শতবর্ষ অতিক্রম করল জালিয়ানওয়ালাবাগের নিষ্ঠুরতা। যে-কোনো সামাজিক বা রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড যদি সুখস্মৃতি বয়ে আনে, তবে তা মধুর হয় স্বাভাবিকভাবেই। কিন্তু তা যদি না হয়ে সেই স্মৃতি হয় বীভৎসতা, নৃশংসতার বার্তাবহ? তবে তা নিয়ে আলোচনায় আপাত কোন সুখ নেই। ভারতবাসী এবং আপামর শান্তিকামী শুভবুদ্ধি সম্পন্ন মানবতাবাদী জনগণের কাছেই ব্রিটিশ সরকারের এই কাপুরুষতা একাধারে ঘৃণা এবং বিরাগের জন্ম দেয়। ‘কে আর হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালোবাসে?’ তবুও আজ শতবর্ষ পরে আমাদের পিছনে ফিরে তাকাতে হয়। তাকাতে হয় এই জন্য যে, মানবতার নির্মম লাঞ্ছনা, যা ভারতবাসী প্রত্যক্ষ করেছিল একশো বছর আগে, লোভী, ক্ষমতাদর্পী, সাম্রাজ্যবাদী শক্তির সেই বর্বরতা থেকে আজও কি মুক্ত হতে পেরেছে ভারতবাসী তথা সমগ্র বিশ্বের নিরপরাধ মানুষ? আজ হয়তো ইংরেজ নেই ভারতবর্ষে, তথাকথিত এই স্বাধীন দেশে হিংস্রতা, অসহিষ্ণুতা, এবং সর্বোপরি নরমেধ থেকে আমরা মুক্ত হতে পারিনি। শুধু আমরা কেন, গোটা বিশ্বই আজ এই সংকটের সামনে অসহায়। সম্প্রতি শ্রীলঙ্কায় ঘটে যাওয়া বর্বরতা, কাশ্মীরে পুলওয়ামা হত্যাকাণ্ড সেকথাই চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়। আমাদের বক্তব্য হল বহুসংখ্যক নিরপরাধ মানুষের ওপর মানুষেরই পাশবিকতার এই ঘটনাক্রম স্তম্ভিত করে। তা যে পরিস্থিতিতে যে ঘটনাক্রমেই ঘটে থাকুক না কেন। কেন আমরা স্মরণ করব সেই দুঃখস্মৃতিকে? করতে হয় এই জন্যই যে মানবতার এই কদর্যতা থেকে মানব সমাজ আজও মুক্ত নয়।
জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে রয়েছেন রবীন্দ্রনাথ। হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে তাঁর সেই নাইট-হুড ত্যাগের মাধ্যমেই তিনি বিরত থাকেন নি। সেই সময়ে এই ঘটনার প্রতিবাদে ভারতবর্ষের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের নিস্পৃহতা তাঁকে ব্যথিত করেছিল। এক্ষেত্রে তিনি একা, ভীষণ একা। নিঃসঙ্গ। তাঁর ভাবনাকে কেউ বোঝেনি সেদিন। অমৃতসর কংগ্রেসের বার্ষিক অধিবেশনে রবীন্দ্রনাথের নাইট উপাধি বর্জন ও প্রতিবাদপত্র কংগ্রেসী মহলে এতটকু স্বীকৃতি পায়নি।১ সে প্রসঙ্গে পরে আসব। তথাকথিত রাজনীতির সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ সরাসরি যুক্ত নন। কিন্তু বাহ্যিক কোনো ঘটনা পরম্পরা রবীন্দ্রনাথের মতো সংবেদনশীল মানুষের মনে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি না করে পারেনি। এক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। রাজনীতির মূল্যবোধহীনতা, ধর্মাধর্মজ্ঞান, নীতিবোধ কোথাও যেন কবিকে মানিয়ে বাঁধা দিয়েছে। স্বাধীনতা আন্দোলনে মডারেট রাজনীতির পৌরুষহীনতা, আবেদন নিবেদনের রাজনীতি, ভিক্ষার দানকে তিনি কাপুরুষতার নামান্তর ভাবতেন; অন্যদিকে চরমপন্থী রাজনীতির violence, রুক্ষ, রূঢ় স্থূল দিকটি সংবেদনশীল কবিমনে বারবার ধাক্কা দিয়েছে। ফলে প্রত্যক্ষ রাজনীতিতে তাঁর মন সায় দেয়নি। অথচ যা ঘটে চলে তাকে অস্বীকারই বা করবেন কীভাবে? মানবতাবাদী কবি পৃথিবীর যে-কোনো প্রান্তে মানুষের ওপর ঘটে যাওয়া অন্যায়ের প্রতিবাদ অজস্রবার, বিভিন্ন মাধ্যমে করেছেন। এ জন্যই তিনি একা, নিঃসঙ্গ।
বিষয়ের গভীরে প্রবেশের পূর্বে আমরা জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকাণ্ডের প্রারম্ভিক প্রেক্ষাপটটি সংক্ষেপে উল্লেখ করব। ঘটনাটি কোনো আকস্মিক পরিস্থিতি থেকে উদ্ভুত ছিল না। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় থেকে ইংরেজ সরকার ভারতের বিরাট সৈন্যবাহিনীকে যুদ্ধে ব্যবহার করে। সে সময় কংগ্রেসের তরফ থেকে স্বায়ত্ত্বশাসনের জন্য আবেদন করা হলে গান্ধীজী প্রাথমিকভাবে তা বিশ্বাসই করেছিলেন। কিন্তু মন্টেগু-চেম্সফোর্ড শাসন পরিকল্পনার ফলে সারা দেশ ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর ব্রিটিশ শাসনকে ভারতের মাটিতে সুদৃঢ় ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠার জন্য এবং ইংরেজের দমনপীড়ন ও যেকোনো ধরনের মুক্তচিন্তা ও আন্দোলনকে কঠোর হাতে দমন করার জন্য রাওলাট রিপোর্টের ভিত্তিতে দুটি বিল গ্রহণ করা হয়। Indian Criminal Law (Amendment) Bill No-I of 1919 এবং Criminal Law (Emergency Power) Bill No-II of 1919. এই আইনের বলে যেকোনো ভারতীয়কে বিনা বিচারে গ্রেফতার করা, সংবাদ সংস্থার ওপর নিষেধাজ্ঞা, এবং সাধারণভাবে ভারতীয় জনগণের সাংবিধানিক অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়েছিল। ১৮ই মার্চ ১৯১৯ ভারতীয় সদস্যদের সমবেত প্রতিবাদ অগ্রাহ্য করে রাওলাট বিল পাশ হয়। এর প্রতিবাদে মদনমোহন মালব্য, আলি জিন্না, ও মজহর-উল-হক কেন্দ্রীয় ব্যবস্থা পরিষদের সদস্যপদ ত্যাগ করেন। গান্ধীজী এর প্রতিবাদে রাওলাট সত্যাগ্রহ শুরু করেন। ২৪শে ফেব্রুয়ারি, ১৯১৯ গান্ধীজীর নেতৃত্বে সত্যাগ্রহ সভায় ঠিক হয় সারাদেশ ওই দিনটিতে কর্মবিরতি পালন করবে এবং আত্মশুদ্ধির জন্য প্রার্থনা করবে। প্রথমে তারিখটি ৩০ মার্চ ঠিক হলেও পরে সেটি পরিবর্তিত হয়ে হয় ৬ই এপ্রিল। কিন্তু তারিখ পরিবর্তনের খবরটি যথাযথভাবে দেশের সর্বত্র প্রচারিত হয়নি বলে কোনো কোনো স্থানে ৩০ মার্চ হরতাল পালিত হয়। দিল্লিতে জনতার ওপর পুলিশ গুলি চালায় এবং কয়েকজন হতাহতও হয়। এ সময়ে পাঞ্জাবে গভর্নর ছিলেন কুখ্যাত মাইকেল ও'ডায়ার।
