• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ২৯ | মার্চ ২০০৩ | প্রবন্ধ
    Share
  • নাম?? : দেবোপম ভট্টাচার্য

    বর্তমান প্রবন্ধের বিষয় একটি পত্রিকার দুটি স্মরণ সংখ্যা । সংখ্যাদুটি বেশ পুরোনো । স্মরণের পাত্র এমন দু’জন ব্যক্তি, যাঁদের নিয়ে আলোচনা এত পরিমাণ হয়েছে, যে শুধু তা নিয়েই বাংলা সাহিত্যের আরেকটি আলাদা শাখা তৈরি করা যায় । অতএব প্রথম প্রশ্ন হচ্ছে, এ প্রবন্ধের প্রয়োজন কী ? এতে আমি নতুন কী কথা বলব এবং এইসব পুরোনো রচনার সমালোচনা করে কী লাভ এর উত্তরে আমি দু-চার কথা ব’ংইল । সেটাই এ-লেখার ভূমিকা করা যেতে পারে ।

    আলোচ্য পত্রিকাটির নাম `কবিতা' । স্মারক সংখ্যাদুটির উদ্দিষ্ট ব্যক্তিরা যথাক্রমে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও জীবনানন্দ দাশ । সংখ্যাদুটির প্রথম প্রকাশ যথাক্রমে ১৯৪১ (পুন: প্রকাশ ২০০২, দাম একশ টাকা) ও ১৯৫৪ (পুন: প্রকাশ ১৯৯৮, দাম পঞ্চাশ টাকা), প্রকাশক : বিকল্প প্রকাশনী ।

    গোড়াতেই পরিষ্কার করে নেওয়া যাক, যে এ-প্রবন্ধে আমি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অথবা জীবনানন্দ দাশ সম্পর্কে বিশেষ কিছু বলব না । (অন্ততপক্ষে হাজার বার বলা কথার পুনরাবৃত্তি না করবার চেষ্টা করব ।) আমার আলোচনার মূল বিষয় সমালোচনামূলক কতকগুলো প্রবন্ধের সমালোচনা । অতএব পাঠক যদি জিজ্ঞাসা করেন যে এইসব স্বনামধন্য প্রাবন্ধিকদের এত সমালোচনার থেকে (রবীন্দ্রনাথ ও জীবনানন্দ বিষয়ে) আমার বক্তব্যটা কী সে কথা তো কই কিছু শোনা গেল না, তবে আমার নিরুত্তর থাকা ছাড়া গতি নেই ।

    এই লেখার প্রয়োজন কী ? দুরকম প্রয়োজন । এক, একটি পত্রিকার সম্পূর্ণ একটি সংখ্যা হাতে পাওয়াটা লাভজনক । কারণ, তাতে একটি সময়ের ও কনটেক্সটের পুরো চেহারাটা অনেকখানি ধরা পড়ে । `নির্বাচিত প্রবন্ধ' জাতীয় সংস্করণে হয় না । আলোচ্য সংখ্যাদুটিতে আমরা নানা বয়সের লোকের লেখা দেখি । তাতে একদিকে যেমন এটা বোঝা যায় যে এক একটি প্রজন্ম একই লোকের দ্বারা এক এক রকম ভাবে প্রভাবিত হয়েছিল ; তেমনই এও বোঝা যায় যে একই সময়ে এরা সকলেই একই পত্রিকায় এঁদের বিভিন্ন জেনারেশনের মতামত জানাতেন । এই সমষ্টিটা শুধুমাত্র নিজের কারণেই চিত্তাকর্ষক ।

    দুই, ভালো-মন্দের বিচার এক এক যুগ এক এক রকম ভাবে করে । দু:খের বিষয়, বাংলায় সমালোচনাসাহিত্যে শ্রদ্ধারসের পরিমাণ কিঞ্চিৎ অতিরিক্ত । আমাদের সংস্কৃতিতে শ্রদ্ধা ব্যাপারটা গুরুত্বপূর্ণ । সমালোচনার ক্ষেত্রে যেটা অনেক সময় বদভ্যাসও মনে হ’ংএত পরে (অন্তত আমার তা-ই হয়) । সমালোচক তাঁর সমালোচ্য ব্যাক্তিটির তুলনায় কী পরিমাণ ক্ষুদ্র ও দীন সেটা, আমার মতে, আদৌ প্রাসঙ্গিক নয় । সে-জন্য গদগদ শ্রদ্ধার বাণী পরিহার করলে খুব কিছু ক্ষতি হয় ব’ংএল মনে হয় না । অথচ আলোচ্য সংখ্যাদুটির বিভিন্ন রচনায় এই শ্রদ্ধারসের এবং স্তাবকতার ঘনঘটা বিভিন্ন পরিমাণে বর্তমান । মজার বিষয় এই, যে জীবনানন্দ দাশ সংখ্যাটিতে এইজাতীয় শ্রদ্ধা-বিহ্বলতা বহুলাংশে বেশি । আমি প্রায় নিশ্চিত যে এই কথাটা আমি আগে থেকে আন্দাজ করতে পারতাম না । অতএব দেখা যাচ্ছে, যে সাহিত্য এবং তার সমালোচনার ধারা সম্পর্কে আমাদের যেটা স্টিরিওটাইপ, যেটা এক্ষেত্রে খাটেনি, এতদিন পরে এইসব রচনা পড়ার সুবিধে অবশ্যই এই যে এতদিনে আমাদের সঙ্গে এই দুই ব্যক্তির যথেষ্ট দূরত্ব তৈরি হয়েছে । প্রাবন্ধিকদের সঙ্গেও । অতএব উত্সাহের আতিশয্য এবং নবজাত শ্রদ্ধার বিগলিত বিহ্বলতা থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখাটা সহজ হয়েছে । আমার মূল উদ্দেশ্য, সেই দূরত্বের সুযোগ নিয়ে এই দুটি গুরুত্বপূর্ণ সংখ্যার একটি যতদূর সম্ভব নিরপেক্ষ সমালোচনা করা । এবং এমন কয়েকটি প্রাসঙ্গিক কথা বলার, (যা আমি আগে কোথাও পড়িনি বা শুনিনি) যা হয়তো অনেকের কানে নতুন (এবং সঠিক) শোনাবে ।

    গোড়ায় কতকগুলো তুলনামূলক কথা বলি । তারপর এক একটি সংখ্যা নিয়ে আলাদা করে আলোচনা করব । ভূমিকায় সর্বাঙ্গীণ কনটেক্সটের যে-কথা বলছিলাম, তার খুব একটা পরিচয় কোথাওই পাওয়া গেল না । তার কারণ স্মরণসংখ্যা হওয়ার দরুণ এতে বিষয়ের তেমন কিছু বৈচিত্র্য নেই । দু:খের কথা, জীবনানন্দ সংখ্যাটি নিদারুণ রকম বৈচিত্র্যহীন । তার একটা কারণ অবশ্যই এই, যে (বিশেষত র,ঠা'র তুলনায়) জীবনানন্দ দাশের কর্মকাণ্ড অত্যন্ত সংকীর্ণ এবং তাঁর সম্পর্কে পরিষ্কার করে যে-কটা কথা বলা যায় । তাও সংখ্যায় বেশি নয় । সেক্ষেত্রে, আমার মনে হয়, দু-সংখ্যায় দু-রকম পৃষ্ঠা সংখ্যা হওয়া উচিত ছিল । কার্যক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, সংখ্যা হ’ল ১১৪ ( র,ঠা ) এবং ১৪৮ (জীবনীপঞ্জী প্রভৃতি বাদ দিয়ে ; জী, দা ) । জীবনানন্দ দাশকে লোকসমক্ষে হাজির করতে সম্পাদকের অত্যন্ত বেশি আগ্রহ ছিল ব’ংএল শোনা যায় । সে-সময়ে হয়তো তার প্রয়োজনও ছিল । এতদিন পরে সে-কথা স্পষ্ট করে অনুভব করা কঠিন । তবে প্রচার আর সমালোচনা এক বস্তু নয় । সেটা জীবনানন্দ দাশ সংখ্যায় বারবার গুলিয়ে যেতে দেখা যাচ্ছে । অনেকসময় একই লেখার মধ্যে । উদাহরণে পরে আসছি ।

    র,ঠা সংখ্যার তুলনায় জী, দা সংখ্যার লেখকরা প্রায় সর্ব অর্থে নবীনতর । অধিকাংশ ক্ষেত্রে । এই নবীনতার প্রভাবটা তেমন সুবিধের হয়নি । জীবনানন্দ দাশ যে কীরকম ব্যতিক্রমী এবং অনন্য সাধারণ সেই বাণী প্রচারের উত্সাহে নবীন লেখকের দল (এবং সম্পাদক) খেয়ালই করেননি যে এর মাধ্যমে কী পরিমাণ স্তাবকতা ঢুকে পড়েছে রচনাগুলির মধ্যে । যে অন্ধ অক্ষম অনুকরণের বিরুদ্ধে তাঁদের এত প্রতিবাদ (বুদ্ধদেব বসু ( বু,ব ) কর্তৃক করুণানিধান, কুমুদরঞ্জন, সত্যেন দত্ত-র কাব্য সমালোচনা স্মর্তব্য) । সেই অন্ধ ভক্তিবিহ্বলতা বারবার যুক্তিনির্ভর বুদ্ধিমত্তার পথে বাধা হয়ে উঠেছে জীবনানন্দ দাশ সংখ্যায় ।

    অপরপক্ষে, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সংখ্যাটি এই স্তাবকতার হাত থেকে প্রায় মুক্তই বলা চলে । সেখানে ব্যক্তিগত শ্রদ্ধাজ্ঞাপন অনেকবার দেখতে পাওয়া যাচ্ছে । কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পরিষ্কার করে বলে দেওয়া হয়েছে শ্রদ্ধার কারণটা কী । এবং তার মধ্যে দিয়ে কতকগুলি পরিণত মস্তিষ্ক ব্যক্তিগত সৎ মনোভাবের পরিচয় পাওয়া গেল (অবন ঠাকুর, প্রমথ চৌধুরী, অতুল গুপ্তদের লেখাগুলি যেমন) যার জাত ভক্তিবিহ্বল ব্যাকুলতার থেকে পৃথক । এই ব্যাকুলতার সর্বোকৃষ্ট উদাহরণ অশোক মিত্র, নরেশ গুহ এবং অমলেন্দু বসু-দের জীবনানন্দ দাশ বিষয়ক প্রবন্ধ-ত্রয়ী । এ-বিষয়ে আমার ধারণাটা এইরকম । রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্তাবকগুচ্ছকে সম্পাদক সচেতন ভাবেই দূরে রেখেছিলেন । দূরত্ব বাড়লে দৃষ্টি একটু স্বচ্ছ হয় বলেই হয়ত এটা তাঁর পক্ষে সম্ভব হয়েছিল । জীবনানন্দ দাশের সঙ্গে সম্পাদকের সময়ের পার্থক্য অনেক কম, তাছাড়া তাঁর বিষয়ে লিখতে পারেন, এমন লোকেরা অনেকেই হয়তো সম্পাদকের ব্যক্তিগতভাবে নিকটজন । যাঁদের সাহায্য ছাড়া পত্রিকাটি হয়তো অচল । কাজেই এঁদের বাদ দেওয়া সম্ভব হয়নি । দু:খের কথা । এবং হয়তো খানিকটা কৌতুকজনকও বটে ।

    প্রসঙ্গান্তরে আসি । দু’ংইট সংখ্যার মধ্যে ১৩ বছরের পার্থক্য । হয়তো এই কারণে, কিংবা সম্পাদকের সচেতন প্রচেষ্টার ফলে, অথবা আর্থিক কারণে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সংখ্যাটি বিজ্ঞাপন বিবর্জিত । জীবনানন্দ সংখ্যাটি নয় । আমার সবসময়েই মনে হয়, বিজ্ঞাপন অতি অসাধারণ ঐতিহাসিক দলিল । এবং না হয়ে থাকলে, `বাংলা সাহিত্যপত্রে বিজ্ঞাপনের ত্রক্রমবিবর্তন” ব’ংএল একটি ডক্টরেট থীসিস অবিলম্বে লেখা উচিত । রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সংখ্যায় প্রাক্‌-স্বাধীনতা যুগের বিজ্ঞাপন দেখা যাবে -- এরকম একটা দুরাশা আমার ছিল । সে-আশা মিটল না বটে । তবে জীবনানন্দ সংখ্যায় পাওয়া গেল একাধিক এবং চিত্তাকর্ষক এবং অত্যন্ত সমসাময়িক কয়েকটি বিজ্ঞাপন । নাভানা ও বিশ্বভারতীর বইয়ের । গোল্ডেন আমলা হেয়ার অয়েল (ইংরেজি শব্দগুলি লক্ষ করার মতো) ও ডানলপের টায়ারের, এবং প: বঙ্গ সরকার কর্তৃক প্রকাশিত কতকগুলি মাসিক পত্রের । এইসব মাসিক পত্রের অস্তিত্বের কথা আমি কোনোকালে শুনিনি । এর মধ্যে রয়েছে একটি নেপালি এবং একটি উর্দু পত্রিকা । এবং নাম শুনে সরকারী প্রোপাগাণ্ডার মুখপত্র ব’ংএল অনুমান হয় । (কেউ জানলে শুধরে দেবেন ।) পত্রিকাগুলির নাম বসুন্ধরা, উইকলি ওয়েষ্টবেঙ্গল, স্বাস্থ্যশ্রী, মগরেবী বংগাল ইত্যাদি এবং প্রাপ্তিস্থান প্রচার অধিকর্তা, রাইটার্স বিল্ডিংস । এ-ছাড়াও রয়েছে টি-বোর্ডের একটি অসাধারণ চায়ের বিজ্ঞাপন । সদ্য-স্বাধীন ভারতবর্ষের বৃহৎ পঞ্চবর্ষীয় পরিকল্পনা, বহু প্রকার আশাবাদ ও গ্রামীণ উন্নয়ন জাতীয় বৃহৎ প্রকল্পের সময় সেটা । (আমাদের ছোটবেলায় ছায়াছবির পূর্বে যে নিউজরিল দেখানো হ’ত, তার কথা মনে পড়ছে ।) সে সময়কার প্রচারমাধ্যমের ভাষা ও কনটেক্সটের একটি জীবন্ত ছবি (ভবিষত্‌-এর প্রতীকী একটি শিশুর ছবি সমেত) দেখতে পাওয়া গেল ।

    রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সংখ্যাটির সম্পর্কে কয়েকটি কথা এই অধ্যায়ে (??) বলব । এই সংখ্যার একটি দুরন্ত প্রাপ্তি একটি পুরো সাদা পাতার মধ্যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর-এর কাঁপা হাতের সইটি, যা দিয়ে বলতে গেলে, সংখ্যাটি শুরু হয় । সেই অতি পরিচিত সই, রোগে, শারীরীক দুর্বলতায়, মৃত্যুর আসন্নতার সঙ্গে মিলে একটা খুব বড়ো মাপের ট্রাজেডিকে মূর্ত করে তোলে । ( সব পেয়েছির দেশে -র সঙ্গে মিলিয়ে দেখলে আরো পরিষ্কার হবে) । নক্ষত্রপতন জাতীয় ছেঁদো কথা ব'লে আর সেই সুরটাকে কাটাতে ইচ্ছে করছে না । যাঁরা সিম্বলিজ্ম ব্যাপারটা বোঝেন, কিংবা সিনেমায় উত্সাহী, অন্তত তাঁদের কাছে এ অতি বড় প্রাপ্তি । এই আইডিয়াটি কার আমি জানি না । সম্পাদকের ইন্ট্যুইশন বেশ ভালো বলেই এটি এখানে স্থান পেয়েছে । অত্যন্ত বুদ্ধিমত্তার কাজ হয়েছে ।

    প্রমথ চৌধুরী ও অবন ঠাকুরের দুটি লেখার মধ্যে স্মৃতিচারণার দুটি চিত্তাকর্ষক দৃষ্টান্ত পাওয়া গেল । লেখার ধরনটি একেবারে মুখের কথার আদলে । অনুলিপিও হ’ংএত পারে । ( জোড়াসাঁকোর ধারে কিংবা সত্যজিৎ রায় কর্তৃক বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায়ের সাক্ষাত্কার স্মর্তব্য ।) আমার মনে হয় স্মৃতিচারণা লিপিবদ্ধ করার স্টাইল হিসেবে এটি অত্যন্ত উপযুক্ত এবং চিত্তগ্রাহী ।

    প্রমথ চৌধুরীর লেখার মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ ইঙ্গিত আছে (পৃ: ১২) রবি ঠাকুর তখনকার কলাকাত্তই ভাষায় কথা বলতেন না । কলকাত্তাই ভাষা কি হুতোমের ভাষা ? তা যদি হয়, তবে বক্তব্যটি প্রণিধান যোগ্য । রবি ঠাকুরের প্রচণ্ড ব্যক্তিগত দাপটে অনেকগুলি উত্সমুখ যেমন খুলে গিয়েছিল, অনেক ক্ষীণ ধারা কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল । হুতোমের ধারাটি তার অন্যতম । আমি ভাষাতত্ত্বের ব্যক্তি নই । এ-বিষয়ে গভীরতর আলোচনা আমার ক্ষমতার বাইরে । কেবল হুতোমের সাম্প্রতিক পাঠের ফলে, কিছু পরিমাণে প্রাচীন বাংলা ছায়াছবি (তার নাটুকে দুর্বলতা সমেত) দেখার দলে, টিনের তলোয়ার প্রভৃতি শুনে আমার মনে হয়েছে যে ওই ভাষার মধ্যে এক ধরনের প্রাণ ছিল । একটি সংস্কৃতির (তা সে যতই খেলো, মদ্যপ, `রাঁড় - সম্বলিত হোক না কেন), একটি সময়ের ভাবধারার পরিচয় ছিল । ঘটনাচক্রে রবি ঠাকুরের প্রবল আঘাতে সেই সমস্ত কাঠামো ধুলোয় মিশে যায় । আমার মনে হয় এ অতি দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা । রবি ঠাকুরের ভাষা তাঁর নিজের কথা বলার ভাষা । তাঁর ভাবনা প্রকাশ করার বাহন । বাংলার অনেক মানুষের ভাবনা তার থেকে পৃথক একটি জগতের বাসিন্দা । সেইসব অন্যতর ভাবনা প্রকাশের জন্য অন্যতর ভাষা উপযুক্ত হতে পারে । দুর্ভাগ্যবশত, উনিশ শতকের শেষ থেকে শুরু করে রবি ঠাকুরের মৃত্যু পর্যন্ত এমন কোনো ব্যক্তি ছিলেন না যিনি সেই প্রচণ্ড প্রতিভার প্রবল বন্যার মধ্যে স্থির দাঁড়িয়ে অন্য ভাষায় কথা বলতে পারেন । তাছাড়া আমাদের অর্চনাঅভ্যস্ত সমাজে অলটারনেটিভ ব্যাপারটার তো কোনো স্থানই নেই । আজকের কথ্য বাংলায় এত যে হিন্দীর প্রভাব, সেটা হয়তো এই অভাব পূরণ করারই প্রচেষ্টা । একটি জাতির স্বাভাবিক সময়োচিত প্রচেষ্টা, একজন অতিমানবের ব্যক্তিগত দাপটের ভয়ঙ্কর আঘাত নয় ।

    দুটি সংখ্যা মিলিয়ে সেরা লেখা আমার মতে, অতুলচন্দ্র গুপ্তের ``আমাদের ছাত্রাবস্থা ও রবীন্দ্রনাথ” প্রবন্ধটি । বাঙালি সমাজে রবীন্দ্রনাথের আত্মপ্রকাশের এবং ত্রক্রমবিবর্তনের কনটেক্সট-এর একটি উত্কৃষ্ট বর্ণনা (দ্বিতীয় অধ্যায়, পৃ: ১৮-২০) । ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার একটি ঝরঝরে সামারি (প্রথম অধ্যায়, পৃ: ১৭-১৮) । তৃতীয় অধ্যায়ে সাহিত্যানুরাগী অল্পবয়সী শিক্ষিত বাঙালির পক্ষে রবীন্দ্রনাথের যে ভূমিকাটি কী ছিল, তার একটি ব্যক্তিগত মূল্যায়ন । ঐতিহাসিক কনটেক্সটটি পরিষ্কার করে বলা হয়েছে । সাহিত্যের ক্ষেত্রে যুগ-সঞ্চিত ইনফিরিয়রিটি কমপ্লেক্স-কে কীভাবে জয় করা গেল (অন্তত অংশত) -- এ-বিষয়টা অন্তত আমি আগে কোথাও দেখিনি । রবীন্দ্রনাথের নিজের লেখায় অবশ্য পড়েছি । কিন্তু কোথাও পরিষ্কার করে বলা হয়নি । এবং পৃ: ২২-এ সাহিত্যবিচারের কষ্টিপাথর, অর্থাৎ একটি স্ট্যাণ্ডার্ড তৈরি হবার যে-কথা তিনি বলেছেন, সেটি গুরুত্বপূর্ণ কথা । ভাবালুতায়, আবেগে, ন্যাকামিতে বিহ্বল নয় ব’ংএল উপেক্ষা করে যাবার সম্ভাবনা থেকে যায় ।

    এই প্রবন্ধে প্রায় প্রত্যেকটি বাক্য প্রয়োজনীয় । প্রত্যেকটি বাক্যে একটি বক্তব্য আছে । যা অন্য বাক্যের পুনরুক্তি নয় । বক্তব্যগুলো পরিষ্কার । যা বলা হচ্ছে, তার স্বকীয়তা অনস্বীকার্য । এবং পুরো প্রবন্ধটিতে লেখক কখনো মূল বিষয়টি থেকে দূরে সরে যান না । প্রবন্ধ রচনা করতে যাঁরা চান, তাঁদের জন্য এটি অবশ্য পাঠ্য হওয়া উচিত ।

    পৃ: ৯৯-১০১-এ দুটি আশ্চর্যরকমের দুর্বল কবিতা -- সুধীরচন্দ্র কর এবং অচিন্ত্য সেনগুপ্তর রচনা । `আঁখিপাতে', `পত্রপুটে' `বীণে' প্রভৃতি শব্দের প্রয়োগে, `হাতে ও আঁখিপাতে', `ছায়া ও মায়া', `ছবি ও কবির' মিলে প্রথম কবিতাটিকে ওই কুমুদরঞ্জন করুণানিধান গোত্রীয় ব’ংএল মনে হয় । রবীন্দ্রপ্রভাব মুক্তির আন্দোলনের প্রধান সৈনিকদের অন্যতম অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্তর লেখাটি পুন:প্রকাশিত । লজ্জাজনক রকমের দুর্বল এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রচনাশৈলীর একটি অক্ষম, উত্কট অনুকরণ ।

    অমিয় চক্রবর্তীর `রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টি' লেখাটি স্বকীয়তায় উজ্জ্বল । নিচুস্বরে বলা অনুভূতি ও অভিজ্ঞতার একটি মিশেল । চারটি অধ্যায়েই রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টি সম্পর্কে আলোচনা, কখনো রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নিজের কথায়, কখনো শান্তিনিকেতনের কর্মকাণ্ডের অল্প বর্ণনায়, কখনো ব্যক্তিগত অনুভূতির মৃদু অভিব্যক্তিতে । প্রায় তাঁর কবিতার মতোই `আধ্যাত্মিক' ( বু,ব -র কথা) ঋজু, শান্ত এবং স্বকীয় ।

    যামিনী রায়ের `রবীন্দ্রনাথের ছবি' প্রবন্ধটিতে অনেকগুলো নতুন কথা (আমার কাছে নতুন) শুনলাম । ছবি ও পৌরাণিকতা বিষয়ের সংক্ষিপ্ত আলোচনাটিতে (পৃ: ৪২) খুবই নতুন রকমের কথা বলা হয়েছে । রবি ঠাকুরের অনভিজ্ঞাতার পরিচয় একটি বিশিষ্ট দৃষ্টান্তের মাধ্যমে বলা -- ভাবতে অবাক লাগে গদগদ ভক্তি প্রকাশের যুগে এরকম কথা লেখা যেত । প্রবন্ধটি আগাগোড়া ঝরঝরে, প্রায় মুখের কথার মতো স্বচ্ছন্দ, সাবলীল, স্বাভাবিক, `সতেজ শিরদাঁড়া' রবি ঠাকুরের ছবির মতোই এ-প্রবন্ধের সেরা গুণ ।



    রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সংখ্যার তুলনায় জীবনানন্দ দাশ সংখ্যাটি বহু অংশে দুর্বলতর । এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ অশোক মিত্র, সঞ্জয় ভট্টাচার্য এবং নরেশ গুহর প্রবন্ধত্রয়ী । এই তিনটি প্রবন্ধে যুক্তিনির্ভর পরিষ্কার বক্তব্য খুঁজে বের করা কঠিন । অত্যন্ত সেন্টিমেন্টাল এবং প্রায় অসার পাণ্ডিত্যের ভাণ বারবার বিরক্তির উদ্রেক করে । কয়েকটি উদাহরণ দিই ।--

    ``এই হতভাগ্য দেশে, কবিকর্মের সঙ্গে আর্থিক সচ্ছলতার যেখানে নিশ্চিত আড়াআড়ি ...''(অশোক মিত্র : পৃ: ৯০)
    লেখক কি এমন কোনো সেই ভাগ্যবান দেশ বা সময়ের কথা জানেন যেখানে কাব্যরচনা আর্থিক দিক থেকে খুব লাভজনক ?

    ``... অনুরাগী পাঠকদের মুগ্ধতাবোধের প্রত্যক্ষ, আন্তরিক জবানবন্দিও কবির তৃপ্তির পক্ষে অনেকখানি । অতটুকু অর্ঘ্যও তাঁকে দেওয়া হয়নি ।'' (অশোক মিত্র: পৃ: ৯০)
    একি ফ্যান-মেল থেকে উদ্ধৃত ?

    ``পাপ মানে অবশ্য স্বভাব-বিরোধিতা'' ( স,ভ : পৃ:: ৮২)
    এটা কি লেখকের মত ? নাকি চিরকালের সবার জানা কথা ? এ-কথার মানে কী ? কীরকম স্বভাব ? হঠাৎ পাপের প্রসঙ্গ উঠল কেন ?

    ``জীবনানন্দ দাশ জ্ঞানী কবি, তিনি বিজ্ঞানী নন''
    ( স,ভ : পৃ:: ৮২)
    মনে হচ্ছে কিছু একটা বক্তব্য এখানে থাকলেও থাকতে পারে । দু:খের বিষয়, জ্ঞানী-বিজ্ঞানী-পাপ -- প্রভৃতির কতকগুলো সংজ্ঞা সঞ্জয়বাবুর মাথার মধ্যে আছে । কিংবা তাঁর ধারণা, আছে । সে সংজ্ঞাগুলো কিছুমাত্র পরিষ্কার হয়নি । তাঁর মাথার মধ্যেও পরিষ্কার আছে কিনা সন্দেহ হয় ।

    ``তারপর, কল্পনার গতিবেগ আয়ত্ত করবার পর, কল্পনারই স্পর্শে বা ঘর্ষণে পথের সব-কিছু আলোকিত হয়ে যায় ।'' ( স,ভ : পৃ:: ৮৩)
    মনে হচ্ছে ধর্মপ্রচারী রঙিন প্যামফ্লেট থেকে উদ্ধৃত ।

    ``উত্কৃষ্ট চিত্তের মহাজিজ্ঞাসা রাষ্ট্রনীতি-সমাজনীতি-ব্যক্তিনীতির আবর্তে ঘুরপাক খায় না, জীবন-নীতির উপর প্রশ্ন-পাত করে ।'' ( স,ভ : পৃ: ৮৩)

    তাই নাকি ? আমার তো অনেক `উত্কৃষ্ট চিত্তের অধিকারী'র কথা মনে পড়ছে, যাঁরা রাষ্ট্রনীতি ব্যক্তিনীতির আবর্ত নিয়ে বেশ ভালোই মাথা ঘামিয়েছেন । চার অধ্যায় ব’ংএল একটি উপন্যাস আছে, সঞ্জয়বাবুকে প’ংএড় দেখতে অনুরোধ করি ।

    ``যদিও এ-সব রচনা আমকে ধূসর পাণ্ডুলিপি আর বনলতা সেন -এর সম-পরিমাণে আচ্ছন্ন করেনা, -- তাহ'লেও বলতে পারি কান-মনকে অভ্যেস করিয়ে নিতে পারলে এ-কবিতাগুলিও আগের মতোই স্বচ্ছ ব'লে ঠেকবে ।'' ( ন, গু পৃ: ১০৬)
    নরেশবাবু কিসে নিজেকে প্রবেশ করতে পেরেছেন (বোলে অশ্লীল ইঙ্গিত করছি না ! ????) - এ জেনে পাঠকের লাভ কি ? আর সবকিছুকে স্বচ্ছ ঠেকাবার এত দায়ই বা কিসের ? যার মধ্যে তিনি নিজেকে প্রবেশ করতে পেরেছেন, সে সম্পর্কে দু-চার কথা পরিষ্কার করে বলাই কি যথেষ্ট নয় ?

    জীবনী-পঞ্জি'র (পৃ: ১৪৯) শেষে নরেশবাবুর একটি মেলোড্রামাটিক স্মৃতিচারণা -- ব্যাকুলতায়, ন্যাকামিতে প্রায় অদ্বিতীয় । ``ডাক্তারি পড়া তরুণ ছাত্ররা সারারাত্রি শয্যার পাশে ... '' ইত্যাদি (????)।

    অমলেন্দু বসু'র (``যে দেখেছে মৃত্যুর ওপার'' পৃ: ১২) ভূমিকায় জীবনানন্দের সদ্যপ্রয়াণ প্রসঙ্গে ``যে-সময়টিতে সুর-বিশ্লেষণ হৃদয়হীন বিশেষত যদি কবির সঙ্গে মুগ্ধ পাঠকের সুহৃদ সম্পর্ক থেকে থাকে'' বাক্যটি লক্ষ করার মতো । আমার মনে হয় কথাটা আন্তরিকভাবেই বলা । নিদারুণ শোকের অশ্রুবাষ্পে দৃষ্টির অস্বচ্ছতা ঘটতে পারে । সেক্ষেত্রে, আমার মনে হয়, সেই অস্বচ্ছতাকে প্রবন্ধের আকারে সবার সামনে প্রকাশ করাটা নিতান্ত শোভন নয় । একান্তে আড়ালে সরে থাকাই ভালো । অন্তত যদ্দিন অশ্রু ঝরছে, ততদিন । তা না হ’ংএল ``কবির জীবনোপলব্ধির নাভিমর্মে মৃত্যুর অব্যয় ভাবনা অন্য সব ভাবনা ঘুরে ফিরে এই কেন্দ্রের সংযোগে সঞ্জীবিত'' -- জাতীয় শব্দবন্ধের ম্যানারিজম দুষ্টতা কাটানো মুশকিল ।

    এই সংখ্যার একটি উল্লেখযোগ্য প্রাপ্তি বুদ্ধদেব বসু’র (পৃ: ১৩৭-১৩৯) সংযোজনটি । জীবনানন্দ দাশ যে এক্সেরসাইজ খাতায় হার্ড পেন্সিলে লিখতেন এবং পাণ্ডুলিপিতে ওই পরিমাণ কাটাকুটি থাকত, ব’ংএল না দিলে অনুমান করা কঠিন । এই ধরনের তথ্য ব্যক্তিগত হলেও সম্পাদকের সীরিয়াসনেসের পরিচায়ক । এ-ধরনের কাজে খাটুনি আছে । বিরক্তিকর খাটুনি আছে । সেটা-ও একরকমের প্রাপ্তি । যাঁরা গবেষণা করেছেন, তাঁরা ভুক্তভোগী এবং এ-ধরনের অভিজ্ঞতার সঙ্গে আইডেন্টিফাই করতে পারবেন ।

    আরো একটি গবেষণাধর্মী মূল্যবান কাজ জীবনানন্দ দাশের বিভিন্ন কবিতার প্রকাশের কাল ও স্থানের তালিকাটি । এই পরিশ্রমের ফলে কবির ত্রক্রমবিবর্তন সম্বন্ধে একটা ধারণা পাওয়া গেল । প্রাসঙ্গিকতা (কনটেকসট) -- ব্যাপারটা জরুরি । এবং একটি আপাতনীরস তালিকার মাধ্যমে এ-সম্পর্কে অনেক বেশি ধারণা পাওয়া যায়, অনন্ত স্মৃতিমেদুর ব্যাকুলতায় যা পাওয়া সম্ভব নয় । সম্পাদককে ধন্যবাদ । (পক্ষান্তরে, জীবনানন্দ দাশ সংখ্যার একেবারে গোড়ার দিকে জীবনানন্দ দাশের প্রকাশিত চিঠিটার প্রাসঙ্গিকতা যে কী, আমি কিছুমাত্র বুঝতে পারিনি ।)

    এবার কয়েকটি প্রবন্ধের কথা বলব যার মধ্যে নতুন ধরনের কিছু দেখতে পাওয়া গেল । ‘নতুন’ কথাটা অবশ্যই একটু অদ্ভুত । হয়তো ব্যতিক্রমী বলা ভালো । মোট কথা, এই লেখাগুলি স্বতন্ত্র ধরনের । এবং সে-জন্য এগুলি সম্বন্ধে অল্প ক’ংইট কথা বলব ।

    জীবনানন্দ দাশ সংখ্যায় অরুণ সরকারের প্রবন্ধ ``জীবনানন্দ দাশের আস্তিকতা'' । পরিষ্কার সব বক্তব্য । সশ্রদ্ধ হলেও সেন্টিমেন্ট্যালিটিতে চটচটে হয়ে, ভক্তিতে অস্বচ্ছ হয়ে, ন্যাকামিকে ব্যাকুল হয়ে বক্তব্যটাকে ঢেকে দেয়নি । ``মনোময় জগৎ ছেড়ে কিছুদিন তিনি কর্মময় জগতে ভ্রমণ করেছিলেন এবং পুনরায় নবতর উত্সাহে মনোময় জগতেই ফিরে গিয়েছিলেন ।'' (পৃ: ৯৭) খুব অল্প কথায় জীবনানন্দের কেরিয়ারের একটি প্রায় সঠিক বর্ণনা এবং নির্যাস । `` `পৃথিবীর পথে গিয়ে কাজ নেই' -- এই কথা ব'লে সমস্ত সাংসারিক উত্সাহ এবং উদ্যমের দিকে পাশ ফিরে `জেগে থেকে ঘুমাবার সাধ' যিনি জ্ঞাপন করেছিলেন, বলা বাহুল্য, সেই কবির মনোবিপ্লব রাতারাতি সংঘটিত হয়নি ।'' (পৃ: ৯৭-৯৮) যুক্তিপূর্ণ কথা, পরিষ্কার এবং আস্ত একটি বক্তব্য । অপর দিকে ``সেটা ঠিক সুস্পষ্ট ইতিহাসচেতনা নয়'' -- আবার একটি সঠিক মূল্যায়ন এবং স্পষ্ট বক্তব্য । তাঁর কবিতা জনপ্রিয় নয় -- সে-কথা বলা হয়েছে কিন্তু নরেশ গুহর মতো তা নিয়ে চটচটে সেন্টিমেন্টালিটি করার কোনো প্রচেষ্টা নেই । এ-জন্য এঁর কথা শুনতে ইচ্ছে করে, বোঝার চেষ্টা করে বিরক্ত হ’ংএত হয় না এবং অল্প পরিশ্রমে কয়েকটি স্পষ্ট বক্তব্য জানা হয়ে যায় । ন্যাকা এবং স্তাবককুলেরা এঁদের দেখে কেন শেখেন না ?

    জীবনানন্দ দাশের পুন:প্রকাশিত ``কবিতার কথা'' প্রবন্ধটি । বহু পঠিত, বহু আলোচিত । আমার মনে হয়, একটি অত্যন্ত ব্যক্তিগত লেখা । কিন্তু তাড়াতাড়িতে পড়লে `পণ্য'-জাতীয় সারসত্য প্রচারের অপচেষ্টা মনে হতে পারে । স্টাইলের দিক থেকে অদ্ভুত রকমের স্বকীয়, অদ্ভুত ভাবেই অস্পষ্ট । অনেক বক্তব্য শুরু হয়ে ঠিক করে শেষ হয় না, অনন্ত উপমায়, কল্পনায়, মেটাফরে, বাক্যগঠনের জটিলতায় একটি কিম্ভুত রচনা হয়ে ওঠে । এবং অনেকেই যে কথা বলেছেন, তাঁর কবিতার ভাষা ও আঙ্গিক এখানে-ও সম্পূর্ণভাবে উপস্থিত । এ-প্রবন্ধের যে কোনো বিশেষ উদ্দেশ্য ছিল তা পরিষ্কার, কিন্তু সেই উদ্দেশ্য সমাজে কবির স্থান এবং ভূমিকা নির্ণয় জাতীয় একটি গোলমেলে বিষয় । এ-সম্পর্কে একজন প্রাকটাইসিং কবির বক্তব্য জানা গেল । ভালো কথা । ব্যস, ও টুকুই ।

    জীবনানন্দ দাশ সংখ্যায় বুদ্ধদেব বসু-র দীর্ঘ, দুর্বল ভূমিকা । তার মধ্যে মাঝে মাঝে আত্মপ্রচারের অতিশয় ঝোঁক । অনিল এবং সুরেশ নামক দুই বন্ধুর একটি কাল্পনিক সংলাপ -- যার বিষয় জীবনানন্দ -- অসাধারণ দুর্বল এবং অপরিণত লেখা -- লেখকের বয়স তখন কুড়ির কাছাকাছি । এরকম লেখা উদ্ধৃত করার কি আত্মপ্রচার ব্যতীত অন্য কারণ থাকতে পারে ? ৬৯ পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে ``ইচ্ছে করেই উদ্ধৃতি একটু দীর্ঘ করলাম, সেই সময়কার সাহিত্যিক আবহাওয়ার কিছু আভাস দেবার জন্য ।'' অদ্ভুত সাফাই । ``আবহাওয়ার'' আভাস মনে একই ব্যক্তির দুটি অত্যন্ত কাঁচা কাজের পরিবেশন । ``আবহাওয়ার'' বিচিত্র আভাস ।

    অথচ বুদ্ধদেববাবুর স্বভাবসিদ্ধ শব্দপ্রয়োগের উত্কৃষ্ট আলোচনার আভাস এ-প্রবন্ধে আছে, যেমন পৃ: ৭৯-তে । `বিয়োবার' এবং `ঠ্যাং' শব্দদুটোকে বেছে নিয়ে তার তাত্পর্য সম্পর্কে আলোচনা করাটা বুদ্ধিমান রসিকজনের লক্ষণ । যা আমাদের ভালো লাগে । আস্চর্য লাগে তার পেছনে কী ধরনের ডিটেলের ভূমিকা আছে, তার বিবরণ । এ-রকম আলোচনা বু,ব'র কাছ থেকে পরে বহুবার পাওয়া গেছে । অবনীন্দ্রনাথের গদ্য সম্পর্কে, সুকুমার রায়ের কাজ প্রসঙ্গে ইত্যাদি । বাংলা সমালোচনা সাহিত্যে বুদ্ধদেব বসুর একটি উত্কৃষ্ট অবদান ।

  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments