• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ২৮ | নভেম্বর ২০০২ | ভ্রমণকাহিনি, প্রকৃতি, বাকিসব
    Share
  • মার্কিন মুলুকে মাসকয়েক : নন্দন দত্ত





    ॥ উদ্বর্তন পর্ব ॥



    ফিনিকস থেকে সোয়া দুশো মাইল আন্দাজ উত্তরে, গ্রাণ্ড ক্যানিয়ন । এ-তল্লাটে এলে সকলেই একবার পায়ের ধুলো দিয়ে যান । নামটা জগদ্ব্যাপী এবং স্কুলের জিওগ্রাফি বইতেও ছিল । দেশে বসে আঙুল চোষবার সময় গ্রাণ্ডময় অনেক ইমেল পেতাম । তখনই মনে মনে ঠিক করে রেখেছিলাম আমি কেমন মেল লিখব চান্স পেলে, কোটেশনও । কুড়ি হাজার মাইল বেয়ে যখন দুশো মাইলের ভিতর এসে পড়েছি, তখন তো আর হাতের গ্রাণ্ড পায়ে ঠেলা যায় না ।

    তক্কে তক্কে থাকতাম প্রথম থেকেই । একথা সেকথার পর ধাঁ করে বলতাম, গ্রাণ্ড ক্যানিয়ন যাবেন, এই য়ুইকেণ্ডে ? পরস্মৈপদীর কারণ তখনও লাইসেন্স পাইনি, আর পেলেও অতদূর পথ একলা মোটর চাগানো সাহসে কুলোত না । আমার আকুতির ঢেলা গিয়ে পড়ত দু-ধরণের লোকের ঘাড়ে । একদল গেছেন, একদল যাননি । মল্যবিজয়ীরা বলতেন,
    -- ইট্স অ্যা কুল প্লেস ..... ।
    -- ফাণ্ডু বস্‌, ক্যামেরা নিয়ে যাস কিন্তু .... ।
    -- আমার সবকটা পয়েন্টই দেখা, আর কেউই দেখেনি সবকটা.... ।
    -- ক্যানিয়ন তো খানাখন্দ, আমার ভাল লেগেছে আইম্যাক্স থিয়েটার, আল্টিমেট গুরু ....।
    -- গ্রাণ্ড ক্যানিয়ন দেখেছি, কিন্তু লাস্‌ ভেগাস্‌ আরো ভাল, কি আলো .....।

    আর যাঁরা যাননি, আমার পাল্লায় পড়ে পাছে যেতে হয়, সেই ভয়ে বলতেন, -- গ্রাণ্ড ক্যানিয়ন, বড্ড ঠাণ্ডা না, আমার আবার সাইনাসটা হঠাৎ চাগড়ে উঠেছে । তাছাড়া কালই তো টিভিতে দেখলাম ক্যানিয়ন ট্যানিয়ন কি সব, ডিস্কভারিতে.... ।
    -- হোয়াট য়ুইল য়ু সী ইন দ্য গ্রাণ্ড ক্যানিয়ন, ইট ইজ জাস্ট অ্যা হোল, হা: হা: হা: ।
    বক্তা সমর্থ যুবক, যাকে বলে ভিরাইল, নিজের রসিকতায় কুটপাট । আশপাশ দেখে আমিও দাঁত কেলাব কিনা ভাবছি, এমন সময় বামাকন্ঠে ,
    -- সো য়ু ওয়ান্ট টু সী অ্যা হোল ?

    আড় চোখে বক্তিকে দেখে বিনা জাবনায় বিষম লাগল । ভারত থেকেই আলাপ, ওধারে জিতেন্দ্রিয়তার নড়চড় দেখিনি, এমন ইতর ইয়ার্কিতে নাকও সিঁটকোতেন না, আর এধারে পাখোয়াজে বোল তুলছেন । একি উত্তরণ ! রোমাঞ্চিত হলাম, এ দেশের জল হাওয়ার কি গুণ, মূষিককে মানুষ বানায়, আর মানুষীকে স্ট্যাচু অফ্‌ লিবার্টি !

    মার্কিন পৃষ্ঠে পদাঘাতের দিন পনেরোর মাথায় এক শনিবার ভোর ভোর, গ্রাণ্ড অভিযানের সূচনা । একটা তেজী গাড়িতে চেপে আমারা চারজন, তিনজন দেখিনি, একজন দেখেছেন, তিনিই পথিকৃৎ । লাদাই করা হল বিস্তর পোট্যাটো চিপ্স, সফট ড্রিংক এবং অন্যান্য মুখরোচক টুকিটাকি । সকলেই স্থিতপ্রজ্ঞ, আমরা হোল দেখতেই চলেছি, অ্যাণ্ড জাস্ট অ্যা হোল ।

    আই-১৭ ধরে উত্তর দিকে চলতে শুরু করলাম, এই প্রথম আমার ফ্রী-ওয়ে'র সাথে সংগত । আমাদের ধারণার হাই-ওয়ে'কে এ দেশে ফ্রী-ওয়ে বলা হয় । নামের মধ্যেও মার্কিন জাতিক দর্শন জ্বলজ্বলে । ফ্রী শব্দের মধ্যে যে আমার মুক্তি আলোয় আলোয় ভাব, এটা খুব পছন্দ শ্যামখুড়োর ।

    যাক, নামের ঠিকুজি ভুলে এবার ধামে আসা যাক । আই-১৭ একেবারে অশ্বমেধের ঘোড়া ছোটানোর রাস্তা । ঊর্ধ্ব ও অধোগতির জন্য দুদিকে ব্যবস্থা, এক এক সড়কে চারটে করে ভাগ, গতির নিরিখে । সর্বদক্ষিণে ঢিমোচ্চ, সর্ববামে দ্রুততম । ডানদিকের পথে চাপান, বাঁদিকে উতোর, এদেশের যা নিয়ম । আই অর্থে ইন্টারস্টেট, ১৭ সাংখ্যগণক । বেজোড় সংখ্যার রাস্তাগুলো উত্তর-দক্ষিণে ছোটে, জোড় সংখ্যার পূর্ব-পশ্চিমে । ফিনিক্সের আরেক প্রান্তে ছিল আই-১০ । খানিক তফাতে তফাতে ফ্রী-ওয়ে থেকে শাখা সড়ক বেরিয়েছে, এদের বলা হয় এক্সিট । মোমবাতিবন এমনিই এক এক্সিটের উপান্তে । ফ্রী-ওয়ের নাম আর এক্সিট নং বাত্লালেই দেশের যেকোনো অবস্থান জানা যাবে । ফ্রী-ওয়েতে ঢোকা ও বেরোনো কসরতের ব্যাপার, লেন চেঞ্জ করা যেন কান মুচড়ে এস্রাজের ঘাট তোলা । তবে একবার চলতে শুরু করলে স্রোতই টেনে নিয়ে যায়, মাথাটা ঠাণ্ডা রাখলেই হল । ফ্রী-ওয়েতে থেমে যাওয়া বা লেনের অনুপযুক্ত বেগে চলা বেদম অভব্যতা । খাওয়া দাওয়া আর প্রাকৃতিক প্রয়োজনের জন্য খানিক বাদে বাদে আছে ফুড এক্সিট, ফুড ও অন্যান্য ব্যবস্থা থাকে । গাড়ি বিগড়োলে রাস্তার ধারে জায়গা আছে, সেখানে ভিড়োতে হয়, তারপরে হাঁকাহাঁকি ।

    চারজনের মধ্যে আমারই শুধু লাইসেন্স নেই বলে রেহাই পেয়েছিলাম সারথ্যে । অন্য তিনজন পালা করে হাল ধরছিলেন । তাঁদের জীবনবীক্ষায় হয়ত পার্থক্য প্রচুর, তবে গাড়ি চালানোয় আশ্চর্য মিল । আশি থেকে একশো মাইলের তলে কেউ দর হাঁকছিলেন না । আমি সীট বেল্টে আষ্ঠেপৃষ্ঠে বেঁধে নিজেকে, প্রমাদ গুনে প্রায় শেষ করে ফেলেছিলাম । এই সীট বেল্ট বাঁধা নিয়ে আমি ছিলাম নিত্য রগড়ের খোরাক । অনেকেই মনে করতেন ওটা একটা কাপুরুষের কৌপীন । আর বলতেন, কিছু হবে না, আমেরিকা তো । তা সত্ত্বেও আমি বাঁধতাম । পরমবীরচক্র পেতে চাই খুবই, কিন্তু সেটা মরণোত্তর না হলেই ভালো ।

    তবে এত জোরে যে চলেছি, বুঝবার জো নেই । গাড়ির কাঁচ সব তোলা, ইঞ্জিনের বৃংহণও মৃদু, মনে হয় যেন দুলকি চালে হাওয়া খেতে বেরিয়েছি । আশেপাশেও একই গতি, তাই নিজেদের অগ্রগতি চোখে পড়ে না । রিলেটিভিটি ব্যাপারটা বোধহয় এটাই ; পদব্রজে ঘষ্টালে তবেই না মনে হয় , একটা মোটরকার গাড়োলের মতো গেল কেশে, অস্থির পেট্রোল ঝেড়ে ।

    আযরিজোনাস্কেপের দর্শন মিলল প্রথম । মরুভূমির প্রদেশ শুনেছিলাম, ভেবেছিলাম সাহারা বা নিদেনপক্ষে আমাদের থর'এর জাতভাই হবে, বালিয়াড়ির ছড়াছড়ি । কিন্তু রাস্তার দুধারে দেখি বিস্তীর্ণ সিকতা-সাগর, মাঝে মাঝে বেঁটে ঝোপঝাড়ের দাঁড়ি কমা ফুলস্টপ । এ ওষধিগুলোর মধ্যে রমণীয়ের ছিটেকণাও নেই, এদের সৃষ্টির সময় বোধহয় প্রজাপিতার হ্যাংওভার কাটেনি । তবে এরই মাঝে হঠাৎ হঠাৎ দুটো একটা ঢ্যাঙা ক্যাকটাস্‌, পার্শ্বিক তুচ্ছতা কেটে অমর্ত্যের দিকে বাড়ানো হাত যেন । আকার সবকটিরই একই, প্রকারও তদ্রুপ । হাত-পা গুলো যেন ড্রয়িং বোর্ডে ফেলে ফাঁদা হয়েছে, রঙ গাঢ় বর্ণহীন সবুজ । আযরিজোনার লোগো বা ধ্বজা হল এই একহারা ক্যাকটাস । আযরিজোনার নামের সাথে একটি ভণিতা সেঁটে থাকে অফিসিয়ালি, দ্য গ্রাণ্ড ক্যানিয়ন স্টেট । তবে লোগোর চটজলদি চমক হিসেবে গ্রাণ্ড ক্যানিয়ন তেমন সুবিধার নয, ছোট্ট কয়েক টানে আঁকাও দুস্কর, তাই ঢ্যাঙা ক্যাকটাসই নিশানা বনেন । সব গাড়ির নাম্বার প্লেটেও থাকে এই শ্রমণ বৃক্ষের ছবি ।

    চারপাশের মাটি পাথুরে নুড়ি বোঝাই, কর্ষণের প্রবল প্রতিপী । এমন মানবজমিন রইল পতিত আবাদ করলে ফলত সোনা, এ সে বান্দাই নয় । এসব গড়ানো মালভূমি, খাড়া খাড়া পাহাড় সবই রকি মাউন্টেনের পরিবারস্থ । নামের সার্থকতা সদা বিদ্যমান, পাথরের রাজসূয় এপাশে ওপাশে । গাড়ি চলছিল উটের পিঠের মত উঁচু নীচু পথে, অনেকটা চড়াইয়ের পরে হঠাতি সুললিত উত্রাই, ছেলেবেলার স্লিপস্মৃতি জেগে ওঠে ।

    এমন পারিপার্শ্বিক দেখিনি কখনও, বা হয়ত দেখেছি, সব দেখাই তো চোখে নয় । বাদামী বন্ধুরতার মধ্যে এক দুর্মর নির্বান্ধব ছোপ, ধারিনী ভ্রূকুটি যেন চারদিকের শত ইশারায় ।

    ফ্ল্যাগস্টাফের ধ্বজা দেখা গেল অচিরেই, ফিনিক্স থেকে একশ সত্তর মাইল চলে এসেছি চোখের নিমেষে । এমন মোটর ছোটনের ধকল কম নয়, খিদে পেয়েছিল চনচনে । অবশ্য আমার পরিশ্রম গাঢ় ছিল না, শুধুই পেছনের সীটে সেঁদিয়ে, এযই আস্তে, সামলে, মর্মের হ্রেষাধ্বনি । ম্যাকডোনাল্ডে থামা হল, হৃদয় ও উদরপূর্তির ঢালাও ব্যবস্থা, সাঁটিয়ে আবার যাত্রা । আমেরিকার বিস্তীর্ণ দুপারে অসংখ্য মানুষের জন্য সদা মজুত এইসব খাদ্যমন্দির । পাছে অন্নজলের হয় ঘোর অনটন, এই শঙ্কায় শ্যামখুড়ো আগেভাগেই চারপাশে বিছিয়ে দিয়েছেন মূর্গী মটন আর চাইলে হুইস্কি সোডাও । এবার তিন পার্ট টাইম সারথির মুখেই যাক্ষিক প্রশ্ন, পথ কি ? আমি আর যৌধিষ্ঠার্য্যে রিস্ক না নিয়ে বললাম, জিজ্ঞেস করলে হয় না, সামনেই তো ফ্ল্যাগস্টাফ চেম্বার অফ কমার্স ।

    দপ্তরে ঢোকা হল গাড়ি ভিড়িয়ে । দিকভ্রান্তির দায় আমার নয়, তাই এপাশ ওপাশ ঘোরাঘুরি করতে লাগলাম, তিনসঙ্গী জেরায় জেরবার করলেন দপ্তরীদের । প্রশ্ন সেই চিরন্তন, পথ কি ? উত্তর মিলল অবশ্য খানিক খেলো মাপের, পথ কোনটা । যাক তাই সই, সে যুগ তো আর নেই, কোথায় সেই মায়াসরোবর আর কোথায় তৃষ্ণাহত ভ্রাতৃকুল ।

    পথ পেয়ে খানিক আশ্বস্ত আমরা, হেঁটে এদিক ওদিক একটু ঘুরে নিলাম । চেম্বার অফ কমার্সের পিছন দিকটা হল ফ্ল্যাগস্টাফ স্টেশনের রেলের গুমটি ও সন্নিহিত প্ল্যাটফর্ম । রেল স্টেশন বলতে যে দৃশ্যটা মনে ভেসে ওঠে, সেই চা-কুলি-মালের চঁযা-ভঁযার সাথে কোনো মিল নেই । লাইনের ওপারে কয়েকটা দীর্ঘসূত্রী মালগাড়ির টুকরো, পৌঁছনোর প্রয়োজনে তেমন তাড়িত মনে হল না । রেলপথের ব্যবহার এদেশে পণ্যপারাপারের জন্য, তা সে বহুদিনই, জনারণ্যের যাত্রা বিমানপোতে । দূর থেকে ঝিকঝিক শুনেই এক বন্ধু লাফিয়ে উঠলেন, ট্রেন, ট্রেন । ছোট্ট অপু-দূর্গা বোধহয় সবার মধ্যেই লুকিয়ে থাকে । দুলকি চালে একটা মালগাড়ি পাশ হয়ে গেল, বন্ধু তার সামনে দাঁড়িয়ে ছবি তুলিয়ে নিলেন, বললেন, ওপরের ফ্ল্যাগস্টাফ লেখাটা যেন আসে ।

    ফ্ল্যাগস্টাফে অনেক সোজা ও বাঁকা রাস্তার মিলন । যেকোনো একটা বেয়ে চললেই দুরন্ত দ্রষ্টব্য দুধারে । চেম্বার অফ কমার্সের পথিকৃত্রা বাত্লালেন অনেক দেখবার জিনিস, গ্রাণ্ড ক্যানিয়নের উপরি, মিটিওরাইট ক্রেটার, ভলক্যানিক ক্রেটার, লাওয়েল ল্যাব ইত্যাদি । রাশিকৃত ম্যাপ আর কাঁডিকৃত. প্রেরণা নিয়ে চড়তে শুরু করা গেল কাছের একটা পাহাড়ে, অবশ্যই পায়ে হেঁটে নয় । বেশ খানিকের হাঁসফাঁস চড়াইয়ের পরে পৌঁছলাম টিলার চূড়ায়, অনেকটা জায়গা নিয়ে সেখানে সমতল বাগান । একপাশে ছড়ানো ছেটানো একতলা বাড়ি কখানা, অন্য ধারে ঘন পাইনের বন । সব থেকে নজর কাড়ছে বাড়িগুলোর মধ্যে একটা প্রকাণ্ড গম্বুজ গোছের ব্যবস্থা, টেলিস্কোপের আস্তাবল বোধহয় । দপ্তর বন্ধ, তবে বাইরে সাইনবোর্ড, এইখান থেকেই সৌরজগতের ছোকরাতম গ্রহ, প্লুটোকে খঁংউজে পাওয়া যায় । আরো লেখা, সেই শুভাদৃষ্টের দিনক্ষণের ছক আর আবিষ্কর্তার নামে দূরবীক্ষণ গবেষণাগারের নামকরণের গল্প । এই হল লাওয়েল অবজারভেটরি ।


    জ্যোতিষ্ক-সন্ধানের ঠেকরানো দ্যুতিতে নিজেদেরও বেশ আলো আলো লাগছিল, তবে তখন কিন্তু আমাকে টানছিল আরও মামুলি একটা কিছু । যে ঘন পাইনের বনের কথা বলেছি, তার রঙ গভীর সবুজ, আর বনানীর মেঝে বিছিয়ে মেদুর সাদার আস্তরণ । এক লাফে আমি তুষারে গালিচায় গড়াগড়ি । দুই সহযাত্রী তখন তর্ক জুড়েছেন প্লুটোর কক্ষপথের আকৃতি নিয়ে । পিছনের গম্বুজে নির্মোহ সুস্মিতি, বালকের বালখিল্য দেখে ।


    বরফের ভিতর যেটা আছে, তার সাড়া ওঠে প্রায় পঞ্চ-ইন্দ্রিয়েই । রবার্ট ফ্রস্ট হঠাৎ বেঁচে উঠলেন কোন সুদূর পাঠ্যের পাতা থেকে, ঘধধরুয ছশং ত্ধটংত্ষ্‌ রুছশূ ছত্ররু রুংংংঋ, ঝ চ্ছটং ংঋশধস্ঠযংয ঞধ ংঊংংংঋ ছত্ররু স্ঠত্‌ংয ঞধ ভধ ঢংংঈধশং ঝ যত্‌ংংংঋ, স্ঠত্‌ংয ঞধ ভধ ঢংংঈধশং ঝ যত্‌ংংংঋ..... চারপাশে ওঠে ঘন বনানীর সুর, নিদ্রা এখনো লক্ষ যোজন দূর, লক্ষ যোজন দূর । কোথায় যেন পড়েছিলাম, জওহরলাল নেহরুর ডায়রিতে পাওয়া গিয়েছিল ফ্রস্টের এই দুলিয়ে দেওয়া ছত্রগুলি । মৃত্যুর আগের রাত্রে লেখা । কোন একটা পরাস্ত প্রতিশ্রুতি, মনটা মজিয়ে দিয়ে গেল, ভাবলাম, শুধু আসন পাতা হল আমার সারাটা দিন ধরে, ঘরে হয়নি প্রদীপ জ্বালা...। খানিক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে বরফকে তেলোয় চেখে দেখতে লাগলাম, শ্বেতশুভ্র নবীন নয়, ধূলো মাটিতে খানিক ম্লান, তবে মলিন নয় । পাইন গাছগুলোর খাড়া নির্লিপ্তি, এমন বরফ জমা সারা হলে নদী হয়ে গলবে, ওদের ঢের দেখা আছে ।

    বরফের রাশি রাশি ভারা ভারা'রসাথে আসল আলাপ জমেছিল আরো কদিন পরে, সে গল্প পরে ।

    মানুষকে বিশ্বকর্মা ইন্দ্রিয় দিয়েছেন, তবে ফিল্টার গোছের কিছুই দেননি, যা এমনকি সিগারেটেও আবশ্যক । পাইনবনে দাঁড়িয়ে আমার চোরা-গোপ্তা কবিত্বের মাঝে কান ঝালাপালা হচ্ছিল এক সহকর্মীর আবৃত্তিতে । চেঁচিয়ে, সুর করে পড়ছিলেন, সাইনবোর্ডের যা কিছু পঠিতব্য, অনেকটা দাশুরায়ের পাঁচালির ঢঙে । জানলাম টেলিস্কোপ সর্বসাধারণের দেখার জন্য (ভিতর দিয়ে), খোলা হয় রোজ সন্ধেতে, সময়ের কড়াকড়ি উল্লিখিত । আসলে দিবাকর তো বড্ড কড়া, দিনের বেলা আকাশে চালান মনোপলির দুর্মুষ । তাই টেলিস্কোপগুলো, হোক না যতই লাওয়েলীয়, তখন শুধুই গম্বুজসার । নিশানাথ নরম মেজাজের, তিনিও জ্বলেন আবার স্যাঙাত্দেরও চান্স দেন । আর তখনই না টেলিস্কোপের কেরামতি । কি আর করা, এবারের মত লগ্নভ্রষ্টার লেবেল নিয়েই ফিরতে হল । প্রতিজ্ঞা রইল, পরের বার নক্ষত্রলোককে দেখে নেব ।

    দিন গড়িয়ে চলেছে, সভা হল আগামী গন্তব্য নিয়ে । গ্রাণ্ড ক্যানিয়নের দিকে নাক বরাবর রাস্তাটাই ধরা যাক এবার, এমনই মতামতের জোর, পথে ভলক্যানিক ক্রেটার দেখে নিলেই হবে । আমি মিনমিন করে মিটিওরাইট ক্রেটারের পক্ষে ওকালতি করতে গিয়ে তাড়া খেলাম । ফ্রন্টসীট, ব্যাকসীট, কোনো ড্রাইভিংই আমার নয়, অতএব সারথিরাই শিরোধার্য । ছেলে ভুলিয়ে ওঁরা বললেন, মিটিওরাইট তো বিরাট ব্যাপার, ওটা ঠিক চোট পায় হয় না । পরের বার নিশ্চয় । উল্কার প্রতি টানটা আমার ঠিক স্বাগতিক ছিল না, অন্য টানের টানে, তাই বাজল । তাতে আসব বাদে । ।

    -- "ঢিপির গা'টায় মনে হল বেশ করে কে যেন কালি লেপেছে ।
    একেবারে রীতিমতো কালাপাহাড় । "
    খানিক পরে একটা টিলার পাদুকায় গাড়ি ভিড়ল, ঢিপির গা'টায় মনে হল বেশ করে কে যেন কালি লেপেছে । একেবারে রীতিমত কালাপাহড় । এই হল ভল্ক্যানিক মাউন্টেন । কাছে গিযে দেখি যা চিমনির কালি মনে হচ্ছিল তা আসলে অসংখ্য ছোট বড় পাথরের টুকরো, গাঢ় কালচে রঙের । চোখের কাছেই সাইনবোর্ড, দাবী অনুযায়ী এইসব পাথরের টুকরো নাকি আসলে জমাট বাঁধা লাভাখণ্ড । পাহাড়ের আগায় গহবর কেটে কত অযুতাব্দ আগে ফেটে বেরিয়েছিল ধরার উষ্মা । তারপরে ত্রক্রমশ: বহ্নি চঁংউয়ে বেরিয়ে সৃজিত হয়েছে এই ঢিপি, ছোট একটা পাহাড়ের সমান ।

    অত:কিম নিয়ে গোল বাধল, একদলের ইচ্ছা জ্বালাময়ী জালামুখ জিতে ফেরা, আরো খানিক বেয়ে উঠতে হয় তবে । অন্যদল বললেন, বেলা তো অনেক এগিয়েছে, গ্রাণ্ড পিছলে যায় যে । গ্রাণ্ডীয়রা সাবধান করলেন, আগ্নেওগিরিদের বিশ্বাস নেই, হঠাৎ জেগে উঠে যা তা করতে পারেন । আগ্নেওদেরও যুক্তি খাঁটি, ছয় ডলার দিয়েছি গেটে, তুলতে হবে না ?

    এই দুয়ারে ডলার দক্ষিণা, মার্কিনিয়ানার আরেক সার্বিক উপসর্গ । দর্শনীয় প্রকৃতিকে খাবলা করে বেঁটে দেওয়া হয়েছে ঠিকাদারদের মধ্যে । এঁরা বেড়া দিয়ে বাঁধেন নিজের এলাকা, দ্রষ্টব্যের ঠিকুজী কুষ্ঠী লিখে বিরাট বোর্ড টাঙান, জল, জলযোগ, সভ্য টয়েলেট, ইত্যাদি সবেরই দায়িত্ব এঁদের । বিনিময়ে আগমন শুল্ক ধার্য হয় সব দর্শকের জন্য । দ্রাষ্ট্যবিক সংরক্ষণের দায় ঠিকাদাররাই নেন, বলাই বাহুল্য ব্যবসার স্বার্থেই । ভল্ক্যানিক মাউন্টেনে ঢোকার মুখেই ব্যাকুল আবেদন ছিল, পাথর নুড়ি না তুলে আনার, য়্যজ্‌ মেমেন্টো । আকুতির গাণিতিক কৈফিয়তও বেজায়, দিনে অমুক পর্যটক হারে তমুক সংখ্যক প্রস্তর হাতালে যে বাইশ দিন তেরো ঘন্টা তিপ্পান্ন মিনিট চার সেকেণ্ডে পাহাড় সাফ হয়ে যাবে । তবে মোক্ষম দাওয়াইটা শেষে, পার গেঁড়ানো নুড়ি ডলার পঞ্চাশ জরিমানা, সাইজের সাথে ফাইনও বাড়বে চক্রবৃদ্ধিহারে, সারভেলান্স এমপ্লয়েড, অতএব ....। একজনের কথা মনে করে একটা পাথরের টুকরো নেব ভাবছিলাম । কত আদি অনাদির গল্প তিনি বের করতে পারতেন ঐ নুড়ি নিংড়ে, সেই সুবাদে আমার দরটাও বাড়ত হয়ত, ওঁর কাছে । তবে সাহসে কুলোলো না, ডলারের দাঁড়িপাল্লায় চান্স নেওয়া যায় না, শেষে যদি পঞ্চাশের দিকেই হেলে যায় তাহলে নাকাল হতে হবে । তার থেকে বরং পাথরের গল্পই করব । কথায় চিঁড়ে ভেজানোয় ইন্ভেস্টমেন্ট কম ।

    ভগবানের কারিকুরিতেও এমন এন্ট্রি ফী খসানো, প্রথম দিকে কামড়াতো । পরে সয়ে গিয়েছিল, দেয়ার ইজ্‌ নাথিং কল্ড্‌ অ্যা ফ্রী লাঞ্চ । আমাদের ওধারে তো প্রাকৃতিক, মানুষিক সব দ্রষ্টব্যই হরির লুটের বাতাসা, তাই দর্শকের হাতের কাজও ছিটিয়ে থাকে সবখানে । নব্বই সালে দেখেছিলাম তাজমহলের পিছনের দেওয়ালে ব্লেড দিয়ে ঘসে এক যুবক প্রেমিকার নাম লিখবার চেষ্টা করছেন, সাথে বাণ-বিদীর্ণ হৃদছবি । এতদিনে হয়ত আই লাভ ইউ টিউ অবধি পৌঁছে গেছেন । টঁযাক না টাটালে তো আর দাম বোঝা যায় না ।

    আগ্নিক চূড়া আর গ্র্যাণ্ডের ভিতর বিবাদটা মিটে গেল শিগ্গিরিই । হোল'ই যখন লক্ষ্য তখন অন্য উপ বা অপলক্ষ্যদের দাবড়ানো সহজ হয় । এবার সটান ধাওয়া গ্র্যাণ্ডের দিকে, একশো কুড়ি মাইল ঈশান বেয়ে । মধ্যাহ্ন সুর্য্যে ধুয়ে যাচ্ছে দিক্বিদিক্‌, আকাশের নি:সীম নীল নগ্নতায় একটুকু মেঘের আব্রু নেই ।

    কোথাও আমার হারিয়ে যাওয়ার নেই মানা, এটা নিশ্চয় মানেন মার্কিনরা, ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যের চাড়ে, তবে হারানোর ভয় ভীষণ এখানে সকলের । প্রায় সব গাড়িতেই জোতা থাকে এক যন্তর, নেভার লস্ট গোছের আশ্বাসী নাম । একটা ছোট্ট স্ক্রীণ, কয়েকটা বোতাম, আবার কথাও বলতে পারেন । গন্তব্যের নাম জানিয়ে দিলে পথ নির্দেশ ভেসে উঠবে পর্দায়, মাঝে মাঝে বাত্লানোয়ও হবে কর্কশ গলায় । গ্রহ তারার সঙ্গে এঁদের লাইন করা থাকে, ওঁরাই ওপর থেকে দেখে হদিস প্রম্প্ট করেন । আমার প্রথম থেকেই গোঁ চেপেছিল, এই সবজান্তাকে নাকাল করব । একবার যখন বাঁদিকে ঘোরার ছক, বলে উঠলাম এযাই ডানদিকে ঘোরা তো । যন্ত্রকে হ্যাটা করার তালটা ছোঁয়াচে, স্থিতধি সারথিও টলে গেলেন, স্টিয়ারিং'এ ডাইনে মোচড় লাগল । অমনি খঁযাক করে যান্ত্রব খিস্তি, উজবুক, চোখের মাথা খেয়েছিস । নিস্তার পাওয়া সহজ নয় । তবে পরে একবার ব্যাটাকে জোর জব্দ করেছিলাম । মোমবাতিবন থেকে বেরিয়েই বললাম , কোলকাতা, বানান করে করে, কে-ও-এল-কে-এ-টি-এ । খানিক্ষণ আমতা আমতা করে পথ-প্রদর্শক বললেন, সরি ডেস্টিনেশন নট ফাউণ্ড । তা অবশ্য বেচারার দোষ নেই, কোলকাতা সত্যিই সিলেবাসের বাইরে পড়েছিল, ওটা নাকি ভ্যালিড ফর নর্থ আমেরিকান কন্টিনেন্ট অনলি ।

    গ্রাণ্ড বিজয়ের মোটরমেধ ধেয়ে চলল, দিগন্ত ছাওয়া বিশাল প্রান্তরের আঁকাবাঁকা পথে । মাইলের পর মাইল চলেছি তো চলেইছি, একশো কুড়ি এবার যেন শেষ হয় না । ,মাঝে একটা সাইনবোর্ডের ধারে গাড়ি থামানো হল, আশে পাশে কিছু ভাঙাচোরা বাড়ি ঘর । লেখা ন্যাশনাল হেরিটেজ ইত্যাদি নানা ভণিতা, সঙ্গে সাল তারিখের খাতিয়ান । য়ুপুটাকি না কি একটা নাম, রেড ইণ্ডিয়ানদের গ্রাম ছিল, এখন প্রিজার্ভড্‌ ফর পস্টারিটি । প্র্রাচীনদের পগার পার করে তোষামুদে নোটিশ টাঙানো সোজা ব্যাপার । সভ্যতার থেকে সভ্যতার ধ্বংসস্তূপ তো আচার বা মোরব্বা বানিয়ে সংরক্ষণ সহজ । খচাখচ ছবি উঠল, একজন বান্ধব চারটে ফিল্ম রোল কিনেছিলেন ভোরে, তাই শেষ করবার ডেড্লাইন ছিল ।

    মহতী গিরিসঙ্কটের প্রথম আভাস পেলাম পথে, ত্রক্রমশ পাকদণ্ডী বেয়ে সমতল ছেড়ে ওঠা । মাটির রঙ লালচে, ঢিপি টিলারাও ভিড় করতে থাকেন । গাছপালা প্রায় নেই বললেই চলে, শুধুই কিছু গোঁয়ার ক্যাকটাস এদিকে ওদিকে । জনপদ অল্পই তবে মাঝে মধ্যে খোলা আকাশের তলে তাঁবু খাটিয়ে ইণ্ডিয়ান স্টোর্স্‌, কোথাও না'র ঠিক মাঝখানে । এক বন্ধুর দিশি রক্ত চলকে উঠল, বললেন, দেখেছো ভারতীয়দের ব্যবসাবোধ, টুরিস্ট স্পট দেখে ঠিক দোকান দিয়েছেন, নিশ্চয় খুব কাটতি । তবে ভাল করে লক্ষ্য করে খোলসা হল, কলম্বাসের সেই চিরন্তনী ভ্রম । দোকানগুলোতে ভরতি লোহিতইন্দোদের এথনিক টুকিটাকি, মহতী বিজয়ের স্মারক হিসেবে কিনে নিয়ে নেওয়ার নিমন্ত্রণও । আমার ইচ্ছা ছিল একটু থেমে দেখি, তেমন গলার হার বা কানের দুল পেলে নিয়ে যাব, সব সময়ে যে মনে ছিল তার আলঙ্কারিক প্রমাণ । তবে আর কারোরই উত্সাহ দেখলাম না, ইলেক্ট্রনিক চকমকি নয় বলেই হয়ত । আরেকজন বললেন, দুর এ সব'ই তো নেট'এ পাওয়া যায় ।

    পথের দুধারে পাহাড়ের প্র্রাচীর যেমন উঁচু হচ্ছিল তেমন খাদের স্পর্শও অতলমান । এদের মনে হল গ্রাণ্ডের আমাত্য আমলারা, মুযড সেট করার জন্য আগেই পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে । অচিরেই স্লোগানী তোরণ, ওয়েলকাম টু গ্রাণ্ড ক্যানিয়ন ন্যাশনাল পার্ক । এমন ন্যাশনাল পার্ক ছড়িযে আছে সারা দেশে । অনেক কুলীন পর্যটন স্থানেই এই লেবেল । ইয়েলোস্টোনের নাম শুনেছিলাম, গ্রাণ্ডও সেই তালিকায় জেনে সমীহ বাড়ল । অভ্যর্থনার পরেই ছোট্ট জরুরি কাজ, টিকিট কাউন্টার । মাথা পিছু ন'ডলার হারে শুল্ক, খাঁচার গায়েই বড় বড় করে দায়মোচন, হঠাৎ মেঘ করে দ্রষ্টব্যের দফা রফা হতে পারে, তার জন্য কতৃপক্ষ দায়ি নহেন । এঁদের কাজে কম্মে কোথাও ফোকর নেই, আঁটের সঙ্গে ঘাঁট সদাই শক্ত করে বাঁধা, তাই জন্যই হয়ত, ভাবছো হবে তুমি যা চাও, জগত্টাকে তুমি নাচাও । তবে এমন নোটিস বুদ্ধিমান মাত্রেই লাগান, সেই যেমন দেখেছিলাম দক্ষিণ কলকাতার আদিগঙ্গার পাড়ে এক মায়ালু সিনেমা হলে । শো শুরুর আগে মশারির মত স্ক্রীনে ফুটত ডিস্ক্লেমার, বানের জলে জুতা ভাসিয়া গেলে কতৃপক্ষ দায়ি নহেন । প্রকৃতির সাথে তো আর পাঞ্জা চলেনা ।

    ন'ডলারের বিনিময়ে মিলল টিকিট আর সঙ্গে ফাউ একগাদা ম্যাপ আর গ্র্যাণ্ডের ইতিহাস ভূগোলের বিস্তর চচ্চড়ি । কাউন্টার পেরিয়ে আমরা চললাম কোঁচানো রাস্তা ধরে, পাশে গাছের বেড়া, তাদের ডালে ডালে বরফের ছোপ । ঠাণ্ডাও বেড়েছে অনেক, বাতাসের চুম্বনে যথেষ্ট ধার । গ্রাণ্ড ক্যানিয়ন সমতল থেকে ঠিক কতটা উঁচু তা শোনালেন আমার পাশের বন্ধু, কাউন্টারে মেলা প্যাম্ফ্লেট পড়ে । আরও জানালেন, পাশের বন বেশ সভয়ারণ্য, এমন সব প্রাণীর বাস যাঁদের হৃদ্যতার খ্যাতি জগদ্ব্যাপী নয় । গাড়ির দরজা জানালা সব সাঁটতে বলে, সারথিকে বললাম, বাঘ ভালুকদের সামলে চলতে ।

    টিকিট কেনা থেকেই বিতণ্ডা চলছিল, ঠিক কোন তরিকায় মহতী বিজয় হবে । গ্রাণ্ড ক্যানিয়ন দুটি রিজ'এ ক্লাসিফাইড, উত্তর ও দক্ষিণ, মাঝে পরিখার উপর দিয়ে দুই পাড়ের দূরত্ব কয়েক মাইল, দাঁড়কাকী উড়ানের মাপে । দুটি রিজ ধরেই অনেকগুলি করে পর্যটন পথ বা ট্রেইল্স্‌, খেয়ালি নাম তাদের, হার্মিট'স্‌, রেড ইণ্ডিয়ান ইত্যাদি । এই ট্রেইল ধরে ধরে পয়েন্টস্‌, অর্থাৎ দর্শন বিন্দু, রেলিং টাঙানো পাটাতনে চড়ে ক্যানিয়ন পানের সুন্দর ব্যবস্থা । পয়েনটগুলোর নাম, ইয়াকি, মোহাভে প্রভৃতি, মেটে গন্ধে মাতোয়ারা । প্রতিটি ট্র্রেইল কয়েক মাইল করে লম্বা এবং সবকটিতেই বেশ কয়েকটি করে পয়েন্ট, ক্যানিয়নের কানা ঘেঁষে । ঘড়িতে বেলা সাড়ে তিনটে, আগামী ঘন্টা দুয়েকের মধ্যেই ন'ডলারের পর্য্যাপ্তি নিকিয়ে. নিতে হবে, এমনই জনমত । ঠিক হল সবার কাছের ট্রেইল ধরে যে কটা পয়েন্ট কভার করা যায়, হবে । প্রথম পয়েন্টে এক ঝাঁক গাড়ির মধ্যে পার্ক করে বেরোনো হল, জমাট বাঁধা ঠাণ্ডা, পুরোনো রেন কোটটা ধড়ে জড়িয়ে নিলাম, মুড়ো মুড়ে মাঙ্কি ক্যাপ ।

    প্রাচীন প্রাতরাশ পঞ্চভূতে মিলেছে কখন । চারজনের মধ্যেই তখন এক নিবিড় যোগ, লেলিহান ক্ষুধার । তাছাড়া ঠাণ্ডা ভীষণ, আমি ওয়াইজক্র্যাক ফাটালাম, ন' ডলারের মধ্যে সেন্ট্রাল হীটিং'টা পড়ছে না কেন, কেউই হাসলেন না, পটকা ফুস হয়ে গেল । মেজাজ খেঁচড়ানো, উদরের বাইরের পৃথিবীটা অর্থহীন ।

