ঢাকাতে প্রথম পোয়েট্রি কাগজটি দেখবার সঙ্গে সঙ্গে আমার বুদ্ধদেবের কবিতা পত্রিকার কথা মনে পড়েছিল । ভেবেছিলাম শিকাগোর পোয়েট্রি কে মডেল করেই হয়তো বা বুদ্ধদেবের কবিতা পত্রিকার যাত্রা শুরু । ভুল ভাঙিয়ে দিলেন বুদ্ধদেব নিজেই :
পরিচয়ের কোনো-এক বৈঠকে দেখেছিলাম অন্নদাশঙ্করের হাতে একটি ইংরেজি পত্রিকা -- চেহারা কিছুটা শেষ উনিশ-শতকী, ইঁট-রঙের মলাট থেকে বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে আছেন শেলি, লম্বা রোগা অক্ষরে আঁকা "পোইট্রি" তার শিরোনামা । আমি জানিনা সেটাই হ্যারিয়েট মনরো-স্থাপিত শিকাগোর "পোইট্রি" কিনা -- তখনো সেই বিখ্যাত পত্রিকাটির নাম শুনিনি । কিন্তু সেটাতেও ছিল শুধু কবিতা আর হয়তো কিঞ্চিৎ কবিতা-সংক্রান্ত গদ্য । নমুনাটি উল্টে-পাল্টে দেখে আমার মনের মধ্যে একটা উশকানি জাগলো । এরকম একটি কবিতাসর্বস্ব পত্রিকা বাংলায় কি বের করা যায় না ?( আমাদের কবিতাভবন, পৃ. ১০)
![]() |
![]() |
১৯১২ সালে যে পোয়েট্রি র অভ্যুদয়, প্রায় এক শতাব্দীর কাছাকাছি সময় পার করে দিয়েও তার প্রকাশ অব্যাহত আছে দেখে অবাক হই । এতো দীর্ঘদিন ধরে একটা পত্রিকার একটানা প্রকাশ পশ্চিমেও বিরল ঘটনা । ফ্রাঙ্ক লুথার মট পোয়েট্রি সম্পর্কে যে-কথা বলেছেন, বুদ্ধদেবের কবিতা পত্রিকা সম্পর্কেও একই কথা প্রযোজ্য : পোয়েট্রি কাগজ তুলে ধরে একটা দীর্ঘ সময়ে পরিব্যাপ্ত মার্কিন কবিতার ইতিহাস ; এ-কাগজ আবিষ্কার করে আমেরিকার অনেক প্রধান ও প্রতিভাবান কবিকে যাদের প্রত্যেকেরই কোনো না কোনো সময়ে এ-কাগজে আত্মপ্রকাশ ঘটে [ যশছত্রূ ত্ণ্ণঞচ্ংশ ংঔধঞঞ, ধৈংঞশষ্, ংই ণঠযঞধশষ্ ধী স্ংংইশঠবছত্র ংঔছভছজ়্ঠত্রংয ; ৫ ফ্ধত্য. (ঙছস্ঢশঠরুভং, ংঔছযয.: জংত্ংঊত্রছৃ শৈংযয ধী ণছশটছশরু লত্রঠটংশযঠঞষ্ শৈংযয, ১৯৬৮), ৫:২৪৪]. পোয়েট্রি র আবির্ভাব-মুহূর্তে যেসব কাগজে কবিতা বেরুতো তা হলো আটলান্টিক, হার্পারস ও স্ক্রাইবনারস -- কিন্তু সেসব কবিতা ছিল, হ্যারিয়েট মনরো-র ভাষায়, একেবারেই মলিন, ও নিতান্ত প্রথাগত । হ্যারিয়েট ব্যথিত ও পীড়িত বোধ করেন সাহিত্যের এ-পরিস্থিতিতে, কেন না তিনি ভালো করেই জানতেন যাদের কবিতা কাগজে ছাপা হয় কেবল তারাই আমেরিকার কবি নন ; তার বাইরেও অনেক নতুন কন্ঠস্বর এই বিশাল দেশের বহুস্থানে ছড়িয়ে আছে, যথাযথ আউটলেটের অভাবে যাদের আত্মপ্রকাশ হয় বিঘ্নিত অথবা বাধাগ্রস্ত । এ পোয়েটস লাইফ (১৯৩৮) নামক আত্মজীবনীতে হ্যারিয়েট, আত্মপ্রকাশের জন্যে নতুন কবিদের সেকালে কীরকম সংগ্রাম করতে হতো তার বিবরণ দেন । আধুনিক বাংলা কবিতার ক্ষেত্রে এই সংগ্রামের কথাটা অবশ্য আরো অনেক বেশি করে সত্য । আমাদের সৌভাগ্য এই যে আধুনিক কবিতার ক্ষেত্রে এই সংগ্রামের দায়িত্ব অসামান্যরকম উদার, মহৎ ও মেধাবী বুদ্ধদেব স্বেচ্ছায় নিজ স্কন্ধে গ্রহণ করেন । শুধু কি আধুনিক কবিতার জন্যে ? আধুনিক কবিদের সাহিত্যিক প্রতিষ্ঠার জন্যে তিনি যে লড়াই করেন তার তুলনা কোথায় ? মনে রাখতে হবে যে এসব লড়াইয়ের কারণে বুদ্ধদেবের ব্যক্তিগত ও সাহিত্যিক ইমেজ অনেকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় ।
![]() |
![]() |
কবিতাভবনের সান্ধ্য আড্ডায় আমাকে শুনতে হয় অনেক তর্ক যাতে আমার মন নি:সাড় হয়ে থাকে, সহ্য করতে হয় অনেক নিষ্ফল অশান্তি, মুখে একটি কুস্বাদ নিয়ে শুতে যাই কোনো-কোনো রাত্রে । কেউ কেউ আসেন ঝুড়ি-ভর্তি খবর নিয়ে যা না-জানলেও আমার দিব্যি চলে যেতো ; কোনো হিতৈষী আমাকে এক ঘন্টা ধ'রে শিক্ষা দেন কোনো তত্কালিক বিষয়ে যাতে আমার একফোঁটা উত্সাহ নেই । আমি পাই না সেই বাতাসের ছোঁওয়া যাতে অস্পষ্ট রেণু উড়ে বেড়ায়, সেই অর্ধালোক যেখানে কল্পনা খেলা করতে পারে -- সব যেন আঁটো, উগ্র, অত্যন্ত বেশি নিশ্চিত । যেন জুটে গেছে হাতের মুঠোয় কোনো আলাদীনের দীপ ; কোনো অব্যর্থ বিশ্বম্ভর মাদুলী -- এমনি সুরে কথা বলেন অনেকে ; সব সমস্যার সমাধান এবং সব প্রশ্নের জবাব নিয়ে তাঁরা তৈরি ।এই সময়টাকে বুদ্ধদেব দেখেন কবিতা ও সাহিত্যের এক দুর্যোগের কাল হিসেবে ; এসময় থেকেই "সাংবাদিকতায় সমাচ্ছন্ন" একধরনের আশাবাদী সাহিত্য ব্যাধির মতো বিস্তৃত হয় । "বন্ধুতায় ফাটল ধরলো অনিবার্যভাবে" বুদ্ধদেবের সঙ্গে অন্য লেখকদের ; "ঘটলো একের পর এক বিচ্ছেদ -- মন্থর ও মৃদু, আর কখনো বা রূঢ়ভাবে, অকস্মাত্" ; ডাকযোগে প্রশ্ন পাঠিয়ে তাঁকে জিগেশ করা হলো : "আপনি যে এখন বেঁচে আছেন তার কী প্রমাণ দিতে পারেন ?"
আমাদের কবিতাভবন, পৃ. ৩১
এভাবেই তাঁর বিরুদ্ধে শত্রুতার সূত্রপাত ; যার পিছনে নীচতা, ইতরামি, অকৃতজ্ঞতা ও সাহিত্যিক ঈর্ষা সবই বিদ্যমান । এ-পর্যায়ে কেউ কেউ তাঁকে রবীন্দ্রবিরোধি হিসেবে দাঁড় করিয়ে কৃতকার্য হয় । কিন্তু এত কিছুর পরও বুদ্ধদেবের সৃষ্টিশীলতায় কখনো ভাঁটা পড়েনি ; তাঁর আধুনিক সাহিত্যবোধ ও সংশ্লিষ্ট সকল প্রত্যয় অবিচলিত ছিল । বাংলা সাহিত্যের আধুনিকতার পর্বে বুদ্ধদেবের এই সাহিত্যিক অবস্থানের মধ্যে যে একটা বিপ্লব আছে, একটা রাজনীতি আছে (কালচারাল স্টাডিজের সমালোচকেরা শব্দটা যেভাবে ব্যবহার করেন) তা আজকের দিনে অন্তত আমাদের বুঝতে পারার কথা । আর তথাকথিত "কমিটমেন্টের" কথা যদি ওঠে, তাহলে বলতে হয় বুদ্ধদেবের মতো কমিটেড লেখক বাংলা সাহিত্যে এক রবীন্দ্রনাথকে বাদ দিলে আর দ্বিতীয়টি আছে ব'লে তো মনে হয় না । সাহিত্যে এই কমিটমেন্টের জন্যে বুদ্ধদেব বসুর জীবনে কি পরিমাণ ভোগান্তি হয়েছিল আমাদের কবিতাভবন বইটির শেষে মুদ্রিত কবির কনিষ্ঠা কন্যা দময়ন্তী বসু সিং-এর "সংযোজন" অংশটি পড়লেও বোঝা যায় ।
![]() |
বুদ্ধদেব বসুর বিরুদ্ধে ইর্ষাকাতর ছদ্মবেশী ভদ্রলোকদের আসল শত্রুতা শুরু হয় এ-সময় থেকেই । বুদ্ধদেব বসু যাতে বিদেশে না যেতে পারেন, সেজন্যে চতুর, ধূর্ত, বদমাশদের প্ররোচনায় তাঁর ছুটির আবেদন মঞ্জুর না করে তাঁকে পদত্যাগে বাধ্য করেন । ওদিকে অমৃতবাজার ও যুগান্তর-গোষ্ঠী তাঁর বিরুদ্ধে দিনের পর দিন কুত্সা রটাতে থাকে এই ব'লে যে বিদেশে ঘুরে ঘুরে আর রবীন্দ্রনাথের বিরুদ্ধে বক্তৃতা দিয়ে রোজগারের অভিনব পন্থা উদ্ভাবন করেছেন বুদ্ধদেব বসু । যাদবপুরের চাকরিতে বুদ্ধদেবকে কেন ইস্তফা দিতে হয়, তার সংক্ষিপ্ত বিবরণ দময়ন্তীর লেখায় পাই । দময়ন্তী তখন ইণ্ডিয়ানা য়ুনিভার্সিটিতে পড়ালেখা করছেন এবং তাঁর বিভাগীয় প্রধান ডক্টর ফ্রেনজ বুদ্ধদেব বসুকে একটা সেমিস্টার পড়ানোর আমন্ত্রণ জানিয়েছেন জেনে অত্যন্ত খুশি । যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের রেক্টর ত্রিগুণা সেন বিষয়টা শুরু থেকেই জানতেন এবং তাঁর সম্মতিক্রমেই বুদ্ধদেব বসু ইণ্ডিয়ানার আমন্ত্রণ গ্রহণ করেন । সবকিছু ঠিকঠাক হবার পর বুদ্ধদেব যখন নিয়মমতো ছুটির দরখাস্ত দেন, কর্তৃপক্ষ ছুটি দিতে রাজি হলেন না । আত্মসম্মান রক্ষার্থে বুদ্ধদেব বসু পদত্যাগ করেন । ছুটি না-মঞ্জুরের ছুতোয় বুদ্ধদেবকে "বিতাড়নই" ছিল চক্রান্তকারীদের লক্ষ্য এবং তাতে তারা সফল হয় । ইণ্ডিয়ানায় এসে (১৯৬৩) শিক্ষকতা করে যাওয়ার পর (ব্লুমিংটনে আমাদের প্রতিবেশি কলকাতার এক ভদ্রমহিলা অর্চনাদির কাছে শুনেছি, ইণ্ডিয়ানা য়ুনিভার্সিটির প্রধান লাইব্রেরিতে যে রবীন্দ্ররচনাবলী আছে, তা বুদ্ধদেব বসুরই উপহার)। কলকাতায় ফিরে চাকরিহীন বুদ্ধদেব সেই তাঁর আগের লেখালেখির জীবনে প্রত্যাবর্তন করেন । ভিতরে কোথাও তাঁর মন ভেঙে গিয়েছিল খুব । কিছুদিন পরে, ১৯৬৫ সালে, প্রায় তিন দশকের স্মৃতিবিজড়িত তাঁর অসম্ভব ভালোবাসার দু-শো-দুই রাসবিহারী অ্যাভিনিউর কবিতাভবন ছেড়ে দিয়ে যেতে হয় স্ত্রী প্রতিভা বসুর সদ্য তোলা নাকতলার বাড়িতে । কবিতা অবশ্য বন্ধ করে দেন তার আগেই, ১৯৬১-তে, কাগজের পঁচিশ বছর পূর্ণ হবার পর (১৯৩৫-১৯৬১)। নাকতলার