• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ২৯ | মার্চ ২০০৩ | ভ্রমণকাহিনি, প্রকৃতি, বাকিসব
    Share
  • প্রেসিডেন্সি কলেজ : মীনাক্ষী দত্ত


    উইমেনস ক্রিশ্চান কলেজ থেকে আই,এ পাশ করার পর শুরু হলো সমস্যা : মা-বাবার সঙ্গে বিতর্ক । উইমেনস ক্রিশ্চান কলেজ পাড়ার কলেজ, সুরক্ষিত । প্রিন্সিপাল ছিলেন ডাকসাইটে স্টেলা বোস । কাজেই ঐটুকু পথ একা যাতায়াত করতে দিতে মা ভয় পাননি । তাও পারলে অবশ্য নিজে গিয়ে পৌঁছে দিয়ে আসেন । মার ছিলো ভয়ানক উদ্বেগ বাতিক, বাড়ি ফিরতে দশমিনিট দেরি হলে আর উপায় নেই । এতোদিন পর্যন্ত, ষোলো বছর বয়স পর্যন্ত, বলতে গেলে একা একা ট্রামে বাসে চড়ে কোথাও যাইনি, ঐ এক কলেজ ছাড়া । কিন্তু এবারে আমি বেঁকে বসেছি প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হবোই হবো ।

    এই দুর্বার ইচ্ছের অনেক কারণ । প্রেসিডেন্সি কলেজ কিংবদন্তী -- সেখানে সুভাষচন্দ্র বসু পড়েছেন, শ্রেষ্ঠ ছাত্রছাত্রী ও শিক্ষকদের সেটা মিলনক্ষেত্র । সে-সব তো আছেই, কিন্তু আসল ব্যাপার অন্য । প্রেসিডেন্সি কলেজ বাড়ি থেকে বহু দূর । সুতরাং স্বাধীনতা । তাছাড়া এতোদিন পড়েছি শুধুই মেয়েদের সঙ্গে, আমাদের আমলে কোনো স্কুলে কোএডুকেশন ছিলো না -- কলকাতায় সাউথপয়েন্টই প্রথম । প্রেসিডেন্সি কলেজে ছেলেদের সঙ্গে পড়ার ব্যাপারটা উত্তেজক ।

    বহু তর্ক বিতর্কের পর প্রেসিডেন্সি কলেজ স্থির হলো -- এবারে বিষয় । অর্থাৎ কিসে অনার্স নিয়ে পড়বো । আমার খুব মনস্তত্ত্ব পড়ার ইচ্ছে ছিলো । কিন্তু প্রেসিডেন্সি কলেজে ‘মনস্তত্ত্ব' বলে কোনো বিষয় নেই । দর্শন পড়লে একটা বিশেষ পেপার ছিলো মনস্তত্ত্ব তাই আমি দর্শন পড়বো স্থির করলাম, দর্শনে যদিও আমার আগ্রহ ছিলো না । এবারে বাবার খুব আপত্তি, বাবার ইচ্ছে ইংরিজি সাহিত্য নিয়ে পড়ি আর নয়তো ইতিহাস কারণ বাবার বন্ধু সুশোভন সরকার ইতিহাস বিভাগের প্রধান । অর্থনীতির প্রধান ছিলেন ভবতোষ দত্ত তিনিও বাবার বন্ধু । কিন্তু অর্থনীতি তো পড়ার প্রশ্নই ওঠে না বাবার মতে । ইংরিজি বিভাগের প্রধান ছিলেন তখন সুবোধচন্দ্র সেনগুপ্ত । তিনি খুব আগ্রহ দেখিয়েছিলেন আমাকে নেবার জন্য, ভুলভাবে ধরে নিয়ে যে পিতার কন্যা হিসেবে আমি ভালো ছাত্রী হবো । অবশেষে একদিন বাবার সঙ্গে গিয়ে ভর্তি হয়ে এলাম প্রেসিডেন্সি কলেজের দর্শন বিভাগে ।

    তারপর উত্তেজনা -- কলেজ কবে খুলবে আর মায়ের সমস্যা কী করে কলেজে যাবো । শেষ মেষ বাবলু (অজিত দত্তর বড়ো ছেলে অনিরুদ্ধ, যাকে আমি দাদা বলতাম) সমস্যার সমাধান করে দিলো । সে বুক ঠুকে গর্বিত ভাবে জানালো তার ‘`রক''-এর বন্ধু পদু (প্রদীপ দাস) ফার্স্ট ইয়ার থেকে প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়ছে, সে নিয়ে যেতে রাজী হয়েছে আমাকে । সঙ্গে সঙ্গে মা পদুকে তলব করলেন, এবং সাক্ষাত্কারে পদু ভালোভাবে উত্তীর্ণ হলো । মুখে বিরক্তি দেখালেও মনে মনে আমিও নিশ্চিন্ত হলাম কারণ একা একা কলেজ স্ট্রীট যাওয়ার চিন্তা আমাকে বেশ নার্ভাস করে দিচ্ছিলো ভেতরে ভেতরে ।

    প্রদীপ ফার্স্ট ইয়ার থেকে পড়লেও, মেয়েদের সঙ্গে পড়েনি কারণ তখন প্রেসিডেন্সি কলেজে কেবলমাত্র থার্ড ইয়ার থেকে মেয়ে নেওয়া হতো ।

    গোলপার্ক থেকে দোতলা বাস যেতো কলেজস্ট্রীট, এক্সপ্রেস বাস, যার প্রথম স্টপ এসপ্ল্যানেড । গোলপার্কের বাসস্টপে পরে কতো কী ঘটনা ঘটবে যার মধ্যে একটা হচ্ছে লম্বা ফর্সা এক যুবক রোজ আমার জন্য অপেক্ষা করবে ও সঙ্গে যাবে কলেজ পর্যন্ত । প্রদীপ আর আমি একদম সামনের সিটে গিয়ে বসলাম । লেকের সবুজ, রেড রোডের সবুজ পার হলাম । আমার মনে হলো নতুন জীবনে প্রবেশ করছি । কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাড়ি পার হয়ে কলেজ স্ট্রীটের মোড়ে আমাদের স্টপ, হৃংঔঙি -এর গায়ে । প্রদীপ তো তখন আমার অভিভাবক । আর আমি যাকে বলে ‘স্টারি আইড ।' প্রদীপ গাইডের মতো সব দেখাচ্ছে । ঐ দ্যাখো ঐ বাড়ির দোতলায় কফিহাউস, একটু পরেই তোমাকে নিয়ে যাবো ; ঐ যে সংস্কৃত কলেজ । পাঁচিলের গায়ে গায়ে পুরোনো বই-এর দোকান, শুধুমাত্র গেটটুকু বাদ । চওড়া লোহার গেট দিয়ে ঢুকলে এক কোনায় পাহারাদারদের ঘর । বটগাছের তলা সিমেন্টে বাঁধানো । সেখানে বসে একটি ছেলে গভীর মনোযোগ দিয়ে বই পড়ছে, তার শ্যামল কিশোর মুখখানি দেখলেই ভালো লাগে । প্রদীপ বললো, ও পার্থসারথি গুপ্ত, আমাদের এক ক্লাস উপরে পড়ে । বাঁ দিকে মাঠের প্রান্তে হেয়ার স্কুলের বাড়ি ও তার পাশে বেকার ল্যাবরেটরি যেখানে বিজ্ঞানের ক্লাস হয় । ডান দিকের প্রধান বাড়িতে হিউম্যানিটিজ বিভাগ, আমরা বলতাম আর্টস । চারধাপ সিঁড়ি উঠে মোটা থামওয়ালা বারান্দায় ঢুকেই ডানহাতে জিওলজি বিভাগের রাজকীয় ঘর, তার পাশে ছেলেদের কমনরুম । বাঁদিকে সার সার থামের মাঝে দেয়ালে কাঠের ফ্রেমে দেয়াল পত্রিকা `দেয়ালী' আর জগদীশচন্দ্র বসুর আবক্ষ মূর্তি । বারান্দার ঠিক মাঝখানে এলে চওড়া সিঁড়ি যার সামনে পোর্টিকোর তলায় গাড়ি এসে দাঁড়ায় । সিঁড়ির নিচে দাঁড়ালে দেখা যায় দোতলার বারান্দার ঘন্টা । এই সিঁড়িতেই সুভাষচন্দ্র বসু ওটেন সাহেবকে পিটিয়েছিলেন এমন কিংবদন্তী এবং এই সিঁড়িতেই পরে কতো না চোখাচোখি, আলাপ ও অভিমান যা হবে সুভাষচন্দ্র-ওটেনের ঘটনার চেয়ে আমাদের কাছে অনেক বেশি জরুরি । বারান্দার শেষ প্রান্তে লাইব্রেরি । সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠলে বারান্দা, বাড়িটার সামনে ও পিছনে ঐ দুই বারান্দার মাঝে আছে শিক্ষকদের আরাম-কক্ষ, প্রিন্সিপালের ঘর ও অফিস । দুপাশে করিডর, তার একদিকে রাস্তার দিকে মুখ করে মেয়েদের কমনরুম, দরজায় মোটা পর্দা, সাদামাটা ঘর । কিন্তু একটা সেকেলে কায়দার ড্রেসিংটেবিল ছিলো, ঘরের ভেতরেই দেয়ালের আড়ালে ছাদহীন পাউডার রুম । অন্যদিকে ইংরিজি বিভাগ ও ক্লাসঘর । তিনতলায় শুধুই ক্লাসঘর । `তোমার অনার্স ক্লাস তিনতলায়' বলে প্রদীপ আমাকে ক্লাস দেখাতে নিয়ে যায় । দুপাশের বারান্দায় দরজা, তাতে কাঠের রডে সবুজ পর্দা ঝুলছে । বেঞ্চিগুলো সাজানো ইংরিজি শ্‌ অক্ষরের মতো, মাঝের ডাণ্ডাটা বাদ, অধ্যাপকের চেয়ার মাঝখানে । ছেলেমেয়েরা পাশাপাশি বসে না, ছেলেরা একদিকে, মেয়েরা আরেকদিকে ।

    প্রদীপ আমাকে কমনরুমের সামনে ছেড়ে দিয়ে চলে যায় এবং আমার রুটিন দেখে বলে যায় কখন আমাকে কফিহাউসে নিয়ে যাবে । প্রথম দিনেই একটি মেয়েকে নিয়ে কফিহাউসে যেতে পেরে সে নিশ্চয়ই দারুণ গর্বিত হয়েছিলো কিন্তু ভাবখানা দেখাচ্ছিলো যেন নিতান্তই কর্তব্য করছে ।

    কমনরুমের খোলা জানালা দিয়ে ব্যস্ত রাস্তার হরেক কলরব ভেসে আসছে । ছাত্রীসংখ্যা খুবই কম ; যারা ফোর্থ ইয়ারে উঠেছে তারা বেশ আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে কথা বলছে আর নতুনরা সব আড়ষ্ট হয়ে বসে আছে । আমার ভাগ্য ভালো, ঢুকেই দেখি আমার স্কুলের বন্ধু ও নেমসেক মীনাক্ষী চালিহা । মীনাক্ষী আসামের মেয়ে, তার কাকা একসময় আসামের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন । ম্যাট্রিক পাশ করার পর সে আসামে চলে গিয়েছিলো, বি,এ পড়তে কলকাতায় এসেছে । মীনাক্ষীর দিদি ও দাদা বাঙালি বিয়ে করেছেন বলে মীনাক্ষীর মায়ের ইচ্ছে ছিলো মীনাক্ষী স্বদেশীয় কাউকে বিয়ে করে । কিন্তু তাঁর সে ইচ্ছা পূর্ণ হয়নি, মীনাক্ষীও একটি বাঙালি ছেলেকে বিয়ে করলো । মীনাক্ষীকে দেখার জন্য বিশ্বপ্রিয় বসু সেন্ট্রাল কলেজের ক্লাস ফাঁকি দিয়ে প্রেসিডেন্সি কলেজে চলে আসতো রোজ, মীনাক্ষী তাকেই পুরস্কৃত করলো ।

    ১৯৫৩ সাল সেটা । নকশাল আমল আসবে আরো সতেরো বছর বাদে, এবং এই কলেজেই বপন হবে তার বীজ । কিন্তু আমরা তখন শিক্ষকদের মধ্যে অনেককেই উপাসনা করতাম । প্রেসিডেন্সি কলেজ ছিলো স্বয়ংশাসিত একটি প্রতিষ্ঠান, যদিও সরকারি কলেজ এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন, প্রেসিডেন্সি কলেজ জনগণের নয় । স্যার আশুতোষের আমল থেকে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ও ইংরেজ সরকারের মধ্যে যে প্রচণ্ড ক্ষমতার লড়াই চলেছে তার রেষ তখনো আছে । বিশেষ বিশেষ রাজ্যে একটি করে কলেজ থাকতো সরকারের বিশেষ পক্ষপাতপুষ্ট ও দৃষ্টির অধীন । সে-সব কলেজ থেকেই বেরুতো সব জজ ব্যারিস্টার, আই,সি,এসের ঝাঁক ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের নেটিভ স্তম্ভ হয়ে । আবার ঈশান স্কলার, প্রেমচাঁদ-রায়চাঁদ স্কলার এরা সব বেরুতেন, যেতেন অক্সফোর্ডে কেম্ব্রিজে, ফিরে এসে শিক্ষকতা করতেন । সে যুগের তুলনায় তাঁদের মাইনে হতো ঈষর্ণীয় । প্রেসিডেন্সি কলেজে যাঁরা শিক্ষকতা করতেন তাঁদের বদলি করা হতো না, রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের তো প্রশ্নই ওঠে না ।

    মীনাক্ষী আর আমি রুটিন দেখে সময় মতো ক্লাসে গিয়ে বসলাম । ছেলেরা ও মেয়েরা পার্লামেন্টে সরকারপক্ষ ও বিরোধীপক্ষের মতো -- শুধু স্পিকারের বদলে অধ্যাপক মাঝখানে । দর্শনের ছেলেদের তেল চপচপে চুল পাটপাট করে আঁচড়ানো । পরণে ধুতি ও ফুলসার্ট যার গলা পর্যন্ত বোতাম বন্ধ এবং লম্বা হাতাও বোতামে আবদ্ধ । দেখেই বোঝা যায় স্পেশাল পেপার সংস্কৃত । মেয়েরা এদিকে চটুল চপল ও ঝলমলে এবং সহপাঠীদের দেখে আমার মতোই আশাহত ।

    ঐ নৈরাশ্যের পরই আরেক ধাক্কা । পর্দা সরিয়ে প্রবেশ করলেন অধ্যাপক । ওরকম বেশভূষা উনিশ শতক নিয়ে তোলা সিনেমায় ছাড়া আর দেখিনি : পায়ে তালতলার চটি, ধবধবে সামান্য হেঁটো ধুতি ও কনুই-হাতা মোটা কাপড়ের ফতুয়া । সাদা উড়নি । চুল কদমফুলের মতো ছাঁটা তাতে শোভা পাছে টিকি । বিখ্যাত পণ্ডিত, দার্শনিক গোপীনাথ ভট্টাচার্য । আমরা সবাই উঠে দাঁড়িয়ে হাত জোড় করে নমস্কার করলাম, বসতে বলে নিজেও বসলেন । তারপর ক্লাসের উপর একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে বললেন, ‘মোচলমান টোচলমান কেউ আছো নাকি ?' আমরা মেয়েরা তো বটেই, এমনকি ক্যাবলা ছেলেরাও হাঁ করে তাকিয়ে রইলো তাঁর প্রতিক্রিয়াশীল অনাধুনিক উপস্থিতির সামনে । হিন্দু মুসলমান ব্যাপারটা নিয়ে আমার কোনো সচেতনতাই ছিলো না । যদিও মাত্রই ছ-বছর আগে দেশভাগ হয়েছে, সাম্প্রদায়িকতাকে শিক্ষিত মহলে সংস্কারাচ্ছন্ন বর্বরতা বলে মনে করা হতো ।

    সময় লেগেছিলো গোপীনাথবাবুকে গ্রহণ করতে কিন্তু তাঁর পাণ্ডিত্য, ঋজুতা ও দৃঢ়তা ত্রক্রমেই আমাকে আকর্ষণ করতে শুরু করলো । তাঁকে মনে হতো পর্বতের মতো খাড়া, পুষ্পশোভাহীন । নিজের বিশ্বাসে অটল মানুষেরা হয়তো এইভাবেই প্রভাব বিস্তার করেন । হয়তো সে সময়ে ঢাকায় কি লাহোরে কোনো দাড়িওয়ালা টুপিপরা ইসলামিক পণ্ডিত কোনো ক্লাসে গিয়ে প্রশ্ন করছেন, ‘কৈ কাফের হ্যায় ক্লাসমে ?'

    ভারতীয় দর্শন পড়াতে গিয়ে গোপীনাথবাবু ভারতের ইতিহাস বলতেন । তাঁর মুসলিম বিরোধীতার ব্যাখ্যা পাওয়া যেতো । তাঁর চিন্তা স্বচ্ছ, প্রকাশভঙ্গি প্রাঞ্জল । ইংরিজি স্বচ্ছন্দ, জার্মান দার্শনিক ইমানুয়েল কান্ট কি প্রাচীন নৈয়ায়িকদের মতো যুক্তিতে অকাট্য । ওঁর সাম্প্রদায়িকতাটাকে একটা ইডিওসিনক্রেসি বলে ধরে নিয়েছিলাম । মনে করতাম চাঁদের কলঙ্ক । মনে হতো ঐ পোশাকে, শ্যামল, উজ্জ্বল ত্বকে তিনি সুন্দর ।

    ইতিহাস বিভাগের প্রধান সুশোভন সরকার ছিলেন গোপীনাথবাবুর বিপরীত । দীর্ঘকায় ও সুদর্শন, মৃদুভাষী ; বারোমাস ট্রপিকাল স্যুট পরতেন, খড় কি ঘাস রঙের । তিনি ছিলেন বিখ্যাত বামপন্থী, শুনেছি ছদ্মনামে বই লিখতেন -- মার্কসিস্ট প্রাইমার -- জনসাধারণকে মার্কসবাদ বোঝানোর জন্য । সঠিক মনে পড়ছে না -- বোধহয় তাঁর ছদ্মনাম ছিলো অমিত সেন । কলেজের প্রসপেকটসে লেখা ছিলো সুশোভন সরকার, এম,এ অক্সন ।

    অর্থনীতি বিভাগের প্রধান ভবতোষ দত্ত থাকতেন আমাদের ঠিক পাশের বাড়িতে, একই গাছের ছায়ায় । আমাদের মতো তাঁদেরও ছিলো দোতলার ফ্ল্যাট এবং সামনে চিলতে বারান্দা । সেই বারান্দায় দাঁড়িয়ে মা কাকিমা ভবতোষ দত্তর মা ও বোনের সঙ্গে গল্প করতেন । ওঁরা তিন ভাইবোনই অধ্যাপনা করতেন । ওঁর ভাগ্নি পম্পা এখন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ায় । ভবতোষবাবু করিডোর দিয়ে সোজা মাথা গোঁজ করে চলে যেতেন, কারু দিকে চোখ তুলে তাকাতেন না । উনিও স্যুট পরতেন । তাঁর ক্লাস করিনি, শুনেছি ক্লাসে তিনি কঠিনতম তত্ত্বকেও সহজ করে দিতেন । জন মেনার্ড কেইনসকে মনে হতো সহজপাঠ ।

    ইংরিজির শিক্ষকদের মধ্যে আমার সবচাইতে ভালো লাগতো মৌংঐ -কে -- তারাপদ মুখার্জি । তিনি আমাদের ওথেলো পড়িয়েছিলেন । পড়াতেন ভালোবেসে, নাটকের চরিত্রগুলি জীবন্ত করে তুলতেন ; দুহাতের মুঠি বদ্ধ করে তাঁর সেই বলা `ঈশছস্ছঞঠব ঠশধত্রষ্‌ বছত্রত্রধঞ ভধ ংঈণ্ণশঞচ্‌ংশ ঞচ্ছত্র ঞচ্ঠয' মনে পড়ে । সুবোধচন্দ্র সেনগুপ্ত পড়িয়েছেন ‘মিড সামার নাইটস ড্রিম' । তিনি ছিলেন বিভাগীয় প্রধান, কিন্তু শিক্ষক হিসেবে আকর্ষণীয় ছিলেন না । বোধহয় পাস ক্লাস বলে মন দিতেন না, ছাত্ররাও তাঁকে তাঁর মুদ্রায় ফেরৎ দিতো । পাস ক্লাস বেশ বড়ো হতো, শিক্ষকের দুইপাশে মেয়েরা, সামনে ছেলেরা -- এমনিতেই কেউ মন দেয় না সুবোধবাবুর পড়ানোও ছিলো শ্লথগতি । একদিন এক ছাত্র গান গেয়ে উঠেছিলো, ‘তন্দ্রা এলো, বলো জাগি কেমন করে / ঘুমের দেশের পরী এসে নিল আপন করে ।' মেয়েদের চাপা হাসি আর ছেলেদের গুঞ্জনের মধ্যে সুবোধবাবু প্ল্যাটফর্মের উপর দাঁড়িয়ে পড়িয়ে চললেন ।

    ছাত্রছাত্রীর প্রতি ব্যাক্তিগত আগ্রহ দেখাতেন সুবোধবাবু । তখন বুঝতাম না এখন তার মূল্য বুঝি । তাঁর বাড়ি ছিলো একডালিয়ার মোড়ে । আমি তখন সাউথপয়েন্টে পড়াই । ভোরবেলা তাঁর বাড়ির পাশ দিয়ে যেতাম । দেখতাম সামনের ঘরে বসে তিনি চোখের সামনে বই ধরে পড়ছেন । একদিন আমাকে স্কুলে নামিয়ে দিয়ে জ্যোতি ওঁর সঙ্গে দেখা করতে গেলো । ও দরজার সামনে দাঁড়িয়ে বললো, ‘আসতে পারি, স্যার ?' জ্যোতির পিছনে রোদ সুতরাং দরজায় সম্পূর্ণ এক ছায়ামূর্তি । বিশবছর বাদে গলা শুনেই বললেন, ‘কে, জ্যোতির্ময় ?'

    ইংরিজি বিভাগের সবচাইতে বিখ্যাত অধ্যাপক ছিলেন তারক সেন । লাইব্রেরিতে ছোটো ছোটো খুপরি ছিলো ছাত্রছাত্রী বা শিক্ষকদের শান্তিতে পড়াশুনো করার জন্য । একদিন ওখানে আমরা কয়জন বসে ফিসফিস করে কথা বলছিলাম খুবই নিচু গলায়, হঠাৎ অতি কর্কশ স্বরে, `এয়ার্কি হচ্ছে, এযাঁ ?' শুনে চমকে তাকিয়ে দেখি কটমট করে তাকিয়ে রোগা লম্বা কে এক মূর্তি, দরজায় দাঁড়িয়ে । ইনিই তারক সেন, সেদিনের সে কী বকুনি, বাপরে বাপ ! লাইব্রেরিয়ান রহমান সাহেব বললেন, `তোমাদের সাহস কম নয় তো ! ওখানে তারক সেন বসেন, টুঁ শব্দ যেন না হয় ।'

    তারক সেনকে কলেজের অন্য কোথাও দেখা যেতো না । সেই যে সকালে ঢুকতেন ঐ গহ্বরে, বেরুতেন সন্ধ্যায়, দিনের আলোই দেখতেন না । যেন গঠজ়্ছশরু ধী ধজ়্‌ -- মনে হতো আমাদের । শুধু কতিপয় চিহ্নিত ছাত্রকে পড়াতেন । আধুনিক সাহিত্য সমালোচনা তাঁর মোটেই পছন্দ হতো না । তাঁর প্রধান আগ্রহ ছিলো ঞংন্ঞণ্ণছৎ বশঠঞঠবঠযস্‌ -এ । একবার তাঁর এক ছাত্র (নামটা উহ্য রাখছি) ম্যাকবেথের ভেরিওরাম এডিশন নিয়ে এসে সামনে রেখেছে চাল মেরে, কোর্সটা ছিলো ম্যাকবেথের উপরে । অন্যদের কাছে তো এক বিরাট চমক । তারক সেন বললেন, ‘দেখছো বুঝি ?' সে বললো, ‘হ্যাঁ স্যার, বধত্রযণ্ণত্ঞ করছি ।' ‘কোন লাইনটা ?' ছেলেটি অন্য কোনো লাইন মনে করতে না পেরে সবচাইতে বিখ্যাত লাইনটা আওড়ালো, `মধস্ধশশধগ ছত্ররু ঞধস্ধশশধগ ছত্ররু ঞধস্ধশশধগ... , `ও তা এবিষয়ে টেবল্ড কী পাঠ দিয়েছেন ?' ছেলেটি পাতা উল্টে যায়, টেবল্ড আর পায় না, কারণ সে জানে না উচ্চারণ টেবল্ড হলেও আঠারো শতকের বিখ্যাত এই সম্পাদকের নামের বানান মচ্‌ংধঢছত্রু । তারক সেন আবার শ/স/ষ সবই ইংরিজি -এর মতো উচ্চারণ করতেন । বললেন, 'ঘোড়া ডিঙিয়ে ঘাস( ) খেতে চাও ?'

    মার্কসবাদের যুগ সেটা, ‘চিনের চেয়ারম্যান আমাদের চেয়ারম্যান' নয়, সোভিয়েট রাশিয়ার জোসেফ যুগাসভিলি স্টালিন তখন ভারতের গুরু, অথবা তারও অধিক -- জাতীয়তাবাদ, গান্ধীবাদে বিরক্ত, ক্ষুব্ধ বামপন্থীদের সকলের পিতা । স্টালিনের মৃত্যুতে তথাকথিত বিদ্রোহী, বিপ্লবী, ক্ষুরধার বুদ্ধিজীবীদের সে কী আছাড়ি পিছাড়ি কান্না ! । যেদিন প্রথম জ্যোতিদের যতীন্দ্রমোহন এভিনিউর বাড়িতে গেলাম, ওর ঘরে ঢুকেই দেখি স্টালিনের বাঁধানো ছবি দেয়ালে টাঙানো, সোভিয়েট ইউনিয়ন পত্রিকা থেকে কাটা । ইংরিজির তরুণ অধ্যাপক অমল ভট্টাচার্যও ছিলেন এই ‘প্রগতিশীল' দলের । তিনি খ্যাতিমান তাঁর পাণ্ডিত্যের জন্য । শুধু মধ্যযুগের ইংরিজি সাহিত্য নয় । খুঁটিয়ে পড়েছিলেন ল্যাটিন সাহিত্য, আবার সেইসঙ্গে আধুনিক সাহিত্যও তাঁর নখদর্পণে ছিলো । সব সময় ধুতি পাঞ্জাবি পরতেন, খুব নিচু গলায় কথা বলতেন, তারক সেনের মতো উনিও পাস ক্লাস নিতেন না । শুনেছি স্টালিনের মৃত্যুর খবর পেয়ে ক্লাসে এসে চোখে রুমাল চেপে বলেছিলেন, 'আজ আমার পক্ষে ক্লাস নেওয়া সম্ভব নয় ।'

    ছাত্রদের সঙ্গে বন্ধুর মতো ব্যবহার ছিলো ইতিহাসের শিক্ষক প্রফেসর মাহমুদের । তাঁকে আমরা ক্যাপ্টেন মাহমুদ বলতাম কারণ দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় উনি সেনাবাহিনীতে ছিলেন । অক্সফোর্ডের ডিগ্রি ছিলো তাঁর, খুব ভালোবেসে ছিলেন ইংলণ্ড ও ইওরোপকে, অনেক গল্প বলতেন ইওরোপের । দেশভাগের পর একসময় তিনি ঢাকায় গিয়ে থাকার প্রয়াস নিয়েছিলেন । কিন্তু শেষ পর্যন্ত আবার ফিরে এসেছিলেন কলকাতায়, তাঁর পার্কসার্কাসের ফ্ল্যাটে । কলেজের মাঠে বসে ছাত্রদের সঙ্গে আড্ডা দিতেন ক্যাপ্টেন মাহমুদ । শিক্ষকতা থেকে পদোন্নতি হয়ে তিনি শিক্ষাদপ্তরে যখন ডি,পি,আই তখন এম,এ পাশ করার পর আমি তাঁর কাছে একবার গিয়েছিলাম চাকরির সন্ধানে । বলেছিলেন, আমার তো এই সমস্যা, প্রেসিডেন্সি কলেজের ছাত্র শুনলেই হলো, যেন একজন চাকুরিপ্রার্থীর তার চাইতে বড়ো যোগ্যতা আর কিছু নেই ।

    কোনো অজানিত কারণে, গোপীনাথবাবুকে সরিয়ে দর্শনের হেড অব দি ডিপার্টমেন্ট করে নিয়ে আসা হলো প্রভাসজীবন চৌধুরীকে । সুশ্রী, খুবই পণ্ডিত, বহু ডিগ্রিধারী প্রভাসজীবন ছিলেন নন্দনতত্ত্বের লোক এবং গোপীনাথবাবুর তুলনায় একজন আধুনিক মানুষ । কিন্তু গোপীনাথবাবুর ছাত্রচিত্তজয়ের অসাধারণ ক্ষমতা তাঁর ছিলো না । গোপীনাথবাবু প্রেসিডেন্সি কলেজ ছেড়ে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দিয়েছিলেন । সেখানে আমার বাবা স্থাপনা করেছিলেন ভারতের প্রথম ও এখনো পর্যন্ত একমাত্র তুলনামূলক সাহিত্য বিভাগ । সে সময়ে গোপীনাথবাবুর সঙ্গে বাবার পরিচয় হয় । তাঁর বিষয়ে আমার মুগ্ধতার কথা বাবা জানতেন এবং বাবারও তাঁকে খুব ভালো লেগেছিলো । অতি প্রাচীনপন্থী গোপীনাথ ভট্টাচার্য ও অতি আধুনিক বিদ্রোহী কবি বুদ্ধদেব বসুর মধ্যে বেশ একটা সহমর্মিতার সম্পর্ক স্থাপন হয় । অন্তর্বিভাগীয় মিটিঙে তাঁরা দুজন সাধারণত একমত হতেন ।

    দর্শনের আরেক অধ্যাপক ছিলেন অমিয় মজুমদার । তাঁর বয়স অল্প বলে মেয়েরা তাঁকে খুব পছন্দ করতো । পড়াতেনও খুব ভালো । তিনি আমাদের বাড়িতেও এসেছেন কয়েকবার । কিছুদিনের জন্য তিনি প্রেসিডেন্সি কলেজের প্রিন্সিপাল হয়েছিলেন এবং আমাকে পরীক্ষার আগে সাহায্য করেছেন ।

    বাংলার জনার্দন ভট্টাচার্য ছিলেন মধুসূদন ভক্ত, এবং বৈষ্ণব । কেউ মাইকেল বললে রেগে যেতেন, বলতেন, ‘বলবে শ্রী মধুসূদন ।' বাবার ‘মাইকেল' প্রবন্ধ পড়ে তিনি ক্ষেপে গিয়েছিলেন । আমি বু.ব-র মেয়ে জানতে পেরে বাবার উপরের রাগটা আমার উপর প্রথমটায় এসে পড়েছিলো । তিনি হিন্দু হস্টেলের সুপারিন্টেণ্ডেন্ট ছিলেন । কন্যারত্নদের কারণে তাঁর কোয়ার্টার নিয়ে ছাত্রমহলে খুব কৌতূহল ছিলো ।

    বাংলার ছাত্রপ্রিয় শিক্ষক ছিলেন দেবীপদ ভট্টাচার্য । তিনি গল্পও লিখতেন, মার `ছোটোগল্প' সিরিজে তাঁর গল্প প্রকাশিত হয়েছে । ছিলেন ক্ষুদিরাম বসু । আমার বাংলা স্পেশাল পেপার ছিলো তাই এঁদের কাছে পড়েছি । ‘ঘুমে চোখ না চায় জড়াতে / ঘুমহারা বসন্তের রাতে / স্কাইলাইট মাথার উপর' এই পঙ্ক্তি কটি ছন্দ পডা.তে গিয়ে দেবীবাবু ক্লাসে পড়েছিলেন প্রথম দিনে, তার অভিঘাত এখনো মনে আছে ।




    প্রেসিডেন্সি কলেজে সবে সপ্তাহখানেক হয়েছে । একটু একটু করে আড়ষ্টতা কাটছে । আমি, মীনাক্ষী, গৌরী, রানী, মৃদুলা, চিত্রা, চম্পা, মনিকা সব দল বেঁধে কফিহাউসে যাচ্ছি । এরই মাঝে দু'চারজন ছেলে এসে কমনরুমের সামনে দাঁড়িয়ে কোনো অজুহাত নিয়ে আলাপ করে গেছে । তখন ছেলেমেয়েরা অতো সহজে একসঙ্গে ঘুরতো না । আমরা পরস্পরকে নাম ধরে ডাকলেও, ‘আপনি' বলতাম । ছেলেরা নানান অজুহাত বানিয়ে মেয়েদের কমনরুমের সামনে এসে বিশেষ মনোনীতাকে ডাকতো । আমাদের দরজার সামনে বোধহয় একজন পাহারাদার গোছের কেউ বসে থাকতো । ঠিক খেয়াল হচ্ছে না । কেউ বলতো, আমরা পোয়েট্রি সার্কল করছি আপনি যোগ দিন, কেউ বলতো, আপনাকে ইলেকশনে দাঁড়াতেই হবে, কেউ বলতো সেদিন আপনার হাতে অমুক বই দেখলাম, একদিনের জন্য ধার দিন । যেন ‘চিরকুমার সভা'র ডায়লগ -- পূর্ণ বলছে নির্মলাকে ‘সেদিন বেলুন উড়েছিলো, আপনি দেখেছিলেন ?' পরিবেশ আলাদা কিন্তু খেলাটা একই । একদিন অনার্স ক্লাসে বসেছি আমরা, গোপীনাথবাবুর ক্লাস, তিনি মন দিয়ে পড়াচ্ছেন হঠাৎ ভারি গলায়, ‘আসছি সার' বলে যে ছেলেটি ঢুকলো তাকে দেখে মেয়েরা বেশ চকিত হয়ে উঠলো । লম্বায় সে ছফুটের বেশি ছাড়া কম নয়, পরণে সাদা জিনের প্যান্ট ও সাদা হাফসার্ট, সুন্দর মুখশ্রী, ঠোঁটের উপর সযত্নলালিত কিশোর গোঁফ, সুগঠিত দেহ । আমাদের সম্মিলিত মুগ্ধ দৃষ্টির দিকে পিঠ ফিরিয়ে অধ্যাপকের টেবিলে একহাত রেখে সে বললো যে সেদিন তারা স্ট্রাইক ডেকেছে । তিনি যদি দয়া করে পড়ানোটা বন্ধ রাখেন ! ক্লাসে গুঞ্জন, এই হলো সুনীতি ভোঁস, জি,এস । সে যতক্ষণ কথা বলছিলো, গোপীনাথবাবু হাতের বইটার দিকে চোখ নিবদ্ধ রেখেছিলেন তার কথা শেষ হবার পর একবার চোখ তুলে তার দিকে তাকালেন, তারপর পড়াতে শুরু করলেন । সুনীতি যে কী করে এখন ! সে জানে ক্লাসের ঝলমলে মেয়েরা তার দিকে তাকিয়ে আছে, দূর থেকে বিপ্লবের নানান স্লোগান, আওয়াজ ভেসে আসছে । তার প্রতি সহানুভূতিতে আমি আঙুল মটকাতে লাগলাম ; গোপীনাথবাবু চোখ তুলে আমার দিকে হঠাৎ তাকিয়ে বললেন, `ঈধত্র'ঞ রুধ ঞচ্ছঞ.' সুনীতি বেরিয়ে গেলো এবং বাইরে থেকে বলতে লাগলো, ‘আপনারা সবাই বেরিয়ে আসুন' কিন্তু কেউই বেরিয়ে গেলো না ।

    তখন ছাত্রদলে দুই শিবির -- স্টুডেন্টস ফেডারেশন ও ছাত্রপরিষদ । সুনীতি এস,এফ-এর সদস্য নয়, তার পরের বছর জি,এস হবে প্রদীপ -- সেও এস,এফ নয় । আমার যে-সব ছেলেদের সঙ্গে গভীর বন্ধুত্ব হলো তারা আবার সকলেই এস,এফ করে । কিন্তু ভোট দেবার সময় প্রদীপকেই ভোট দিলাম নীতিগত কারণে । আমি যাতে প্রদীপকেই ভোট দিই, প্রদীপের বিপক্ষে যে আমার অতি প্রিয় ছেলেটি দাঁড়িয়েছে তাকে না দিই সেটা বোঝাবার জন্যই সুনীতি বোধহয় প্রথমদিন আমাদের বাড়ি এসেছিলো, অন্তত সেটা একটা ভালো অজুহাত ছিলো । প্রথমদিন এসে সে ননস্টপ রসিকতা করে গেলো ও অন্যকাউকে কথা বলার সুযোগ দিলো না । পরে বলেছিলো সে নাকি ভয়ানক নার্ভাস ছিলো, সেটা কাটাতেই তার অতো কথা বলতে হয়েছিলো । সুনীতিকে আমাদের বাড়ির সকলের খুব পছন্দ হয়ে গেলো । মা তাকে আমাদের নাটকের দলে নিয়ে নিলেন । প্রদীপ তো ততোদিনে আমাদের পরিবারভুক্ত ; নাটকদলের পাণ্ডা হয়ে গেছে । ‘দালিয়া' নাটকে সুনীতি রহস্য খাঁ করেছিলো, আমি জুলেখা, রুমি আমিনা আর শোভেন ঠাকুর দালিয়া । শোভেন পাড়ার ছেলে, তার সুন্দর চেহারায় আমরা আমরা সবাই মুগ্ধ ছিলাম । প্রেসিডেন্সি কলেজের এযালামনাই এযাসোসিয়েশনে অভিনয় করার জন্য সুবোধবাবু আমাকে বাড়ি এসে অনুরোধ করেছিলেন । ‘গোরা' হচ্ছে শুনেই আমি বলেছিলাম, ‘আমি এক শর্তে করবো, গোরা আমি বাছবো ।' সুনীতির নাম শুনে সুবোধবাবু খুবই খুশি । আমরা ‘পথের দাবী' ও করেছিলাম । তাতে আমি সেজেছিলাম ভারতী, সুনীতি কী করেছিলো মনে নেই । তবে মনে আছে সে নাটকে বিখ্যাত অভিনেতা বিকাশ রায় ও সংস্কৃতজ্ঞ গৌরীনাথ শাস্ত্রীও অভিনয় করেছিলেন ।

    একদিন আমি ভিড়ের বাসে কলেজ আসছি, বোধহয় ১০ নম্বর বাস তখন কলেজ স্ট্রীটে যেতো, আমি মাঝে মাঝে প্রদীপের সঙ্গে গড়িয়াহাটে দেখা করে ঐ বাসে কলেজে যেতাম । হঠাৎ বাইরে থেকে জানালায় ঝুলতে ঝুলতে একটি ছেলে পেছনে খোঁচা দিয়ে বললো, ‘খাতাটা ধরুন তো ।' ছেলেটিকে দেখে আমার ‘বা: শব্দটি মুখ দিয়ে না বেরুলেও মনে মনে বলেছিলাম নিশ্চয়ই । সুনীতি একরকমের সুন্দর, এ আরেক রকমের । একেবারে রোমান্টিক সিনেমার নায়কের মতো চেহারা, যদিও সে নয়, তার ছোটো ভাই সৌমিত্র পরে সিনেমার নায়ক হয়েছিলো । সম্বিত্কে অনিন্দ্যকান্তি বলা যেতে পারে । সম্বিত্‌, মৃগাঙ্ক (রায়), ভারতী (সেনগুপ্ত, পরে রায়) এরা সব বোধহয় ইতিহাসের ছাত্র । যে কোনো কারণেই হোক আমার চেয়ে এক বছরের সিনিয়র ছাত্রদের সঙ্গেই আমার ভাব হয়েছিলো বেশি । অমর্ত্য (সেন), বিনয় (চৌধুরী), সুবীর (রায়চৌধুরী), মৃণাল (দত্তচৌধুরী), করুণাশঙ্কর (রায়), পার্থসারথি (গুপ্ত), জ্যোতির্ময় (দত্ত) এরা সবাই আমার চেয়ে এক ক্লাস উঁচুতে পড়তো । সুখময় (চক্রবর্তী)ও এই বছরের । অলোকরঞ্জন দাশগুপ্তও । সুখময়ের চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা, পরণে প্যান্ট ও হাফসার্ট, বগলে মোটা মোটা ভলিউম । একই সঙ্গে হয়তো সে নংটংত্র ত্‌ংঐছষ্য ধী শ্ণ্ণশঠৃঠরুংয ও গীবনের ওঠযং ছত্ররু যছত্ৎ ধী ওধস্ছত্র শ্স্‌ংঋঠশং পড়ছে । অমর্ত্য কখনো বই নিয়ে ঘুরতো না, পরতো মালকোচা মেরে ধুতি ও হাত-গোটানো সার্ট, একটা নরম মলাটের খাতা পকেটে গোঁজা, হাতে একটা পাকানো ছাতা । এরা সবাই জিলেট ব্লেডের মতো ঝকঝকে ও ধারালো, তবে অমর্ত্যকে ছিলো মেয়েদের পছন্দ । পার্থসারথি ছিলো খুব ছেলেমানুষ, পরীক্ষায় সে ভালো না করে পারে না, এবং তার স্মৃতি ফোটোগ্রাফিক । একটা বই পড়লে টাইটেল পেজ থেকে শেষ পাতা পর্যন্ত তার মাথায় গেঁথে যায় । কোন পরীক্ষায় কে কতো নম্বর পেয়েছে তার মুখস্থ থাকতো । সুবীর বাংলা নিয়ে পড়তো, অন্য কোনো বিষয়ে সুযোগ না পেয়ে নয়, বাংলা ভাষা ও সাহিত্যই ছিলো তার জীবন । ত্রক্রমে সে হয়ে উঠবে বাংলা সাহিত্যের, ব্যাকরণের, বানানের একজন অথরিটি । সুবীরের প্রাণের বন্ধু ছিলো করুণাশঙ্কর -- এখনকার বিখ্যাত ব্যারিস্টার কে, এস, রে । তখন ছেলেরা ক্রিকেট খেলতো, মেয়েরা দেখতো । সাহিত্য ছাড়া সুবীরের দ্বিতীয় আগ্রহের বিষয় ছিলো ক্রিকেট । তবে ক্রিকেট বিষয়ে যতো তত্ত্ব সে জানতো, খেলতে ততো ভালো পারতো না । একবার মাঠে নমে প্রথম বলেই সে আউট হয়ে গেলো । করুণার সে কি তড়পানি । সে বলতে লাগলো, ভালো খেলে আউট হওয়া খারাপ খেলে সেঞ্চুরি করার থেকে ভালো । সুবীর যে খেলেইনি সে আর তাকে বোঝায় কে । সুবীরের ব্যাট ধরার কায়দাটাই নাকি বোলার ধরতে পারেনি । এ-নিয়ে কলেজ পত্রিকার জন্য প্রবন্ধও লিখে ফেলেছিলো সে । বিনয় অসম্ভব লাজুক ছিলো, একবার জ্যোতির ঘরে ঢুকে আমাকে দেখে জিভ কেটে বেরিয়ে গেলো । বহু কষ্টে ওর সঙ্গে পরে ভাব করেছি । পরে বিনয় যখন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক তখন সে প্রেম করে ছাত্রীকে বিয়ে করছে শুনে আমরা খুব অবাক হয়েছিলাম ।

    এরা অনেকেই বি,এ পাস করে বিদেশে চলে গেলো । অমর্ত্য কেম্ব্রিজে, পার্থ অক্সফোর্ডে । সুখময় বোধহয় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়েই এম,এ করে তারপর বাইরে যায় । বিনয় এম,এ করে কালকাতাতেই গবেষণা করলো । ওকে দেখেছি রাইটার্স বিল্ডিং-এ ধুলোয় ঢাকা অন্ধ খুপরিতে পুরোনো কাগজ ও ফাইলের ওপর নিমগ্ন হয়ে ঝুঁকে থাকতে, বাইরের জগতে কি ঘটছে তার থেকে যেন সে বিচ্ছিন্ন । তার গবেষণার বিষয় ছিল "ল্যাণ্ড রিফর্মস ইন বেঙ্গল ডিয়োরিং ব্রিটিশ টাইমস্‌" । পরে সে অক্সফোর্ডে যায় গবেষণা-উত্তর (পোস্ট-ডক্টর্যাল) কাজ করতে । ঐতিহাসিক বিনয় চৌধুরীকে গল্পকথার পণ্ডিত বলা চলে । প্রতিতুলনায় অমর্ত্য ছিলো জীবনের, ভালোলাগার, ভালোবাসার উপাসক । সে কখন পড়তো কে জানে ! বি,এ-তে যখন অর্থনীতি বিভাগে সে প্রথম, ও সুখময় দ্বিতীয় হলো, প্রায় অভিযোগের সুরে বলেছিলাম, "এ কি অমর্ত্য ! তুমি প্রথম হলে কি করে ?" অপরাধীর মতো মাথা চুলকে সে বললো, "কি জানি, কিভাবে যেন হয়ে গেলাম ।" অমর্ত্য যখন প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়তে আসে, তখন খুব সম্ভব ওর মা-বাবা কলকাতার বাইরে ছিলেন, তাই সে উঠেছিল কেশব সেন স্ট্রীটের ওয়াই,এম,সি,এ হস্টেলে । পরে ওর বাবা সরকারি বাসভবনে তোলেন আইরনসাইড রোড-এ । ভারি সুন্দর ছিলো সেই বাংলো, অনেকটা অমর্ত্যদের শান্তিনিকেতনের বাড়ির মতোই । সে-সব ইংরেজ আমলের তৈরি বাংলো ভেঙে ফেলে এখন আই,এ,এস অফিসারদের জন্যে বহুতল ফ্ল্যাটবাড়ি উঠেছে । অমর্ত্যদের বাগানে ছিলো একটি কুরচিফুলের গাছ । তার ফুলে ভরা একটি ডাল আমি ভেঙে দিতে বলেছিলাম বলে আমাকে অবাক করে দিয়ে সে ভয়ানক রাগ করেছিলো । অমর্ত্য কেম্ব্রিজে যাবার আগে ওর মা (অমিতা সেন) ফেয়ারওয়েল পার্টি দিয়েছিলেন । তখন তো সবাই জাহাজে যেত, জাহাজ বন্দরে ভিড়লে চিঠি আসবে, আমরা সব প্রতীক্ষা করতাম নানান খবরে ভরা সেইসব চিঠির জন্য । ঐ সময়ে যে যুবকটি আমার সঙ্গে সঙ্গে কলেজ পর্যন্ত যেত, সেও বিলেতে গিয়েছিল । জাহাজ থেকে লেখা তার চিঠির সঙ্গে অমর্ত্যরও পিকচার পোস্টকার্ড এলো । মা `ডেভিড'-এর ছবি নিয়ে বিব্রত । তা নিয়ে এখনো মাকে খেপানো হয় । অমর্ত্য-নবনীতার বিয়ে হয়েছিলো বোধহয় ১৯৬০ সালে । নবনীতা আমাদের `২০২'-এরই মেয়ে, বাবার "ব্লু-আইড গার্ল" । এর ফলে অমর্ত্যর সঙ্গে আমাদের বন্ধুত্ব পারিবারিকতায় পরিণত হয় ।

    পার্থসারথির বাবা শৈবাল গুপ্ত ছিলেন খ্যাতনামা ব্যক্তি, `ক্যালকাটা ইম্প্রুভমেন্ট ট্রাস্ট'-এর চেয়ারপার্সন ।মা অশোকা গুপ্তা সমাজসেবিকা হিসেবে প্রচুর ভালো কাজের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন । লেকের পেছনে, গড়িয়াহাটের কাছে তাদের বিশাল বাড়ি । তার দেশে প্রত্যাগমন উপলক্ষ্যে জমকালো পার্টিতে গিয়েছিলাম । পার্থ কলকাতায় এলেই যোগাযোগ করতো । আমরা যখন অক্সফোর্ডে ঘুরতে গেলাম, তখন উমা (দাশগুপ্ত) একটি মেয়ের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিল যার ঘরে দেখেছিলাম পার্থর ছবি । পরে সে-মেয়েটিকেই সে বিয়ে করে ।

    মীনাক্ষী চালিহা এখন বিখ্যাত নর্তকী, দেবযানী চালিহা, মণিপুরী নাচে পারদর্শিনী । সে দুটো নাচের স্কুল চালায়, তার মধ্যে একটা বস্তির ছেলেমেয়েদের জন্য, অবৈতনিক । এইসব ছেলেমেয়ে উপাসনা করে মধুর, কোমল, স্নিগ্ধ দেবযানীকে । ও আর বিশ্বপ্রিয় কলকাতায় আমাদের প্রতিবেশী বলে আমাদের সম্পর্ক এখনো পুরোনো দিনের মতোই রয়ে গেছে । ভারতী (রায়) কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহ-উপাচার্য ।

    শিক্ষকদের মধ্যে অনেকেই বলতেন, এমন অসাধারণ সব ছাত্র একই বছরে, এরকমটা এমনকি প্রেসিডেন্সি কলেজেও কম হয়েছে । অথচ এরা শুধুই বইয়ের পোকা ছিলো না । তরুণোচিত সমস্ত অপলাপ-অপরাধ-অপঘাত বহু হয়েছে । শক্তি (চট্টোপাধ্যায়) এক বছর পড়ার পর বহিষ্কৃত হয়েছে । (সে পরে যাদবপুরে তুলনামূলক সাহিত্য বিভাগে ভর্তি হয় কিন্তু শেষ করে না ।) সে বুক ঠুকে বলতো "আমি আর সুভাষচন্দ্র বসু দু'জনেই প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে রাস্টিকেটেড ।" আমাদের এক সহপাঠী এক সহপাঠিনীকে নিয়ে `ইলোপ' করেছিলো । মফস্বলে এক বন্ধুর মামাবাড়িতে তারা আশ্রয় নিয়েছিলো । পঁচিশজন ছেলে ব্লাডব্যাঙ্কে রক্ত দিয়ে তাদের জন্যে টাকা তোলে ।




    আমার এক সহপাঠিনী একদিন আমাকে জানালো যে সে একজনের প্রেমে পড়েছে এবং তাকে না পেলে সে পাগল হয়ে যাবে । জানলাম তার নাম অশীন দাশগুপ্ত, ঈশান স্কলার ।

    দূর থেকে দেখালো সে অশীনকে একদিন । ধুতি ও সার্ট পরা তখনকার স্টাইলে, কালো রঙ, চিকন চেহারা । সাক্ষাৎ কেষ্টঠাকুর । অশীন বোধহয় তখন এম,এ পরীক্ষা দিয়ে বিদেশ (হল্যাণ্ড) যাবার প্রস্তুতি নিচ্ছেন । একদিন আমি আর আমার সেই বান্ধবী যাচ্ছি, হঠাৎ সে আমার হাত এমন জোরে চেপে ধরলো যে তার নখ বসে রক্ত বেরিয়ে গেলো আমার । তাকিয়ে দেখি সামনে অশীন আসছেন । একটু হেসে মাথা নুইয়ে ‘কেমন আছো' ধরনের কিছু বলে তিনি পাশ কাটিয়ে এগিয়ে গেলেন । আমার বান্ধবীর প্রেমে তিনি সাড়া দিতে পারেননি । সে ছিলো মা-বাবার একমাত্র মেয়ে, অতি আদরের । সাময়িকভাবে সত্যিই মানসিক বৈকল্য হয়েছিলো তার অশীনের প্রত্যাখ্যানের কারণে ।

    বিদেশ থেকে ফিরে অশীন বিয়ে করলেন উমাকে যে সম্পর্কে আমার পিসতুতো বোন এবং রূপে লক্ষ্মী ও গুণে সরস্বতী । তখন জ্যোতি আর আমিও বিবাহিত । আমরা চারজনে গভীর বন্ধুত্ব উপভোগ করেছি, একটা সময় ছিলো, যখন রোজ দেখা হতো । অশীন আর জ্যোতি একসঙ্গে এক `নতুন বাংলা' স্থাপনা করেছিলো । অশীন তখন অক্সফোর্ডে সেন্ট অ্যান্টনি কলেজের `ফেলো' । উমাও ওখানে পড়ছে । অশীন-উমার বাড়ির তিনটি বাড়ির পরেই থাকতেন আমার চিত্তহারিণী আগাথা ক্রিস্টি । তাঁর স্বামী পুরাতত্ত্ববিদ্‌, তিনিও বোধহয় সেন্ট অ্যান্টনি'র ফেলো । আমার খুব ইচ্ছে আগাথা ক্রিস্টির সঙ্গে দেখা করতে যাবার । কিন্তু অবিশ্বাস্য নাক-উঁচু জ্যোতি ও অশীন হেসেই আকুল । অশীন বললেন, "ওঁর স্বামীর সঙ্গে আলাপ করতে চাও তো করিয়ে দিতে পারি । কিন্তু আগাথা ক্রিস্টি ! হা হা !" ভাগ্যক্রমে পরে নিউ ইয়র্কের পি,ই,এন কনফারেন্সে আগাথা ক্রিস্টির দর্শন পয়েছিলাম । কিন্তু তাঁকে তাঁর স্বস্থানে দেখতে পাইনি এ-দু:খ আমার এখনো যায়নি । অশীনের পাশের বাড়িতে তখন ছিলেন আরেক ঐতিহাসিক এবং প্রেসিডেন্সির ছাত্র হীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী । তাঁর স্ত্রী দারুণ খাইয়েছিলেন আমাদের । রাজেশ্বরী দত্ত চলে এসেছিলেন কেমব্রিজ থেকে । অক্সফোর্ডে অশীন ও উমার বাড়িতে থাকাটা আমাদের অতি মূল্যবান স্মৃতিগুলির একটি । কলেজের বন্ধুদের সঙ্গে সম্পর্ক যে একেবারেই নষ্ট হয়নি আমাদের সেটাকে আমি বিশাল সৌভাগ্য বলে মনে করি ।

    প্রেসিডেন্সি কলেজের লাইব্রেরিটি ছিল চমত্কার আর লাইব্রেরিয়ান ছিলেন অসাধারণ -- রহমান সাহেব । বারান্দার শেষ প্রান্তে লম্বা ঘর, ঢুকে কাচের বাক্সে পুরোনো এটেনডেন্স রেজিস্টারে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের নাম । রহমান সাহেবের দুজন সহকারী ছিলেন, কিন্তু ঐ সাম্রাজ্য তিনি একাই পরিচালনা করতেন । কোন বিষয়ের জন্য কোন বই পড়তে হবে সে ব্যাপারে আমাদের উপদেশ দিতেন, কোন বই কোন পুরোনো বই-এর দোকানে সস্তায় পাওয়া যাচ্ছে তাও তিনি আমাদের বলে দিতেন । তাঁর দয়া হলে আমাদের জরিমানা মকুব হয়ে যেতো । প্রতিটি বই দেবার সময় ও ফেরৎ নেবার সময় ভালো করে দেখে নেবার চেষ্টা করতেন কারণ ছাত্ররা অনেক সময় পাতা ছিঁড়ে নিতো ।

    কলেজে একটা `রবীন্দ্র পরিষদ' ছিলো । এই লাইব্রেরিতে তার নানান অনুষ্ঠান হতো । শম্ভূ মিত্র একবার এসেছিলেন, ‘কাবুকি' দেখিয়েছিলেন মনে আছে । তখন আমাদের যে বয়েস তাতে সব কিছু নিয়ে হাসাহাসি, ব্যঙ্গ বিদ্রুপ করা, তির্যক মন্তব্য করা স্বভাব । কিন্তু ঐ লাইব্রেরিতেই এক অনুষ্ঠানে কোনো ছাত্রের গলায়, ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি' গানটি শুনে এমন মোহিত হয়েছিলাম, যে চোখে জল এসে গিয়েছিল । এই গায়ক কে ছিলো ? সে কি বাদল গুহঠাকুরতা ? সে কি অমিত মিত্র ? মনে নেই ।

    প্রেসিডেন্সি কলেজ আর বিশ্ববিদ্যালয়ের মাঝখানে বেকার ল্যাবরেটরি । সেখানেই অডিটোরিয়ামে ডিবেট হতো । বিখ্যাত ডিবেটররা সব বাইরে থেকে আসতেন আমাদের ছাত্রদের সঙ্গে ডিবেট করার জন্য । ল কলেজের ছাত্র সুধাংশু দাশগুপ্ত, মেডিকেল কলেজের ছাত্র বিষ্ণু মুখার্জি ডিবেটর হিসেবে নাম করেছিলেন । এছাড়া উত্পল দত্ত, হীরেন মুখার্জি, সাধন দত্ত, অম্লান দত্ত -- এরাও এসেছেন । আমাদের ছাত্রদের মধ্যে প্রদীপ দাস (আমার বন্ধু প্রদীপের নেমসেক যে এক ব্যারিস্টার হিসেবে বিশাল নাম করেছে) ও জ্যোতির্ময় দত্ত খুব ভালো ডিবেট করতো । আর কারো কথা তেমন ভাবে মনে পড়ছে না ।

    সকলেই জানেন, প্রেসিডেন্সি কলেজের আসল ‘কমনরুম' কফিহাউস । মেয়েরা অবশ্য তেমন যেতো না কারণ বেশিরভাগের উপরই বাড়ির নির্দেশ ছিলো কলেজ শেষে সোজা বাড়ি ফিরে যাওয়ার । ছেলেদের স্বাধীনতা অনেক বেশি । আমরা যেতাম অফ পিরিয়ডে বা ছেলেদের তাড়নায় ক্লাস কেটে । প্রথম প্রথম আমি ক্লাস কাটতে খুব ভয় পেতাম, পরেও যে খুব একটা কেটেছি তা নয় । আমাদের সঙ্গে একটি মারোয়াড়ি. ছেলে পড়তো তার পকেটে সব সময় টাকা । আমরা তার ঘাড় ভেঙে খেতাম । তা না হলে সাধারণত ছেলেরাই মেয়েদের ঘাড় ভাঙতো । এক একটি যা উড়নচণ্ডি । আর কলেজে ঢুকেই সকলে প্রথমে সিগারেট ফুঁকতে শেখে তা না হলে সঠিক ‘পুরুষ' হওয়া যেতো না তখনকার দিনে । মেয়েরাও বলতো, ছেলেরা সিগারেট না খেলে ভালো লাগে না । সিগারেটের ধোঁওয়ায় কফিহাউসের বাতাস ভারি হয়ে থাকতো । কফিহাউস ছাড়াও ঐ বাড়ির অন্য আকর্ষণ ছিলো `রূপা'র বই-এর দোকান । `রূপা'র মালিক মি: মেহরা বাবার বন্ধু ছিলেন । বাবা ওঁদের বই-এর তালিকা করে দিতেন -- মানে, বিদেশ থেকে কী কী বই আনা উচিত । প্রেসিডেন্সি কলেজের ছাত্রছাত্রীরা যে যা নিয়েই পড়ুক না কেন, কবিতার বই কিনে পরস্পরকে উপহার দিতো । সাহিত্য তাদের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ ছিলো ।

    কফি হাউসে কেউ খেতে যেতো না, যেতো আড্ডা দিতে । খিদে পেলে আমরা যেতাম ওয়াই, এম, সি-এতে । সেখানে কেবিন ছিলো, পর্দা ফেলে দিলে গোপনীয়তা রক্ষা হয় বলে প্রেমিক প্রেমিকারা যেতো । ওয়াই, এম, সি-এতে বসে আমরা একবার একসঙ্গে একটা উপন্যাস লিখতে শুরু করেছিলাম -- জ্যোতি, মৃণাল, অমর্ত্য আর আমি । বুড়োদের নিয়ে গল্প -- বুড়ো বলতে নায়কের বয়স বত্রিশ আর নায়িকার বয়স আটাশ । বত্রিশ বছরের নায়কের চুল নেই, দাঁত নড়ছে -- এরকম । খাতাটা আমার কাছে পুরোনো কাগজপত্রের মধ্যে ছিলো, হঠাৎ একদিন আবিষ্কার করেছিলাম । তাতে কতজনের লেখা কত ছড়া, কবিতায় প্রেম নিবেদন । অশীনের হাতের লেখায় ‘গাধার দুধের খোঁজে ফিরি ক্লিওপ্যাট্রা' -- তার উত্তরে পল্টুদা লিখেছেন, ‘দূর, বলে পল্টুদা, ছাড়াসনে মাত্রা'- নানান ছড়া লিখে সবাই মনের কথা বলতো । পল্টুদা, ছিলেন মেডিকেল কলেজের ছাত্র, দীপক রায়, আমাদের সঙ্গে আড্ডা দিতে আসতেন, ডিবেটও করতেন, এখন ইংলণ্ডবাসী ।

    আমাদের প্রিয় খেলা ছিলো ওংস্ছশূয -- একজন বাইরে যাবে, অন্যরা তার বিষয়ে মন্তব্য লিখে দেবে । তাকে এসে বলতে হবে কে কোনটা বলেছে । আমার সে খাতায় ঐরকম কতো মন্তব্য রয়েছে । আছে কতো না গোপন প্রেম বিনিময়, কতো রবীন্দ্রনাথের গানের লাইনের ব্যবহার -- "তুমি কোন কাননের ফুল, তুমি কোন গগনের তারা", "যদি বারণ করো তবে গাহিব না", "হায় রে, ওরে যায় না কি জানা "..। জ্যোতি তখন বাংলা পড়তো না, লিখতেও পারতো না ভালো করে, ওর মনের ভাবগুলি সবই ছিলো ইংরিজিতে । ইয়েটস তখন ওর প্রিয়তম কবি । আমার ঐ খাতাটাতে ইয়েটস-এর কতো লাইন ছড়িয়ে আছে । জ্যোতি আমাকে একবার ইংরিজিতে চিঠি লিখেছিলো বলে না-পড়ে ফেরত দিয়েছিলাম । ওকে আমিই বাংলা শিখিয়েছি । এই একটা ক্ষেত্রে অন্তত শিষ্যর বিদ্যা গুরুকে ছাড়িয়ে বহুদূর চলে গেছে । তখন অমর্ত্য একটা `পোয়েট্রি সার্কল'ও করেছিলো । অমর্ত্য সেন ও দিল্লি স্কুল অফ ইকনমিকস-এর মৃণাল দত্ত চৌধুরীও যে চেষ্টা করলে লেখক কি কবি হতে পারতেন ঐ খাতাটি দেখলে তা বোঝা যাবে । অনেক পরে, জ্যোতি যখন ‘কলকাতা' পত্রিকা বার করবে স্থির করেছে তখন অমর্ত্যর কাছে লেখা চেয়ে চিঠি লিখেছিলো । অমর্ত্য জানিয়েছিলো এখন আর বাংলা লেখা সহজে আসে না তার । আমাদের বন্ধুরা অনেকেই এখন বিদেশবাসী, বাংলা পড়া বা লেখা তাদের জীবন থেকে চলে গেছে, যদিও বাঙালিরা দুজন একসঙ্গে হলেই নাকি ইংরিজি ভুলে যায় এমন অভিযোগ করেন অন্যভাষাভাষী বন্ধুরা ।

    তখন কোনো একটা এক্সচেঞ্জ প্রোগ্রামে মার্কিনি ছাত্রছাত্রীর একটা দল কলকাতায় এসেছিলো, আমরা বলতাম ক্যালিফোর্নিয়ান স্টুডেন্টস, কারণ তারা লঙত্‌ংই -র ছাত্র । তারা প্রেসিডেন্সি কলেজ দেখতে এলো, ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে ভাব করলো, কফিহাউসে গেলো । একটা আনুষ্ঠানিক ডিবেট হবে স্থির হলো, যার একদিকে প্রেসিডেন্সি কলেজের ছাত্রছাত্রী, অন্যদিকে লঙত্‌ংই -র । মার্কিনি পররাষ্ট্রনীতির এমন সমালোচনা হলো যে প্রায় হাতাহাতি হবার উপক্রম । একটি জাপানি বংশোদ্ভুত আমেরিকান ছাত্রর বক্তৃতার সমালোচনা করতে গিয়ে জ্যোতি বললো, `ংঔষ্‌ ঁছৃছত্রংযং ংঈশঠংত্ররু...-- -- সে ক্ষেপে গিয়ে `ঝ ছস্‌ ত্রধঞ ছ ঁছৃছত্রংযং, ঝ ছস্‌ ছত্র স্‌ংংইশঠবছত্র' বলে জ্যোতিকে মারতে এলো । ক্যাপ্টেন মাহমুদ বহু কষ্টে মারামারি থামালেন । সেই ঘটনার উপর শান্তিজল ছিটোবার জন্য ইউ,এস, আই,এস-এর কালচারাল এযাফেয়ার্স অফিসার মিসেস এযাটারটন একটা পার্টি দিলেন তাঁর বাড়িতে । তার প্রতিদানে আবার প্রেসিডেন্সি কলেজের পক্ষ থেকে একটা পার্টি দেওয়া হলো । সেই পার্টি হয়েছিলো ১ ম্যাণ্ডেভিলা গার্ডেন্স-এ, মুরারকা ভবনে । কতো খেলা, কতো হাসি, নাচ আর গান হলো ।

    সেই পার্টির পরদিন আমি কলেজ স্ট্রীটের মোড় থেকে বাসে উঠেছি, চলন্ত বাসের পিছন পিছন ছুটে এসে একজন লাফিয়ে বাসে উঠে সূর্যমুখী ও রজনীগন্ধা মেশানো ফুলের গুচ্ছ আমার হাতে দিয়ে বাস থেকে নেমে গেলো । সেই ফুলের গুচ্ছের প্রতীকী মানে খুব সহজ -- অহর্নিশ, দিন ও রাত্রি, দিনের ফুল সূর্যমুখী ও রাতের ফুল রজনীগন্ধা । এরপর বহুদিন পর্যন্ত ঐ দিনের স্মৃতিতে সে আমাকে এই দুই ফুল একসঙ্গে করে উপহার দিয়ে আনুগত্য জানিয়েছে । তারই সঙ্গে একসঙ্গে পঁয়তাল্লিশ বছর হলো ।
  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments