যদি ওরা হিন্দি সিনেমা না দেখত, তাহলে বিপ্লবটা হয়তো হোত ।
কবিতা লিখতে চেয়েছিল আমার এক বন্ধু, এই বাক্যটিকে প্রথম লাইন করে । সেই কলেজে পড়ার সময় । যতদূর জানি, সেই কবিতা এখনও লেখা হয়নি, মনে হয় না কখনো হবেও । "বিপ্লব" শব্দটির মধ্যে সে-সময় যে রোমাঞ্চকর রোম্যান্টিসিজমের গন্ধ পাওয়া যেত, বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গেই সেই গন্ধ উবে গেছে কোথায় । হয়ত এটা বোঝার পরই যে এদেশের এখনকার জটিল আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতিতে "বিপ্লব" ঠিক সেভাবে অর্থবহ নয় । কিন্তু তা সত্ত্বেও হিন্দি সিনেমা সম্পর্কে কিছু চিন্তা এখনও রয়ে গেছে, সেই চিন্তাগুলিকেই এই লেখায় প্রকাশ করার চেষ্টা করছি ।
এতে বোধহয় কোনোই সন্দেহ নেই যে আধুনিক সমাজে শিল্পের যে ধারাটি জনমানসে সবচেয়ে বেশি প্রভাব বিস্তার করতে পারে, তা হল সিনেমা । সাধারণত মনে করা হয় যে, সিনেমার "আসল" উদ্দেশ্য হচ্ছে বিনোদন । কিন্তু একটু খুঁটিয়ে দেখলেই বোঝা যায় যে, এই বিনোদনের আড়ালে আসলে অনেককিছুই লুকিয়ে থাকে । দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় থেকেই যেকোনো তত্ত্ব প্রতিষ্ঠার জন্যে সবচাইতে বেশি ব্যবহার করা হয়েছে চলচ্চিত্র মাধ্যমকে, তা সে নাত্সিবাদই হোক, সোভিয়েত কমিউনিজমই হোক বা মহান আমেরিকান স্বপ্নই হোক । তারপর সেই প্রতিষ্ঠিত তত্ত্বের লালনপালনের জন্যে আরও ব্যপকভাবে ব্যবহৃত হয়েছে এই মাধ্যম, বিনোদনের মোড়কে মানুষের মনে গেঁথে দিতে চাওয়া হয়েছে এই বোধ, যে সে যে সামাজিক পরিবেশে বাস করছে, সেই বিশেষ পরিবেশ ছাড়া সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যময় অস্তিত্ব অসম্ভব । অনেকক্ষেত্রে সরাসরিভাবে বলা হয়েছে এ-কথা, অনেকক্ষেত্রে পরোক্ষভাবে ঘটনা মারফৎ এমনভাবে সাজানো হয়েছে সবকিছু যে, ছবি দেখার পর প্রায় অজান্তেই তৃপ্তির উদগার তুলতে থাকা দর্শকের মনের মধ্যে সুদৃঢ়ভাবে প্রোথিত হয়েছে প্রতিষ্ঠানের ভিত ।
সেভাবে দেখতে গেলে আমাদের দেশে আদর্শগতভাবে কোনোরকম "বাদ"-এর চলন নেই । অদ্ভুত এক রাজনৈতিক জগাখিচুড়ি এই দেশে - গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধনতন্ত্র, দু-এক জায়গায় খাপছাড়া কমিউনিজম-এই সবকিছুর এক পাঁচমিশেলি প্রক্রিয়ায় চলতে থাকে আমাদের শাসনব্যবস্থা । এদেশের ভাষাগত ও সাংস্কৃতিক বিভিন্নতা প্রায় কিংবদন্তীতে পরিণত, তবে তা-সত্ত্বেও এক ধরণের আলগা ভারতীয়ত্ব বোধহয় আমাদের সকলের মধ্যেই আছে; এবং আধুনিক ভারতে তার একটি মূল কারণ হয়ত সারা ভারত জুড়ে এই অদ্ভুত "হাঁসজারু" সিস্টেম, যা এই বিশাল দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের তথাকথিত "বিভিন্ন" সমাজব্যবস্থাকে হরেদরে সেই একই রূপ দেয় । বডই. অভিনব এই সিস্টেম । নির্দিষ্ট রাজনৈতিক মতবাদ যেমন এর নেই, নেই কোনোরকম নৈতিকতার ছিটেফোঁটাও । এই রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত মানুষজনের মধ্যে বিবেকের ছোঁয়া দেখলে আমরা বিস্মিত হই, রাজনীতির মূল উপকরণ যে দুর্নীতি-তা এখন শিশুও জানে । আমরা প্রতিবাদ করি না এবং প্রতিবাদের কথা ভাবিও না । আমরা মেনে নিয়েছি । শান্ত চিত্তে ।
