• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ২৭ | আগস্ট ২০০২ | গ্রম্থ-সমালোচনা
    Share
  • লাল নদীর সংক্রাম : সাদ কামালী

    "লালনদী" -- লেখক : মীজান রহমান ; প্রকাশক : পূর্বপশ্চিম ; ২০০২ ; দাম : ১০০ টাকা, বিদেশে ৫ মার্কিন-ডলার ; প্রচ্ছদ-শিল্পী : ধ্রুব এশ ; পৃষ্ঠা : ১৩৬





    মীজান রহমান স্মৃতিচর্চা অথবা স্মৃতিযাপন করেন না ; স্মৃতির ভার কমিয়ে মন হাল্কা করার জন্য তিনি এমন একটি `লাল নদী' তৈরি করেননি । তবুও তার অগণিত পাঠক ভক্ত তার 'স্মৃতিচারণ-মূলক' লেখা পড়ে কেমন করে যেন বিগলিত হন ! মীজান রহমানের 'স্মৃতি' বিষমুক্ত না করে রক্তাক্ত করে তোলে, গ্লানি দূর করে না সুস্থ করেও তোলে না, বরং, মগজে বোধে টোকা মেরে দেখিয়ে দেয় চারপাশের ভয়াবহ অমানবিকতা, মিথ্যা বড়াই আর আত্মঅহমের বিপর্যয় ।

    'পিতা' নিবন্ধে তিনি শুধু তাঁর আব্বার কথা বলেননি । আব্বার স্মৃতিচারণই তার লক্ষ্য নয়, বরং তিনি পিতা ধারণাটিরও একটি দার্শনিক উপলব্ধি প্রকাশ করেছেন, - "পিতা একটি ব্যাক্তি নয় শুধু, পিতা একটি স্তম্ভ, একটি অনড় মূর্তি -- । পিতা এক পরম প্রার্থনা, পৌরুষ আর বীর্যের বাসনা, যে পূর্ণতার সাধনায় সমর্পিত আমাদের জীবন তারই প্রকৃষ্ট প্রতীক" হলো পিতা । তাই কত অনায়াসে তার পিতা হয়ে ওঠেন আমাদের সবার পিতার প্রতিনিধি । মীজান রহমানের পিতা বিস্মরণীর শিকার হয়েছেন, ছেলেকে চিনতে পারছেন না । এই না চিনতে পারাটা রোগের কারণে নাও হতে পরে, স্থান কাল এবং তথাকথিত দরকারের অভিঘাতে পুত্র হয়ে পড়েন দূরের, শিকড়ছেঁড়া অচেনা মানুষ ; আর পিতা যে সেই আদি শিকড়েই রয়ে গেছেন বুক ভরা দোওয়া নিয়ে ।

    মীজান রহমানের জননীও (`কোণার ছোট বাগানটি') বা ণালি জননীর প্রতীক, অর্থাৎ স্বামী-সন্তানের ঘেরাটোপে বন্দি নারী এবং জননী, একাধারে যিনি 'ঝি, রাঁধুনি, ধোপা, নার্স এবং রাতের শয্যাস ণিগনী ।' সংসারের ষোলোআনা দেখভাল করে তার অবসর মিলে না, যদি মিলেও, সেই অবসরে উঠানের ছোটো কোনায় দুই একটি ফুলের গাছ লাগানো আর পরিচর্যা করে নিজের মতো শ্রান্তি দূর করার সুযোগ করে নেন । সংসারে নারীর এই জননীরূপ তিনি হতদরিদ্র জেলে পাড়াতেও দেখেছেন । জেলেনীও তার এক চিলতা উঠানের কোনে কোনোরকম করে গাঁদা জবা ফুল ফুটাতে চান । প্রগতি ও উন্নতির শিখরে বাসিন্দা কানাডাতেও তিনি দেখেছেন উঠানের বদলে একরত্তি ব্যালকনির কোণায় এক নারীর ছোটো একটি বাগানের সাধনা । কানাডাবাসী এই নারী, একজন পুরুষের স্ত্রীও বসবাস করছেন শাশ্বতের শৃঙ্খলে । অথবা একালের মতোই আরো জটিল আরো ভয়াবহভাবে । অধিকাংশ পুরুষের মানস যেমন উন্নতি ও প্রগতির ছোঁয়ায় অগ্রসর হয়নি তেমনি অচলায়তনের ঘেরে নতুন বোধও ঢুকতে পারেনি । মায়ের স্মৃতির উল্লেখ এখানে ভণিতা মাত্র, তথাকথিত আধুনিক জমানায় একজন শিল্পী নারীর শারীরিক মানসিক নির্যাতনের স্বরূপ তুলে ধরাই তার লক্ষ্য ।

