সকাল থেকে শ্রাবণের বৃষ্টি। অঝোর ধারা। দিনটা ছিল ২৯ অগাস্ট। মন ভালো নেই শান্তিনিকেতনের। মন ভালো নেই শান্তিনিকেতনবাসিদের। রিক্ত হয়ে গেল ‘রবিবার’- অনন্তপারে চলে গেলেন এই বাড়ির মালিক বুদ্ধদেব গুহ। বর্ষা কিংবা বসন্ত— অবসর পেলেই কলকাতার দ্রুতলয়ের জীবন থেকে চলে আসতেন শান্তিনিকেতনের এই রাঙা মাটিতে, তাঁর বাড়ি ‘রবিবার’এ। অবশ্য তিনি বলতেন ‘রোববার’। এই বাড়িতে তাঁর আর নিঃশ্বাস পড়বে না। বাড়ির কেয়ারটেকার টুম্পা দেবী জানালেন ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে শেষবার এসেছিলেন তিনি। টানা সাত দিন ছিলেন। গাছ, পাখি আর লেখালিখি নিয়েই দিন কাটত তাঁর।
বুদ্ধদেব গুহর জন্ম ২৯ জুন, ১৯৩৬। বাবা শচীন্দ্রনাথ গুহ, মা মঞ্জুলিকা গুহ। কলকাতায় জন্ম হলেও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় সপরিবারে চলে যান দেশের বাড়ি বরিশালে। ছোটোবেলা কাটে অসচ্ছলতার মধ্যে। পরবর্তী সময়ে কলকাতায় ফিরে এসে পড়াশোনা শুরু দক্ষিণ কলকাতার তীর্থপতি ইন্সটিটিউশনে, স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে ভর্তি হন সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে। ছোটো থেকেই খেলাধুলোয় ঝোঁক। স্কুলজীবনে ক্রিকেট খেলায় নেতৃত্ব দিয়েছেন। দক্ষ টেনিস ও স্কোয়াশে। দীর্ঘদিন খেলেছেন সাউথ ক্লাব ও ক্যালকাটা র্যাকেট ক্লাবে। নিয়মিত রোয়িং করেছেন লেক ক্লাবে। পারিবারিক ব্যবসার হাল ধরার জন্য বাবার নির্দেশে বুদ্ধদেব গুহকে চার্টার্ড আকাউণ্টাণ্ট হতে হয়। পেশায় সফল হলেও সাহিত্যই ছিল তাঁর ভালোবাসা। তাঁর প্যাশন। মাতৃপরিবার থেকেই তাঁর সাহিত্যে অনুরাগ। বুদ্ধদেব গুহর মামা কবি সুনির্মল বসু তাঁকে সাহিত্যে উৎসাহিত করেছিলেন। প্রথম লেখা প্রকাশিত হয় ‘শিশুসাথী’ পত্রিকায়, বয়স ১৬। ছাপার অক্ষরে নিজের লেখা দেখার পর থেকেই লেখক হওয়ার বাসনা তাঁকে সাহিত্যের দিকে ধাবিত করে, সাহিত্যের প্রতি সেই অনুরাগ থেকেই তিনি হয়ে উঠেছিলেন প্রথম সারির এক জনপ্রিয় লেখক। ‘জঙ্গলমহল’ তাঁর প্রথম প্রকাশিত বই। বিশিষ্ট রবীন্দ্রগবেষক অমিত্রসূদন ভট্টাচার্য লিখেছেন, ‘তাঁর জীবনটা ছিল গল্পে ভরা, উপন্যাসে ভরা, প্রেমে ভরা, প্রকৃতিতে ভরা, প্রসন্নতায় ভরা। কোন গুণ নেই এমন কোন কোন মানুষকে উনি নিজ গুণে ভালোবাসতেন…নিজেকে তিনি সামান্য লেখক মনে করতেন। এই ছিল তাঁর অসামান্যতা।’ তাঁর জীবনটা ছিল খোলা আকাশের মতো। কোথাও গোপন করার মতো কিছু নেই। নেই কোন আড়ালের আবরণ। তাঁর সৃষ্ট চরিত্রে তাঁর নিজেরই ছায়া, একাধিক উপন্যাসে নিজেকে উজাড় করে দিয়েছেন তিনি।
শৈশব থেকেই গানের প্রতি আগ্রহ। বিপুল ভালোবাসা রবীন্দ্রনাথের গানে। তিনি এক ঘরোয়া আড্ডায় বলেছিলেন, যে বাড়িতে কোন বই নেই, কোন গান হয় না, সেখানে থাকতে আমার বড় কষ্ট হয়। একদা কলকাতার ‘দক্ষিণী’তে রবীন্দ্রসঙ্গীতের পাঠ নিয়েছিলেন। তালিম নিয়েছেন দেবব্রত বিশ্বাসের কাছ থেকেও। সেসব গানের রেকর্ড আছে। গাইতেন আসরেও। নিধুবাবুর টপ্পা সহ পুরাতনী গানে তাঁর দক্ষতা ছিল অসামান্য। শিখেছেন দিলীপ মুখোপাধ্যায়, চণ্ডীদাস মাল ও রামকুমার চট্টোপাধ্যায়ের কাছ থেকে। টপ্পা যেন লতার মতো শ্রোতার হৃদয় জড়িয়ে ধরত। পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ হয়েছিলেন প্রখ্যাত রবীন্দ্রসঙ্গীত-শিল্পী ঋতু গুহর সঙ্গে। জীবনের অন্তিমে গানই ছিল তাঁর একমাত্র আশ্রয় কারণ ক্ষীণদৃষ্টির জন্য তাঁকে লেখালিখি থেকে বিরত থাকতে হয়েছিল। লেখালিখি ও গানের পাশাপাশি আঁকাতেও বুদ্ধদেব গুহ বেশ পারদর্শী ছিলেন, কিন্তু ছবি আঁকার পাঠ নেননি কারোর কাছ থেকে। পরিচয় ছিল প্রখ্যাত চিত্রশিল্পী পরিতোষ সেনের সঙ্গে, কিন্তু তাঁকে ছবি দেখানোর সুযোগ হয়নি। শিল্পী শ্যামল দত্তরায় তাঁকে উৎসাহ দিয়েছেন। একান্তে, নিজের মত করে সময় কাটানোর মাধ্যম ছিল আঁকাআঁকি। তাঁর জঙ্গলপ্রীতি তাঁর ক্যানভাসেও জীবন্ত হয়েছে। তিনি মনে করতেন ছবি আঁকলে মনের সব দুঃখ, কষ্ট বেরিয়ে যায়। নিজের বইয়ের প্রচ্ছদ করেছেন নিজের আঁকা ছবি দিয়ে।
বাবা শচীন্দ্রনাথের ছিল শিকারের নেশা। একই নেশায় বুদ্ধদেব ঘুরে বেড়িয়েছেন দেশের নানা ছোটবড় জঙ্গলে। জঙ্গলের প্রতি তাঁর গভীর টান। তাঁর উপন্যাসের মধ্যে জড়াজড়ি করে আছে মানুষ ও অরণ্যের গন্ধ, রূপ, আর মন কেমন করা নির্জনতা। বলা যায়, বিভূতিভূষণের পরে বুদ্ধদেব গুহ আমাদের জঙ্গল চিনিয়েছেন। সমস্ত জীবন ধরে তিনি জঙ্গলের কথা বলে গেছেন। সে বলা এতটাই জীবন্ত ও প্রাণবন্ত যে বাংলা সাহিত্য তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞ থাকবে চিরদিন। ‘জঙ্গলের জার্নাল’ তার অন্যতম নিদর্শন। তিনি লেখেন বন আর বনজীবী মানুষের কথা। লেখেন মানুষ, বনের জীবজন্তু আর বনের গাছগাছালির ভালোবাসার কথা। প্রকৃতির প্রতি মানুষের ভালোবাসার কথা। আর সেই ভালোবাসা এতই খাঁটি যে পড়তে গিয়ে তা অনুভব করা যায় । অরণ্যে অরণ্যে ঘুরে তিনি খুঁজতে ছেয়েছেন জীবনের সবুজতা, গভীরতা, মাদকতা। আসলে তিনি ছিলেন জীবনরসিক। এছাড়া, তিনি খুব কাছ থেকে দেখেছেন জঙ্গলের মানুষের দারিদ্র্য। ভালোবেসেছেন তাঁদের সহজ সরল জীবনযাত্রাকে। শহুরে মানুষের ভণ্ডামি ও দ্বিচারিতা থেকে তাঁর যোজন যোজন দূরত্ব। তাঁর মৃত্যুতে প্রকৃতি ও মানুষের আশ্চর্য বিনুনি আলগা হয়ে গেল। বাংলা সাহিত্য হারাল পাঠকপ্রিয়তার শীর্ষে থাকা একজন সাহিত্যিককে। কত আনামি লেখক তাঁর কত আপন ছিলেন। প্রসঙ্গান্তরে গিয়েও বলতে হয়, তরুণ অনামি লেখক শিবতোষ ঘোষের গল্পের বই পড়ে এতটাই মুগ্ধ হয়েছিলেন বুদ্ধদেব গুহ যে তাঁর ৫০ কপি বই কিনে বিভিন্ন জনকে উপহার দিয়েছিলেন। দেবেশ রায়ের ‘তিস্তাপারের বৃত্তান্ত’ও কিনে নানাজনকে দিয়েছিলেন।
বুদ্ধদেব গুহর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ— ‘কোয়েলের কাছে’, ‘কোজাগর’, ‘একটু উষ্ণতার জন্য’, ‘হাজার দুয়ারি’, ‘সুখের কাছে’ ইত্যাদি। ‘কোয়েলের কাছে’— জঙ্গল নিয়ে এরকম নিবিড় উপন্যাস বাঙালি পাঠক বোধ হয় পড়েননি। তাঁর বিশেষ উল্লেখযোগ্য উপন্যাস ‘মাধুকরী’। এই উপন্যাসের প্রধান চরিত্র পৃথু ঘোষ। তাঁর বড়ই সাধ ছিল সে বড় বাঘের মতো বাঁচবে এ জীবনে। …হল না। হবে না…। উপন্যাসটির শেষাংশ যেন গোটা উপন্যাসটির কথামুখ। তিনি লিখছেন, ‘পৃথুরই মতো, প্রত্যক সাধারণ পুরুষ ও নারীকে জন্ম থেকে মৃত্যু অবধি অগণিত নারী, পুরুষ ও শিশুর হৃদয়ের এবং শরীরেরও দোরে দোরে হাত পেতে, ঘুরে ঘুরেই বেঁচে থাকতে হয়। প্রীতি, প্রেম, কাম, অপত্য, ভক্তি, শ্রদ্ধা, ঘৃণা, বৈরিতা, ক্রোধ, সমবেদনা, এবং এমনকি ঔদাসিন্যের বোধগুলিকে দেওয়ালির রাতের অসংখ্য প্রদীপের কম্পমান শিখারই মতো অনুভূতির দ্বিধাগ্রস্ত আঙ্গুলে ছুঁয়ে ছুঁয়ে জীবনকে পরিক্রম করে যেতে হয়। এই পরিক্রমারই আরেক নামই কি মাধুকরী?’ উপন্যাসটির আরেক বৈশিষ্ট্য লেখক বুদ্ধদেব গুহ উপন্যাসে গ্রথিত করেছেন বিজয়া মুখোপাধ্যায়, তারাপদ রায়, শক্তি চট্টোপাধ্যায় প্রমুখদের কবিতার উদ্ধৃতি। আছেন ইংরেজ কবি টেড হিউজেস-ও। তারাপদ রায়ের কবিতাটির উদ্ধৃতি বড় আকর্ষকঃ ‘কপালের চুল ছিড়ে, দাঁত দিয়ে মাটি কামড়ে ধরে/ কবিতা লেখার কোনও মানে হয় না/ কবিতা তো ডাক্তারের স্টেথোস্কোপ নয়/ নয় উদ্বাস্তুর ভিটে বাড়ি/ জেলের হাতে জাল, কিংবা নয় চাষার লাঙ্গল।’
তাঁর আত্মজীবনীমূলক উপন্যাস ‘খেলা যখন’। জীবনের লড়াই এই আত্মজীবনীর অন্যতম উপজীব্য। তিনি লিখছেন, ‘কেউ হয়ত শুধু নিজের প্রিয়জনদের কোনোক্রমে বাঁচিয়ে রাখার জন্য লড়াই করেন, কেউ বা করেন কোনও বিশ্বাসকে বা কোনও সুনামকে বাঁচানোর জন্য। কেউ বা নেহাত তাঁর নিজেকে বা নিজের পরিবারকে বাঁচানোর জন্যই নয়, তার চেয়েও কোনও বড় কারণের জন্য লড়াই করেন। এসব লড়াইয়ের সব লড়াই–ই লড়াই। কোনও লড়াই-ই অন্য লড়াইয়ের চেয়ে কম নয়। সে লড়াইকে আমার ভয় নেই, ভয় ছিল না কোনওদিন।’ কিশোর সাহিত্যেও বুদ্ধদেব গুহর অবাধ বিচরণ। তাঁর সৃষ্ট ‘ঋজুদা’ ও ‘ঋভু’ কয়েক প্রজন্মের বহু কিশোর-কিশোরীর মন তোলপাড় করা চরিত্র। বিভিন্ন সময়ে বিদেশ ভ্রমণের অভিজ্ঞতা থেকে লিখেছেন ‘প্রথম প্রবাস’ থেকে ‘দশম প্রবাস’— দশটি ভ্রমণকাহিনী।
১৯৭৭ সালে ‘হলুদ বসন্ত’ উপন্যাসটি তাঁকে এনে দেয় আনন্দ পুরস্কার। এছাড়া, ভূষিত হয়েছেন ‘শিরোমণি’ ও ‘শরৎ’ পুরস্কারে। বুদ্ধদেব গুহ আকাদেমি পুরস্কার পাননি, সেজন্য তাঁর আক্ষেপ ছিল কি না জানা নেই। কিন্তু তাঁর ঝুলিতে ছিল পাঠকের অফুরন্ত ভালোবাসা আর এই ভালোবাসার আলোয় স্নাত বুদ্ধদেব গুহ একটি বইয়ের উৎসর্গ পত্রে নির্দ্বিধায় লিখতে পেরেছিলেন, ‘আমার পাঠক-পাঠিকাদের, যারা আমার মেরুদণ্ড’। তিনি পাঠকদের অত্যন্ত মান্যতা দিতেন, মনে করতেন একজন গরিব কৃষক, একজন দোকানদার কিংবা একজন ফেরিওয়ালা মনোযোগী পাঠক হতে পারেন। বুদ্ধদেব গুহ আজীবন শেখার আগ্রহে জীবন কাটিয়েছেন, বলতেন, ‘শেখার জন্যে চিতাতে ওঠার আগের মুহূর্ত অবধি আমি উৎসুক।’ তিনি নিজেই লিখছেন, ‘আমার ভারি ইচ্ছে করে আমার কোনও ভীষণ সুখের মুহূর্তে এমন সুন্দর কোনও পথে হাঁটতে হাঁটতে কোনোদিন আমি জাস্ট ফেডআউট করে যাব। তারপর আমাকে কেউ ডাকলেও আমি ফিরব না- আমি নিজে ডাকলেও আমি আর সাড়া দেব না। অথচ আমি আমার চারপাশের অন্ধকারেই ছড়িয়ে থাকব- ঝিঁঝিঁর ডাক হয়ে থাকব, জোনাকি হয়ে থাকব- তারার আলোর দ্যুতিমান শিশিরবিন্দু হয়ে থাকব, ঝরাপাতা হয়ে থাকব।’
গত ২৯ অগাস্ট, ২০২১, ৮৯ বছর বয়েসে বুদ্ধদেব গুহর প্রয়াণে বাংলা সাংস্কৃতিক জগতে একটা শূন্যতা তৈরি হল। যেকোনো সৃষ্টিশীল মানুষের মৃত্যুতে তাই হয়। অসম্ভব প্রতিভাবান মানুষকেও একটা না একটা সময় চলে যেতে হবেই, এই শূন্যতা মেনে নিয়েই আমাদের যাবতীয় থাকাথাকি। বুদ্ধদেব গুহই লিখেছিলেন, ‘শূন্যতার পাথেয় নিয়েই আমরা পূর্ণতার দিকে যাই।’ হয়তো এটাই সত্যি।