বাড়িতে এসে নিমগ্ন হন মহাভারত-চর্চায় ; এবং একের পর এক লিখে চলেন কাব্যনাট্য, মহাভারতের কথা, স্মৃতি । বন্ধুবান্ধবদের আসাযাওয়া নাকতলার বাড়িতেও অব্যাহত, কিন্তু নাকতলা কোনোভাবেই আর কবিতাভবন হ'য়ে ওঠে না । কবিতা পত্রিকা নেই, কবিতাভবন নেই, কিন্তু বুদ্ধদেবের গদ্যের একটা অসাধারণ উত্কর্ষ ও পরিণতি তাঁর শেষবয়সের লেখায় পেয়ে গিয়ে আমরা কৃতজ্ঞ বোধ করি । বুদ্ধদেবের সাহিত্য ও শিল্পবোধের চরমোত্কর্ষ তাঁর এ-পর্যায়ের কাজে দ্রষ্টব্য । তাঁর কবি রবীন্দ্রনাথ (১৯৬৬), তপস্বী ও তরঙ্গিণী (১৯৬৬), অনাম্নী অঙ্গনা ও প্রথম পার্থ (১৯৭০), স্বাগতবিদায় ও অন্যান্য কবিতা (১৯৭১) ও মহাভারতের কথা (১৯৭৪) এ সময়কার শস্য । এ-সময়কার ঘটনা বুদ্ধদেব বসু তাঁর অসম্পূর্ণ লেখায় লিখে যেতে পারেননি । বুদ্ধদেব বসু কবিতা ও কবিতাভবনের সম্পূর্ণ ইতিহাস যে লিখে যেতে পারলেন না সেজন্যে দু:খবোধ আমাদের থেকে যাবেই ।
![]() |
![]() |
"পপুলার ম্যাগাজিন ও সংবাদপত্রে কবিতার নামে প্রতিদিন রাজ্যের যে রাবিশ অনবরত মুদ্রিত হতে দেখি, তার বিপরীতে ভালো কবিতা নিয়ে একখানা সুন্দর কাগজ করার ইচ্ছে থেকেই পোয়েট্রি -র জন্ম", আত্মজীবনীতে লিখেছেন মনরো [ণছশশঠংঞ ংঔধত্রশধং, ংই ধৈংঞ'য ত্ঠীং: নংটংত্রঞষ্ হৃংছশয ঠত্র ছ ঙচ্ছত্রভঠত্রভ ঘধশত্রু ; (ব্ংগ হৃধশূ; ংঔছবস্ঠত্ত্ছত্র, ১৯৩৮) ংঋ. ২৫৬] তবে কবিতার পাশাপাশি উত্কৃষ্ট গদ্য ছাপবার প্ল্যানও ছিল তাঁর । বুদ্ধদেবের কবিতা ও এর ব্যতিক্রম নয় -- কবিতা য় বুদ্ধদেবকে যেরকম অনেককিছু একহাতে লিখতে হত, মনরোকে ওরকম কোনো ঝামেলা পোহাতে হয়নি । এটা অবশ্য কেবল ঝামেলার প্রশ্ন নয় (ঝামেলা তো ছিলই -- সম্পাদকীয় থেকে শুরু করে, প্রবন্ধ-নিবন্ধ ছাড়াও গ্রন্থের প্রাপ্তিস্বীকার, নোটিশ, বইয়ের বিজ্ঞাপন -- নিজের এবং অন্যের -- সবই তো তিনি প্রায় এককভাবে করতেন ; তার উপর ছিল কাগজ এবং ছাপাখানার পয়সা জোগানোর দুশ্চিন্তা ।
![]() |
পোয়েট্রি র মটো ছিল, "মহৎ কবির জন্যে মহৎ পাঠক দরকার" (হুইটম্যান) -- এবং পোয়েট্রি র লক্ষ্য ছিল সেধরনের সংবেদনশীল এক পাঠকগোষ্ঠীর উদ্ভাবন । কিন্তু কেবল নতুন কবিদের প্রকাশের পথ উন্মুক্ত করা নয়, মনরো সমকালের প্রতিষ্ঠিত লেখকদের উত্কৃষ্ট লেখা ছাপানোর জন্যেও সমান উত্সাহী ছিলেন । অর্থাৎ পোয়েট্রি কে কেবল আধুনিক কবিতার মুখপত্র করে তোলা তাঁর লক্ষ্য ছিল না । বুদ্ধদেবও প্রবীণদের লেখা ছেপেছেন, কিন্তু তাঁর লক্ষ্য ছিল আধুনিক কবিতা (অর্থাৎ শুধু বিশেষ ধরনের বা ফর্মের কবিতা নয় তার পিছনে যে বিশেষরকমের একটা বোধ ও তত্ত্ব আছে তা-ও) ; এবং কবিতা সর্বার্থে তাই ছিল ।
যেমন শুরুতে, তেমনি এখনো, পোয়েট্রি র পৃষ্ঠপোষকতার জন্যে এগিয়ে আসেন অনেকেই । বিভিন্ন ব্যক্তির অনুদানের উপর নির্ভর করেই পোয়েট্রি র প্রতিষ্ঠা । এটা অবশ্য আমেরিকার ইতিহাসে মোটেও নতুন নয় । স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় তো বটেই, আমেরিকার শিক্ষা-সংস্কৃতির সকল উদ্যমের পৃষ্ঠপোষণায় সরকার নয়, আছে বিভিন্ন ব্যাক্তির অবদান ; যা রিপাবলিকের সূচনালগ্ন থেকেই ব্যতিক্রমহীনভাবে সত্য । সরকারের ভূমিকা এর কোনোটাতেই প্রায় নেই বললেই চলে । এদেশের সকল বড়ো. বড়ো. বিশ্ববিদ্যালয় বিভিন্ন ব্যক্তির অনুদানের উপর নির্ভরশীল -- সরকার থেকে যা আসে, বলা যায় উপহার হিসেবে, তা দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় দূরে থাকুক, একটা বিভাগের ছ'মাসের ব্যয়নির্বাহও অসম্ভব । পোয়েট্রি র বর্তমান সম্পাদক যাকে বলেছেন "প্রাইভেট ফিলানথ্রপি" [ঁধযংংঋচ্ ছৈশঠযঠ, "মচ্ং ঙছশং ছত্ররু যণ্ণত্ররুঠত্রভ ধী ংংঐভছযণ্ণয", মচ্ং ত্ঠঞঞত্ং ংঔছভছজ়্ঠত্রং ঠত্র স্ংংইশঠবছ: ংই ংঔধরুংশত্র ঈধবণ্ণস্ংত্রঞছশষ্ ণঠযঞধশষ্ ; ংরু. শ্ত্ত্ঠধঞঞ ত্রিরুংশযধত্র ছত্ররু ংঔছশষ্ ষঠত্রজ়্ঠং (হৃধত্রূংশয, বৃ.: ণ্ণৈযচ্বছশঞ শৈংযয, ১৯৭৮), ংঋ.২১৮], কাগজটির এতকাল ধ'রে টিকে থাকার রহস্য সেই ব্যক্তিগত অনুদানই । পোয়েট্রি তে এমনকি গোড়ার দিকেও যাঁরা লিখেছেন, তাঁরাও পারিশ্রমিক পেয়েছেন । বিনা পারিশ্রমিকে কাউকে কিছু লিখতে হয়নি । এ-নিয়ে মনরোর বেশ গর্বও ছিল -- এক জায়গায় লিখেছেন যে আমরা যে কবিদের উপযুক্ত সম্মানী দিই এবং সেদিক থেকে আমাদের কবিতার কাগজ যে একেবারেই ব্যতিক্রম তা অনেকে উল্লেখ করতে ভুলে যান দেখে অবাক হই ।
পোয়েট্রি র সুদীর্ঘ জীবনে সম্পাদক ও সহযোগী সম্পাদক হিসেবে এসেছেন অনেকেই যাঁদের কেউ কেউ লেখক হিসেবে এবং অন্তত একজন কবি হিসেবে -- যেমন কার্ল শাপিরো -- উল্লেখযোগ্য । ১৯১২-র অক্টোবরে প্রথম সংখ্যা ( কবিতা -র প্রথম সংখ্যাও বেরোয় অক্টোবর মাসে, ১৯৩৫ সালে ; সেদিনই বুদ্ধদেব বসুর প্রথম কন্যা মীনাক্ষী-র জন্ম হয়) বার হবার পর এজরা পাউণ্ড (প্রথম সংখ্যাতেই যাঁর "টু হুইসলার--অ্যামেরিকান" কবিতাটি ছাপা হয় ও বিতর্ক তোলে) ইংল্যাণ্ড থেকে চিঠি লিখে জানান যে ইউরোপ থেকে তিনি লেখাজোখা সংগ্রহ করে দিতে পারবেন । একই বছরের সেপ্টেম্বর মাস থেকে তিনি পোয়েট্রি র "বিদেশ প্রতিনিধি" নিযুক্ত হন । পাউণ্ড অবিলম্বে ইয়েটস ও রবীন্দ্রনাথের লেখা সংগ্রহ করে পাঠান । প্রথম বছরের (১৯১২) তৃতীয় সংখ্যাতেই ইয়েটসের কয়েকটি লিরিকের সঙ্গে বেরোয় রবীন্দ্রনাথের গীতাঞ্জলির ছ'টি কবিতা । ১৯১৩ সালে রবীন্দ্রনাথ নোবেল পুরষ্কার পেলে, আনন্দিত মনরো লেখেন :
ঝঞ যংংস্ংরু ঞধধ ভধধরু ঞধ ঢং ঞশণ্ণং ঞচ্ছঞ ধণ্ণশ ত্ঠঞঞত্ং স্ছভছজ়্ঠত্রং চ্ছরু ধীংঈঠবঠছত্ত্ষ্ `রুঠযবধটংশংরু'--ছঞ ত্ংছযঞ ঠত্র শ্ত্রভত্ঠযচ্--ঞচ্ঠয যিঠছত্র ংঋধংঞ গচ্ধযং ত্রছস্ং গছয ত্রধগ শংযধণ্ণত্ররুঠত্রভ ঞচ্শধণ্ণভচ্ধণ্ণঞ ঞচ্ং গধশত্রু.পোয়েট্রি যখন প্রতিষ্ঠালাভ করলো, পাউণ্ড উত্সাহ হারিয়ে ফেললেন এবং জড়িত হয়ে গেলেন অন্য একটি সাহিত্যকাগজ -- লিটল রিভিয়্যু র -- সঙ্গে । তবু, যেমন মনরো লিখে গেছেন তাঁর আত্মজীবনীতে, পাউণ্ড পোয়েট্রি তে কবিতা পাঠানো বন্ধ করেননি ; কবিতার বাইরেও অন্য লেখাজোখা দিয়ে গেছেন নিয়মিত (যেমন পোয়েট্রি তে প্রকাশিত কোনো লেখা বিষয়ে তাঁর অভিমত বা প্রতিক্রিয়া -- কখনো বা কোনো বইয়ের রিভিয়্যু)।ংই ধৈংঞ'য ত্ঠীং, ংঋ.৩৩২
শুরুর দিককার অর্থাভাব ও অন্যান্য সংকটের একটা কিনারা হয়ে এলে পর হ্যারিয়েট মনরো বিদেশভ্রমণে বেরিয়ে পড়েন । ইংল্যাণ্ডে গিয়ে পাউণ্ডের সঙ্গে দেখা করার পর (১৯২৩) তাঁর বিশ্বপর্যটনের সূচনা । মনরোর ভ্রমণের প্রভাব পোয়েট্রি তেও পড়ে -- কাগজটি হয়ে ওঠে সত্যিকার অর্থে আন্তর্জাতিক । উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা যেতে পারে তাঁর চীন ভ্রমণের পর পোয়েট্রি র বিশেষ চীন সংখ্যা (এপ্রিল ১৯৩৫) প্রকাশিত হয় যার মধ্যে শুধু ধ্রুপদী চীনা কবিতা নয়, ওখানকার সমকালীন নতুন ও উদীয়মান কবিরাও উথ্থাপিত হবার সুযোগ লাভ করেন । হ্যারিয়েটের অনুপস্থিতিতে পোয়েট্রি র চরিত্রে কিছুটা পরিবর্তন আসে -- কারো কারো মতে কিছুকালের জন্যে এর সাহিত্যমানের নিম্নগামিতা লক্ষ্যযোগ্য হয়ে ওঠে । ওদিকে পেরুর ইনকায় বেড়াংওর সময় হার্ট-অ্যাটাকে হ্যারিয়েট মারা যান । পোয়েট্রি র উত্তরকালের ইতিহাসে আমরা সম্পাদকের পর সম্পাদক বদল হতে দেখি । হ্যারিয়েটের মতো নিরাসক্ত নিরপেক্ষতা -- যা অনেকসময়ে তরুণ কবিদের বিরক্তির উদ্রেক করতো -- আর দেখা যায় না । যাঁরা সম্পাদক হিসেবে পরবর্তীতে আবির্ভূত হয়েছেন, তাদের কোনো না কোনো একটা মত ছিল, পক্ষপাত ছিল, এবং তার প্রতিফলন তাঁদের সম্পাদিত পোয়েট্রি তে অলক্ষণীয় থাকেনি । মনরোর পরে যাঁরা পোয়েট্রি র সম্পাদক হয়েছেন, তাঁদের মধ্যে কয়েকজনের নাম করতে পারি -- মর্টন যাবেল, জর্জ ডিলন, কার্ল শাপিরো, হেনরি র্যাগো, ডেরিল হাইন ও যোসেফ প্যারিসি । বলা বাহুল্য, এদের মধ্যে কার্ল শাপিরো সবচেয়ে খ্যাতিমান । শাপিরো সম্পাদক হন সে বছরেই যখন টি এস এলিয়ট ঘোষণা করেন যে " পোয়েট্রি আজ আর কেবলমাত্র একটি লিটল ম্যাগাজিন নয়, একটি প্রতিষ্ঠান" । কবি হওয়ার কারণে শাপিরো কাগজটিকে ঢেলে সাজাতে উদ্যোগী হন । পোয়েট্রি র দরজা সেসব লেখকদেরজন্যে উন্মুক্ত থাকা বাঙ্ছিত যাদের অবস্থান বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে এবং গোঁড়া প্রবীণেরা যাদের লেখায় অসন্তুষ্ট : এই ছিল তাঁর মত । আমার ধারণা, সূচনাকালীন পোয়েট্রি দিয়ে নয়, বুদ্ধদেবের কবিতা পত্রিকা সম্ভবত এসময়কার পোয়েট্রি দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিল বেশি (মীনাক্ষী দত্ত কবিতা র যে তিনটি নির্বাচিত সংকলন প্রকাশ করেন, তার দ্বিতীয় ও তৃতীয় খণ্ডে চোখ বুলালেও তা আমাদের চোখে পড়বে) । পঞ্চাশ দশকে কার্ল শাপিরো-সম্পাদিত পোয়েট্রি র একটা নতুনত্ব ছিল । এসময়ে পোয়েট্রি তে প্রকাশিত হন অডেন, জন বেরিম্যান, রবিনসন জেফার্স, পল গুডম্যান, ওয়ালেস স্টিভেন্সের মতো কবিরা । কার্ল শাপিরোর সম্পাদনাকাল অনেকধরনের বিতর্কের জনয়িতা । একবার তিনি উইলিয়াম কার্লোস উইলিয়মাসকে, কার্ল স্যাণ্ডবার্গ সম্পর্কে একটা প্রবন্ধ লেখার দায়িত্ব দেন ; স্যাণ্ডবার্গ ছিলেন শাপিরোর প্রিয় কবি এবং তাঁর ধারণা ছিল, উইলিয়ামসও অনুকূলেই লিখবেন । স্যাণ্ডবার্গ বিষয়ে উইলিয়ামসের মত ছিল একেবারেই বিপরীত এবং লেখাটি যখন পোয়েট্রি তে বেরোলো, স্যাণ্ডবার্গ এতোই ক্ষিপ্ত হন যে শাপিরোর সঙ্গে তিনি দীর্ঘদিনের সম্পর্ক ছিন্ন করেন । কনরাড এইকেনও ছিলেন শাপিরোর বন্ধু, কিন্তু তাঁর আত্মজীবনীর বিরূপ সমালোচনা পোয়েট্রি তে বার হবার পর সে-সম্পর্ক চুকে যায় । কনরাড এইকেন অবশ্য পোয়েট্রি র বিরুদ্ধে মামলা করার উদ্যোগ নেন, তার কারণ রিভিয়্যুকার ইচ্ছাকৃতভাবে বইয়ের অনেক উদ্ধৃতি বিকৃত করেছিলেন । পোয়েট্রি সেসব উদ্ধৃতি সঠিকভাবে ছাপতে রাজি হলে, কনরাড এইকেন আর মামলা করেননি । সাহিত্যের ইতিহাসে এসব অবশ্য নতুন ঘটনা নয় । কার্লশাপিরো ঝুঁকি গ্রহণে উত্সাহী ছিলেন, এক সাক্ষাত্কারে তাঁর পোয়েট্রি সম্পাদনার ইতিহাস বলতে গিয়ে, তিনি বলেন : "আমি কখনো কখনো এমন কবিদের বিশেষভাবে জায়গা দিয়েছি, যারা উত্তরকালে বিখ্যাত -- যেমন ফ্রাঙ্ক ও'হারা ও টমলিনসন ; কখনো আবার ছেপেছি অনেকের লেখা প্রথমবারের মতো, অর্থাৎ পোয়েট্রি তেই যারা প্রথম প্রকাশিত -- কারো কারো ক্ষেত্রে সেটাই প্রথম ও শেষ লেখা ।" এদিক থেকে বুদ্ধদেবের অভিজ্ঞতাও খুব ভিন্ন নয় । কবিতাভবনেই বুদ্ধদেব লিখেছেন যে তিনি এমন কারো কারো লেখাও ছেপেছেন, যাদেরকে ভুলবশত তাঁর খুব সম্ভাবনাময় মনে হয়েছিল যেমন সুরেশচন্দ্র সরকার, মুকুল ভট্টাচার্য কিংবা ছদ্মনামে সুস্মিতা সরকার, কিন্তু লেখালেখিতে পরে আর কখনো যাদের দেখা মেলেনি ।
যেমন আগে উল্লেখ করেছি, পোয়েট্রি র মূল উদ্দেশ্য ছিল ভালো কবিতা ছাপানো (যেমন মনরো স্পষ্ট করেই লিখেছেন, কোনো একটা বিশেষ কবিতার তত্ত্ব, স্কুল বা আন্দোলনের প্রতিনিধিত্ব অথবা অন্য কোনোভাবে তার মুখপত্র হ'য়ে ওঠা এর লক্ষ্য ছিল না)। আজকের দিনের সবচেয়ে ভালো কবিতাটি সংগ্রহ করে ছেপে দেওয়া ছিল আমাদের লক্ষ্য, আর কিছু নয় : মনরো বলেছেন । লিখেছেন, "আমরা জানতে চাই না কবিতার কোন তত্ত্বে তাঁর উত্সাহ, কোন ধরনের কবি বা কবিতার প্রতি তাঁর পক্ষপাত, কোন দেশের তিনি অধিবাসী, কোথায় তিনি বিলং করেন ।" মনরোর মৃত্যুর পরও সম্পাদকীয় নীতির এই উদারতা অব্যাহত থাকে । রবীন্দ্রনাথ ছাড়াও বুদ্ধদেব বসু তো বটেই আরো অনেক বাঙালি ও ভারতীয় কবির মূলে ইংরেজিতে লেখা কবিতা বা তাদের কবিতার ইংরেজি অনুবাদ পোয়েট্রি ছেপে দিতে দ্বিধা করেনি । এধরনের উদারতা সেই সময়ে তো বটেই, এখনো দুর্লভ ।
কোনো বিশেষ কাব্যান্দোলনের প্রতিনিধি ছিল না বটে, তবু একটা সময়ে, প্রথমদিকে, ইমেজিস্টদের কৈশোরে, প্রবীণেরা পোয়েট্রি কে ইমেজিজমের মুখপত্রই মনে করতেন । এর কারণ এ-কাগজে ইমেজিস্ট তরুণ কবিদের ত্রক্রমিক উপস্থিতি (পাউণ্ড, ফ্লিন্ট, টি ই হিউম, হিলডা ডোলিটলের লেখা বেরোয় এখানে)। দ্বিতীয়বর্ষে একই সংখ্যায় (মার্চ ১৯১৩) ইমেজিজমের উপর দু-দুটো লেখা -- যার একটি আবার পাউণ্ডের নিজের -- প্রকাশিত হলে অনেক প্রবীণ এবিষয়ে নি:সংশয় হন । কিন্তু পোয়েট্রি র সংখ্যাগুলোতে চোখ বুলিয়ে গেলে এবং এর বিবর্তন লক্ষ করলে আর যাই হোক একে ওরকম র্যাডিকাল মনে হয় না । তাছাড়া কবিতা নির্বাচন ও প্রত্যাখানের কোনো কোনো সিদ্ধান্তে মনরো রক্ষণশীলতারও পরিচয় দেন, যেমন তিনি ই. ই. কামিংসের মতো কবির কবিতা ছাপতে রাজি হননি । লিটল রিভিয়্যু এজন্যেই পোয়েট্রি কে রক্ষণশীলদের রক্ষাকবচ হিসেবে চিহ্নিত করে । পোয়েট্রি অবশ্যই তা ছিল না, তবে শুরুতে নানা বোধগম্য কারণে কাগজটি যথেষ্ট বিতর্ক কুড়োয় -- এবং তা রক্ষণশীলতার জন্যে নয় । যেমন কার্ল স্যাণ্ডবার্গের "শিকাগো" কবিতাটি যখন বেরোলো মার্চ ১৯১৪-তে, রক্ষনশীলদের ডায়াল পত্রিকা এর বিরুদ্ধে কটুক্তি করে । অনেকে, বিশেষত বামঘেঁষা কিছু লেখক, এ-বলেও সমালোচনা করেন যে পোয়েট্রি তে যা বেরোয় তার সামাজিক প্রাসঙ্গিকতা অকিঞ্চিত্কর । রক্ষণশীল নয়, পোয়েট্রি ছিল আধুনিকদেরই কাগজ, যা প্রবীণ রক্ষণশীলেরা শুরু থেকেই নির্ভুল আঁচ করতে পেরেছিলেন । ১৯১৫-সালের জুন মাসে টি এস এলিয়টের বিখ্যাত কবিতা "দি লাভ সং অফ জে আলফ্রেড প্রুফ্রক" পোয়েট্রি তেই বেরোয়, রক্ষণশীলেরা যার তুমুল সমালোচনা করে (একজন লেখেন কাব্যচর্চা কিভাবে প্যাথলজির উদাহরণ হতে পারে, তার দৃষ্টান্ত এই কবিতা !) ।
মনরোর সাহিত্যিক মনের গড়ন বহুলাংশেই বুদ্ধদেবীয় -- অর্থাৎ সাহিত্যের সামাজিক উপযোগে তিনি অবিশ্বাসী না-হলেও গভীর সংশয়ী ছিলেন । কবিতা গ্রহণ বা বর্জনকেই তিনি একমাত্র দায়িত্ব মনে করতেন না, সম্পাদক হিসেবে তিনি চিঠি লিখে নিজের মতামত অনুপুঙ্খভাবে জানাতেন । এদিক দিয়েও বুদ্ধদেবের সঙ্গে তাঁর গভীর মিল লক্ষ করার মতো । সবচেয়ে বড়ো. মিল বোধ হয় দু'জনের মনের ঔদার্যে, মুক্ততায় ; পরিগ্রহণের বিরল ও অকুন্ঠ ঔত্সুক্যে ; সাহিত্যের জন্যে দরদ ও সংস্কারমুক্ত ভালোবাসায় । একারণে ইমেজিস্টরা যেমন, তেমনি বামপন্থী কবিরাও এতে জায়গা পেয়েছিলেন : ১৯৩৬-সালে বেরোয় বাম সাহিত্যসংখ্যা ; ১৯৩২ সালে অ্যালেন টেট অতিথি সম্পাদক হয়ে সাউদার্ন লিটারেচরের জন্যে বিশেষসংখ্যা বার করার সুযোগ পান । এছাড়া "বছরের শ্রেষ্ঠ কবিতা"-র জন্যে মনরো পুরস্কারেরও প্রবর্তন করেন । আরো নানাধরণের পুরস্কারও প্রবর্তিত হয় পোয়েট্রি র উদ্যোগে -- এবং তা দেখেশুনে আমেরিকার বিক্ষুব্ধ সজনীকান্ত দাশেরা বললেন "টাকা পয়সা দিয়ে কবিতাকে কমার্শিয়াল করবার পাঁয়তাড়া ছাড়া এসবের আর কি মানে হতে পারে !"
রাজনীতিতে অনুত্সাহী হলেও, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় পোয়েট্রির পক্ষে নীরব থাকা সম্ভব ছিল না -- যুদ্ধ নিয়ে স্টিভেন্সের একগুচ্ছ কবিতা ছাড়াও আরো তিনজন কবির যুদ্ধবিষয়ক কবিতা ছাপা হয় : জয়েস কিলমের, আইজাক রোজেনবার্গ ও রুপার্ট ব্রুক -- তিনজনেই যুদ্ধক্ষেত্রে মারা যান । কবিতা বেরুনোর পর ব্রুকের ঠিকানায় সম্মানীয় চেক পাঠালে তা ফেরত আসে "প্রাপক মৃত" ব'লে । বুদ্ধদেবের বিরুদ্ধে অনেকের অভিযোগ ছিল যুদ্ধ ও সমকাল বিষয়ে তাঁর নিরাসক্তি । দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ অবশ্যই এক বড় ঘটনা, কিন্তু আমাদের জীবন ও ইতিহাসে এর এমন কোনো বড় প্রাসঙ্গিকতা নেই । একটা উদাহরণ দিই । পোয়েট্রিতে লিখেছেন এরকম প্রায় বত্রিশজন কবি যুদ্ধে যান -- দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে কোনো বাঙালি কবিকে কি যুদ্ধে যেতে হয়েছে ? হাঁ যুদ্ধের প্রভাব তবু পড়েছিল বাংলায় এবং বুদ্ধদেব যে সে-বিষয়ে অন্ধ ছিলেন না খোদ কবিতাভবনেই তার সাক্ষ্য আছে :
হঠাৎ একদিন শহর ছেয়ে গেল লাল আর খাকি কোর্তায়; তারা আমাদের রক্ষক এবং তাদেরই দাবি সর্বাগ্রগণ্য ; লেক থেকে এসপ্লানেড পর্যন্ত সর্বত্র তারা সঞ্চারমান, কোন দূর রানী-কুঠি না বাঁশধানির জঙ্গলেও তাদের ছাউনি পড়েছে । ... দোকানে সিনেমায় গিশগিশ করছে খাকি ... তারপর যুদ্ধ যখন ঘন, আমাদের সামাজিক বৃত্তে প্রবিষ্ট হ'তে লাগল একটি-দুটি ক'রে সামরিক পুরুষ । আমরা দেখলাম তারা সকলেই ছুটির ঘন্টায় মদে আর মেয়েমানুষে ভ'রে থাকে না । আমাদের পূর্বপরিচিত সুঘৃণিত টমি জাতীয় জীব নয় তারা ; অনেক আছে ভদ্র যুবা, তাদের মধ্যে আছে শিক্ষিত ছেলে, বইয়ের পড়ুয়া, শিল্পরসিক । ... যামিনী রায়ের স্টুডিও তীর্থস্থান হ'য়ে উঠেছে তাদের । খেয়াল ধ্রুপদের আসরে তাদের দেখা যায়, বাংলাভাষার কবিদের বিষয়ে তারা উত্সুক । ... এমনি ক'রে যুদ্ধের ধাক্কায়, ধ্বসে পড়েছিল শাদা এবং কালোর মধ্যে জাতিভেদ, যা গ'ড়ে তুলেছিলো এই ছেলেদেরই সাম্রাজ্য-দক্ষ পূর্বপুরুষেরা ভারতবর্ষে ... সুধীন্দ্র দত্তর বন্ধুমহলে পর-পর কয়েকটা বিয়ে হ'য়ে গেলো যার পাত্র ইংরেজ ও পাত্রী বাঙালি -- জব চার্নকের আমলের পরে বোধ হয় সেই প্রথম ।
আমাদের কবিতাভবন (পৃ. ৬৪-৬৬)
যুদ্ধের আরো অনেক গল্প বলেছেন বুদ্ধদেব -- তাঁর অবলোকন অব্যর্থ ; দু'তিন পৃষ্ঠায় ছবির মত উঠে এসেছে যুদ্ধ-সমকালীন কলকাতা । লিখেছেন কিভাবে এসময়ে তৈরি হতে থাকলো কবিতার নতুন নতুন পাঠক ; বিক্রি হ'য়ে গেল কবিতাভবনের পুরনো, বহুদিন প'ড়ে থাকা বই ও পত্রিকা ; বিদেশি সাহিত্যের সঙ্গে বাংলার তৈরি হল নতুন ধরনের একটা সম্পর্ক । "যেন কিঞ্চিৎ সচ্ছলতার স্বাদ পাচ্ছি আমিও, আমার ছাত্রজীবন ফুরোবার পর সেই প্রথম"-- লিখেছেন বুদ্ধদেব । লক্ষ করব যুদ্ধের সমর্থন-অসমর্থনের অবান্তর তর্ক (ফ্যাশিজমের বিরোধিতা করে লেখা বুদ্ধদেবের প্রবন্ধ মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়-সম্পাদিত স্পেনের গৃহযুদ্ধ : পঞ্চাশ বছর পরে বইতে আছে), বুদ্ধদেবের পর্যবেক্ষণের গুরুত্ব এর তীক্ষণতায়, তির্যকতায়, বাস্তবধর্মী স্বাভাবিকত্বে । আগে থেকে ঠিক করা কোনো মতাদর্শে দীক্ষিত না হওয়ার ফলেই তাঁর পক্ষে যুদ্ধের বহিরবয়বের অন্তরালে অন্যধরনের একটা সত্য, অন্যধরনের একটা বাস্তবতার অনুধাবন সম্ভবপর হয়েছিল । "যুদ্ধ খারাপ" "যুদ্ধ সর্বনেশে" -- এইসব ভাবালুতার মধ্যে না গিয়ে, মানবজাতির সংঘাত অন্য কোনো সম্ভবপরতার পরিসর তৈরি করে কিনা তা-ই হয়তো দেখবার ও বুঝবার চেষ্টা করেছিলেন তিনি । প্রকৃতিকে অতিক্রম করে নানাভাবে সংস্কৃতির ডাঙায় অবতীর্ণ হয় মানুষ -- তার সবই আমাদের বাঙ্ছিত নয় ; অকাম্য হলেও, যুদ্ধের ভিতর দিয়ে প্রকৃতির সঙ্গে বিচ্ছেদ ঘটে, আমাদের, এবং হয়ত-বা নিজেদের অজান্তেই সংস্কৃতির নতুন কোনো বৃত্ত, নবতর কোনো মানচিত্রের উথ্থান সম্ভবপর হয়ে ওঠে । বুদ্ধদেবের লেখা যাঁরা যত্ন করে পড়েছেন, আমার এই ভাষ্য তাঁদের কাছে খুব বেগানা ঠেকবে না ।আধুনিক কবিতার আন্দোলন কিংবা তার বিশেষ ধরনের প্রতিষ্ঠা বা প্রতিনিধিত্ব বুদ্ধদেবের মত মনরোর লক্ষ্য ছিল না বটে, তবু পোয়েট্রি র সার্থকতা কি শেষ পর্যন্ত তা-ই নয় ? কিন্তু আগে যেমন বলেছি, পোয়েট্রি কেবল মনরোর একার কাজ নয় -- এ আসলে বহুজনের মিলিত উদ্যম ও প্রয়াস । মনরোর মৃত্যুর পর সম্পাদকের পর সম্পাদক বদল হবার সূত্রে এর চরিত্রও বদলায় বিভিন্নসময়ে । হ্যারিয়েট মনরোকে ভাবীকাল খুব সম্ভবত পোয়েট্রি র প্রতিষ্ঠাতা হিসেবেই মনে রাখবে ; কবিতা, সাহিত্যচর্চা কিংবা আত্মজীবনীর জন্যে নয় । কিন্তু বুদ্ধদেব আমাদের প্রাত:স্মরণীয় শুধু সম্পাদনার কারণে নয়, তাঁর বিপুল বিচিত্র সাহিত্যকর্মের জন্যে । কবিতা ও কবিতাভবন বুদ্ধদেব বসুর নিজস্ব সৃষ্টি : তাঁর হাতে পত্রিকা সম্পাদনা কেবল একটা দায়িত্ব বা সামাজিক কর্ম থাকেনি, হ'য়ে উঠেছিল বাংলা সাহিত্যের আধুনিকতায় একজন মহৎ শিল্পীর নিবিড়, তুমুল, মগ্ন, অপরূপ সৃজনোদ্যমের উদ্ভাবনাময় আখ্যান ।