    অবসরজীবনে মীজান রহমান পুরাকালের মতো ছেলের সংসারে অনিবার্য হয়ে উঠতে চান না । পশ্চিমের সিনিয়র হোমের ব্যবস্থায় তিনি অনেক ভালো কিছু খুঁজে পান । ছেলে বা কোনো ব্যাক্তির ওপর নির্ভরশীলতার চেয়ে সমাজ ও রাষ্ট্রের তত্ত্বাবধান প্রৌঢ় প্রাজ্ঞ পিতামাতার জন্য যেমন সম্মানের তেমনি ছেলের স্বাধীন স্বাচ্ছন্দের জন্যও ভালো ('শরণার্থী') । মীজান রহমান প্রগতিবিমুখ নন, তিনি চান প্রগতির মানবিকীকরণ, এটিই আধুনিকতা । মীজান রহমান প্রকৃত উত্তরআধুনিক মানুষ । মুহুর্মুহু কম্পিউটার - ইন্টারনেট - ইমেইল ইত্যাদি ব্যবহারের সময় 'প্রগতি ও প্রশ্ন নিবন্ধে' সেই ক্লাসিকেল সিদ্ধান্তটি স্মরণ করে খোঁজ নেন, প্রযুক্তি ও প্রগতি কতটা বেগের বিনিময়ে কতটা মানবিক আবেগ কেড়ে নিয়েছে । এবং এর ফলে সমাজের কতটা কল্যাণ নিশ্চিত হয়েছে । মীজান রহমানের প্রিয় হাসনাবাদের প্রায় অদূরে বা ণালোরে গত দুই দশক ধরে ঘটেছে কম্পিউটার শিল্পের বিপ্লব । প্রদেশ, জাতীয় অর্থনীতির সূচক হয়তো হয়েছে ধনাত্মক, কিন্তু জাতীয় অর্থনীতি বলতে যে জনতার অর্থনীতি বোঝায় সেখানে উন্নতির কোন সূচক পরিলক্ষিত হয় ! বা ণালোরে বা ভারতে নারী ভ্রুণহত্যা, শিশুনারী হত্যার কথা তিনি লিখেছেন "আজকের দিনের হাইটেক ভ্রূণহত্যা আর সেযুগে কন্যাসন্তান মা-গঙ্গার কাছে বিসর্জন দেওয়ার মাঝে খুব একটা তফাৎ আছে বলে" তার মনে হয় না । উপরন্তু কম্পিউটার ব্যবহারকারী জনতা ভোট দিয়ে সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক শক্তি বিজেপি জোটকে ভারতের ক্ষমতায় বসিয়েছে । বাংলাদেশেও ওই একই ব্যাপার । মীজান রহমানের উত্তরআধুনিক মন প্রগতির এই রূপ দেখে কাঁদে, পাঠকও তার দু:খের অংশভাক হন । হঠাৎ করেই অনিবার্য হয়ে ওঠা ই-মেইল কি সেই শিহরণে কাঁপাতে পারে যেভাবে আমরা মীজান রহমানের মতোই ('শিশু') প্রতিক্ষীত অথবা আকস্মিক  চিঠির  ঘ্রাণে নেচে উঠতাম অথবা অপেক্ষায় থাকতাম ! অপেক্ষার নামই তো ভালবাসা । সেই ভালবাসা কি আন্তর্জালের আধানডাকে পাই ! চিঠি ডাক ইত্যাদির মতো মিষ্টি ও হ্রস্ব ধ্বনিও বুঝি গায়েব হয়ে গেছে ।

