• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | Rabindranath Tagore | প্রবন্ধ
    Share
  • গীতার রবীন্দ্র-ভাষ্য : মারণতত্ত্বের উড়োজাহাজ : আশীষ লাহিড়ী

    ১৯২৫ সালে রবীন্দ্রনাথের রচনায় আধুনিক প্রযুক্তি-যন্ত্রের 'আশীর্বাদে'র অনুল্লেখ দেখে বিস্মিত ও অখুশি হয়েছিলেন রবীন্দ্র-অনুরাগী বিজ্ঞানী-লেখক হ্যাভেলক এলিস। রবীন্দ্রনাথ নিজেকে সমর্থন করেছিলেন এই বলে যে প্রযুক্তির মধ্যে সৌন্দর্য নেই, আছে কেবল efficiency; তাই তা সৃজনশিল্পের উদ্দীপনা জোগায় না। তরুণ অমিয় চক্রবর্তী রবীন্দ্রনাথের এই প্রযুক্তি-বিমুখ বিজ্ঞান-অবগাহনকে সমর্থন করে লিখেছিলেন, 'বিজ্ঞানকে এরকম high romantic plane-এ sublime করে দেখাতে কে পেরেছে - যাতে চিন্তা, কল্পনা অনুভূতির বিচিত্র ধারা এক অপরূপ সৌন্দর্য্য সৃষ্টিতে এসে চরম ব্যঞ্জনা লাভ করেছে? আমি ওঁকে [এলিস্‌কে] বলতে চাই যে আপনার [রবীন্দ্রনাথের] কবিতায় সহর বা রাস্তা বা রেলগাড়ীর বর্ণনা খুঁজতে গিয়ে উনি ভুল করেছেন - ওরকম information ওতে না খুঁজে এইটেই দেখতে হবে যে তা informed with the spirit of the times কি না।' [১]

    কিন্তু বছর পঞ্চাশ পর মনে হয় অমিয় চক্রবর্তীর ধারণা বদলেছিল। প্রযুক্তির ফসল এরোপ্লেন কিংবা জাহাজ শুধুই রবীন্দ্রনাথ-কথিত 'efficiency'-র বহিঃপ্রকাশ, তা মানুষের কল্পনাশক্তিকে রুদ্ধ করে, এ কথা ঠিক মনে হয়নি তাঁর। ১৯৭৬-৭৭ সালে নরেশ গুহকে এক চিঠিতে লিখেছিলেন তিনি : 'কিন্তু প্লেনে বসে আমরা কফিও খাই, কবিতাও লিখি, নিবিড় অধ্যয়নের সঙ্গে সঙ্গে বিজলি-রঙের প্লেন-পাখার মেঘচ্ছায়া নীলান্তরে লক্ষ্য করি। সূর্যাস্ত, সূর্যোদয়, স্পন্দিত নক্ষত্রাকাশ এরোপ্লেনে নবতর মূর্তি নেয় ...'। [২] তাঁর মতে রবীন্দ্রনাথের লেখায় 'যন্ত্রপাতির প্রত্যক্ষ পরিচয়' বিশেষ না থাকার কারণ 'বোধ হয় টেক্‌নলজির প্রথম অধ্যায়ে যে কলকারখানা, দানব-শহর, এবং সংহারী-যুগের অতিকায় নির্মম বিলাস তিনি দেখেছিলেন তার প্রতি বিরুদ্ধতা তাঁকে সমস্ত টেক্‌নিকাল ক্রিয়াকলাপ সম্বন্ধে সন্দিহান করেছিল।' এছাড়া এই 'স্বাভাবিক যন্ত্রবিরুদ্ধতা'র মূলে ছিল 'বিদেশীদের হাতে যুদ্ধাস্ত্র ব্যবহার - লক্ষ লোক মারবার বৈজ্ঞানিক বিধি।' [৩] তবে সবকিছুর পরেও উল্লেখ্য এই যে প্রযুক্তির প্রতি অনুৎসাহ রবীন্দ্রনাথকে বিজ্ঞান-অনীহ তো করেই নি, উপরন্তু বিজ্ঞানের নান্দনিক ও দার্শনিক নিষ্যন্দ আত্তীকরণে প্রণোদিত করেছিল। সেদিক থেকে তরুণ অমিয় চক্রবর্তীর মন্তব্যটি অভ্রান্ত।

    গীতা : 'তত্ত্বনির্মিত উড়ো জাহাজ'

    কিন্তু এর সম্পূর্ণ আলাদা একটা মাত্রাও ছিল, সেটা নান্দনিক নয়, সেটাকে বিশুদ্ধ তাত্ত্বিক ও নৈতিক মাত্রা বলা চলে। ১৯৩২ সালে প্রথমবার বিমানপথে পারস্যভ্রমণে গিয়েছিলেন তিনি। পৃথিবীর মাটি থেকে অনেক উঁচুতে, 'যেখানে ধরণির সঙ্গে আমাদের পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের যোগ সংকীর্ণ', সেখানে 'বায়ুতরী' থেকে বোমা ফেলে মানুষ মারার দুর্ধর্ষ প্রযুক্তি-সাফল্যের কথা শুনে তাঁর মনে হয়েছিল : এমন অবস্থায় আকাশযানের থেকে মানুষ যখন শতঘ্নী বর্ষণ করতে বেরোয় তখন সে নির্মমভাবে ভয়ংকর হয়ে উঠতে পারে; যাদের মারে তাদের অপরাধের হিসাববোধ উদ্যত বাহুকে দ্বিধাগ্রস্ত করে না, কেননা হিসাবের অঙ্কটা ঝাপসা হয়ে যায়। যে বাস্তবের পরে মানুষের স্বাভাবিক মমতা, সে যখন ঝাপসা হয়ে আসে তখন মমতারও আধার যায় লুপ্ত হয়ে। [৪]

    'ব্রিটিশদের আকাশফৌজে'র 'খ্রীস্টান ধর্মযাজকে'র কাছে পারস্যের 'কোন্‌ শেখদের গ্রামে তারা প্রতিদিন বোমা বর্ষণ' করছে তার হৃষ্ট ফিরিস্তি শুনে শিহরিত হয়েছিলেন তিনি। উদ্ধৃত অংশটিতে 'এমন অবস্থায়' কথাটার তাৎপর্য দূরপ্রসারিত। দূর থেকে 'রিমোট' সুইচ টিপে কিংবা অনেক উঁচু থেকে বোমা ফেলে অনেক মানুষ মারার রণপ্রক্রিয়ার একটা 'সুবিধা' হল লক্ষ্যবস্তুর থেকে হত্যাকারীর নৈর্ব্যক্তিক দূরত্ব : কাকে মারছি তার মুখ বা ছিন্নবিচ্ছিন্ন দেহ দেখতে হচ্ছে না। ঝাপসা হয়ে-আসা সেই বাস্তবতা আনে এক ধরণের দার্শনিক নির্লিপ্ততা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এ প্রক্রিয়া খুব কার্যকর হয়েছিল; যার চরম পরিণতি হিরোশিমা ও নাগাসাকির ধ্বংসকাণ্ড। রবীন্দ্রনাথের সৌভাগ্য, বিজ্ঞান আর প্রযুক্তির সে- 'সাফল্য' তাঁকে দেখতে হয়নি। 'অস্ত্রশস্ত্রের নিয়ন্ত্রণ ও দিক্‌নির্দেশের ব্যাপারে' ইলেকট্রনিক বোতাম-টেপা দূর-নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতির প্রয়োগের তাৎপর্য বিষয়ে রবীন্দ্রনাথের অনেক পরে ১৯৬৫ সালে জে ডি বার্নাল লিখেছিলেন, এর 'আসল উদ্দেশ্য হল সাক্ষাৎ সংঘর্ষের ক্ষেত্র থেকে মানুষের প্রত্যক্ষ উপস্থিতিকে আরও দূরে সরিয়ে আনা। ... ক্রিয়া ও তার পরিণামের মধ্যে দূরত্বটা খুব বেশি হওয়ায় আধুনিক যুদ্ধপ্রক্রিয়া দায়িত্বজ্ঞানহীনতাকেই প্রশ্রয় দেয়। আগেকার যুদ্ধের সচেতন নিষ্ঠুরতার সঙ্গেই পাল্লা দেয় আধুনিক যুদ্ধের এই নির্বিকার দায়িত্বজ্ঞানহীনতা। আজকের বোতাম-টেপা যুদ্ধপ্রক্রিয়ার কল্যাণে সুবুদ্ধিসম্পন্ন, আপাত-সুসভ্য কোনও ব্যক্তির পক্ষেও অনায়াসেই চরম বীভৎস মারণযজ্ঞের আয়োজন করা সম্ভ - যার ফলাফল তিনি অকুস্থলে স্বচক্ষে দেখতে পান না।' [৫] মানুষ-নিধনের প্রত্যক্ষ ভয়াবহতা থেকে নিধনকারীকে দূরে সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার ফলে যুদ্ধপ্রক্রিয়ায় যে একটা গুণগত পার্থক্য দেখা দিয়েছিল, সেটা রবীন্দ্রনাথ অভ্রান্ত প্রত্যয়ে ধরতে পেরেছিলেন। এরোপ্লেন জিনিসটাকে তিনি সেই মারণ-অনুষঙ্গে দেখেছিলেন। তাঁর কাছে প্রশ্নটা নিছক হিংসা-অহিংসার নয়, গণ-নিধন করে মানুষের মন কী করে দায় এড়িয়ে নির্বিকার থাকতে পারে, সেই নৈতিকতার —

    পাশ্চাত্য হননবিদ্যা যারা জানে না তাদের মানবসত্তা আজ পশ্চিমের অস্ত্রীদের কাছে ক্রমশই অত্যন্ত ঝাপসা হয়ে আসছে।

    ইরাক-যুদ্ধের সময় বোতাম-টেপা পেট্রিয়ট-ক্ষেপণাস্ত্রের অভূতপূর্ব 'এফিশিয়েন্সি' আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের প্রযুক্তিবিদ ও বিজ্ঞানীদের বিশেষ গর্বের ব্যাপার ছিল, বিশেষ করে হাইড্রোজেন বোমার জনক এবং মার্কিন যুদ্ধপ্রয়াসে অগ্রসর কম্পিউটার-প্রযুক্তির অন্যতম প্রবর্তক এড্‌ওয়ার্ড টেলারের। এই আধুনিক, দূর-নিয়ন্ত্রিত 'efficient' যুদ্ধপ্রক্রিয়ার (যার প্রায় কিছুই রবীন্দ্রনাথ দেখে যাননি) নিশ্চিন্ত দায়িত্বজ্ঞানহীনতার পিছনে যে-মন কাজ করে, কিংবা বলা যায়, যে-দার্শনিকতার প্রশ্রয়ে মন এই দানবিকতার তুরীয় যৌক্তিকতা খুঁজে নিতে পারে, তার সমান্তরাল রবীন্দ্রনাথ দেখতে পান ভগবদ্‌গীতার শিক্ষায়।

    গীতা সম্বন্ধে রবীন্দ্রনাথের দোলাচল অনেক কালের। ৩১ মে ১৯০৮ অজিতকুমার চক্রবর্তীকে লিখেছিলেন, 'অর্জুনকে যুদ্ধে প্রবৃত্ত করবার জন্যে আত্মার অনশ্বরত্ব সম্বন্ধে যে উপদেশ আছে তার মধ্যেও বিশুদ্ধ সত্যের সরলতা নেই।' গীতার যা প্রাণ, সেই আত্মার অবিনশ্বরত্ব-তত্ত্ব সম্পর্কিত উপদেশ নিয়েই প্রশ্ন তুলেছিলেন তিনি, বলেছিলেন, যেভাবে ও তত্ত্ব প্রয়োগ করা হয়েছে, তার মধ্যে 'বিশুদ্ধ সত্যের সরলতা নেই।' [৬] অর্থাৎ ওটা সাময়িক কার্যসিদ্ধির কৌশল মাত্র। অথচ এর ঠিক দু বছর পরে, ১৯১০ সালের ২৩ মে তিনি লেখেন :

    এতকাল এত হুজুগের মধ্যেও আমি গীতা পড়িনি — কারণ তখন আমার পড়ার সময় হয়নি, এখন সময় বুঝেই সময়ের কর্ত্তা আমার হাতে এই বইখানি তুলে দিয়েছেন। তার সঙ্গে যোগমুক্ত হবার জন্যে মনকে যে একটি অতি গভীর শান্তি ও সামঞ্জস্যের মধ্যে দিয়ে যেতে হবে তার সত্যতা বুঝতে পারচি। ... এই যে সামঞ্জস্য এত বাইরের জিনিষ নয় — নিজের অন্তরের মধ্যে সমস্ত দ্বন্দ্বের অতীত লোকে অধিরোহণ করতে হবে — ভিতরকার সমস্ত বিরোধ নিঃশেষে না মেটালে নয়, এই জন্যেই বাইরের বাধার দ্বারা পদে পদে তার পরীক্ষার প্রয়োজন হচ্চে। ঈশ্বর কবে এই পরীক্ষা থেকে আমাকে উত্তীর্ণ করবেন? কবে তিনি আমার সমস্ত ভাঙাকে জোড়া দিয়ে নেবেন? [৭]

    এখানে দেখি, গীতা সম্বন্ধে সংশয়হীন মান্য মনোভাবেই ফিরতে চাইছেন তিনি। তবে, সংশয় ঝেড়ে ফেলে 'শান্তি ও সামঞ্জস্যে' পৌঁছনোর আপ্রাণ সাধনা করছেন রবীন্দ্রনাথ, এইটুকুই কেবল এখানে সত্য; বাকি সমস্তটুকুই ভবিষ্যৎকালে ঘটবে বলে তাঁর আশা। সে-ঘটনা ঘটেছিল কি? ভাঙা বিশ্বাসে জোড়া লেগেছিল কি? বোধহয় কোনোদিনই লাগেনি। নইলে ১৯০৮ সালে ব্যক্ত সংশয় ১৯৩২ এ আরো তীক্ষ্ণ, আরো দ্বিধাহীন বিদ্রূপবর্ষী ভাষারূপ নিয়ে ফিরে আসবে কেন? পারস্যে আকাশ থেকে নীচের মানুষদের ওপর ব্রিটিশ বোমারুর 'এফিশিয়েন্ট' বোমাবর্ষণের নির্বিকার অমানবিকতার কথা বলার পরেই তিনি বলেন —

    গীতায় প্রচারিত তত্ত্বোপদেশও এই রকমের উড়ো জাহাজ — অর্জুনের কৃপাকাতর মনকে সে এমন দূরলোকে নিয়ে গেল, সেখান থেকে দেখলে মারেই বা কে, মরেই-বা কে, কেই-বা আপন, কেই-বা পর। বাস্তবকে আবৃত করবার এমন অনেক তত্ত্বনির্মিত উড়ো জাহাজ মানুষের অস্ত্রশালায় আছে, মানুষের সাম্রাজ্যনীতিতে, সমাজনীতিতে, ধর্মনীতিতে। সেখান থেকে যাদের উপর মার নামে তাদের সম্বন্ধে সান্ত্বনাবাক্য এই যে, ন হন্যতে হন্যমানে শরীরে। [৮]

    ভারতীয় দার্শনিক প্রজ্ঞার সারাৎসার রূপে যা বহুজনমান্য, ইদানীং অনেকে যাকে ক্রীডহীন হিন্দুধর্মের 'ক্রীড' বলে প্রচার করতে ব্যস্ত, তা রবীন্দ্রনাথের কাছে নিছক বোমা-ক্লিষ্টদের মন ভোলাবার 'সান্ত্বনাবাক্য'!

    স্মরণ করলে হয়তো অন্যায় হবে না, এর উনচল্লিশ বছর আগে অক্ষয়কুমার দত্ত ১৮৮৩ সালে গীতা সম্বন্ধে বলেছিলেন, 'ঐ প্রবন্ধ রচনার উদ্দেশ্য কি জান? জীবাত্মার ধ্বংস হয় না, অতএব যত ইচ্ছা নরহত্যা কর, তাহাতে কিছুমাত্র পাতক নাই।' [৯]


    সূত্রনির্দেশ :

    [১] নরেশ গুহ, সম্পা, কবির চিঠি কবিকে, প্যাপিরাস, কলকাতা ১৯৯৬, পৃষ্ঠা ৫২
    [২] নরেশ গুহ, সম্পা, প্রমথ চৌধুরীকে লেখা অমিয় চক্রবর্তীর পত্রাবলী, পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি, কলকাতা ২০০০, পৃষ্ঠা ৩৩
    [৩] ঐ, পৃষ্ঠা ৩২
    [৪] রবীন্দ্র রচনাবলী, পশ্চিমবঙ্গ সরকার শতবার্ষিক সংস্করণ, ১০ : ৭৫৪
    [৫] জে ডি বার্নাল, ইতিহাসে বিজ্ঞান (অনু: আশীষ লাহিড়ী), আনন্দ, কলকাতা ২০০৫, পৃষ্ঠা ৪৭২
    [৬] রুদ্রপ্রসাদ চক্রবর্তী (সম্পা), ভক্ত ও কবি : অজিতকুমার চক্রবর্তী-রবীন্দ্রনাথ পত্রবিনিময়, বাংলা আকাদেমি, কলকাতা ২০০৭, পৃষ্ঠা ২৪
    [৭] ঐ, পৃষ্ঠা ৬২
    [৮] রবীন্দ্র রচনাবলী পশ্চিমবঙ্গ সরকার শতবার্ষিক সংস্করণ, ১০ : ৭৫৪
    [৯] অক্ষয়কুমার দত্ত, ভারতবর্ষীয় উপাসক সম্প্রদায়, দ্বিতীয় খণ্ড (১৮৮৩), করুণা প্রকাশনী, কলকাতা ১৯৯৯, পৃষ্ঠা ২৫৪

    পরবাস, ফেব্রুয়ারি ২০১৩
  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments