• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ২৯ | মার্চ ২০০৩ | গল্প
    Share
  • সেই অন্য লোকটা : বাসুদেব দেব


    বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে দেখছি তোমার কপাল খুলে যাচ্ছে । বৈজয়ন্ত ভুরু কোঁচকালো । দীপার কথায় যেন শ্লেষের আভাস ।

    - কপাল আর কোথায় দেখলে, সবটাই তো টাক ।

    দীপা হাসলো । আলমারি খুলে ভাঁজ করা পাঞ্জাবি পাজামা এনে রাখলো সামনে । পাঞ্জাবিটা রঙিন, কাজ করা । -- এই বয়সে এটা মানাবে ?

    -- খুব মানাবে । তোমরা কবিরাই তো বলো বয়সটা তো শরীরের নয়, মনের । তোমার চারদিকে তো তরুণ-তরুণীদের ভিড় এখন ।

    একটু যেন ঈর্ষা । মেয়েরা, মানে মহিলারা কি পুরুষের থেকে আগেই বুড়ো হয়ে যায় ? পাঞ্জাবিটা বিলুর । এখন ছেলের জামা বাবার গায়ে বেশ লেগে যায় । ছেলে পড়তে গেছে ব্যাঙ্গালোর । তথ্যপ্রযুক্তির ঝকঝকে তকমার জন্য । অধ্যাপনা থেকে অবসর নিয়েছে বৈজয়ন্ত, তাও তিনবছর হয়ে গেল । বৈজয়ন্ত আজ পুরস্কার নিতে বাংলা আকাদেমির সভাঘরে যাবে ছটা নাগাদ । দীপা যেতে রাজি হয়নি । -- ছবিতে দেখবোখন । টিভিতেও নিশ্চয়ই দেখাবে । ঐ-সব ভিড়ভাডাক্কা, তার ওপর কোমরের ব্যাথাটাও বেড়েছে । -- যাও, তুমি রেডি হয়ে নাও । ট্যাকসি করে যেও কিন্তু । কি হলো, অমন শুকনো মুখ করে আছ কেন ? আজ তো তোমারই দিন ।

    বৈজয়ন্ত আজ দুপুরে ঘুমোয়নি । এই-বয়সে এমনিতেই ঘুম কমে যায়, তার ওপর ভিতরে ভিতরে একটা অদ্ভুত উত্তেজনা, কেটলির মধ্য থেকে বাষ্পের মতো বারবার বেরিয়ে আসতে চাইছে । হঠাৎ এক বছরের মধ্যে তার জীবনটাই যেন বদলে গেল । এইতো মাসখানেক আগেই শিশিরমঞ্চে হয়ে গেল তার সংবর্ধনা সভা । লিটল ম্যাগের কবি সাহিত্যিক সম্পাদকেরা মিলে একটা মোচ্ছবই লাগিয়ে দিয়েছিল যেন, তাকে ঘিরেই ! সারাজীবন ছোটো কাগজেই লিখে এসেছে সে । হঠাতি বৈজয়ন্তকে নিয়ে মাতামাতি শুরু হয়ে গেছে সাহিত্য সংস্কৃতি জগতে । এ-সময়ের একজন বিশিষ্ট, হয়তো বা শ্রেষ্ঠ কবিই সে । এই কথাটি আবিষ্কার করেছে এই প্রজন্মের পাঠক, কবি, সম্পাদকেরা । দূরদর্শনে সাক্ষাত্কারও প্রচারিত হয়েছে একদিন । নানা কাগজে তাকে নিয়ে লেখালেখি হচ্ছে -- সভাসমিতি, তরুণ লেখকদের ভিড় । উপভোগ করছে আবার অবাকও হচ্ছে খুব । কতগুলো যে সংবর্ধনা অনুষ্ঠান হলো ! কত লোকজন বাড়িতে ফোন করছে, আসছে । এমনকি প্রকাশকেরাও । যাদের পেছনে কতদিন ফ্যা ফ্যা করে ঘুরে বেড়িয়েছে সে, এই সেদিনও । কেউ তাকে পাত্তা দেয়নি আগে । ছোটো ছোটো কাগজে ডাক আসতো না । মাঝেমধ্যে নিজে গিয়ে লেখা গছিয়ে আসতো, কখনো ছাপা হতো, কখনো হতো না । শারদীয় সংখ্যায় আমন্ত্রণ-চিঠিও তার ভাগ্যে জোটেনি আগে । অযাচিত ভাবে লেখাগুলো নানা পত্রিকার দপ্তরে পাঠাতো, চেনাজানাদের হাতে গুঁজে দিতো । আর এবছর কতগুলো পত্রিকায় লেখার জন্য তাগাদা -- ফোনে মনে করিয়ে দেওয়া, বাড়িতে লোক পাঠানো ।