    সহজ, অতি নম্র কন্ঠে অথচ দ্ব্যর্থ একটি প্রশ্ন তিনি করেন 'ওস্তাদজী' নিবন্ধে, - "আমরা কেন মানুষ থেকে মুসলমানকে আলাদা করে ভাবি ?" মুসলমান, খাঁটি মুসলমান হওয়ার সাধনায় আমরা যেন মানুষ হওয়া থেকে পিছিয়ে যাচ্ছি । বিশ্বের অন্য অন্য মানুষও আমাদের মানুষ না বলে চিহ্নিত করে মুসলমান হিসাবে । তবে এর দায় মীজান রহমান চাপিয়েছেন ওস্তাদজীদের ঘাড়ে । ওস্তাদজী সৎ শিশুমনের উর্বর জমিতে বিসমিল্লাতেই মুসলমান হবার সবক রোপণ করে করে তাকে মানুষ থেকে আলাদা করে ফেলেছে । ওস্তাদজী পরম্পরায় এর জন্য দায়ি । মসজিদ মক্তব মাদ্রাসা এমনকি ঘরের ভিতরও সাচ্চা মুসলমান হওয়ার শিক্ষা ফজর থেকেই শুরু হয় । মীজান রহমান মনে করেন, ধর্মগ্রন্থে এভাবে খুন-বৈষম্যের কথা, ইহুদী-বিদ্বেষের কথা নাই, তিনি ধর্মগ্রন্থ থেকে জেনেছেন স্রষ্টা সব মানুষকেই সমান চোখে দেখেন । প্রস ণগত তিনি মওলানা ইউসুফ আলীর তর্জমাকৃত ইংরেজি কোরআন শরিফের কথা উল্লেখ করেছেন । এই তর্জমা আমি পড়িনি, কিন্তু সৌদী আরবের সৌদী বাদশাহর পৃষ্ঠপোষকতায় মাওলানা মুহিউদ্দীন খানের তর্জমাকৃত 'পবিত্র কোরামুল করীম' থেকে বহু উদ্ধৃতি উদ্ধার করে বলা যায়, ওস্তাদজীগণ অশিক্ষার প্রভাবে ভুল সবক দেননি । তাদের দেয়া শিক্ষার বয়ান মূল কিতাবেই রয়েছে । সুরা আল-বাক্কারাহ-র ১৯১, ১৯৩, ২১৬, ২২৮, ২৫৬, ২৮২ নম্বর আয়াত, সুরা আল-মায়েদা'র ৩৪, ৫১ নম্বর আয়াত, সুরা আল-তওবাও'র ৫, ২৩, ২৮, ৩৯, ৭৩, ১১১, ১২৩ নম্বর আয়াত দেখে নিলে বেচারা ওস্তাদজী দায় থেকে মুক্ত হতে পারেন । সুরা ওয়াকিয়াহ-র অর্ধেক অংশ জুড়েই আছে ওস্তাদজীদের বর্ণনা মতো বেহেশতের বিবরণ, কিশোর, কুমারী কামিনী নারী, মদের লোভ । আপাতত এই কয়েকটি সূত্রই যথেষ্ট ।

    তিনি আরো একটি দ্ব্যর্থবোধক সংশয় প্রকাশ করেছেন 'কোরবানি' নিবন্ধের শেষে, "আল্লার উদ্দেশ্যে কোরবানি দেওয়ার কথা আমাদের কিন্তু, কোরবানি কারা দিচ্ছে ? আমরা না ওই নিরীহ পশুগুলো ?" কোরবানি নামক সংস্কারের নিষ্ঠুরতায় তার হৃদয়ে রক্তক্ষরণ ঘটে, সেই ক্ষরণের কষ্ট তিনি সংক্রমিত করতে পারেন পাঠক হৃদয়েও । তার ভাষা, স্বাদুগ এবং অনায়াস লিখনভঙ্গির জাদুতে পাঠকও দ্বিতীয় মীজান রহমান হয়ে ওঠেন, অথবা পাঠককে তিনি আসর করেন । আদরের প্রাণীটিকে আল্লার ওয়াস্তে বলি দেয়ার নামে স্বদেশে যেমন ঘটেছে ইগোর স্বার্থে হত্যার উত্সব তেমনি এই প্রবাসেও দেখেছেন কোরবানির প্রহসন, প্রাণীহত্যার পশ্চিমা ফর্মুলা । সেই দৃশ্য ছেলেদের সহ দেখে আর কোনোদিন কোরবানি দেয়ার কথা ভাবেননি, তার ছেলেদুটিও ভয়ে কষ্টে অনেক দূর সরে গেছে । আরো এক রক্তঝরা স্মৃতিও তার রয়েছে । স্মৃতি অথবা অতীতের সঙ্গে বর্তমানের দ্বান্দ্বিক অভিঘাতের প্রকাশই শুধু নয় সেই সঙ্গে মানবিক বোধের স্পর্শী উচ্চারণে মীজান রহমান পাঠককে বিব্রত করে তোলেন । পাঠকের শান্তির ঘুমের মধ্যেও লাল নদীর দু:সহ সংক্রাম ঘটে । ধর্ম আচার সংস্কারের অছিলায় প্রাণীহত্যার মচ্ছব দেখে তার মনে প্রশ্ন জাগে "ঈশ্বর কি মাংস খেতে পছন্দ করে ?"
  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments