• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৩২ | জানুয়ারি ২০০৪ | প্রবন্ধ
    Share
  • রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৮৮-১৯৬১): এক বিস্মৃত ব্যক্তিত্ত্ব : অলকা দত্ত


    ॥ প্রাক্কথন ॥

    রবীন্দ্রনাথের পুত্র রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর সম্বন্ধে আমরা হয়ত অল্পই জানতে চেয়েছি । পিতার প্রতিভার দ্বারা আচ্ছন্ন মানুষটি আলোর পিছনেই থেকে গেছেন চিরদিন । পারিবারিক বন্ধুত্বের সূত্রে এই বিশিষ্ট মানুষটির কিছু কথা জানবার সৌভাগ্য আমার হয়েছে । তিনি ছিলেন একজন অশেষ গুণসম্পন্ন মানুষ । জীবনভর বিচিত্রধরনের কাজ করে গেছেন সুনিপুণ দক্ষতায়, কিন্তু পিতার আকাশব্যাপী প্রতিভার জন্যই হোক্‌ বা নিজের নেপথ্যচারী স্বভাবের জন্যই হোক,- সব কাজই করেছেন নীরবে লোকচক্ষুর আড়ালে । সেই জন্যই রথীন্দ্রনাথ জনমানসে অজানা রয়ে গেছেন - তাঁর পূর্ণ পরিচয় অল্প মানুষই পেয়েছেন ।

    নিজের জীবনচর্যায় রথীন্দ্রনাথ একদিকে পিতার একনিষ্ঠ অনুগামী -- রবীন্দ্রনাথের ব্যক্তিগত জীবনের ও বৃহৎ কর্মকাণ্ডের প্রায় সব ব্যবহারিক দিকের দায়িত্বই ছিল তাঁর । অন্যদিকে তাঁর নিজের অনন্য প্রতিভার চর্চাও চলেছে ত্রক্রমান্বয়ে, যার প্রকাশ নিভৃত অথচ স্ফূরণ নিরঙ্কুশ ।


    ॥ জন্ম ও প্রাথমিক শিক্ষা ॥

    রবীন্দ্রনাথের পাঁচটি সন্তানের মধ্যে রথীন্দ্রনাথ দ্বিতীয় । তাঁর জন্ম জোড়াসাঁকোয়- ১৮৮৮ সালের ২৭শে নভেম্বর । সে সময় মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ জীবিত থাকায় তিনিই পৌত্রের নামকরণ করেন । জোড়াসাঁকো বাড়িতে পরিবারের ছেলে-মেয়েদের নিয়ে যে ইস্কুল তৈরি হয়েছিল সেখানেই রথীন্দ্রনাথের প্রথম শিক্ষা শুরু । এর কিছু পরে জোড়াসাঁকোর বৃহৎ সংসার ছেড়ে তাঁর পরিবার নিয়ে রবীন্দ্রনাথ যখন শিলাইদহে গিয়ে বসবাস শুরু করেন, তখন সেই অবারিত প্রকৃতির কোলে স্বাধীনভাবে তাঁর প্রকৃত শিক্ষা শুরু হয় । ইস্কুল সম্বন্ধে রবীন্দ্রনাথের তিক্ত অভিজ্ঞতা থাকায় পুত্রকন্যাদের বাড়িতেই শিক্ষাদানের ব্যবস্থা করেন । ইংরেজি পড়াতেন লরেন্স সাহেব, সংস্কৃতের শিক্ষক ছিলেন শিবধন বিদ্যার্ণব ও তিনি নিজে পড়াতেন বাংলা । রবীন্দ্রনাথের শিক্ষাবিষয়ে ভাবনাচিন্তার শুরু বলতে গেলে পুত্র রথীন্দ্রনাথকে কেন্দ্র করেই ।
    ঈঠশংবঞ স্‌ংঞচ্ধরু -এ পড়ানো তিনি পুত্রকন্যাদের নিয়েই অভ্যাস করেছিলেন যা শীঘ্র ও সহজে ভাষা শেখানোর পক্ষে খুবই কার্যকরী হয়েছিল । কিছুদিন পরেই রবীন্দ্রনাথ উপলব্ধি করেছিলেন যে নিজগৃহের সীমানার মধ্যে যে শিক্ষালাভ তাতেও কিছু ঘাটতি থেকে যাবার সম্ভাবনা থাকে । তাই সমবয়সীদের সঙ্গে একত্রে শিক্ষালাভের যে সুফল তার ভাবনাচিন্তার ফলে শান্তিনিকেতন বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন । পুত্র রথীন্দ্রনাথকে কেন্দ্র করেই ব্রহ্মচর্য বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হল ১৯০১ খৃষ্টাব্দে । এই বিদ্যালয়ের প্রথম ছাত্রদের মধ্যে রথীন্দ্রনাথ অন্যতম । রবীন্দ্রনাথ প্রবর্তিত শিক্ষাধারার প্রধান উদ্দেশ্য মনকে সরস ও বহুমুখী করা । পড়ার সঙ্গে সঙ্গে হাতেকলমে কাজ করা ও সুন্দর শোভন রুচি তৈরি করা । এর সঙ্গে গান-বাজনা, ছবি আঁকা, অভিনয় তো ছিলই । প্রকৃতির আবহাওয়ায় এমন একটি সর্বাঙ্গসুন্দর শিক্ষাব্যবস্থায় রথীন্দ্রনাথের পড়াশোনা এগোতে থাকল । বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর রবীন্দ্রনাথ শিলাইদহ অঞ্চলে পল্লী পুনর্গঠনের কাজ শুরু করলেন ।


    ॥ শিলাইদহ অঞ্চলে পল্লী পুনর্গঠন ও আমেরিকায় কৃষিবিজ্ঞান শিক্ষা ॥


    বিজ্ঞান সচেতন কবি পুত্রকে পল্লীসংস্কারের কাজের জন্য গড়ে তুলতে চাইলেন । ইস্কুল ও কলেজের পাঠ শেষ করে ১৯০৬ সালে রথীন্দ্রনাথ ও তাঁর বন্ধুপুত্র সন্তোষ মজুমদারকে রবীন্দ্রনাথ আমেরিকায় ইলিনয় বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠালেন কৃষিবিজ্ঞান শিক্ষার জন্য । তত্কালীন বাঙালি সমাজে উচ্চশিক্ষার পরাকাষ্ঠা ছিল বিলাতে ব্যারিস্টারি পড়া । আমেরিকায় গিয়ে প্রযুক্তি পাঠের হাল আমলের ধারার প্রবর্তন রথীন্দ্রনাথের মধ্যে দিয়েই । মনে মনে রবীন্দ্রনাথ যে স্বদেশী সমাজের পরিকল্পনা করছিলেন, তারই পরিপ্রেক্ষিতে তাঁর ভাবনা ছিল যে রথীন্দ্রনাথ ও সন্তোষ ফিরে এসে গ্রামাঞ্চলে চাষিদের উন্নত প্রণালীতে চাষবাসের শিক্ষা দেবেন । ইলিনয় বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা শেষ করে ১৯০৯ সালে রথীন্দ্রনাথ দেশে ফিরে এলেন । শিলাইদহে একটি কৃষি-খামারের পত্তন করলেন । উন্নত ধরনের লাঙল এবং নানান যন্ত্রপাতি প্রস্তুত করা হল । মৃত্‌-বিজ্ঞানে তাঁর ব্যুত্পত্তি কাজে লাগিয়ে মাটির গুণাগুণ পরীক্ষার জন্য একটি ল্যাবরেটরিও গড়ে তোলেন । পতিসর ও কালীগ্রাম পরগনাতেও তাঁর কাজের ক্ষেত্র বিস্তৃত ছিল । নিজে ট্রাক্টর চালিয়ে প্রজাদের জমি চাষ করতে শিখিয়েছিলেন । শিলাইদহে খামারের কাজ ছাড়াও চাষিদের মধ্যে আলু, টমেটো এবং আখের চাষের সূচনা করেন । পিতার গ্রামোন্নয়নের স্বপ্নকে পুত্র রথীন্দ্রনাথ বাস্তব রূপ দিলেন ।




    ॥ বিচিত্রা সভা গঠনে ভূমিকা ॥


    শান্ত নীরব মানুষটিকে বাইরে থেকে দেখলে বোঝা যেত না কত বিচিত্র কর্মকাণ্ডে তিনি ব্যাপৃত । আমেরিকা থেকে যখন ফিরলেন তখন জোড়াসাঁকো বাড়ি শিল্পে সাহিত্যে নতুন নতুন সৃষ্টিতে মুখর । রবীন্দ্রনাথের কাব্য ও সঙ্গীতের মাধুর্য প্রসারিত হচ্ছে রসজ্ঞ মানুষের মাঝে । রবীন্দ্রনাথ জোড়াসাঁকোয় গড়ে তুললেন `বিচিত্রা' ক্লাব । অবনীন্দ্রনাথ, গগনেন্দ্রনাথ, সত্যেন দত্ত, সুকুমার রায়, প্রমথ চৌধুরী, যতীন বাগচী, চারুচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় প্রভৃতি শিল্পী সাহিত্যিকরা যোগদান করলেন । রবীন্দ্রনাথ তাঁর বহু গল্প প্রবন্ধ এই `বিচিত্রা'য় প্রথম পড়ে শুনিয়েছেন । এখানে সাহিত্য আসর ছাড়াও, সংগীতের জলসা, অভিনয় চিত্রকলা ইত্যাদির চর্চাও হত । সৌম্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর `যাত্রী' গ্রন্থে এ-প্রসঙ্গে বলেছেন - "রসবিদ রসস্রষ্টাদের আসর তখন একটিও ছিলনা .... রবীন্দ্রনাথের নিজের হাতে রসের পর্দাবাঁধা `বিচিত্রা' কলকাতার রসিক সমাজে রসের রুচি সৃষ্টি করতে যে কী অসামান্য কাজ করেছে তা বলে শেষ করা যায়না "। রবীন্দ্রনাথের এ হেন প্রচেষ্টার প্রধান সহায় ছিলেন রথীন্দ্রনাথ । তিনিই তখনকার সাহিত্যি-শিল্প-সঙ্গীত রসিকদের যুক্ত করতেন `বিচিত্রা'র সাথে । এমন সাংগঠনিক কাজে রথীন্দ্রনাথ আগেও উত্সাহিত হয়েছেন । আমেরিকায় থাকতেও কিছু বিদেশি ছাত্রকে একত্র করে ইলিনয় বিশ্ববিদ্যালয়ে `কসমোপোলিটান ক্লাব' নাম দিয়ে একটি প্রতিষ্ঠানের সূচনা করেন ও পরে তার প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচিত হন । তাঁর এই গঠনমূলক প্রচেষ্টা পরবর্তী জীবনে বিশ্বভারতীর কাজে সার্থকরূপ লাভ করে ।



    ॥ স্বদেশ-প্রীতি ॥


    বাংলাদেশে স্বদেশী আন্দোলনের সূত্রপাত ১৯০৫ সালে । ঠাকুরবাড়িতে দ্বারকানাথের আমল থেকে যে স্বদেশপ্রীতি পারিবারিক জীবনে স্বত:স্ফূর্ত আলোড়ন তুলত, রথীন্দ্রনাথের জীবনেও তার প্রভাব পড়েছিল । দেশের মানুষের মধ্যে স্বাজাত্যবোধ জাগাতে তিনি দিনেন্দ্রনাথ ও অজিত চক্রবর্তীর সঙ্গে শান্তিনিকেতনের পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলিতে পিতার রচিত স্বদেশী গান গেয়ে ন্যাশনাল ফাণ্ডের জন্য টাকা তুলেছিলেন । অনুশীলন সমিতিতে জুজুত্সুও শিখিয়েছিলেন বেশ কিছুদিন ।


    ॥ বিবাহ ও বিশ্বভারতীতে যোগদান ॥


    মীরা, রথী, রবীন্দ্রনাথ, প্রতিমা দেবী, ও বেলা (১৯১০)
    আমেরিকা থেকে ফেরার পর গগনেন্দ্রনাথের অল্পবয়স্কা বিধবা ভগ্নী প্রতিমা দেবীর সঙ্গে রথীন্দ্রনাথের বিবাহ হয় । রবীন্দ্রনাথ এই প্রথম নিজে অগ্রণী হয়ে পরিবারের নিয়ম ভেঙে বিধবাবিবাহ দিলেন । এদিকে রবীন্দ্রনাথের পক্ষে একা শান্তিনিকেতন পরিচালনা ত্রক্রমেই কষ্টসাধ্য হয়ে উঠছিল, তাই তিনি পুত্রকে শিলাইদহ থেকে ডেকে পাঠালেন ১৯১৮ সালে । তখন থেকেই রথীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতনের দায়িত্ব নিলেন - তাকে সুন্দর, সুষ্ঠু রূপ দেবার কাজে নিজেকে সম্পূর্ণভাবে উত্সর্গ করলেন - নিজস্ব জীবনকৃত্যকে দূরে সরিয়ে রেখে । রথীন্দ্রনাথ যখন শান্তিনিকেতনের ভার নেন তখন চরম অসচ্ছলতা চলছিল । এই দুর্দিনে নানান আইনগত অসুবিধা ও আর্থিক দুরবস্থা সামাল দেবার জন্য বৈষয়িক কাজকর্মের সবটাই নিজের হাতে তুলে নিলেন । রবীন্দ্রনাথ তাঁর সৃষ্টিজগতে বিচরণের অবসর পেলেন । ১৯২১ সালে যখন আনুষ্ঠানিকভাবে বিশ্বভারতী প্রতিষ্ঠিত হল তখন রথীন্দ্রনাথ ও প্রশান্ত মহলানবীশ হলেন তার যুগ্ম-সচিব । পরে তিনি একাই এ-দায়িত্ব বহন করে গেছেন দীর্ঘ পঁয়ত্রিশ বছর ধরে । সুরেন্দ্রনাথ কর, অনিল চন্দ এ কাজে তাঁর সহযোগী ছিলেন । নূতন প্রতিষ্ঠানের অর্থনৈতিক কাঠামো সুদৃঢ় করার কাজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগ গড়ে তোলার কাজে তাঁকে প্রায়ই একক দায়িত্ব পালন করতে হত । কালীমোহন ঘোষ এ প্রসঙ্গে লিখেছেন, তাঁরা রথীন্দ্রনাথকে বিশ্বভারতীর কাজে দৈনিক টানা আঠারো ঘন্টা অবধি পরিশ্রম করতে দেখেছেন । বিশ্বভারতীর প্রথম পর্বে রথীন্দ্রনাথ অধ্যাপনাও করেছেন;
    ষ্ণংত্রংঞঠবয বা সৌজাত্যবিদ্যা পড়াতেন । রবীন্দ্রজীবনীকার প্রভাত মুখোপাধ্যায় তাঁর স্মৃতিচারণে এ-প্রসঙ্গে বলেছিলেন - `এই জটিল বিষয়কে সরস করে বোঝাবার জন্য তিনি উত্তমরূপে প্রস্তুত হয়ে আসতেন, ংন্‌ংঋংশঠস্‌ংত্রঞ দেখিয়ে আমাদের মুগ্ধ করতেন ।' বিশ্বভারতীর শিক্ষাসূচিতে পড়াশোনা ছাড়াও বিভিন্ন বিভাগ ছিল । সব বিভাগগুলির মধ্যে পাঠভবন নিয়েই রথীন্দ্রনাথের চিন্তা ছিল অধিক । বিশ্বভারতীর এটি আদি প্রতিষ্ঠান ও তিনি এখানেই পড়াশোনা করেছিলেন বলে এ-বিভাগের ওপর তাঁর বিশেষ মমতাও ছিল । শুধু কাজ নয়, সব কর্মীদের সঙ্গে তাঁর মধুর সম্পর্ক ছিল । স্বভাবে তিনি নীরব মানুষ হলেও সহকর্মীদের সুখে-দু:খে তাঁদের পাশে থাকতেন, তাদের প্রয়োজনে যা দান করতেন তা পাশের লোকও জানতে পারত না ।

    বিশ্বভারতীর কাজ তাঁর সাধনার ধন ছিল । একবার দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস তাঁকে অনুরোধ করেন রাজশাহী ডিভিসন থেকে ভারতীয় লেজিস্লেটিভ অ্যাসেম্বলির সদস্য হতে । বিনা প্রতিদ্বন্দিতায় যাতে রথীন্দ্রনাথ নির্বাচিত হতে পারেন, সে ব্যবস্থাও করে রেখেছিলেন দেশবন্ধু । তাঁর পিতা সম্মতি দিলেও রথীন্দ্রনাথ বিশ্বভারতীর কাজ ছেড়ে যেতে রাজী হননি । আর একবার জওহরলাল নেহরু তাঁকে রাষ্ট্রদূতের পদ দিয়ে বাইরে পাঠাতে চেয়েছিলেন । সেই সম্মান ও অর্থের হাতছানি তিনি উপেক্ষা করেন বিশ্বভারতীর ক্ষতির কথা ভেবে । অথচ অর্থাভাব তখন তাঁর যথেষ্ট ছিল । পিতার আদর্শকে রূপায়িত করতে এমনই বদ্ধপরিকর ছিলেন রথীন্দ্রনাথ ।

    এখানে তিনি অনন্য । পিতার প্রবল প্রতিভা ও খ্যাতির অভিঘাতে পুত্রের জীবন বিক্ষত হওয়ার ঘটনা ইতিহাসে বিরল নয় । কিংবদন্তী ক্রিকেটার স্যর ডন ব্র্যাডম্যানের পুত্র যশের অসহ্য বিচ্ছুরণে বিব্রত হয়ে নিজের পদবী পরিবর্তন করেন । অনেক ক্ষেত্রেই পুত্র পিতার কীর্তি ও জীবনবীক্ষার প্রতি বিমুখও হয়ে পড়েছেন ।

    নগেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়কে একটি চিঠিতে রথীন্দ্রনাথ লেখেন, "... আজ আবার আমার জন্মদিন, তাই বসে বসে অনেক কথা মনে হতে লাগল । এই কুড়ি বত্সরের সুখদু:খের কথা ঠেকিয়ে রাখা গেল না । এই মাসটা এলেই সেই সব কথা মনে পড়তে থাকে । সাত বছর হল এই সময়তেই মা আমাদের ছেড়ে যান । আবার শমীরও এই মাসেতে জন্ম ও মৃত্যু দিন । ভগবান আমাদের অদৃষ্টে আর কি লিখেছেন কে জানে ? বাবাকে যত দেখছি, ততই কষ্ট হচ্ছে -- তিনি অবশ্য কিছু বলেন না -- কিন্তু স্পষ্টই দেখছি তাঁর মনে আর কোনো সুখ নেই । আমার কষ্ট আরও বেশি হয় এই জন্য যে, আমি তাঁকে সুখী করতে পারব এ বিশ্বাস আমার নেই । এখন থেকে নিজেকে যদি একটু কাজের মানুষ গড়ে তুলতে পারি তা হলেই তাঁকে সন্তুষ্ট করতে পারব একটু ।"

    কুড়ি বছর বয়সেই রথীন্দ্রনাথ তাঁর জীবনধারা নির্ণীত করেছিলেন ।


    ॥ পিতার ভ্রমণসঙ্গী ॥


    রথীন্দ্রনাথ ছিলেন পিতার ভ্রমণসঙ্গী । রবীন্দ্রনাথ জন্মপথিক - বিভিন্ন দেশ
    বিদেশে বহুবার যেতেন ও সেখানকার গুণীদেরও আমন্ত্রণ জানিয়ে আসতেন । শান্তিনিকেতনের সেই অনটনের দিনে বিদেশি অতিথিদের আসা-যাওয়া, থাকা ও আপ্যায়নের ব্যবস্থা সবই হত রথীন্দ্রনাথের তত্বাবধানে । রথীন্দ্রনাথ ঘরে ও বাইরের কাজে কর্মী তৈরি করতে পারতেন সহজেই, তাদের দিয়ে সুষ্ঠুভাবে এসব কাজও সমাধা করতেন । অতি বৃহৎ কাজ করতেও তাঁকে উচ্চৈ:স্বরে কথা বলতে কেউ শোনেনি । সব কাজই তিনি নীরবে, নি:শব্দে সম্পন্ন করতেন । তাঁর ভদ্র ব্যবহার ও সহজাত সৌজন্য পরিচিত মহলে প্রবাদবাক্যে পরিণত হয়েছিল । অহংকার তাঁকে স্পর্শ করেনি, স্নিগ্ধ ব্যবহারে ছিল উদারতায় মাধুর্য । ভ্রমণের ব্যাপারে একটি ঘটনা এখানে উল্লেখ করতেই হয় । বিদেশ-ভ্রমণের সময় রবীন্দ্রনাথের সেক্রেটারির যাবতীয় কাজ তিনিই সম্পন্ন করতেন । ১৯১২-১৩ সালে লণ্ডন বাসকালে টিউব-রেলে করে ব্লুম্সবেরি যাবার পথে নামার সময় বাবার অ্যাটাচি কেসটি রথীন্দ্রনাথ ট্রেনে ফেলে আসেন ভুলবশত: । অ্যাটাচির ভিতর রবীন্দ্রনাথের গীতাঞ্জলির ইংরেজি অনুবাদের একমাত্র পাণ্ডুলিপি ও আরো অনেক দরকারি কাগজপত্র ছিল । পরে খোঁজ পড়লে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত রথীন্দ্রনাথ ত্ধযঞ ংঋশধৃংশঞষ্‌ ধীংঈঠবং -এ হারাধন ফেরৎ পেয়ে স্বস্তি পান । পিতৃস্মৃতিতে তিনি লিখছেন - "মাঝে একটা দু:স্বপ্নের মত ভাবি যদি ইংরেজী গীতাঞ্জলি আমার অমনোযোগ ও গাফিলতির দরুণ সত্যিই হারিয়ে যেত, তাহলে ...." তাহলে সত্যিই কি হত আমরাও ভেবে কূল পাই না ।


    ॥ রবীন্দ্রভবন গঠন ॥

    ১৯১২ সালে রথীন্দ্রনাথ যখন পিতার সঙ্গে লণ্ডনে ছিলেন, গীতাঞ্জলির অনুবাদের ব্যাপারে বিলেতের মনীষী ও প্রকাশনা জগতের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের তখন নিত্যনূতন যোগাযোগ ঘটছে । এই পরিস্থিতিতে প্রতিভাশালী পিতার নিত্যনূতন খামখেয়াল সামলে রথীন্দ্রনাথকে কাজ করে যেতে হত । তখনই তিনি এমন একটি কাজের সূত্রপাত করেছিলেন যার জন্য পরবর্তীকালে রবীন্দ্র সাহিত্যের পাঠক ও গবেষকরা প্রভূত উপকৃত হন । দূরদর্শী পুত্র লণ্ডনের নামী
    ঝত্রঞংশত্রছঞঠধত্রছৎ ঙত্ঠৃংঋঠত্রভ নংশটঠবং এর গ্রাহক হওয়ার ফলে বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কিত সবরকম কর্তিকা তাঁর কাছে আসে । এই সব কর্তিকাগুলি বিভিন্ন দেশে রবীন্দ্রনাথের রচনা মুখের ভাষণ ও যাবতীয় কাজকর্মের ঐতিহাসিক দলিল । তিনি পিতার সমস্ত চিঠিপত্রের ও রচনার কপি সংরক্ষণের ব্যবস্থা করেন । এরই ফলে চিঠিপত্র গ্রন্থমালা প্রকাশিত হতে পেরেছে । বিদেশ থেকে ফিরে পিতার নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তির পর থেকে কর্তিকাগুলি সন-তারিখ অনুসারে বিন্যাস করে লিখে রাখার শ্রমসাধ্য কাজটি রথীন্দ্রনাথ নিজে করতেন । এইসব মূল্যবান দলিল এক জায়গায় সংগ্রহ করে তিনি শান্তিনিকেতনে প্রতিষ্ঠাতা আচার্যের দপ্তর স্থাপন করেন যা রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর পর `রবীন্দ্রভবন' নামে পরিচিত হয় । এই `রবীন্দ্রভবন' গড়ে তোলা রথীন্দ্রনাথের মহৎ সৃষ্টি । রবীন্দ্রজীবনীকার প্রভাত কুমার মুখোপাধ্যায় বলেছিলেন যে রথীন্দ্রনাথের এই প্রচেষ্টার জন্যই রবীন্দ্রজীবনীর অনেক অংশ তাঁর পক্ষে লেখা সহজ হয়েছিল ।


    ॥ চামড়া ও কাঠের কাজ ॥

    বিশ্বভারতীর দায়িত্ব ও পিতার রক্ষণাবেক্ষণের গুরুভার কাজের পাশে পাশে রথীন্দ্রনাথের সৃষ্টিশীল মন সর্বদাই সজাগ থেকেছে । তিনি ছিলেন মনেপ্রাণে আর্টিস্ট -- চামড়ার কাজে তাঁর বিরল নৈপুণ্য অনেকেরই অজানা । আজকের চামড়ার কাজ ভারতবর্ষে যা প্রচলিত তা অনেকাংশে তিনিই  ১৯২৬ সালে মিলান থেকে শিখে আসেন । কিন্তু কাজ করার সময় রথীন্দ্রনাথ সম্পূর্ণ দেশি ডিজাইনে বিভিন্ন জিনিস তৈরি করতেন । আজ আমরা যেসব চামড়ার ব্যাগকে শান্তিনিকেতনের ব্যাগ বা বাটিকের কাজ বলি তার প্রবর্তক হলেন রথীন্দ্রনাথ । ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে এই কাজ শিক্ষাদানের জন্য তিনি ও প্রতিমাদেবী মিলে গড়ে তোলেন শ্রীনিকেতন শিল্পসদন । আশেপাশের গ্রামের মানুষ যাতে কাঠ, চামড়া, মৃত্শিল্প ইত্যাদির কাজ শিখে স্বনির্ভর হতে পারে তার জন্য নিজের হতে তাদের কাজ শিখিয়েছিলেন । সরকার শিল্পের ক্ষেত্রে তাঁর কৃতিত্ব স্বীকার করেছিল - তাঁকে সরকারি এক শিল্প সংস্থায় শিল্পবিষয়ক উপদেষ্টা রূপে গ্রহণ করা হয়েছিল । কাঠের কাজেও তিনি ছিলেন সিদ্ধহস্ত । তাঁর বৈশিষ্ট্য, কাঠে তিনি কোনও রং দিতেন না । নানা রং'এর কাঠ সংগ্রহ করে সেই কাঠ সাজিয়ে তিনি বিভিন্ন সৃষ্টি করেছেন । দৈনন্দিন ব্যবহারের অজস্র জিনিস তিনি তৈরি করতেন নিবিষ্ট মনে । উত্তরায়ণের উদয়ন গৃহ, রতনপল্লী গেস্টহাউস ইত্যাদিতে এখনও তাঁর তৈরি কিছু আসবাবপত্র দেখা যায় । তাঁর তৈরি কাঠের শিল্পকৃতিতে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় পাওয়া যায় । উদয়ন বাড়ির আভ্যন্তরীণ সজ্জায় যে অসামান্য উন্নতরুচি ও মনের পরিচয় পাওয়া যায় তা বিস্ময়কর । তাঁর নিজের কথায় - "জন্মেছি শিল্পীর বংশে, শিক্ষা পেয়েছি বিজ্ঞানের কাজ করেছি মুচির আর ছুতোরের ।" প্রভাতকুমার এই প্রসঙ্গে লিখেছেন - "তাঁর মেজাজটি ছিল বিজ্ঞানীর, মনটা ছিল আর্টিস্ট বা ভাবুকের । এই দোটানার মধ্যে তাঁর জীবন যায় কেটে ।"