    নিরুপদ্রব সাদামাটা মধ্যবিত্ত একজন মানুষ, অধ্যাপনা করে, কবিতা লেখে । কোনো দলে ভিড়ে হৈ চৈ করেনি কখনো । না লড়াকু, না বৈপ্লবিক । না প্রতিভাবান, না প্রতিষ্ঠানের আনুকূল্যলোভী । অর্থাৎ তাকে নিয়ে কারো কোনো মাথাব্যাথা ছিল না এতকাল । সেও ছিল বেশ নির্ঝঞ্ঝাট । কোনো অভিযোগ অভিমান বা সংকলনে ঠাঁই পাবার জন্য তদবির তদারকি -- এসব তার স্বভাবেই ছিল না । এরকম সময় হঠাৎ কোথ্থেকে কি হয়ে গেল । কফিহাউসে দুজন তরুণ কবি তার কাছে এসে বল্লো : বৈজয়ন্তদা, আমরা একটা কাগজ করছি দুর্গাপুর থেকে । আপনার একগুচ্ছ কবিতা চাই ।

    - এক গুচ্ছ ? ঢোঁক গিলে এক গেলাশ জলই খেয়ে ফেল্লো সে ।
    - হ্যাঁ, তার সঙ্গে একটি সাক্ষাত্কার । সামনের রবিবার আপনার বাড়ি যাবো । ঠিকানাটা দেবেন ?

    সেই এক অদ্ভুত শুরু ।

    সামনে চায়ের কাপ নামিয়ে রেখে দীপা বলে : এখনও তৈরি হলে না । কালচার মিনিস্টার নিজে প্রাইজ দেবেন -- সরকারি পুরস্কার -- দেরি হয়ে যাবে যে ! কবি বলে কি ন্যালাখ্যাপা হতে হবে না কি ? বলতে বলতে দীপা ড্রেসিং-টেবিলের দেরাজ থেকে পারফিউমের শিশিটা বের করে, পাঞ্জাবিতে, রুমালে ছড়িয়ে দেয় । সারাঘরে এক দুর্লভ সুগন্ধ খেলা করতে থাকে । কোথায় ছিল এই ঐশ্বর্য, এতকাল ! বৈজয়ন্ত স্নানঘরে ঢুকে জলের ঝাপটা দেয় চোখে মুখে । আরাম লাগে । জল মানুষকে শুদ্ধ করে । চোখের জলও । কফিহাউস থেকে বেরিয়ে বৈজয়ন্ত পুরোনো বইয়ের দোকানের পাশ দিয়ে হাঁটতে থাকে । সামনেই একটা পত্রিকার দপ্তর । সেখানে কিছুক্ষণ আড্ডা দিয়ে বাস বা মিনিবাস ধরে সল্টলেক । কয়েকজন অধ্যাপক আর সরকারি কর্মকর্তারা মিলে সমবায় আবাসন তৈরি করেছেন । রাজনৈতিক দলের আনুকূল্যে জমিটা পাওয়া গেছে, জলের দামে । বৈজয়ন্তের ভূমিকাও এখানে গৌণ । অনেকের মধ্যে একজন । শেষমুহূর্তে একজন অধ্যাপক সরে দাঁড়ালে বিনয়বাবু ওর নাম ঢুকিয়ে দেন । একেই বলে ভাগ্য । পুরোনো বইয়ের দিনও শেষ হয়ে এসেছে । আগে এখানে কত ভালো ভালো বই পাওয়া যেত । অভ্যাসবশত চোখ এখনো চলে যায় সারি সারি বইয়ের দিকে । একেই বলে কাকতালীয় বা যারা দৈবে বিশ্বাস করে তাদের ভাষায় বিধি-নির্দিষ্ট । ডাঁই করা বইয়ের ওপরতলায় মোটামতো একটাতে হাত দিতেই এক রাশ বইয়ের মধ্য থেকে একটা পাতলা চটিবই ছিটকে পড়ে গেল ফুটপাথের ওপর । তার মতোই আভিজাত্যহীন, অনামা । অর্থাৎ মলাট ছেঁড়া, হতমলিন । সৌজন্যবশত সে বইটা কুড়িয়ে তাকের ওপর রাখে । আবদুল, অনেক কালের পুরোনো বেপারি, বলল : নিয়ে নিন না বাবু, পড়ে আছে কবে থেকে ! বৈজয়ন্ত কি ভেবে বইটা হাতে নেয় । ময়লা, শতচ্ছিন্ন । কবিতার বই । কার কবিতা ? মলাট নেই, কবির নাম বা বইয়ের নামও কোথাও লেখা নেই । আশ্চর্য ! সাত পাতা থেকে শুরু । হলদে হয়ে গেছে পাতাগুলো । ধূলোর পরত ভাঁজে ভাঁজে । বাঁধাই আলগা হয়ে গেছে । শেষের দিকেও বেশ কয়েকটা পাতা নেই । -- কার লেখা ? বলতে পারো ? -- কি জানি ? ফালতু । নিয়ে যান বাবু ।

    ভদ্রতা করে তিনটে টাকা গছিয়ে দেয় বৈজয়ন্ত, আবদুল তাতেই খুশি । এমনি করে তার ঘরে সর্বনাশ ঢুকলো ।

    বাড়িতে ফিরে বইটা উলটে পালটে দেখলো আবার । কার লেখা বই, কবে ছাপা কিছুই বোঝা যায় না । তবে কবিতাগুলি মনে হয় টাটকা, যেন তারই লেখা, অথচ তার নয় । যেকথা সে লিখতে চেয়েছে অথচ লিখতে পারেনি, কে যেন তা অবলীলায় লিখে রেখে গেছে । সাহিত্যের ছাত্র ছিল, অধ্যাপনা, গবেষণাও করেছে । কিন্তু বুঝতে পারছে না কার লেখা । রবীন্দ্রনাথের নয় । মধুসূদন বিহারীলালের হওয়া সম্ভব নয় । ভাষা, শব্দ, ছন্দ একেবারে আধুনিক । সুধীন দত্ত বিষ্ণু দে প্রেমেন্দ্র মিত্রদেরও নয় । তাদের লেখা বৈজয়ন্ত পড়েছে, পড়ায় । আরো আধুনিক কেউ ? তবু যেন অন্যরকম । চেনা কোনো কবি নয় । বইয়ের যা চেহারা, অন্তত একালের কেউ হবার কথা নয় । হয়তো কোনো কবিযশোপ্রার্থী তরুণের প্রথম অবদান -- এখন পরিচয়হীন । বন্ধুদের মধ্যে কয়েকজনকে পড়াতে হবে, ওরা যদি ধরতে পারে, বিষ্ণু বা অশোক । ছোটো ছোটো কবিতা । বৈজয়ন্ত রাত জেগে কয়েকটি কবিতা টুকতে শুরু করলো । আশ্চর্য নতুন লাগে, অথচ অচেনা, অথচ পুরোনো । যতিচিহ্নহীন । পুরোনো বানান । তত্সম শব্দ খুব কম । আত্মমগ্ন, বিষণ্ণ -- নশ্বরতার ঈশ্বর যেন ছড়িয়ে দিচ্ছেন তার দু:খ, শব্দের মধ্যে ঘনিয়ে উঠছে মেঘের অভিমান, অনেক দূরের কোনো জলধারার ভিজে ছোঁয়া । সারারাত ধরে কি একটা ঘোরের মধ্যে বৈজয়ন্ত অনেকগুলো কবিতা কাগজে টুকে ফেল্লো । যেন কি একটা নেশায় পেয়েছে তাকে ।

    পরের দিন ঘুরে ঘুরে সে বিষ্ণু, অশোককে দেখালো কয়েকটি কবিতা -- এমনকি কয়েকজন কবি বন্ধুকেও । নানা আলোচনায়, সেমিনারে তারা অংশ নেয় । খুব নামডাক । বইটা সে নিজের কাছে রাখলো । তার হাতের লেখা কাগজ থেকে পড়ে শোনালো -- বল তো কার লেখা ? বিষ্ণু বল্লো : ফাজলামির আর জায়গা পাসনি ? পরীক্ষা করছিস ? এতো তোর লেখা । তবে একটু বদলেছে লেখা, বেশ হয়েছে, চলে যায় । এ-পর্যন্ত কেউ অন্য কথা বলেনি । কোনো কবির নাম উঠে আসেনি । অনেকেই ভেবেছে কায়দা করে বৈজয়ন্ত তার কবিতা ওদের পড়িয়ে নিলো । নইলে ওর কবিতা খুঁজে পেতে পড়বার দায় কার পড়েছে ।

    নিজে সে অবাক । কবিতাগুলি যতই পড়ছে, ততোই ভালো লাগছে । এ কবিতাগুলি আগে অন্যেরা কেউ পড়েনি, বোঝা গেল । চেনাজানা কবিতা-পড়ুয়া মানুষেরা এই কবিতার সঙ্গে পরিচিত নয় । অখ্যাত অপরিচিত হারিয়ে যাওয়া এক কবিকে আবিষ্কার করেছে সে । কিন্তু কে সে ? কিরকম ছিল তার জীবন ? সে কি বেঁচে আছে এখনও ?

    রবিবার বিকেলে চলে এলো সুধাময় আর নীলাঞ্জন -- দুর্গাপুরের ছেলে দুটি । নতুন কবিতার কাগজ তাদের 'বিকল্প জীবন' । অল্পবয়সী ছেলেমেয়েরাই পারে কবিদের বিখ্যাত করতে । ওদের আবেগ আছে, সততা আছে, হয়তো আছে । ওরা কেন যে এতো লোক থাকতে বৈজয়ন্তকে পাকড়াও করেছে সেটা ভেবেই অবাক লাগে । মনে হলো একটা জুয়া, একটা বাজি, একটা শঠতা, একটা ঝুঁকি । বৈজয়ন্ত সেই মলাটহারা বই থেকেই টোকা পাঁচটি কবিতা ওদের দিলো ছাপার জন্য । কবিতার নামকরণ তার নিজের । তারপরই শুরু হলো মামুলি সাক্ষাত্কার । একান্তই ঘটনাহীন সাদামাটা জীবন তার । কোথায় থাকতেন, কোথায় পড়তেন, কাদের প্রভাব আছে লেখায়, কবে কিভাবে লেখা শুরু করেন, আপনি কি মনে করেন যে কবিতাকে হতে হবে সংগ্রামের হাতিয়ার ? ওরে-ব্বাপ । আমতা আমতা করে ওদের নানান ধরনের বলগুলো ঠুকে ঠুকে কোনোক্রমে ক্রিজে দাঁড়িয়ে থাকার চেষ্টা করে যাচ্ছে সে । এমন সময় গুগলি : বৈজয়ন্ত তো আপনার আসল নাম নয়, তাই না ? ঢোঁক গিলে সে বলে : না মানে, বাবার কথা মতো কলেজে উঠেই এফিডেবিট করে, কাগজে বিঞ্জাপন দিয়ে নামটা বদলানো হয় -- মানে "নিরাপদ" নামটা খুব নিরাপদ ঠেকেনি তখন । সময়ের সঙ্গে তাল রেখে.. । বলতে বলতে মেদিনীপুরে তেরপেখিয়া গ্রামে তাদের একমোলি বাড়ির কথাটাও মনে পড়ে যায় । সেই মাঠ, কিছু দূরে হলদি নদী, পুকুর, আমলকি গাছ, ভাঙা মন্দির, শিবানী ... সবকিছু সামান্য সময়ের জন্য এই লবনহ্রদের আটশো বর্গফুটের ঝুলন্ত খাঁচার মধ্যে পাখা ঝাপটাতে থাকে, দু:খের আতর মিশে যায় বাতাসে । নিজেকেই বড়ো অচেনা বলে মনে হতে থাকে । যে-জয়ের কথা ভেবে সে নাম নিয়েছিল বৈজয়ন্ত সেই জয়ের সঙ্গে বাস্তবে তার দেখা হয়নি আজও । অতি সাধারণ মামুলি একটা জীবন অহংকারী একটা নাম নিয়ে প্রহসনের মতোই কেটে যাচ্ছিল এতকাল ।

    এই সময়ই ঘটলো ব্যাপারটা । গতানুগতিকতার মধ্যে একটা নতুন পালাবদলের নাটক, ভিতরে বাইরে তার জীবন বদলে গেল অনেকটা ; দীপার চোখেও তা স্পষ্ট । একটা অস্বস্তি যেন বাসা বেঁধে আছে কোথাও । যেন হিসেব মিলছে না ঠিক । তবু সম্মান সংবর্ধনা নাম যশ কে না চায় ? যে-বয়সে বেশিরভাগ মানুষ থেমে যায়, সেই সময়েই তার জীবনে নতুন অধ্যায় জুড়ে দিলেন যেন বিধাতা । একি কৌতুক না করুণা ?

    "বিকল্পজীবন" প্রকাশিত হলো । অনেকের হাতে পৌঁছে গেল । নতুন কাগজ এমন কিছু সাড়া পড়ার কথা নয়, কিন্তু কি আশ্চর্য, বৈজয়ন্তের কবিতাগুচ্ছ অনেকের চোখে পড়লো । এমনকি সমুদ্র বসুর মতো বিদগ্ধ কবি অধ্যাপক ও মনীষীও বল্লেন, একেবারে অন্যরকম, নতুন, বাংলা কবিতায় নতুন হাওয়া এনে দিল । সাবাস । বেশ কয়েকটি কবি সম্মেলনে তাকে যেতে হলো, কবিতা পড়তে হলো, তার অনুরাগী ভক্ত জুটে গেল । সমুদ্র বসুর মন্তব্য উসকে দিলো অনেকের প্রশংসা ও সমীহ । কেউ কেউ অবশ্য একটু তির্যক মন্তব্যও করলো । সেটা না হলেও যেন মানাতো না । তাতে প্রচার বরং বাড়লো । নানা পত্রপত্রিকা থেকে লেখার আমন্ত্রণ আসতে আরম্ভ করলো । নামকরা বড়ো পত্রিকার চিঠি, টেলিফোন । প্রত্যেকটি কবিতা নিয়ে তরুণদের মধ্যে আলোচনা, বিতর্ক । ছোটো ছোটো কাগজে স্ফুলিঙ্গের মতো বৈজয়ন্তের নাম, খ্যাতি ছড়িয়ে পড়তে লাগলো । বেশ লাগতো এই তাপটুকু উপভোগ করতে । এতো নিরুত্তাপ নিরুত্তেজ বর্ণহীন অস্তিত্ব ছিল তার । সমালোচনা যতো হয় -- ততোই তার প্রচার, প্রশংসা । কয়েকটি কবিতা হিন্দিতে ইংরেজিতে অনুবাদ হয়ে প্রকাশিত হলো । অনেকের চোখ টাটাচ্ছে, আর মজা বাড়ছে বৈজয়ন্তের । দীপা শুধু একদিন বলেছিল : এই বয়সে নতুন করে প্রেমে পড়লে নাকি কারো ? নইলে কবিতা তো এতকাল ধরেই লিখে এসেছ ! ভাগ্যিস, দীপার কাছেও সেই মলাটছেঁড়া বইয়ের কথা বলা হয়ে ওঠেনি ! এক প্রচ্ছন্ন পাপবোধ, সে কেবলই তার নিজস্ব । এখন কোনো সাহিত্যসভা, কবি সম্মেলন, কলকাতায় হোক বা মফস্বলে কোথাও বৈজয়ন্ত ছাড়া প্রায় শিবহীন যজ্ঞ । সর্বদা ভয়ে ভয়ে থাকে, যদি কেউ এসে বলে "এ কবিতাগুলো তোমার নয় হে । আমার ।" না, কেউ বলেনি । পঞ্চান্নটি কবিতার ভাঁড়ারও ফুরিয়ে এসেছে এক বছরে । এর মধ্যে এক নামকরা প্রকাশক প্রকাশিত চল্লিশটি কবিতা নিয়ে একটি সুদৃশ্য কবিতার বই ছেপেছে, তার ছবি ও সংক্ষিপ্ত জীবনী সহ -- ব্যাপক বিঞ্জাপন, আলোচনা । তারই পরিণতি, মধুর পরিণতি আজকের পুরস্কার । এ-রাজ্যের সরকারি পুরস্কার । স্বীকৃতি । কিন্তু ছোটো বইখানা যে শেষ হয়ে এসেছে, এরপর ? আবার কোনো একটা বই তার হাতে এসে যাবে না কি ? সেও কি হয় ?

    - স্যার, এসে গেছি । রবীন্দ্রসদনের সামনে ট্যাকসি থামতে বাস্তবে ফিরে আসে বৈজয়ন্ত । ভাড়া মিটিয়ে শান্ত পায়ে সভাঘরের দিকে হাঁটে । সে নয়, যেন অন্য কেউ । ভিতরে এক অনিশ্চিত অস্থিরতা । যেন অন্য কারো পাওনা সে নাম ভাঁড়িয়ে চুরি করতে যাচ্ছে । একদল তরুণ তাকে ঘিরে ধরে মুহূর্তের মধ্যে ।

    সভাঘর ভর্তি লোক । আয়োজনও বেশ জমকালো । দূরদর্শনের লোকেরা ছবি তুলছে । ফুলে ব্যানারে সাজানো মঞ্চ, সুদর্শনা ঘোষিকা, মন্ত্রীমশাই এসে গেছেন । অনেক বিখ্যাত মানুষকে চিনতে পারলো সে । আচ্ছা, কাগজের বিজ্ঞাপন দেখে শিবানীও যদি চলে আসে সভায় ? ঈশ্বর তো কত অসম্ভবকেই সম্ভব করে দিতে পারেন । একবার যদি দেখা হতো শিবানীর সঙ্গে, এই বেশে, এই পরিবেশে ! কোথায় আছে সে ?

    যুদ্ধক্ষেত্রের মতো শিল্প সাহিত্যেও কত না শিবির ! কিন্তু এখানে সবাই হাসি হাসি মুখ । মন্ত্রীর হাত থেকে মানপত্র, উপহার আর চেক নেবার সময় ঘনঘন ক্যামেরার আলো । তার কবিতা নিয়ে দু-চার কথা বল্লেন সমুদ্র বসু নিজেই । কি পরিশীলিত বাকভঙ্গি । ঘনঘন হাততালি । -- এবার আপনি কিছু বলুন । সচিব মশাই অনুরোধ করেন । এক উথাল ঢেউয়ের শীর্ষ থেকে বৈজয়ন্ত দেখতে পাচ্ছে সমস্ত সভাঘর লোকে লোকারণ্য ।

    -- আমার বেশি কিছু বলার নেই । এসব কিছুর জন্য আমি কৃতজ্ঞ । মনে হয় এসব আমার যেন পাওনা নয় । এসব লেখাও যেন আমার নয়, আমাকে দিয়ে যেন লিখিয়ে নিয়েছে কেউ । আমি তাকেই দেখতে চাই, জানতে চাই । -- আবার হাততালি । তবু বৈজয়ন্ত স্পষ্ট দেখতে পায়, এক অতিমলিন গরিব চেহারার দু:খী একটা মানুষ মাথা নিচু করে উঠে যাচ্ছে শেষের দিকের কোনো সিট থেকে, মিশে যাচ্ছে ভিড়ের মধ্যে । অন্ধকারে ।

  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments