• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৩২ | জানুয়ারি ২০০৪ | গল্প
    Share
  • গোবিন্দ : বৈদূর্য ভট্টাচার্য

    ॥ ১ ॥

    পেন্সিল কাটতে গিয়ে গোবিন্দ রক্তারক্তি কাণ্ড বাধিয়ে দিল । দুপুরবেলা খাওয়াদাওয়া শেষ করে সবাই একটু গড়িয়ে নিচ্ছে, গোবিন্দ বসেছে খাওয়ার ঘরের চৌকাঠে । বাঁহাতে পেন্সিল, ডানহাতে ছুরি । বাঁহাতের মুঠোয় ধরেছে পেন্সিলটা, আর মুঠো ঘুরিয়ে ধরে শিষটা চেপে রেখেছে বাঁকব্জির ওপরেই, সেই ভাবে চলছে পেন্সিল কাটা । পাঁচ মিনিটও হয়নি, হঠাৎ তীক্ষণ শ্বাসটানার শব্দ, মাথা তুলে দেখি গলগল করে কালচে রক্ত গোবিন্দর হাত থেকে । দিদার বাড়ির সাদাকালো মেঝে ভর্তি হয়ে গেল লালে । ডানহাতে বাঁকব্জি চিপে ছুটে বেড়াল গোবিন্দ, গোবিন্দর পেছনে ছুটল সবাই । কুন্তো ততদিনে রিটায়ার করে দেশে চলে গেছে, অত রক্ত পরিষ্কার করবে কে । ছোটদাদু মাতব্বর লোক, দেখে বলল `শিরা কেটে গেছে, এ রক্ত থামলে হয়--' । সারা দুপুর লাগল সেই রক্ত থামতে । গোবিন্দর মণিবন্ধে ঢিবির মতো সেই ক্ষতচিহ্ন এখনো আছে ।

    সেই সব পেন্সিল দিয়ে আমি তখন যুক্তাক্ষর লিখি । অথবা আঁকি কঁংউড়েঘর, কঁংউড়েঘরের সামনে নদী, নদীর ধারে গাছ, গাছের ওপরে মেঘ, আর মেঘের পাশে তিনদিনের দাড়ি না কামানো সূর্য । গোবিন্দ রোজ সকালে হরিণঘাটার দুধ নিয়ে আসে, সেই দুধ জ্বাল হলে দাদু চা খায় । আটটার সময়ে গোবিন্দ মুদির দোকানে যায় । দাদু অপিস গেলে আমি আর গোবিন্দ বাগানে পাতাল রেলের গর্ত খঁংউড়ি । দুপুরে দিদার সঙ্গে দাবা খেলে গোবিন্দ, বিকেল হলে আমরা ক্রিকেট খেলি বাগানে । সন্ধেবেলা আটা চালতে বসে গোবিন্দ, সেই আটা দিয়ে আমরা ফুলকো ফুলকো রুটি খাই । গোবিন্দ খায় মোটা চালের ভাত, ওর ওই খেয়ে অভ্যেস ।

    ॥ ২ ॥

    তবে গোবিন্দ রাত হলে একলা বসে ফিঁচফিঁচ করে কাঁদে কেন ? রাত হলে দিদার কানে রেডিও, দিদা শোনে নাটক, দাদু শুয়ে পড়ে তাড়াতাড়ি, আর গোবিন্দ রান্নাঘর আর খাবার ঘরের মধ্যে দরজায় পিঠ দিয়ে অন্ধকারে বসে দুহাতে মুখ ঢেকে যেটা করে, ফিঁচফিঁচ করে শব্দ হয়, সেটা কী, কান্নাই তো ? রান্নাঘরের দিকটা রাত্রিবেলা খুব বেশি যাবার উপায় নেই আমার । অন্ধকার যেখানটা খুব ঘনিয়েছে, সেখানে দেওয়াল জোড়া বিকট হাঁ কার এবং কী তার মতলব, আমার না জানলেও চলে । তাই পরদিন সকালে জিগেস করতে হয় গোবিন্দকে, কাঁদছিলে কেন ?

    জবা গাছের নীচে চলছে আমাদের পাতাল রেলের কাজ । মাটি খোঁড়া শেষ হয়েছে এতদিনে, এবার মাটিতে সমান করে ইঁট পেতে তার ওপর রেললাইন পাতা হবে । গোবিন্দরই নক্সা । সেটা হলে দুপাশে লম্বালম্বি এক-ইঁট উঁচু দেওয়াল তুলে, তাদের ওপর আড়াআড়ি ইঁট বসিয়ে দিলেই হল । তারপর ঢেকে দাও মাটি দিয়ে, বুঝতে পারবে না কেউ । শুধু একদিক থেকে ট্রেন ঢুকে হুশ করে বেরোবে আর এক দিক দিয়ে । তাক লেগে যাবে দাদুর, আর মামুরও, যখন ফিরবে অ্যামেরিকা থেকে ।

    গোবিন্দ উত্তর দেয় না । চার হাত-পায়ে ভর দিয়ে আমার দিকে পিছন ফিরে ইঁট বসিয়ে চলে । কেমন একটা গন্ধ সবসময়ে বেরোয় গোবিন্দের গা থেকে, ঘামের গন্ধ, মলিন গেঞ্জি হাফপ্যান্টের গন্ধ, দাঁত না-মাজার গন্ধ । `কাঁদছিলে কেন গোবিন্দ ?' গোবিন্দ উত্তর দেয় না একবারও । হঠাৎ ঘুরে বসে বলে, `চলো, ইঁট আনতে হবে ।' ওর ঈষৎ ট্যারা চোখ, বসন্তর ছাপমারা গাল, নীচের ঠোঁটের ওপর চেপে বসা দুপাটি বেরিয়ে থাকা দাঁতে অধৈর্য ঝরে পড়ে ।

    ইঁট পাওয়া যায় অনেকই রাস্তা পেরিয়ে সামনের মাঠ থেকে । একের পর এক খালি জমি, তাদের একটাতে বাড়ি তৈরি হচ্ছিল একসময়ে, ভিত পর্যন্ত উঠে থমকে গেছে । বালি ছিল এক ঢিবি, সেটা বৃষ্টিতে ধুয়ে গেছে একেবারে, বাড়ির মালিকেরা যদি আসে কখনো, অবাক হয়ে ভাববে গেল কোথায় এই তো সেদিন বালি রেখে গেলাম এতগুলো ! তাদের ফেলে যাওয়া ইঁংএটর পাঁজায় শ্যাওলা জন্মেছে তুলতুলে সবুজ, আর গজিয়েছে একটা আকন্দ গাছ, প্রায় ঢেকে ফেলেছে ইঁটগুলোকে । আমাদের ক্রিকেট খেলার উইকেট সাধারণত আসে ওইখান থেকে, পাতালরেলের কাজ আরম্ভ হবার পর প্রধান উপকরণও তাই ।

    ইঁট বয়ে নিয়ে আসা চলে কিছুক্ষণ । আমার ডবল বয়সী গোবিন্দর সামনের দিকে কঁংউজো হয়ে হাঁটা, দুহাতে ধরা ইঁট, পেছন পেছন খালি-হাতে আমি । বার কয়েক এমন হবার পর দেখি আকন্দ গাছের গোড়ায় পাঁজার গর্তে কাগজে মোড়া বলের মতো কতগুলো, দড়ি দিয়ে বাঁধা ক্রিকেট বলের মতো, শেষবার সেগুলো নিয়ে আমিও গোবিন্দর সঙ্গে বাড়ি ।

    ॥ ৩ ॥

    ছোটদাদু বসল না বেশিক্ষণ, `দিনকাল খারাপ' বলে চাটা শেষ করল তাড়াতাড়ি । গোবিন্দ ধুনো দিয়ে গেল । আমি সারা দুপুর ঘুমিয়ে উঠেছি ছোটদাদুর গলার আওয়াজেই, অনেকক্ষণ ঘুমিয়ে কেমন ভোম্বল ভোম্বল লাগছিল । গোবিন্দ ডেকে দেয়নি আমাকে, আলো থাকলে খেলা যেত । ধোঁয়ার ওপাশ থেকে শুনি ছোটদাদু বলছে, `বাপ্পাকে ধরে নিয়ে গেস্ল জানো তো কালী, তপু ওদের চেনে বলে ছেড়ে দিয়েছে --' আমাকে নজর করেই আমার দিকে ফিরে ডানহাত মুঠো করে বাড়িয়ে তর্জনীতে দুবার আঁকশি বানিয়ে গলা চড়িয়ে বলল, `পারিস পিস্তল চালাতে? স্যাট স্যাট?'

    রোগা ছোটখাট ছোটদাদুর পাঞ্জাবী ঢাকা পেটটা অস্বাভাবিক ফোলা । `কী ওটা ?' পাল্টা জিগ্যেস করতে হল । ধোঁয়ার ভেতর থেকে ছোটদাদু দুহাতে পেট সমান করতে করতে গলা নামাল, `বোমা । পুলিশ দেখতে পেলেই ধরবে না এমন --' দিদা নাক ঝাড়ার শব্দ করে থামিয়ে দিল, `কী যে বলো না ছোড়দা !'

    `সে তোমরা ভয় পেতে পার,' ছোটদাদুর মোটা গলা আরও মোটা হল, `কিন্তু স্বাধীনতা-যুদ্ধে আমি যে পিস্তল স্মাগল করেছি সে কথা তো তোমরা জানো কালী ।' দিদা দরজা খুলে দিল । ছোটদাদু যেতে যেতে বলে গেল শুনতে পেলাম, `অমল যেন রোজ রাত করে বাড়ি না ফেরে কালী, আমি বলেছি বোল ।'

    ধড়াম করে বন্ধ হল সিঁড়ির নীচের দরজা । তার আগে ফাঁক পেয়ে বিকেলের মরা আলোর সঙ্গে ঢুকে পড়ল একশো মশা । দিদা পূজো করতে গেল । আমার ঝিমধরা ভাবটা কাটল না, পিনপিন করতে লাগল মশার মতো মাথার চারপাশে । একা একা বসে থাকলাম দাদুর আরাম-চেয়ারের ওপর । দিনের আলো একদম শেষ হলে কোণার ল্যাম্পপোস্টটা জ্বলল । কিছুদিন হল আবিষ্কার করেছি রাত্রিবেলা ল্যাম্পপোস্টের দিকে চেয়ে চোখের নীচে কোণাকুণি আঙুল রেখে চাপ দিলে একটার বদলে দুটো আলো দেখা যায় । দুটো চোখে চাপ দিয়ে দুটো আলোকে চারটে করা যায় কি না কিছুক্ষণ চেষ্টা করলাম, সুবিধা হল না । গোবিন্দ পারে কি ?

    গোবিন্দ যথারীতি বসেছে রান্নাঘরের মেঝেতে । খবরের কাগজের ওপর রাখা স্টীলের থালায় জমা হচ্ছে মিহি আটা, আর চালুনীতে থেকে যাওয়া ভুষিগুলো ঢালা হচ্ছে থালার পাশে স্টীলের কৌটোতে । আটাচাকির চশমাআঁটা বুড়োটা পারে না ভালো করে গম ভাঙাতে ?

    `কাঁদছিলে কেন গোবিন্দ?' গোবিন্দ উত্তর দেয় না । থাবড়া মারে চালুনীতে ।

    দাদু ফিরল অপিস থেকে । দিদার রান্না শেষ হল । গোবিন্দ থালার আটায় জল ফেলে দুহাত দিয়ে মাখল । একবারও উত্তর দিল না । দিদা ডাকল, `খেতে আয় ।' দাদু খেতে বসবে এবার । গোবিন্দ রুটি বেলতে বেলতে উনুনের ওপর তাওয়া চড়ায় । `কাঁদছিলে কেন গোবিন্দ ?' আমার মজা লাগে । ছন্দ জাগে প্রশ্নটার ভেতর । গোবিন্দ কোন কথা না বলে একটা চায়ের চামচ ঢোকায় তাওয়ার নীচে লালকালো কয়লাগুলোর ওপর । হঠাৎ চামচটা উনুন থেকে টেনে নিয়ে আমার পায়ের পাতার ওপরে চেপে ধরে গোবিন্দ । মাথা নামিয়ে দেখতে পাই ওৎ পাতা জন্তুর মতো উবু হয়ে বসা গোবিন্দ, নীচের ঠোঁটের ওপর চেপে রাখা দাঁত, স্ফীত চোয়াল, আর মাথা তুলে তীব্র দুটো চোখই রাখতে চেষ্টা করছে আমার চোখে, কিন্তু পারছে না, পিছলে যাচ্ছে বারবার ।

    ॥ ৪ ॥

    তারার মতো দেখতে সেই ফোসকার দাগটা এখনো আছে আমার বাঁপায়ের ওপর । আর কেউ জানে না সেটার কথা, সেদিন অনেক রাত্রে যে লোকটা প্রচুর মার খেলো আমার জন্য, সেও না ।

    দাদুর ঘরের জানলা দিয়ে শোনা যাচ্ছিল সবচেয়ে ভাল । দাদু কেমন নি:ঝুম হয়ে বসেছিল খাটের ওপর । দিদা ধীরে ধীরে এসে দাঁড়াল । বাইরে একদল লোক খঁংউজছিল কিছু, আর পাচ্ছিল না বলে কাউকে মারছিল খুব । টর্চের আলো ঘোরাফেরা করছিল ফেলে যাওয়া আধখানা বাড়িটার চারপাশে । গোবিন্দও এসে দাঁড়িয়েছে দরজা ধরে । দিদা শ্বাস ফেলে বলল, `নকশাল ।' বলে পর্দা টেনে দিল সব । গা-শিরশির-করা শব্দটা এরাই তবে ? কিছুদিন আগে এরা আসত পূজোর চাঁদার জন্যে । এখন হয়েছে নকশাল । কতদিন থাকবে ? কী হবে এর পরে ? আবার কি চাঁদার দল হয়ে যাবে সামনের বছর ?

    কত নতুন শব্দ শিখলাম সে রাতে । শিখলাম মানুষ বাঁচতে চায় কত । কী করে চুপ থাকতে হয় । আমি তো জানি জিনিষগুলো কোথায় আছে । গোবিন্দও জানে । জবাগাছের নীচে, পাতালরেলের গর্তের মধ্যে স্টেশনের গায়ে ।

    শেষরাতে শিউলি ঝরল অনেক দিদার বাগানে । ভোরবেলা কাগজ দিয়ে গেল কাগজওয়ালা । গোবিন্দ দুধ আনল, দাদু অপিস গেল, রোজকার মতোই । কিন্তু বাগানে নেমে দেখি অবাক কাণ্ড, পাতালরেলের গর্ত উধাও, নিপুণভাবে ঢাকা পড়েছে মাটি দিয়ে যেমন প্ল্যানে ছিল । সামনের বর্ষায় যখন ঘাস উঠবে তার ওপর, কে জানবে কী জগৎ আছে জবাগাছের নীচে !

    সেদিন দুপুর থেকে আমাদের শুরু হল পিচবোর্ড আর গঁদের আঠা দিয়ে এরোপ্লেন বানানোর কাল ।



  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments