এটা দেখে ভালো লাগল যে, অনিরুদ্ধ একা আসেনি, সঙ্গে নীলিমাও এসেছে । এর মধ্যে একদিন সন্ধের দিকে এসেছিল ওরা । না, অনিরুদ্ধর নিজের বাড়িতে নয়, যে বাড়িতে প্রেমাংশুবাবু এতগুলো বছর কাটিয়ে চলে গেলেন সেখানেই শ্রাদ্ধের কাজকর্ম হবে । এই উপলক্ষে যাদের আসতে বলা হবে তাদের জন্য যে আমন্ত্রণপত্র ছাপা হয়েছে তার ভাষা দোকান থেকে নেওয়া । যারা এসব চাপিয়ে দেয় তারা প্রয়োজনে কী ছাপতে হবে তার নমুনাও পেশ করে মুহূর্তের মধ্যে । তাদের কাছে জন্মোত্সব, উঅপনয়ন, বিবাহ, শ্রাদ্ধ এ সব চাড়াও গৃহপ্রবেশ কিংবা নববর্ষের আমন্ত্রণ জানানোর ভাশাও সহজলভ্য । নীলিমা থাকতেও এমন পত্রভাশার উপস্থিতি দেখে ধীরেন্দ্র কষ্ট পেল । তবে প্রকাশ করল না কারো কাছে । স্নাতকোত্তর পাঠক্রম শেষ করে নীলিমা তো বাংলা নিয়ে একসময় গবেষনাও করতে চেয়েছিল । সে যাঁদের কাছে পড়েছে তাঁদের মধ্যে অন্তত দু-একজন ভাষার মূল্য শিক্ষার্থীর মর্মে প্রবেশ করানোর মন্ত্র জানতেন । তবু কেন এই ধার করা ভাষার গতানুগতিকতা দিয়ে পিতাকে স্মরণ করার পত্র ছাপা হলো ? আরো একটা কথা আছে খুবই ব্যক্তিগত স্তরের বেদনা হয়ে প্রায় । তার ভাই সে ভাবে না জানুক নীলিমা তো জানে তার পিতার অন্তত এক ভ্রাতুষ্পুত্র এত বিফলতার মাঝখানেও ভাষার নাটমন্দিরের সংস্রব কখনো ছেড়ে আসেনি । ছাপতে দেওয়ার আগে তাকেও কি একবার দেখানো যেত না কী ছাপানো হচ্ছে শেষে ? অনিরুদ্ধ বা নীলিমা কাউকেই কিছু বুঝতে না দিয়ে ধীরেন্দ্র আমন্ত্রণপত্র প্রতিমার হাতে দিয়ে দেয় । প্রতিমা সেটা সরিয়ে রাখে যত্ন করে । যত তাড়াতাড়ি সম্ভব শ্রাদ্ধবাসরে উপস্থিত থাকার কথা বলে চলে গেছে তারা । তারা চলে যাওয়ার পরেই বেরিয়ে পড়ে ধীরেন্দ্র । - একটু হেঁটে আসি । বাড়িতে আর ভালো লাগছে না । আমি ফিরে এলে তুমি বেরিয়ো । তোমাকে তো আবার একটু বাজারের দিকে যেতে হবে । কী, তাই না ? প্রতিমা অবাক হয় । - তুমি কী করে জানলে ? - খুব কঠিন কিছু নয় । নীলিমাকে যখন বলছিলে তখন আমি কি খুব দূরে দাঁড়িয়েছিলাম ? তুমি যে ত্বকের ভাষা নিয়ে বেশ সচেতন তা যারা ভাষা নিয়ে একটু-আধটু কাজ করে তাদের চোখে পড়বেই । বাজারের সামনে অত ঝলমলে দোকান হয়েছে । এটুকু অন্তত কল্পনা করতে পারি তুমি সেখানে গিয়ে কী করো । প্রতিমা হাসে । - কী করি বলো তো ? - কী আবার করবে ? ওখানে একবার ঢোকার পর তোমার তো আর কিছুই করার নেই । শুধু একজন সুদর্শনার হাতে নিজেকে সঁপে দিয়ে চোখ বন্ধ করে বসে থাকতে হবে । তারপর যা যা করার সব তিনিই করে যাবেন । তিনি তোমার মাথায় কী প্রয়োগ করবেন, তোমার ভুরু তাঁর আঙুলের স্পর্শ কতটা পাবে, কী কী তিনি তোমার মুখে মাখিয়ে তোমার মুখের ভাষা পালটে দেবেন, সবই তো তাঁরই ব্যাপার । তুমি তো এক সমর্পিতা মাত্র । আমি একটু হেঁটে আসি । তারপর তুমি যত খুশি নিজেকে সমর্পণ করো ।
আজকাল আর লক্ষ্যহীনভাবে খুব একটা হাঁটা হয় না । কোথায় যাওয়া হবে সেটা নিজের কাছেই পরিষ্কার করে নিতে হয় । ধীরেন্দ্র ঠিক করল শ্মশানের দিকেই যাবে । শ্মশানের পাশে একটা উদ্যান ঐতিহ্যমন্ডিত হয়ে বেঁচেছিলো অনেক বছর । সেটা নষ্ট হতে হতে এক সময় যাদের হাতে চলে যায় তাদের ভয়ে সন্ধের পরে কেউ আর সেখানে ঢোকার কথা ভাবতে পারত না । যাদের হাতে চলে যায় তাদের হাত সর্বত্র বেশ বড়ো । সেই লম্বা হাতের ছায়া সেই বাগান থেকে সরিয়ে নিয়ে সেখানে গাছের ছায়া ধরে রাখার মতো সবুজের সব বেদি করে দেওয়া হয়েছে । আর হয়েছে ঝর্না । আর হয়েছে বীথিপথ । সেখান থেকে সন্ধের পরে নির্ভীকভাবে হেঁটে সেই জলক্ষেত্রের কাছে পৌঁছে যাওয়া যাবে যার সঙ্গে আবহমানের যোগ ক্ষীণ হয়ে এলেও বিলীন যে হয়নি তার প্রমাণ পাওয়া যায় বান এলে । বান এলে জলক্ষেত্রের তীরের ঘরগুলোতে জল ঢুকে যায় । কাউকে উঠে যেতে হয় খাটের ওপর । কাউকে খাট উঁচু করার কথা ভাবতে হয় । কাউকে সারা রাত জেগে বসে থেকে দেখতে হয় জল বাড়ছে কিনা । যার যৌবনের কথা কেউ মনে রাখে না তার ক্ষণস্থায়ী যৌবনের সঙ্গে পাল্লা দিতে কতবার যে হিমসিম খেয়ে গেছে তীরবর্তী সব গৃহস্থ তার কোনো হিসেব নেই । কে যেন সেদিন বলছিল দু-এক বছর ধরে নাকি যৌবনের উচ্ছ্বাস আর তত নেই । উচ্ছ্বাস কমেছে, নাকি নিয়ন্ত্রণ বেড়েছে ? সেই নতুনভাবে রচিত উদ্যানের মধ্যে প্রবেশ করে ধীরেন্দ্র টের পায়, জলের খবর যাই হোক না কেন, ঝর্না এবং বীথি দুইই আবেগের নয়, নিয়ন্ত্রণেরই শিল্পকলা । চারিপাশে এত লোকজন, এত যানবাহন, এত শব্দ, এত খাওয়াদাওয়া, এত হরিধ্বনি, এত দাহ, এমনকী ছোট ছোট মিছিল তথা ছোট ছোট পথসভা, এমনকী শোক থাকলেও উদ্যানে জমা হয়েছে এমন এক নৈ:শব্দ্য যাকে কাজে লাগাতে পারলে লাভবান হওয়া যায় । ধীরেন্দ্রর সেই ক্ষমতা নেই । তা সে ভালো করেই জানে । সে বড়োজোর প্রদক্ষিণ করতে পারে ঝর্ণা । বীথিকে করে তুলতে পারে ভাবিত হয়ে হেঁটে যাওয়ার অবকাশ । তার বেশি কিছু করা তার পক্ষে সম্ভব নয় এই মুহূর্তে । তার পক্ষে যা সম্ভব এই মুহূর্তে তাই সে করতে থাকে । তার বাবার পদচারনার কথা মনে পড়ে যায় । কিন্তু বুক চিতিয়ে হাত দুলিয়ে সেই হাঁটার আদল তার এই হাঁটায় সে যেন কিছুতেই আনতে চায় না । স্বাস্থ্যের জন্য নয়, তার এই পাদচারনায় নিরর্থকতার জন্য কিছু একটা করে ওঠার বাসনা জমতে থাকে যেন । এখান থেকে বেরোলেই যে মোড় সেখানে যে সব পথসভা হয় সেগুলি যেতে আসতে লক্ষ করেছে বহুবার । তা নিয়ে বলার কিছু থাকে না, যদিও এত লোক এত জোর দিয়ে এত সভায় কত কিছু যে বলে যায় নিয়ম করে । একবার কিন্তু তাকে কিছুক্ষণের জন্য হলেও দাঁড়িয়ে পড়তে হয়েছিল । ছোট মঞ্চে যে ছেলেটি একাই উপস্থিত থেকে বিচারাধীন বন্দীদের বিনা বিচারে ফেলে রাখার ছবি আঁকছিল, সে যখন শীতের দিনের ধুলোভরা কম্বল ঝেড়ে যে বন্দীর ঘোর হাঁপানি আছে তাকে কী ভাবে আরো শ্বাসকষ্টের মধ্যে ঠেলে দেওয়া হয় তা দৃশ্যমান করে, তখন প্রতিভাত হতে থাকে কান্না । সপ্রতিভ ছেলেটি সেই একজনের মঞ্চে একা একা দাঁড়িয়ে নতুন করে কিছু বলার আগে কান্নার দ্বারা অধিকৃত হয় । সেই কান্নাকে ছুঁতে পারেনি কোনো অভিনয়ের পাপ । ফলে কিছুক্ষণের জন্য ধীরেন্দ্রও চলে গিয়েছিল সেই ঘরে যেখানে মানুষ বিচার পায় না, কিন্তু কম্বলের ধুলো পায়, তার টান বাড়ে, কিন্তু আস্তে আস্তে কমতে থাকে জীবনীশক্তি । সেই কান্না যতটা সার্থক ছিল তার সমপরিমাণ নিরর্থকতার জন্য কী যে করে ওঠা যায় এই পদচারনা ছাড়া, তা সে যতই বুঝতে পারে না ততই তার দেরি হতে থাকে বাগান থেকে বেরিয়ে আসতে । শেষে তার কানে আসে সেই শব্দ যা বীথির কোনো কোল থেকে ধ্বনিত হয় । সেই ধ্বনির মধ্যে যোগাযোগব্যবস্থার জয়ধ্বনিও মিশে আছে । মানুষ যেখানেই থাকুক না কেন তাকে ধরে ফেলা যাবে সেখানেই । এই ভাবের জগতে কিছুতেই যোগাযোগের অভাব মাথা তুলতে পারবে না আর । কে যেন বীথির কোলে কাকে নিয়ে বসেছিল নির্বিবাদে । তাকে মাথা তুলে উঠে দাঁড়াতে হয় এবং ছোট যন্ত্র কানে রেখে প্রকাশ করতে হয় ব্যাকুলতা । ঝর্ণার দিক থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে ধীরেন্দ্র যে শেষে রাজপথের দিকে এগোতে পারে তা সেই ব্যাকুলতার জন্যই । এই ব্যাকুলতার প্রকাশ না হলে সে বোধহয় এখানেই কাটাত বরাদ্দ সময় ।
ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে তারিখের গন্ডগোল সত্ত্বেও সময়ের কাঁটা স্বচ্ছন্দ । আরো কিছুক্ষণ তার হাতে আছে । সে হেঁটে বেড়াতে পারে আরো কিছুক্ষণ একেবারে নিজের মতো করে । একেবারে নিজের মতো করে খোঁজ করতে পারে সেই মহিলার যাঁকে আর কোথাও দেখা যাচ্ছে না । তিনি তাদের বাড়ির পেছনের কোনো এক টালির ঘর থেকে বেরিয়ে এসে কুড়ি মিনিট ধরে হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছে যেতেন সেই আয়তনে যেখানে স্পন্দিত হয়ে আছে পুরাণ । নিমন্ত্রণ ছিল দক্ষযজ্ঞে সবারই । নিমন্ত্রিত হতে পারেননি কেবল দুজন, শিব ও সতী । তবু সতী পিতার এই মহাযজ্ঞে উঅপস্থির থাকতে চাইলেন । শিব অনুমতি দিলেন না । সতী তাঁর রাগ চেপে রাখতে পারলেন কিছুতেই । ফলে প্রকাশ পেল মহামায়ার বিভূতি দশমহাবিদ্যারূপে । শিব দেখলেন সতীর বদলে তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে কালী, তারা, ষোড়শী, ভুবনেশ্বরী, ভৈরবী, ছিন্নমস্তা, ধূমাবতী, বগলামুখী, মাতঙ্গী ও কমলা । বিভ্রান্ত হলেন তিনি । সেই সুযোগে সতী পৌঁছে গেলেন পিতার যজ্ঞস্থলে । সেখানে তাঁকে অপমানিত হতে হলো এবং শুনতে হলো শিবনিন্দা । এ সব সহ্য করতে না পেরে তিনি যজ্ঞস্থলেই দেহত্যাগ করলেন । সতীর মৃত্যুসংবাদ পেয়ে শিব ও তাঁর সঙ্গীরা যজ্ঞ পন্ড করলেন । সতীর দেহ কাঁধে ফেলে শোকে উন্মত্ত শিব নেচে চলেছেন ভীষণভাবে । এই দৃশ্যের মধ্য থেকে কেউ বের করেছেন ট্রাজেডির সার্থক রূপ । কিন্তু এই ঘোর নৃত্য সৃষ্টির পক্ষে খুবই বিপজ্জনক ছিল বলে এগিয়ে এলেন বিষ্ণু তাঁর সুদর্শন চক্র হাতে । এই চক্র দিয়ে তিনি সেই মৃতদেহ খন্ড-বিখন্ড করলেন । টুকরোগুলি ছড়িয়ে পড়ল দিগিবদিকে । একান্নটি টুকরো একান্নটি স্থানকে মহাপীঠ করেছে । যে মহিলার খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না তিনি রোজ বিকেলবেলায় দশমহাবিদ্যার প্রথম প্রকাশের সামনে বসে থাকতেন । যেখানে বসে থাকতেন সেখানে নাকি ছিটকে এসে পড়ে সেই দেহের একটি টুকরো । অনেকদিন ধরেই তাঁকে লক্ষ করত ধীরেন্দ্র । তাঁর মাথায় জটা । ছাই মেখে নিলে যে রুক্ষতা হয় তেমন এক জলাভাব তাঁর সারা শরীরে । সামান্য শাড়ি পরে খালি পায়ে লক্ষ্যের দিকে হেঁটে যেতেন রোজ । প্রথম দেখায় কেউ ভৈরবী বলে ভুল করতে পারে । শুধু জটার জন্য নয়, চোখের জন্যও খানিকটা । যখন রাজপথ দিয়ে দিবালোকে হেঁটে যেতেন তখন মনে হতো চোখ একটা বড়ো দায়িত্ব বহন করে চলেছে । যার দিকে তাকাতেন তাঁকে দেখে নিতে চাইতেন আমূল । একদিন ধীরেন্দ্র তাঁকে অনুসরণ করতে শুরু করে । তিনি চলেছেন, তাঁর পেছন পেছন চলেছে সে । তিনি রাস্তা পার হওয়ার জন্য দাঁড়ালে সেও দাঁড়িয়ে পড়ছে যথাসম্ভব । তাঁকে অনুসরণ করার সবচেয়ে বড়ো সুবিধে তিনি পরিবেশমুখী নন, চৈতন্যমুখী । ফলে তিনি কখনো পেছন ফিরে দেখবেন না কেউ তাঁর পেছন পেছন আসছে কিনা । এই জটিলতার দিনে এত সহজেই কাউকে সামনে রেখে এগিয়ে যাওয়ার উদাহরণ দুর্লভ । এগোতে এগোতে তিনি শ্মশানের পথ ধরেছিলেন । কিংবা বলা যায় শ্মশান বাঁদিকে রেখে তাঁর নতুন করে যাত্রা শুরু হয়েছিল । তারপর তিনি একটা বাজারের মাঝখান দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে ফুরিয়ে ফেললেন বাজার । কাঁচাবাজার পার করে তিনি পাকা বাজারে প্রবেশ করলেন । এত সাবলীলভাবে অনুসরণের কাজ হয়ে যাচ্ছে বলে অনুসরণকারী একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিল । সে হঠাৎ সামনে তাকিয়ে দেখে যাঁর জন্য তার এই এগিয়ে যাওয়া তাঁকে আর দেখা যাচ্ছেনা কোথাও । তখন তার মহানাগরিক বুদ্ধি তাকে পরিবেশ সচেতন করে । সে বুঝতে পারে সামনে এমন গলি আছে যেখান দিয়ে গলে যাওয়ার সম্ভাবনা খুব বেশি । সে পা চালিয়ে ধরে ফেলে ডানদিকের গলি । ডানদিকের গলিতে যারা বাস করে তাদের কারো কারো ঘরের দরজা খোলা ছিল । যাঁর মাথায় জটা আছে তিনি যদি এমন কোনো ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়েন তবে তাঁকে চট করে পেতে প্রাণ বেরিয়ে যাবে । সে এটা বুঝতে পেরেই ঝুঁকি নেয় । সে আর কোনো খোলা দরজার দিকে না তাকিয়ে খোলা গলির মধ্যে ঢুকে পড়ে এবং খানিকটা এঁকে বেঁকে এগিয়ে গিয়েই শেষে পেয়ে যায় সেই মহিলাকে যিনি আপনমনে হেঁটে চলেছেন । এবার সে সাবধান হয় যাতে তিনি চোখের আড়ালে আর না চলে যেতে পারেন । ফলে অচিরাৎ প্রকাশিত হয় সেই মন্দির যেখানে দশমহাবিদ্যার প্রথম মূর্তি প্রতিষ্ঠিত । সেই মন্দিরে যেখানে বলি হয় সেখানে একটু দাঁড়িয়ে তিনি কিন্তু নাটমন্দিরে উঠে যান না । নাটমন্দির পার হয়ে উঠে যান মন্দিরে । সিঁড়ির নীচে ছেলেমেয়েরা জড়ো হয়েছে । তাদের দৃষ্টি যারা এখানে এসে পড়েছে তাদের পায়ের দিকে সারাক্ষণ । যেহেতু জুতো পরে মন্দিরে ওঠা যাবে না সেই কারণে জুতো সঞ্চয়ের প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যায় তাদের মধ্যে । মহিলার খালি পা । তাই তাঁকে স্পর্শ করার দায় নেই । যারা ধীরেন্দ্রর পায়ের দিকে হাত বাড়িয়েছিল তারা সুবিধে করতে পারেনি । তার দুটি কারণ । ধীরেন্দ্র চায়নি সেই মুহূর্তে ওপরে উঠতে । টালির ঘর থেকে বেরিয়ে এসে তিনি কোথায় যান তা যখন এত সহজেই জানা হয়ে গেছে তখন তার মন্দিরে আপাতত না গেলেও চলবে । দ্বিতীয় কারণ একেবারেই বৈষয়িক । তার কাছে বড়ো নোট ছিল । খুচরো পয়সা ছিল না একেবারেই । খুচরো পয়সা কাছে না থাকলে ভূমির ছেলেমেয়েরা যখন জুতো ফিরিয়ে দেবে তখন তাদের হাতে বিনিময়ে কী তুলে দিতে পারবে সে ? তাদের তো আর ভাঙিয়ে দেওয়ার কথা বলতে পারবে না । তারা তো নিজেরাই এত বেশি খুচরো হয়ে ছড়িয়ে আছে নিরন্তর । সে সেদিন মন্দিরের কাছ থেকে ফিরে আসে এই আশা নিয়ে যে, অনতিবিলম্বে খুচরো পয়সার জোরে সে উঠে যেতে পারবে মন্দিরে একদিন । সেদিন সে নিশ্চয় মুখোমুখি হতে পারবে তাঁর । মন্দিরে না উঠেও ভূমির বিভিন্ন কোণ ঠিকভাবে বেছে নিয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখে নেওয়া যায় আয়তনের ডানা । সেই ইচ্ছে থেকেই সে সক্রিয় হয়, কিংবা তার সক্রিয়তা বাড়ে । গর্ভগৃহের সামনে যে বারান্দা সেখানে নয়, এমনকী নয় গর্ভগৃহে, মহিলা বসে আছেন বাইরের বারান্দায় । একটা কাপড়ের ব্যাগ তাঁর কাঁধে ঝুলতে থাকে বলে সেই বসে থাকা অবস্থায় সেই ব্যাগও বসে পড়েছে মেঝেতে । কী আছে ওই ব্যাগের মধ্যে ? এই প্রশ্নের নিজস্ব জোর ছিল সেদিন । কিন্তু বৌদ্ধিক এবং বৈষয়িক কারণে তাকে সেদিন পিছিয়ে আসতে হয় বলে উত্তর কেবল অনুমানের মাধ্যমে মুক্তি খুঁজেছিল । ওতে বোধহয় পুজোর সরঞ্জাম আছে । সন্ধেবেলায় যখন প্রনতির জোর বাড়ে, যখন যে যার তাগিদে দশমহাবিদ্যার প্রথম রূপ দেখতে চায় একবার, ঠিক তখন ওইসব সরঞ্জাম কাজে লাগিয়ে তিনি বোধহয় আত্মদীপনের কাজ শুরু করে দেন কোথাও । তাঁর গন্তব্যস্থল চিনে নেওয়ার ফলে এই সুবিধে হয়েছিল যে, মাঝে মাঝে সন্ধের দিকে হাঁটতে হাঁটতে সেখানে চলে যাওয়া যেত যেখানে তিনি বসে থাকতেন মানুষের ভিড়ের দিকে তাকিয়ে একা একা । শুধু তাঁকে একটু দূর থেকে দেখার জন্য কতবার যে দশমহাবিদ্যার প্রথম মূর্তির রাজত্বে চলে গেছে ধীরেন্দ্র তার কোনো হিসেব নেই । নাটমন্দিরের ভিড়ে, গর্ভগৃহের ভিড়ে, কিংবা যে ভিড় মন্দিরচাতালকে পূর্ণতা দিয়েছে তার ঘনত্বে কতরকমের মানবিক প্রকাশই তো দেখতে চাইলে দেখা যায় সহজেই । তার কাছে এ সবের থেকেও কিন্তু আকর্ষক ছিল সেই স্থির এবং অন্যমনস্ক অবয়ব, সেই জটা যার দৌলতে চোখ থেকে ঝরে গেছে সামান্যতম জটিলতাও । এভাবে বেশ কিছুদিন অতিক্রান্ত হওয়ার পর সে ঠিক করে এবার এগিয়ে গিয়ে কথা বলবে তাঁর সঙ্গে । ফলে ছেলেমেয়েদের কাছে জুতো রেখে সে একদিন উঠে যায় ওপরে । গর্ভগৃহের বাইরের দিকের বারান্দায় তাঁকে খুঁজে নিতে খুব বেশি সময় লাগেনি । সেদিন যত ভিড় ততই একাকিত্বের প্রতিনিধিত্ব তাঁর উপবেশনের মধ্য থেকেই বেরিয়ে আসছিল । তিনি সাধারণত এমনভাবে বসে থাকতেন যার সঙ্গে কোনো প্রতিষ্ঠিত আসনের সাদৃশ্য খুঁজে পাওয়া যেত না । হাঁটুদুটোকে খানিকটা হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে বসে থাকায় যে ভাবটা আসত তার মধ্যে খুব বেশি পরিমানে ছিল প্রতিষ্ঠার বিপ্রতীপে যাওয়ার প্রবণতা । ধীরেন্দ্র সেদিন ভিড়ের মধ্যে জায়গা করে নিয়ে এমনভাবে বসে তাঁর সামনে যাতে সেও সক্ষম হয় জড়িয়ে ধরতে তার দুটি হাঁটু । যে চোখ চারিপাশের মধ্যে থাকতে চায় না সেই চোখও শেষে তার চোখের দিকে তাকায় । - কী ভাইটি ? কিছু বলবি ? ধীরেন্দ্র এই সম্বোধনে উদ্দীপিত হয় । তার মনে হয় তার সামনে যিনি বসে আছেন তিনি সত্যিই অগ্রজা এবং তাঁকে দিদি বলতে পারার সুযোগের সদ্ব্যবহার করা উচিত অবিলম্বে । - হ্যাঁ দিদি, আপনি তো আমাদের বাড়ির কাছেই থাকেন । - তুই কোথায় থাকিস ? আমি কোথায় থাকি তাই বা তুই জানলি কী করে ? এত সহজ নয় রে এ সব জানা । - আমি যে আপনাকে দেখেছি আমাদের বাড়ির কাছেই । রোজই তো আপনি সেখান থেকে বেরিয়ে এখানে চলে আসেন । - তুই কী বোকা রে । এতেই তুই বুঝে ফেললি আমার ঘর কোথায় ? তারপর ধীরেন্দ্র দেখে সে যাঁর সামনে বসে আছে তাঁর মধ্যে আবার দেখা দিয়েছে প্রবল অন্যমনস্কতা । এই অন্যমনস্কতার সঙ্গে যুদ্ধ করার উপকরণ তার কাছে যে নেই এটাও সে বেশ ভালো করেই বুঝতে পারে । অনেক কথা বলতে পারবে এমন কোনো আশা করে সে আসেনি তাঁর সামনে । তার মানে এই নয় যে, কোনো কথাই সে বলতে পারবে না এটাও প্রত্যাশিত ছিল । তার নিজেকে একটু অসহায় লাগে । যাদের সঙ্গে সে সাহিত্যের আলোচনা করতে পারেনি তাদের সঙ্গে রাজনীতির আলোচনা অগভীরভাবে হলেও চালিয়ে যেতে পেরেছে কিছুক্ষণ । সংসারের কথা বলতে গিয়ে হোঁচট খেলে সম্ভারের কথায় চলে যেতে পেরেছে অবিলম্বে । আমিষ থেকে নিরামিষে পৌঁছে যেতে পেরেছে প্রয়োজনে দেশ-দেশান্তর সামনে রেখে । কিন্তু কাউকে সামনে রেখে কোথাও পৌঁছে যেতে না পারার এমন উদাহরণ তার ঝুলিতে নেই বলে সে যে কী বলবে কী করবে কিছুই বুঝে উঠতে পারছিল না । তিনি নিজেই যেন নেমে এলেন । - হ্যাঁ ভাই, কী যেন বলছিলে, তুমি আমার কাছেই থাকো । ঠিক কথাই তো । একদম ভুল নেই । তুই তো আমার কাছেই আছিস । চাকরি করিস, বউকে ভালোবাসিস, তাতে কী হয়েছে ? তুই তো সত্যিই আমার কাছেই আছিস । এই দ্যাখ কত কাছে, এই দ্যাখ আমি তোকে ছুঁয়ে ফেলতে পারছি । তিনি ধীরেন্দ্রর বাহুর ওপর হাত রাখেন । কিংবা স্পর্শ করেন বাহু । সে শুধু এইটুকু টের পেয়েছিল যে, তার ত্বক কোমলতম কিছুর সংযোগসূত্রে জেগে উঠল নি:শব্দে । - আমার খোঁজ নিয়ে তোর কী লাভ হবে বল তো ? একটু নিজের খোঁজ কর । কতদিন নিজের খোঁজ করিসনি একটু ভেবে দ্যাখ তো । আবার তিনি চুপ করে যান । আবার তাঁর দৃষ্টি অন্য কোথাও চলে যায় । ধীরেন্দ্র ভাবে প্রথম দিনের পক্ষে যথেষ্ট হয়েছে । এবার বোধহয় নিজেকে ভিড় আর একাকিত্বের দ্বৈরথ থেকে সরিয়ে নেওয়ার সময় আসন্ন । সে উসখুস করে । - যেতে চাইছিস । যা না, তোকে কেউ ধরে রাখেনি । তবে একটা কথা শোন । তিনি তাঁর ঝুলির ভেতর থেকে বের করে আনলেন দু বাক্স ধূপকাঠি । - আজ সারাদিন কিছু খাওয়া হয়নি রে । এই দুটো নিবি ? খুব অল্প দাম । দেব ? সত্যিই অল্প দাম দিয়ে সে নিয়ে নেয় সেই দুটো বাক্স । সে বলেও ফেলেছিল - আমাকে আরো দুটো দিতে পারেন । আমার তো বাড়িতে কাজে লাগে । - তুই এখন যা তো । আমি এই বেশ আছি । ভারতীয় মুদ্রা হাতে নিয়ে তিনি দৃষ্টিকে আবার রিক্ত করেছিলেন । কোনো উপচিকীর্ষারই কোনো ভূমিকা নেই সেখানে । ধীরেন্দ্র উঠে আসে আবার হাজির হওয়ার মন নিয়ে । তার তাঁকে কিছু বলার ছিল, এই কথাটা এর পরে যতবারই তাঁর সঙ্গে কথা বলার পর উঠে এসেছে ততবারই মনে হয়েছে তার । কী যে তার বলার ছিল তা আজও তার কাছে পরিষ্কার নয় খুব একটা । এটা ঠিক যে, সে তাঁর কাছ থেকে দেবীসূক্ত সম্পর্কে জানতে চায়নি কিছু । জগতের যে পিতা তাঁকেও কীভাবে প্রসব করা যায় তা নিয়ে কোনো আলোচনার শ্রোতা হতে চায়নি সে । যে গৌরীপীঠকে মায়ের জননস্থান বলা হয় কোথায় তার অবস্থান - তাঁর সামনে বসে এ প্রশ্নের চাপও সে অনুভব করেনি । এই অন্তহীন বিশ্ব যে `গূঢ় যোনিস্থান' থেকে জন্ম নিয়েছে তাকে কেন্দ্র করে তার কোনো জিজ্ঞাসা ছিল না । তার কী যে বলার ছিল তা তার নিজের কাছেও ফুটে ওঠেনি বলে সে কখনো কখনো মৃত্যুর কথা বলতে চেয়েছে । ভস্ম হওয়া অথবা মাটিতে মিশে যাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে যে অর্থহীনতা অভূতপূর্ব বিজনতার জন্ম দেয় তার নাগপাশ থেকে বেরিয়ে আসার রাস্তা কি তাঁর চোখের মধ্যে সত্যিই আছে, এই নিয়ে ভাবতে ভাবতে কয়েকটি সান্নিধ্যের পর্ব শেষ হয়েছে কেবল । কিন্তু কোনো সক্রিয়তার ভূমিকা রচিত হয়নি । তাঁর কাছ থেকে আনা ধূপকাঠি জ্বালাতে জ্বালাতে মনে হয়েছে কেবল ধূপের গন্ধই পাওয়া যাচ্ছে । কিন্তু তাঁর মধ্যে যে নি:শব্দ দহন চলছে এবং তার ফলে যে অনন্তের গন্ধ জাত হচ্ছে, তার কোনোটারই অন্তর্গত না হতে পারলে মূল বক্তব্য দানা বাঁধতে পারে না কখনো । দেবীসূক্ত নয়, দু-একবার তাঁর কাছে বসে তাঁর হেঁয়ালির যোগ্য শ্রোতা হওয়ার চেষ্টা করতে করতে সে বরং রাত্রিসূক্তের সেইসব দিক নিয়ে ভাবতে চেয়েছে যেখানে রাত্রির ভূমিকার মধ্যে আশ্রয়দাত্রীর ভূমিকাও আছে । যখনই সে রাত্রির কোলে মাথা রাখতে চেয়েছে তখনই কেন সেই মাথা বালিশের কোলে চ্যুত হয়েছে এবং ভয়ের অচ্যুত রূপ থেকে জেগে উঠেছে অন্ধকার বাঁকা হাসির মতো পরিচ্ছন্নভাবে, এই প্রশ্নকেও সে আকরিক স্তর থেকে উঠিয়ে ব্যবহারযোগ্য করে তুলতে পারেনি কোথাও । তার মাঝে মাঝে মনে হয়েছে গর্ভগৃহের বাইরের বারান্দায় যাঁর বসে থাকা তিনি কিছুই না করে তাকে কেবল আলোড়িত হওয়ার সুযোগ করে দিয়েছিলেন ধাপে ধাপে । ফলে তাঁর খোঁজ নেওয়ার একটি অতিব্যক্তিগত দায় তার ওপর এসে বর্তেছে এমনই মনে করে ধীরেন্দ্র, কখনো আপনমনে হেঁটে যেতে যেতে পথ দিয়ে অথবা পাথেয় নিয়ে । তার বাড়ির পেছনদিকে যেখানে টালির ঘরের পাশে ত্রক্রমান্বয়ে জমে উঠেছে টালির ঘরই কেবল, সেখানে কোন ঘর থেকে তিনি বেরিয়ে আসতেন তা তার জানা নেই । তবু একদিন সেখানেও চলে গিয়েছিল সে । কলের মুখে যারা কাপড় কাচছে, যারা জল ভরছে, যারা এক কোণে দাঁড়িয়ে সেরে নিচ্ছে স্নান, তাদের কেউই পুরুষ নয় । সে যখন গিয়েছিল ঠিক সেই মুহূর্তে সমলিঙ্গের ভিড়ে ভরে উঠেছিল জলক্ষেত্র । সেই ক্ষেত্র থেকে একটু নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়িয়ে সে ভেবেছিল কীভাবে জানতে চাইলে যাঁর কথা জানতে চাওয়া হচ্ছে তাঁর একটা ভাবমূর্তি ফুটিয়ে তোলা সম্ভব হবে শেষপর্যন্ত । তাঁর চোখটাকে বড়ো করে দেখাবে, নাকি বড়ো করবে জটাকে ? তাঁর ঝুলির কথা কতটা বলবে, কতটা বলবে তাঁর খালি পায়ে হেঁটে যাওয়ার কথা । হঠাৎ তার কানে আসে একজন তার থেকে অনেক ছোট একটি মেয়েকে কী একটা কথা বলায় সে জলের বালতির পাশে দাঁড়িয়ে রুখে উঠল আপাদমস্তক । যে ছোট সে ভাষায় ভাষায় নিজেকে প্রায় প্রতিষ্ঠিত করে ফেলল সেই ভূমিকায় যা সাধারণত যে বড়ো তার নিশীথপুরুষ পালন করে এসেছে এ পর্যন্ত । যে বড়ো সে যে লজ্জায় দমিত হয়ে সরে পড়ল তত্ক্ষণাত্, এমন দৃশ্য দেখা গেল ন সেখানে । বরং সে আরো গলা করে আরো নিজস্ব ভাষায় সেই প্রতিপক্ষের ভাবী স্বামীর ধর্ষকের ভূমিকায় নিজেকে প্রতিষ্ঠিত দেখতে চাইল । ফলে জলক্ষেত্রের রমনীমন্ডল থেকে তার প্রশ্নের কোনো উত্তর রচিত হতে পারে কিনা তা নিয়ে সে মাথা না ঘামিয়ে স্থানত্যাগ করেছিল এই কথা মাথায় রেখে যে, মুখোমুখি বসে যাঁকে তার অগ্রজা মনে হয়েছে তাঁর খোঁজ নেওয়ার জন্য সে জলস্রোতের কাছে যেতে পারলেও যেতে পারবে না তাদের কাছে যারা অভাবের জোরে ভাবকে এতখানি নামিয়ে আনতে পেরেছে শেষে । আজ নতুন করে খোঁজ করার জন্য সে আর তাঁর আবাসমন্ডলে নয়, তাঁর চুপ করে বসে থাকার ক্ষেত্রে চলে যেতে যায় ।
মন্দিরে আজ বেশ ভিড় । সেই ভিড়ের মধ্যে যাবে কিনা এই নিয়ে তার ভাবনা হয়েছিল । ভাবনার পাশাপাশি ছিল দ্বিধা । শুধু তো অনিরুদ্ধের নয় তারও অশৌচ চলছে । মন্দিরের চত্বরে এসে পড়াটাকে আরো কয়েকটা দিনের জন্য স্থগিত রাখার মন তার কাজ শুরু করেছিল । সে মনকে প্রবোধ দেয় এই বলে যে, সে পুজো দিচ্ছে না, কিংবা প্রবেশ করছে না কোথাও । যেমন মানুষ পথে ঘোরে সেভাবেই সে ঘুরতে চাইছে মন্দিরের পথে । তার এই আসা তো তাঁর খোঁজে যিনি মূর্তির কাছে বসে নিজেকেও মূর্ত করেছেন নিয়মিত । এত মনস্কতার ভিড়ে সে কীভাবে এক অন্যমনস্ক নারীর সন্ধান নেবে, শুরু করবে কোথা থেকে, এসব চিন্তা তার মাথায় এসে ভিড় করে । তার এক সহপাঠীকে একবার সে এখানে আবিষ্কার করেছিল পান্ডার ভূমিকায় । সে যতটা কালো ততটাই স্বাস্থ্যবান । ধুতি আর ফতুয়া পরে ডালা নিয়ে চলেছে । তার ধাবমানতাকে ধীরেন্দ্র হাসি দিয়ে আটকাতে চেয়েছিল । সে মুহূর্তের জন্য থামে । ক্লাসের শেষ সারিতে বসে যে কাগজ পাকিয়ে ছুড়ে মারত শিক্ষকের দিকে, যার পেশি তখন থেকেই উল্লেখযোগ্য ছিল বলে তার বদলে অন্য কাউকে অপরাধী সাব্যস্ত করে শাস্তি দিতে এগিয়ে আসতেন শিক্ষক, তার ধীরেন্দ্রকে এক ডাকে চিনতে পারার কথা নয় । ফলে হাসির বদলে সেও হাসে এবং বলে আবার গতিময় হতে হতে - আপনি ওই দোকানে চটি খুলে বসুন । আমি এই পুজোটা সেরে আসছি । ধীরেন্দ্র কষ্ট পায় । সতীর্থ তাকে যজমান ভাবল । তবু সে সেদিন দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে তার অপেক্ষা করেছিল । ফিরে এলে ধীরেন্দ্র তাকে সব কথা বলে, তার ভুল ভাঙায় । তাকে নিয়ে যেতে চায় সেইসব দিনে যেগুলির মধ্যে পূর্নমাত্রায় ছিল বেঁচে থাকার আনন্দ । পন্ডিতমশাই বেত চালালেও বই থেকে যখন বেতস বনের বর্ননা পাঠ করতেন তখন একটা অন্যরকম মুক্তি যে বেজে উঠত চতুর্দিকে সে কথা সেই সতীর্থকে বোঝাতে গিয়ে সে অশ্রুপাত করে । এবং হাত ধরে ফেলে তার । যার হাত ধরে ফেলে সে কুতকুতে চোখ মেলে তাকে দেখতে দেখতে হাসে এবং সরব হয় অনেক পরে - তোর কোনো দরকার হলে বলিস গুরু । আমাকে এখানেই পাবি । এই ভিড়ের মধ্যেও দোকানের সামনে গিয়ে তাকে পাওয়ার চেষ্টা করে । ডালার দোকানের মালিক জানিয়ে দেয় - ওকে কবে পাবেন বলা মুশকিল । ওকে পুলিশ খুঁজছে তো, সেদিন মন্দিরে মারামারি করেছে । কিছু বলার থাকলে আমাকে বলতে পারেন । আমি ওর কাছে খবর পাঠিয়ে দেব । ডালার ব্যাপারে হলে আপনি আমাকে বলুন । ওর থেকে অনেক ভালো লোক আছে । চটি খুলে হাত ধুয়ে নিন । বলুন তো ক টাকার হবে । ধীরেন্দ্র তাকে নিরস্ত করে । - আপনি ব্যস্ত হবেন না । আমি একটু অন্য কাজে এসেছি । সে আস্তে আস্তে সেই অবয়বটি প্রকাশ করে যার মাথায় জটা, পা খালি, কাঁধে ঝোলা । চোখের প্রকাশ নিয়ে কিছু বলতে গিয়েও পিছিয়ে আসে । - এমন কাউকে চেনেন নাকি ? তাঁর খবর কিছু জানেন ? দোকানের মালিকের সামনে নতুন নতুন ক্রেতা আসছে । ব্যস্ততার ফাঁকে সে বলে ওঠে - আমি ঠিক বলতে পারব না । কত লোক আসছে যাচ্ছে । কী করে বলব বলুন তো ? সে এ প্রশ্নের কোনো উত্তর না দিয়ে সরে আসে । তার নিজেকেই যেন অপরাধী মনে হতে থাকে । সে একবার হাড়িকাঠের সামনে এসে দাঁড়ায় । মহিলাও এখানে দাঁড়াতেন এবং পথ পরিষ্কার থাকলে এখান থেকেই দেখে নিতেন দশমহাবিদ্যার প্রথম প্রকাশ । গর্ভগৃহের বাইরের বারান্দায় বসে পড়ার আগে এই দেখার সুযোগ গ্রহণ করতে তাঁর দ্বিধা ছিল না । আজ পথ পরিষ্কার নেই । ফলে তার দৃষ্টি নাটমন্দির পেরিয়ে গিয়ে আর এগোতে পারে না । সেখানে আজ থিকথিক করছে মেরুদন্ডের নমনীয়তা । মেরুদন্ডে আটকে যাওয়া দৃষ্টি সংহত করে নিয়ে সে এগোতে থাকে সেইসব ছেলে মেয়ের দিকে যারা পাদুকা ছিনিয়ে নেওয়ার অপেক্ষায় বসে আছে । ভিড় তাদের কী যে খুশিতে রাখে । তারা জুতোর ওপর গড়াগড়ি খেতেও দ্বিধা করছে না । - তোরা কেউ আমার দিদিকে দেখেছিস ? সিঁড়ি দিয়ে উঠে বাঁদিকে বসে থাকত । চুপ করে বসে থাকত । মাথায় জটা । দেখেছিস নাকি রে ? ধীরেন্দ্রর কথা শুনে তারা খিল খিল করে হাসতে থাকে । তাদের মধ্যে যে মেয়েটি একটু বড়ো সে পেছনের ধুলো ঝাড়তে ঝাড়তে উঠে আসে এবং সরাসরি তাকায় তার চোখের দিকে । - তোমার দিদি এখানে আসত ? তা চটি রাখত কোথায় ? - চটি রাখত না । - ওপরে উঠত কী করে ? চটি তো ছেড়ে রাখতে হবে । ধীরেন্দ্র যখন বলল খালি পায়ের কথা তখন সে মুখ ঘুরিয়ে নিল এইভাবে আশ্বস্ত করতে চেয়ে যে, খালি পা না হলে তারা হয়ত খোঁজ দিতে পারত । সে এখন কী করবে ঠিক করতে না পেরে মন্দিরপ্রদক্ষিণ শুরু করে দেয় । তার মনে এই আশা উঁকি দিতে থাকে যে, মহিলা হয়ত তাঁর স্থান পরিবর্তন করেছেন । গর্ভগৃহের বাইরের বারান্দার যেদিকে তিনি বসতেন সেদিকে না বসে তার উলটোদিকে হয়তো বসতে শুরু করেছেন তিনি । মন্দির প্রদক্ষিণের ভঙ্গি বজায় রেখে সে চারিপাশটাই দেখতে থাকে । না, কোথাও নেই সেই মহিলার অস্তিত্ব । গর্ভগৃহের ডানদিক, বাঁদিক এবং পেছনদিক দেখা হয়ে গেলেও একটা দিক কিন্তু বাকি থেকে যায় । সেটা হলো তার সামনের দিক । সামনের দিকটা পড়েছে আবার একটা ঘরের মধ্যে । সেই ঘরের মধ্যে দেবীর একেবারে চোখের সামনে হয়তো বসে থাকতে চেয়েছেন তিনি । কিন্তু যতই ঘোরা যাক বাইরে থেকে কিছুতেই বোঝা সম্ভব নয় ঘরে তিনি আছেন কিনা । এই খোঁজ নিতে গেলে তাকে ওপরে উঠতে হবে । সে আবার ছেলেমেয়েদের কাছে আসে । তারা অনেকেই এগিয়ে আসে তার পায়ের দিকে । যে জয়লাভ করে সে সেই পাদুকা টেনে নিয়ে যায় । তার ওপরে ওঠার আর কোনো সমস্যা নেই । সে ওপরে উঠে গর্ভগৃহের সামনের ঘরের অন্ধকারের মধ্যে মহিলাকে খোঁজে । দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে চোখ বুজে যিনি হাতজোড় করে বসে আছেন তাঁর মধ্যে সেই মহিলার বিন্দুমাত্র চিহ্ন নেই । ঘর শুধু অন্ধকার নয়, সে আমন্ত্রকও । সেখানে নিজের মতো করে বসে পড়ার আমন্ত্রণ আছে গোপনে । মহিলাকে যখন পাওয়াই গেল না তখন দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে একটু বসে থাকতে দোষ কী ? সেই প্রলোভন সে জয় করে । কারণ তার চোখে ভাসছে প্রতিমার হাতছানি । সে বাড়ি ফিরে না গেলে প্রতিমা বেরিয়ে এসে সমর্পিতা হতে পারবে না । সে বেরিয়ে এসে ঘড়ি দেখে এবং পা চালানো শুরু করার আগে ঠিক করে মালার বড়ো দোকানে যাঁর খোঁজ নিতে এসেছে তাঁর খোঁজ নেবে । মানুষসমান জবার মালা বিক্রি হচ্ছে । যে বিক্রি করছে সে দাঁড়িয়ে আছে মালা হাতে করে । তার বসার পাটাতনে না বসে যত বড়ো মালা ততখানি দন্ডায়মান থেকে সে যে সক্রিয়তার পরিচয় দিচ্ছে তার তুলনা এই চত্বরে প্রায় নেই বললেই চলে । ধীরেন্দ্র অনতিদূরে দাঁড়িয়ে তার সরব বিক্রয়কৌশল দেখতে দেখতে আর নীরব থাকতে পারে না । তাকে শেষে জিজ্ঞাসা করতেই হয় যাঁকে পাওয়া যাচ্ছে না তাঁর খবর জানা আছে কিনা । সে তার জিজ্ঞাসাকে গুরুত্ব না দিয়ে একটি গুরুত্বপূর্ন জবার বলয় প্রায় স্খলিত করে দেয় ধীরেন্দ্রর হাতে । যে মালা তার হাতে এসে পড়েছে তা ফিরিয়ে দেওয়ার ইচ্ছে দমন করে সে দাম দেওয়ার সময় আবার তার কাছে দিতে চায় প্রশ্ন । - মাথায় জটা, মন্দিরের বারান্দায় বসে থাকতেন । তাঁকে দেখতে পাচ্ছি না । জানেন কিছু ? টাকা গ্রহণ করার সঙ্গে সঙ্গে সে প্রশ্নও গ্রহণ করে এবার । - মেয়েলোক তো ? কাঁধে একটা ব্যাগ থাকত ? একেবারে ঠিক কথা বলছে লোকটা । খুব আশা জাগে তার মনে । - হ্যাঁ হ্যাঁ, একেবারে ঠিক বলেছেন । জানেন কিছু ? যে মালা ধীরেন্দ্র পেয়েছে তার থেকে যেন আরো বড়ো মালা আরো লম্বা হয়ে জনস্রোতকে দেখাতে দেখাতে সে বলে ওঠে - ঠিক বলেছেন, তাকে তো দেখা যাচ্ছে না কদিন ধরে । মালটা গেল কোথায় বলুন তো ? আসুন, এইদিকে আসুন । টাটকা জবা । রানিজবা । আসুন ।
সে পা চালিয়ে বাড়ির দিকে ফিরলেও বাড়ি পৌঁছোতে তার একটু দেরি হয়ে যায় । প্রতিমা দরজা খুলেই অবাক হয় । - এতবড় মালা নিয়ে এলে, কী হবে ? আমাদের অশৌচ চলছে, তিনি তোমার কাকা, সব ভুলে গেলে ? - এই মালা আমার হাতে এসে প.ংএদছিল । আমি আর ফিরিয়ে দিতে পারলাম না । সত্যিই তো মালাটা নিয়ে কী করা যায় বলো তো ? তোমার গলায় পরিয়ে দেখব কেমন দেখায় ? টাটকা জবা, রানিজবা । - খুব ইয়ার্কি হচ্ছে ? রজনীগন্ধা, বেল বা যুঁই নিয়ে মজা করো । সইবে । কিন্তু জবা নিয়ে মজা করতে যেয়ো না । একেবারেই ভালো লাগে না । এক কাজ করি । একটু মার সঙ্গে দেখা করতে বাড়ি যাব ভাবছিলাম । মালাটাও সঙ্গে নিয়ে যাই । এই মালা যত বড়ো তত বড়ো ছবি তো আমাদের ওই বাড়িতেই আছে । অত বড়ো জিবের সঙ্গে এই জবাই শেষে পাল্লা দিতে পারবে । তুমি জামাকাপড় ছাড়ো । আমি ঘুরে আসি । দরজাটা দিয়ে দাও । - বলেছিলে যে বেরোবে, মাথা সঁপে দেবে কারো হাতে । কী হলো ? প্রতিমা লজ্জা পায় । - নীলিমার ফোন এসেছিল । কাজের দিন খুব সকালে চলে যেতে বলল । তখন আমার হুঁশ হলো । এ আমি কী করছি ! এখন আমার এসব করা সাজে ?
টেবিলে বইপত্র জমে গেছে । গুছিয়ে রাখার অনেক সমস্যা । গুছিয়ে রাখতে গেলে বই তলায় চলে যাবে । একবার চোখের আড়ালে গেলে চোখের আড়ালেই যেন থেকে যাবে চিরকাল । এই বহয় থেকেই বোধহয় সে অনেক বই চোখের সামনে রাখার চেষ্টা করে । ফলে যেমন জায়গা নষ্ট হয় তেমন অরাজকতার চিহ্ন আর লুকিয়ে রাখা যায় না । এই চিহ্ন বজায় রেখেই ধীরেন্দ্র একটি বই তুলে নেয় । বইটি গাছপালা নিয়ে লেখা । সে লক্ষ করে দেখেছে ইদানীং গাছপালার বই হাতের কাছে পেলে তার খুব যত্ন করে পড়তে ইচ্ছে করে । একটা কারণ খুব পরিষ্কার । গাছপালার জগৎ তার কাছে বড়ো অচেনা । অথচ বনমহোত্সবের মঙ্গলধ্বনি তার কানে পৌঁছে যায় ঠিক । অচেনা জগতের মধ্যে কারো হাত ধরে একটু একটু করে প্রবেশ করার দৌলতে কেমন এক নিস্তব্ধ সহিষ্ণুতার সঙ্গে পরিচয় হতে থাকে । মনে হয় বা মনে হতে থাকে মূল্যবোধ ছড়িয়ে আছে মাইলের পর মাইল জুড়ে দিবারাত্র । যে বইটি সে হাতে তুলে নিয়েছে তার পাতায় পাতায় পাতার ছবি । কিন্তু পাতার ছবি দেখে সে যে কোনোদিনও পাতা চিনতে পারবে না এ কথা সে নিজেও জানে খুব ভালো করে । তবু তার পাতার ছবি দেখতে ইচ্ছে করে । বইয়ের পাতা তাকে প্রকৃত পাতা চেনার ব্যাপারে কোনো সাহায্য না করলেও সে তার কাছে কোথায় যেন ঋণী থাকতে চায় । তা ছাড়া এক-একটা গাছের কত সুন্দর নাম । সেই নামের ধ্বনি থেকেও তো ঘোর বাস্তবের দিকে এগিয়ে যাওয়া যায় সহর্ষে । যেমন আকাশমনি আছে তেমন আছে দেবকাঞ্চন । দেবকাঞ্চন আর শ্বেতকাঞ্চন এক নয় কিন্তু । দেবকাঞ্চনের ফুল গোলাপি । কিংবা এমন বেগুনি যার মধ্যে গোলাপিরও স্বাক্ষর আছে । আর শ্বেত কাঞ্চন তো সাদা । তবে তার পাপড়িতে হলদে দাগ আছে । এমন শ্বেত কাঞ্চনও দেখা যায় যার ফুলের রঙ সাদা না হয়ে হালকা গোলাপি বা বেগুনিও হতে পারে । এমনিতে এমন কোনো অনড়তা নেই যা দেখে অস্বস্তি হয় । যেমন আছে উদাল তেমন আছে পরশ । যেমন আছে গাব তেমন আছে মহুয়া । মহুয়ার ফুল সকালে ফোটে না, এটা মনে রাখতে হবে । রাতে ফোটে আর সকালে ঝরে যায় । তার মানে রাতে হাঁটাই কঠিন হয়ে পড়বে মহুয়াবন দিয়ে । যে গন্ধ শুধু মানুষ নয় প্রানীকেও মাতাল করে নিশীথে, তার বিরাজমানতার প্রমাণ তার হাতে নাতে পেতে ইচ্ছে করে । প্রতিমা কি সেই প্রমাণ বহন করে আনতে পেরেছে কোনোদিন তেমনভাবে ? আর মনে রাখতে হবে মহুয়ার পরিণত পল্লবে, কোনো রোম নেই । মহুয়ার পাশে ছাতিমকে রাখতে ইচ্ছে করে । ভারতবর্ষের প্রাচীন ইতিহাসের ছাত্ররা জানে এমন সব গুরুগৃহের ঠিকানা যেখানে শিক্ষা শেষ হলে শিক্ষার্থীর হাতে মানপত্রের বদলে তুলে দেওয়া হতো ছাতিমের পাতা । ছাতিমের ফুলের গন্ধও তো কেমন মাতাল করে দিতে চায় । ধীরেন্দ্রর বাড়ির কাছে এক কবিরাজের মৃত্যু হলেও তাঁর ছাতিম গাছটি কখনো মৃত্যুর কথা বলে না । অক্টোবর থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে সে যখন এই গাছের তলা দিয়ে হেঁটে যায় তখন টের পায় যৌবনের ঠিকানা যে কেবল যৌবনের মধ্যেই আবদ্ধ থাকবে এমন কথা ভাবাও কতটা ভুল । পশ্চিম ভারতে কি শেষে এই কারণেই এই গাছকে শয়তানের গাছ বলা হয়ে থাকে ? সেখানকার আদিবাসীদের কেউ কেউ কেন এই গাছের কাছে যেতে চায় না, কেন তার ছায়ার থেকেও দূরে থাকে বা থাকতে চায় তার উত্তর কি নিহিত আছে যৌবনের এই নতুন সংজ্ঞা প্রদানের মধ্যে ? এ সব কথা নিয়ে ভাবতে ভাবতে তার দেরি হয়ে যায় শিমুলের প্রাঙ্গণে পৌঁছোতে, পলাশবনে পৌঁছোনোর প্রতিশ্রুতি দিতে । লালফুলের সমারোহ দেখে শিমুলকে যারা `বনের অগ্নিশিখা' বলতে চায় তারা নিশ্চয় পলাশ দেখেনি । তবে তারা আর পলাশকে বাদ দিয়ে শিমুলের সম্বন্ধে এ কথা বলার ঝুঁকি নিত না । আবার লাল পলাশ নিয়ে মজে থাকলেই হবে না, হলদে পলাশের কথাও ভাবতে হবে । কারণ ভারত কেবল এক সুরেই বাজতে চায় না, সে যে বহু সুর একইসঙ্গে ধারণ করে আছে । যে পলাশকে বলা হয়েছে `উজ্জ্বল লালচে কমলা' তার আধিক্যের পাশে হলুদ পলাশের স্বল্পতাও বহু মূল্যবান । সংখ্যাগুরুর নিসর্গ সম্পূর্ন হতে পারে না সংখ্যালঘুর বিরাজমানতা ছাড়া । ধীরেন্দ্র যে-জানলার পাশে বসে গাছপালার সংসার নিয়ে জানতে পারছে কত কিছু সেই জানলার সামনে আপনমনে বড়ো হয়ে উঠেছে কারিপাতার গাছ । এই মুহূর্তে বাতাসে দুলছে পাতা । বই বলছে এর আদি বাসস্থান হিমালয়ের পাদদেশ । আদি বাসস্থান যেখানেই হোক সে তো শেষে এসে দাঁড়িয়েছে তাদের সামান্য সংসারের সামনে । সামনে না ভেতরে এই নিয়ে সংশয় আছে প্রবল । প্রতিমার রান্না করা তরকারি থেকে যখন তার পাতা মুখে উঠে আসে তখন তাকে তো ভেতরেই পাওয়া যায় । বইতে লিখেছে ফল ছোট আর ডিমের মতো । ফুলও ছোটতবে সাদা । ফল পাকলে তার রঙ হয়ে যায় কালো । শুধু তোবইতে লেখেনি, সে নিজেও দেখেছে স্বচক্ষে । আর পড়ার সঙ্গে দেখার যত মিল খুঁজে পাচ্ছে ততই তার আত্মবিশ্বাস বেড়ে চলেছে । সে ভালো করে খুলে দিল সামনের জানলা । কারিপাতার ঠিক পাশেইরয়েছে কামিনীর ছবি বইতে । কামিনী যেমন গুল্মজাতীয় তেমনই আবার বৃক্ষজাতীয়ও বটে । যেখানে প্রতি পুষ্পগুচ্ছে অনেক ফুল সেখানে কামিনী গুল্মজাতীয় । যেখানে অল্প ফুল প্রতি পুষ্পগুচ্ছে সেখানে সে বৃক্ষজাতীয় নির্ঘাত । কিন্তু দুই জাতের গাছেই প্লাবিত করে দেওয়ার মতো গন্ধ । মহুয়া, ছাতিম আর কামিনী একযোগে যে গন্ধভুবনের সৃষ্টি করতে পারে তার ছবি কোনোদিনও কোনো বইতে ছাপা যায় না । তা কেবল কোনো কোনো ভাগ্যবান চিনতে পারে কোনো কোনো রাতের জানলা খুলে দিয়ে । কেবল এই অর্থে ধীরেন্দ্র নিজেকে ভাগ্যবান মনে করে বইবন্ধ করল আস্তে আস্তে । প্রতিমা কখন ফিরবে, তার কোনো ঠিক নেই । সে কোথাও বেরোনোর সময় `এই যাব আর আসব' - এমন একটা কথা বলে বটে, কার্যত তার ফেরার কোনো ঠিক থাকে না । এখন প্রতিমা এসে পড়লে ভালো হতো বেশ । কারণ এই মুহূর্তে তার ইচ্ছে করছে কারো সঙ্গে কথা বলতে, কেবল নিজের সঙ্গে কথা না বলে । প্রতিমার সঙ্গে কাজের বাইরে বেশ একটা বড়ো সময় ধরে সে যত্ন করে ঘরে বসেই দেখতে চায় একটার পর একটা চ্যানেল ঘুরিয়ে এমন এমন ধারাবাহিক যেখানে সংসারকেই মূল বিষয়বস্তু করে এগিয়ে যাওয়ার হিসেব ছকে ফেলা হয়েছে । যারা এ সব ছবি দাপটের সঙ্গে গড়ে তুলছে তাদের বানিজ্যিক বিচক্ষণতা দেখে মাঝে মাঝে প্রশংসা না করে পারে না ধীরেন্দ্র । কারণ সে আড়াল থেকে দেখেছে কোনো চ্যানেলের নীরব দর্শক হয়ে যে-প্রতিমা হেসেছে একটু আগে সেই প্রতিমাই একটু পরে অশ্রুপাত করছে এবং অত্যন্ত গোপনে মুছে নিচ্ছে চোখ । চ্যানেল থেকে চ্যানেলে চেনা মুখের অভাব নেই বিন্দুমাত্র । বরং চেনা মুখেরই জয়জয়কার । যে কোথাও দেবরের ভূমিকায় প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে তাকে আবার কোথাও দেখা যাচ্ছে পুলিশের ছোট কর্তার ভূমিকায় । যে একটা চ্যানেলে অবিমিশ্র জননী আর একটা চ্যানেলে সে একমাত্র কন্যার ভূমিকায় নেমে নৃত্যরত ভোরের বাগানে । একটা সংখ্যা টিপলে যে স্বামী আর একটা সংখ্যা টিপলে সে বিপ্লবী । সাতে যাকে শাশুড়ি সাজতে দেখা গেল, সতেরোয় সে সতিন হয়ে সাতাশে অন্ধ মালিনী হলেও বেশ লাগে দেখতে । এই বেশ লাগার জগত্, এই পারঙ্গমতার জগৎ প্রতিমার যে ঘুম কেড়ে নিতে পারে তা তো স্বচক্ষে দেখেছে সে । যে বাগানে নাগলিঙ্গমের প্রতিষ্ঠা, সেখানে এরন্ড গাছও মাথা তুলে দাঁড়াতে চাইছে । এই বৈচিত্র্যের হাতছানি প্রতিমার পক্ষে এড়িয়ে যাওয়া যে সম্ভব নয় তা বোঝে ধীরেন্দ্র । সে এও বোঝে যে, ইচ্ছে থাকলেও কোনো এক চ্যানেলের কোনো এক দিনের কোনো এক অধ্যায় কোনো বিশেষ কারণে তাকে বসিয়ে রাখতে বাধ্য করলেও তার সেখানে বসে থাকার উপায় থাকে না কিন্তু । বেশ মনে আছে, এর মধ্যে একদিন কোনো কাজই আর টানছিল না বলে সে রিমোট হাতে করে বসে টিপতে থাকে সংখ্যা । যেখানেই পৌঁছোচ্ছে সেখানেই নৈপুণ্য, সেখানেই হিসেব, সেখানেই যাদের চেনে তাদের চেনা সব মুদ্রাদোষ । শেষে মনে হলো আর সংখ্যার সাহায্য নিয়ে লাভ নেই । রিমোট যেখানে ছিল সেখানেই রেখে দেওয়া ভালো । রিমোট যাতে আর নগ্ন থাকতে না পারে তার জন্য কেনা হয়েছে আবরণ । সেই আবরিত খেলনাটি যথাস্থানে তুলে রাখার আগে ধীরেন্দ্র একবার শেষ চেষ্টা করে দেখতে চায় । সে আর চেনা সংখ্যার দিকে হাত না বাড়িয়ে অচেনা সংখ্যার দিকে হাত বাড়িয়েছিল । অচেনা সংখ্যা টিপে ধরার সঙ্গে সঙ্গে এমন একটা জায়গা তার চোখের সামনে ভেসে ওঠে যেখানে ক্যামেরার আলোই সবটুকু নয়, পৃথিবীর আলোও আছে সমপরিমাণে । যেখানে দৃশ্যের নির্মাণ হয়নি জন্ম হয়েছে বরং, সেখানে তার দৃষ্টি খুঁজে পেল মুক্তির অবকাশ । কী এমন দেখেছিল ধীরেন্দ্র ? শুধু সিন্ধুঘোটক দেখলে তার কিছু বলার ছিল না । সে দেখেছিল সিন্ধুঘোটকের সন্তানপ্রসব । প্রতিবেশী পাখিরা উদাসীন নয় । তারা বসে থাকছে না, কিংবা উড়েও বেড়াচ্ছে না । তারা এগিয়ে এসে প্রসূতির নাড়ি কেটে দিচ্ছে । আর গড়িয়ে পড়ছে মাতৃদুগ্ধ । একেবারে সাদা । যে গর্ভ থেকে বেরিয়ে এসে এইমাত্র পৃথিবীর আলো দেখল সে একা সেই শ্বেতধারা পান করছে না, পাখিরাও খাচ্ছে দুধের মধ্যে মুখ ডুবিয়ে । ফলে কোনো পরিচালকের রাজত্ব পেরিয়ে ফুটে উঠেছিল দুগ্ধপূর্নিমা । সেই মুহূর্তে কোথাও বাঁচার জন্য সংগ্রাম ছিল না, ছিল সংগ্রামের জন্য বাঁচার আনন্দ । রান্নাঘর থেকে আগুনের কাছ থেকে সরে এসে প্রতিমা রিমোট নিয়ে নেয় তার অনুষ্ঠানের সময় হয়েছে বলে ।
॥ পাঁচ ॥
অনেকদিন বাদে নীলিমারা যে বাড়িতে বড়ো হয়েছে সেই বাড়ির দিকে যাত্রা শুরু করে ধীরেন্দ্র । সঙ্গে আছে প্রতিমা । মাটির তলা দিয়ে যে রেল যায় সেই রেলে উঠে সরাসরি শ্রাদ্ধবাসরে পৌঁছোনোর কোনো উপায় নেই । তবু এই দম্পতি যতটা মাটির তলা দিয়ে এগিয়ে যাওয়া যায় ততটাই এগিয়ে থাকতে চায় বলে বেছে নিয়েছে পাতাল রেল । ট্রেন আসতে দশ মিনিট বাকি । অনেক উঁচুতে যে বাক্স বসানো আছে বসে বসেই তারা দেখতে পায় সেখানে নির্বাক ছবি শুরু হয়ে গেছে । এত কথা বলেও যা বলা যায় না কোনো কথা না বলে কতো বছর আগেই তা বলা হয়েছে নিশ্চিত । যিনি খর্বকায় তাঁর উল্লম্ফন দেখে হেসে ওঠে প্রতিমা । ধীরেন্দ্র দেখে ছবির মাঝখানের সচিত্র ঘোষনায় একটা দাগ ফুটে উঠছে যাকে বলা হয়েছে জীবনরেখা । সাবধান করে দেওয়া হচ্ছে ট্রেন আসার আগে কেউ যেন এগিয়ে গিয়ে ওই দাগ পার না হয় । ওই দাগ অতিক্রম করা দন্ডনীয় অপরাধ । সে জানে এই সাবধানবানীর পেছনে কারণ আছে যথেষ্ট । বেশ কয়েকটি ক্ষেত্রে ওই দাগ পার হয়ে চলন্ত ট্রেনের মুখে ঝাঁপিয়ে পড়ার দুর্ঘটনা ঘটেছে । কেউ কেউ অত্যন্ত আহত হয়ে বেঁচে গেছে । যারা বিদায় নিয়েছে তারা কোনো বিশেষ বয়সের প্রতিনিধি নয় । নানা বয়সের নারীপুরুষ আত্মহননের ইচ্ছে নিয়ে পার হয়েছে জীবনরেখা । প্রেমাংশুবাবু যেখানে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন সে জায়গাটা এত সুসজ্জিত ছিল না, সেখানে এত প্রচারও ছিল না জীবনরেখা নিয়ে । মাটির ওপরের সে জায়গাটা ঠিক কোথায় তা বোধহয় অপ্রকাশিতই থেকে গেছে চিরকাল । নির্বাক ছবির একটা নিজস্ব জীবনরেখা আছে । তার মধ্যে শেষে এই বিজ্ঞাপনের জীবন্রেখা ঢুকে পড়ে কেমন একটা ভূতুড়ে কলরবের জন্ম দিয়েছে । বিজ্ঞাপনের ট্রেন যেতে না যেতেই তাদের ট্রেন এসে পড়ল ঠিক সময়ে । স্বামীস্ত্রীদুজনেই অত্যন্ত সচেতনভাবে জীবনরেখা পার হলো ট্রেনে ওঠার জন্য । তারা পাতালের মধ্য দিয়ে শ্রাদ্ধবাসরের দিকে যতটা এগিয়ে থাকা যায় এগিয়ে যেতে লাগল ততটাই । স্টেশনে পৌঁছে মনে হলো পুরুষের তারা এসেছে প্রায় মনোরথগতিতে । অথবা বলা যায় এই যাত্রা রেত:পাতের মতো ক্ষণস্থায়ী প্রায় ।
ভূগর্ভ থেকে উঠে এসে মাটিতে পা রাখতে সময় লাগে । কারণ সিঁড়ির সংখ্যা একেবারে কম নয় । সিঁড়িরও দুটি গুচ্ছ পরপর প্রকাশিত । প্রথম গুচ্ছ শেষ হলে বাইরে বেরিয়ে আসার সুযোগ । দরজার মাথায় যে ছিদ্র আছে সেখানে টিকিট গুঁজে দিলে তবেই দরজা খুলে যাবে নি:সন্দেহে । কিন্তু ধীরেন্দ্র নি:সন্দেহ হতে পারে না । তার প্রতিবারই ভয় হয়, দরজাকে টিকিট দেওয়া হল কিন্তু দরজা ছাড়পত্র দিল না - এমন কিছু হলে কার সাহায্য নেওয়ার জন্য কোনদিকে যাবে বা যেতে পারবে শেষপর্যন্ত । এই ভয় অমূলক নয় খুব । টিকিট যথাস্থানে নেওয়ার পরেও দরজা খোলেনি, আটকে গেছে গতিপথ, এ তার নিজের চোখে দেখা । অন্তত দুবার সে দেখেছে তার হাতের টিকিট যথাস্থানে অর্পণ করার পরেও তাকে প্রতিহত করা হয়েছে । সে বেরোতে চাইছে অথচ পারছে না বলপ্রয়োগ করেও । তাকে আটকে দেওয়া হয়েছে দেখেও কেউ এগিয়ে আসেনি । তারা বরং সরে গেছে অন্য দরজার দিকে নির্বিবাদে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য । সে মানুষের নির্মম ব্যস্ততার মাঝখানে কী করবে কিছু বুঝতে না পেরে খানিকক্ষণ অপরাধীর মতো দাঁড়িয়ে থেকে শেষে স্টেশনের কর্মীর খোঁজ পেয়েছে । সে স্বীকার করে নিয়েছে দরজার খামখেয়াল । তাকে সুস্থ এবং স্বাভাবিক করার জন্য খবর পাঠানো হয়েছে । লোক এসে পড়বে যে কোনো মুহূর্তে । কর্মী হাতের চাপে যে টিকিট ঢোকানো হয়েছিল সেটি বের করে এনে ফিরিয়ে দিয়েছিল ধীরেন্দ্রর হাতে । - আপনি ওই পাশের টা দিয়ে বেরিয়ে যান । ওটা ভালো আছে । কোনোবারই আটকে দেয়নি প্রশাসন, বেরিয়ে আসতে পেরেছে । কিন্তু প্রত্যাখ্যাত হওয়ার ঘটনা ভুলে যেতে পারেনি সে । প্রতিমাকে নিয়ে সিঁড়ির প্রথম গুচ্ছ পেরিয়ে এসে শেষে যদি প্রত্যাখ্যাত হতে হয়েই আশঙ্কায় সে কোন দরজা বেছে নেবে তা নিয়ে একটু দ্বিধায় পড়ে যায় । এদিকওদিক করতে থাকায় প্রতিমা তার হাত থেকে টিকিট নিয়ে নেয় এবং তাকে অনুসারীতে পর্যবসিত করে বেরিয়ে আসে সসম্মানে । সামনে সিঁড়ির সেই দ্বিতীয় গুচ্ছ । ধাপে ধাপে পা রেখে উঠে আসতে থাকে পরিষ্কারভাবে ধীরেন্দ্র । যে অগ্রগামী সে এগিয়ে থাকার দৌলতে পেছন ফিরে তাকানোর সুযোগ পেয়ে হাসে । - তোমাকে নিয়ে আর পারা গেল না । গেটের সামনে দাঁড়িয়ে ওরকম কেউ করে ? উঠে আসতে আসতে ধীরেন্দ্র কোনো উত্তর খুঁজে পায় না । কিংবা সে ভাবে, বুঝিয়ে বলার দিন শেষ হয়ে গেছে । যতই নির্বাক ছবির মাঝখানে ছবি দেখিয়ে জীবনরেখা পার হওয়ার বিপদের কথা বুঝিয়ে বলা হোক না কেন, যে পার হতে চায় সে পার হবেই তার বুঝে ওঠা দিয়ে ।
অনেকটা এগিয়ে এলেও লক্ষ্যস্থলে পৌঁছোনোর জন্য বাসের সাহায্য নিতে হলো শেষপর্যন্ত । তারা বাস থেকে নামল যেখানে সেখানে অনেক পরিবর্তন হলেও সেই ডাক্তারখানা যে মুছে যায়নি তা প্রত্যক্ষ করল ধীরেন্দ্র । - ওই যে ডাক্তারখানা দেখছ বিকেলবেলায় হাঁটতে হাঁটতে কাকা ওখানে এসে বসতেন । এটা ছিল প্রায় রোজকার ঘটনা । ডাক্তারের সঙ্গে একটু সুখদু:খের কথা বলতে না পারলে তাঁর ভাত হজম হতো না । কতবার কাকাকে বাড়ি গিয়ে পাইনি । কাকিমা হেসে বলতেন, এই সময় তোর কাকাকে কোথায় পাওয়া যায় তোরা জানিস না ? সেখানে চলে যা, ঠিক পাবি । যা, গিয়ে ডেকে নিয়ে আয় । তাই অনেকবারই ডাক্তারখানায় আসতে হয়েছে । প্রেমাংশুবাবু ভাইপোকে দেখে এক গাল হেসে বন্ধুকে বলতেন - বুঝেছেন, কথাটা আর শেষ করা গেল না । কাল আবার হবে । আজ উঠি । কাকার দৌলতে ধীরেন্দ্র আর এক কাকাকে পায় । তিনি ডাক্তারকাকা । - ভালো করে খাওয়াদাওয়া করছ তো ? শুধু পড়লেই হবে না, খেলাধুলোও করতে হবে । না হলে শ্রীর ভালো হবে কী করে ? এমন হয়েছে, কাকাকে নিয়ে চলে আসবে বলে পা বাড়িয়েছে যখন তখনই হয়তো আটকে দিলেন ডাক্তারকাকা । - প্রেমাংশুবাবু, আপনার ভাইপোর সঙ্গে যে একটু কথা ছিল । তুমি আমার কাছে এসো তো । কী দিয়ে দাঁত মাজো ব্রাশ দিয়ে তো ? ঠিক আছে । কিন্তু কী করে এটা ব্যবহার করতে হয় সেটা না জানলে কোনো কাজই হবে না কিন্তু । আমার সামনে সোজা হয়ে দাঁড়াও । আমি দেখিয়ে দিচ্ছি । তিনি তাঁর ঝকঝকে দাঁত বের করে কীভাবে ব্রাশ ব্যবহার করতে হবে তা দেখানোর জন্য হয়তো পেনসিল তুলে নিলেন হাতে । - বুঝতে পেরেছ তো, এলোমেলো ব্রাশ চালালে দাঁতের বারোটা বাজবে । আর দাঁতের বারোটা বাজলে স্বাস্থ্যেরও বারোটা । কী, মনে থাকবে তো ঠিক ? এসব আমি রেঙ্গুনে খাস সাহেবের কাছ থেকে শিখেছি । ধীরেন্দ্র জানে ডাক্তারকাকু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ দেখেছেন । প্রেমাংশুবাবুর মুখ থেকে সে কখনো কখনো তাঁর সেইসব অভিজ্ঞতার কথা শুনেছে । কিন্তু তাঁর নিজের মুখ থেকে শোনার সুযোগ হয়নি কখনো । নীলিমা বা অনিরুদ্ধ কি তাঁকে জানিয়েছে তাঁর বন্ধুর মৃত্যুসংবাদ যথাসময়ে ? এই প্রশ্ন হাঁটতে হাঁটতে তীব্র হয় যত তত এই ভয়ও তাকে গ্রাস করে, ডাক্তারকাকা বেঁচে আছেন তো ? ডাক্তারখানা থাকলেই যে ডাক্তারকাকা থাকবেন এমন সহজ সিদ্ধান্তের দিন আর নেই । ফলে শ্রাদ্ধবাসরে ঢুকে যার মস্তক মুন্ডিত তার কাছে দাঁড়িয়ে তার প্রথম প্রশ্ন হয়, ডাক্তারকাকা বেঁচে আছেন ? অনিরুদ্ধ হেসে জানায় যে তাঁর লয় হয়নি । তার পিতার লয়ের খবর তিনি পেয়ে গেছেন যথাসময়ে । তাঁর একটাও দাঁত অবশিষ্ট নেই । সকালের দিকে নয়, বিকেলের দিকে রোজ একবার কিছু সময়ের জন্য লাঠি ভর দিয়ে এসে বসেন তাঁর ডাক্তারখানায় । সমসাময়িক যাঁরা তাঁরা সবাই গত হয়েছেন । এমনকী সেই কম্পাউন্ডারও গত হয়েছেন গত বছর । খুব পুরোনো দু-চার ঘর আছে । তাদের কেউ এলে ওষুধ লিখে দেন । তারা বাইরে থেকে যোগাড় করে নেয় । ওই যে লাল মিক্সচারের দাগ দেওয়া শিশি তা কম্পাউন্ডার মারা যাওয়ার পর থেকে হারিয়ে গেছে চিরতরে । একদম শেষে অনিরুদ্ধ জানায়, ডাক্তারকাকু জানিয়েছেন বন্ধুর শ্রাদ্ধে হাজির হওয়ার মতো মনোবল তাঁর নেই । তাঁকে যেন ভুল বোঝা না হয়, যেন মার্জনা করা হয় সম্ভব হলে । ধীরেন্দ্র চিরকালীন বিশ্বযুদ্ধের ধ্বনি যেন শুনতে পায় ।
শ্রাদ্ধবাসরে পিসিমার ছেলে প্রীতিকে নিয়ে এসেছে । প্রীতি এগিয়ে এসে প্রতিমাকে জড়িয়ে ধরে - কেমন আছো দিদিভাই ? ধীরেন্দ্র সন্ধেরাতের সেই মাঝিকে দেখে সকালবেলায় । দিনের আলোয় তার অন্য রূপ । সেখানে কেবল তার সামাজিকতা । প্রীতি এক ফাঁকে এসে প্রণামও করে যায় ভাশুরকে । দিনের আলোয় দিনের আলোর মতোই পরিষ্কার করে কথা বলতে হয় বলে সে প্রণাম গ্রহণ করে বলে - ছেলেকে আনোনি ? তারও হাসিমুখে উত্তর দিতে দেরি হয় না । - কার কাছে রেখে আসব ? মা থাকলেও নয় এক কথা ছিল । ওই তো ছেলে । বাবু, এদিকে এসো । জ্যেঠু তোমাকে দেখতে চাইছেন । বাবু লজ্জা পায় বলে শেষে জ্যেঠুকেই বাবুর কাছে এগিয়ে যেতে হয় । প্রীতি পেছনে পড়ে যায় । দিনের আলোয় এই রকমই হয়ে থাকে । শেষে নীলিমাও এগিয়ে আসে কোনো এক নেপথ্য থেকে । - দাদা, এই তুমি সকালে এলে ? সেদিনও বৌদিকে ফোন করে বলেছিলাম সকাল সকাল চলে আসতে । এত দেরি করলে চলে ? নীলিমকে পেয়ে ধীরেন্দ্রর মনে পড়ে যায় তপতীর পটভূমি । সে যে কাকিমার নিত্যসঙ্গী ছিল । মেয়ে যখন কাছে থাকত না তখন মেয়ের দায়িত্ব পালন করে গেছে সানন্দে । প্রেমাংশুবাবুর স্ত্রী যাকে দেহাবসানের পরে দেখতে পেয়েছিলেন তাঁর মৃত্যুশয্যায়, তাকে দেখার ইচ্ছে জেগে ওঠে তার মধ্যে । - আমাকে একটু তপতীর ছবির সামনে নিয়ে যাবি ? - ওই তো উলটোদিকের ফ্ল্যাট । ওর মা-বাবা থাকেন । চলো ঘুরে আসি । মা-বাবাকে পার হয়ে তপতীর ছবির সামনে দাঁড়িয়ে ধীরেন্দ্র টের পায়, ফ্রেমের মধ্যে যার হাসি আটকে আছে তার পক্ষেই এতটা ছড়িয়ে পড়া সম্ভব শেষে । তপতীর মা এবং বাবা পরস্পরকে দেখে নিয়ে শেষে ধীরেন্দ্রর দিকে তাকান যৌথভাবে, সোজাসুজি ।
ধীরেন্দ্র আবার ফিরে আসে শ্রাদ্ধবাসরে । যে ঘরে কাজ হবে, কিংবা ধাপে ধাপে শুরু হয়ে গেছে কাজ, সেই ঘরে প্রেমাংশুবাবু সস্ত্রীক মাল্যভূষিত হয়ে বিরাজমান । দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে একটু প্রণতিমান হয় সে । ঘর থেকে বেরিয়ে পুরোহিত ও অনিরুদ্ধর কাছ থেকে সরে এসে পাশের ঘরের উপবিষ্ট এবং পরিচিত মানুষজনের কাছে যাওয়ার আগে সে প্রতিহত হয় । - মামা, দাদাকে চিনতে পারছ ? অনিরুদ্ধর প্রশ্নে যিনি ধীরেন্দ্রর দিকে তাকান তাঁর পরনে সিল্কের পাঞ্জাবি আর ধুতি । মাথায় জটা খুব বড়ো না হলেও অস্তিত্বের প্রশ্নে তারও গুরুত্ব আছে । আছে রঙের মধ্যে পলাশের স্বাতন্ত্র্য টানা টানা চোখের সঙ্গে বেশ খানিকটা দূরবর্তিতার একটা নিবিড় সম্পর্ক যে প্রতিষ্ঠিত তা কিন্তু প্রতিভাত হচ্ছে সর্বক্ষণ । - চিনতে পারছ না ? জ্যেঠুর ছেলে, ধীরুদা । - তাই বল । তুই ধীরু ! কত বয়স হলো রে ! আমার তুলনায় তোরা কত ছেলেমানুষ । অথচ এত বয়সের ছাপ পড়ে গেছে কেন ? জটার অনেকটাই তো সেদিন কেটে ফেলেছি । পুরোটা কেটে ফেললে আমি তো এখনো যুবক । কিন্তু মনে রেখো, সাতের ঘরে ঢুকে পড়েছি । চলো আমরা কোণের ঘরে গিয়ে বসি । আমি তো কোনো অনুষ্ঠানে যাই না । আর বছরের মধ্যে নমাস আমার আশ্রমে থাকি । ওই আশ্রমে বসেই প্রেমাংশুদার মৃত্যুসংবাদ পেলাম । দিদি আমার থেকে তিন বছরের বড়ো ছিল । দিদির বিয়ে হলো তবে তার আগে থেকেই প্রেমাংশুদাকে চিনি । আমাদের একই দেশ, কেবল গ্রাম আলাদা । আলাদা মানে তোমাদের পাশের গ্রাম । চলো আমরা কোথাও গিয়ে বসি । ধীরেন্দ্র বহু যুগের ওপার থেকে চিনতে পারল নলিনীকান্তকে । নীলিমা-অনিরুদ্ধর ছোটমামা । তাদের বাড়িতে একসময় কত গেছেন । তার যে কথাটা খুব বেশী করে মনে পড়ে সেটা হলো, বাবা তাঁকে তাঁর কাছে বসিয়ে বেশ জোরেই বলতেন - বাজে কথা বাদ দাও । তোমরা ঠাকুরের কথা বলো, নলিনী । সে সব কথার কিছুই তার মনে পড়ে না । সে কেবল বুঝতে পারত শুল্ক-দফতরের উচ্চপদস্থ কর্মচারী হয়েও নিজস্ব সন্ধানের তাগিদে এক ভ্রাম্যমাণতা তাঁকে পেয়ে বসেছিল তখন থেকেই । কালক্রমে তিনি যে বিবাহ করেছেন, সন্তানের পিতা হয়েছেন, এ সব কথা যেমন তার ঘরে বসেই জানা হয়ে গেছে তেমন করেই সে জানতে পেরেছে, তাঁর অন্তর্জগতের প্রতিষ্ঠা তাঁর বহির্জগতের প্রতিষ্ঠা থেকে পাল্লায় ভারী হয়ে উঠেছে অনেকখানি । তিনি তার সঙ্গে একটা ঘরের একটা কোণে গিয়ে বসলেন । - মামা, আপনি যে এখানকার বাড়িতে আর থাকেন না বলতে গেলে তা আমাকে নীলিমা বলেছে । ধীরেন্দ্র অনেক কথা একসঙ্গে বলতে চয় । কিন্তু একটা কথাই শেষপর্যন্ত বেরিয়ে আসে মুখ থেকে । - আপনার সেই রাতটার কথা মনে আছে ? দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ শুনে আমরা তো ভয় পেয়ে গেছি । অত রাত্তিরে এতটা কড়া - নাড়া ! বাবার নাম করে কারা যেন ডাকছেন সমানে । শীতের রাত । এমনিতেই কুঁকড়ে আছি । ওই ডাকে আরো যেন শীত বাড়ছে । বাবা গিয়ে দরজা খুলে দিলেন । আমিও আর শুয়ে থাকতে পারলাম না । উঠে গিয়ে দেখি আপনি আর বড়োমামা কাকার খোঁজে এসেছেন । কাকা সকালবেলায় সেই যে অফিস গেছেন আর বাড়ি ফেরেননি । আপনারা ভেবেছিলেন কাকা বোধহয় আমাদের কাছে আছেন । যখন শুনলেন তিনি আসেননি তখন দুজনে খুব হতাশ হয়ে ফিরে গেলেন । শীতের মধ্যরাতে আপনারা দুভাই হতাশ হয়ে শেষে ফিরে যাচ্ছেন এ দৃশ্য আমার মনে আঁকা আছে । বড়োমামাও তো গত হয়েছেন, তাই না ? - হ্যাঁ, দাদা এমনিতে খুব ভালো ছিলেন । নিজের মতো করে কাজকর্ম করছিলেন । কাজকর্ম মানে, একাই একটা অভিধানের কাজে হাত দিয়েছিলেন । অভিধানের কাজ মানে কতখানি পরিশ্রমের কাজ তা তো বুঝতেই পারিস । খুব সকালে উঠে বসে যেতেন কাজে । বাংলা থেকে বাংলা । খুব বেশি এগোতে পারেননি । তার আগেই ডাক এসে গেল । ডাক আসবেই । সেটা বড়ো কথা নয় । বড়ো কথা হলো, শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত বুক চিতিয়ে কাজ করে যাওয়া । হ্যাঁ, বুক চিতিয়ে । মিনমিনে হলে চলবে না কিন্তু ভাগ্নে । মনে থাকবে তো ? নলিনীকান্ত একটু ঝুঁকে ধীরেন্দ্রর মেরুদন্ডে হাত রাখেন । - এ জায়গাটা একটু বেঁকে আছে । তাতে চিন্তার কিছু নেই । ঠিক হয়ে যাবে । সময় করে একবার আমার আশ্রমে আসিস । তোমার জায়গাটা খারাপ লাগবে না । সত্পথে যেটুকু সঞ্চয় করেছিলাম সব ঢেলে সস্তায় অনেকটা জমি কিনে নিয়েছিলাম । ওখান থেকে বর্ডার বেশি দূরে নয় । আর বর্ডার পেরোলে আমাদের দেশে পৌঁছোতে আর কতক্ষণ লাগে । তুমি কি জানো তোমার বাবা, মানে হিমাংশুদা খুব ভালো ফুটবল খেলতে পারতেন ? জানো না ? জেনে রাখো, এ-গ্রাম সে-গ্রাম থেকে তাঁর দাক আসত । আমি তখন খুব ছোট । আবছা মনে আছে তিনি আমাদের গ্রামে খেলতে এসে গোল দিয়েছিলেন । তুমি কিন্তু তাঁর স্বাস্থ্যের কিছুই পাওনি । যা বলছিলাম, আশ্রমের চারিদিকে চাষের জমি । একবার ওখানে পৌঁছোলে তোদের এই মামাকে আর চিনতে পারবি না । তখন আর ভদ্রলোক থাকি না । পোশাক আশাক ছেড়ে গামছা পরে চাষ করতে নেমে যাই । একটু গুনগুন করে উঠলেন । - মন তুমি কৃষিকাজ জানো না । সত্যিই আবাদ করলে সোনা ফলে রে । তিনি যতই কথা বলুন দূরের দিগন্তের সঙ্গে তাঁর চোখের সম্বন্ধ এক মুহূর্তের জন্যও বিচ্ছিন্ন হচ্ছে না । - একবার সময় করে আমার আশ্রমে চলে এসো । মেরুদন্ডের ওই গোলমালটা আমি ঠিক করে দেব । শ্রাদ্ধবাসর থেকে একটু দূরে কোনো এক ঘরের কোনো এক কোণে বসে ধীরেন্দ্র জানতে পারল নলিনীকান্তর পঞ্চমুন্ডীর আসনের কথা । সেখানে বসে তিনি মানবহিতার্থে যজ্ঞ করেন । সেই যজ্ঞাগ্নিও শেষে হয়ে ওঠে মানুষসমান । তিনি কথা দিলেন ধীরেন্দ্র কখনো গেলে তাঁর ঘৃতলিপ্ত হস্ত যজ্ঞের আগুনে সেঁকে নিয়ে সেই হাত কয়েকবার রাখাবেন তার সেই মেরুদন্ডে যা সৃষ্টি করছে বাধার । কথা বলা এবং কথা দেওয়ার পর্ব মনে হয়েছিল দীর্ঘস্থায়ী হবে । কিন্তু হতে পারল না তা । নীলিমা মামার হাতে জোর করে শরবতের পাত্র তুলে দিয়ে সরে গেলে নলিনীকান্ত তা শেষে হস্তাতরিত করেন । - এটা তুমি খেয়ে নাও । এই পাগলিকে বোঝাতে পারি না যে আমি যা খুশি তাই করতে পারব না । চলি । আমার অনেক কাজ পড়ে আছে । আমি দু-তিনদিন এখানে আছি । ওকে বলিস পরশুদিন অর্থাৎ নিয়মভঙ্গের দিন এসে মাছভাত খেয়ে যাব । তোমার সঙ্গে সেদিনও আমার দেখা হবে । যতটা মায়ায় জড়িয়ে কথা বলছিলেন ঠিক ততটাই মুক্তভাবে চলে গেলেন নলিনীকান্ত তাঁর আঞ্চলিক বাসায় । বহুবছর আগে ওই বাসাতেই প্রেমাংশুবাবু যে বউ আনতে গিয়েছিলেন শরবত হাতে তা মনে করার চেষ্টা করে ধীরেন্দ্র ।
শ্রাদ্ধের কাজকর্ম মিটে যাওয়ার পর বেশ একটা প্রতিষ্ঠিত বিকেলে যারা তখনো চলে যায়নি, এক্ষুনি দৌড়োনোর খুব একটা তাড়া নেই যাদের, তাদের নীলিমা নিয়ে এল সেই ঘরে যেখানে যিনি সদ্য:প্রয়াত তাঁকে স্মরণ করা হয়েছে নানা মন্ত্রোচ্চারণের মাধ্যমে, অনিরুদ্ধের নানারকম সক্রিয়তায় । ঘর ইতোমধ্যে ধুয়েমুছে পরিষ্কার করা হয়েছে । নতুন করে জ্বালানো হয়েছে ধূপ সেই প্রতিকৃতির সামনে যা নতুন করে মাল্যবান । মেঝেতে পাতা হয়েছে কোথাও মাদুর, কোথাও বা শতরঞ্চি । এতে মেঝে যে পুরোপুরি আবরিত হয়েছে তা সত্যের খাতিরে বলা যাবে না । মাদুর ও শতরঞ্চি দিয়ে ঘেরা যে খালি জায়গাটা সেখানে একটা কেন্দ্রের ভাব এসে গেছে । নীলিম সেখানে পেতে দিল তার মায়ের হাতে গড়া আসন । - দাদা, আমার সঙ্গে একটু আসবে ? ধীরেন্দ্র নীলিমাকে অনুসর করে । তপতীর ঘরে তার ছবির নীচে তার হারমনিয়ামের বাক্স থেকে হারমনিয়াম বের করে এনে নীলিমা তার হাতে এক প্রান্তের দায়িত্ব তুলে দেয় । দুজন দুদিক ধরায় ওজন বলে আর কিছু থাকে না তেমন । আসনের সামনে রাখা হলো সুরযন্ত্র । সবাই আসন আর যন্ত্রকে ঘিরে গোল হয়ে বসে পড়লেও বুঝতে পারছে না কে গান গাইবে । শেষে নেপথ্য থেকে প্রকাশিত হতে থাকে এক ভাবিনী । নীলিমার হাত তার হাতের মধ্যে । শাড়ির রঙের সঙ্গে গাত্রবর্নের সমন্বয় সাধিত হওয়ায় তাকেই মনে হচ্ছে প্রকৃত নীলিমা । তাকে আসনে বসিয়ে সরব হয় প্রেমাংশুদুহিতা । - আজ এই শোকের দিনেও আমার আনন্দ হচ্ছে । কারণ আমি আমাদের মাঝখানে আজ সফিউন্নিসাকে পেয়েছি । সফি যখন আমার সঙ্গে কলেজে পড়ত তখন ও কতবার যে আমাদের বাড়িতে এসেছে । বাবা এবং মা দুজনেই সফিকে খুব ভালোবাসতেন । দুজনেই ওকে কাছে বসিয়ে কত যে গান শুনেছেন তার হিসেব নেই । পড়ার পাট চুকিয়ে ওকে আবার ওর দেশে ফিরে যেতে হয়েছে । একটা বিশেষ কাজে এখানে এসে ও বাবার কথা জানতে পারে । শত কাজের মধ্যেও খবর পেয়েই ছুটে এসেছে । আজ আমাদের দিন শেষ হোক সফির গান দিয়ে । আর সফি হারমনিয়াম টেনে নেওয়ার আগে কেবল একটা কথাই প্রকাশ করল । - আমি যে গানটা দিয়ে শুরু করছি, তা কেন জানি না মেসোমশাই আমার গলায় শুনতে চাইতেন, আমাকে বসিয়ে শুনতে চাইতেন, যখন তখন । - আমি তোমার সঙ্গে বেঁধেছি আমার প্রাণ # সুরের বাঁধনে-/ তুমি জান না, আমি তোমারে পেয়েছি # অজানা সাধনে ॥ অজানা সাধনেতে এসে সফি নিজেকে শুধু প্রমাণ করল না, সেইসঙ্গে প্রমাণ করল ধীরেন্দ্রর সেদিনের ভুল । যে ভুল প্রতিমা বা রেবা কেউই এগিয়ে এসে দেখিয়ে দিতে পারেনি শেষ্পর্যন্ত, তা সংশোধন করে দিল সফি । শ্রাদ্ধবাসরের সেই পরিমন্ডলে ধীরেন্দ্র বুঝতে পারল নীলিমা তার মায়ের হাতে গড়া আসনের ওপর যাকে এনে বসিয়ে দিয়েছে তার মাধ্যমেই ছড়িয়ে পড়ছে সেই শ্রদ্ধা যা সারাদিনে অনাগত ছিল । প্রতিমাকে নিয়ে বাসে ওঠার আগে সে গায়িকাকে শুধু একটা প্রশ্নের মুখোমুখি করে । - তোমার দেহ কোথায় ? যে দিদি কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে মন্দিরে এসে বসতেন এই প্রশ্ন শুনে তিনি হয়তো বকতেন কিঞ্চিৎ । - আমার দেশ কোথায় সেটাই তো আমি খুঁজে বেড়াচ্ছি এত দিন ধরে । কিন্তু প্রশ্নের উত্তরে সফি তাকে এমন কোনো পরিপ্রশ্নের চাপে ফেলল না যাতে সে নির্বাক হয়ে যেতে পারে হঠাৎ । সে বরং একটু হেসে একটু সময় নিয়ে একটু বন্ধুর দিকে তাকিয়ে যে নামটি উচ্চারণ করল সেখানে হিমাংশু এবং প্রেমাংশু দুজনেই ভূমিষ্ঠ হয়েছিলেন । একই দেশ, শুধু গ্রাম আলাদা । সফি সেখানেই ফিরে যাচ্ছে আগামীকাল । বাড়ি ফিরতে ফিরতে ধীরেন্দ্র বুঝতে পারল এমন এক স্নিগ্ধতা অজান্তে অর্জিত হয়েছে যার দৌলতে অন্তত আজকের রাতটা মৃন্ময় হয়ে উঠবে ।
নিয়মভঙ্গের দিন নলিনীকান্ত এসে মাছভাত খেয়েছেন । খাওয়াদাওয়ার পর সবাই যখন একটু শিথিল হতে চাইছে । তখন তাঁর হাতছনি ধীরেন্দ্রকে এগিয়ে যেতে সাহায্য করল । - আশ্রমে যখন পারবে যাবে । এখন একবার মামারবাড়ি যাবি নাকি ? চল্ তবে আমার সঙ্গে । কখনো `তুমি' কখনো `তুই', সম্বোধনের এই বৈচিত্র্য তাকে খানিকটা প্রাণিতই করছে । সে আর না করতে পারল না । প্রতিমাও সঙ্গী হলো । নীলিমাদের এই বাড়ি থেকে তাদের মামাবাড়ি হেঁটে যাওয়া যায় স্বচ্ছন্দে । এই স্বাচ্ছন্দ্যের কথা মাথায় রেখেছিলেন প্রেমাংশুবাবু নতুন বাসা বাঁধবার সময়, এমন কথা বললে খুব বেশি ঝুঁকি নেওয়া হয় না । নীলিমার সঙ্গে বেশ কয়েকবার হেঁটে যাওয়ার অভিজ্ঞতা আছে ধীরেন্দ্রর । নীলিমার দাদুকে ঢোকার মুখেই দেখা যেত । আরাম কেদারায় বসে আছেন । পাশে হুঁকোর সরঞ্জাম । সাধারণত তামাক সেবনের ফাঁকে ফাঁকে বলতে চাইতেন কথা । ফলে জিজ্ঞাসার মধ্যে বেশ একটা সজলতা ফুটে উঠত । তিনি বহুদিন শিক্ষকতা করেছেন । ফতুয়া পরে বসে থাকতেন অবসরজীবনে । তিনি যেখানে বসে থাকতেন সেটা ছিল প্রাঙ্গণ । ঢুকতে গিয়ে সেই প্রাঙ্গণ আর খুঁজে পেল না ধীরেন্দ্র । এই প্রাঙ্গণকে ঘিরে রেখেছিল কয়েকটি মাটির ঘর । হ্যাঁ, বাসরাস্তার পাশে সে প্রথম মাটির ঘর দেখেছিল । কোনো এক মাটির ঘরে কাকিমার সঙ্গে তাঁর বাপেরবাড়ি এসে সে আর সামলাতে না পেরে মলত্যাগ করে কেঁদে ফেলেছিল সৃষ্টির প্রথম যুগের কোনো এক সকালবেলায় । সবাই সেই কান্না দেখে সেই শিশুকে ঘিরে হেসেছিল । শেষে কোনো এক মাসির হাত ধরে সে জলক্ষেত্রের দিকে চলে যায় । আজ মধ্যবয়সে সেই স্মৃতিক্ষেত্রে পৌঁছে আমূল এবং অনিবার্য রূপান্তরের মুখোমুখি হয়ে সে নিজেকে ঠিক সামলে নেয় । প্রাঙ্গণ প্রসব করেছে কয়েকটি ঘর । কোথাও এক চিলতে মাটির গন্ধ নেই । এক ঘর থেকে আর এক ঘরে যাওয়ার যে পথ সেখানেই ফুটে উঠেছে দারুসোপান । নলিনীকান্ত ওপরে উঠে গিয়ে ওপরে ওঠার আমন্ত্রণ জানান । - সাবধানে উঠে এসো । প্রতিমা, সাবধানে । প্রতিমা অনায়াসে উঠে যায় । কিন্তু ধীরেন্দ্রকে উঠতে আয়াস করতে হয় কিছুটা । কাঠের সিঁড়িতে পা রাখতে রাখতে হাত রাখতেও হয় কখনো কখনো । নলিনীকান্ত তাঁর ঘরে ঢুকে গেছেন । সেখান থেকেই বলে উঠছেন - আয়, তোরা ঘরে আয় । প্রতিমা ঘরে ঢোকার আগে নীচের দিকে তাকায় এবং তার মুখ ভরে যায় শব্দহীন হাসিতে । ইতোমধ্যে জামাকাপড় যথাস্থানে ছাড়তে শুরু করে দিয়েছেন নলিনীকান্ত । সব ছেড়ে শুধু একটা লাল বস্ত্র লুঙির মতো করে পরে নিয়ে মেঝেতে বসে পড়লেন তিনি । প্রতিমা আগেই আসন করে বসে পড়েছে ষোড়শীর সামনে । ষোড়শীর আর এক নাম রাজরজেশ্বরী । আরো একটা নাম আছে, শ্রীবিদ্যা । ইনিই তো শ্রী দান করেন । বর্ণ রক্তের মতো, নয়ন তিনটি, চারটি ভুজ । তাঁর মুখে সব সময় লেগে আছে মধুর হাসি । বইয়ে যে হাসির কথা লেখা আছে, ঘরের মূর্তিতে সেই হাসি খুঁজে না পেয়ে সে জীবনের মাঝখানে যেন ত খুঁজে পায় শেষে । পরশুদিন যে অজানা সাধনের সুর সংশোধন করে দিয়েছিল আপনমনে গাইতে গাইতে, মিলিয়ে যায়নি কখনো হাসির সেই মাধুর্য তার মুখ থেকে । জীবনের মধ্যে ডুব দিয়ে ধীরেন্দ্র এসে দাঁড়ায় নলিনীকান্তের বইয়ের আলমারির সামনে । -আপনার তো অনেক রকমের বই আছে দেখছি । নলিনীকান্ত হাসেন । - হ্যাঁ, এখানে অনেক রকমের বই । আর আশ্রমে অনেক বই । তবে রকমভেদ কম । বৈচিত্র্যকে পেরিয়ে তবেই তো সেই চিত্রে পৌঁছোনো । সময় করে এসো একবার । জায়গাটা খারাপ লাগবে না । প্রতিমা, তোমাকে বলে রাখি ও যদি নাও আসে তোমার আসতে কিন্তু বাধা নেই । নীলিমারা হঠাৎ হঠাৎ চলে যায় । তুমি ওদের সঙ্গে একটু যোগাযোগ রেখো । তাহলেই হবে । যা দেবী সর্বভূতেষু বুদ্ধিরূপেণ সংস্থিতা ।/নমস্তস্যৈ ॥ নমস্তস্যৈ ॥ নমস্তস্যৈ নমো নম: ॥ নলিনীকান্তের উচ্চারণে ঘ্র ভরে উঠেছে । তিনি তোমার মধ্যে বুদ্ধিরূপেও আছেন কিন্তু । বইপত্র ঘাঁটতে ঘাঁটতে বইয়ের মধ্য থেকেই ঝরে পড়তে দেখে একটি সর্বভারতীয় দৈনিকের কর্তিত অংশ । তাতে একটা প্রতিবেদন বেরিয়েছে । সম্প্রতি একটি আলোচনাচক্র অনুষ্ঠিত হয়েছে বাঙ্গালোরে । ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স-এর অঙ্গনে এই যে সভা হলো তার বিষয় ছিল । `বিজ্ঞান ও আধ্যাত্মিক অন্বেষ' । সেখানে যোগ দিয়েছিলেন রজার পেনরোজের মতো বিজ্ঞানসাধক । তিনি চেতনার অনন্ত সম্ভাবনার কথা স্বীকার করে নিয়েছেন । এও জানিয়েছেন যে, চৈতন্য সর্বত্র বিরাজমান এই যে মতবাদ, এর সঙ্গে কোয়ান্টাম ফিল্ডসের গবেষনার ফসল জুড়ে দিলে শেষে ব্রহ্মরই কাছে এগিয়ে যাওয়া হয়, তার থেকে সরে যাওয়ার পরিবর্তে । প্রতিবেদন পড়তে পড়তে খোলা জানলা দিয়ে ধীরেন্দ্র সেই আকাশের দিকে তাকায় । `আকাশ ছড়ায়ে আছে নীল হয়ে আকাশে আকাশে ।' কাউকে যেন বোঝানো যায় না কোনোদিনও, এমন এক সংবেদনশীলতার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার জন্য উন্মুখ হয়ে আছে ভূমন্ডল । যে কাগজটি পাতার মতো ঝরে পড়েছিল তাকে মনে হতে থাকে ভূর্জপত্র, কিংবা প্যাপিরাস, অথবা সপ্তপর্নীর অংশবিশেষ । ধোঁয়াধুলোর পরিমন্ডলে এটি নষ্ট হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থেকে তার পুনর্বাসনের কাজ আর ফেলে রাখার সাহস হয় না । যে বই থেকে সেটি ঝরে পড়েছিল সেই বইয়ের অন্তরালে তা আবার অতি যত্নে রেখে দিতে পেরে সত্যিই স্বস্তি পায় সে ।
॥ ছয় ॥
হ্যাঁ, নীলিমার সঙ্গে সমানে যোগাযোগ রেখে গেছে প্রতিমা । তার ফলও মিলেছে । নীলিমার স্বামীর কাছ থেকে যে প্রাণায়াম শিখেছিল তারই গাড়িতে করে তারা সবাই মিলে এক সপ্তাহের জন্য গেছে নলিনীকান্তের সেই আশ্রমে যেখান থেকে সীমান্ত খুব দূরে নয় । যাওয়ার আগে প্রতিমা একটু দ্বিধায় পড়েছিল, একটু সংকোচ হয়েছিল তার । একা একা সব দিক সামলে নিতে পারবে তো ধীরেন্দ্র ? এমন কোনো পেরে ওঠার প্রমাণ যে তার হাতের কাছে নেই । ধীরেন্দ্র স্বয়ং এগিয়ে এসে সব দ্বিধা সব সংকোচ দূরে ঠেলে দেয় । - এক সপ্তাহের মামলা মোটে । হাসতে হাসতে কাটিয়ে দেব । কাল পূর্নিমা ছিল । ভালো দিন । কাল দীক্ষা হয়ে গেছে প্রতিমার । ফোনে ভেসে আসা তার গলায় ছিল যথেষ্ট প্রাণ, যথেষ্ট উজ্জ্বলতা । - ভাবতেই পারিনি, হঠাৎ হয়ে গেল । গিয়ে সব কথা বলব । সব ছবি দেখাব । তার কথা অনুযায়ী নীলিমারা হোমানলের ছবিও তুলেছে । সেই ছবিতে সেই যজ্ঞাগ্নির মাপ পাওয়া যাবে যা উচ্চতায় মানুষসমান । সে আরো জানিয়েছে, দীক্ষার কাজ হয়েছে কামাখ্যামতে, রাজরাজেশ্বরীকে স্মরণ করে । নলিনীকান্ত প্রতিমার কান হোমাগ্নির তাপে অভিষিক্ত করেছেন । তারপর তাকে মন্ত্র দিয়ে আবদ্ধ করে দিয়েছেন । মন্ত্র দেওয়া হয়েছে দুকানেই । তার নাভিও অভিষিক্ত করা হয়েছে ঘৃতের সাহায্যে । বিরাট খাঁড়া ছোয়ানো হয়েছে তার মাথায়, বুকে এবং নাভিতে । দীক্ষা-শেষে কী করে প্রণাম করতে হয় তা স্বাভাবিকভাবেই জানা ছিল না তার । প্রনামের শিক্ষাও সে লাভ করেছে হাতেকলমে । প্রতিমা প্রনাম করার আগে চুল খুলে নিয়েছিল এবং পাদস্পর্শ করেছিল দুহাত দিয়ে । - এত কথা তো ফোনে বলা যায় না । গিয়ে সব বলব । জায়গাটা খুব ভালো লাগছে । তুমি এলে তোমারও ভালো লাগত । তোমাদের দেশ নাকি এখান থেকে খুব দূরে নয় । এখন রাখছি ।
আজ দুপুর থেকেই ধীরেন্দ্র কেমন এক অস্থিরতা বোধ করছে । কাল রাতে যখন বাড়ি ফেরে, যখন বিশেষ কোনো কাজ সেরে শেষে ভূগর্ভ থেকে উঠে আসে, তখন পথের ওপর একটা দোতলা বাড়ির একতলার দরজা খোলা ছিল পুরোপুরি । তাদের ছাত্রবস্থায় এই ঘর খোলা থাকলে লোক ধরত না । এই ঘরের ভেতরে যিনি পারিবারিক হয়ে এবং পরিবৃত হয়েও বসে থাকতেন তাঁর ইংরেজির মানে বই কী যে চলত চারিদিকে ! দিগন্ত থেকে দিগন্তে সেই বই হাতে করে ঘুরত পরীক্ষার্থীরা । কাল সেই ঘরের সামনে দিয়ে যেতে যেতে অনুমান করতে পারল, ঠিক তার নীচ দিয়ে যে রেল ছুটছে, তার অপেক্ষায় বসে থাকা যাত্রীরা উঁচুতে ঝোলানো বাক্সের মধ্যে নির্বাক ছবির মাঝখানে শুনতে পাচ্ছে প্রচারচিত্রের ঘোষনা । - কেউ গাড়ি আসার আগে জীবনরেখা পার হবেন না । যখন বাংলায় বলা হচ্ছে তখন লাইফলাইনের মানে করা হচ্ছে জীবনরেখা । কিন্তু সেই খোলা ঘরে এক বৃদ্ধা মাথায় হাত দিয়ে একেবারে একা হয়ে পথের দিকে তাকিয়ে বসে আছেন । তাঁর ঘরের খুব কাছেই নতুন ঘর হয়েছে । সেখানে সারাদিন নতুন মডেলের কত যে গাড়ি এসে থামে । সুদর্শনা হওয়ার জন্য কত মানুষ যে ধাবিত হয় সেই ঘরের দিকে । কাল রাতে বাড়ি ফেরার সময় সেই ঘর বন্ধ হয়ে গিয়েছিল সারাদিনের বেচাকেনার পর । কিন্তু তার বাইরের বারান্দায় বসে কুদর্শন ভিখারি গলা ছেড়ে গাইছিল - ঘুম ভেঙেছে আর কি ঘুমাই যোগে যাগে জেগে আছি । এমনকী ফিরে যাচ্ছিল প্রসাদের সেই ছত্রে - যে দেশে রজনী নাই, সেই দেশের এক লোক পেয়েছি । আজ দুপুর থেকেই ধীরেন্দ্র যে অস্থিরতা বোধ করছে তার সূচনা কাল রাত থেকেই হয়েছিল বোধহয় । আজ দুপুরে হঠাৎ তার অলকেশের কথা মনে পড়ল । লালবাড়ির অলকেশ লালবাড়ি ছেড়ে কবে চলে গেছে । এ পাড়া ছেড়ে যাওয়ার পর আর দেখা হয়নি । যাদের পদবি ছিল ব্রহ্ম সেই তারকদের কথা মনে পড়ল । তারা দুই ভাই দুইদিক থেকে তাকে আক্রমণ করত । অলকেশের সাহায্যে সে বেরিয়ে আসত ঠিক । নিতু আর তারক যখন হাসত তখন তাকেও হাসাত হাসতে হাসতে । তারাও পাড়া ছেড়ে চলে গেছে যুগ যুগ আগে । আর দেখা হয়নি । পুলিশবাড়ির বাবু জড়িয়ে ধরে নতুন নতুন পায়রার কথা বলত । খুব আবেগের মুহুর্তে তোতলা হয়ে যেত । তার অসম্পূর্ন কথা সম্পূর্ন করার জন্য এগিয়ে আসতে হতো ধীরেন্দ্রকে । বাবুর খুড়তুতো বোন মালার গলা থেকে পঁচিশে বৈশাখে ঝরে পড়ত `নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ'। উপগ্রহ মারফত চোখের পলকে কোথায় পৌঁছে যাচ্ছে মানুষ । দেশে বসে দেখা যাচ্ছে সুদূরতম বিদেশের বানিজ্যমন্ত্রীর মঞ্চাবতরণ এক লহমায় । কিন্তু যারা পাড়া ছেড়ে পাড়ায় পাড়ায় হারিয়ে গেছে তাদের কাউকে আর দেখতে না পেয়ে কেমন এক অস্থিরতা বোধ করছে ধীরেন্দ্র । পাঁচ বছর আগে এই পৃথিবীতে তার অর্ধশতাব্দী পূর্ন হলে পাঁচজন একটি ঘরে তাকে ঘিরে ধরে তারই লেখার বিভিন্ন ছত্র পাঠ করেছিল । তেমন একটি ছত্রও কানে ভেসে আসছে এই দুপুরে । - আজ রাত প্রায় সাড়ে আটটায়/ তোমার মুখের মধ্যে আমার উপন্যাস/ প্রবেশ করল । মনে পড়ল এটা তার একটি কবিতার শেষ ছত্র । প্রেমাংশুবাবুর দাহকর্ম শেষ করে শ্মশান থেকে ফিরে এসে সেদিন রাতেই তাকে উচ্চারণ করতে হয়েছিল সেই কবিতার প্রথম ছত্র । - আজ রাত প্রায় সাড়ে আটটায়/ আমার উপন্যাসে তোমার মুখ/ প্রবেশ করল । যত সময় বাড়ে, যত দুপুর বিকেলে এবং বিকেল সন্ধের মধ্যে প্রবেশ করে, যত কে কার মধ্যে প্রবেশ করছে তা কিছুতেই আর বুঝে ওঠা যায় না, ততই ধীরেন্দ্রর অস্থিরতা বাড়তে থাকে ত্রক্রমান্বয়ে । শেষে রাত প্রায় সাড়ে আটটায় সে যে-ভবনের অন্তর্গত হয় তার কোনো এক প্রত্যঙ্গে বাস করে রেবা ।
- রেবা কোথায় ? এই প্রশ্ন যেখানে করা হয় সেই ঘরের দূরদর্শনের পর্দায় এমন কিছু হচ্ছে যা তার মা ও দাদাকে এবং সেইসঙ্গে কাজের ছেলেটিকেও প্রায় অনড় করে রেখেছে । তার মা হেসে শুধু ইশারা করলেন । সেই ইশারা সম্বল করে একটির পর একটি সিঁড়ি পেছনে ফেলে এমন এক উচচতায় এসে পৌঁছোয় ধীরেন্দ্র যেখান থেকে অনায়াসে দেখা যায় রেবাকে এবং বোঝাও যায় যে, সে কিছু খুঁজছে আপনমনে । -কী খুঁজছ ? - আর বলো না, চাবিটা কিছুতেই খুঁজে পাচ্ছি না । রেবা সব বুঝিয়ে বলে । অনেকদিন বাদে ছাদে বসে থাকতে থাকতে তার ছবি আঁকার ইচ্ছে হয় । একেবারে নতুন সুরে কিছু আঁকতে হবে । কোনো কারণ ছাড়াই নিজেকে এতটাই উদ্দীপিত মনে হয় যে, ছাদে আর বসে না থেকে সে সোজা চলে আসে তার চিত্রশালায় । এ বাড়ির অনেক ঘরেই তালা ঝোলে । সে সব তালার চাবি থাকে তার মায়ের কাছে । কিন্তু চিত্রশালার চাবি রেবা তার নিজের কাছেই রেখে দেয় চিরকাল । সেই চাবি দিয়েই সে দরজা খোলে । সবকিছু গুছিয়ে আঁকতেও বসে যায় প্রায় । হঠাৎ কাজের ছেলেটি নীচের থেকে চিত্কার করে ওঠে - দিদি, তোমার ফোন এসেছে । ধরো ওপরে । রেবা পড়িমরি করে ফোন ধরতে দৌড়োয়নি । সে কখনো চিত্রশালার ঘর খুলে রেখে এক চুলও নড়ে না । এটা তার চিরকালের অভ্যেস । দরজায় তালা লাগিয়ে তবেই সে ফোন ধরতে যায় । ফিরে এসে তালা খুলতে গিয়ে দেখে তার কাছে চাবি নেই । এদিক-ওদিক খুঁজছে । কিন্তু কোথাও পাচ্ছে না । - এতদিন বাদে আঁকতে গেলাম । তাও দেখ কত বাধা । বেদনার দাগ পড়েছে তার চোখে । সেই চোখের দিকে তাকিয়ে ধীরেন্দ্রর চোখে উদ্ভাসিত হয়ে উঠল কিছু । - আচ্ছা শোনো, আমার যতদূর জানা আছে তোমার ওই তালাটা টিপতালা । তুমি তাড়াতাড়িতে চাবি ভেতরে রেখে তালাটা টিপে বন্ধ করে বেরিয়ে আসনি তো ? তার কথায় রেবার সংবিৎ হয় । - তুমি ঠিক কথা বলেছ তো ! এই কান্ডটাই হয়েছে । চাবি রয়ে গেছে ভেতরে, আর আমি বাইরে খুঁজে মরছি । রেবা চোখ মেলে দেখে ধীরেন্দ্রকে । ডাক্তার তার মুখমন্ডল নষ্ট করতে পারেনি । যে দৃষ্ট হয় সে সেই মুখমন্ডলে খুঁজে পায় চিরঞ্জীব পার্থিবতা ।
মুহূর্তের মধ্যে কী করণীয় তা ঠিক করে ফেলেছে রেবা । সে ছাদ থেকে নিয়ে এসেছে হাতুড়ি । তালা ভাঙার পক্ষে এই হাতুড়ি বিশ্বাসযোগ্য । যার আঙুলে রঙ লেগে আছে সে সেই আঙুল দিয়েই হাতুড়ি জড়িয়ে নিয়ে তার মতো করে আঘাত করতে শুরু করে দেয় তালায় । এ দৃশ্য দাঁড়িয়ে দেখা যায় না বলে ধীরেন্দ্রকেও এগিয়ে আসতে হয় ।
- আমাকে দাও ।
- তুমি পারবে ?
- চেষ্টা করে দেখি ।
রেবা জেগে উঠেছে । এমনকী জেগে উঠেছে তার ত্বক । সেই সদ্যোজাত শিখার সংস্পর্শ থেকে হাতুড়ি তুলে নেয় ধীরেন্দ্র । যে এতদিন কেবল কলম ধরে এসেছে সে জানে না কী করে হাতুড়ি ধরতে হয় । তবু তার মতো করে সে ধরে এবং আঘাত করতে থাকে একের পর এক । রেবা ভয় পায় । - আঙুল বাঁচিয়ে, ধীরুদা, আঙুল বাঁচিয়ে । ধীরেন্দ্র জানে খুব বেশি সময় আর বাকি নেই । শুনতে পায় জানলার শিক ধরে দাঁড়িয়ে থাকা দোলনচাঁপার সেই আর্তনাদ । - কেন যামিনী না যেতে জাগালে না দাদাবাবু ?
কি ভাবে লেখা পাঠানো যাবে এবং লেখা প্রকাশ-সংক্রান্ত কয়েকটি নিয়ম
(১) লেখা, ছবি অপ্রকাশিত (এর মধ্যে আন্তর্জাল [পত্রিকা, ব্লগ, ফেসবুক ইত্যাদিও ধরতে হবে]) ও মৌলিক হওয়া চাই।
(২) ই-মেইল ঠিকানাঃ parabaas@parabaas.com
(৩) লেখার মধ্যেই আপনার ই-মেইল ঠিকানা, সাধারণ ডাক-ঠিকানা, ফোন নম্বর দেবেন - তাহলে লেখকের সঙ্গে যোগাযোগ করতে সুবিধা হয়।
(৪) কবিতা পাঠালে এক সঙ্গে অন্তত তিনটি কবিতা পাঠালে ভালো হয়।
(৫) ইউনিকোড হরফে এখন পরবাস প্রকাশিত হচ্ছে - সেই মাধ্যমে লেখা পেলে আমাদের সুবিধা হয়, কিন্তু অন্য মাধ্যমে, যথা "বাংলিশ", অন্য ফন্ট-এ, বা হাতে লেখা হলেও চলবে। সাধারণ ডাক-এ পাঠালে অবশ্যই কপি রেখে পাঠাবেন, কারণ লেখা/ছবি ফেরত পাঠানো সম্ভব নয়।
(৬) 'পরবাস' বা 'ওয়েবশিল্প'-সংক্রান্ত পরামর্শ ও সহযোগিতাও আমাদের কাম্য।
(৭) পরবাসে প্রকাশিত লেখা আন্তর্জাল ও অন্য বৈদ্যুতিন মাধ্যমে প্রকাশ করা যাবে না। পরবাসের পাতার লিংক দেয়া যাবে। পরবাসে প্রকাশের ১২০ দিন পরে অন্য কাগুজে মাধ্যমে প্রকাশিত হতে পারে কিন্তু সেখানে পরবাসে পূর্ব-প্রকাশনের উল্লেখ রাখা বাঞ্ছনীয় এবং সঙ্গত।
(৮) লেখক এই নিয়মগুলি মান্য করছেন বলে গণ্য করা হবে। এর কোনোরকম পরিবর্তন চাইলে অবশ্যই আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করবেন।
সাধারণ ডাকযোগে লেখা, ছবি, বই ইত্যাদি পাঠানোর ঠিকানার জন্যে ই-মেইলে parabaas@parabaas.com অথবা ফোন-এ (+91)8609169717-এ যোগাযোগ করুন।
আমরা আপ্রাণ চেষ্টা করি সব লেখার লেখকদের উত্তর দেবার, কিন্তু অনেক সময় অনিবার্য কারণবশতঃ তা সম্ভব না হতেও পারে। সেই জন্য লেখা পাঠানোর ৬ মাসের মধ্যে উত্তর না পেলে ধরে নিতে হবে যে লেখাটি মনোনীত হয়নি।
আপনাদের সবাইকে অনুরোধ করছি আপনাদের সৃষ্টিশীল রচনা পাঠাতে, এবং সে-জন্য আগাম ধন্যবাদ।