কেন ? কি বাঁচিয়ে রেখেছে এই সিস্টেমকে ? দিনের পর দিন তাকে লালনপালন করে প্রায় গ্রহণযোগ্য করেও তুলেছে ? কেন আমাদের কিছু এসে যায় না ? আমরা কি পাথরে পরিণত হয়েছি ? একশো কোটির দেশে শতকরা দশজনের রাগ হলেই তো সেই পুঞ্জীভূত রাগ সবকিছু ওলটপালট করে দেবে । রাগ কি তবে হয় না কারোর ? কোথায় যায় সেই রাগ ?
"গুলাম" ছবির শেষ সিকোয়েন্স । শহরের ত্রাস ... স্মাগলার, "হপ্তা"-আদায়কারী, দাঙ্গা- লাগানোকারী ইত্যাদি ইত্যাদি অসীমবল ভিলেনের সামনে তারই দলের প্রাক্তন সদস্য আমীর খান । চেহারায় ভিলেনের কাছাকাছিও নন । কিন্তু তবু চ্যালেঞ্জ জানিয়েছেন তাকে । তার এতদিনের রাজত্বকে । দুজনের চূড়ান্ত মোকাবিলা । তাদের ঘিরে দাঁড়িয়ে সমস্ত মহল্লা । দর্শক হিসেবে । লড়াই শুরু হয় । নিয়মানুযায়ী নায়ক আমীর প্রচণ্ডভাবে প্রহৃত হন প্রথমে, মাটিতে শুয়ে রক্তাক্ত মুখে যখন প্রায় অজ্ঞান, তখনই শুনতে পান কানের কাছে কে যেন বলছে, "দাদা, উঠ, চল উঠ" (এরকমই ছিল কিছু যতদূর মনে পড়ছে, ভুল হলে পাঠক-পাঠিকারা নিজগুণে মাপ করে দেবেন), অমনি আমীর উঠে দাঁড়ালেন, টলতে টলতে, তাঁর গায়ে চলে এল সহস্র হাতির জোর, এতক্ষণ যে ঘুষিগুলো ভিলেনের মুখে আঁচড়টি কাটতে পারছিল না, সেগুলি হয়ে গেল মুগুরের ঘা । একমিনিটের মধ্যে ভিলেন কুপোকাত । তার নিদানে বন্ধ হয়ে যাওয়া সমস্ত দোকানপাট ঝপাঝপ খুলে গেল । ন্যায়ের জিত । মিষ্টি হেসে নায়িকা দাঁড়িয়ে । আমীরের পুরস্কার ।
এবং সমস্ত রাগের ধুয়ে যাওয়া । অস্বীকার করব না যে, এই পুরো ব্যাপারটা দেখার সময় আমিও আমীরের সঙ্গে সঙ্গেই ভিলেনকে ঠ্যাঙাচ্ছিলাম । শেষ পর্যন্ত সে যখন মুখ থুবড়ে পড়ল পরাজিত হয়ে, তখন মনে মনে আমিও বিজয়ের আনন্দ পেয়েছিলাম । অথচ বাস্তবে আমি কখনও এইরকম অপরাধ-জগতের শাহেনশাদের দ্বারা প্রভাবিত হব না হয়ত । কিন্তু যারা হয়, যাদের সত্যি সত্যিই এক আদেশে সমস্ত দোকানপাট বন্ধ করে দিয়ে বসে থাকতে হয় ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে, যাদের সপ্তাহান্তে মোটা টাকা তুলে দিতে হয় পাড়ার "দাদা"-দের হাতে, তারা আমীরকে দেখে এক স্বপ্নের ত্রাণকর্তা হিসেবে । সত্যি সত্যি যে কোনোদিন তাদের বাঁচাতে আসবে না, কিন্তু রুপোলি পর্দার স্বপ্নছবিতে তাদের রাগটা ধুয়ে দিয়ে যাবে, একটানা অবদমিত হওয়ার তিক্ত অপমান সইতে শেখাবে । আর এই সিস্টেমে টিকে থাকার শক্তিটা দেবে ।
আর যদি উল্টোটা হত ? যদি দেখা যেত যে "দাদা উঠ" বলা সত্ত্বেও আমীর উঠতে পারলেন না আদৌ, উলটে ভিলেন আরও কয়েকটা "ফিনিশিং টাচ" ঘুষির দ্বারা তাঁর পঞ্চত্বপ্রাপ্তি ঘটাল এবং দোকানগুলো বন্ধই রইল ? মানুষগুলো মাথা নিচু করে ফিরে গেল যে যার ঘরে ? তা হলে ?
তা হলে আর কি, "গুলাম" ফ্লপ করত !
আর আমরা কি তবে বিপ্লব করতাম ? মানুষগুলোর জমে-থাকা রাগ বয়ে যাবার ছিদ্রটা না পেয়ে কি ফেটে পড়ত ? কে জানে । হয়ত না ।
একটা জিনিস লক্ষণীয় অবিশ্যি, অধুনা হিন্দি সিনেমা অনেকটাই চলে অপরাধ-জগতের টাকায়, সিনেমা-স্টারদের সঙ্গে দাউদ ইব্রাহিম, ছোটা শাকিলদের দহরম মহরম সর্বজনবিদিত । কেন টাকা ঢালে অপরাধ-জগৎ হিন্দি সিনেমায় ? একটা কারণ অবশ্যই হল ব্যবসায়িক লাভ, কিন্তু শুধু তাই বোধহয় নয় । বোধহয় এইজন্যেই যে, অপরাধ-জগত্কে অনেকটাই জীইয়ে রেখেছে হিন্দি সিনেমা । যে প্রতিবাদ আমজনতা করে উঠতে পারে না দাউদের বিরুদ্ধে, যে প্রতিশোধ নেওয়া হয় না কখনও, সঞ্জয় দত্ত সেলুলয়েডে একা তা করেন-সিনেমার ক্লাউন দাউদদের দফারফা ঘটিয়ে, বাস্তব দাউদকে বাঁচিয়ে-বর্তে রাখেন ।
তারপর ধরা যাক রাজনীতিকদের কথা । ভারতের রাজনীতিতে প্রত্যক্ষভাবে গুণ্ডাদের প্রবেশ সত্তর দশকের শেষের দিক থেকে । সেই সময়ই তারা প্রকাশ্যে ভোটে দাঁড়িয়ে জিততে শুরু করে । মন্ত্রী হতে থাকে । এবং হিন্দি সিনেমার ভিলেনও হতে থাকে । যারা শেষে হিরোর কাছে নির্দয়ভাবে মার খায় । ভরা বিধানসভা বা পার্লামেন্টে সিকিউরিটি-কর্ডন ভেঙে আসা কর্তব্যপরায়ণ পুলিশ অফিসার (এর আগে যাঁর কন্যাহত্যা, স্ত্রীহত্যা, চাকরি থেকে সাসপেন্সন ইত্যাদি ঘটেছে মন্ত্রীমহোদয়ের দাক্ষিণ্যে) সিনেমাটিতে অসৎ মন্ত্রীকে সকলের সামনে কোতল করেন, অবশ্যই আগে একটি লম্বা ভাষণ ঝেড়ে (দ্রষ্টব্য "শূল") । এরকম বহু বহু সিনেমা আছে । সত্যিকারের রাজনীতিতে আমরা গুণ্ডাদের ভোট দিয়ে জেতাই । এবং "আখরি রাস্তা"য় তাদের শাস্তিটা দেখে নিই ।
এই লেখার কি কোনো ভিত্তি আছে ? সিনেমা বা সেরকমভাবে কোনো শিল্পই কি পারে কোনোরকম সামাজিক পরিবর্তন আনতে ? সাহিত্যের মানুষকে প্রভাবিত করার কিছু নিদর্শন আছে, ভলত্যেয়ার রুশোর জ্বালাময়ী লেখার ফরাসি বিপ্লবে অবদান ঐতিহাসিকভাবে স্বীকৃত, রুশ বিপ্লবেও লেনিন ট্রটস্কির লেখালেখি অনেকটাই চাগিয়ে তুলেছিল মানুষকে । আধুনিক কালেও রুশদির "স্যাটানিক ভার্সেস" নিয়ে মৌলবাদীদের প্রচণ্ড রোষ স্মরণীয়-ভারতে বইটি এখনও নিষিদ্ধ । সাহিত্যের চেয়ে সিনেমা মানুষের অনুভূতিকে স্পর্শ করে অনেক সরাসরিভাবে । স্বাভাবিকভাবেই সিনেমার আঘাত করার ক্ষমতাও অনেক বেশি । সেই জন্যেই জরুরি অবস্থায় একের পর এক "নিরীহ" ছবি ক্যানবন্দী থেকেছিল, এখনো "ওয়াটার"-কে নিয়ে চূড়ান্ত জলঘোলা হয়ে ছবিটি শেষ অবধি শুটিং-পর্বেই আটকে যায় । এই অবস্থায় বলা যেতেই পারে যে সিস্টেমের মুখোশ খুলে দেওয়া ছবিকে ভয় খায় সিস্টেম এবং প্রাণপণে দমিয়ে রাখতে চায় । এই সিস্টেমকে বাঁচিয়ে রেখেছি আমরা-প্রাণপণ তাকে গালাগাল করে যাই, অথচ কোথাও আটকে গেলে আগে ঘুষ দিই, ঘুষ খাই যথেচ্ছ, ভাড়াটে তুলতে গুণ্ডা লাগাই-এককথায় সুবিধেমত দুর্নীতি, অসততার চূড়ান্ত ব্যবহার করে বেড়াই । এবং তারপর সৎ কর্তব্যপরায়ণ পুলিশ অফিসারটির শেষমেষ জিৎ দেখে প্রলেপ লাগাই ক্ষতবিক্ষত বিবেকে । ঘুণ ধরে যাওয়া প্রশাসন, অব্যবস্থা, শোষণ-সবকিছু চলতে থাকে অপ্রতিহতভাবে ।
আমাদের খুব একটা রাগও হয় না ।
অনেকে হয়ত বলবেন যে, এ দরকার । চতুর্দিকে যে ধরনের পচনের মুখোমুখি আমাদের হতে হয় দৈনন্দিন জীবনে, তারপর সিনেমাতেও সেই একই জিনিস দেখার কোনো মানে হয় না । বড়োই মন খারাপ লাগে, চাপ সৃষ্টি হয় । ভুলে যাওয়া যায় না । সারাদিনের খাটাখাটনির পর, বিবিধ-বিভিন্নসমস্যার প্রাণপণ মোকাবিলা করার পর, রুপোলি পর্দায় আবার সেই একই জিনিসের পুনরুথ্থাপন অর্থহীন । বন্ধ করে দেওয়া উচিত এ ধরনের নেগেটিভ সিনেমা । সেই কালো-কালো রোগা-রোগা না-খেতে-পাওয়া মানুষ ভর্তি মৃণাল সেন মার্কা সিনেমা-উফ হরিবল । সিনেমা হল থেকে বেরিয়ে দর্শক ভুলে যায় সবকিছু, অতএব এইসব দেখানো সম্পূর্ণ বোকামি । "দারিদ্র বেচে" বাইরের ফিল্ম-ফেস্টিভালে পুরস্কার পাওয়া । তার চেয়ে এক ঘরের ঝুপড়িতে থাকে কিন্তু নিত্যনতুন জিনস পাল্টায়, এরকম নায়ককে দেখে আনন্দ পাওয়া ঢের ঢের কাজের । তিন ঘন্টার জন্যে ভুলে যাওয়া যায় তো যাক না, পাল্টানো তো আর যাবে না কোনোদিন, কিছুকে !
কিন্তু সত্যিই কি হল থেকে বেরিয়ে মানুষ ভুলে যায় সবকিছু ? তবে কেন বিশেষ সময়ে বিশেষ সিনেমা নিষিদ্ধ হয়, সেন্সর-বোর্ড ধারালো তলোয়ার নিয়ে বসে থাকে "আপত্তিকর" কিছু থাকলেই ঘচাং-ফু: করে দেওয়ার জন্যে ?
আসলে বোধহয় রাগ করানো যায় ।
"খারিজ" সিনেমাটির কথা মনে করা যাক । সিনেমাটি এক বার বছরের গ্রাম-থেকে-শহরে- চাকর-হয়ে-আসা ছেলেকে নিয়ে-মধ্যবিত্ত যে বাড়িতে সে কাজ করত, তাদের চূড়ান্ত অবহেলার ফলে মারা যায় সে । সময়টা ছিল শীতকাল, কুড়ি বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি শীত পড়েছিল সেবার, রাত্রিবেলা রান্নাঘরে শুয়ে শুয়ে অসহ্য শীতে জমে যাচ্ছিল ছেলেটি যথেষ্ট গরমজামা দেওয়া হয়নি তাকে । সহ্য করতে না পেরে উনুন জ্বালিয়ে দেয় সে, আর সারারাত ধরে বন্ধঘরে উনুনের ধোঁয়ায় দমবন্ধ হয়ে মারা যায় । তারপর যথারীতি পুলিশ কেস হয়, এবং কায়দা করে ব্যাপারটা ধামাচাপা দিতে সক্ষম হয় দম্পতি । ছবির শেষে ছেলেটির বাবা আসে দম্পতির বাড়িতে তার অন্য ছেলেকে নিয়ে, মৃতের একমাত্র সম্বল-একটি ছোটো পুঁটলি নিয়ে যাওয়ার জন্যে । দৃশ্যটি এরকম-সিঁড়ির নীচে দাঁড়িয়ে বাঁকের কাছে তরুণ গৃহস্বামী । তার চোখে ভয়, কারণ মনে মনে সে অপরাধী, এক নিষ্পাপ বালকের হত্যাকারী । আইনের ফাঁক দিয়ে পালালেও মৃতের বাবার কাছে সে খুনী, নিজের বিবেকের কাছেও । দুজনে ধীরে ধীরে এগিয়ে আসে একে অপরের দিকে-সিঁড়ির মাঝামাঝি মুখোমুখি হয় । নিস্তব্ধতায় পেরিয়ে যায় কিছু মুহূর্ত । এইবার হয়ত রোগা টিঙটিঙে হাত ফেটে পড়বে পুষ্ট গালে-বিনা বাক্যব্যয়ে সেই চড় হজম করবে মধ্যবিত্ত, তার কিছু বলার নেই । সেইটিই হবে পুত্রহারার প্রতিবাদ, সান্ত্বনাও । কিন্তু কিছুই হয় না । ভাঙা গলায় লোকটি বলে, "আসছি বাবু"। এবং ধীরপায়ে নীচে নেমে যায় । আমরা বিস্মিত হই । অত্যন্ত অসন্তুষ্ট চিত্তে হল ছেড়ে বেরিয়ে আসি ।
রাগটা বেরোতে পারে না । ।
মৃণাল সেন পরে বলেছিলেন যে ব্যাপারটা তিনি করেছিলেন পুরোপুরি ইচ্ছাকৃতভাবে, মানুষকে রাগাতে । ওই একটা চড় যে ততক্ষণ অবধি সিনেমাটির সৃষ্টি-করা দমচাপা পরিবেশ দমকা হাওয়ায় উড়িয়ে নিয়ে যাবে, তা বুঝেই ।
মানুষকে রাগাতে ।
কিন্তু আমরা "খারিজ" দেখি না । আমরা দেখি "জঙ্গ" । সমাজের যাবতীয় নীচতার বিরুদ্ধে একা মানুষের লড়াই, এবং জিত্-ও ।
কারণ, না দেখলে এই সিস্টেমটা একটু গুরুপাক হয়ে যেতে পারে !