৯ এপ্রিল ছিল রামনবমী। এই রামনবমীর শোভাযাত্রায় হিন্দু ও মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের স্বতঃস্ফূর্ত যোগদান সরকারের মাথাব্যথার কারণ হয়েছিল। দিল্লিতে অশান্তির প্রেক্ষিতে গান্ধীজী দিল্লি অভিমুখে রওনা হতে গেলে দিল্লি ও পাঞ্জাবের সরকার তাঁর প্রবেশ নিষিদ্ধ করে। ১০ এপ্রিল পথে তাঁকে গ্রেফতার করে বম্বেতে তাঁকে ছেড়ে দেওয়া হয়। ইতিমধ্যে সারা দেশে বার্তা রটে যায় গান্ধীজীর গ্রেফতারের। উত্তেজিত জনতা আমেদাবাদে সরকারী বাসভবন ঘেরাও করে এবং দুজন ইউরোপীয়কেও হত্যা করে।
১০ই এপ্রিল কংগ্রেসের দুই জনপ্রিয় নেতা ডাঃ সত্যপাল এবং ডাঃ সৈফুদ্দিন কিচলুর গ্রেফতার পাঞ্জাবের পরিস্থতি অগ্নিগর্ভ করে তোলে। উত্তেজিত জনতা রাস্তায় নামে। প্রতিবাদ বিক্ষোভে তারা রেলস্টেশন, অফিস, পোষ্টঅফিস ঘেরাও করে পাঁচ জন ইংরেজকে হত্যা করে। এবং অগ্নিসংযোগ করে। মিস শেরউড নামে এক নার্সকে জনতা আক্রমণ করতে গেলে এক ভারতীয় তাঁকে উদ্ধার করেন। এ্ররকম অবস্থায় পাঞ্জাবের পরিস্থিতি শান্ত করার জন্য এক মিলেটারী কর্নেলকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। তিনি হলেন Reginald Edward Harvey Dyer. ডায়ার অমৃতসর শহরে সবরকম সভা-সমিতির উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে। ১৩ই এপ্রিল বৈশাখী উৎসব উপলক্ষে প্রায় দশ হাজার লোক জালিয়ানওয়ালাবাগের উদ্যানে সমবেত হয়েছিল। সেখানে সংকীর্ণ দু-একটি প্রবেশদ্বার রুদ্ধ করে ডায়ার শিখ এবং গুর্খা রেজিমেন্টের মিলেটারি দিয়ে নিরস্ত্র অসহায় মানুষের ওপর গুলিবর্ষণ করে। তাদের সভা ভঙ্গ করবার আগাম কোনো নির্দেশও তিনি দেন নি। বা কোনোরকম আলোচনায় ধার ধারেন নি। সরকারি মতেই মৃতের সংখ্যা ৩৭৯ এবং আহত ১২০০। বেসরকারি মতে প্রায় এক সহস্র মানুষের মৃত্যু ঘটেছিল। প্রায় ১৬০০ গুলি সেদিন অসহায় মানুষের ওপর বর্ষিত হয়েছিল। পরবর্তীকালে হান্টার কমিশনে দেওয়া সাক্ষে উদ্ধত ডায়ার বলে সংকীর্ণ পথে অস্ত্রবাহী গাড়ি আনা সম্ভব হয়নি বলে হতাহতের সংখ্যা এত কম। নইলে আরও গুলি থাকলে সেগুলি ফুরতেও দ্বিধা করত না সেই নরখাদক। ১৪ই এপ্রিল পাঞ্জাবে সামরিক শাসন জারি করা হয় এবং গুজরানওয়ালায় বিমান থেকে বোমা বর্ষণ হয়। ভারতীয়দের ওপর অভূতপূর্ব অত্যাচার চলতে থাকে। প্রকাশ্যে চাবুক মারা, হামাগুড়ি দিয়ে রাস্তা পার করানো, রৌদ্রে দাঁড় করিয়ে রাখা, ইউরোপীয় দেখলেই সেলাম ঠোকা ইত্যাদি তো ছিলই। সংবাদ সংস্থার ওপর কঠোর নিষেধাজ্ঞা জারি থাকার ফলে অমৃতসর শহর দেশের বাকি অংশ থেকে প্রায় বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল।
রবীন্দ্রনাথ দিল্লিতে পুলিশি অত্যাচারের খবর পড়লেও পাঞ্জাবে সংবাদপত্রের ওপর কঠোর বিধিনিষেধ আরোপিত হওয়ায় সন্দেহ জন্মে সেখানে ভয়ানক কিছু ঘটে গেছে। অ্যান্ড্রুজ অসুস্থ শরীর নিয়েই দিল্লি রওনা হন। রবীন্দ্রনাথ বিভিন্ন মানুষের কাছে এবং পত্র মারফৎ যা খবরাখবর পাচ্ছেন, তাতে পরিস্থিতির ভয়াবহতা জানতে আর কিছু বাকি থাকল না। এই সময় অ্যান্ডুজ দিল্লিতে, তাঁর সঙ্গে কিছু চিঠির লেনদেন হয় কবির। সেখানে ব্রিটিশের রক্তলিপ্সা, দমনপীড়ন এবং সর্বোপরি ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যবাদী শাসকের ওপর ক্ষুরধার কলম বর্ষিত হয়েছে। কেননা ২৬শে এপ্রিল রবীন্দ্রনাথ রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়কে লিখেছিলেন — “এন্ডুজ দিল্লিতে। সেখান থেকে দুই একটা চিঠি যা লিখেচেন তাতে মনটাকে উত্তপ্ত করেছে। আমার মনের তাপমানযন্ত্র আমার কলম। সুতরাং তার ভাষাটা চড়ে উঠেচে। বর্তমান চিঠিখানি আজ লিখে মনে করলুম আপনার সম্পাদকী দরবারে তার নকল পাঠাই। এটা বর্ত্তমান দুর্য্যোগের দিনে প্রকাশযোগ্য হবে কিনা জানিনে। আপনি যা ভাল মনে করবেন”।২ ‘Sir Rabindranath Tagore’s letter to a friend’ শিরোনামে ‘Notes’ [The Modern Review May]- তে প্রকাশ করেন। রবীন্দ্রনাথ লেখেন — “I believe our outcry against the wrongs inflicted upon us by our governing power is becoming more vehement than is good for us. We must not claim sympathy or kind treatment with too great an insistence and intensity.”
যাইহোক, অ্যান্ড্রুজ দিল্লি থেকে পাঞ্জাবে ঢুকতে গিয়েছিলেন কিন্তু পথমধ্যে তাঁকে সেখানে ঢুকতে বাধা দেওয়া হয়। তিনি যেতে পারেননি। ফলে তিনি বম্বেতে মহাত্মা গান্ধীর সঙ্গে দেখা করতে দিল্লি থেকে বম্বে চলে আসেন। অবশেষে তিনি শান্তিনিকেতনে চলে আসেন। এ সমস্ত ঘটনা কবিকে ব্যথিত করে তুলেছিল। লেডি রানু মুখার্জিকে লেখা এক পত্রে শান্তিনিকেতনের গরমের বর্ণনা দিতে গিয়ে তিনি লেখেন —
“আকাশের তাপ আমি একরকম সইতে পারি। মর্ত্যের প্রতাপ আর সহ্য হয় না। তোমরা তো পাঞ্জাবে আছ। পাঞ্জাবের দুঃখের খবর বোধহয় পাও। এই দুঃখের তাপ আমার বুকের পাঁজর পুড়িয়ে দিলে। ভারতবর্ষে অনেক পাপ জমেছিল। তাই অনেক মার খেতে হচ্ছে। মানুষের অপমান ভারতবর্ষে অভ্রভেদী হয়ে উঠেছে।”৩
গান্ধীজি ১৮ই এপ্রিল তাঁর এই রাওলাট সত্যাগ্রহ আন্দোলন আহ্বান করাকে একটি হিমালয়প্রমাণ ভুল বলে স্বীকার করে আন্দোলন প্রত্যাহার করে নেন সাময়িকভাবে। খুব স্বাভাবিকভাবেই এই খবরে জনআন্দোলন কিছুটা হলেও বিমর্ষ হয়ে পড়ে। তিনি অহিংসার ভিত্তিতে গণআন্দোলনকে চালিত করতে চেয়েছিলেন কিন্তু উত্তেজিত জনতার অগ্নিসংযোগ, হত্যা তাঁর অহিংস আদর্শের পরিপন্থী। তিনি বলেছিলেন জনগণের মনকে সত্যাগ্রহের আদর্শে দীক্ষিত না করে তুলেই তিনি তাদের আন্দোলনের মধ্যে টেনে এনেছিলেন। ভুল হয়েছিল সেখানেই। বলা বাহুল্য গান্ধীজি উত্তেজিত দেশবাসীর আচরণে যতটা বিরক্ত ছিলেন, জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকাণ্ড নিয়ে ততটা প্রতিবাদী তিনি সে মুহূর্তে হননি।রবীন্দ্র জীবনীকার প্রশান্তকুমার পাল তাঁর ‘রবিজীবনী’ গ্রন্থের সপ্তম খণ্ডে জানাচ্ছেন প্রশান্তচন্দ্র মহলানবীশ উল্লিখিত কয়েকটি দিনের চিত্র লিপিবদ্ধ করেছেন। গুরুদেব শান্তিনিকেতন থেকে কলকাতায় আসার পর তিনি ছিলেন তাঁর সর্বক্ষণের সঙ্গী। অবশ্য তার অনেক আগেই প্রশান্তচন্দ্র ‘লিপিকার সূচনা’ শিরোনামে রচনাটি শারদীয়া দেশ ১৩৬৭ [পৃ. ২১ - ২২] সংখ্যায় প্রকাশ করেছিলেন। সেখানে জানা যায়, কবি সে-সময় খুব অসুস্থ। প্রশান্তচন্দ্র নীলরতন সরকারকে ডেকে কবির স্বাস্থ্য পরীক্ষা করান। সারাদিন শুয়ে থাকেন, লেখা বন্ধ। মন ভারাক্রান্ত। অ্যান্ড্রুজকে ডেকে পাঠালেন। পাঞ্জাবের ঘটে যাওয়া ঘটনার প্রেক্ষিতে দেশের একজন মানুষও প্রতিবাদে সামিল হবে না এটা কবি মেনে নিতে পারছেন না। অ্যান্ড্রুজকে গান্ধীজির সমীপে পাঠালেন রবীন্দ্রনাথ একটি প্রস্তাব নিয়ে। সেটি হল, রবীন্দ্রনাথ দিল্লি যাবেন ও সেখান থেকে গান্ধীজি এবং তিনি একসঙ্গে পাঞ্জাবে ঢোকার চেষ্টা করবেন। পুলিশ গ্রেফতার করবে তাঁদের। এমনিভাবে প্রতিবাদের প্রাথমিক রূপ তৈরি হবে। অ্যান্ড্রুজ কবির প্রস্তাব নিয়ে গান্ধীজির কাছে চলে যান। ফিরে এসে তিনি কবিকে জানালেন — গান্ধীজি এই মুহূর্তে পাঞ্জাবে যেতে রাজি নন। “I do not [...] embarrass the government now.” শুনে কবি নিশ্চুপ হয়ে যান। এ সম্পর্কে কোনো কথা তিনি বলেন নি। এরপর তিনি কংগ্রেসের প্রবীণ নেতা চিত্তরঞ্জন দাশের কাছে যান। তাঁকে প্রতিবাদ সভা আহ্বান করতে বলেন এবং তিনি নিজে সভাপতি হবেন বলে স্থির করেন। চিত্তরঞ্জন খানিক্ষণ ভেবে বলেন আর কে কে বক্তৃতা দেবে? গুরুদেব সেটা তাঁকেই ঠিক করতে বলেন। এরপর তিনি বলেন সভায় রবীন্দ্রনাথের বক্তব্যই যথেষ্ট এবং তিনিই বলবেন, তখন সভাটাও তাঁর নামে ডাকাটাই সমীচীন হবে। চলে এলেন কবি। এদের দিয়ে হবে না বুঝতে পেরে কবি মনে করলেন তিনি যদি একাই কিছু করেন, তবে আর ঘটা করে লোক জমাবার প্রয়োজনই বা কী? নিজের কথা নিজের মতো করে বলাই সমীচীন। ‘নাইট-হুড’ ইংরেজ সরকার কবিকে দিয়েছিল। সেটা প্রত্যাখ্যানের মধ্য দিয়ে ভেতরের কাঁটাটা কোনো ভাবে তুলে ফেলার উপলক্ষ পেলেন।৪লিখলেন সেই ঐতিহাসিক চিঠি। পড়তে দিলেন অ্যান্ড্রুজকে। অ্যান্ড্রুজ চিঠিখানি পড়ে কবিকে সেটা একটু মোলায়েম করে দেবার অনুরোধ জানালে, কবি সাহেবের দিকে এমনভাবে তাকিয়েছিলেন, সে-দৃষ্টি তিনি পূর্বাপর আর কোনোদিন কবির চোখে দেখেন নি--“Such a look as I had never seen in the eyes of Gurudev before or after.”৫
কবি চেয়েছিলেন পাঞ্জাবের এই ঘটনাবলীর প্রেক্ষিতে সারাদেশের অন্তত একটি জায়গা থেকেও প্রতিবাদ আসুক। কিন্তু কংগ্রেসের তরফ থেকে একটি পৃথক তদন্ত কমিটি গঠন ছাড়া, আর কারও মধ্যে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা গেল না।
জালিয়ানওয়ালাবাগের ঘটনাটি কবির কাছে অমৃতসরের স্থানীয় কিছু গণ্ডগোলের ফলশ্রুতি ছিল না। ঘটনাটিকে এমন সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গিতে তিনি দেখেন নি। তাঁর কাছে এই কাপুরুষতা সমগ্র বিশ্বব্যাপী সাম্রাজ্যবাদী শক্তির লোভের ফল। খিলাফৎ সম্মেলনের কয়েক মাস পর জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকাণ্ডের স্মরণ দিবস উপলক্ষে যে লিখিত ভাষণটি কবি জিন্নার হাত দিয়ে পাঠিয়েছিলেন সেখানেও উঠে এসেছে এই কথা। “.... চার বছর ধরে যে দানবীয় সংগ্রাম বিধাতার সৃষ্ট এই জগতকে আগুনে দগ্ধ ও বিষে কলঙ্কিত করেছে, তারই আসুরিক ঔরস্য হল এই জালিয়ানওয়ালাবাগ। ... এই যে ক্ষমতাবানের কাপুরুষতা, তা এতটুকু লজ্জাবোধ করেনি অস্ত্রহীন ও অসতর্কিত গ্রামবাসীদের ওপর মারণাস্ত্র চালনার নিষ্ঠুরতায়, কিংবা কুৎসিত বিচার-প্রহসনের যবনিকার অন্তরালে, অকথ্য অবমাননা প্রয়োগে।"৬
রবীন্দ্রনাথের নাইটহুড প্রত্যাহার স্বদেশে এবং বিশ্বে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে। এমন নয় যে ক্ষমতাদর্পী ইংরেজ এই ঘটনাকে খুব সহজভাবে নিয়েছিল। রাওলাট আইন পাশ হয়ে গিয়েছে। বাহুবলে অন্ধ সরকারের পক্ষ থেকে রবীন্দ্রনাথের গ্রেফতারও অস্বাভাবিক ছিল না। রবীন্দ্রনাথ জানতেনও সে কথা। আর তা ছাড়া রবীন্দ্রনাথ তো নিজেই এই ঘটনার প্রতিবাদে স্বেচ্ছায় গান্ধীজির সঙ্গে পাঞ্জাবে প্রবেশের ইচ্ছা দেখিয়ে কারারুদ্ধ হতে চেয়েছিলেন। কিন্তু এতখানি মূঢ়তা ইংরেজ সরকার সেদিন দেখায়নি। রাজার দেওয়া নাইট-হুড যে প্রত্যাখ্যান করা যায় এ তাদের কল্পনাতেও আসে নি। বিষয়টি ইংল্যান্ডের রাজা পর্যন্ত চলে গিয়েছিল। রাজার দেওয়া খেতাব শুধুমাত্র রাজাই নিতে পারে। ফেরাতে আজ পর্যন্ত কেউ যায় নি। ফলে বিষয়টি নিয়ে সরকারি তরফে আর কোনো উচ্চবাচ্য করা হল না।
পূর্বেই উল্লেখ করেছি কংগ্রেসের তরফ থেকে এই ঘটনার জন্য তেমন কোনো গুরুত্ব আরোপ করা হয়নি। গান্ধীজি বিষয়টিকে খুব আকস্মিক ফলশ্রুতি মনে করেছেন। একটি চিঠিতে তিনি রামস্বামীকে লিখছেন —
“The Punjab horrors have produce a burning letter from the poet. I personally think it is premature. But he cannot be blamed for it.”৭
দেশ বিদেশের অনেক পত্রপত্রিকায় নাইট উপাধি ত্যাগ নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা গিয়েছিল। এর মধ্যে শরৎচন্দ্র, রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী যেমন কবির এই পদক্ষেপের অকুন্ঠ প্রশংসা করেছিলেন, তেমনি করেছিলেন প্রবাসীর সম্পাদক রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়। প্রবাসীতে তিনি লিখেছিলেন — “পত্রখানিতে পাঞ্জাবের আধুনিক ঘটনাবলী ও অবস্থা সম্বন্ধে দেশের লোকের ধারণা ও মনের ভাব ঠিক প্রকাশ পাইয়াছে। ইহা রবীন্দ্রনাথের উপযুক্ত হইয়াছে। তিনি যাহা লিখিয়াছেন তাহা আদ্যোপান্ত সত্য। ‘কবি সুলভ ভাবপ্রবণতা’ বশতঃ হঠাৎ বিচলিত হইয়া তিনি এ কাজ করেন নাই। ধীর, সত্যনিষ্ঠ, হৃদয়বান মানব প্রেমিকের যাহা করা উচিত, তিনি তাহাই করিয়াছেন। ... আমাদের প্রত্যেকেরই কোনো না কোনো রকমের অহংকার আছে। — আভিজাত্যের, ধনের, শিক্ষার, বিদ্যার, পদমর্যাদার, শক্তির বা রূপের অহংকার আছে। এই সব অহংকার বিসর্জন দিয়া যদি আমরা দেশে ও সমাজে ভ্রমবশতঃ তুচ্ছ অকিঞ্চিৎকর বা ইতর বলিয়া বিবেচিত সকল মানুষের পাশে তাহাদেরই দশজন বলিয়া কথায় ও অন্তরে দাঁড়াইতে পারি, তাহা হইলে রবীন্দ্রনাথের পত্র সার্থক হইবে।”রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়ের এই কথাগুলির সূত্রে মনে এল — “হে মোর দুর্ভাগা দেশ, যাদের করেছ অপমান। / অপমানে হতে হবে, তাহাদের সবার সমান”। অথবা “ইহাদেরও পথে নিতে হবে সাথে দিতে হবে অধিকার”।
গান্ধীজি এবং রবীন্দ্রনাথ দুজনেই দেশের অশিক্ষিত, দরিদ্র, জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল মানুষকে নিয়েই দেশের কাজে, স্বাধীনতার লড়াইয়ে সামিল হতে চেয়েছেন। দুজনেই মনে করতেন, কোনো আকস্মিক ভাবাবেগ দ্বারা, সাময়িক উত্তেজনা তথা হিংসা, বলপ্রয়োগ দ্বারা দেশের চিরস্থায়ী মঙ্গল কাম্য নয়। স্বদেশের কাজ করতে হলে তা গঠনমূলক হওয়া চাই। বস্তুত সন্ত্রাসবাদ এবং হিংসার মাধ্যমে স্বাধীনতা লাভকে গান্ধী রবীন্দ্রনাথ কেউই মেনে নেননি বলা বাহুল্য। স্বদেশী আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে অমল হোম-কে লিখিত এক পত্রে রবীন্দ্রনাথ এই বক্তব্যটি স্পষ্ট করেছিলেন —
... দেশের যুবকদের উপর আমার আশার অন্ত নাই। তোমরা একদিন জ্ঞানে ও কর্মে সাধনায় ও সিদ্ধিতে এ দুর্ভাগা দেশের অপমান দূর করিবে এই ভরসা রাখি। জ্ঞানের চর্চায় অবহিত থাকিয়া সেবায় ও কল্যাণকর্মে স্বদেশের উপর আপন অধিকার স্থাপন কর, কোনো সহজ উপায়ে কি কেবলমাত্র দু:সাহসিকতায় স্বদেশের উদ্ধারসাধন কল্পনা কদাচ মনে স্থান দিও না। .... আপনাকে প্রস্তুত কর, আপন স্বদেশবাসীকে প্রস্তুত কর।
[চিঠিপত্র, বিশ্বভারতী পত্রিকা, ১৪শ বর্ষ, ২য় সংখ্যা কার্তিক পৌষ]।রাওলাট সত্যাগ্রহের ডাক দিলেন গান্ধী। কিন্তু যে সত্যাগ্রহের পথ মুষ্টিমেয় মানুষের অন্তরের সত্য উপলব্ধির পথ, তা আপামর অশিক্ষিত নরনারীর ক্ষণিকের উত্তেজনার পথ থেকে বহু যোজন দূরবর্তী। সেই অহিংস সত্যাগ্রহের জন্য দেশের জনগণকে তৈরি হতে হবে। রাওলাট বিল পাশ হয়ে যাওয়ায় গান্ধীজিকে তৎক্ষণাৎ আন্দোলনের ডাক দিতে হল বটে, কিন্তু সেই আন্দোলন যখন তার নিজস্ব গতিপথে ধাবিত হতে লাগল তখন তাকে আর দমানো সম্ভব হল না। ফলে গান্ধীজি আন্দোলন সাময়িকভাবে বন্ধ রাখার নির্দেশ দিলেন।
রবীন্দ্রনাথের নাইটহুড প্রত্যাখ্যানের একবছর পর রবীন্দ্রনাথ যখন লন্ডনে গিয়েছিলেন ১৯২০ সালে তখন কবির মনে আশা ছিল পাঞ্জাবের অত্যাচারে যারা দায়ী ছিল তারা নিন্দিত হবেন। কিন্তু ঘটল তার বিপরীত। ২২ জুলাই ১৯২০ লন্ডন থেকে তিনি চিঠিতে লিখেছিলেন —
“পার্লামেন্টের উভয় পক্ষে যে ডায়ার বিতর্ক হল, তার ফলে ভারতের প্রতি এদেশের শাসকবৃন্দের মনোভাব স্পষ্ট হয়ে আমার মনে বেদনার সঞ্চার করেছে। এতে বোঝা গেল, ব্রিটিশ সরকারের প্রতিনিধিরা আমাদের প্রতি যতই অমানুষিক অত্যাচার করুন না কেন, এতে পার্লামেন্টের সদস্যদের মনে বিন্দু-মাত্রও ক্রোধের সঞ্চার হয় না।”
সবসময় নিজেকে এবং দেশের মানুষকে তৈরি হবার ওপর তিনি জোর দিয়েছেন। নিজেকে প্রস্তুত কর।৭ সেপ্টেম্বর প্যারিস থেকে লেখা পত্রে বলেছিলেন পাঞ্জাবের ব্যাপার এবার আমাদের ভুলতে হবে। তবে একথাও মনে রাখতে হবে নিজেদের রাজনৈতিক এবং সামাজিক ভিত তৈরি না করতে পারলে বাইরে থেকে এ ধরনের লাঞ্ছনা আমাদের সইতেই হবে। সমুদ্রতরঙ্গের দিকে দৃষ্টি না দিয়ে নিজের নৌকাটিকে মজবুত করা চাই। আজ একশ বছর পর আমাদের ভাবতে হবে স্বদেশের সেই তরী আমাদের বহিঃজগতের ঝঞ্ঝা সইতে পারবে তো?