    গাড়ি থেকে শ'খানেক গজ দূরে পয়েন্টের বেদী, মাঝে গাছে ঘেরা সর্পিল পথ, দুপাশে চোখ চলে না । দাঁত চেপে চলতে লাগলাম, বনানীর মাঝে ছড়ানো জড়ানো মানবমিথুন কয়েক গুচ্ছ । অনেকেই এগিয়ে এলেন যৌগলিক স্ন্যাপ তুলে দেওয়ার আর্জিতে, আমি বললাম, ধ্যাৎ । পথের শেষে ব্যালকনিতে খুব ভিড়, ঝিন্চ্যাক ক্যামেরা হাতে এক জাপানিকে কনুই দিয়ে গঁংউতিয়ে প্রথম সারিতে আসা গেল । রেলিঙ'এর ছোঁয়া ছঁযাক করে উঠতেই সামনে তাকালাম । এক নিমেষে ধুয়ে দিল আমায় গ্রাণ্ড ক্যানিয়ন ।


    কোনো দ্রষ্টব্য দেখার আগেই তার ছবি আঁকা হয়ে থাকে আমাদের মনে । সে চিত্র খানিক শোনা, খানিক ভাবা আর খানিক টিভি দেখার রসায়ন । তাই প্রথম আসল দেখায় অবচেতনে চলে এই চোখের ছবি আর মনের ছবির তুলনা । আমার মনেও গ্রাণ্ড ক্যানিয়ন ছিল, প্রায় পুরোটাই ক্লাস সেভেনের ভূগোল বইয়ের চার কলাম সেই হাফটোনের ছাঁচে । মনে মনেই অনেক রোম্যান্সের রং চড়িয়েছিলাম সে ছবিতে । গ্রাণ্ড ক্যানিয়ন এক পলকেই মনে হল, এ না দেখে কখনই দেখা যায়না, স্বপ্নেও না । প্রথম অনুভূতিটা হয় এক অসহ্য বিস্ময়ের, এক অসাড় নতুনত্বের ।

    -- "যেন পাহাড়ের প্রত্যয় আর সাগরের সন্ধিত্সা
    মিলে গেছে এক শাশ্বতী মুহূর্তে"
    এমন কখনও বুঝিনি, ভাবিনি, দেখিনি, শুনিনি । যেন পাহাড়ের প্রত্যয় আর সাগরের সন্ধিত্সা মিলে গেছে এক শাশ্বতী মুহূর্তে -- একটি নিমেষ দাঁড়াল সরণি জুড়ে, থামিল কালের চিরচঞ্চল গতি ।

    তাকিয়ে রইলাম অপার নিসর্গবহরের দিকে -- একের পর এক পাহাড়ের কিনারা, একের পর এক খাঁড়ির গহবর । যেন অজস্র ঢেউ ফণা তুলে দাঁড়িয়ে আছে, দাঁড়িয়ে থাকবে সময়ের শুরু থেকে কালের ত্রক্রান্তি অবধি । সূর্য্য তখন সান্ধ্য বিশ্রামে ত্রক্রমশ এলিয়ে পড়ছে, তার কৌণিক রশ্মিতে ক্যানিয়নের কানা গনগনে গৈরিক । খাদের গহনে পাতালের পথ অদ্ভুত আহবানী, পেলব আঁধার জমাট বাঁধছে, থাকে শুধু অন্ধকার মুখোমুখি বসিবার । পাহাড়ের আগার জ্বলন্ত রং থেকে সরে এলে চোখে পড়ে আরেক বর্ণিল নক্সিকাঁথা, লাল নীল সবুজ সবেরই মেলা, কিন্তু কেউই আলাদ করে নেই । খাড়া গায়ে ইতস্তত ঝোপঝাড়, বরফ জমে গঁংউড়ো হয়ে লেগে আছে এখানে ওখানে ।

    -- "নীচে, বহু নীচে, সবুজ ফিতের মত কলোরাডো নদী,
    এই অতীন্দ্রিয় সৃষ্টির ভাষ্কর, নিজে প্রায় অদৃশ্য অন্তর্লীনা "
    নীচে, বহু নীচে, সবুজ ফিতের মত কলোরাডো নদী, এই অতীন্দ্রিয় সৃষ্টির ভাষ্কর, নিজে প্রায় অদৃশ্য অন্তর্লীনা -- আমি আপনি পড়ি আলোর পিছনে ।

    এ যেন এক সিম্ফনি । রৌদ্রকরোজ্জ্বল শিখর আর নিশুতি পরিখার সংঘাতের ঐকতান । আরও অসংখ্য মিশ্রণ, নানা সুরের আকুল ধারা মিলিয়ে দিয়ে আত্মহারা । মেজর কী নিশ্চয় মহাজাগতিক নির্লিপ্তি, মাইনর কী'দের অত সহজ দিশা মেলে না । অভিজিৎ হলে নিশ্চয়ই বলতেন , নয়ন আমার রূপের পুরে, সাধ মিটায়ে বেড়ায়ে ঘুরে, শ্রবণ আমার গভীর সুরে হয়েছে মগন ।

    অভিঘাতের প্রথম ধাক্কাটা সামলেই মনে এল এক কোমল বিচ্ছিন্নতা । যা দেখে আমি আজ এত উথাল পাথাল, তা তো ছিল ; শ্লোক আওড়ায় গেছে মৈত্রেয়ী কবে, রাজ্য জয় করে গেছে অমর আত্তিলা । আর থাকবেও ; যখন আমারে নি:শেষে পিষে, মিশে যাবে নিশ্চিহ্ন নাস্তিতে, একদিন স্বরচিত এ পৃথিবী মম । ত্রিকাল আর ত্রিলোকের অসংখ্য অক্ষরেখার কেন্দ্রবিন্দু যেন এটা, মহাকাল আর মহাদেশের সাগরসঙ্গম । কত প্রহর, কত প্রভঞ্জন পেরিয়ে নিসর্গের নিয়তির নিশ্চল সাক্ষ্যে আজও গ্রাণ্ড ক্যানিয়ন -- কত শুকতারা যে স্বপ্নে তাহার রেখে গেছে স্পর্শ, কত বসন্ত যে ঢেলেছে তায় অকারণের হর্ষ । নিজেকে যত্সামান্য লাগে, পরশুর ডেড্লাইন, তুচ্ছ ।

    এই নির্বেদের সাথেই আসে আরেক অনুভূতি । এই অকল্পিক রূপসৃষ্টি, শুধুই এক আমোঘ র্যানডম্নেসের ফসল, নেই কোনো মহাচেতন শিল্পীর স্পর্শ, মন মানতে চায় না । তবে এ স্রষ্টা আমাদের বাত্সল্য বাঁটা আটপৌরে ভগবান নন, তাঁর কাছে চলে না, আমার সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে'র আর্জি । চোখে সামনের দৃশ্যে যদি ধরা পড়ে কীর্তির দিগন্তিক মনোহারিতা, তেমনই মনেও ছঁংউয়ে যায় কর্তার অচল ঔদাস্য । শৈশবের কোন বিস্মৃত বারান্দায় বেজে উঠল অজান্তেই, নিত্য নিরঞ্জন, নিখিল কারণ, বিভু বিশ্ব নিকেতন / বিকার বিহীন, কামক্রোধ হীন, নির্বিশেষ সনাতন / অনাদি অক্ষর, পূর্ণ পরাত্পর, অন্তরাত্মা অগোচর / সর্বশক্তিমান, সর্বত্রসমান, ব্যাপ্ত সর্বচরাচর ।

    যাদের ভালবাসি, তাঁরা যারা দেখলেন না, আর দেখতে পেলেন না, মনে এলেন তাঁরা । যাইহোক, নদীতটসম কেবলি বৃথাই, প্রবাহ আঁকড়ি রাখিবারে চাই, এ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে লাভ নেই ।

    অ্যাগনসিজ্ম'এর বুলি কম কপচাই না, তার পরেও চলেছি কপচে, তবে সেই সময়টুকুর জন্য যে বিরাটের সান্নিধ্যে মন নত হয়েছিল, তার মীমাংসা আজও পাই নি । সেই বোধের কোনো বর্ণনা নেই, হয়ত আছে, আমার কাছে নেই । ইংরাজির ছগং শব্দ খানিক ছঁংউয়ে যায় হয়ত ।

    ১৯৫৬ সালে গ্রাণ্ড ক্যানিয়ন দেখে আর কে নারায়ণ লিখেছিলেন ঝঞ ঠয চ্‌ংশং ষ্ধণ্ণ ংঈংংৎ গঠঞচ্‌ ছত্র ণ্ণত্রঢংছশছঢত্‌ং ছভধত্রষ্‌, ছ স্ষ্যঞঠব স্ধধরু; ঞচ্‌ং ছত্স্ঠভচ্ঞষ্‌ ঞছূংয চ্ঠয ত্রছস্‌ং চ্‌ংশং. ণংশং ঠয ছ ংঋংশীধশস্ছত্রবং ঞচ্ছঞ ধটংশগচ্‌ংত্স্য ণ্ণয গঠঞচ্‌ ঠঞয স্ঠভচ্ঞ. . সত্যিই পালা বটে, হয়ত ইচ্ছা করেই ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে দুটো একটা, অবিশ্বাসীদের নাড়া লাগানোর জন্য ।

    ছবিও তুললাম কয়েকটা, তবে পরে দেখতে ও দেখাতে লজ্জা লেগেছিল । চোখের ফিল্ম মন, আর ক্যামেরার তো শুধুই কাগজ আর কেমিক্যাল । ছবিতে গ্রাণ্ড ক্যানিয়ন যেন কার্টুনে বিশ্বরূপ ।

    আরও চারটে পয়েন্ট দেখেছিলাম, প্রত্যেকটিতেই গ্রাণ্ড ক্যানিয়নের সাথে সংরাগ গাঢ় হল । মনে হচ্ছিল মাতৃ-বৈমাতৃ কোনো ভাষাই শিখিনি, না হলে এমন শব্দ হারাচ্ছি কেন । সত্যিই, নারায়ণের ভাষাতে "মচ্‌ং গধশরু ভশছত্ররু চ্ছয ত্রংটংশ চ্ছরু ছ ভশছত্ররুংশ ংঈণ্ণত্রবঞঠধত্র ঞধ ংঋংশীধশস্‌"

    ফেরার পথে গেটের ধারে বিরাট আইম্যাক্স প্রেক্ষাগৃহ, গ্রাণ্ড সম্বন্ধীয় একটা ছোট তথ্যছিত্র দেখানো হচ্ছে । ফিনিক্সে অনেকে দেখতে বলেছিলেন, ঢোকা হল । নতুন করে টিকিট, কেন জানি কেউ কোনো রা কাড়লেন না, এবার । কথাবার্তাও বেশ কমে গিয়েছিল, খাবার সময়তেও কেউ কথা বলেন নি খানিক আগে । পিএনিপসি, টীকা-টিপ্পনি সব বন্ধ । একটা ভাসা ভাসা বৈরাগ্যের বাতাবরণ ।

    শো'টা কিন্তু জব্বর । দেয়াল জোড়া বিরাট অবতল পর্দা, শব্দক্রিয়া দুলিয়ে দিয়ে যায় । বিষয় গ্রাণ্ড ক্যানিয়ন জয়ে মানুষের প্রয়াস, যুগে যুগে, কালে কালে । অসাধারণ ক্যামেরার কাজ, পরিখার অসীম তলায় নিয়ে গেল , সঙ্গে বিহবল জলোচ্ছাস । কত চেষ্টা, প্রকৃতিকে পোষ মানানোর, সেই আদিম কাল থেকে কত প্রাণপাত, কত অর্থশ্রাদ্ধ । সবেরই অনুপুঙ্খ রোমহর্ষক বিবরণী, কথকের অনবদ্য বাচনভঙ্গী । পঁচিশ মিনিটের রেশ রয়ে গেল কয়েক ঘন্টা, কান পাতলেই শুনছিলাম কলরাডোর কলময় তোয়াধ্বণি আর চোখে ক্যানিয়নের আঁধার অতল থেকে নিমেষে আলোয় উথ্থান ।

    তিনশো মাইল পথ উজিয়ে ফেরা হল প্রায় নি:শব্দে । মনে হল, প্রাণটাকে একটা শিখা ছঁংউয়ে গেল আজ । ফিনিক্সের মশাল মুখে পড়তেই স্বপ্ন গেল ভেঙে ।

    বিজনেসের বেসাতি বেড়ে চলে । রোজ যাওয়া আসা, শুধুই স্রোতে ভাসা নয়, নানা ডেড্লাইনের ভ্যাঙচানি লেগেই থাকে । কাজ নামিয়ে এক সন্ধ্যার স্বস্তি ও মস্তি, কিন্তু শেষ নাহি যে, শেষ কথা কে বলবে, পরের প্রাতে আবার নতুন মৃতরেখা, তারই দিকে ধাওয়া প্রাণপণে ।

    কদিন ধরে পাশের রাজ্য ক্যালিফোর্ণিয়া থেকে বিস্তর বিদ্যুত বিভ্রাটের খবর আসছিল । ঘড়ি ধরে নাকি পাওয়ার কাট চালু হয়েছে । এই নিয়ে মিডিয়া তোলপাড়, টিভিতে ঝানু টক্‌ শো ওয়ালারা সব বলছেন , হোয়াট আর য়ুই কামিং টু ? ইজ দিস্‌ অ্যা সিভিলাইজ্ড়্‌ নেশন ? কলকাতার লোডশেডিং'এর কাছে শৈশবের অনেক উজ্জ্বল স্বর্ণালি সন্ধ্যা খুইয়েছি, আমার মন্দ লাগছিল না এই রগড় দেখতে । এত ঠুনকো আপনাদের সভ্যতা, সুইচ টিপে আলো না জ্বললেই হাহাকার ? আলোর ব্যাপারে আপ্তবাক্য তো ঐ, য়্যণ্ড দেয়ার ওয়াজ লাইট, এটা ভুললে কি চলে ?

    একদিন সকালে অফিসে পৌঁছে দেখি লবি থৈ থৈ । বড়, মেজ, সেজো, ছোট সকলেরই ঘেঁষাঘেঁষি গুঞ্জন । একেবারেই সুসাম্য । ব্যাপারখানা কি ? দরজা খুলছে না । অফিসের সব দরজাই বন্ধ থাকে এমনিতে, প্রত্যেক কর্মীর কাছে থাকে নিজস্ব আযক্সেস কার্ড , সেই চাপাটি চাবি, খাঁজে ঢুকিয়ে খঁযাচ্‌ করলেই, তোমার দুয়ার খোলার ধ্বনি ঐ যে বাজে । সেদিন শুনলাম ধৈর্য্য ধরার আবেদন, প্রব্লেম উইল বি ফিক্স্ড, স্যুন । গুজব শোনা গেল, দ্বারীযন্ত্রগুলো নাকি চলে ক্যালিফর্ণিয়ার বিদ্যুত পোষণে । ওখানকার গ্রীড আজ একেবারেই ক্ষান্ত দিয়েছেন, তাই এই বিপত্তি । ব্যাপারটার গহন ব্যাখ্যা বুঝতে কোন কবের সেই বৈদ্যুতশাস্ত্রের তিলক চড়চড়িয়ে উঠল কপালে, আশপাশের কয়কজনকে বুঝিয়ে দিলাম, গ্রীড কোল্যাপ্স মে বি ডিউ টু মেনি রিজনস্‌, মোস্ট কমন বিইং ফ্রিকুয়েন্সী মিসম্যাচ । ওঁরা বললেন, হাহ । কেমন যেন ভয়ও হল, আধুনিক এই তারে বাঁধা ত্রক্রন্দসী, ওঅ্যার্ড ওঅ্যার্ল্ড, চাঁদের মত অলখ টানে, সবাই সবাইয়ের খপ্পরে । কোনদিন হয়ত গুজরাটের স্নানের জল পাওয়া যাবে না, গুয়াটেমালায় জঙ্গীমির যোগে । যুক্ত হওয়া তো জড়িয়েও যাওয়া । গোলযোগ মেটাতে শেষে দ্বারী হাটিয়ে দোর হাট হয়েছিল, দ্বার ভেঙে প্রাণে আসার ধকলটা নিতে হয়নি ।

    বড়দিনের সপ্তাহখানেক আগে থেকেই লোকলস্কর ফিকে হতে আরম্ভ করে, সবাই বাত্সরিক ছুটি জমিয়ে একটানে নিয়ে নেন এই সময়ে । ধ্বজাধারী আমরাই লড়ে যাচ্ছি ফেস্টিভ সিজ্নে, ত্রক্রমশ: বাড়ছে কাজের চাপ । ভ্যাকেশনে চড়ার আগে ঊর্দ্ধতন বলে যাচ্ছেন, প্লিজ ফীল ফ্রী টু কল মী অন মাই মোবাইল । আমাদের সঙ্কোচ কাটাতে অচিরে উনিই ফোন করে খবর নিচ্ছেন, সব ঠিকঠাক চলছে তো ?

    ক্রিস্টমাস য়ুইক শুরুর আগের শেষ ওয়ার্কিং ডে'তে দুপুরে ছিল বিরাট ভোজ । প্রসিদ্ধ সী-ফুড রেস্টোরেন্টে খাওয়াচ্ছেন দপ্তরের প্রধান । তিমি থেকে গুগলি, সবেরই আয়োজন, তবে সিন্ধুসারস নেই দেখলাম । বসে খাওয়া, একেকটি করে পদ আসছে মহা সমারোহে, সামনে পাইক বরকন্দাজ, পিছে তল্পিবাহক । বসা হয়েছে লম্বা টেবিলে, সকলেরই জায়গায় আগে থেকে নাম সাঁটা ছিল, চালে ডালে যাতে ঘাঁটে ভাল । আমার ঠিক পাশেই বসেছিলেন রজার উইনোস্কি । আমি ভাবলাম, হঁংউহ, অযোধ্যার লোকে যোদ্ধা হয়েছে । বললাম, পূর্ব য়ুরোপীয় ? বলেই বুঝলাম, বেয়াদবি । উনি একটু থেমে, প্রশান্ত স্মিতে বললেন, তিন পুরুষ হল এদিকে । ঠাকুর্দা চলে এসেছিলেন, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পরে পরেই, তখন সবে লৌহ যবনিকা জমাট বাঁধছে । এসব বলে বললেন, পাঞ্চ লাইনের ভঙ্গীতে, স্ত্রী আমেরিকান, তারপর চোখ টিপে, রিয়েল ।

    আশে পাশের সকলেরই ভারত সম্বন্ধীয় গভীর আগ্রহ উপচে পড়ছিল । ইয়োগা ও তার তুমুল গুণাগুণ, সকলেই দেখি ওয়াকিবহাল । আমার নিকটতম জাতভাই বললেন, আওয়ার স্ক্রিপচার্স আর অ্যাকচুয়ালি অ্যা ওয়ে অফ লাইফ, ভেডাস্‌, সহ্মিটাস্‌, য়ুপানিষাড্স । চারদিক থেকে ডাক উঠল , য়ু-উ-উ-পা-আ-আ-ন্‌-ই-ই-ষ্ষ্‌-আ-আ-আ-ড্ড্ড, শ্রদ্ধা চোঁওয়া সমস্বরে, নিম্নগ্রামে । যেন ঝাপসা গলায় ফার্সী কবে নি:শ্বাসে ফিস্ফাসে, যদি কুমড়ো পটাস হাসে । গুরু বলে চললেন, দেয়ার আর ফোর অফ দেম, য়ুপানিষাড্স । আমি বিষম খেলাম, অয়েস্টার খাচ্ছিলাম তো । ভাগ্য ভাল ভেডাস্‌'এর দিকে আর কথা বাঁকল না, জানি না কোন আশ্চর্য্য সাংখ্যপ্রমাণ মিলত, য়ুপানিষাড্স'এর উচ্চারণ বাগে আনতেই ওঁরা হেদিয়ে গেলেন । বক্তা কিন্তু যে সে লোক ছিলেন না, ওনার রুমমেটের সাক্ষ্যে, রোজ সকালে কৌপীন পরে গুরু টাইপের ছবির সামনে জপতেন, যাঁ হতে বাহিরে ছড়ায়ে পড়েছে পৃথিবী আকাশ তারা, ইত্যাদি । অবশ্যই মূল সংস্কৃতে । এনার স্ক্রিপচার্স জ্ঞানের জন্যই হয়ত, দারুণ লাক, লাস ভেগাস'এ গিয়ে একঘন্টায় পৌনে চার শ' জিতেছিলেন, ডলার, মোমবাতিবনের তত্কালীন রেকর্ড ।

    টেবিলের উল্টো দিকে বসেছেন এক মার্কিন যুবতী, কোলে গোল-গাল ভীষণ মিষ্টি শাবক, স্ট্র্যাপ লাগানো সীটে এলিয়ে মা'র বুকে মাথা রেখে স্বপ্নিল । আমি টেবিল টপকে হাত বাড়িয়ে গাল টিপতে গিয়ে কোকের গেলাস উল্টে যা'তা করলাম । অস্বস্তি কাটানোর জন্য অত:পর উনি নিজেই বললেন, পুত্রের বয়স আট মাস, সিঙ্গল মাদার, আজ ক্রেশ থেকে তাড়াতাড়ি ছাড়িয়ে নিয়ে এসেছেন, খেয়েই ছুটবেন কানেক্টিকাট, দয়িত অপেক্ষমান ।

    এইবার অবধারিত মোড় আলোচনার, ভারতের জয়েন্ট ফ্যামিলি । ওঁদের কাছে বড় বিস্ময়, ছাত একটাই মাথা এতগুলো, কেমন করে আর কেনই বা ? আমি চুপ করে শুনে গেলাম, উপনিষদজ্ঞের ভাষ্য, কেমন করে আমরা পরম যত্নে লালন করি বৃদ্ধদের, চরম হর্ষে পালন করি শিশুদের, সবই একসাথে একযোগে, ভীষণ ভাল লাগায়, বিকজ্‌ আওয়ার স্ক্রিপচার্স টীচ সো । শেষে সিদ্ধান্তির রেখায় বললেন, আওয়ার ফ্যামিলিজ্‌ আর এক্সটেণ্ডেড ফ্যামিলিস্‌ । বিদেশীরা সবাই বললেন, দ্যাট্স ওয়াণ্ডারফুল । শুধু বালকবক্ষে বিদেশিনীই ফুট কাটলেন, আই ওয়াণ্ডার হাও ইউ ম্যানেজ, আই কান্ট ইভ্ন লীভ উইথ মাই মাদার, বাট আই লাভ হার ভেরি মাচ ।

    আমরাও যে একেবারেই বনে বাদায় পড়ে নেই, এগোচ্ছি, তার প্রমাণ রাখলেন এক দেশজ সহকর্মীনী । বাচ্চাটির গাল টিপে (গেলাস না উল্টেই) বললেন, রিমাইণ্ডস্‌ মী অফ মাই ড'টার, নাইন মানথ্স ওল্ড । সী ইজ অ্যাট বম্বে, আই টক টু হার এভেরি ডে, সী ওয়েট্স ফর মাই কল । সবাই বললেন, হাউ কিউট । এই সুনীতাদেবীর পতি, ছিলেন শিকাগোতে, সে অনেকদিন হল, ক্রিস্টমাসের ছুটিতে ফিনিক্স উড়ে এলেন, দাম্পত্যের ব্যাকলগ খানিকটা টেনে দিয়ে গেলেন হয়ত ।

    ডিসেম্বার একুশ, রাত ন'টায় চড়লাম প্লেনে । ঘন্টা খানেক লাস ভেগাস ছঁংউয়ে নিউ ইয়র্ক । চড়বার আগে রঞ্জন বললেন টেলিফোনে, ভীষণ ঠাণ্ডা, বেরিয়ো না এয়ারপোর্ট থেকে, আমি কোট নিয়ে যাব । আমি বললাম, তুমি আবার কষ্ট করে..,আমার তো রেনকোট আছে । রঞ্জন বললেন, সাব জিরো, উইণ্ড চীল নিয়ে আরো কম, যা বলছি শোনো ।

  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments