্রু। কিন্তু আকৃতিতে তারা ক্ষুদ্র, বৈচিত্র্যেও তেমন উল্লেখযোগ্য নয়। এর কারণ হিসেবে মনে হওয়া স্বাভাবিক যে রেখার ছন্দের সঙ্গে কবিতার ছন্দের যোগই তৈরি হয়েছে হয়তো তাঁর সুরময় চৈতন্যলোকে। কবিতার চিত্রকল্পরাজির সমান্তরালে পাণ্ডুলিপির পরিবর্তমান প্রতিমাগুলি বেড়ে উঠেছে - গদ্যের ভাবকাঠিন্য ও যুক্তি-শৃঙ্খলার নিরেট বুননের পাশে তারা জায়গা পায়নি। কিন্তু সেই সঙ্গে আরেকটি অত্যন্ত বাস্তব কারণও স্পষ্ট - কবিতার পাণ্ডুলিপিতে এবং নাটকের সংলাপের ফাঁকে ও পৃষ্ঠার এদিক ওদিক জুড়ে রয়ে যায় অনেকখানি শাদা জমি, কলমের ডগায় ভিড় করে আসা রূপগুলিকে মুক্তি দেবার সময় ঐ ফাঁকা পট কবি কাজে লাগিয়েছেন। কবিতার পংক্তিগুলির আশে পাশে ঘিরে ধরেছে এই সব নকশা, কখনো গোটা স্তবকটির প্রাথমিক খসড়াকে অবলুপ্ত করে ছবি তৈরি হয়ে উঠেছে আবার ডানপাশে চৌকো শাদা জমি ঘিরে নিয়ে সংশোধিত স্তবকটিকে পরিচ্ছন্ন বিন্যস্ত করেছেন, যেমন 'শেষ বসন্ত' কবিতার শেষ পৃষ্ঠার পাণ্ডুলিপিতে। এতখানি স্বাধীনতা, আলো অন্ধকারের বৈপরীত্যকে জোরের সঙ্গে, এতখানি আয়তন দিয়ে ফুটিয়ে তোলা গদ্যের পাণ্ডুলিপিতে কখনোই সম্ভব নয়।
'শেষবসন্ত' কবিতার ঐ পাণ্ডুলিপিতে রহস্যময় কারুকার্যের ফাঁকে টুকরো আলোর ঝিলিকের মধ্যে কবিতার শেষ অংশটি আশ্চর্য তাৎপর্য নিয়ে দেখা দেয়, অন্ধকারের মধ্য থেকে চেয়ে থাকে অবিস্মরণীয় পংক্তিগুলি--
ফেলে দিয়ো ভোরে-গাঁথা
ম্লান মল্লিকার মালাখানি
সেই হবে স্পর্শ তব, সেই হবে বিদায়ের বাণী।
কবিতা আর ছবি মিলে রচিত হয়ে ওঠে এক অভিনব শিল্পকলা।
অ্যাণ্ড্রু রবিনসনের রবীন্দ্র চিত্রকলা বিষয়ক গ্রন্থের মুখবন্ধ লিখতে গিয়ে সত্যজিৎ রায় পাণ্ডুলিপির পৃষ্ঠার এই চিত্রচর্চা বিষয়ে 'Fantastic forms' শব্দটি ব্যবহার করেছেন এবং লক্ষ্য করেছেন:
"... Rabindranath turned them into grotesque creatures. These emendations were strung together until the whole page took on the appearance of a tapestry of words and images."[৫]
পূরবীর পাণ্ডুলিপির অঙ্কনে কালোকালিরই বহুল ব্যবহার। কিন্তু কোথাও কোথাও লাল কাল এবং মোমরঙের ব্যবহারও চোখে পড়ে। বর্ণ প্রয়োগ স্পষ্টত একটি চিত্রধর্মী চারিত্র্য এনে দেয়।
'যাত্রা' কবিতার পাণ্ডুলিপিতে দীর্ঘ, বক্রচঞ্চু, সর্পিল দেহ তিনটি বিচিত্র পক্ষীমূর্তি একে অপরের সঙ্গে সংযুক্ত, ঐ কবিতারই পর পৃষ্ঠায় আছে গাড় কালো আর টুকরো শাদা জমির আলোছায়ায় রচিত নকশা। 'তপোভঙ্গ' কবিতার পাণ্ডুলিপিতে একটি উড়ন্ত পাখি চোখে পড়ে। বস্তুতঃ পাখির মোটিফ ফিরে ফিরেই দেখা দিয়েছে।
'যাত্রা বা তপোভঙ্গ' -এর আলগা কাগজে লেখা পাণ্ডুলিপি রয়েছে কিন্তু চিত্রচর্চার অসাধারণ নিদর্শন হল পূরবীর 'পথিক' পর্যায়ের কবিতাগুলি যে খাতায় লেখা হয়েছে (রবীন্দ্র পাণ্ডুলিপি ১০২) সেটি। এগুলি সবই 'আণ্ডেস' জাহাজ ও বুয়েনোস এয়ারিস লেখা ।
'অপরিচিতা' কবিতার পাণ্ডুলিপিতে অদ্ভুত দুটি জন্তু যেন মিলে মিশে গেছে। মাঝে মাঝে সরু সরু শাদা আয়্তাকার জমিতে কবিতাটি লেখা। 'আনমনা' কবিতাতে জটিল ভারি নকশা তৈরি হয়েছে, সূক্ষ্ম মাকড়সার জালের মত রেখাচিত্র দেখা দিয়েছে ফাঁকে ফাঁকে। 'বিস্মরণ' কবিতায় চঞ্চল রেখায় তৈরি হয়েছে একটি ফিগার এবং একটি কুকুর জাতীয় উদ্ভট জীব - যার দাঁতের সারি স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। 'বাতাস' কবিতার পাণ্ডুলিপিতে একটি মনুষ্যমুখের প্রোফাইল, তাতে উল্কি ধরনের ত্রিকোণের বিন্যাস রয়েছে ।
লক্ষণীয় যে পাণ্ডুলিপিতে মনুষ্যমুখ সবই পাশ থেকে দেখা আকৃতি, কালো সাদার সংঘাতে নাক, চোখ ও মুখের একদিকের ছাঁচ - অনেকটা যেন মিশরীয় প্রাচীন চিত্রকলার মতো। পরে অবশ্য রবীন্দ্রনাথ সম্মুখ মুখাকৃতি অজস্র এঁকেছেন, ডিম্বাকৃতি মুখশ্রীতে গহন দুটি চোখে রহস্যময়তা ফুটেছে, বিশেষত রমণীমুখে। নারী মুখশ্রীতে চোখ দুটির একই ভঙ্গি আর গড়ন তাঁর ছবিতে ঘুরে ঘুরে আসে, এর কারণ জিজ্ঞাসা করেছিলেন নন্দলাল বসু একবার। রবীন্দ্রনাথের উত্তরটি আজ আমরা সবাই জানি, 'নতুন বৌঠানের চোখ দুটো এমনভাবে আমার মনের মধ্যে গাঁথা আছে যে মানুষের ছবি আঁকতে বসলে অনেক সময়েই তাঁর চোখ দুটো আমার চোখের সামনে জ্বলজ্বল করতে থাকে - কিছুতেই ভুলতে পারিনে। তাই ছবিতেও বোধহয় তাঁর চোখেরই আদল এসে যায় ।' [৬] পূরবী র পাণ্ডুলিপিতে কিন্তু এই ধরনের চোখ আঁকা হয়নি ।
'স্বপ্ন' কবিতাটির প্রথম পৃষ্ঠার পাণ্ডুলিপিতে একটি মনুষ্যমূর্তির আভাস আছে, কিন্তু সে শুধু উপরের অংশে, নীচের দিকে নানা আকৃতির কৌণিক নকশা সমস্তটাই পরস্পরের সঙ্গে যুক্ত। পরের পৃষ্ঠার একটি গুরুভার হীরকাকৃতি শীর্ষ থেকে লঘুভঙ্গিতে নৃত্যপুর লতা নীচে প্রবাহিত হয়ে চলেছে।
'সমুদ্র' কবিতার পাণ্ডুলিপিতে একটি বক্রপাখি গড়ে উঠেছে। 'মুক্তির তো এক মূর্তি নহে' এই পংক্তিটি ছাড়া ২৯ পৃষ্ঠায় সমস্ত লেখা মুছে আঁকা হয়েছে একটি পাশফেরা মুখ, গলা এবং কিছুটা শরীরের অংশ। ছবির ভেতরটা ভরাট করা হয়েছে আলোছায়ার জাফরি কাটা সূক্ষ্ম ডেকোরেটিভ ডিজাইন দিয়ে। হঠাৎ করে মনে পড়ে যায় আফ্রিকার আদিম শিল্পকলা, কোনো প্রাচীন ধর্ম সংস্কার জড়ানো মূর্তি ।
'ঝড়' কবিতার পাণ্ডুলিপিতে দুটি ছবি রয়েছে, ৩৫ পৃষ্ঠার যেন বিরাট পাখির মতো একটা কিছু রয়েছে। সমস্ত ছবিটি কালোর জমিতে টুকরো টুকরো নানা বিচিত্র আকৃতির শাদার বিন্যাসে এক অভিনব আলপনার চেহারা নিয়েছে। ঐ আলোর মধ্যে মধ্যে কবিতাটি ফুটে উঠেছে। কিন্তু অনেকগুলি শাদা টুকরো রয়েছে যেগুলিতে কোনো লেখা নেই, শুধু রূপটিকে সম্পূর্ণ করতেই এদের আবির্ভাব। ৩৭ পৃষ্ঠায় কালো ও লাল কালির ব্যবহারে একটি প্রাণী হেন কিছু গড়ে উঠেছে। পাণ্ডুলিপির কাটাকুটিতে কালো ও লাল দুই বর্ণের ব্যবহার রবীন্দ্রনাথ প্রায়শ করেছেন। পরে তাঁর ছবিতেও আমরা দেখি এই দুই রঙের প্রতি তাঁর স্পষ্ট পক্ষপাতিত্ব।
'পদধ্বনি' কবিতার সূচনা অংশের পাণ্ডুলিপিতে (৪১ পৃঃ) ঘন কালি লেপে প্রাণী ও মানুষে তালগোল পাকানো একটি মূর্তি আঁকা হয়েছে। ঠোঁটের অংশ - বিরাট হাঁ বেশ স্পষ্ট, ফালি ফালি শাদা অংশে কবিতাটি লেখা, তারই মধ্যে গলা বাড়িয়েছে একটি পাখি। ঐ কবিতারই ৪৩ পৃষ্ঠার পাণ্ডুলিপিতে একটি উপবিষ্ট মনুষ্যমূর্তি আঁকা হয়েছে, কিন্তু তার পিঠের কাছেও শক্ত, দীর্ঘ চঞ্চু নিয়ে একটি পাখি জেগে উঠেছে। সমগ্র ফিগারটি নানা ত্রিকোণ, বর্গ ও আয়তাকার জ্যামিতিক নকশা দিয়ে ভরে দেওয়া হয়েছে। মুখে একটা ভয়ার্ত ভাব চাপা থাকেনি, চোখ যেন বিস্ফারিত, চুল দীর্ঘাকৃতি টানটান। কোন অদৃশ্য শক্তি যেন এই অদ্ভুত মানুষটিকে বেঁধে রেখেছে। এই ছবিটি খুবই বিখ্যাত, নানা গ্রন্থে ব্যবহৃত, পাণ্ডুলিপির চিত্রচর্চার উদাহরণ রূপে।
'প্রকাশ' কবিতার পাণ্ডুলিপিতে ঘন বুনোটে একটি বিরাট মুখ তৈরি হয়েছে। জটিল নকশা এখানেও আছে। 'শেষ' কবিতাতেও সূক্ষ্ম ডিজাইন ঠাসা রয়েছে। 'অবসান' কবিতার পাণ্ডুলিপিতে হালকা নর্তনশীল রেখা ছাড়াও ৬৩ পৃষ্ঠায় ওপরে মার্জিনে একটি ছোটো পাশফেরা মুখ আঁকা হয়েছে, শ্মশ্রু গুম্ফমণ্ডিত। 'তারা' কবিতাটির শুরুতে আবার শেষে লঘু পরিসজ্জা রয়েছে।
'মৃত্যুর আহ্বান' কবিতার পাণ্ডুলিপিতে ডানা মেলা পাখি আঁকা হয়েছে। 'দান' এর পাণ্ডুলিপিতে ছোটো ছোটো রেখা টেনে স্তরীভূত একটি নকশার সৃষ্টি করা হয়েছে। 'অতীতকাল' এর পাণ্ডুলিপিতে একটি কুমির জাতীয় জীব দেখা দিয়েছে। সর্পিল ভাবও খানিকটা আছে তাতে।
'শীত' এর পাণ্ডুলিপির ছবিটি নানা কারণে উল্লেখযোগ্য। পৃষ্ঠার মাঝখানে একটি পাশফেরা মুখ, ধারেও একটি মুখের আভাস, চারপাশে নীল রেখা টেনে বর্ডার দেওয়া হয়েছে। কালোর সঙ্গে নীল ও হালকা বেগুনি মোম রঙের ব্যবহার করা হয়েছে। মৃদু বর্ণের আভা ছবিটিতে একটা খুশির ভাব নিয়ে এসেছে।
'প্রভাত' কবিতায় উপস্থিত হয়েছে একটি চতুষ্কোণ, দ্বিস্তর কারুকার্য। এই কবিতার শেষ ও 'বিদেশী ফুল' এর শুরু - মাঝের ফাঁকা জমিটিতে যেন একটি পাখি ডানা মেলে দিয়েছে। স্পষ্টত পক্ষী আকৃতি নয় কিন্তু সূক্ষ্ম রেখার জালে আচ্ছন্ন ফিগারটি পাখিরই বিমূর্ত রূপ মনে হয়। 'অতিথি' কবিতার শেষে জমাট কালোর মাঝে হাল্কা সাদা লাইন চলেছে। 'অন্তর্হিতা' কবিতার পাণ্ডুলিপিতে ছোটো ছোটো প্রাণীর মত ডিজাইন রয়েছে। 'শেষ বসন্ত' কবিতার পাণ্ডুলিপিতে রহস্যময় আলোছায়ার বিমূর্ত জ্যামিতিক বিন্যাসের মধ্যে সাদা টুকরো জমি ঘিরে কিভাবে শেষ স্তবকটির সংশোধিত রূপটিকে রাখা হয়েছে তা আমরা পূর্বেই আলোচনা করেছি।
'চাবি'র পাণ্ডুলিপিতে নমনীয় রেখার লীলা চলেছে। 'বৈতরণী'র পাতা জোড়া আলপনাধর্মী তরঙ্গ তো খুবই বিখ্যাত। সাবলীল ভঙ্গিতে পাক দিয়ে উঠেছে কলমের জোরালো টান। সাদা-কালোর দ্বন্দ্বে রূপ জেগে উঠছে।
তৃতীয়বার পাণ্ডুলিপিতে ঘন কালোর মাঝে মাঝে সাদা ফাঁকে কবিতাটি লেখা। কালোর গায়ে হলুদ মোম পেন্সিল ঘষে দ্যুতি আরোপ করা হয়েছে। 'চঞ্চল' কবিতার পাণ্ডুলিপিতে আবরণের আড়ালে কার যেন মুখের ইঙ্গিত আসে। 'প্রবাহিনী'র পাণ্ডুলিপিতে স্পষ্টত নারীমুখ, কোমল মায়াবী টানে আঁকা, কখনো মনে হয় যেন, মাথায় টুপির আভাস। 'আকন্দ' কবিতার পাণ্ডুলিপিতে অধাবগুণ্ঠিত মুখ দেখা দিয়েছে। তাছাড়া রয়েছে লেখা লুপ্ত করে একটি ছবির বিস্তার-- তাতে কালো, নীল, বেগুনী, সবুজ রঙের উজ্জ্বল খেলা চলেছে।
পাণ্ডুলিপির পৃষ্ঠাগুলি দেখলে বোঝা যায় কী বিপুল আবেগ পূরবীর পাণ্ডুলিপির চিত্রচর্চায় সংহত হয়ে আছে যা পরবর্তীকালে আড়াই হাজার স্কেচ ও ছবিতে দুর্দম বেগে প্রবাহিত হবে। যে বিস্ফোরণ অবনীন্দ্রনাথের [৭] শিল্পীমানসে আগ্নেয়গিরির উৎসারের উপমা জাগিয়ে তুলেছিল। দক্ষিণ আমেরিকা যাত্রার সময় রেখার তরঙ্গ আবির্ভূত হচ্ছে পাণ্ডুলিপির পৃষ্ঠায়, ধারাটা চলছে বুয়েনোস এয়ারিসে পৌঁছবার পরও। সান ইসিদ্রোতে কবির অবস্থান কালে এই অদ্ভুত পাণ্ডুলিপি উৎসাহিত করে তুলল ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোকে; এটি ঐতিহাসিক ঘটনা। এভাবে তাঁর কবিতার পাণ্ডুলিপির বিচিত্র মূর্তি সাড়া জাগায়নি আর কারো মনে। ভিক্টোরিয়ার সংবেদনশীল শিল্পবোধপ্রদীপ্ত মনে ধরা পড়েছিল এই পাণ্ডুলিপির চিত্রময়তা--
'The cancelled mistakes in Tagore's poems gave birth to a world of forms that grinned, frowned or laughed at us in a mysterious and fascinating way. I begged him to let me photograph some of the pages. The permission was granted. That copy-book, I think, was the beginning of Tagore the Painter, of his urge to translate his dreams with a pencil or a brush.'
(Tagore on the banks of the River Plate Rabindranath Tagore. A Centenary Volume 1861-1961, Sahitya Akademi. pp 40)
স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে কোথা থেকে এল এসব বিচিত্র পাখি, পশু অন্ধকার দীর্ণ করে প্রকটিত মনুষ্যমুখ, কৌণিক নকশা - পূরবীর কবিতা গুচ্ছের সমান্তরালে এরা বেড়ে উঠেছে তাই কবিতা ও ছবিকে একটি তলে রেখে সাদৃশ্য সন্ধানের ইচ্ছা হওয়া অস্বাভাবিক নয়। স্রষ্টার মন একই সময়বৃত্তে স্বতন্ত্র দুটি শিল্পমাধ্যমে নিজেকে প্রকাশ করছে, তাই মনে হয় কবিতার ভাবনা সূত্রে কবির মনে যে ইমেজগুলি সঞ্চরমান, ছবিতে কি তারাই দেখা দিয়েছে রূপান্তরে?
প্রতিমাদেবী লেখা ও ছবি দুয়ের মধ্যে একটি সংযোগ আবিষ্কারের চেষ্টা করেছেন: '... লেখার মাঝে ফাঁকা সময়টুকু তাঁর চিত্তকে চিন্তা করবার অবকাশ দিত। তিনি সেই শূন্য সময়টা পূর্ণ করতেন রেখাঙ্কনের অবলীলায়মান খেলায়। সেই সঙ্গে তাঁর মনোলোকের 'আগডুম বাগ্ডুম' ভাবগুলো ভাষায় যেমন বিশেষ আকৃতি নিয়ে বাঁধা পড়ত, রেখায় থাকত তেমনি জল্পনাকল্পনার অনির্দিষ্ট সংকেত। অর্থাৎ রেখায় পড়ত ধরা সৃষ্টির প্রাক্কাল। আর ভাষায় দেখা যেত ভাবের পরিপূর্ণ রূপ। বস্তুত এমনি করেই তাঁর লেখা - কাটাকুটির খেলা একদিন চিত্রজগতের দ্বারে এসে ঘা দিল।" [৮]
পূরবীর পাণ্ডুলিপির কাটাকুটিতে কালো রঙের বহুল ব্যবহার একটা আঁধার ঘনিয়ে আনে, কৃষ্ণবর্ণের গাঢ়তায় কিছুটা ভীতিও মিশে থাকে। পরবর্তী কালের ছবিতেও দেখি রবীন্দ্রনাথের বর্ণরুচি অন্ধকারের কূল ঘেঁষে চলেছে - তমস্বিনী রাত্রির ছায়া প্রায় সর্বত্র পড়েছে বিচিত্র বর্ণের ব্যবহার সত্ত্বেও।[৯] পূরবী কাব্যের মৃত্যুবোধ, 'আতঙ্কিত নিশীথবেলা'র অনুভূতির সঙ্গে পাণ্ডুলিপির এই কালিমা অনেকসময় যেন একাকার হয়ে যায়। কখনো পুঞ্জ পুঞ্জ আলো ছায়ায় রোমাঞ্চিত প্রতীক্ষার প্রতিফলন ঘটে। ডানামেলা পাখির দল কি অজানার পথে যাত্রার প্রতীকী রূপ নিয়ে আসছে? ভয়ার্ত মনুষ্যমুখেও কখনো কি ধরা দিয়ে যায় অবর্ণনীয় মরণশঙ্কা? রঙিন মোম পেন্সিলের কোমল আভায় কি রোমান্টিক উত্তেজনা ছাপ রেখে যাচ্ছে?
কিন্তু এ ক্ষেত্রে প্রথমেই স্বীকার করে নিতে হবে বস্তুজগতের সাদৃশ্য রবীন্দ্র চিত্রকলায় জরুরি নয়। কবি কাটাকুটিগুলিকে খাপছাড়া অবস্থা থেকে উদ্ধার করতে গিয়ে আকারের বিচিত্র নৃত্য দেখে যেন বিস্মিত হয়ে যান, ক্রমে রেখার আবর্তের মধ্যে দেখা দেয় পরিচিত পার্থিব কোনো রূপের হয়তো সুদূর আংশিক আভাস, জীবজগতের কোনো ভঙ্গি, তখন লেখনী নতুন নতুন রেখায় অঙ্গ প্রত্যঙ্গ যোজনা করে, অবশেষে একটা প্রাণী ধীরে ধীরে স্পষ্ট হয়, পরিচিত জগতের সঙ্গে যার কিছু সম্পর্ক আছে, কিছু বা নেই। পৃথ্বীশ নিয়োগী লক্ষ্য করেছেন : "রেখার গ্রন্থিজটিল খেয়ালী কারুকার্যের চরম রূপান্তর প্রাথমিক অবস্থায় কবিরও অজ্ঞাত। মগ্ন চৈতন্যের রহস্যময় মূর্তিশালা থেকে অজানা ইশারা আসে, আকৃতির অঙ্কুর অভাবনীয় পরিণতি পায়। অর্ধ চেতনার এই খেলায় দ্বিধা দেখা দেয় - কোনো কোনো অর্ধরচিত পুষ্পাকৃতি হয়তো মধ্য পথে মত পরিবর্তন করে অবশেষে রূপ ধরে কোনো এক সৃষ্টিছাড়া কাল্পনিক পাখির। রেখার প্রাথমিক নীহারিকায় হয়ে ওঠার কোনো স্থিরতা বা নিশ্চিত নির্দেশ থাকে না অনেক সময়।"[১০]
পাণ্ডুলিপির কবিতা ও ছবিকে পাশাপাশি রেখে দেখতে গেলে কোথাও হয়তো কিছু মিল পাবো, কোথাও পাবো না। কবির চৈতন্যলোকের গহন স্তর থেকে এই বুদবুদগুলি অভাবিত রূপ নিয়ে ভেসে উঠেছে, তার সঙ্গে সচেতন শিল্পপ্রয়াস যুক্ত হয়েছে পরবর্তী সোপানে, ছন্দের অব্যর্থ গতিতে ও আকারের আনন্দ স্থাপত্যেই এর উৎকর্ষ। 'শেষবসন্ত' কবিতার পাণ্ডুলিপিতে সাদা কালোর রৈখিক বিন্যাসের মধ্যে--
বেণুবনচ্ছায়াঘন সন্ধ্যায় তোমার ছবি দূরে
মিলাইবে গোধূলির বাঁশরির সর্বশেষ সুরে।
এই পংক্তিগুলি দেখে কানাই সামন্তের মনে হয়েছিল--
"পূরবীর পৃষ্ঠায় এই রচনা বক্ষে ধরে আছে যে ছবি সে কোনো অরণ্যের প্রতিচ্ছবি নয়, কিন্তু কালোর গহনে পুঞ্জ পুঞ্জ আলোক কণিকার সচকিত সমাবেশ অরণ্যের কল্পরূপ যা স্বরূপ বলে মনে হয় সহজেই।"[১১]
এই ধরনের কল্পরূপের সাক্ষাৎ পাণ্ডুলিপির পৃষ্ঠায় কিছু পেয়েছি, পূর্বেই তা আলোচিত হয়েছে। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের চৈতন্যলোক ও শিল্পীসত্তার আতত দুরধিগম্য গভীরতার কথা স্মরণ করে প্রতিটি ক্ষেত্রে সাদৃশ্য স্থাপনের চেষ্টা জরুরি মনে হয়নি। কারণ এও দেখছি পাণ্ডুলিপির এই সব ছবির কিছু কিছু আভাস এসেছে কবির পরবর্তীকালের কাব্যসমূহের চিত্রকল্পে, এর সঙ্গে হয়তো যোগ আছে তাঁর বিশ্বপরিস্থিতির ধাক্কায় সংকটাপন্ন শুভবোধের, কবে থেকেই যা ডালপালা মেলছিল। আমাদের মনে পড়বে 'বাতায়নিকের পত্র' (১৩২৬), অ্যাণ্ডরুজকে লেখা ১৯২০-২১ সালের চিঠিপত্রে লুব্ধ যন্ত্রসভ্যতার বিরুদ্ধে কবির ধিক্কার আর গ্লানি, মনে পড়বে এর আগেই লেখা হয়ে গিয়েছে মুক্তধারা আর রক্তকরবীর মতো নাটক। যেখানে আমরা পেয়েছি ভয়, বিতৃষ্ণা মেশা অদ্ভুত প্রতিমাপুঞ্জ--
'ওটাকে অসুরের মাথার মতো দেখাচ্ছে, মাংস নেই, চোয়াল ঝোলা।'
'ওটাকে দানবের উদ্যত মুষ্টির মতো দেখাচ্ছে'
'... ঐ যন্ত্রের চূড়াটা সূর্য্যস্তমেঘের বুক ফুঁড়ে দাঁড়িয়ে আছে যেন উড়ন্ত পাখির বুকে বাণ বিঁধেছে, সে তার ডানা ঝুলিয়ে রাত্রির গহ্বরের দিকে পড়ে যাচ্ছে।'
'... সইতে পারছি নে ঐ বীভৎসটাকে যা এই ধরণীর সংগীত রোধ করে দিয়ে আকাশে লোহার দাঁত মেলে অট্টহাস্য করছে।'
বিভূতির যন্ত্রের বর্ণনায় এই ধরনের উপমা ঘুরে ফিরেই এসেছে। মুক্তধারার এইসব ইমেজের পাশে রক্তকরবী নাটকের তাৎপর্য যেন গভীরতর হয়ে দেখা দেয়। শুধু টিকে থাকার অর্থহীন কুশ্রীতা নিয়ে আসে 'একটা মরা ব্যাঙ', 'পৃথিবীর বুক চিরে দরকারের বোঝা-মাথায় কীটের মতো' মানুষের দল উঠে আসে, বিশুর সংলাপে ধরা পড়ে বণিক সভ্যতার ধূ ধূ মরুভূমি--
'সুড়ঙ্গ কেটেই চলেছি, এক হাতের পর দুহাত, দুহাতের পর তিন হাত। তাল তাল সোনা তুলে আনছি, এক তালের পর দুতাল, দু তালের পর তিন তাল। যক্ষপুরে অঙ্কের পর অঙ্ক সার বেঁধে চলেছে, কোনো অর্থে পৌঁছয় না। তাই ওদের কাছে আমরা মানুষ নই, কেবল সংখ্যা।'
পাণ্ডুলিপির চিত্রচর্চা প্রসঙ্গে এই সূত্রেই স্পষ্ট করে নেওয়া ভালো যে এই সব অদ্ভুত ইরেজারের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের পরবর্তী পর্যায়ে আঁকা বেশ কিছু ছবির ঘনিষ্ঠ যোগ আছে।[১২] অঁরি বিদো পূর্বোক্ত আলোচনায় বলেছিলেন:
"Rabindranath Tagore has long since abandoned this starting point of turning erasures into a design. Fate and the gods give him now a days other starting points, but there are recognizable traces of this first manner even in his latest work, and these explain certain forms that it takes." [১৩]
পরবর্তীকালেও যখন কবি রং তুলি ব্যবহার করেছেন তখনো কালো রঙের ব্যবহার সবচেয়ে ব্যাপক। সোমেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় লক্ষ্য করেছেন:
"বহু ছবিতে কালো আর পাঁচটি রঙের সরিক মাত্র নয়, সেই প্রধান আসন জুড়ে। গাছপালা, মানুষ, বিচিত্র দৃশ্যবস্তুকে গাঢ় অন্ধকারের প্রলেপে আচ্ছন্ন করে অনেকখানি ঢেকে ফেলার প্রবণতা রবীন্দ্রনাথের ছবিতে খুব বেশি চোখে পড়ে ।"[১৪]
ক্রেয়ন ও কালির প্রতি একটা পক্ষপাত তাঁর বরাবরই ছিল। তেল রং পছন্দ করতেন না, শুকোতে দেরি হয় বলে। রঙের জমিতে বুনট তৈরি করার জন্য কালিমার ওপর পেন্সিল ঘষে বর্ণ আরোপ তাঁর একটি স্ব-আবিষ্কৃত কৌশল। জল রং ব্যবহার করতেন ঘন করে গুলে। প্রকরণগত এই সব বৈশিষ্ট্যের ফলে তাঁর ছবিতে একটা গ্রাফিক কোয়ালিটি আছে - পাণ্ডুলিপির ছবিতেও এটা লক্ষ্য করি। শুধু প্রকরণ নয় ভাবের দিক দিয়েও পাণ্ডুলিপির ছবি ও পরবর্তী চিত্রাবলির যোগ যথেষ্ট। এই সব অদ্ভুত জান্তব আকৃতি, পরিযায়ী পাখি, রহস্যময় মনুষ্যমুখ, কড়ি ও কোমলে লীলাময় রেখার নৃত্য সবই এসেছে পরবর্তী স্তরে ব্যাপক ভাবে। বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায় সিদ্ধান্তে এসেছেন:
"পাণ্ডুলিপিতে কাটাকুটির নকশা এবং ঠিক পরের যুগের রচনা, এই দুইয়ের সংযোগে রবীন্দ্রনাথের চিত্রের নিজস্ব পরম্পরা তৈরি হয়েছে। পাণ্ডুলিপির নকশাগুলি যদি কেউ বিশেষ সাবধানতার সঙ্গে অনুসরণ করেন তবে তাঁরা স্পষ্টই বুঝবেন, পরবর্তীকালের রচনার আকার প্রকার ও ভঙ্গির সঙ্গে পাণ্ডুলিপির নকশাগুলির সম্বন্ধ কত ঘনিষ্ঠ।" [১৫]
কাটাকুটির খেলা, 'ডুড্ল' তা থেকে ছবি গড়ে ওঠা - এ ব্যাপারটি কেমন করে হয় কে. জি. সুব্রমনিয়ম একটি সাক্ষাৎকারে তা ব্যাখ্যা করেছিলেন, প্রথমে বিশেষ কোনো উদ্দেশ্য বা ইনটেনশন থাকে না, অনেকটা এগিয়ে চলার সঙ্গে সঙ্গে আবিষ্কার করার মতো, একটি মডেল ইমেজ থেকে অন্য মডেল ইমেজ যাত্রা, চিন্তার জগতেও দার্শনিকদের এমন অভিজ্ঞতা ঘটে। কাটাকুটি থেকে নকশা গড়ে ওঠা, ছবির দিকে এগোনো - ব্যাপারটা প্রথমদিকে grows from a chance function, তারপর ধীরে ধীরে ডেকোরেশন আসে।[১৬]
শুধু যে পূরবীর পাণ্ডুলিপির চিত্রচর্চাতেই এই বৈশিষ্ট্য তা নয়, আমাদের মনে পড়বে ২১ কার্তিক, ১৩৩৫ এ রাণী মহলানবিশকে লেখা রবীন্দ্রনাথের পত্র:
"এই ব্যাপারটা মনকে এত করে যে আকর্ষণ করছে তার প্রধান কারণ এর অভাবনীয়তা। কবিতার বিষয়টা অস্পষ্টভাবেও গোড়াতেই মাথায় আসে, তার পরে শিবের জটা থেকে গোমুখী বেয়ে যেমন গঙ্গা নামে তেমনি করে কাব্যের ঝরনা কলমের মুখে তট রচনা করে, ছন্দ প্রবাহিত হতে থাকে। আমি যেসব ছবি আঁকার চেষ্টা করি তাতে ঠিক তার উলট প্রণালী - রেখার আমেজ প্রথমে দেখা যায় কলমের মুখে, তারপরে যতই আকার ধারণ করে ততই সেটা পৌঁছতে থাকে মাথায়। এই রূপসৃষ্টির বিস্ময়ে মন মেতে ওঠে।" [১৭]রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়কে ২ পৌষ ১৩৩৮ এ লিখছেন:
"ছবিতে নাম দেওয়া একেবারেই অসম্ভব। তার কারণ বলি, আমি কোনো বিষয় ভেবে আঁকিনে - দৈবক্রমে একটা কোনো অজ্ঞাত কুলশীল চেহারা চলতি কলমের মুখে খাড়া হয়ে ওঠে। জনক রাজার লাঙলের ফলার মুখে যেমন জানকীর উদ্ভব।" [১৮]
সুতরাং দেখা যাচ্ছে চান্স ফাংশন ব্যাপারটা তাঁর ছবি আঁকার মধ্যে আগাগোড়াই ছিল। এ ব্যাপারে শিল্পীর অবচেতন মন কী ভাবে কাজ করেছে তার ব্যাখ্যা সে যুগেও হয়েছিল, এখনো চলছে, কবি এতে কৌতুক বোধ করেছেন, চিত্রলিপির একটি রচনায় তার চিহ্ন আছে--
কে জানে কার মুখের ছবি কোথার থেকে ভেসে ঠেকল অনাহূত আমার তুলির ডগায় এসে। সাইকোএনালিসিস যোগে ইহার পরিচয় পণ্ডিতেরা জানেন স্পষ্ট, আমার জানা নয়।
(চিত্রলিপি ১)
চেতনার নির্জ্ঞান স্রোত এবং স্মৃতিপুঞ্জ কীভাবে ধরা পড়েছে তাঁর চিত্রকলায় তা বিশ্লেষণ করেছেন অনেকেই, অনেক সময় মাত্রাতিরিক্ত ঝোঁক পড়েছে অবচেতনের ব্যাখ্যায়। পশ্চিমযাত্রীর ডায়েরিতে রবীন্দ্রনাথ আপন চৈতন্যের ওপরতলা এবং নীচেরতলার রহস্যময়তা সম্বন্ধে কিছু মন্তব্য করেছিলেন। এই প্রসঙ্গে আমরা স্মরণ করতে পারি সেই কথাগুলি--
"আমার চৈতন্যের উপরের তলায় আমি এত বেশি ভুলি যে, তাতে আমার প্রতিদিনের জীবনযাত্রায় ভারি অসুবিধা হয়। কিন্তু, আমার ভোলা সামগ্রীগুলো চৈতন্যের রঙ্গমঞ্চ ছেড়ে নীচের তলায় নেপথ্যে এসে জড়ো হয়; সেখানে নতুন নতুন বেশ পরিবর্তনের সুযোগ ঘটে। আমার মনটাকে বিধাতা নাট্যশালা করতে ইচ্ছা করেছেন, তাকে তিনি জাদুঘর বানাতে চাননা। ... এই হারিয়ে যাওয়ার ভিতর দিয়ে এক যখন আর সেজে এসে হাজির হয় তখন তীক্ষ্ণ স্মরণশক্তিওয়ালা বৈজ্ঞানিক যদি সওয়াল জবাব করতে শুরু করে, তাহলে মুশকিল। তখন বিশ্লেষণের চোটে বেরিয়ে পড়তে পারে, যেটাকে নতুন বলছি সেটা পুরনো যেটাকে আমার বলছি সেটা আর কারো।" [১৯]
পাণ্ডুলিপি ও পরবর্তী চিত্রকলার কিছু কিছু কিম্ভুত, উদ্ভট মূর্তিগুলি দেখে মনে হয় জোড়াসাঁকো বাড়িতে সন্ধ্যা বা রাত্রির অভিজ্ঞতা রূপকথা এবং ভয় দেখানো, ছেলে ভুলানো গল্প তাঁর চৈতন্যে বাসা বেঁধে ছিল। মনে পড়বে ছেলেবেলার নানা বর্ণনা-- ভূত, প্রেত, শাঁকচুন্নির গল্প ঘিরে বালকমনের রহস্য-কল্পনা। এছাড়াও ছিল আব্দুল মাঝির বাঘ ও কুমীরের গল্প - শৈশবস্মৃতিপুঞ্জ থেকে অনেক সময় উঠে এসেছে হয়তো এইসব আজগুবী জানোয়ার। ফ্যান্টাসি এই সব ছবির একটা চারিত্র্য। এই উদ্ভটের খেয়াল দেখা দিয়েছে শেষপর্বের ছড়া, ছড়ার ছবি, খাপছাড়া, সে প্রভৃতি রচনায়।
রবীন্দ্রনাথের ছবির সঙ্গে শিশুদের ছবির সাদৃশ্য লক্ষ্য করেছেন বহু কলা-সমালোচক। আনন্দ কুমার স্বামীর বিখ্যাত মন্তব্য মনে পড়ে 'not childish but childlike', রাশিয়ান কলাসমালোচক এইসব চিত্রে দেখেছিলেন প্রতিভাদীপ্ত শিশুর বিস্ময়ের প্রকাশ। বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায়ের মনে হয়েছে যে-বয়সে রবীন্দ্রনাথ ছবি আঁকতে শুরু করেছেন সে-বয়স দ্বিতীয় শৈশব - পিছনে দীর্ঘজীবনের প্রান্তে শৈশবস্মৃতির অভিজ্ঞতা ও বিস্ময় ফিরে এসেছে ছবিতে। [২০] উল্লেখযোগ্য যে হেমন্তবালা দেবীকে লেখা একটি চিঠিতে রবীন্দ্রনাথও ছবি আঁকার ব্যাপারে এই 'প্রাচীন বয়সের শৈশবতা' কথাটি ব্যবহার করেছিলেন।
কিন্তু শুধুই কি শিশুর আঁকা, সাদৃশ্য আছে আদিম চিত্রকলার সঙ্গেও। পাণ্ডুলিপির আঁকিবুকিতে যে সব প্রতীকী রূপ ফুটেছে, উত্তর-পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল কিংবা মেলানেশিয়া, মাইক্রোনেশিয়া দ্বীপপুঞ্জের নানা প্রতীকী মূর্তির আদল সেখানে দেখা যায়।[২১] নন্দলাল বসু লক্ষ্য করেছেন:
"রূপকল্পনার অসংস্কৃত রূঢ় রুক্ষ বেশে আর ভাবব্যাক্তির দুর্দমনীয় শক্তিতে রবীন্দ্রচিত্রের কিছুটা সাদৃশ্য আছে মনে হয় গুহাবাসী আদিম চিত্রকরের কাজের সঙ্গে।"[২২]
বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায়ও পাণ্ডুলিপির নকশা প্রসঙ্গে এই আদিম মোটিফের উল্লেখ করেছেন:
"পাণ্ডুলিপিতে লেখার চারদিক ঘিরে লতার পাকের মতো যে নকশা সেগুলির কোনো পরম্পরা নেই। অপর দিকে অনুরূপ ভাবের নকশা যে আর কোথাও দেখা যায়না এমনও নয়। আফ্রিকা বা অস্ট্রেলিয়ার মানুষের গায়ের উলকির নকশার সঙ্গে এগুলির আকারগত সাদৃশ্য লক্ষ্য করা যাবে। এ যেন লেখাকে ঘিরে উলকি তৈরি হয়েছে।[২৩]
হতেই পারে ইওরোপে, আমেরিকা ভ্রমণকালে বিভিন্ন সংগ্রহশালায় আদিম শিল্পরূপের নানা নিদর্শনের সঙ্গে তিনি পরিচিত হয়েছিলেন কিন্তু শুধু সেই স্মৃতিই পরবর্তীকালে তাঁকে উদ্বেজিত করেছে এটা ধরে নেওয়া ঠিক হবে না। এ ক্ষেত্রে অবশ্যম্ভাবী হয়ে ওঠে সমকালীন ইওরোপে চিত্রকলা বিষয়ক আন্দোলনগুলির প্রসঙ্গ। উনিশ শতকের শেষ থেকেই ইওরোপে আধুনিকতার যে নবতম পর্ব শুরু হয় তাতে আদিম, বেহিসেবী, উচ্ছ্বাস পরায়ণ, বাস্তববোধ বিমুক্ত মগ্নচেতন প্রাণশক্তি প্রকাশ পেয়েছে, কখনো শিশুর অতিরঞ্জনী কল্পনায়, কখনো আদিম পুরাণকল্পে। চিত্রকলার জগতে বিংশ শতাব্দীর সূচনাপর্বের একটা বৈপ্লবিক চরিত্র আছে।
যামিনী রায় এই চরিত্রটিকে বিশ্লেষণ করেছেন:
"কোনো গুহায় প্রাগৈতিহাসিক ছবিতে যখন দেখি একটা ঘোড়া আঁকা হয়েছে, বুঝি যে ওটা ঘোড়াই কিন্তু ঘোড়া বা ওই ঘোড়ার সঙ্গে মিলিয়ে দেখার মতো নিখুঁত বর্ণনা তাতে নেই। অর্থাৎ ঘোড়ার মূলকথাটা আছে শুধু। তারপর সভ্যতা যতো এগোতে লাগল ততো ঝোঁকটা পড়ল রিয়ালিজমের দিকে। ... সভ্যতার বিড়ম্বনায় শিল্প হাঁপিয়ে উঠল। আজকের শিল্পীরা তাই অভিযান শুরু করেছেন এই রিয়ালিজমের বিরুদ্ধে। পালিশ ছাড়, প্রাণের দিকে নজর দাও, এই হল তাঁদের কথা।" [২৪]
বস্তুর যথাযথ অনুকরণে শিল্পীরা যখন দিশা হারিয়েছেন তখনি সন্ধান শুরু হয়েছে অন্যত্র। তাঁরা ছুটেছেন আফ্রিকায়, টাহিটিতে, জীবনের সরল আদিরূপ খুঁজে ফিরেছেন। প্রকরণের অভিনবত্ব আবিষ্কার করতে চেয়েছেন। বিংশ শতাব্দীর চিত্রকলার ইতিহাস এই সব আবিষ্কারের অ্যাডভেঞ্চারে ভরপুর।
ভ্যান গগ্ ও গগ্যাঁ জাপানী চিত্ররীতির অনুসরণে সমতল পটে স্থূল আয়তনের মধ্যে বর্ণলেপনের যে নিরীক্ষা করেছেন, সেই ফবিজম-এর চর্চা চলেছে মাতিসে প্রমুখ অসাধারণ শিল্পীদের তুলিতে। সেজান বস্তুজগতের যথাযথ প্রত্যক্ষ সাদৃশ্যকে আর লক্ষ্য রাখলেন না তাঁর ছবিতে, একটি বস্তুকে তিনি ভেঙে দিলেন কৌণিক, বর্গাকার, আয়তাকারে, কিউবিজম্-এর আগমনী পদধ্বনি শোনা গেল। পিকাসোর যে ছবিটিকে কিউবিজম্-এর সূচনা বলা হয় সেই 'Les Demoiselles d' Avigon' আঁকা হয় ১৯০৭ সালে। এতে শুধু যে নারী অবয়বগুলিকে শিল্পী খাড়া, অসমান, কোনাচে আকৃতিতে ভেঙে দিলেন তাই নয়, স্পষ্ট হয়ে উঠল আফ্রিকান ভাস্কর্যের আদল।
অন্যদিকে বিমূর্ত শিল্পকলার নিজস্ব ভাষার সন্ধান শুরু হল। কানডিনষ্কি এবং পল ক্লী র মতো শিল্পীরা আধুনিক চিত্রকলার নতুনতম নিরীক্ষা শুরু করলেন। বিমূর্ত চিত্রভাবনা একদিকে নানা নিখুঁত গাণিতিক ও জ্যামিতিক বিন্যাসে রূপ পেল, অন্যদিকে এক্সপ্রেশনিজম-এ তার বৈচিত্র্যময় প্রকাশ ঘটল। [২৫]
বারবার ইওরোপ ও আমেরিকা ভ্রমণের সময় রবীন্দ্রনাথের সজাগ ও উৎসুক চিত্ত নিশ্চয়ই এইসব চিত্র আন্দোলনগুলির পরিচয় নিয়েছিল। পশ্চিমযাত্রীর ডায়ারিতে দেখছি আর্টের এই সন্ধানকে তিনি মিলিয়ে নিচ্ছেন গোটা সভ্যতার মুক্তি সন্ধানের সঙ্গে:
"আধুনিক কলারসজ্ঞ বলছেন, আদিকালের মানুষ তার অশিক্ষিতপটুত্বে বিরলরেখায় যে-রকম সাদাসিধে ছবি আঁকত, ছবির সেই গোড়াকার ছাঁদের মধ্যে ফিরে না গেলে এই অবান্তরভারপীড়িত আর্টের উদ্ধার নেই। মানুষ বারবার শিশু হয়ে জন্মায় বলেই সত্যের সংস্কারবর্জিত সরলরূপের আদর্শ চিরন্তন হয়ে আছে; আর্টকেও তেমনি শিশুজন্ম নিয়ে অতি-অলংকারের বন্ধনপাশ থেকে বারে বারে মুক্তি পেতে হবে।
এই অবান্তর বর্জন কি শুধু আর্টেরই পরিত্রাণ। আজকের দিনের ভারজর্জর সভ্যতারও এই পথে মুক্তি ।" [২৬]
পিছিয়ে যাই ১৯১৭ সালে। মডার্ন রিভিউ পত্রিকায় ১৯১৭ সালের জানুয়ারি মাসে প্রকাশিত হয়েছিল 'অটোমেটিক ড্রইং' শীর্ষক একটি নিবন্ধ। ঐ একই সংখ্যায় রবীন্দ্রনাথের কিছু চিঠিপত্রের ইংরেজি তর্জমাও প্রকাশিত হয়। আর্চার তাই অনুমান করেছেন নিবন্ধটি হয়তো কবির নজরে পড়েছিল।[২৭] নিজের মনে যে ভাবনা গড়ে উঠছে তার কিছুটা স্বীকৃতি হয়তো পেয়েছিলেন ঐ ইংরেজি নিবন্ধটির মধ্যে। আধুনিক শিল্পীর আত্মপ্রকাশের সূত্রে ফ্রয়েড, ইয়ুং প্রমুখ মনোবিজ্ঞানীদের তাত্ত্বিক আলোকপাতের ওপর জোর দেওয়া হয়েছিল ঐ প্রবন্ধে। স্বতঃস্ফূর্ত আঁকিবুকি থেকে কী ভাবে নির্দিষ্টরূপ গড়ে ওঠে তার ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছিল--
"... automatic scribble of twisting and interlacing lines permits the germ of ideas in the subconscious to express or atleast suggest itself to the consciousness. From this mass of procreative shapes ... a feeble embryo of idea may be selected and trained by the artist to full growth and power." [২৮]
মূল কথা, শিল্পীর আঙুল একান্ত স্বচ্ছন্দগতিতে বিচরণ করবে, আদিতে বিন্দুমাত্র চেষ্টাকৃত নিয়ন্ত্রণ থাকবে না, ক্রমে একটা নির্দিষ্ট রূপ উঠবে ভেসে। তখন অবচেতন ও চেতনস্তরের মধ্যে যোগসূত্র রচিত হবে - দেখা দেবে বিশিষ্ট স্বকীয়তা, শিল্পীর নিজস্ব শৈলী।
মডার্ন রিভিউর ঐ প্রবন্ধটি ছাড়াও, আরো জোরালো একটি সম্ভাব্য অনুপ্রেরণার কথা তুলেছেন আর্চার, শিবনারায়ণ রায় প্রমুখ অনেকেই। ১৯২২ সালে কলকাতায় আধুনিক চিত্রকলার একটি প্রদর্শনী হয় - তাতে পল ক্লী, হ্বাসিলি কানডিনস্কির চিত্রাবলি ছিল। ঐ প্রদর্শনীটির বিষয়ে আলোচনা করেছিলেন স্টেলা ক্রামরিশ 'দি নিউ আর্ট ইন ইওরোপ' শীর্ষক নিবন্ধে আর স্মরণীয় যে সেটি প্রকাশিত হয়েছিল বিশ্বভারতী কোয়ার্টারলি পত্রিকায়।[২৯] রবীন্দ্রনাথ ঐ প্রদর্শনীটি দেখেছিলেন কি না তার কোনো পাথুরে প্রমাণ অবশ্য পাওয়া যাচ্ছে না কিন্তু তাঁর সদাজাগ্রত শিল্পীমনের সজীব তারুণ্য এবং অদম্য আগ্রহের কথা চিন্তা করলে মনে হয় দেখে থাকাটাই স্বাভাবিক।
শিবনারায়ণ রায় এই সব অনুপ্রেরণা সম্বন্ধে যথার্থ সিদ্ধান্তে এসেছেন--
"রবীন্দ্রনাথের ছবির উপরে এঁদের প্রত্যক্ষ প্রভাব হয়ত অল্পই পড়েছিল; কিন্তু এদের সাফল্য তাঁকে সাহস জুগিয়েছিল, সঙ্কোচজয়ে সহায়ক হয়েছিল ।"[৩০] পূরবীর 'মুক্তি' কবিতার পাণ্ডুলিপিতে একটি স্তবক ছিল, মুদ্রিত পাঠে যা বর্জিত, তার ক'টি পংক্তি এই প্রসঙ্গে আমাদের মনে পড়ে যায় -
শিশুর মতন তুমি এঁকে দাও আকাশের পটে
আনমনে যাহা-তাহা ছবি।
শিশুর মতন বসি একাসনে তোমা - সনে কবি।
চিত্রচর্চার জগতে এই লীলাময়তা যেন নতুন তাৎপর্য পেল। সাহিত্যের ক্ষেত্রে যেমন, চিত্রকলার ক্ষেত্রেও বিশ্বচেতনা মিলে গেল তাঁর মনোভূমিতে। আমরা অনুভব করি ধূর্জটিপ্রসাদ কেন বলেছিলেন খাপছাড়া ও চিত্রলিপির চিত্রে আধুনিক সমগ্র ইওরোপীয় চিত্র প্রচেষ্টা কেন্দ্রীভূত, ঘনীকৃত হয়েছে।[৩১]
আদিকালের মানুষের অশিক্ষিত পটুত্ব ও বিরলরেখার যে ছবিতে ফেরার কথা পশ্চিমযাত্রীর ডায়ারিতে বলেছিলেন, তাই যেন ফলে উঠল অনেকটা তাঁর তুলিতে। চিত্রলিপি গ্রন্থের সমালোচনাসূত্রে ও. সি. গাঙ্গুলী নির্দেশ করেছিলেন এই বৈশিষ্ট্য:
"... they are the automatic and impulsive creation of forms in a mood of naive playfulness - characteristic of the Primitive Man." [৩২]
অন্যদিকে, 'তীরের মতো', 'বর্শার ফলার মতো', 'ন্যুরালজিয়ার ব্যথা'র মতো 'খোঁচা ওয়ালা', 'কোণওয়ালা' যেসব অক্ষরের কথা বলেছিল অমিত শেষের কবিতা উপন্যাসে, চিত্রপ্রকরণেও তারাই যেন ধরা দিল। বিশ্বপটভূমির সঙ্গে রবীন্দ্রচিত্তের সংযোগ তাঁর সাহিত্যে, শিল্পে কী ভাবে ফলে উঠেছে এখানে তার বিস্তৃত আলোচনা আমরা করতে যাবোনা। শুধু এইটুকু বলতে চাই আধুনিক মনের যন্ত্রণা, সভ্যতার প্রত্যাগত বর্বরতার অশেষ বিভীষিকা তাঁর স্পর্শকাতর মনের স্বচ্ছ দর্পণে প্রতিফলিত হয়েছিল, ছবিতে অনেক সময়ে মসীলিপ্ত চিত্রপটের অন্ধকার বিদীর্ণ করে দেখা দিল তারাও। স্মরণীয় যে রক্তকরবী নাটকের জন্য যক্ষপুরীর জটিল ছবি আঁকার দায়িত্ব কবি দিয়েছিলেন গগনেন্দ্রনাথকে-- "যিনি আধুনিক নগরের শিল্পী, বর্গ আর আয়তক্ষেত্রের জটিল রূপায়ণে ছবির মধ্যে যিনি নিয়ে আসতে চান, কিউবিজমের ছায়াপাত" — লক্ষ্য করেছেন শঙ্খ ঘোষ [৩৩]।
রবীন্দ্রনাথের ছবির সাথে জার্মান এক্সপ্রেশনিস্টদের ছবির আত্মীয়তার কথা জার্মান কলা-সমালোচকরা উল্লেখ করেছেন। প্রাণ-প্রাবল্যে, রহস্যময়তায়, প্রক্ষোভের প্রকাশে সেই আত্মীয়তার সূত্র মেলে। ১৬ জুলাই ১৯৩০ বার্লিনের গ্যালারি মোয়ালার এ রবীন্দ্রনাথের চিত্রপ্রদর্শনী হয়েছিল, ১৭ জুলাই Vossische Zeitung Berlin এর কলা-সমালোচক [৩৪] লিখেছিলেন:
' There is a remarkable similarity between Tagore's manner of piercing through outer reality and that of modern European and perticularly of German artists. Some of his animals may be taken as representative of Christian Morgenstern's art. There are shadowy outlines of the human figure suggestive of Munch. There are groups and heads forcibly reminding one of Nolde... There again Tagore allows his fancy free play in the manner of Paul Klee.'
কিন্তু তাই বলে এক্সপ্রেশনিজমের ছাঁচে সম্পূর্ণ রবীন্দ্রচিত্রকলাকে ঢেলে দেওয়া অনুচিত। এক্সপ্রেশনিজমের উদ্দামতা ও অতিরঞ্জিত বিষাদ বা সুররিয়্যালিজমের সম্পূর্ণ মানসিক স্বয়ংক্রিয়তা কোনোটির সঙ্গেই রবীন্দ্রনাথের ছবি পুরোপুরি মেলেনা। এক্সপ্রেশনিস্টদের সঙ্গে তার মিলকে প্রভাব বলেননি জার্মানীর কলা সমালোচকরাও।[৩৫] তাঁরা সবিস্ময়ে লক্ষ্য করেছিলেন চেতনার অনেকটা একই রকম ধারা দুই মহাদেশে বইছে।
Hannoverschen Kurier-এ ১৯.৭.৩০ তারিখের সমালোচনাটিতে আছে:
'A shade of expressionism is especially in it which shows the character of Nolde - hardly a sign of influence, but rather a document of tendency they have in common.'
তাঁর অতিমাত্রায় সংবেদনশীল চিত্তে বিশ্বের নানা চিন্তাতরঙ্গ কীভাবে ছুঁয়ে যেত তার নানা চিত্তাকর্ষক বর্ণনা আমরা জানি। তাঁর সজাগ মনের গ্রাহকযন্ত্রে অব্যর্থ কম্পন উঠেছে বারবার। আর্জেন্টিনায় অবস্থান কালেও দেখছি তিনি এলম্হার্স্ট ও ভিকটোরিয়ার সঙ্গে উরুগুয়ের শিল্পী পেড্রো ফিগারির চিত্রপ্রদর্শনী দেখতে যাচ্ছেন, উল্লেখযোগ্য যে ফিগারিও ছবি আঁকতে শুরু করেন ষাট বছর বয়স পার করে। কেতকী কুশারী ডাইসন অনুমান করেছেন, ফিগারির চিত্রাবলির বিষাদ রবীন্দ্রনাথের মনে ঘা দিয়েছিল। তখন তিনিও চিত্রকলার জগতে প্রবেশ করেছেন, এই প্রদর্শনী একটা অনুপ্রাণনা এনে দিতেই পারে।[৩৬] ১৯২৪-এ অন্তর্গত ও বহির্গত অনুপ্রেরণা মিশে গিয়েই নতুন একটা স্রোত শুরু হয়েছিল। যা পুরোপুরি চেহারা পেল ১৯২৮ থেকে।
তবে ইওরোপীয় চিত্রকলার সঙ্গে এইসব যোগাযোগের কথা ভাবলে মনে হয় যামিনী রায় তো বলেছিলেন এতটাও, 'রবীন্দ্রনাথ ছবি আঁকেন খাঁটি ইওরোপিয়ান আঙ্গিকে ।' [৩৭] মুকুলে দে ১৯৩২ সালে কলকাতায় রবীন্দ্রনাথের চিত্রপ্রদর্শনী উপলক্ষ্যে যে মুখবন্ধ রচনা করেছিলেন তাতেও জোর দিয়েছিলেন সমকালীন ভারতীয় চিত্রকলার সঙ্গে এর স্পষ্ট পার্থক্য--
"What appears to not an inconsiderable number of critics as the effeminate characteristics which mar the beauty of the productions of the New Bengal School of Art, has not escaped the notice of such a keen observer as our Poet."[৩৮]
তাই বলে তাঁর ছবির জাত সম্পূর্ণ অভারতীয় এমন ঘোষণাও করা যায়না। রবীন্দ্রমন, রবীন্দ্র সৃজনকলার অন্তর্গত প্রতীতি সম্বন্ধে নির্দ্বিধায় বলা যায় ভারতীয়তা মিশে আছে তার মজ্জায় মজ্জায়। ভারতীয় সেই আভা বিচ্ছুরিত হয় ঐতিহ্যকে আত্মস্থ করে, বহির্বিশ্বের প্রভাবকে অণু পরমাণুতে মিশিয়ে নিয়ে এ তাঁর একান্ত নিজস্ব রসায়ন। নন্দলাল বসু এই দিকটি লক্ষ্য করেই বলেছিলেন, 'গুরুদেবের চিত্রকলা, তাঁর রীতি সবই তাঁর নিজস্ব, তবু তা ভারতীয় ঐতিহ্যের অনুগত।' [৩৯] তিনি লক্ষ্য করেছেন 'ভারতীয় কলার রাজ্যে দু'মাত্রার ছবিই বেশী। গুরুদেবের অঙ্কন-পদ্ধতি এই দ্বিমাত্রিক ধারার।'[৪০]
ভারতীয় চিত্রকলায় রবীন্দ্রনাথ যে প্রাণশক্তি, দুর্মর বলিষ্ঠতা সঞ্চার করেছিলেন, আর্চার ইংল্যাণ্ডের পরিপ্রেক্ষিতে তার তুলনা খুঁজে পেয়েছেন হেনরি মূরের ভাস্কর্যে, তিনিও উল্লেখ করেছেন জাতীয়তার এই শিকড়ের কথা:
"Both seem, at first sight, to involve a complete break with every immediate predecessor, both suggest a new start yet both can still be fitted into their respective national tradition." [৪১]
রবীন্দ্র চিত্রকলা আসলে একই সঙ্গে বিশিষ্ট দেশ কালে বিধৃত অন্যদিকে তার আবেদন দেশকালের বৃত্ত ছাপিয়ে চলে যায়। ভারতীয়তা তার বৈশিষ্ট্য, কিন্তু ভারতীয়তাই তার শেষ কথা নয়।
পশ্চিমযাত্রীর ডায়ারিতে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, আর্টের বাইরের দিক, আঙ্গিক বা টেকনিক বিষয়ে তিনি জানেন না, কিন্তু আর্টের অন্তরের কথাটা জানেন, সেখানে স্থান পেতে হলে - 'সমস্ত চিত্ত দিয়ে দেখো, দেখো, দেখো।[৪২] ডায়ারির সমকালেই পাণ্ডুলিপির চিত্রচর্চা চলছে তা আমরা ভুলতে পারিনা। ডায়ারিতেও ফিরে ফিরে দেখা দেয় চিত্রকলা প্রসঙ্গ, আসে এই 'দেখা'র কথা ।
এই 'দেখা' একেবারে অভিনব ধরনের। মনে পড়ে যায় অবনীন্দ্রনাথ তাঁর রবিকাকার ছবি প্রসঙ্গে আলোচনা করতে গিয়ে বলেছিলেন, যেসব রং ও আকার নিয়ে সেখানে কারবার করা হয়েছে প্রকৃতিতে সে সবই আছে, তারা নতুন নয় অথচ নতুন। কেন তিনি একথা বলেছিলেন, কোথায় সেই নতুনত্ব তার সন্ধান আমাদের করতে হবে কবির বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে ।
কথাপ্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ রাণী চন্দকে বলেছিলেন একবার:
"যখন ছবি আঁকতে শুরু করি, আমার একটা পরিবর্তন দেখলুম। দেখলুম গাছের ডালে পাতায় নানা রকম অদ্ভুত জীবজন্তুর মূর্তি। আগে তা দেখিনি। ... কিন্তু এই রিয়ালিস্টিক মূর্তিকে দেখালে। আর্ট দেখালে। সে বলল, এ অন্যকেও দেখাতে। এই যে দেখার সম্পদ, এ চারিদিকে বিস্তার করে এসেছে মানুষ। কেন বলে ওঠো - 'বা!' সুন্দর ব'লে নয়, দেখবার বলেই। এইটেই হচ্ছে আমাদের আর্ট।' [৪৩]
পাণ্ডুলিপির ছবিগুলিকে এবং পরবর্তী চিত্রাবলিকে প্রচলিত অর্থে সুন্দর বলা যায় কিনা সে প্রশ্নই আসেনা আর - সুন্দরের সংজ্ঞা ভিন্ন মাত্রা পেয়েছে, যা প্রকাশময় তাই রূপময় হয়ে দাঁড়িয়েছে। সবাই যখন বলে ছবি বেশ সুন্দর হয়েছে তখন কালি ঢেলে সে ছবি নষ্ট করে দেন আবার ঘা খাওয়া কোনো মানুষের মতো সে ছবিকে উদ্ধার করেন এ কথাও নিজেই একদিন জানিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ।
তাঁর গোটা চিত্রচর্চাই সুন্দরের নতুন ব্যাখ্যায় দীপ্তি পেয়েছে। পশ্চিমযাত্রীর ডায়ারিতে জানিয়েছিলেন আর্টে আমরা গুণবানকে চাইনা, রূপবানকে চাই। কেমন সে রূপ, প্রচলিত অর্থে আলঙ্কারিক সৌন্দর্য নয়, স্পষ্ট করেই জানান 'শ্রীমন্ত সদাগরের চেয়ে রূপবান ভাঁড়ু দত্ত ।' [৪৪] অর্থাৎ যে রূপের স্পষ্টতায় সুপ্রত্যক্ষ সেই সুন্দর। এখানে সাহিত্যের উদাহরণই দিয়েছেন এবং সৌন্দর্য চেতনার এই প্রকাশ তাঁর সাহিত্যচর্চার আসেনি এমন বলবনা, কিন্তু এ ব্যাপারে সাহিত্য আর চিত্রকলার একটি পার্থক্য তাঁর মনে বরাবরই ছিল বলে মনে হয়। ১৩৩৪ সনে লেখা একটি প্রবন্ধে বলেই ফেলেন:
"এইখানে চিত্রকলার সুবিধা আছে। কচু গাছ আঁকতে রূপকারের তুলিতে সংকোচ নেই। কিন্তু বনশোভাসজ্জায় কাব্যে কচু গাছের নাম করা মুশকিল। আমি নিজে জাত-মানা কবির দলে নই, তবু বাঁশবনের কথা পাড়তে গেলে অনেক সময় বেণুবন ব'লে সামলে নিতে হয়। শব্দের সঙ্গে নিত্যব্যবহার গত নানা ভাব জড়িয়ে থাকে। তাই কাব্যে কুরচি ফুলের নাম করবার বেলা কিছু ইতস্তত করেছি, কিন্তু কুরচি ফুল আঁকতে চিত্রকরের তুলির মানহানি হয়না।" [৪৫]
ছবির জগতে কোনো পূর্ব সংস্কার গণ্ডি টেনে দেয়না। সব কিছুই তাৎপর্যময় হয়ে উঠতে পারে, শুধু সুন্দরী রমণী নয়, অপরূপ কোনো প্রাকৃতিক দৃশ্য নয়, 'একটা কাঁটা গাছ', 'একটুকরো পাথর', 'একটা গাধা', 'একজন বুড়ি', 'একটা উট' নিশ্চিত যা দেখতে পাচ্ছেন সেখানেই অসীমকে স্পর্শ করে শিল্পী আনন্দিত হয়ে উঠছেন। মনে পড়ে লিওনার্দো দা ভিঞ্চি কবিতার তুলনায় চিত্রকলাকে আরো তৃপ্তিদায়ক বলেছিলেন, কারণ, সত্তার জানালার মত যে দর্শনেন্দ্রিয়, ছবিতে তারই প্রাধান্য আর কাব্যের ক্ষেত্রে গুরুত্ব পায় দ্বিতীয় স্তরের ইন্দ্রিয় শ্রবণ।
এই পরিপ্রেক্ষিতে বিষ্ণু দে কবি রবীন্দ্রনাথ ও চিত্রী রবীন্দ্রনাথ দুজনের মধ্যে তুলনা টেনেছেন এবং কবি হিসেবে রবীন্দ্রনাথ যা সম্পূর্ণ করে উঠতে পারেননি, চিত্রী হিসেবে তাই সফল করেছেন এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন,
"As a painter, he realised the ultimate aesthetic function of all objects, though as a poet he had narrower, rather Victorian ideals of beauty .... in his literary work, inspite of repeated efforts, Tagore was circumscribed by his theory and practice of Beauty as something delicate, well-mannered, spiritual, somehow aristocratic and a little Tennysonian. In his pictures however he had discovered that : 'Camels are very weird, but in its own surroundings in the desert, the Camel is complete." [৪৬]]
সাহিত্যের জগতে তাঁকে যে সত্যদর্শনকে প্রতিষ্ঠা করতে চেষ্টা করতে হয়েছে, চিত্রকলায় অনায়াসে তা প্রকাশ পেয়েছে। চিত্রী রবীন্দ্রনাথ সেই অর্থে তাই কখনোই কবি রবীন্দ্রনাথের অনুবাদক নন। চিত্রশিল্পী রবীন্দ্রনাথ কবি রবীন্দ্রনাথকে ছাড়িয়ে চলে যাচ্ছেন, কবি যেখানে হাল ছেড়েছেন, চিত্রী সেখান থেকে শুরু করেছেন যাত্রা - বিনয়কুমার সরকারের এই মন্তব্য [৪৭] মোটেই আতিশয্য বলে মনে হয়না আমাদের।
পূরবী রচনাকালে কবির এই নতূন করে দেখার পালা রচিত হচ্ছে। শুধু যে সমুদ্রযাত্রা কালে আকাশের পটে লক্ষ লক্ষ রাগরক্ত ছবি দেখছেন তাই নয়, ছবি বলতে তিনি কী বোঝেন তা ডায়ারিতে ব্যাখ্যা করতে বসেছেন, ছবি বিশ্বের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে বলে, 'ঐ দেখো আছে'। সুন্দর বলেই আছে তা নয়, আছে বলেই সুন্দর।' এই বহুদূর প্রসারিত মনোহর যেন দেখা দিতে শুরু করেছে বিভিন্ন আকারে, রেখার ছন্দে, সাদাকালোর সংঘাতে। রবীন্দনাথের জীবনের শেষ পর্ব জুড়ে চলেছে এই 'আকারের মহাযাত্রা'র নির্নিমেষ দর্শন আর চিত্রপটে তাকে ফলিয়ে তোলার প্রয়াস। 'আকারের মহাযাত্রা' শব্দটি কবি ব্যবহার করেছিলেন ১৩ অগ্রহায়ণ ১৩৩৫ রাণী মহলানবিশকে লেখা একটি চিঠিতে। রং তুলির জগতে তখন তিনি পূর্ণোদ্যমে ডুবে আছেন:
এর আগে আমার মন আকাশে কান পেতে ছিল, বাতাস থেকে সুর আসত, কথা শুনতে পেত, আজকাল সে আছে চোখ মেলে রূপের রাজ্যে, রেখার ভিড়ের মধ্যে। গাছপালার দিকে তাকাই, তাদের অত্যন্ত দেখতে পাই - স্পষ্ট বুঝতে পারি জগৎটা আকারের মহাযাত্রা। আমার কলমেও আসতে চায় সেই আকারের লীলা। আবেগ নয়, ভাব নয়, চিন্তা নয়, রূপের সমাবেশ। আশ্চর্য এই যে তাতে গভীর আনন্দ। ভারি নেশা। আজকাল রেখায় আমাকে পেয়ে বসেছে। তার হাত ছাড়াতে পারছিনে।" [৪৮]
রেখা তাঁকে পেয়ে বসছিল পূরবীর যুগ থেকেই। পাণ্ডুলিপির পৃষ্ঠাগুলির দিকে তাকালে সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ থাকে না। অপ্রগলভা, অর্থহীনা রেখার মায়ায় পড়েছেন, একটা নেশার মতই পাতার পর পাতা জুড়ে রূপের সমাবেশ রচনা করে তুলছেন। শেষ সপ্তক-এর একটি কবিতায় বলেছিলেন--
এই আকারের নৃত্যকে প্রাণভরে দেখা এবং দেখানো যে তাঁকে কী গভীর আনন্দ দিয়েছিল বিভিন্ন চিঠিপত্রে, এবং তাঁর অন্তরঙ্গদের স্মৃতিচর্চায় তা ধরা আছে।
যদিও আগাগোড়াই রবীন্দ্রনাথের মনে একটা গভীর অভিমান ছিল তাঁর চিত্রাবলি বিষয়ে দেশবাসীর নিরুৎসুক ব্যবহারকে ঘিরে। তাঁর ছবি এ-দেশের জন্য নয়, বিদেশের মাটিতেই তার যথাযোগ্য স্থান এমন অভিমত প্রায়শই ব্যক্ত করতেন। ছবি দেখার চোখ এ-দেশে তৈরি হয়নি মনে হয়েছিল তাঁর। সেকালের পরিপ্রেক্ষিতে এই সিদ্ধান্ত প্রায় নির্ভুল বলা যায়, আর একালেও চিত্রকলা বিষয়ে সচেতনতা কতটুকু বা বৃদ্ধি পেয়েছে। এ ব্যাপারে আমাদের একটা মানসিক অন্ধত্ব এবং জড়ত্ব আছে সন্দেহ নেই। মৈত্রেয়ী দেবীকে গভীর আক্ষেপ নিয়ে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন:
"এখানে অধিকাংশ লোকই ছবি দেখতে জানে না, প্রথমেই দেখে এর চেহারাটা ভালো দেখতে কি না। দেখতে হয় এটা ছবি হয়েছে কি না, সে দেখা কেমন করে দেখা তা বুঝিয়ে দেওয়া যায় না।" [৪৯]
এ কথা বলার সময় তাঁর কি মনে পড়েছিল শনিবারের চিঠির বিরূপ সমালোচনা? তাঁর ছবিগুলি 'একটা কিছু বটেই' এই বিদ্রুপাত্মক মন্তব্য থেকে শুরু করে, 'শ্যাওলা, ছ্যাৎলা, মেছেতা জাতীয় একটা রূপ', 'বিকট হিলিবিলির মত রেখা বিন্যাস', 'লালাক্লিন্ন সরীসৃপের সাদৃশ্য' - কতো রকম রুচিহীন ব্যাখ্যাই করা হয়েছিল। এমন কি ইঙ্গিত করা হয়েছিল এই সব ছবির অর্থ গিরীন্দ্রশেখর বসুর মত মনস্তত্ত্ববিদেরই শুধু অধিগত। কলাচর্চার সঙ্গে এর কোনো সংযোগ নেই। [৫০]
কিন্তু বিদেশেও সেকালে এবং একালেও প্রভূত সমাদরের পাশাপাশি অবজ্ঞা এবং নিন্দাবাক্য কম বর্ষিত হয়নি। আমরা জানি এজরা পাউণ্ডের অসহিষ্ণু মন্তব্যের কথা। পাউণ্ডের মনে হয়েছিল এই সব আঁকিবুকির খেলাকে শিল্পের কোঠায় ফেলা উচিত নয়। এমনকি রবীন্দ্রনাথের চিত্রপ্রদর্শনীর সাফল্যকেও তাঁর নেহাত চাটুকারদের মিথ্যাবাক্য মনে হয়েছিল। আর এই সেদিনও ১৯৮৬-৮৭ সালে ইংল্যাণ্ডে রবীন্দ্র-চিত্রকলার প্রদর্শনীর পর বিভ্রান্ত এক কলাসমালোচকের নির্মম আক্রমণের খবর জানিয়েছেন অ্যাণ্ড্রু রবিনসন। [৫১] সেই সঙ্গে রবিনসন এও লক্ষ্য করেছেন দীর্ঘকালের বিরতিও এই সব ছবির নাড়া দেবার, বিপর্যস্ত করার ক্ষমতা বিন্দুমাত্র হ্রাস করেনি - এখনো তা সমান অভিনব, আধুনিক। চিত্রকলার ক্ষেত্রে কোনো পূর্বনির্ধারিত পরম্পরা মানেননি রবীন্দ্রনাথ - নিজেই সৃষ্টি করেছেন একটা ইতিহাস, তাই মনে হয় আরো বহুকাল ধরে দর্শক ও সমালোচকের মনে তা বিস্মিত প্রশংসা ও নিন্দার ঝড় তুলবে। অবনীন্দ্রনাথ যেমন বলেছিলেন, আর্টের পণ্ডিতরা কোনো আইন বের করে কাজে লাগাতে পারবেনা এমনি একটা অদ্ভুত জিনিস হয়ে গিয়েছে। দেশী বা বিদেশী কোনো নিন্দাতে পরাস্ত হবার মতো ভীরু কোনোদিনই নন রবীন্দ্রনাথ। ছবি আঁকতে যে তাঁর খুব ভালো লাগছে অকুণ্ঠভাবে বন্ধদের তা জানিয়েছেন - বিরূপ সমালোচনা তাঁকে দমাতে পারেনি। এমনকি হেমন্তবালাকে ৫ই জুলাই ১৯৩৪ তারিখে লেখা চিঠিতে জেদী, বেপরোয়া ভঙ্গিতে জানিয়েছেন সাহিত্যে তাঁর যে খ্যাতির দায়, ছবিতে তা নেই, তাই একখানা কাগজ টেনে যা তা আঁকতে তাঁর দ্বিধা হয় না। 'লোকে যদি বলে আমি ছবি আঁকতে পারিনে, তবে তাতে সঞ্চিত যশের অপচয় ঘটে না। ... তাই আমার জীবন যাত্রাপথের শেষপ্রান্তে যখন আলো ম্লান হয়ে এসেছে তখন ইচ্ছা করে ছবি এঁকে সময় নষ্ট করি।'
ছবি এঁকে এবং ছবির ব্যাপারে প্রসংশা শুনলে যেন বালকের মত আনন্দিত রবীন্দ্রনাথ, চিঠিপত্র ও স্মৃতিকথাগুলি পড়লে আমাদের অন্তত তাই মনে হয়। বিদেশে সমঝদার পেয়ে তাঁর উচ্ছ্বাস জানাচ্ছেন, রথীন্দ্রনাথ, প্রতিমাদেবী, কখনো ইন্দিরাদেবী বা অন্যান্যদের। এমনকি রোদেনস্টাইনকে লিখছেন:
"This has a strange analogy with the time which followed the Gitanjali publication - it is sudden and boisterous like a hill stream after a shower." [৫২]
রম্যাঁ রলাঁর কাছে এই উচ্ছ্বাস প্রায় চপলতা বলে মনে হয়েছিল। মোটেই তিনি প্রসন্ন মনে গ্রহণ করতে পারেননি চিত্রশিল্পের প্রতি কবির এই উন্মুখতা। রলাঁ দিনপঞ্জীতে লিখছেন:
"তিনি আরও বললেন 'আমার বাকি সমস্ত শিল্পকর্ম সম্পর্কে এখন আমার আগ্রহ নেই। একমাত্র যার জন্যে আমি গর্বিত তা আমার ছবি।' ছবিগুলো ইউরোপে যে অভ্যর্থনা পেয়েছে, তাতে তিনি বুঁদ হয়ে আছেন। এর মধ্যে স্নবারি ও মিথ্যা ভদ্রতার অংশ যে কতখানি তা তিনি ধরে উঠতে পারেননি।" [৫৩]
তৎকালীন ভারতবর্ষের রাজনৈতিক আবহাওয়ার পটভূমিতে রলাঁ রবীন্দ্রনাথকে পলায়নবাদী মনে করেছিলেন। প্রকৃতপক্ষে শিল্পী হিসেবে যে চরম মুক্তির স্বাদ পাচ্ছিলেন কবি, বন্ধুর কাছে তার আন্তরিক প্রকাশ না করে পারেননি। ছবি আঁকা যে তাঁর অস্তিত্বের অপরিহার্য অঙ্গ হয়ে উঠেছিল।
ভাবতে অবাক লাগে, ১৯২৪-২৫ সালে লেখা হয়েছিল পূরবীর কবিতাগুলি - পাণ্ডুলিপির কাটাকুটিগুলিকে বিলুপ্ত করতে গিয়ে তিনি আকৃষ্ট হয়েছিলেন চিত্রকলায় নতুন করে, পড়েছিলেন রেখার মায়ায়। পৌষ ১৩৩৩ এর প্রবাসীতে ছাপা হয়েছিল পূরবীর আটটি কবিতার পাণ্ডুলিপি। সঙ্গের ছোট্ট ভূমিকাটিতে এগুলিকে শুধু বলা হয়েছিল জোড়া তাড়া দিয়ে তৈরি করা খাতার অলঙ্কার। [৫৪] আর ফেব্রুয়ারি ১৯৩৯, ভাষা সাম্রাজ্যের অধিরাজ রবীন্দ্রনাথ অমিয় চক্রবর্তীকে লিখলেন বিখ্যাত সেই চিঠি:
"বাক্যের সৃষ্টির উপরে আমার সংশয় জন্মে গেছে। এত রকম চলতি খেয়ালের উপর তার দর যাচাই হয়, খুঁজে পাইনে তার মূল্যের আদর্শ। ঐতিহাসিক এক একটা অপঘাতে সাহিত্য সেতারের কানে মোচড় লাগায়। ... এই টলমলে অবস্থায় এখন দুটো পাকা ঠিকানা পেয়েছি আমার বানপ্রস্থের গান আর ছবি।" [৫৫]
রবীন্দ্রনাথের অন্ত্যপর্বের জীবন ও শিল্প সাধনার পরিপ্রেক্ষিতে এই চিঠি কিংবা মৃত্যুর কয়েক মাস আগে বলা কথা ক'টি অসীম তাৎপর্য নিয়ে দেখা দেয়:
"ছবির এক হিসেবে স্থায়িত্ব তাই অনেক বেশি। চোখের দেখা আর ভাষার দেখার তফাত ওই খানেই। শিল্পী তার সৃষ্টি রেখে যায়; যুগ যুগ ধরে লোকেরা দেখে। আর আমার বেলায় - আমার সঙ্গে সঙ্গে ধূলিসাৎ হবে। তাই এক এক সময়ে ভাবি এত কেন লিখেছি জীবনে।" [৫৬]
মনে পড়ে যায় চৈনিক সেই সদুক্তি, এক হাজার কথার থেকে একটি ছবির ক্ষমতা বেশি। রবীন্দ্রনাথের শেষ জীবনেও ছবি ও গানকে লেখার প্রতিদ্বন্দ্বী করে দেখানোর প্রবণতা বেশ চোখে পড়ে। ব্যাপারটা আমাদের অনেকখানি ভাবিয়ে তোলে।
আমরা অনুভব করি আয়ুর শেষসীমায় চিত্রকলার দেবীর সঙ্গে প্রণয় সৃষ্টিশীলতার কী গভীর আলোয় দীপিত করেছিল তাঁর চিত্ত, আর এই প্রণয়ের যথার্থ সূচনা পূরবীর সেই ছোট খাতাটিতে। জীবনের শেষ সতেরো বৎসরে অজস্র স্কেচ আর ছবি এঁকে নাটকীয় একাকিত্বে ভারতীয় চিত্রকলায় আধুনিক যুগ প্রবর্তন করলেন আপাতদৃষ্টিতে চিত্রকলায় প্রশিক্ষণ না পাওয়া এক কবি। তাঁর ছবির আশ্চর্য মৌলিকতা, তারুণ্য আর আধুনিকতা লক্ষ্য করে আর্চার নির্দ্বিধায় যা উচ্চারণ করেছেন তা আজ স্বীকৃত সত্য।
'The first modern art to be produced in India was the work of the poet, Rabindranath Tagore.' [৫৭]
[১] প্রতিমাদেবী, 'গুরুদেবের ছবি', বিশ্বভারতী পত্রিকা, ভাদ্র ১৩৪৯, পৃঃ ১১৬।
[২] Paintings by Rabindranath Tagore, Foreign Comments, Printed and published by N. Mukherjee. Art Press. Calcutta, pp14.
[৩] তদেব।
[৪] Stella Kramrisch, 'The Drawings of Rabindranath Tagore', The Visva-Bharati Quarterly, Tagore Birthday Number, Edited by K. R. Kripalani, May-October 1941, pp 117-118.
[৫] Foreword by Satyajit Ray of the book 'The Art of Rabindranath Tagore' by Andrew Robinson, Rupa, Calcutta, 1989, pp 12.
[৬] মনোরঞ্জন গুপ্ত, রবীন্দ্রচিত্রকলা, সাহিত্য সংসদ, কলকাতা, ১৯৭০, পৃঃ ৩৬।
[৭] অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর 'আর্ট প্রসঙ্গ', বিশ্বভারতী পত্রিকা, শ্রাবণ ১৩৪৯, পৃঃ ৪৩। প্রবন্ধটির পাদটীকায় ছিল : 'গত ফাল্গুনে আচার্য অবনীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতনে কিছুদিন ছিলেন। সেই সময়ে একদিন কোণার্কের বারাণ্ডায় বসে নন্দলাল বসু, ক্ষিতিমোহন সেন প্রভৃতির সহিত আচার্যদেবের আর্ট সম্বন্ধে যে আলোচনা হয়, তারই সারাংশ শ্রীমতী রাণীচন্দ এই প্রবন্ধে সংকলন করেছেন।'
[৮] প্রতিমাদেবী 'গুরুদেবের ছবি', পৃঃ ১১৮-১১৯।
[৯] কানাই সামন্ত এবং আরো অনেকেই রবীন্দ্রচিত্রে কালোরঙের ব্যবহারে 'বিষাদ বেদনা' 'অভিভূতির' ভাব লক্ষ্য করেছেন। দ্রষ্টব্য : কানাই সামন্ত 'রবীন্দ্রচিত্রকলা', রবীন্দ্রপ্রতিভা : কবি, শিল্পী সুরকার রবীন্দ্রনাথ, ইণ্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েটেড পাবলিশিং, কলকাতা, ১৩৬৮, পৃঃ ৪১৪। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য যে রবীন্দ্রনাথ নিজের চিত্রের এই বিষাদময়তা সম্বন্ধে সচেতন ছিলেন। কথা প্রসঙ্গে বলেছেনও বারবার। দ্রষ্টব্য: আলাপচারি রবীন্দ্রনাথ (৩১.৭.৩৯)
[১০] পৃথ্বীশ নিয়োগী, 'রবীন্দ্রনাথের চিত্র', বিশ্বভারতী পত্রিকা, বৈশাখ-আষাঢ় ১৩৫১, পৃঃ ৪১৩।
[১১] কানাই সামন্ত, চিত্রদর্শন, বিদ্যোদয় লাইব্রেরী, কলকাতা, ১৮৮১ শক, পৃঃ ১৫৮।
[১২] সোমেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ২৬ নভেম্বর, ১৯৮৪ তে আমাদের সঙ্গে শান্তিনিকেতনে একটি সাক্ষাৎকারে রবীন্দ্রনাথের পাণ্ডুলিপির চিত্রচর্চার নানা দিকে আলোকপাত করেন। তাতে তিনিও এই বিষয়টির উপর জোর দিয়েছিলেন।
[১৩] Paintings by Rabindranath Tagore : Foreign Comments. pp 15.
[১৪] সোমেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, রবীন্দ্রচিত্রকলা : রবীন্দ্রসাহিত্যের পটভূমিকা, দে'জ পাবলিশিং, কলকাতা, ১৯৮২, পৃঃ ১৯৬।
[১৫] বিনোদ বিহারী মুখোপাধ্যায়, 'রবীন্দ্র-চিত্রের ভিত্তি', রবীন্দ্রায়ণ, দ্বিতীয় খণ্ড, সম্পাদক : পুলিন বিহারী সেন, বাক্ সাহিত্য, কলকাতা, ১৩৬৮, পৃঃ ২-৩।
[১৬] আমরা এই সাক্ষাৎকারটি নিয়েছিলাম, ২৫ নভেম্বর, ১৯৮৪, শান্তিনিকেতনই, কলাভবনে।
[১৭] রাণী মহলানবিশকে ২১ কার্তিক, ১৩৩৫ এ লেখা চিঠি, 'ছবির কথা', বিশ্বভারতী পত্রিকা, বৈশাখ - আষাঢ় ১৩৫১, পৃঃ ৪১০।
[১৮] তদেব, পৃঃ ৪১১।
[১৯] পশ্চিমযাত্রীর ডায়ারি, ২৭ সেপ্টেম্বর, ১৯২৪।
[২০] বিনোদ বিহারী মুখোপাধ্যায়, 'রবীন্দ্রনাথের ছবি', 'সৃজনী', রবীন্দ্র-শতবর্ষপূর্তি স্মারক সংলকন, সম্পাদক মণ্ডলীর সভাপতি সত্যরঞ্জন সেন, বিচিত্রা, কলকাতা, ১৯৬১, পৃঃ ১৫৭-৫৮। হেমন্তবালা দেবীকে ৫ জুলাই ১৯৩৪ এ লেখা চিঠিতে 'প্রাচীন বয়সের শৈশবতা' কথাটি এসেছে চিত্রকলা প্রসঙ্গে। (দ্রষ্টব্য : চিঠিপত্র ৯, পৃঃ ২৩৮।)
[২১] এই সাদৃশ্য লক্ষ্য করেছেন কে. জি. সুব্রমনিয়ন। (দ্রষ্টব্য: 'রবীন্দ্র-চিত্রকলা ও পশ্চিমী জগৎ', দেশ, ৯মে ১৯৮৭, পৃঃ ৪৬।
[২২] নন্দলাল বসু, 'গুরুদেবের আঁকা ছবি', রবীন্দ্রায়ণ, দ্বিতীয় খণ্ড, পৃঃ ৭।
[২৩] বিনোদ বিহারী মুখোপাধ্যায়, 'রবীন্দ্রচিত্রের ভিত্তি', তদেব, পৃঃ ২ ।
[২৪] যামিনী রায়, 'চিত্রকর রবীন্দ্রনাথ' সৃজনী, পৃঃ ১৫৪-১৫৫।
[২৫] এই সংক্ষিপ্ত ইতিবৃত্ত রচনায় আমরা সহায়তা নিয়েছি নিম্নলিখিত গ্রন্থাদি থেকে: (ক) Introduction by C. Wood, '100 Masterpieces in Colour', Galley Press, London. 1986. / (খ) Master of Art : The World's Great Artists, Their Lives and Works. Samm Sinclair Baker and Natalia Baker, Galahad Books, New York, 1981.
[২৬] পশ্চিমযাত্রীর ডায়ারি, ১৪ ফেব্রুয়ারি, ১৯২৫।
[২৭] W. G. Archer, India and Modern Art, George Allen and Unwin Ltd., London, 1959, pp 56-57.
[২৮] তদেব।
[২৯] তদেব।
[৩০] শিবনারায়ণ রায়, 'পটুয়া রবিঠাকুর ও চিত্রবিপ্লব', দেশ ১০ মে, ১৯৮৬, পৃঃ ৬৩।
[৩১] ধূর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, 'রবীন্দ্র-সৃষ্টি', রবীন্দ্রস্মৃতি পূর্ব্বাশা, সম্পাদক : সঞ্জয় ভট্টাচার্য, পৃঃ ৭।
[৩২] O. C. Ganguly, 'Poet's Pictures, A Review', The Modern Review, December 1940, pp 634.
[৩৩] শঙ্খ ঘোষ, নির্মাণ আর সৃষ্টি, বিশ্বভারতী, ১৩৮৯, পৃঃ ৮৮।
[৩৪] Paintings by Rabindranath Tagore. Foreign Comments, pp 11.
[৩৫] তদেব।
[৩৬] Ketaki Kushari Dyson, In Your Blossoming Flower Garden, Sahitya Akademi, New Delhi 1988, pp 124.
[৩৭] যামিনী রায়, 'চিত্রকর রবীন্দ্রনাথ', সৃজনী, পৃঃ ১৫৪।
[৩৮] 'Exhibition of Drawings, Paintings, Engravings, Pottery and Leather Work by Sir Rabindranath Tagore, Government School of Art, 28 Chowringhee Road, Calcutta, February 20-29 1932', Foreword by Mukul Dey, pp 6.
[৩৯] নন্দলাল বসু, 'রবীন্দ্রচিত্রকলা', সৃজনী, পৃঃ ১৫২।
[৪০] তদেব।
[৪১] W. G. Archer, India and Modern Art, pp 79 .
[৪২] পশ্চিমযাত্রীর ডায়ারি, ১৫ ফেব্রুয়ারি, ১৯২৫। (পরিশিষ্ট)
[৪৩] রাণী চন্দ, আলাপচারি রবীন্দ্রনাথ, বিশ্বভারতী, কলকাতা, ১৩৭৭, পৃঃ ১৩৩।
[৪৪] পশ্চিমযাত্রীর ডায়ারি, ১৫ ফেব্রুয়ারি, ১৯২৫।
[৪৫] 'সাহিত্য ধর্ম', সাহিত্যের পথে, রবীন্দ্ররচনাবলী, ত্রয়োবিংশ খণ্ড, পুস পৃঃ ৪০৪।
[৪৬] Bishnu Dey, 'Paintings of Rabindranath Tagore', Visva-Bharati Quarterly Booklet, January 1958, pp 7-8.
[৪৭] Binoy Kumaro Sarkar, 'The Poetry and Paintings of Rabindranath', Creative India, Lahore, 1937, pp 584.
[৪৮] দ্রষ্টব্য: 'ছবির কথা', বিশ্বভারতী পত্রিকা, বৈশাখ-আষাঢ় ১৩৫১, পৃঃ ৪১০-১১।
[৪৯] মৈত্রেয়ী দেবী, মংপুতে রবীন্দ্রনাথ, রূপা, কলকাতা, ১৯৬৭, পৃঃ ১০৩।
[৫০] শনিবারের চিঠি, মাঘ, ১৩৩৮।
[৫১] এই সমালোচনাও প্রায় শনিবারের চিঠির অনুরূপ।
'They are abysmal. Never were scribble, scrabble, scratch, scrawl and blot more industriously used to less effect. He has as much idea of spatial judgement as an infant reaching for the breast; his chromatic freshness is the muddied palette of primary ignorance and (its so called) textural subtleties is critic's jargon for this is such a mess that I can't see what's what."(Brian Sewell, Standard, London, Sept. 1986)
Quoted in The Art of Rabindranath Tagore by Andrew Robinson, pp 50.[৫২] Mary M. Lago, Imperfect Encounter. Letter from Tagore to Rothenstein, August 24, 1930, pp 328-329.
[৫৩] রম্যাঁ রলাঁ, ভারতবর্ষ : দিনপঞ্জী (১৯১৫-১৯৪৩) অনুবাদ : অবন্তীকুমার সান্যাল, র্যাডিকাল বুক ক্লাব, কলকাতা, ১৯৭৬, পৃঃ ২৮০।
[৫৪] প্রবাসী, পৌষ, ১৩৩৩, পৃঃ ৩৯৮-৪০৪।
[৫৫] ১৪ ফেব্রুয়ারি ১৯৩৯ এ লেখা চিঠি, চিঠিপত্র ১১, বিশ্বভারতী ১৯৭৪, পৃঃ ২২৯।
[৫৬] রাণী চন্দ, আলাপচারি রবীন্দ্রনাথ, ২৩ এপ্রিল, ১৯৪১, পৃঃ ৯৭।
[৫৭] W. G. Archer - India and Modern Art, George Allen and Unwin Ltd. London, 1959, pp 49.
পরবাস, বাইশে শ্রাবণ, ২০১১