• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ২৯ | মার্চ ২০০৩ | গল্প
    Share
  • নিতাইয়ের দ্বিতীয় পক্ষ : সাবর্ণি চক্রবর্তী



    ওপরে ওঠার লিফটের সামনে দাঁড়িয়ে নিতাই লোকটাকে নজর করে দেখছিল । লম্বা-চওড়া বলিষ্ঠ চেহারার মাঝবয়েসী লোক । খুব দামি স্যুট পরে আছে । দাম্ভিক উন্নাসিক চেহারা । লোকটার প্রচুর টাকা । নিতাই বুঝতে পারে । এ-হোটেলে পয়সাওয়ালা লোকের যথেষ্ট আনাগোনা আছে । তাদের অনেক দেখেছে নিতাই ।

    রিসেপশন কাউন্টারের সামনে দাঁড়িয়ে লোকটা ফর্মে নিজের নামধাম লিখছিল । কাউন্টারের উল্টোদিকে দাঁড়ানো রমেন রায় । এই হোটেলের ক্লার্ক । অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে ঘাড় ঝুঁকিয়ে দাঁড়িয়েছিল রমেন । ফর্মে লেখা শেষ করে লোকটা সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে খুব তাচ্ছিল্যের সঙ্গে কাগজটা রমেনের দিকে ঠেলে দিল । বেশি করে ঘাড় ঝুঁকিয়ে রমেন বলল, থ্যাংক য়্যু, স্যার । তারপর হাতের ইশারায় নিতাইকে কাছে ডাকল ।

    কাউন্টারের সামনে গিয়ে সেলাম করে দাঁড়াল নিতাই । রমেন ঘরের দরজার চাবিটা নিতাইয়ের হাতে দিল । তারপর মেঝেতে রাখা একটা বড়ো স্যুটকেস আর একটা মোটা ব্রিফকেস আঙুল দিয়ে দেখিয়ে বলল, সাহেবকে ঘরে নিয়ে যা ।

    পেতলের তৈরি সুদৃশ্য চাবি, তার সঙ্গে লাগানো আছে পেতলের ভারি আয়তক্ষেত্রাকার চাকতি । তাতে সুন্দর করে খোদাই করা আছে ঘরের নম্বর । নিতাই নম্বরটা দেখে নিল । পাঁচশো-এক । এ-হোটেলের সবচেয়ে দামি কামরা । একদিনের ভাড়া পাঁচ হাজার টাকার ওপর ।

    চকচকে পরিষ্কার মার্বেল পাথরের মেঝে । তার ওপর থেকে ভারি স্যুটকেসটা ডান-হাতে তুলে নিল নিতাই । বাঁ-হাতের মুঠোয় ঘরের চাবি আর বাঁ হাতেরই তিন আঙুল দিয়ে ধরা ব্রিফকেসের হাতল -- মাথা ঝুঁকিয়ে খদ্দেরকে বলল, প্লীজ কাম স্যার । তারপর লিফটের দিকে এগোল -- পেছনে খদ্দের । এই হোটেলে কাজ করে ছোটোখাটো কয়েকটি ইংরিজি কথা শিখে গিয়েছে নিতাই ।

    লিফটে উঠতে উঠতে নিতাই স্যুটকেসটা দেখে নিচ্ছিল, অনেক দেশের এয়ারলাইন্সের নাম লেখা কাগজের লেবেলের টুকরো এটার গায়ে লেগে আছে । কাগজ একবার সাঁটবার পর সেটা ছিঁড়ে ফেললেও পুরোটা ওঠে না । ওই টুকরোগুলোর থেকে নিতাই আন্দাজ করে নিল লোকটা দুনিয়ার অনেক দেশে ঘুরে বেড়ায় । ওর শ্রদ্ধাটা তাতে আরও বেড়ে গেল ।

    কামরা খুলে প্রথমে আলো জ্বালল নিতাই । তারপর মাল ভেতরে নিয়ে গেল । কামরাটা এত বিরাট -- এটাকে প্রায় একটা সাজানো ফ্ল্যাটই বলা চলে । শোবার ঘরটা প্রকাণ্ড -- দামি খাটে দুজনের বিছানা । চারপাশে আয়না -- জামা রাখার জন্যে দামি কাঠের সুদৃশ্য ওয়ারড্রোব -- তার ভেতরে স্যুটকেস রাখার জায়গা । ফ্রীজে রাখা রয়েছে সফট ড্রিংকস । খাটের পাশে একটা কাঁচের ছোটো টেবিল -- তার ওপাশে চারটে গদিমোড়া বেতের চেয়ার । শোবার ঘরে ঢোকার আগে আর একটা অপেক্ষাকৃত ছোটো ঘর -- দামি সোফা আর সেন্টার-টেবিল দিয়ে সাজানো । পড়াশোনা করার জন্যে রাইটিং-টেবিল, চেয়ার, সবই রয়েছে । দুটো ঘরেই দামি টিভি রয়েছে । ঘরের রাস্তার দিকের দেয়ালের অর্ধেকটা মোটা কাঁচের তৈরি -- দামি পর্দা দিয়ে ঢাকা । এয়ারকণ্ডিশনারটা চালিয়ে দিল নিতাই । তারপর সেলাম ঠুকে যেন ঘরের বাইরে বেরিয়ে যাচ্ছে এরকম ভাব দেখাল ।

    লোকটা কোটের পকেট থেকে দুটো দশ টাকার নোট বার করে ওর দিকে এগিয়ে দিল । নিতাই টাকাটা নিয়ে আবার সেলাম দিল । লোকটার হাত খুব দরাজ মনে হচ্ছে ।

    মিনিট দশেক পরে কামরার দরজায় টোকা দিয়ে আবার ঘরে ঢুকল নিতাই । লোকটা হাতে রিমোট ধরে টিভিতে ছবি দেখছে । অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত পোষাক পরা একটি বিদেশিনী যুবতী বা মহিলা -- পাগলির মতো এলোমেলো ঝাঁকড়া চুল -- হাতে করে মুখের কাছে মাইক নিয়ে অঙ্গভঙ্গি করে নেচে নেচে গান গাইছে । পেছনে এক যুবক বসে দুহাতে কাঠি নিয়ে চোখ বন্ধ করে এন্তার ড্রাম পিটিয়ে যাচ্ছে -- আর একপাল যুবক-যুবতী মাথা ঝাঁকিয়ে ঝাঁকিয়ে বিচিত্র সব শরীরের ভঙ্গি করছে । নিতাইয়ের হাতে একটা বড়ো ট্রে -- তার ওপরে বেতের টুকরি । টুকরিতে নানারকম ফল সাজানো -- কলা, আপেল, কমলালেবু, বেদানা, কাগজের ন্যাপকিন দিয়ে সুন্দর করে ঢাকা । ফল কাটবার জন্যে ট্রেতে একটা ছুরিও রয়েছে । ফলের টুকরি সমেত ট্রে টেবিলের একপাশে রেখে নিতাই সোজা হয়ে দাঁড়ালো । লোকটার চোখ টিভিতে আটকে আছে -- ওর দিকে তাকিয়ে দেখছেই না । কামরা থেকে বেরিয়ে এল নিতাই -- দরজাটা টেনে বন্ধ করে দিল । শালা এবারে আর বকশিশ দিল না । কামরায় ফল পৌঁছে দেওয়া নিতাইয়ের ডিউটির ভেতর পড়ে না । ওটা করে ভোলা । আরো বকশিশ পাবে এই লোভে নিতাই তাড়াতাড়ি করে ওই কামরায় ফল পৌঁছে দিতে ছুটেছিল । কোনো লাভ হল না । ধ্যুত্ত্তেরি ।


    নিতাইয়ের ডিউটি শেষ হয় রাত আটটায় । ওর বউ রেখাও ছুটি পায় একই সময় । নিতাই আর রেখা -- দুজনেই হোটেল থেকে উর্দি পায় ডিউটি করার সময় পরবার জন্যে । কাজ শেষ হলে নিজেদের পুরনো জামাপ্যান্ট আর শাড়ি পরে -- তারপর বাড়ি যায় ।

    হোটেল থেকে অনেক দূরে থাকে ওরা । বাসে পাকা একঘন্টা । তারপর অন্ধকার গলির রাস্তায় হাঁটতে হয় মিনিট কুড়ি । দুজনে মিলে হোটেলের চাকরি পাবার পর ওরা এখানে উঠে এসেছে । নিতাইয়ের হোটেলের চাকরি প্রায় বছর চারেক । তার আগে ছিল প্রাইভেট বাসের কণ্ডাক্টার । থাকত আরো দূরে একটা বস্তির ঘরে -- টিনের চাল, কাঁচামাটির মেঝে । ঘরে ছিল বাতাসী -- নিতাইয়ের প্রথম পক্ষের বউ । বাসের চাকরিতে অনেক রাতেই বাড়ি ফেরা হোত না । বাসেই শুয়ে থাকত । সারাদিন ধরে চলন্ত বাসে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে লোকের ভিড় ঠেলে ঠেলে পয়সা আদায় করা । মনে হোত বুকের পাঁজরা ভেঙে যাবে -- পায়ের গোছের শিরায় শিরায় রক্ত জমে ফেটে যাবে । যে-কদিন বাড়ি আসত, মড়ার মতো পড়ে ঘুমোত । সোহাগ না-পেয়ে মনে মনে গুমরে মরত বাতাসী । তারপর লুকিয়ে লুকিয়ে ঘরে আসতে শুরু করল পল্টু । ট্যাক্সি চালাত । থাকত ওই বস্তিতেই । পড়শীরা চোখ খুলে রেখে যা দেখত নিতাইয়ের কানে তা গুজগুজ ফুসফুস করে যেত । একদিন বাতাসীকে ধরে বেধড়ক পিটল নিতাই । দু-দিন পরে ফিরে এসে দেখে ঘর খালি । বাতাসী নেই । ওর ছোটো টিনের বাক্সটাও নেই । পল্টুও সেই সঙ্গে হাওয়া । রাত করে বাড়ি ফিরছে -- বউ পালিয়েছে, ঘরে একদানা চাল নেই, স্টোভে তেল নেই । খিদের মুখে বউ এর চাইতে রান্না করা ভাতেরই দরকার বেশি । ফঁংআঁকা ঘরে বাতাসীকে গালাগাল দিয়ে খিদে পেটে চেপে রাত জেগে শুয়ে রইল নিতাই । সকালে উঠে ওদের বাস রাতে যে-রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকে সেখানে গেল । সেখানে রাস্তার পাশে ইঁট সাজিয়ে উনুন করে সকালে কচুরি ভেজে বিক্রি হয় । সারা রাতের খিদে পেটে নিয়ে নিতাই সেদিন কচুরি একটু বেশিই খেয়ে ফেলেছিল ।

    তারপর এক নেতাকে ধরাধরি করে এই হোটেলের চাকরি । এ চাকরি অনেক আরামের । হোটেল অবশ্য ওর চাকরি পাকা করে না । মাসে কুড়িদিন রাখে -- আবার দশদিন ছাঁটাই করে । খাতায় মাইনে লেখা থাকে পাঁচ হাজার টাকা -- কিন্তু সে-খাতায় সই করিয়ে হাতে দেয় তিন হাজার । তবুও আগের কাজের চাইতে ভাল । তারপর রেখাকে ঘরে আনল নিতাই । হোটেলের চাকরি সেরে রোজ রাতেই বাড়ি ফিরে আসত । খাঁ খাঁ খালি ঘর । হাত পুড়িয়ে রান্না তবু সয়ে যায় -- কিন্তু ফাঁকা বিছানায় একা একা শোয়া ? দুপুরে হোটেলে ভরপেট খাবার খায় -- একটু পুরনো হয়ে যাওয়া মুরগি, নরম হয়ে আসা মাছ । সে খাবারে গা গরম হয়ে ওঠে -- সেই গরম বেরোবার রাস্তা খোঁজে ।

    অতএব দ্বিতীয় পক্ষ এল নিতাইয়ের ঘরে । তখন নিতাইয়ের বয়েস পঁয়তিরিশ -- রেখার এই আঠেরো উনিশ । রেখার বুড়ো বাপ আর খাণ্ডার সত্‌-মা খুব খুশি হয়ে মেয়েকে দোজ পক্ষের গলায় ঝুলিয়ে দিয়েছিল । খাওয়ার একটা মুখ বাড়ি থেকে দূর হলেই হোল ।

    একরাতে বৃষ্টি পড়ছিল মুষলধারে -- টিনের চালের ওপর তোড়ে বৃষ্টির ফোঁটা পড়ার চড়বড় আওয়াজ -- ঘরের ভেতর অন্ধকারে কচি বয়েসের নতুন বৌকে জাবড়ে ধরে সোহাগ করছিল নিতাই । ঘরের চাল থেকে বড়ো একটা ঠাণ্ড জলেরা ফোঁটা টপ করে পড়ল গালে -- তারপর টুপটাপ করে পড়তেই লাগল সমানে । টিনের চাল চুঁইয়ে জল আসছে । নিতাইয়ের বউ-সোহাগের সুখ তখন মাথায় । সেই মাঝরাত্তিরে উঠে লন্ঠন জ্বালো, টানাটানি করে চৌকি বিছানা সরাও -- যাতে ভিজে না যায় । ছোট্টো অতটুকু ঘরে চৌকি সরাবার জায়গাই বা কোথায় ?

    তখন অন্য ঘর খোঁজার চিন্তা । পাকা ছাদ চাই -- নইলে নতুন বিয়ের আনন্দই বরবাদ । ঘরের খোঁজ পাওয়া গেল -- ছাদ পাকা, মেঝে পাকা, বিজলী বাতিও আছে -- কিন্তু ভাড়া মাসে পুরো হাজার টাকা, তার ওপর বাড়িওলাকে সেলামি দিতে হবে সাত হাজার । তখন নিতাইয়ের মাথায় বুদ্ধি খেলল । ওর হোটেলে মেয়েদেরও কাজে নেয় । ধরাধরি করে রেখাকে কাজে ঢোকাল নিতাই । তারপর ধারদেনা করে সেলামির টাকা জোগাড় করে নতুন ঘরে উঠে এসে সংসার পেতে বসেছে ওরা ।

    হোটেল কিন্তু রেখাকে টাকা আরও কম দেয় । এই হাজার দেড়েক মতো । কোনো কোনো মাসে একটু বেশিদিন ডিউটি করতে দেয় -- সেসব মাসে জোর দুহাজার । নিতাই একবার অনেক চেষ্টা-চরিত্র করে নির্মল চ্যাটার্জীর সঙ্গে দেখা করেছিল । নির্মলবাবু হোটেল মজদুর সংঘের নেতা । উনি ব্যস্ত ছিলেন তখন । বললেন -- হ্যাঁ হ্যাঁ, আমাদের কাছে এই কম মাইনে দেওয়ার খবর আছে । হবে হবে -- সময়মতো সব কিছু হয়ে যাবে । তবু তো তোমরা স্বামী-স্ত্রী কাজ করছ । অনেকের তো কাজই নেই ।

    নির্মল চ্যাটার্জীর একজন ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র চেলা এই হোটেলে কাজ করে । স্টোরকিপার নগেন । হোটেলের কর্মচারীদের থেকে মজদুর সংঘের চাঁদা তোলে । নিতাই আর রেখা দুজনেই মাসে একশ টাকা করে ইউনিয়নকে চাঁদা দেয় । যারা পুরনো, চাকরি পাকা হয়ে গেছে, তাদের চাঁদার হার আরও বেশি ।

    রতে ফেরার সময় এই অন্ধকার গলির পথটুকু হাঁটা ওদের পক্ষে বেশ অস্বস্তিকর । রেখার চেহারা রোগা, অপুষ্ট, কিন্তু মুখখানা ঢলঢলে । এ-রাস্তায় একটা চায়ের দোকান আছে । রাস্তার খানিকটা জায়গা দখল করে একটা লম্বা বেঞ্চ রাখা রয়েছে -- খদ্দেররা সেখানে বসে চা খায় । রাতের বেলায় এ দোকানে দেশি মদও বিক্রি হয় । ওদের বাড়ি ফেরার সময়ে কতগুলো জোয়ান ছেলে ওই বেঞ্চে বসে গুলতানি করে । রেখাকে দেখলেই ওরা টিটকিরি দেয় । দূর থেকে ওদের দেখতে পেয়েই রেখার হাত চেপে ধরল নিতাই । তারপর মাথা নিচু করে রাস্তার ওপর চোখ রেখে হাঁটতে লাগল ।

    চায়ের দোকানটার পাশ দিয়ে যাবার সময় অনেকগুলো গলার হাসি শুনল নিতাই । সেইসঙ্গে সব মন্তব্য -- ও চমচমি, ওই বুড়োটাকে ছেড়ে একটু আমাদের দিকে তাকাও -- আমাদের সঙ্গে শুয়েই দেখ না কেমন লাগে -- ওদের দিক থেকে ছুঁড়ে মারা একটা কাগজের টুকরো এসে লাগল রেখার গায়ে ।

    নিতাইয়ের কান মাথা ঘাড়ে রক্ত দপদপ করে -- বুকে ধকধকানির আওয়াজটা বাড়ে । রেখার হাত আরও শক্ত করে চেপে ধরে নিতাই, আরও জোরে হাঁটে । নিরাপদ দূরত্বে এসে রেখা গোসা করে । ঠোঁট ফুলিয়ে নিতাইকে বলে, তুমি কেমন পুরুষমানুষ ? তোমার ঘরের মাগকে অপমান করে -- তুমি কিছু বলতে পার না ?

    নিতাই চুপ করে থাকে । ওর বুকের খাঁচা চৌতিরিশ ইঞ্চির বেশি নয় -- হাত পা গুলোও রোগা রোগা । ওই ছেলেগুলোর গাঁট্টাগোট্টা ষণ্ডামার্কা চেহারা । তার ওপর ওরা কানা নান্টার দলের ছেলে । এ-তল্লাটের বাজারটার থেকে, সব দোকানিদের থেকে তোলা আদায় করে কানা নান্টা । সেই তোলার ভাগ আবার যায় ওপর মহলে । পুলিশ-টুলিশকে থোড়াই কেয়ার করে ওরা । ওরা আবার পকেটে মেশিন-টেশিনও রাখে । একটু টাকা পয়সার সুরাহা হলে যদি অন্য জায়গায় উঠে যাওয়া যায় । ভাগ্যিস এখনও বাচ্চা-টাচ্চা হয়নি -- ঝাড়া হাত-পায়ে অনেক সুবিধে । রেখা আজকাল গাঁইগুঁই করতে শুরু করেছে -- ওই যে ডাক্তারখানায় গিয়ে মাসে মাসে বাচ্চা না-হওয়ার জন্যে ইনজেকশন নিয়ে আসে তা বন্ধ করে দিতে চাইছে । নিতাই ওকে বোঝায় -- এখনও কয়েক বছর ওসব ভাবা যাবে না । বাচ্চা হওয়া মানেই একগাদা খরচা বেড়ে যাওয়া । তার ওপর রেখারও তো আর চাকরি থাকবে না । তখন চলবে কি করে ? ঘরভাড়া দিয়ে, সেলামির ধারের টাকার সুদ মিটিয়ে যা বাকি থাকবে তাতে খাবে কি ?

    এ সপ্তাহটা পুরোটাই ডিউটি পাওয়া গিয়েছে । সামনের সপ্তাহেই হয়তো দিনকয়েক কাজ থেকে বসিয়ে দেবে । খুব সকালে স্নান-টান সেরে বেরিয়ে পড়তে হয় ওদের । সাড়ে সাতটা থেকে ডিউটি । সাতটায় পৌঁছে হোটেলের উর্দি পরে নিতে হয় । তখন ফাউ হিসেবে পাওয়া যায় এক-কাপ চা আর মোটা করে কাটা চার পিস পাঁউরুটি । মাখন কিম্বা জ্যাম মাখানো । যেসব খদ্দের পাঁউরুটি টোস্ট খেতে চায় তাদের আলাদা প্লেটে মাখন আর জ্যাম দেওয়া হয় । খদ্দের হয়তো অল্প একটু রুটিতে লাগায় -- এসব বেশি খেলে কোলেস্টেরোল বেড়ে যাবার ভয় আছে । যা পড়ে থাকে সেসব নিতাই, রেখা, ভোলাদের দেওয়া হয় । এর দাম তো খদ্দের নাস্তার বিলের সঙ্গে দিয়েই দিয়েছে । চিবোন মাখন রুটির দলা আধঠাণ্ডা চা দিয়ে তাড়াতাড়ি করে গেলে নিতাই । রেখা খাওয়া শেষ করে উঠে গেছে । ওদের খাবার দেয় মন্টু -- কিচেনের চার্জে থাকা বেয়ারা । ব্যাটা এমন পাজি চায়ে চিনিটাও ঠিকমতো দেয় না । রাস্তার ওপাশে, হোটেলের উল্টোদিকেই একটা বড়ো মিষ্টির দোকান । তার মালিকের সঙ্গে প্রায়ই গুজগুজ ফুসফুস করে মন্টু । নির্ঘাৎ চিনি ময়দা এসব বিক্রি করে দেয় । হেড-কুকও নিশ্চয়ই ভাগ পায় । নইলে একা মন্টু কি আর এসব করতে পারত ?


    সাড়ে সাতটা প্রায় বাজে । এ-ঘরে ঘন ঘন ফোন আসতে শুরু করেছে । বিভিন্ন ঘরে খদ্দেররা নাস্তার অর্ডার দিচ্ছে । তাদের ঘরে খাবার পৌঁছে দিতে হবে । মন্টু ফোন ধরে অর্ডার নেয় । তারপর সেটা বিলে লিখে নিয়ে হেড-কুককে জানিয়ে দেয় । মন্টু ইংরেজি হিন্দি দুইই শুনে বুঝতে পরে -- অল্প অল্প বলতেও পারে । সেজন্যে ওকে এই ডিউটিতে রেখে দিয়েছে । ওর চাকরি পাকা -- মাইনেও অনেক বেশি ।

    পাঁউরুটি খাওয়া শেষ করে মেঝেয় উবু হয়ে বসে কাপের চা-টুকু শেষ করে নিতাই । মন্টু ওর হাতে একটা বিল ধরিয়ে দিল । এই অনেক খেয়েছিস -- এবার ওঠ । পাঁচশো-এক নম্বরে নাস্তা পৌঁছে দিয়ে আয় ।

    এই ডিউটি ভোলার । কিন্তু আজ থেকে তিন চারদিন ভোলাকে কাজ দেবে না হোটেল কর্তৃপক্ষ । এখন এই ডিউটি নিতাইকে করতে হবে । কাপের তলানি চা-টুকু এক চুমুকে গিলে নিয়ে নিতাই উঠে পড়ল । মূল রান্নাঘর আর এ-ঘরটার মাঝখানে একটা পার্টিশন -- তাতে সার্ভিস উইণ্ডো রয়েছে । নিতাইদের রান্নাঘরের ভেতরে ঢোকা বারণ । ও সার্ভিস উইণ্ডোর সামনে দাঁড়াল । হেড-কুক দুটো ট্রে ওই উইণ্ডো দিয়ে নিতাইয়ের সামনে ঠেলে দিল । একটাতে চায়ের সরঞ্জাম, আরেকটায় সব খাবার ঢাকা দিয়ে রাখা । বলল, পাঁচশো-এক নম্বর ।

    হাতে দুটো ট্রে একটা আর একটার ওপর ব্যালেন্স করে রাখা -- ঘরের দরজার হাতল ঘুরিয়ে দেখল নিতাই । দরজা ভেতর থেকে বন্ধ । ট্রে-দুটো বিলক্ষণ ভারি । একহাতে ধরে রাখা রীতিমতো কষ্টকর । তাড়াতাড়ি করে দরজার বেল বাজিয়েই দু-হাত দিয়ে ট্রে সামলে নিল ।

    প্রায় মিনিটখানেক লাগল দরজা খুলতে । লোকটা এখনো স্নান করেনি । পরে আছে একটা দামি ড্রেসিং-গাউন । তার ফাঁক দিয়ে ওর রোমশ বলিষ্ঠ চওড়া বুকের ছাতি দেখা যাচ্ছে । লোকটা দাড়ি কামাচ্ছে -- এক গাল সাবানের ফেনায় পুরো ঢাকা, অন্য গালের সাবান রেজারের টানে টানে জায়গায় জায়গায় পরিষ্কার হয়ে গিয়েছে । লোকটার হাতে রেজারটা ধরা -- রেজারের মাথাটা সাবানের ফেনায় ভর্তি । সেন্টার-টেবিলটা আঙুল দিয়ে দেখিয়ে লোকটা ভেতরের ঘরে ঢুকে গেল । বাথরুমটা ভেতরের ঘরের লাগোয়া ।

    খাবার আর চায়ের ট্রে সেন্টার-টেবিলের ওপর নামিয়ে রাখল নিতাই । ঢাকাগুলো খুলে খাবার সাজিয়ে দিল । দুধ-কর্নফ্লেক্স, পাঁউরুটি টোস্ট, জোড়া ডিমের পোচ । সঙ্গে আলাদা করে চিনি, মাখন, জ্যাম । পট ভর্তি চা -- আলাদা করে দুধ আর চিনি । এই চিনি মন্টু বাজারে বেচবে -- এই মাখন আর জ্যামের পড়ে থাকা অংশটুকু হয়তো কাল সকালে নিতাই আর রেখাকে খেতে দেওয়া হবে । কোনো বকশিশ দিল না লোকটা । খাবারের বিলটায় সইও করল না । ডেকে সই করতে বলতে ভয় করে । যদি চটে যায় । যাকগে, কাউন্টারে দিয়ে দিলেই হবে । ওরা পরে সই করিয়ে নেবে ।

    বেরোতে গিয়ে নিতাইয়ের চোখ পড়ল ফলের টুকরিটার ওপর । সবকটা ফলই খানিকটা করে খেয়ে রেখেছে লোকটা । ছুরি দিয়ে পরিষ্কার করে কাটা আধখানা আপেল পড়ে আছে -- বেদানা, কমলালেবু, কলা, এসব কোনোটাই পুরো খায়নি । শালা -- পয়সা আছে, তাই খাবার এরকম ছড়িয়ে ছিটিয়ে নষ্ট করছে । বেশ আছে এরা ।

    দরজা দিয়ে বাইরে বেরিয়ে নিতাই রেখাকে দেখতে পেল । লম্বা করিডোরটা মুছে সাফ করছে । লাঠির ডগায় লাগানো ফিনাইল মেশানো জলে ভেজা মোটা কাপড়ের ঝাড়ন -- তা দিয়ে তাড়াতাড়ি করে অনেকটা জায়গা পরিষ্কার করা যায় । করিডোরের এককোণে রাখা আছে চাকা লাগানো ট্রলি । তাতে থরে থরে সাজানো স্টোররুম থেকে নিয়ে আসা সদ্য ধোয়া পাটকরা বিছানার চাদর, বালিশের ওয়াড়, স্নানের তোয়ালে । এই কাজ শেষ হলে পর রেখা এই তলাটার প্রত্যেক ঘরের চাদর তোয়ালে পালটে দেবে । তারপর নোংরা চাদর তোয়ালে ট্রলিভর্তি করে নিয়ে গিয়ে স্টোররুমে পৌঁছে দেবে । এই তলার ঘরগুলোর দায়িত্ব আজ ওকে দেওয়া হয়েছে ।

    নিতাই আর দাঁড়ালো না । একতলায় কিচেনে ছুটল । এখন ঘরে ঘরে খাবার পৌঁছে দেবার সময় । একটুখানি ফুরসত পাবে বেলা দশটা বাজলে পর । তখন বেশিরভাগ খদ্দেরই হয় তাদের কাজে বেরিয়ে যায়, নয়তো ঘর খালি করে হোটেল ছেড়ে দেয় ।

    কিচেনের বাইরে মন্টুর ফোনের সামনে বসে বিলগুলোর হিসেব করে নিচ্ছিল নিতাই । বেশ একগোছা বিল । সকালে যেসব ঘরে নিতাই খাবার দিয়েছে তার বিল । গোটা দশ বারো হবে । এগুলো হেড কুকের বিলের কপির সঙ্গে মিলিয়ে নিয়ে কাউন্টারে জমা দিতে হবে । প্রত্যেক খদ্দেরের নামে কম্পিউটারে তুলে রাখবে ওরা ।



    রেখা ঝড়ের মতো ঘরে ঢুকল । চুল এলোমেলো, বিধ্বস্ত চেহারা, চোখ জলে ভর্তি, গালেও চোখের জলের দাগ । এখনো ফোঁপাচ্ছে রেখা । নিতাই ঘাবড়ে গেল । কি হয়েছে রে বাবা ।

    রেখা নিতাইয়ের হাত ধরে টানল । এই, ওঠো -- চলো, পুলিশে যাব ।

    নিতাই নড়ে না । ওর মাথায় কিছু ঢুকছে না । খালি ভ্যাবলার মতো রেখার দিকে তাকিয়ে আছে । বউটা এরকম করছে কেন ? আর হঠাৎ পুলিশের কাছে যেতে যাবে কোন দু:খে ?

    ফোঁপাতে ফোঁপাতেই রেখা ঝাঁঝিয়ে উঠল -- তোমার লজ্জা করে না ? আমার এই অবস্থা আর তুমি হাবার মতো বসে আছো ? -- ভ্যাঁ করে কেঁদে ফেলল তারপর ।

    গোলমাল শুনে কিচেনের ভেতর থেকে হেড-কুক বেরিয়ে এসেছে -- পেছনে তার অ্যাসিসট্যান্ট । কিচেনের ভেতর অনেকগুলো গ্যাসের বার্নার জ্বলছে -- এক একটায় এক এক রান্না চাপানো । গ্যাসের ওপর গরম তাওয়ায় পরোটা চড়চড় আওয়াজ করছে -- পরোটার একটা পিঠ পুড়তে শুরু করেছে । হেড-কুকের ধমক খেয়ে অ্যাসিসট্যান্ট জিভ কাটল । দৌড় মেরে ঢুকে গেল কিচেনে । তাওয়ার ওপর পরোটা উল্টে দিতে হবে ।

    মন্টু চোখ ছোটো করে রেখাকে দেখছিল । ও একেবারে শেয়ালের মতো ধূর্ত । রেখাকে জিজ্ঞেস করল -- কোন ঘরে ঢুকেছিলি ?

    পাঁচশো-এক -- রেখা বলল ।

    কেন ?

    আমার চাদর তোয়ালে পাল্টে দেবার ডিউটি ছিল -- ফোঁপানির ফাঁকে ফাঁকে রেখার কথা অস্পষ্ট ।

    গেস্ট যখন ঘরে ছিল তখন ঢুকেছিলি কেন ?

    রেখা উত্তর দেয় না, শাড়ির আঁচল তুলে চোখ মোছে ।

    খ্যা খ্যা করে হেসে উঠল মন্টু । বলল, তুই ইচ্ছে করে এসব করিসনি তো ? টাকা পয়সাও কিছু পেয়েছিস নাকি ?

    রেখা চুপ । খালি রাগে, কান্নায় ওর নাকের পাটা ফুলে ফুলে ওঠে, ঠোঁট থরথর করে কাঁপে ।

    এরমধ্যে আরো কয়েকজন কর্মচারি এঘরে জড়ো হয়ে গেছে । সনাতন, ছায়া, আর চাঁপা । সনাতন বেল-বয়ের কাজ করে । ছায়া আর চাঁপার ডিউটি রেখারই মতো । ওদের স্থানীয় নেতা নগেনও এসে গেছে । ওদের দেখে মন্টু চুপ হয়ে গেল । এসব কেস খুব ঝামেলার । ব্যাপারটা থানা-পুলিশ পর্যন্ত গড়াতে পারে । যে এই ব্যাপারে কথা বলবে তাকে নিয়েই টানাটানি হবে । কি দরকার এসব ঝামেলায় জড়িয়ে পড়ার ? গম্ভীর গলায় বলল, দ্যাখো বাবা, আমি এসব কিছু জানি না । এখানে দাঁড়িয়ে নাটক কোরো না । রিসেপশনে যাও -- রমেন রায়কে বল । এই নিতাই -- ওঠ ওঠ । বউকে নিয়ে এখান থেকে বেরো ।

    ওরা ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে হেড-কুক মন্টুকে বলল, তুই ঠিকই বলেছিস । পয়সাকড়ির ব্যাপার আছে ভেতরে ।

    অ্যাসিসট্যান্ট কুক গ্যাসের আঁচ কমিয়ে দিয়ে আবার বেরিয়ে এসেছিল । ও বলল, তাহলে রেখা কান্নাকাটি চেঁচামেচি করছে কেন ?

    কে জানে -- ঠোঁট ওলটাল মন্টু । হয়তো টাকাপয়সা ভালমতো দেয়নি লোকটা ।

    হেড-কুক অ্যাসিসট্যান্টকে ধমক লাগায় -- আবার তুমি বেরিয়ে এসেছ ? এবার খাবার পুড়ে গেলে মাইনের থেকে টাকা কাটা যাবে কিন্তু ।

    অ্যাসিসট্যান্ট কাঁচুমাচু মুখ করে দুহাত নিজের কানে ছোঁয়ায় -- তারপর কিচেনে ঢুকে যায় ।


    ততক্ষণে নিতাইয়ের দলবল রিসেপশনে পৌঁছে গেছে । রমেন ওদের চেহারা, হাবভাব দেখেই বুঝে নিল, কোনো একটা গোলমাল হয়েছে । এখন রিসেপশনের ব্যস্ত সময় । গেস্টরা অনেকে ঘর ছেড়ে দিচ্ছে -- অনেকে কাউন্টারে ঘরের চাবি জমা দিয়ে তাদের কাজে বেরোচ্ছে । হোটেলের দারোয়ান মহাবীর সিংএর ছ'ইঞ্চি লম্বা ঝাঁটাগোঁফ আর মাথায় ফুটখানেক উঁচু পাগড়ি । এক একজন লোক বেরোচ্ছে আর ও বুক পর্যন্ত মাথা ঝুঁকিয়ে সেলাম করে রিসেপশন লবির প্রকাণ্ড কাঁচের দরজা খুলে ধরছে । তাদের জন্যে বাইরে রাস্তায় গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে -- হোটেলের উর্দিপরা সিকিউরিটির লোক ছুটে গিয়ে তাদের গাড়ির দরজা খুলে ধরছে । রমেন ওদের বলল -- এই, এই, এখানে একদম দাঁড়াবি না । ভেতরে ম্যানেজারের ঘরে চলে যা ।

    ম্যানেজারের ঘরটা বেশ বড়ো । ঘরের লাগোয়া ভেতরদিকে একটা অ্যান্টিরুম রয়েছে । পুরো ঘরটায় কার্পেট পাতা । সোফা-টোফা রয়েছে একপাশে । প্রকাণ্ড বড়োসাইজের একটা টেবিলের একপাশে একটা কম্পিউটার রাখা । ম্যানেজার কৌশিক রায় টেবিলের সে-পাশে চেয়ার সরিয়ে নিয়ে গিয়ে কম্পিউটারের পর্দার খুব কাছে ঝুঁকে একমনে কম্পিউটারের বোর্ডের চাবি টিপছিল । কৌশিক রায়ের ছোকরা বয়েস -- বত্রিশ তেত্রিশের বেশি হবে না । হোটেল ম্যানেজমেন্ট পাশ । বেলজিয়াম না ফ্রান্স কোথাকার একটা হোটেলে কিছুদিন ট্রেনিংও নিয়েছে । কম্পিউটারেরও কিসব ডিপ্লোমা পাশ করেছে । দেখতে ভাল, স্মার্ট আর চটপটে । কামরার দরজা খুলে এতজনকে একসঙ্গে ভেতরে ঢুকতে দেখে একটু অবাক হয়েই মুখ তুলল । ডিউটি ছেড়ে হঠাৎ এসে সোজা ম্যানেজারের ঘরে ঢুকেছে -- এত বুকের পাটা হোল কোথা থেকে ?

    ভুরু কুঁচকে বেশ কড়া চোখে ওদের দিকে তাকিয়েছিল কৌশিক । নগেন বলল, স্যার, বিচার চাই । তারপর রেখার দিকে আঙুল দেখিয়ে বলল, ওর ওপর অত্যাচার করেছে পাঁচশো-এক নম্বরের গেস্ট । আপনি ওই লোকটাকে পুলিশে দিন ।

    কি করতে হবে না-হবে তা তোমরা আমাকে বলে দেবে নাকি ? কৌশিক ধমকে উঠল । আমি নিতাই আর রেখার সঙ্গে কথা বলছি । নগেন, তুমি থাকো । আর মেয়েদের মধ্যে একজন থাক । ছায়া, তুই থাক -- আর তোরা দুজন যা । ডিউটিতে একদম ঢিলে দিবি না । আর হ্যাঁ -- খবরদার এ-নিয়ে এখন কোনো কথা বলবি না । কড়া শাস্তি হবে তাহলে ।

    সনাতন একবার নিতাই আর রেখার দিকে তাকিয়ে দেখল । তারপর চুপচাপ ঘর থেকে বেরিয়ে গেল । ওর পেছনে গেল চাঁপা ।

    কৌশিক টেবিল ছেড়ে উঠে এল । নিজে সোফায় বসে ওদেরও ডেকে উলটো দিকের সোফায় বসালো । রেখাকে বলল, এবার বল্‌ তো কি হয়েছে ?

    রেখা চোখে আঁচল চাপা দিয়ে বসে থাকে, কথা বলে না । চাপা কান্নার, অল্প অল্প নাক টানার আওয়াজ পাওয়া যায় ।

    এবার কৌশিক জেরা করতে শুরু করল -- পাঁচশো-একে গিয়েছিলি কেন ?

    চোখে আঁচল চেপে রেখেই রেখা বলল -- আমার ডিউটি ছিল চাদর তোয়ালে পাল্টে দেওয়ার ।

    ওর গলার আওয়াজ এখন ভেঙে ভেঙে যাচ্ছে -- ঢোঁক গিলে গিলে গলা পরিষ্কার করে কথা বলছে ।

    পাঁচশো-একের গেস্ট কি করেছিল তোকে ?

    রেখা ওর সমস্ত মুখ আঁচল দিয়ে ঢেকে ফেলে । বলে -- আমি বিছানার চাদর তুলছিলাম -- আমাকে টেনে নিয়ে --

    সজোরে ঘাড় নাড়ল রেখা -- আমি আর বলতে পারব না । ওর গলা কান্নায় বুজে যাচ্ছে ।

    তো তুই চেঁচালি না কেন ?

    আমার মুখ চেপে ধরেছিল । ও লোকটার গায়ে ভীষণ জোর ।

    রেখার পাশে বসা নিতাই পুরো ঘটনাটা মনে মনে চিন্তা করার চেষ্টা করে । বিছানায় ছটফট করছে রেখা -- লোকটা ওর মুখ টিপে ধরে আছে । নিতাই এই ছবিটা চোখের সামনে দেখে আর ওর মাথার রক্ত চড়ে । রেখার ছোট্টো হাড় জিরজিরে কিন্তু উষ্ণ নরম শরীরটা -- সেতো একেবারেই ওর নিজস্ব । সেই এক্তিয়ারে জোর করে ভাগ বসিয়েছে লোকটা । নিতাইয়ের ঘন ঘন নি:শ্বাস পড়ে, দুহাত মুঠো হয়ে আসে । লোকটাকে হাতের কাছে পেলে ওকে দু-টুকরো করে ছিঁড়ে ফেলবে এরকম মনে হয় । কিন্তু আবার মনে পড়ে যায় লোকটার জোয়ান চেহারা -- সকালে দেখা চওড়া বলিষ্ঠ বুকের পাটা, পেশিবহুল দুই হাত । তার ওপর আবার লোকটার অঢেল টাকা । নিতাইয়ের রাগের পারদ নামতে থাকে । নিজেকে খুব অসহায় মনে হয় । বুকের খাঁচাটার ভেতর কিরকম খালি খালি লাগে ।

    কৌশিক আবার রেখাকে বলে -- শোন্‌, কি করতে চাস এখন সেটা আমাকে বল ।

    এবার রেখা মুখ থেকে আঁচল সরিয়ে ফুঁসে ওঠে, পুলিশে দিতে হবে ওকে -- শয়তান বদমাস কোথাকার । জেলের ঘানি টানতে হবে ওকে ।

    নগেন তাতে সায় দেয় -- ঠিক ঠিক । পুলিশে খবর দিতে হবে । তা না-হলে আমরা হোটেলকর্মীরা লাগাতার আন্দোলনে নামব ।

    কৌশিক নগেনের কথায় খুব একটা পাত্তা না দিয়ে রেখাকে দেখছিল । ওর দু-চোখে কান্নায় উপচে ওঠা জল -- তার ভেতর দিয়ে আহত বাঘিনীর রাগ ঝলক দিচ্ছে ।

    একটা সিগারেট ধরিয়ে ধোঁয়া ছাড়ল কৌশিক, বিশ্রী ফ্যাসাদ । এই ঘটনাটার কথা বাইরে বেরোলে যাচ্ছেতাই কেলেংকারি হবে । পাঁচশো-একের লোকটা হোটেলের দামি খদ্দের । হোটেলের প্রচণ্ড বদনাম হবে । সবকটা খবরের কাগজে খুব রসিয়ে সামনের পাতায় বড়ো বড়ো করে ছাপাবে -- হোটেলের মধ্যে মহিলা কর্মচারী ধর্ষিতা । নারী-সমিতির মহিলারা হাতে ফেস্টুন নিয়ে হোটেলের সামনে ধর্না দেবে । সব রাজনৈতিক দলগুলো ট্রাক আটকে পথসভা করবে । তার ওপর পুলিশ । ঘন্টায় ঘন্টায় আসবে -- নানা কথা জিজ্ঞেস করবে । কৌশিককেও কতবার থানায় ডাকবে কেজানে । রেখা কিন্তু রাতারাতি বিখ্যাত হয়ে যাবে । টিভির পর্দায় ওকে দেখা যাবে -- টিভির সাংবাদিক ওর মুখের সামনে মাইক ধরে আছে আর রেখা ছলছল চোখে থেমে থেমে সেই মাইকে বলে যাচ্ছে ওই দিন ওই সময়ে হোটেলের পাঁচশো-এক নম্বর ঘরে কি হয়েছিল । আর কৌশিকের চাকরিটা । সেটা তো যাবেই । এই ঘটনার পর মালিক ওকে কখনোই কাজে রাখবে না । পাঁচশো-একের গেস্টের ওপর বড়ো বিরক্ত হয় কৌশিক । মেয়েমানুষের যদি এতোই দরকার তো একটা ফোন করলে একগাদা ডবকা ছুঁড়ি এসে হাজির হয়ে যাবে । তখন বেছে নাও কাকে চাই । এড্স আটকানোর জন্যে রবারের জন্ম-নিরোধক পর্যন্তও সব মেয়েরা নিজেদের হাতব্যাগেই রাখে । অবশ্যি ওদের দর বিলক্ষণ চড়া । তা পাঁচশো-একের গেস্টের তো আর পয়সার অভাব নেই । সেসব ছেড়ে এই টিকটিকির মতো রোগা মেয়েটার ভেতর কি জিনিষ দেখল লোকটা ? শালা, মজা লুটল পাঁচশো-একের গেস্ট আর ঝামেলা সামলানোর জন্যে এই কৌশিক রায় ।

    সিগারেট মুখ থেকে নামিয়ে সোফার সামনের সেন্টার-টেবিলে রাখা অ্যাশট্রের ওপর রাখল কৌশিক । রেখাকে বলল, পুলিশ তো নাহয় ডাকা গেল -- কিন্তু পুলিশ এসে কি করবে জানিস ?

    কি আবার করবে -- রেখা বলে । ওই লোকটাকে ধরে নিয়ে চলে যাবে ।

    কৌশিক হাসে । বলে, ব্যাপারটা অত সহজ নয় । কাউকে গ্রেপ্তার করার আগে পুলিশ নানারকম তদন্ত করবে । তোকে নিয়েই তো আসল তদন্ত ।

    আমাকে আবার কি করবে ? -- সন্দেহের গলায় বলল রেখা । ওর কান্না এখন কমেছে । কথাও অনেক পরিষ্কার ।

    কৌশিক নির্বিকার মুখে বলে যায় -- তোকে নানারকম জেরা করবে পুলিশ । তার জন্যে তোকে আর নিতাইকে থানায় নিয়ে যাবে । আমাকে তুই যেসব কথা মুখে বলতে পারলি না সেসব তোকে খুঁটিয়ে জিজ্ঞেস করবে । তোকে লোকটা ঠিক ঠিক কি কি করেছে সেসব খুলে বলতে হবে তোকে । তুই যা বলবি সব লিখে নেবে, আর বার বার করে একই কথা জিজ্ঞেস করে দেখবে যে তোর কথায় কোনো তফাৎ হয় কিনা । তার ওপর তুই চিত্কার করিসনি । তাতে করে তোর ওপরই সন্দেহ আসতে পরে যে তুই ইচ্ছে করে একাজ করেছিস ।

    রেখা গলা চড়াল -- আপনাকে বললাম তো কেন চেঁচাইনি ।

    কৌশিক মুরুব্বিয়ানার হাসি হাসে । সে বললে কি পুলিশ বিশ্বাস করবে রে ? তাছাড়া এসব ব্যাপারে আরো হ্যাপা আছে । তোকে হাসপাতালে পাঠাবে -- ডাক্তার থেকে আরম্ভ করে হাজারটা লোক এসে তোর সারা গায়ের দাগ খুঁটিয়ে দেখবে ঠিক কি হয়েছিল বোঝার জন্যে ।

    চুপ করুন -- রেখা ফুঁসে উঠল । অসভ্য কথা বলবেন না ।

    আমি নাহয় চুপ করলাম -- খুব শান্ত গলায় কৌশিক বলল । কিন্তু পুলিশ তো চুপ করে থাকবে না । এটাতো ওদের কর্তব্য -- সে তো করতেই হবে । পরে তো তোকে আদালতে কাঠগড়ায় দাঁড় করাবে -- তখন জজ সাহেবের কাছে সব খুলে বলতে হবে । নিতাইয়েরও ঝামেলা আছে । ওকে পিটুনি দিয়ে পুলিশ বার করার চেষ্টা করবে যে ওর বউ টাকা নিয়ে হোটেলের খদ্দেরদের সঙ্গে প্রায়ই এসব করে কিনা ।

    রেখা আবার রেগে ওঠে -- ফের অসভ্য কথা বলছেন আপনি ?

    কৌশিক দুহাত উলটে দেয় । ওই নাও -- কি আর বললাম আমি ? তারপর নিতাইয়ের দিকে তাকিয়ে বলল -- আমি খালি তোদের বোঝাবার চেষ্টা করছি এসব ব্যাপারে পুলিশ কি কি করতে পারে । হয়তো আরো অনেক কিছু করবে । সব তো আমার জানা নেই ।

    নিতাইয়ের তলপেট জুড়ে একটা ঠাণ্ডা অনুভূতি শিরশির করতে থাকে । তার নাম ভয় । অল্প অল্প পেচ্ছাপ পেয়েছে এরকম মনে হয় । যদি সত্যি সত্যিই ওকে পুলিশে পেটাই করে ? মনে মনে এবার বউএর ওপর একটু রাগ করতে থাকে । গেস্ট যখন ঘরে ছিল তখন কেন যে রেখা ওখানে ঢুকতে গিয়েছিল ? নাহয় ঘর পরিষ্কার করতে একটু দেরিই হোত । কি এমন মহাভারত অশুদ্ধু হয়ে যেত তাতে ?

    কৌশিক আবার বলল -- ওর গলা এখন খুব নির্বিকার -- পুলিশ কোনো একটা ঘটনার তদন্ত শুরু করলে অল্পে ছেড়ে দেয় না । এই যে ছায়া এখানে বসে সব কথা শুনছে -- পুলিশ তো ওকেও থানায় নিয়ে যাবে । ঘন্টার পর ঘন্টা ওকে জেরা করবে । সব কথা খুঁটিয়ে জিজ্ঞেস করে জানতে চাইবে কি সত্যি আর কি মিথ্যে ।

    ছায়ার মুখ ফ্যাকাশে । দুচোখে পরিষ্কার ভয় । ও দাঁড়িয়ে ওঠে । বলে, স্যার, আমার ডিউটি পড়ে আছে । আমি কাজে যাই ।

    কৌশিক দুহাতের ভঙ্গি করে ওকে বসিয়ে দেয় । মুখে বলে, আরে বোস্‌ বোস্‌ । ঘটনাটার একটা ফয়সালা হয়ে যাক । রেখার সঙ্গে একটা লোক এরকম বদমায়েসি করল, তার জন্যে কিছু একটা করা তো দরকার ।

    তারপরই নগেনের দিকে তাকাল কৌশিক । বলল, ভাল কথা মনে পড়েছে । নির্মলবাবুকে ফোন করি । যদি এখানে আসতে পারেন ।

    নির্মলবাবুর নাম শুনে ঘন ঘন ঘাড় নাড়ল নগেন । ঠিক ঠিক, ওনাকে খবর দেওয়াই সবচেয়ে ভাল ।

    কোটের পকেট থেকে মোবাইল ফোন বার করে ওদের দেখিয়ে দেখিয়ে বোতাম টেপে কৌশিক । নির্মল চ্যাটার্জীর ফোন-নম্বর ওর মুখস্থ । স্যার কৌশিক রায় বলছি । আপনি এখন কি ফ্রি আছেন ? না, না, স্যার -- আমার এখানে দশমিনিটের জন্যে একবার পায়ের ধুলো দিতে হবে -- খুব দরকার পড়েছে একটা -- তাহলে আসছেন তো ? থ্যাংক ইউ সো ভেরি মাচ্‌, সো কাইণ্ড অফ ইউ ।

    মোবাইল ফোন আবার কোটের পকেটে রাখল কৌশিক । নগেনকে বলল, একঘন্টা পরে একটা জরুরি মিটিং আছে -- সেজন্যে আসতে চাইছিলেন না । ভাগ্য ভাল আসতে রাজি হয়েছেন । উনি তোমাদের সঙ্গে কথা বলবেন । তোমরা এখানেই বসো ।

    নির্মল চ্যাটার্জী কাছেই থাকেন । দশমিনিটের মধ্যে এসে পড়লেন । কৌশিক নিজে দৌড়ে গিয়ে তার গাড়ির দরজা খুলে ধরল । নির্মলবাবু নামলেন । ধোপদুরস্ত পায়জামা পাঞ্জাবি পরা, গোল মুখে নেতাসুলভ ভারিক্কি ভাব, মাথায় টাকের দু-পাশ দিয়ে কাঁচাপাকা কোঁকড়া চুল, চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা । খুব খাতির করে সঙ্গে নিয়ে এল কৌশিক । তারপর নির্মলবাবুকে অ্যান্টিরুমে নিয়ে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিল ।

    মিনিট পনেরো পরে অ্যান্টিরুমের দরজা খুলে গেল । নির্মলবাবু বেরিয়ে এসে রেখাদের উলটোদিকের সোফায় বসলেন, পাশে কৌশিক । প্রায় সঙ্গে সঙ্গে এসে গেল বড়ো একটা প্লেটে করে জোড়া চিকেন কাটলেট, সেই সঙ্গে বড়ো বড়ো লম্বাটে টুকরোর আলুভাজা, বিভিন্ন রকম সস, আলাদা প্লেটে ছুরি-কাঁটা, ন্যাপকিন । আর এল বড়ো এক গেলাস হট চকোলেট -- গেলাসটা গরম বলে ধরবার সুবিধের জন্যে সেটা কাগজের ন্যাপকিনে মোড়া । একটা প্ল্যাস্টিকের স্ট্র আবক্ষ গরম চকোলেটের মধ্যে ডুবে থেকে নিজের মাথাটা গেলাসের ওপর ভাসিয়ে রেখেছে । নির্মলবাবু মৃদু আপত্তি জানালেন -- এত সব আবার কেন ?

    কৌশিক কুন্ঠিত বিনয়ের সঙ্গে বলল, এ কিছুই নয় । একটু কিছু মুখে দিন স্যার ।

    নির্মলবাবু ছুরি-কাঁটায় হাত লাগালেন না । কাটলেটের বড়ো বড়ো টুকরো আঙুল দিয়ে ভেঙে মুখে দিতে লাগলেন -- আর কাটলেট চিবিয়ে গলা শুকিয়ে গেলেই গেলাসের স্ট্রতে মুখ লাগিয়ে টান দিয়ে গরম চকোলেটে গলা ভিজিয়ে নিতে লাগলেন । পাশে খুব বশংবদ ভাবে হাতে হাত মুড়ে বসে রইল কৌশিক আর নির্মলবাবুর কাটলেট চিবোনোর আওয়াজ শুনতে লাগল ।

    নির্মল চ্যাটার্জী প্লেটের কাটলেট, গেলাসের চকোলেট শেষ করে ন্যাপকিন দিয়ে হাতের আঙুল মুছে ফেললেন । তারপর শব্দ করে একটা ঢেঁকুর তুলে সোফায় হেলান দিলেন । কৌশিকের এগিয়ে দেওয়া দামি বিদেশি সিগারেটের প্যাকেট থেকে একটা তুলে ঠোঁটে গুঁজলেন । কৌশিক তাড়াতাড়ি লাইটার জ্বেলে নির্মলবাবুর সিগারেট ধরিয়ে দিল । নগেন উলটোদিকের সোফায় এককোণে চুপ করে জড়োসড়ো হয়ে বসে আছে । এতবড় একটা নেতার সামনে ওর মতো চুনোপুঁটির মুখ খোলা একেবারে বারণ ।

    একমুখ ধোঁয়া ছেড়ে বেশ খানিকক্ষণ চোখ বন্ধ করে মাথা সোফায় হেলান দিয়ে রইলেন নির্মলবাবু । তারপর চোখ খুলে সোজা হয়ে বসলেন । রেখার দিকে তাকিয়ে বললেন, সব কথা শুনলাম । তোমার ওপর অত্যাচার হয়েছে সেকথা একশভাগ ঠিক । কিন্তু ব্যাপারটা কি জানো ? এই ঘটনাটা নিয়ে নাড়াচাড়া করলে তোমারই ক্ষতি হবে সবচেয়ে বেশি । অত্যন্ত দু:খজনক ঘটনা, তাতে কোনো সন্দেহ নেই । তবে এটা ভুলে যাওয়াই ভাল । হোটেল তোমাদের কমপেনসেশান দেবে । এ-মাসটা দুজনেই বাড়ি বসে বিশ্রাম নাও । শরীর-মনের ওপর যা ধকল গেল সেটা কেটে যাবে । ওই দিনগুলোর মাইনে তোমরা বাড়ি বসেই পেয়ে যাবে ।

    নিতাইয়ের মাথা এতক্ষণে ঠাণ্ডা হয়ে গেছে । ও এখন এই কথাই ভাবছিল । ব্যাপারটা নিয়ে যদি বেশি ঝামেলা হয় তাহলে হোটেল কি আর ওদের চাকরিতে রাখবে ? তখন তো নির্মলবাবুকে ধরেও কিছু লাভ হবে না । উনি তো সোজা দরজা দেখিয়ে দেবেন ওনার কথা শোনা হয়নি বলে । অন্য চাকরি যদি বা জোটে তবুও পাড়ায় থাকা যাবে কি ? খবরটা ছড়ালে কানা নান্টার দলের ছেলেরা যদি এসে রেখাকে তুলেই নিয়ে যায় তাহলেই বা দেখে কে ? সবাই বলবে -- মেয়েটার স্বভাব-চরিত্র খারাপ, এরকম তো হবেই । রেখার মুখের দিকে তাকিয়ে দেখল নিতাই । কিরকম একটা রাগ রাগ মুখ করে বসে আছে । রাগ করিস না রে রেখা -- ঝামেলা আর বাড়াস না । তুই আমার দ্বিতীয় পক্ষের কচি বউ -- গণ্ডগোল বাড়লে তোকে নিয়ে আর শান্তিতে ঘর করতে পারব না । ব্যাপারটা চেপে যা রেখা -- চেপে যা ।

    আর হ্যাঁ -- নিতাইয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন নির্মলবাবু, এব্যাপারে যদি তোমার বউএর কোনো অবাঙ্ছিত মাতৃত্ব হয়ে-টয়ে যায়, তা সারাবার ব্যবস্থা হোটেল করে দেবে ।

    রেখা তো মাসে মাসে ইনজেকশন নেয়, নিতাই ভাবল । একবার নগেন আর রেখার দিকে তাকিয়ে দেখল নিতাই । নগেনের মুখের ভাব ভক্তিতে গদগদ, শ্রদ্ধাপ্লুত চোখে নেতার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে । রেখা মাথা নিচু করে বসে আছে -- নিচের ঠোঁট একটু ফুলিয়েছে, অভিমানী বাচ্চার মতো ।

    নিতাই দু-হাত জোড় করল । নির্মলবাবুকে বলল, স্যার, আপনি আমাদের মা-বাপ । আপনি যা বলবেন তাই হবে ।

    নির্মলবাবু উঠে পড়লেন । কর্মব্যস্ত মানুষ -- এক জায়গায় বেশিক্ষণ বসে নষ্ট করার মতো সময় নেই । তার ওপর ওই জরুরি মিটিংটা রয়েছে । সঙ্গে দৌড়ল কৌশিক, পেছনে নগেন । গাড়ির দরজা খুলে ধরল কৌশিক । নির্মলবাবু গাড়িতে উঠে বসলেন ।

    ড্রাইভার গাড়ি ছাড়ল । নির্মলবাবু হেলান দিয়ে সিটে বসেছিলেন । পাঞ্জাবির পকেটে একটা বড়ো খাম, সেটা এখন ওনার মেদবহুল উদরদেশে খোঁচা দিচ্ছে । খামটা পকেট থেকে বার করলেন তিনি । গাড়ির সিটে রাখা ছিল কম্বিনেশন-লক লাগানো ব্রিফকেস । খামটা তিনি তার ভেতর রাখলেন । অনেকগুলো একশ টাকার নোট আছে এই খামে । ব্রিফকেসে রাখাটাই ভাল । মনে মনে এসব হোটেলের নিয়মকানুনের তারিফ করলেন তিনি । ওরা হোটেল ম্যানেজারের হাতে ঢালাও ক্ষমতা দিয়ে রাখে । হোটেলের হিসেবের খাতায় এ-টাকাটা কৌশিকের এন্টারটেনমেন্টের ভেতর দেখানো হবে ।

    কৌশিক ফিরে এসে দেখল নিতাই আর রেখা চুপ করে বসে আছে । ছায়া সরে পড়েছে সেখান থেকে । কৌশিক ওদের বলল, তোদের আজ থেকেই ছুটি দিয়ে দিচ্ছি । খালি একটা কাজ করে দিয়ে যা । পাঁচশো-একের গেস্ট একটু আগে ঘর খালি করে হোটেল ছেড়ে দিয়েছে । বিকেলের দিকে ও-ঘরে নতুন গেস্ট আসবে । তোরা দুজন মিলে চটপট ঘরটা সাফ করে দে । তারপর বাড়ি চলে যা -- ছুটি মারতে থাক্‌ । একেবারে সামনের মাসের পয়লা তারিখে আসবি -- দুজনেই পুরো মাসের মাইনে পেয়ে যাবি ।



    পাঁচশো-এক নম্বরের জোড়া খাটের ওপর বিছানা একেবারে লণ্ডভণ্ড, বিধ্বস্ত হয়ে আছে । খাটের একপাশে পড়ে আছে সদ্যধোয়া চাদর, তোয়ালে । রেখা বিছানার চাদর তুলে ভাঁজ করে -- বালিশের ওয়াড় খুলে নেয় । নিতাইয়ের হাতে ভ্যাকুয়াম ক্লিনার । কার্পেট সাফ করছে । কাজ শুরু করেছে বাইরের দিকের ঘরটার থেকে ।

    নিতাই এদিকে শোবার ঘরে এল । ওর বাঁ-হাতে ক্লিনারের লম্বা হাতল ধরা, ডানহাতে ফলের টুকরিটা । রেখা ততক্ষণে বিছানার চাদর তুলে ফেলেছে, পরিষ্কার ধোপভাঙা চাদর বিছিয়ে দিচ্ছে গদির ওপর । নিতাই ফলের টুকরি খাটের পাশে ছোটো সেন্টার-টেবিলটার ওপর রাখল । বলল, হারামিটা সবকটা ফল আদ্ধেক করে খেয়ে গেছে । ফেলে দিয়ে কি হবে ? বাকিটা আমরা শেষ করে দি -- কি বলিস ?

    রেখা উত্তর দিল না, নিজের কাজ করে যেতে লাগল ।

    নিতাই অর্ধেক করা আপেলটায় কামড়া দিল । জিব দিয়ে সুড়ুক আওয়াজ করে বলল, কি দারুণ খেতে রে । তারপর এককোয়া কমলালেবু খোসা থেকে ছাড়িয়ে রেখার হাতে গুঁজে দিয়ে বলল -- নে, খা ।

    হঠাৎ নিতাইয়ের চোখে পড়ল দূরে দলামোচা হয়ে কার্পেটে পড়ে থাকা একটা কাগজের টুকরোর দিকে । কাছে গিয়ে সেটা তুলে নিল । একটা পাঁচশো টাকার নোট । রেখার দিকে তাকাল নিতাই ।

    রেখা এদিকে তাকিয়ে দেখছিল । বলল, শয়তানটা আমার হাতে কি একটা গুঁজে দিয়েছিল । আমি ওটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিলাম ।

    নোটটা এই অবস্থায় পকেটে রাখা যাবে না । দুহাত দিয়ে সেটা পাট করতে থাকে নিতাই । বলে, আজকাল হাজার টাকার নোটও বেরিয়েছে রে । কখনো দেখিনি । হারামজাদাটা যদি এটার বদলে একটা হাজার টাকার নোট দিত তাহলে তাও চোখে দেখা হয়ে যেত ।

    রেখার নিচের ঠোঁটের ভেতর দিকটায় লোকটার দাঁত লেগে কেটে গেছে । কমলালেবুর রস লেগে সেখানটায় জ্বালা করছিল । জিভ দিয়ে সেখানে চেটে জ্বলুনি কমায় রেখা । মুখে আওয়াজ করে -- হুঁ ।
  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments