আসলে একটা ইংরেজি কল্পবিজ্ঞান সংকলনের যার নাম The World Treasury of Science Fiction (Ed. David G. Hartwell; Little Brown; 1989), মুখবন্ধে দেখলাম সম্পাদক লিখেছেন উন্নয়নশীল তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলিতে সেরকম উল্লেখযোগ্য কোনো কল্পবিজ্ঞান লেখা হয়নি, কারণ তারা নাকি এত প্রযুক্তিগত উন্নতির ব্যাপারটা বুঝতেই পারেনি । তাই যতো ভালো ভালো কল্পবিজ্ঞান নাকি শুধু উন্নত দেশেই লেখা হয় ।
সেখানে তবু চীন আর জাপানের কল্পবিজ্ঞানের কিছু উল্লেখ রয়েছে কিন্তু ভারতের উল্লেখই নেই আর বাংলা তো দূর অস্ত !
ভাবতে চেষ্টা করি কল্পবিজ্ঞানকাহিনীর সংজ্ঞা কি । নামের মধ্যেই লুকিয়ে আছে দুটি কথা, কল্পনা আর বিজ্ঞান । এই ব্যাপারে ওয়াকিবহালরা বলেন বিজ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে কাহিনীর অগ্রগতি যেসব গল্পে, সেইগুলিই কল্পবিজ্ঞান । অর্থাৎ তার মধ্যে থাকবে কিছুটা কল্পনা, কিছুটা বিজ্ঞান । বর্তমান বিজ্ঞানের উন্নতির সূত্র ধরে ভবিষ্যতের কল্পনা--তাও থাকতে পারে । অন্য আরেকটি দল বলেন যে এই ভবিষ্যতের কথা বলার ব্যাপারটিই প্রধান হওয়া উচিত কল্পবিজ্ঞানের গল্পে । আমাদের যেসব ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধতা, এখনো যেসব জানা যায়নি, এখনো যেসব রোগের ওষুধ আবিষ্কার হয়নি, এখনো যেসব গ্রহ আবিষ্কার হয়নি--অথচ ঠিক সেইসব জিনিসের জন্যই আমাদের আকাঙক্ষা, তাই সেগুলিই কল্পবিজ্ঞানের মূল বিষয়বস্তু ।
পলাতক তুফান নামের গল্পটিকে বাংলায় লেখা প্রথম কল্পবিজ্ঞানের গল্প বলে অনেকে মনে করেন । লেখক ? -- বিখ্যাত বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসু । এখানে একটি সামুদ্রিক ঝড়কে কি করে রুখে দেওয়া গেল তেল ব্যবহার করে, সেকথা অতি সুন্দর আঙ্গিকে বলা হয়েছে । সমুদ্রে তেল ছুঁড়ে দিয়ে জলের সারফেস টেনশান পালটে ঢেউ কমাবার ব্যাপার আছে, বিজ্ঞানের এই সত্যকে ব্যবহার করে গল্পের পরিণতি । কিন্তু কোথ্থাও বিজ্ঞানের তাত্ত্বিক কচকচি নেই, সবটাই সুন্দর নিটোল একটি গল্প ।
আর শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের ময়ূরকূট , অনেকে সেটাকেও মনে করেন কল্পবিজ্ঞান, কিন্তু তা নিয়ে বিতর্ক আছে । এখানে বহুদূরের দুটি পাহাড়ের মধ্যে শব্দের দ্বারা সংযোগ করা যেত প্রাকৃতিক উপায়ে । এই ব্যবস্থাকে কাজে লাগিয়ে কিভাবে রাজধানীকে শত্রুর আক্রমণ থেকে রক্ষা করলো এক তরুণ, তাই নিয়ে গল্প । গল্পটি মিলনান্তক, কারণ পুরস্কার হিসেবে সেই তরুণ পেয়েছিল রাজপদ এবং তাঁর প্রিয় রাজকন্যাকে, যাঁর উপস্থিত বুদ্ধি আর সাহসের জন্যই শেষ পর্যন্ত সে রাজধানী রক্ষা করতে পেরেছিল । আমার একে একটি সুন্দর মানবিক গল্প বলেই মনে হয় ।
চমকে উঠলাম । মনে হলো তাহলে কি কল্পবিজ্ঞানের সঙ্গে মানবিক অনুভূতির বিরোধ আছে ? বিদেশের বেশিরভাগ কল্পবিজ্ঞান হলো যন্ত্রপাতির উন্নতির গল্প, অথবা মহাকাশে যুদ্ধ অথবা অন্য গ্রহের প্রাণীরা এসে ভয়ানক যুদ্ধ করে পৃথিবী দখল করছে । এ কি অদ্ভুত রে বাবা ! বিজ্ঞান আর কল্পনা মিশে শেষে কিনা ভয়ানক যুদ্ধ ?
মন থেকে যুদ্ধ ঠেলে ফেলে ভাবতে চেষ্টা করি কোথায় আছে যুদ্ধবিহীন কল্পবিজ্ঞান । পরশুরামের গামানুষ জাতির কথা মনে পড়ে, সেখানে অবশ্য ফ্যান্টাসি এর থেকে `উইট' ব্যাপারটাই প্রধান । অথবা পরশপাথর । এগুলোকে অনেকে সরাসরি কল্পবিজ্ঞান বলতে দ্বিধা করবেন ।
আরেকটি উল্লেখযোগ্য কল্পবিজ্ঞানের চরিত্র হলো অদ্রীশ বর্ধনের সৃষ্ট চরিত্র বিজ্ঞানী প্রফেসর নাটবল্টু চক্র । বহু কল্পবিজ্ঞানের গল্পের নায়ক তিনি । যেমন অদ্ভুত নাম, তেমনি আশ্চর্য চরিত্র । আমি বেশ কয়েকটি গল্পের উল্লেখ করতে পারি যেখানে এই বৃদ্ধ বিজ্ঞানী পাঠকের চক্ষু চড়কগাছ করে দিয়েছেন কিন্তু সবই বিজ্ঞানের নিয়ম মেনে । যেমন ম্যাটার হর্ন গল্পটা । যেখানে ভিনগ্রহী ব্যাকটেরিযারা (তারা আবার বুদ্ধিমান জীব, বলছিল যে আমাদের পারমানবিক চুল্লিতেও যা সম্ভব নয়, তা তারা খালি হাতে করতে পারে --যেমন বাতাস, লবণ আর জল থেকে সূর্যের আলোকে কাজে লাগিয়ে দিব্যি শক্তি তৈরি করতে পারে ।) প্রায় পৃথিবী কব্জা করে ফেলছিল আরকি, নাটবল্টুবাবু তাদের কায়দা করে নিজের গ্রহে ফিরৎ পাঠিয়ে দিলেন, বললেন যে পৃথিবী খুব বাজে গ্রহ, এত দূষণ, এখানে ওদের মতো ভদ্র লোকেরা থাকতে পারে না । অথবা আরেকটা গল্প, নাম টেরা ইনকগনিটো । এখানে একটি অঞ্চলের বিরাট লম্বা লোকেরা সব খুব বেঁটে হয়ে গেছিল আর তাদের বাঁকা বাঁকা নখ হয়েছিল, বেড়ালের মতো ক্ষিপ্রতা দেখা দিয়েছিল । আর জঙ্গলের ইঞ্চি তিনেক লম্বা বাঁদরেরা হয়ে গেছিল সব মহাকায়, অতি উন্নত, মস্তিষ্কের শক্তিতে মানুষকে ছাড়িয়ে গেছিল, মনের যোগাযোগের দ্বারা কথা বলতে পারতো । বেঁটে হয়ে যাওয়া মানুষেরা চাইছিল ওদের মেরে ফেলতে, প্রফেসর কিভাবে ওই বেঁটে খুনেদের হাত থেকে রক্ষা পেলেন মহাকায়দের সহায়তায় সেই নিয়ে গল্প । এগুলোকে অবশ্য ফ্যান্টাসির পর্যায়ে ফেলা যায় । নানা অ্যাডভেঞ্চারে ভরা কল্পবিজ্ঞারের কাহিনী । অর্থাৎ এগুলিতে বিজ্ঞানের তাত্ত্বিক দিকটার চেয়ে রোমাঞ্চকর ঘটনাপ্রবাহের উপর বেশি জোর দেওয়া হয়েছে ।
এইধরনের কল্পবিজ্ঞানের মধ্যে অবশ্য ক্ষিতীন্দ্রনারায়ণ ভট্টাচার্যের লেখাগুলোও পড়ে । প্রধানত অ্যাডভেঞ্চারধর্মী কল্পবিজ্ঞান । প্রেমেন্দ্র মিত্রের ঘনাদা সিরিজের গল্পগুলোও এইধরনের । তবে সেগুলোর মধ্যে একটা বেশ আড্ডার পরিবেশ রয়েছে ।
বাংলা কল্পবিজ্ঞানে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এই আড্ডার পরিবেশ একটা প্রধান ভূমিকা পালন করে । অ্যাকশন-এ ভর্তি, ভীষণ মারামারি, যুদ্ধ এইসব বোধহয় বাঙালি স্বভাবে ঠিক খাপ খায় না । তাই এখানকার কল্পবিজ্ঞানেও গায়ের জোরে নায়ক বনে না কেউ, বুদ্ধির জোরকেই প্রাধান্য দেওয়া হয় ।
অবিস্মরণীয় প্রফেসর শঙ্কু; চরিত্রের স্রষ্টা সত্যজিৎ রায় । এই কল্পচরিত্রটি বাংলা কল্পবিজ্ঞানের এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ দখল করে আছেন । একে নিয়ে লেখা প্রতিটা গলপই খুব ভালো । কিন্তু প্রথমদিকে মূলত কিশোরকিশোরীদের কথা ভেবেই লেখা হয়েছিল বলে ফ্যান্টাসিই বেশি ছিল । শেষ পূর্ণসমাপ্ত গল্প স্বর্ণপর্ণী , এই গল্পে আমরা দেখি আশ্চর্য মানবিক ছোঁয়া, অন্যান্য শঙ্কুকাহিনীতেও এই মানবিক আবেগের সংযত প্রকাশ রয়েছে, কিন্তু স্বর্ণপর্ণীতে তা এক নতুন পথের দিকে বাঁক নিতে চলেছিল । আমাদের দুর্ভাগ্য যে এরপরেই লেখকের প্রয়াণে আমরা অনেক কিছুই হারালাম । শেষ দুটি কাহিনী অসমাপ্ত, ইন্টেলেক্ট্রন আর ড্রেক্সেল আইল্যাণ্ডের ঘটনা । কি জানি কি মণিমুক্তা লুকিয়ে ছিল ওই দুটির ভিতরে । কোনো উত্সাহী পাঠকলেখক চেষ্টা করবেন নাকি অনুমতি আনিয়ে ওই দুটো শেষ করার?
সত্যজিৎ রায় শঙ্কুকাহিনী ছাড়াও কল্পবিজ্ঞান লিখেছেন বেশ কয়েকটি । অনুকূল , বংকুবাবুর বন্ধু , অংকস্যার, গোলাপীবাবু আর টিপু , ময়ূরকন্ঠী জেলি সবকটিই উল্লেখযোগ্য । তবে সবকটির মধ্যেই যান্ত্রিক কচকচির বদলে মানবিক আবেগের সুন্দর প্রকাশই বেশি মনে রয়ে যায় । আসলে বোধহয় মানুষ সেটাকেই বেশি করে মনে রাখে যেটা তার মনে ধরে । সেই হিসেবে যান্ত্রিকতার চেয়ে মানবতাই যে বেশি মনকে টানবে তা তো খুবই সহজবোধ্য । অবশ্যই মানুষে মানুষে রুচির প্রকারভেদ রয়েছে, কিন্তু সাধারণভাবে মনে হয় মানবিক আবেদনের মূল্য অনেক বেশি ।
মনে পড়ে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের লেখা অমৃতের পুত্রকন্যা । এটা অবশ্য প্রাপ্তবযস্কদের জন্য লেখা কিন্তু এত ভালো কল্পবিজ্ঞানের গল্প আমি খুব কমই দেখেছি । আমি কাহিনীটা একটুখানি বলার লোভ সামলাতে পারছি না । ভবিষ্যতের কাহিনী, পৃথিবীতে বিজ্ঞানের খুব উন্নতি ঘটেছে কিন্তু সাংঘাতিক মারাত্মক সব অস্ত্র তৈরি হয়েছে যা মুহূর্তের মধ্যে সব ধ্বংস করে দিতে পারে -- এই পর্যন্ত সব জানা পথেই এগিয়েছে । এরপর আসে গল্পের মূল আখ্যানভাগ, একদল বিজ্ঞানী একটি জনশূন্য দ্বীপে কিছু মানুষ পাঠিয়ে তারা কিভাবে বেঁচে থাকতে পারে তা দেখছেন পরীক্ষা করে, এদের তাত্ক্ষণিক স্মৃতি নষ্ট করে দেওয়া হয়েছে ফলে এদের নিজের জীবনের কথা কিছুই মনে নেই । কিন্তু যুগ যুগ ধরে যে স্মৃতি গড়ে উঠেছে সেটা কাজে লাগিয়ে কিভাবে এরা টিঁকে থাকতে পারে তা দেখা হচ্ছে । ফলে এরা দিব্যি আগুন জ্বালিয়ে রেঁধেবেড়ে খেয়ে থাকতে পারলো দেখে পর্যবেক্ষক বিজ্ঞানীরা খুব আনন্দিত । একটি তরুণ এক তরুণী আর একটি ছোট্টো বাচ্চা-- বেশ ভালোই চলছিল । এবার এক চতুর্থ চরিত্র এসে উপস্থিত হলো । সে এক সাংঘাতিক লোক, বিশাল গরিলার মতো চেহারা, মনুষ্যপ্রবৃত্তি সব চাপা পড়ে গেছে পশুপ্রবৃত্তির আড়ালে । সে এক ভীষণ কঠিন অবস্থা । তার উপর আবার হঠাৎ জলপ্লাবন দেখা দিল, দ্বীপটি প্রায় ডুবে যায় যায় । উপর থেকে যারা পর্যবেক্ষণ করছিলেন তাদের মধ্যে বিজ্ঞানী ছাড়াও ছিলেন কবি আর একজন সমাজসেবী মহিলা, তাদের রাখা হয়েছে নাহলে নাকি বিজ্ঞানীরা অনেক সময় সহজ মানবিক ব্যাপারগুলি ভুলে গিয়ে কেলেংকারি করে বসেন । যেমন মহা ধ্বংসসাধক প্রোটোনিউট্রন বোমা বানাবার পর আবিষ্কারক বিজ্ঞানী সাংবাদিকদের কাছে সরল বিস্ময়ে বলছিলেন যে এটা তিনি বানিয়েছেন শুধু দেখাবার জন্য যে এটা বানানো সম্ভব, কারণ আগে সবাই বলেছিলেন যে তা সম্ভব নয় । ভদ্রলোক ধরতেই পারেননি যে কি সাংঘাতিক জিনিস তিনি বানিয়ে বসে আছেন । তাই এখন সব বৈজ্ঞানিক পরীক্ষায় পর্যবেক্ষক দলের মধ্যে অন্য বিশিষ্টদের রাখতেই হবে ঠিক হয়েছে ।
অমৃতের পুত্রকন্যা কিন্তু কেমন যেন অসমাপ্ত অবস্থায় শেষ হয়েছে যেমন সব বিরহান্তক গল্পই অসমাপ্ত হিসেবে শেষ হয় । শেষে রয়েছে সেই প্রোটোনিউট্রন বোমার আবিষ্কারক নিজের গবেষণাগারে আত্মহত্যা করেছেন (এতদিনে তিনি বোধহয় ব্যাপারটা বুঝতে পেরেছেন, যধ ত্ছঞং ত্ছস্ংত্রঞংরু! । সেই জনশূন্য দ্বীপে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে যেতে উদ্যত হয়েছেন সেই সমাজসেবী মহিলা যাকে শুধুমাত্র মহাশয়া নামে উল্লেখ করেছেন লেখক ।
এই গল্পটি সম্পর্কে এত বিস্তৃত বলার একটি কারণ হলো এটি কল্পবিজ্ঞান কিন্তু এটার মধ্যে এক বিশেষ গভীরতার ছাপ রয়েছে, শুধু ফ্যান্টাসি বা যান্ত্রিক কচকচি নয় । বিজ্ঞানের মহাশক্তিশালী রূপের সামনে আমাদের অসহায়তা কোনো কোনো ক্ষেত্রে আমাদের সর্বদা বিপন্ন করে রাখে, আমাদের হাতে যেন ব্যবহার-নির্দেশিকা ছাড়াই দিয়ে দেওয়া হয়েছে সাংঘাতিক সব শক্তি, আমরা জানি না কোন পথে আমরা যাবো, অথচ যেতে আমাদের হবেই । অন্ধকার থেকে বেরোতেই হবে, অথচ বেরোবার পথ অন্ধকারের জন্যই দেখা যাচ্ছে না । এই অবস্থায় কেবল নিজেদের শুভবুদ্ধি ছাড়া আর কিছু নেই পথ দেখাবার, সে শুভবুদ্ধিও মাঝে মাঝে ঢেকে যায় দুর্যোগের মেঘে ।
শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের লেখা কল্পবিজ্ঞানের গল্পগুলোও বেশ ভালো লাগে আমার । বিজ্ঞানের থেকে এখানেও হাসিখুশি মেজাজটিই প্রধান । একটি গল্প বলার ইচ্ছে হচ্ছে । এটার নাম রুমাল । এটাও ভবিষ্যতের পৃথিবীর কাহিনী । তবে সে-পৃথিবী তেজস্ক্রিয়তায় ভরে গিয়ে মনুষ্যবসবাসের অযোগ্য হয়ে যাওয়ায় মানুষ সেখান থেকে চলে গিয়েছিল অন্য গ্রহে বসবাসের জন্য । এরপর একরকম গাছ, ভবিষ্যতের একজন বিজ্ঞানী যার নাম দিয়েছেন "আটমমারি" গাছ, সেই গাছ পৃথিবীর সব তেজস্ক্রিয়তা শুষে নিয়ে আবার মানুষের থাকার যোগ্য করে দিচ্ছে পৃথিবীকে । তো সেই উপলক্ষ্যে এক সম্মেলনের ব্যবস্থা করা হয়েছে, সে সম্মেলনে বিভিন্ন কাল থেকে বিভিন্ন বিজ্ঞানীদের আনা হয়েছে টাইম গাড়ির সহায়তায় । আইনস্টাইন, গ্যালিলিও, আর্কিমিডিস, নিউটন, জগদীশ বোস-- প্রায় সবাই এসেছেন । ভবিষ্যতের বিজ্ঞানীরা সবাই নানারকম আশ্চর্য জিনিস দেখাচ্ছেন প্রদর্শনীতে । একজন দেখালেন বনসাই পারমানবিক বিস্ফোরণ । টেবিলের উপর ঘটালেন এটা, মোটে ছ ইঞ্চি উঁচু আর বারো ইঞ্চি ব্যাসের মাশরুম ক্লাউড তৈরি হলো, দেখে সবাই খুব হাততালি দিলেন । আরেক বিজ্ঞানী দেখালেন পঞ্চভূতের খেলা; ক্ষিতি, অপ, তেজ, মরুত্, ব্যোম থেকে মানুষ তৈরি করে আবার সে মানুষকে পঞ্চভুতে মিশিয়ে দিলেন । দেখতে দেখতে আর্কিমিডিস আইনস্টাইনকে জিজ্ঞেস করছিলেন, "কি হে ছোকরা, কেমন বুঝছ ?" আইনস্টাইন মাথাটাথা চুলকে বললেন "আজ্ঞে, বিজ্ঞানের খুব উন্নতি হয়েছে ।" আর্কিমিডিস রেগে গিয়ে বললেন, "আরে দূর, বিজ্ঞান আর ম্যাজিক যে এক জিনিস হয়ে গেল হে ছোকরা !" এইসব ছোট্টো ছোট্টো কথা মনকে ভরিয়ে দেয় । গল্পের নায়ক বিজ্ঞানী, ইনিও ভবিষ্যতের, তবে খুব শান্তশিষ্ট মেজাজের, তার রুমালে অ্যান্টিগ্রাভিটি সলিউশন লাগিয়ে তিনি লেভিটশন দেখিয়েছিলেন । কিন্তু পুরোনো যুগের বিজ্ঞানীরা নিজেদের মধ্যে মশগুল হয়ে আলোচনাই করছিলেন, বিজ্ঞানের নামে ম্যাজিক দেখে সময় নষ্ট না করে । এমন সময় হঠাৎ নিউটনের বেড়াল আর্কিমিডিসের পায়ে কামড়ে দিয়েছে, খুব রক্ত পড়ছে । জগদীশ বোস ছুটে এসে সেই রুমালটা (সেই অ্যান্টিগ্রাভিটি রুমাল) দিয়ে আর্কিমিডিসের পায়ের ক্ষতটা বেঁধে দিলেন আর তাকে বললেন যে আর্কিমিডিসের পায়ের ছোঁয়ায় তার রুমাল ধন্য হলো এতদিনে । শেষে এত সুন্দর একটা শ্রদ্ধার আবহ ফুটে ওঠে যে মনটা ভরে যায় ।
এরপর লীলা মজুমদারের লেখাগুলো নিয়ে বলতে ইচ্ছে করছে । ওঁর লেখাগুলোতেও ফ্যান্টাসির ছোঁয়া, মনকে টেনে রাখে সুন্দর সুন্দর বর্ণনা । ওঁর লেখা গল্পগুলোর মধ্যে শূন্য , চক্রান্ত , সিঁড়ি , লে , লিম্বো সাহেবের পেশা --সবই খুব ভালো লেগেছে । ওঁর লেখা বেশিরভাগই পড়েছি কিশোর-জ্ঞানবিজ্ঞান বলে একটি কিশোরকিশোরীদের জন্য প্রকাশিত বাংলা পত্রিকায় ।
আমি এই কিশোর-জ্ঞানবিজ্ঞানের কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করতে চাই কারণ আমার মনে হয় বাংলা কল্পবিজ্ঞানের ক্ষেত্রটিতে এই পত্রিকাটির এককভাবে বিরাট অবদান রয়েছে । আমি বাংলায় শুধু বিজ্ঞান বিষয়ক পত্রিকা খুব কমই দেখেছি । আর এটিতে প্রকাশিত লেখাগুলো প্রধানত কিশোরকিশোরীদের জন্য হলেও সেগুলি যথেষ্ট পরিণত ও মননশীল । যেন আবার ভেবে বসবেন না যে ওদের জন্য বিজ্ঞাপন দিতে বসেছি, কিন্তু সত্যি অনুসন্ধিত্সু ছাত্রছাত্রীদের কাছে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ পত্রিকা ।
যাক এবারে আবার বাংলা কল্পবিজ্ঞানের কথায় ফিরে আসি । আমার পড়া কল্পবিজ্ঞানের (যদিও খুব বেশি পড়ার সৌভাগ্য হয়নি) গল্পগুলির মধ্যে আরেকজন উল্লেখযোগ্য লেখক হলেন অনীশ দেব । এঁর লেখাও ভালো লেগেছে, পড়েছি নানা জায়াগায় । মনে পড়ছে আনন্দমেলায় পড়া এঁর একটি কল্পবিজ্ঞান কাহিনী -- নামটা ভুলে গেছি বলে খুব দু:খিত, কিন্তু গল্পটা অত্যন্ত সুন্দর ছিল বলে আখ্যানভাগ আজও মনে আছে । এটিও যন্ত্রপাতিতে অতি উন্নত এক সমাজের কাহিনী । তারা এমন `অ্যাণ্ড্রয়েড' তৈরি করতে পারে যে তাকে মানুষের থেকে তফাৎ করা খুব শক্ত । (ওহ্, বলতে হবে একটা কথা । অ্যাণ্ড্রয়েড হলো মানুষের মতো দেখতে রোবট । ওই উন্নতযুগের লোকেরা অ্যাণ্ড্রয়েড তৈরি করে তাদের রক্ত, মাংস, অভ্যন্তরীণ যন্ত্রপাতি সবই মানুষের মতো করে; শুধু শক্তির উত্স আলাদা ।) এইরকম একটি সমাজে এক ভদ্রলোক, তিনি মানুষ, `অ্যাণ্ড্রয়েড' নন, ফিরে এলেন একটি বিরাট দুর্ঘটনার থেকে কোনোক্রমে রক্ষা পেয়ে । কিন্তু তার কাছের লোকেরা খুব ভয় পেয়ে গেল কারণ তারা মনে করেছিল যে ভদ্রলোক নন, তার জায়াগায় শত্রুরা পাঠিয়েছে ঠিক তার মতো দেখতে একটি `অ্যাণ্ড্রয়েড' (দুর্ঘটনাটি ঘটেছিল শত্রুপক্ষের দ্বারা এবং সেই দুর্ঘটনার অঞ্চল তখন সম্পূর্ণ শত্রুকবলিত) । তাই নানাভাবে তাকে পরীক্ষা করা হলো কিন্তু কিছুতেই নিশ্চিত হওয়া গেল না তিনি মানুষ নাকি `অ্যাণ্ড্রয়েড' । এই অবস্থায় তিক্ত বিরক্তচিত্তে ভদ্রলোক বাড়ি চললেন । চেনা লোকেদের কাছে তিক্ততম ব্যবহার পেয়ে তিনি তখন হৃদয়ের ভিতরে ক্ষতবিক্ষত । গল্পের শেষটা যদিও বিরহান্তক কিন্তু অত্যন্ত হৃদয়স্পর্শী । ভদ্রলোক তার বাড়ির বাগান থেকে একটি গোলাপ তুলে সেটিকে আদর করছিলেন, তার হৃদয়ক্ষত প্রশমিত হয়ে যাচ্ছিল শুভ্র গোলাপটির কোমল স্পর্শে । হঠাত্ ভদ্রলোকের স্ত্রী মারাত্মক এক অস্ত্রের মারণরশ্মি প্রয়োগ করে বসলেন তার উপর । ভদ্রমহিলা ভেবেছিলেন যে শত্রুপক্ষের `অ্যাণ্ড্রয়েড' এসে তাদের শেষ করবে । ভদ্রলোক যখন মরে যাচ্ছেন তখন তার হাতে গোলাপটি দেখে সেই `অ্যাণ্ড্রয়েড' বিশেষজ্ঞ বললেন যে তিনি মানুষই, `অ্যাণ্ড্রয়েড' নন, কারণ `অ্যাণ্ড্রয়েড' বিনা কারণে গোলাপ তুলে তাতে মুখ ঘষতে পারে না, যুক্তি ছাড়া তারা কোনো কাজ করতে পারে না, তাদের প্রতিটি পদক্ষেপ যুক্তির কড়াপাকে আঁট করে বাঁধা । নিশ্চিতভাবে জানার পর সবাই কান্নায় ভেঙে পড়লো, কারণ যে-মাত্রায় মারণরশ্মি তার উপরে প্রয়োগ করা হয়েছিল তারপরে সেই উন্নতযুগের চিকিত্সাব্যবস্থার দ্বারাও আর তাকে বাঁচানো সম্ভব নয় । ভদ্রলোকের তখন কিন্তু মনে হচ্ছিল যে প্রিয়জনেরা যদি চোখের জলে বিদায় জানায় তাহলে কি কখনো মৃত্যু কষ্টের হতে পারে ? গল্পটা এত গভীর যে রীতিমতো ভাবতে হয় । আমরা তো উর্ধশ্বাসে ছুটে চলেছি উন্নত থেকে আরো উন্নত দিনের দিকে, নতুন নতুন আবিষ্কারের থেকে আরো নতুন আবিষ্কারের দিকে, চাওয়া আমাদের কখনো ফুরায় না, কিন্তু আমরা কি একটু থেমে একবার ভাববো না যে ঠিক কোন লক্ষ্যের দিকে আমরা এগিয়ে যাচ্ছি, এগোতে গিয়ে কোনো অমূল্য ধন হারিয়ে ফেলছি কিনা শুধুই আমাদের অনবধানতায় ? যা আমাদের বাঁচার প্রকৃত চাবিকাঠি ?
এইরকম আরো কিছু কল্পবিজ্ঞান কহিনী পড়েছি, যেখানে শেষপর্যন্ত যান্ত্রিকতাকে ছাপিয়ে মানবিকতা বড়ো হয়ে উঠেছে ।
সমরজিৎ করের লেখাগুলোর কথাও উল্লেখ করা দরকার । ইনিও খুব ভালো লেখেন । এঁর সৃষ্ট কল্পচরিত্র ড: বাসু খুবই ভদ্র, মানবিক আর প্রতিভাবান চরিত্র । তার ছাত্রছাত্রীরাও তারই মতো । এঁরাও নানা বিপদ থেকে পৃথিবীকে রক্ষা করেন ।
আরো অনেক কল্পবিজ্ঞানের গল্প-উপন্যাস পড়েছি নানা জায়গায়, কিন্তু সব লেখকদের নাম মনে নেই । তাই হয়তো অনেক উল্লেখযোগ্য কাহিনীকারের নাম দিতে পারলাম না ।
বহুকাল আগে আনন্দমেলায় পড়া একটি কল্পবিজ্ঞান উপন্যাসের নাম না দিয়ে পারছি না । এর নাম ছিল দ্বিতীয় পৃথিবী । লেখিকা খুব সম্ভবত চিত্রা রায় । লেখাটি ছিল অসাধারণ । এখানেও ভিন্নগ্রহের আগন্তুকদের কথা আছে তবে এরা একটু অন্যরকম । তারা অতি উন্নত সভ্যতা থেকে পৃথিবীতে এসেছে হৃদয়ের খোঁজে । এদের সভ্যতায় সব থাকা সত্ত্বেও প্রযুক্তির চাপে দমবন্ধ হয়ে মরতে বসেছে তাই বেরিয়েছে অভিযানে যে যদি এই গরিব গ্রহ পৃথিবীতে খুঁজে পায় সেই অমূল্যধন । এদের দেখতে একেবারে পৃথিবীর মানুষের মতো, খুবই সুদর্শন । এদের যানে মেয়েরা আর ছেলেরা উভয়েই রয়েছে । নেতার নাম লে । সে এক অতি ভদ্র ও ভালো চরিত্র (কেন যে ওদের মতো ভালোরা এই হতশ্রী গ্রহে হৃদয়ের সন্ধন করছিল কে জানে !) । যাইহোক ওরা বেছে নিল কতগুলি অসহায় বালকবালিকা ও বৃদ্ধ বৃদ্ধাদের । বালকবালিকাগুলি প্রত্যেকেই ছিল মানসিকভাবে প্রতিবন্ধী । বেশিরভাগই ছিল `মেন্টাল হোম'-এ । আর বৃদ্ধবৃদ্ধারা অতি দরিদ্র বস্তিবাসী । যাইহোক দূরনিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে স্নায়ুতন্ত্রে অপারেশন করে তো তারা প্রতিটি বালকবালিকাকেই ভালো করে দিলেন । তাদের মেধা স্বাভাবিকের থেকেও বাড়িয়ে দিলেন । এবার তাদের সকলকে নিজেদের যানে তুলে নিলেন । কিন্তু পাকাপাকিভাবে নিজেদের গ্রহে নিয়ে যাওযার আগে তারা সত্যি যেতে ইচ্ছুক কিনা তা জানার জন্য `ভারচুয়্যাল' দ্বিতীয় পৃথিবী তৈরি করে তাদের সেখানে রাখলেন ওঁরা । কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেইসব ছেলেমেয়েরা আর বুড়োবুড়িরা অনেক দু:খের জায়গা হওয়া সত্ত্বেও পৃথিবীতেই ফিরে আসতে চাইলেন, সেই গ্রহের আরাম বিলাস তুচ্ছ করে । যখন ভিনগ্রহীরা একলা একলা ফিরে যাচ্ছেন তখন ওদের জন্য সহানুভূতিতে মনটা ভরে যায় । এই প্রথম কোনো কল্পবিজ্ঞানের গল্পের ভিনগ্রহীদের জন্য এত মনকেমন করে । মনে হয় আমরা ভালো হয়ে উঠছি, সত্যি সত্যি মহাকাশ-অভিযানের যোগ্য হচ্ছি এতদিনে । ওঁরা কিন্তু যে তীক্ষণ মেধা এই অসহায় ছেলেমেয়েগুলিকে দিয়ে গিয়েছিলেন তা ফিরিয়ে নিয়ে যাননি । তাই ওরা নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ করে, তাদের জীবনের `মিশন' ঠিক হয়ে গেছে, নানা দুর্যোগে দুর্দশার জর্জরিত রাসায়নিক ধুলোয় ঢাকা এই গরিব পৃথিবীকে ভালো করে তুলবে এই তাদের জীবনের একমাত্র লক্ষ্য । এই গল্পটি বিরহান্তক নয়, কিন্তু এটা পড়ে মনে সুখ আর দু:খ একই সঙ্গে দেখা দেয় । কেন এই ছেলেমেয়ে বুড়োবুড়ি সবাই সেই ভালো গ্রহান্তরে চলে গেল না, কেন পড়ে রইলো এইখানে প্রবল অনিশ্চয়তার মধ্যে, তা ভেবে মনে কষ্ট হয়; আবার পৃথিবীকে ভালোবেসে এর ভালো করার ব্রত নিয়ে কিশোরকিশোরীরা রয়ে গেল এখানে এটা ভেবে ভালোও লাগে । খুব মনে রাখার মতো লেগেছিল গল্পটা, তাই এতকাল পরেও কিছু কিছু নাম পর্যন্ত মনে আছে । বহু বছর আগে এটা পড়েছিলাম আনন্দমেলার পাতায় ।
সুনীল গঙ্গোপাধ্যাযের বিশ্বমামা চরিত্রটি বেশ ভালো লাগে । ইনিও কল্পবিজ্ঞান কাহিনীর নায়ক, তবে সবসময় মজা করতে ভালোবাসেন, মানুষকে চমকে দিতে পছন্দ করেন । ইনি বিজ্ঞানী, পৃথিবীর নানা দেশ থেকে এঁর ডাক আসে, তিনি যানও গবেষণা করতে বা বক্তৃতা দিতে । কিন্তু সেখানে তাকে থাকার প্রস্তাব দিলেই তিনি নানারকম কায়দা করে কেটে পড়েন । দেশে ফিরে মজা করে সেইসব গল্প ভাগ্নেভাগ্নিদের বলেন আর খুব মজা পান নিজেও । এঁকে নিয়ে লেখা গল্পগুলো খুব ভালো লাগে । যেন একঝলক ঠাণ্ডা হাওয়া । আমার একটা আফশোস যে প্রেমেন্দ্র মিত্রের লেখা ঘনাদার গল্প বেশি পড়ার সুযোগ পাইনি । একেবারে শেষদিকে লেখা কয়েকটি গল্প শুধু পড়েছি । ঘনাদার কাহিনিতে তো গোটা পৃথিবীর ভূগোল । আর বিজ্ঞানের নানারকম মারপ্যাঁচ । আমি আনন্দমেলাতে পড়েছিলাম ঘনাদার চিংড়ি বৃত্তান্ত । এটা আফ্রিকার একটি অঞ্চলে এক মারাত্মক জার্মান সাহেবের অভিযান নিয়ে । সেই জার্মান, নাম তার ব্রুল, তিনি ছিলেন এক প্রাক্তন নাত্সি, তিনি ভিরুংগা পর্বতের পাদদেশে একটি বিশেষ অংশে যেতে চান, কারণ তার গোপন লক্ষ্য হলো সেইসব পর্বত গহ্বরের থেকে বিষাক্ত গ্যাস সংগ্রহ করা, পরবর্তী যুদ্ধে যাতে কাজে লাগানো যায় । কিন্তু সেই পাহাড় জঙ্গলে পথ দেখাবার জন্য তো স্থানীয় কাউকে চাই । তাই তার আফ্রিকী সহকারিরা ধরে আনলো চিংড়ি নদীর ধারের এক খুব রোগাচিমড়ে লোককে । সে নাকি ওই অঞ্চল হাতের তালুর মতো চেনে । তারপরে আর বলার দরকার নেই, সবাই নিশ্চয় বুঝতে পারছেন যে সেই লোকটিই ঘনাদা, তিনি কিভাবে সেই সাহেবকে বিপথ থেকে ফিরিয়ে ভালো পথে নিয়ে এলেন সেই হলো গল্পের শেষটা । এটাও খুব ভালো গল্প ।
এরকম মাঝে মাঝে মনে পড়ে যায় ছোটো ছোটো গল্প । যেগুলো হয়তো পড়েছি বহুকাল আগে অথবা কিছু বছর আগে ।
তাহলে বাঙালিও ভালোই কল্পবিজ্ঞান লিখতে জানেন । আসলে সেগুলি অন্যধরনের একটু তাই সাহেবরা বুঝতে পারেননি । অবশ্য বাংলা কল্পবিজ্ঞান খুব বেশি অনুবাদ হয়েছে বলে মনে হয় না । সাহেবরা পড়ে দেখার সুযোগ পাননি তো কি করে আর বুঝবেন কি মণিমুক্তো লুকিয়ে আছে বাংলা কল্পবিজ্ঞানে । ওয়ার্ল্ড ট্রেজারির সম্পাদক না জেনেই তৃতীয বিশ্বের সব দেশের কল্পবিজ্ঞানকে একধারসে বাতিল করেছেন । উত্সাহী অনুবাদকরা বসে যাবেন নাকি কয়েকটা গল্পকে ইংরেজিতে অনুবাদ করতে ?
বাংলা কল্পবিজ্ঞান কাহিনীগুলিতে কল্পনা আর বিজ্ঞান দুইই আছে তবে অনেকটাই আমাদের চেনাজানা জগতের মধ্যে । প্রাধান্য পেয়েছে শুভবুদ্ধি, স্নেহ, করুণা, শান্তি । মহাকাশে মারাত্মক মারামারি চলছে, ভীষণ সাংঘাতিক সব অস্ত্র ব্যবহৃত হচ্ছে, বাংলা কল্পবিজ্ঞানে এরকম প্রায় কোথাও দেখিনি । আমি সব গল্প পড়েছি বলব না, সত্যি কথা বলতে কি খুব সীমিত সংখ্যকই পড়েছি, তবে বেশিরভাগই ভালো ছিল বেশ । সবগুলিতেই শক্তির চেযে বুদ্ধিকেই প্রাধান্য বেশি দেওয়া হয়েছে ।
বিজ্ঞান তো শুধু যন্ত্রপাতির বিজ্ঞান নয়, সে তো জীবনের বিজ্ঞান, সত্য অনুসন্ধানের বিজ্ঞান, ভালো থেকে আরো ভালোর দিকে যাবার বিজ্ঞান । তাই এই হিসেবে বাংলা কল্পবিজ্ঞান অবশ্যই সার্থক সৃষ্টি । তবে আরো অনেক নতুন কল্পবিজ্ঞানের গল্পের জন্য অপেক্ষা রয়েছে আমাদের । বাংলাসাহিত্যে এই ধারাটি এখনো খুব সবল নয়, এখনো খুব শক্তিশালী নয় । প্রতিশ্রুতি আছে প্রচুর, পরিণতির দিকে তাকে নিয়ে যাবেন নবীন লেখক-লেখিকারা, এই প্রত্যাশা ।