    ॥ চিত্রাঙ্কন ও উদ্যানচর্চা ॥


    গগনেন্দ্রনাথ, অবনীন্দ্রনাথ, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ও রবীন্দ্রনাথের শিল্পী প্রতিভার ধারা অনুসরণ করে রথীন্দ্রনাথও অপূর্ব সব ছবি এঁকেছেন । কিন্তু তাঁর আঁকা ছবি তাঁর নিজস্বধারায় গড়ে উঠেছিল । অন্যকোনও শিল্পীর প্রভাব সেখানে নেই । তাঁর ছবি অসংখ্য - তার মধ্যে ফুলের ছবি ও দৃশ্য চিত্রই বেশী । তাঁর আঁকা Øংউলের ছবি এত জীবন্ত হত যে মনে হত সত্যিই ফুল ফুটে আছে । স্টেলা ত্রক্রামরিস বলেছিলেন - "
    চ্‌ং ংঋছঠত্রঞয ঞচ্‌ং ংঋধশঞশছঠঞয ধী স্ছত্রষ্‌ ংঈত্ধগংশয " সব রকম ফুলের মধ্যে গোলাপফুলের ছবিই তাঁর সর্বোত্তম । রবীন্দ্রনাথ পুত্রের এই চিত্রকলা সম্বন্ধে একবার বলেছিলেন -"রথীর মত এত নিপুণ করে আমি ফুলের ছবি আঁকতে পারিনা ।" নিজে অনেকবার এড়িয়ে গেলেও তাঁর ছবি ও অন্যান্য কাজের প্রদর্শনী হয় অনেক পরে - ১৯৪৮ সালের ১০ই মার্চ । দিল্লীতে এই প্রদর্শনী হয় ও পণ্ডিত নেহরু তা উদ্বোধন করেন । চীন থেকে তাঁকে একটি উপাধি দেওয়া হয় ও সেই উপলক্ষ্যে কলকাতায় ও কলাভবনে উত্সব হয় ও প্রদর্শনীও হয় । ১৯৫২ সালে কলকাতার গভর্নমেন্ট আর্ট কলেজে একটি প্রদর্শনী হয় । রথীন্দ্রনাথের বিচিত্র রকমের ফুলের ছবি আঁকার এই আবেগ পরিপূর্ণ রূপ পেল তাঁর সৃষ্ট বাগানগুলিতে । দেশবিদেশ, জংলি পাহাড় থেকে আনা বিভিন্ন ধরনের অচেনা ফুলগাছের পারস্পরিক মিলন নিয়ে সারাজীবনই তিনি পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়ে তাদের সন্তানস্নেহে লালন করেছেন । উত্তরায়ণের বাগানে দেশিবিদেশি ফুলের এক অভিনব সমাবেশ । তাঁর সৃষ্ট বাগানে প্রকৃতি যেন নিজের স্বভাবে গড়ে উঠেছিল । শান্তিনিকেতেনের কাঁকুরে মাটিতে কয়েকশ' গোলাপের চারা লাগিয়ে এক অনন্যসুন্দর গোলাপ বাগান তৈরি করেছিলেন - পিতা তাতে অত্যন্ত খুশি হয়েছিলেন । উদয়ন যাবার মুখে লোহার রেলিং-এর সঙ্গে পেয়ারা, আম, জামরুল, সফেদা প্রভৃতি গাছের কাণ্ড ও শাখাপ্রশাখাকে লতানো গাছে পরিবর্তিত করেছিলেন । উত্তরায়ণের চারপাশ বর্ণে, বৈচিত্র্যে সারাবছর ঝলমল করত । এখানেই তাঁর তৈরি "গুহাঘরে" বসে বিশ্বভারতীর যাবতীয় কাজ ও তাঁর শিল্পকৃতির সব কিছুই করে যেতেন । সেই একটা সময় ছিল যখন রবীন্দ্রনাথের নতুন নতুন গানের সুরে শান্তিনিকেতনের আকাশ মুখর, পুত্রের সৃষ্ট বাগান ও ফুল দেখে মনে হত "সেথায় তরু তৃণ যত, মাটির বাঁশি হতে ওঠে গানের মত ।"


    ॥ সাহিত্যে অনুরাগ ॥


    রথীন্দ্রনাথের সম্বন্ধে জানার এত কিছু আছে, তাঁর সহজাত বিভিন্ন গুণ ও কীর্তির তালিকা এত বড় যে বিস্মৃতি থেকে তুলে আনাও একটা বৃহৎ কাজ । গৃহনির্মাণের কাজ, তার পরিকল্পনা ও সুন্দর রূপ দেওয়া রথীন্দ্রনাথের একটা বিশেষ সখ ছিল । রবীন্দ্রনাথ পরিবর্তন প্রিয় ছিলেন - এক বাড়িতে বেশিদিন থাকতে চাইতেন না । তাঁর সখ মেটাতে রথীন্দ্রনাথ একের পর এক উদয়নগৃহ, কোণার্ক, শ্যামলী, পুনশ্চ, উদীচী গৃহ তৈরি করেছেন । তাঁর এই স্থাপত্যশিল্পে প্রধান সহযোগী ছিলেন সুরেন কর ও নন্দলাল বোস । স্থাপত্যের নক্সায় ও সৌন্দর্যে এক-একটি গৃহ অনবদ্য হয়ে উঠেছে । রথীন্দ্রনাথের এই সখ চরিতার্থ হতে অর্থের প্রয়োজন হত বিস্তর, এবং এই কারণে রথীন্দ্রনাথকে সমালোচনার মুখেও পড়তে হত ।


    বিজ্ঞানের ছাত্র হয়েও রথীন্দ্রনাথের সাহিত্যে অনুরাগ ছিল । দেশি-বিদেশি সাহিত্যে তাঁর অধ্যয়ন ছিল । ইংরেজি ভাষায় তাঁর দখল সম্বন্ধে লেনার্ড এলমহার্স্ট বলেছিলেন - "এই বিষয়ে আমার সংশয় নেই যে চর্চা করলে ইংরেজিতে প্রতিষ্ঠা অর্জন করবার সম্ভাবনা তাঁর মধ্যে ছিল ।" শ্রী কৃষ্ণ কৃপালনীর অনুরোধে শেষ বয়সে লেখা "
    চত্র ঞচ্‌ং শ্রুভংয ধী মঠস্‌ং " বইটি পড়লে এ বিষয়ে একমত হওয়া যায় । নিজেকে অন্তরালে রেখে জীবনস্মৃতি রচনায় এ-এক বিরল দৃষ্টান্ত ! চমত্কার ঝরঝরে ইংরেজিতে লেখা এ বইএর ভাষা অত্যন্ত স্বচ্ছন্দ ও সাবলীল । রথীন্দ্রনাথ এই বইটিই পরে `পিতৃস্মৃতি' নাম দিয়ে বাংলায় লেখেন । তাঁর লেখার মধ্যে আমরা অনেক কিছু জানতে পারি যা রবীন্দ্রনাথের লেখাতেও পাই না । বাংলাদেশের একটি গৌরবময় যুগের কথা, পিতার আশেপাশের কৃতী মানুষজনের কথা খুব চিত্তাকর্ষক ভাবে সহজ ভাষায় বলে গেছেন - কোথাও নিজেকে ংঋশধএংবঞ করেননি । সংস্কৃতে তাঁর জ্ঞান ছিল । অশ্বঘোষের বুদ্ধচরিত তিনি বাংলায় অনুবাদ করেন । এ এক বিশেষ কীর্তি তাঁর । কিছু কবিতাও লেখেন - পুরুষের মন (১৯৩৭); বাঙালী মেয়ে, শেষ দান, ইত্যাদি । তাঁর গল্প -`বাঁধাঘাট' (১৯৩৭) বিচিত্রায় প্রকাশিত হয়েছিল । `এক ভাল্লুকের গল্প' ১৩৬৮ তে সন্দেশে বেরোয় । ক্ষমতার তুলনায় তিনি লিখেছেন কম । তবে বাংলায় বিজ্ঞানবিষয়ক বই হিসাবে তিনি দুটি বই লেখেন - `প্রাণতত্ত্ব' এবং `অভিব্যক্তি' । এই বই দুটির বৈশিষ্ট্য তাঁর ভাষা । ভাষার মধ্যে কোনওরকম অলংকার বা আতিশয্য নেই, যা বিজ্ঞান রচনার পক্ষে একান্ত উপযোগী ।  লক্ষ্য করার বিষয়- এই দুটি বই-ই তিনি প্রকাশ করেন পিতার মৃত্যুর পর । স্বভাবলাজুক ও পিতার প্রতিভায় অভিভূত পুত্র অসংকোচে আত্মপ্রকাশে ভরসা পাননি ।


    ॥ বিচিত্র কর্মপ্রচেষ্টা ॥


    শান্তিনিকেতন ও বিশ্বভারতীর দৈন্দনিন জীবনযাত্রাকে শিল্পিত করে তুলেছিলেন রথীন্দ্রনাথ । যখন যেখানে থেকেছেন, তার চারপাশ রুচিকর শিল্পের স্পর্শে সুন্দর করে তুলেছেন । সংসারের কাজেও তাঁর কম দক্ষতা ছিল না । তাঁর কন্যা নন্দিনী দেবী লিখেছেন "বাবা রন্ধন শাস্ত্রেও বিজ্ঞ ছিলেন । আধুনিকভাবে
    নঞংছস্‌ জধঠত্‌ংশ এর সাহায্যে বিভিন্ন জিনিস কি ভাবে কম সময়ে তৈরি করা যায় তা তিনি শেখাতেন । জেলি, আচার ইত্যাদি খুব ভাল তৈরি করতে পারতেন । সবচেয়ে মজার কথা তিনি দই খুব ভাল পাততে পারতেন । সুগন্ধি পাউডার এবং বিভিন্নরকম সেন্ট ভাল তৈরি করতেন । শেষের দিকে শিঞষ্‌ ংংঐশীণ্ণস্‌ংয বলে কিছু সাজসজ্জার জিনিস বাজারে ছেড়েছিলেন । এছাড়া ছিল তাঁর শিকারের নেশা । প্রায়ই তিনি চলে যেতেন শিকারে । আর একটা জিনিসও তিনি খুব ভালবাসতেন - তা হল তাস খেলা । প্রতিদিন সন্ধ্যায় উত্তরায়ণে ব্রিজের আড্ডা বসত, অনেকেই আসতেন । রবীন্দ্রনাথ এ বিষয়ে খুব বিরক্তি প্রকাশ করলেও তিনি এটা বন্ধ করেননি । সঙ্গীতচর্চার মধ্যে এস্রাজ বাজাতেন, বাবার গানও গাইতেন তবে তা সর্বসমক্ষে করতেন না । বন্ধুবত্সল রথীন্দ্রনাথের ঘনিষ্ঠ মানুষদের সামনে নিজের স্বভাবের এই দিকগুলি প্রকাশ পেত ।


    ॥ ত্যাগের জীবন ॥


    বস্তুত পিতৃভক্তিতে ত্যাগে ও সৌজন্যপ্রকাশে রথীন্দ্রনাথের মত ব্যক্তিত্ব বিরল । চিরজীবনই তিনি তাঁর পিতার স্বপ্নকে রূপায়িত করতে বা তাঁর জন্য `কাজের মানুষ' হয়ে উঠতে অনেক ত্যাগ স্বীকার করেছেন । প্রথম জীবনে তাঁর অধীত কৃষিবিজ্ঞান শিক্ষা পূর্ববাংলার পৈতৃক জমিদারির কাজে লাগাতে না-লাগাতে পিতার আহ্বানে সে-কাজ ছেড়ে শান্তিনিকেতনের কাজে যোগদান করতে হয় । পরে দ্বিতীয়বার যখন তাঁরা আমেরিকায় যান, তখনও তাঁর ডক্টরেট ডিগ্রীর অধ্যয়নের কাজ অসমাপ্ত রেখে পিতার সঙ্গে ইউরোপে চলে যেতে হয় । শেষের ক'টি বছর ছাড়া সুদীর্ঘকাল তিনি বিনা পারিশ্রমিকে শান্তিনিকেতনের সেবা করেছেন । এসব আমরা হয়ত ভেবে দেখিনি কোনওসময় । এই মানুষটির যথার্থ মূল্যায়ন হয়ত হয়নি । যথাযোগ্য মর্যাদাও তিনি পাননি । পুত্রের এই দিকটার কথা অপর লোক হয়ত বোঝেনি । - কিন্তু স্নেহশীল পিতা অবশ্যই তা মর্মে অনুভব করেছিলেন । তাই রথীন্দ্রনাথের পঞ্চাশ বছরের জন্মদিনে তিনি লিখেছিলেন -
    "তোমার সকল চিত্তে

    সব বিত্তে

    ভবিষ্যের অভিমুখে পথ দিতেছিলে মেলে,

    তার লাগি যশ নাই পেলে ।
    কর্মের যেখানে উচ্চদাম

    সেখানে কর্মীর নাম
    নেপথ্যেই থাকে একপাশে ।"

    পিতার কাছ থেকে পাওয়া এই আশীর্বাদই ছিল পুত্রের জীবনে শ্রেষ্ঠ পুরস্কার ।



    ॥ উপসংহার ॥


    একটি বিশেষ তথ্য হয়ত আমাদের অনেকেরই জানা নেই যে দেশ স্বাধীন হবার পর রথীন্দ্রনাথ পণ্ডিত নেহরুর কাছে ছুটে গিয়েছিলেন যাতে `জনগণমন অধিনায়ক' গানটি ভারতবর্ষের জাতীয় সঙ্গীত হয় । সেকাজ সমাধা করে তবে তিনি Øংইরে আসেন । এইভাবেই হয়ত জানা নেই যে ১৯৫১ সালে বিশ্বভারতী যে কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয় রূপে পরিচিতি লাভ করে তার পিছনেও রথীন্দ্রনাথের অক্লান্ত প্রচেষ্টার কথা । শান্তিনিকেতন ব্রহ্মচর্য বিদ্যালয়ের প্রথম ছাত্র রথীন্দ্রনাথ বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম উপাচার্য হন । তিনি ছ-বছরের জন্য নিযুক্ত হলেও দুর্ভাগ্যের বিষয় হল যে তিনি দুবছরের পর শান্তিনিকেতন ছেড়ে দেরাদুনে গিয়ে বসবাস শুরু করেন । নীরবে নিভৃতে তাঁর ছোট্ট `গুহাঘর'-খানিতে বসে বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ করতে যে-আনন্দ তিনি পেতেন, সরকারি আইনের বেড়াজালের ভিতর কাজ করতে গিয়ে তিনি সে আনন্দ হারিয়ে ফেলেন । তবে শান্তিনিকেতনের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ ছিল । চিরকালের নেপথ্যচারী মানুষটির মৃত্যুও ঘটল নেপথ্যে । ১৯৬১ সালে রবীন্দ্রনাথের শতবর্ষ জন্মজয়ন্তীর কোলাহলে পুত্রের মৃত্যুসংবাদটি সহজেই ডুবে গেল । হীরেন্দ্রনাথ দত্তের একটি কথা এ-প্রসঙ্গে স্মরণ করি - "ইনি বরাবর জীবনের একটি ছন্দ বজায় রেখে চলেছিলেন, মৃত্যুতেও তার ছন্দপতন হয়নি ।" ১৯৬১ সালের ৩রা জুন দেরাদুনে রথীন্দ্রনাথের নম্রনীরব জীবনটির অবসান হয় ।



  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments