• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৩২ | জানুয়ারি ২০০৪ | গ্রম্থ-সমালোচনা
    Share
  • `রাজদ্রোহী ভ্রাতৃদ্বয়' - লিওনার্ড গর্ডনের একটি বইয়ের আলোচনা : রণনবিহারী বন্দ্যোপাধ্যায়

    শ্রী লিওনার্ড গর্ডন-এর `ব্রাদার্স এগেনসট দি রাজ - এ বাইওগ্রফি অফ ইণ্ডিয়ন ন্যাশনলিস্টস শরৎ এণ্ড সুভাষ চন্দ্র বোস' বইখানার খবর আমাকে দিয়েছিলেন সিলভর স্প্রিং-নিবাসী আমার অগ্রজপ্রতিম শ্রীজগদীশ শর্মা । বইখানা পাড়ার লাইব্রেরিতে স্বভাবতই পেলাম না । তবে ওনারাই আবার খোঁজ করে রাটগার্স বিশ্ববিদ্যালয়ের পুস্তকাগার থেকে আনিয়ে দিলেন । পাতা উল্টে প্রথমেই লক্ষ করলাম যে নেতাজি সুভাষ সম্বন্ধে বহু প্রয়োজনীয় কথা আমার জানা নেই । বই দীর্ঘ - দু-সপ্তাহের কর্ম নয় । আমাজনে অর্ডার দিলাম - নিউ ইয়র্ক য়ুংউনিভার্সিটি প্রেসের প্রকাশনা : হয়তো সেই কারণেই পেতে দেরি হতে লাগল । ইতোমধ্যে `পরবাস' বইটার ভারতীয় সংস্করণ আনিয়ে দিলে দেশের রূপা কোম্পানি থেকে ।

    লেখক ন্যু ইয়র্কের ব্রুকলিন কলেজের অধ্যাপক । কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের দক্ষিণ এশিয়া গবেষণা কেন্দ্রের অধ্যক্ষ । বইটা লিখতে ওনার বহুদিন লেগেছিল, সে পরিচয় তিনি নিজে যদি বা ভুমিকাতে নাও দিতেন, কত লোকের সঙ্গে কথা বলতে হয়েছে, কত দেশে যেতে হয়েছে, সেই তালিকাটুকু পড়লেই আন্দাজ হবে । এ-বই জোড়াতালি দিয়ে লেখা নয় । গভীর শ্রদ্ধা নিয়ে লেখা । এ বাবদ বসু-পরিবারের সঙ্গে লেখকের ঘনিষ্ঠতা ঘটেছে । সেই নিয়ে দেশের যাঁরা সি.আই.এ. বিশারদ (এবং বসু পরিবারের কিছু পরশ্রীকাতর জ্ঞাতি) তাঁরা ওনাদের নামে কুত্সাও কিছু রটিয়েছেন, সে কাহিনীও পড়তে হোল কিছু এই বইতেই ।

    কিন্তু এহ বাহ্য । বইটি আমার যত্পরোনাস্তি ভাল লেগেছে বলে এত অবান্তর কথা এসে গেল । হয়তো আরো আসবে - এটা শুধুংউ বইএর কথা নয় - কিছুটা আমারও কথা হয়তো ।

    বর্তমান যুগের বাঙালিরা নেতাজি সুভাষ সম্বন্ধে কতটুকু জানেন সে খবর আমার জানা নেই । আমার নিজের জ্ঞান সীমিত । দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর ভারতবর্ষের লোক আজাদ হিন্দ বাহিনীর কথা প্রথম ভাল করে জানতে পারে (যুদ্ধের সময়ে কিছু আজাদ হিন্দ-কৃত বেতারবার্তা কেউ কেউ শুনেছিলেন নিশ্চয়, কিন্তু তাঁরা আমার পরিচিত ছিলেন না) তখনকার উত্তেজনা ও গৌরববোধের কথাটাই মনে গাঁথা আছে (এই কাহিনীর রাজনৈতিক ফলের কথা এ প্রবন্ধের শেষে আসবে - হয়তো একালের লোকেরাও জানেন ; তবে এ কাহিনী লোকে জানুক, এটা বহু শক্তিশালী লোকের ইচ্ছা নয়) । এছাড়া এর আগে হরিপুরায যখন নেতাজিকে সর্বভারত কংগ্রেসের সভাপতি হিসাবে সম্বর্ধনা করা হোল এবং পরের বছর ত্রিপুরী কংগ্রেসে যখন নির্বাচিত সভাপতি হওয়া সত্ত্বেও তাঁকে নানা কলে ফেলে সভাপতিত্ব থেকে পদত্যাগ করতে প্রায় বাধ্য করা হোল, সেই সময়ে আমার দাদার উত্তেজনার কথা আমার মনে আছে (আমার বয়স তখন দশ-এগারো বছর) । কবে তিনি নাকি প্রেসিডেন্সি কলেজের কোন ইংরেজ অধ্যাপককে চটিপেটা করেছিলেন, সে গুজবও কানে গেছিল (গর্ডন-সাহেব ও ঘটনাটা নিয়ে গবেষণা করেছেন এ-বইয়ে - কতটা গুজব ও কতটা সত্য সে মীমাংসা হয়নি) । নেতাজির জীবন নিয়ে দুটি ভিডিও টেপও পাওয়া যায় । একটা `দি রেবেল অ্যাণ্ড দি রাজ' (কার তৈরি আর মনে নেই - বসু পরিবার এতে প্রচুর সাহায্য করেছিলেন, এটুকু জানা আছে) ও বি. বি. সি'র তৈরি `দি লীপিং টাইগার' । এ-দুটিতেও ওনার যুদ্ধকালীন কাজ ও আজাদ হিন্দ সরকার (আর্জী হুকুমৎ এ আজাদ হিন্দ) ও বাহিনীর কথাই বেশি । ওগুলো কী করে কোথায় পাওয়া যায় আমার জানা নেই - ক্লীভল্যাংআণ্ডের বন্ধু শ্রী মিহির দত্ত আমাকে কপি করে দিয়েছিলেন ।

    পীযূষ বসুর বাংলা সিনেমা, `সুভাষচন্দ্র' অধুনাকালে দেখেছি । চলচ্চিত্র হিসাবে তার উত্কর্ষ সম্বন্ধে মন্তব্য করার জায়গা এটা নয় । তবে এতে এমন কিছু নেই যা গর্ডন-সাহেবের বইয়ের সঙ্গে মেলে না । তবে এমন অনেক কথা আছে যা গর্ডন-সাহেবের বইয়ে নেই । সেগুলো হয়তো সুভাষচন্দ্রের আত্মজীবনী থেকে পাওয়া । সে আত্মজীবনী থেকে গর্ডন-সাহেব অবশ্যই সব কিছু তোলেননি । দু-এক জায়গায় (যেমন সুভাষের কলেজে ভর্তি হওয়ার ব্যাপারে আশুংউতোষ মুখোপাধ্যায়ের প্রভাব) চলচ্চিত্রে অত্যুক্তি হয়তো একটু আছে, কিন্তু সে ধর্তব্য নয় । সিনেমাটি যথার্থ । চলচ্চিত্রটি সুভাষচন্দ্রের বাল্যকাল থেকে আরম্ভ হয়ে শেষ হয়েছে ওনার প্রথম গ্রেপ্তারি (১৯২১) পর্যন্ত ।

    কিন্তু এসব সত্ত্বেও ভারতের ও বাংলার রাজনৈতিক আকাশে নেতাজির এবং শরৎ বাবুর ত্রক্রম-উথ্থান, কলকাতা কর্পোরেশনের মেয়র ও অল্ডরম্যান পদে তাঁঁদের কাজ ও আদর্শবাদের উথ্থান, এ সবই আমার অজানা রয়ে যেত যদি এ বইখানি আমি না পড়তে পেতাম ।

    এ বই প্রধানত সুভাষচন্দ্র সম্বন্ধে - ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের পটভুমিকায় । সেইসঙ্গে সেই সংগ্রামে শরত্চন্দ্রের দানের কথা আসেই - বসু পরিবারের ধারক ও সুভাষচন্দ্রের পোষক হিসাবে শুধুংউ নয়, সংগ্রামের একজন নেতা হিসাবেও তাঁর দানের পরিচয় লেখক বিস্তৃতভাবে দিয়েছেন ।

    এ-প্রসঙ্গে একটা কথা আমার পক্ষ থেকে বলে নেয়া দরকার । স্বাধীনতা সংগ্রাম যেকালে ইংরেজ সরকারের বিরুদ্ধে, তখন ভারতের শাসক হিসাবে ইংরেজদের অন্যায়গুলোর কথাই এ আলোচনায় আগে আসবে । কিন্তু এই ইতিহাসে এটাও পদে পদে দেখা যাবে যে ভারতের স্থাথনীয় শাসন এবং সে-সংক্রান্ত আইন প্রণয়নের ভার ইংরেজরা ভারতীয়দের হাতে যখনই পারে দেবার চেষ্টা করেছে । সেটার সঙ্গে নানা বাধ্য-বাধকতা জড়ান থাকত নি:সন্দেহে (লোকে বলত, `সর্বস্ব তোমার, চাবিকাঠিটি আমার') এবং এই আপাত-স্বাধীনতার পেছনে কতটা মত্লববাজি থাকত, সে বিতর্ক অবশ্যই করা যায় । তবে ভারতের সমাজব্যাবস্থার ইতিহাসে ইংরেজ শাসনকালের একটা মঙ্গলকর ছাপ যে আছে, এটা আমি ব্যক্তিগত ভাবে বিশ্বাস করি । এ-প্রবন্ধ সে-সম্বন্ধে নয় - কাজেই ইংরেজ শাসনের খারাপ দিকটাই এখানে চোখে পড়বে । সেটা ভুল কিছু নয়, তবে নিরপেক্ষও নয় ।

    লেখক শুরু করেছেন বসু পরিবারের আদি নিবাস কোদালিয়া গ্রাম ও নেতাজির পিতামহ হরনাথ বসুকে নিয়ে । বসুপরিবারের সঙ্গে কটক শহরের সম্পর্ক হরনাথ বসুর ছেলে দেবেন্দ্রনাথের মাধ্যমে - দেবেন্দ্রনাথ সরকারি শিক্ষা পরিষদের কর্মী হিসাবে কৃষ্ণনগর কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন, পরে কটকে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন । তাঁর ভাই জানকীনাথ কটকের রাভেনশ কলেজ থেকে পাশ করেন । জানকীনাথের বিবাহ হয় হাঠখোলার দত্ত পরিবারের প্রভাবতী দেবীর সঙ্গে । জানকীনাথ শরত্চন্দ্র ও সুভাষচন্দ্র বসুর পিতা ।

    হরনাথ বসুর সব ছেলেরাই (দেবেন্দ্রনাথ, জানকীনাথ, যদুনাথ ও কেদারনাথ) ইংরেজি শিক্ষিত এবং সবাই ইংরেজের অধীনে নানা কাজ করে প্রতিষ্ঠিত হন । ফলে ইংরেজ সরকারের কেন্দ্র কলকাতার সঙ্গে ঐ পরিবারের যোগ তখন থেকেই । জানকীনাথ মেট্রোপলিটন ইনসটিট্যুশন থেকে ওকালতি পাশ করে কটকে ওকালতি শুরু করেন । পরে সরকারি উকিলের পদ পান । কটকের ভারতীয় ও ইংরেজ সমাজে তাঁর প্রতির্পংইত্ত ছিল । ইংরেজি সংস্কৃতির সঙ্গে বাংলার ঘনিষ্ঠতা এই সময়ের থেকেই শুরু । জানকীনাথ `সাহেব মানুষ' ছিলেন । ঘোর সাহেব নয় । কোদালিয়ার দেশের বাড়ির সঙ্গে তাঁর পুরো যোগ ছিল । দেশের লোকের সঙ্গেও ছিল । তখনকার ধনীসমাজের লোকেদের মতো তিনিও দানে ও পরোপকারে মুক্তহস্ত ছিলেন । কিন্তু ওদের বাড়ির সাহেবিয়ানা পরবর্তী প্রজন্ম পর্যন্ত চালু ছিল এবং এখনো আছে - কলকাতার উচ্চ মধ্যবিত্ত লোকের সংস্কৃতির সঙ্গে ওটা এখন ওতপ্রোত হয়ে গেছে বলে আমার ধারণা (আমি নিজে এই সংস্কৃতির মধ্যেই মানুষ) । তখনকার ইংরেজি-শিক্ষিত লোকের কাছে এটা স্পষ্ট ছিল যে ভারতের (বিশেষ বাংলার) তখনকার সংস্কারগুলো দেশের ক্ষতি করছে এবং ইংরেজের কাছে তাঁদের অনেক শেখার আছে । জানকীনাথ বাংলার আইনসভার সদস্য হিসাবে মনে করতেন যে ইংরেজি গণতান্ত্রিক প্রথায় দেশশাসনের পথে ভারতের পদক্ষেপ শুরু হয়েছে । শরত্চন্দ্র বড় হয়ে এই পথেই চলেছিলেন শেষ পর্যন্ত - কিন্তু ইংরেজের পরোপকারিতার ওপর বিশ্বাস ঐ পরিবার থেকে সরে গিয়েছিল জানকীনাথের পর থেকেই । হয়তো তার শুরু সুভষচন্দ্রকে দিয়েই ।

    কিন্তু সে গল্প পরে । বইটার চুম্বক দিতে হলে, সেটাই প্রধানত আমি করতে চাইছি, আবার জানকীনাথে ফিরে যেতে হবে ।

    জানকীনাথের ছেলেমেয়েদের নাম প্রমীলা, সরলা, সতীশচন্দ্র, শরত্চন্দ্র, সুরেশচন্দ্র, সুধীরচন্দ্র, সুনীলচন্দ্র, তারাবালা, সুভাষচন্দ্র, মলিনা, প্রতিভা, কনকলতা, শৈলেশ, সন্তোষ । পরবর্তী একটি সন্তান শিশুবয়সে মারা যায় । আমাদের গল্পে অবশ্যই এঁদের সকলের স্থান সমান নয় । গর্ডন-সাহেব বিদগ্ধতার খাতিরে পুরো তালিকা দিয়েছেন । তাছাড়া মা প্রভাবতী দেবী যে চোদ্দবছর বয়স থেকে সাঁইত্রিশবছর বয়স পর্যন্ত তেইশ বছরে পনেরটি (গর্ডন-সাহেব লিখেছেন চোদ্দ, কিন্তু আমার হিসাবে মিলছে না) সন্তান প্রসব করেছিলেন সেটা ওনার পাশ্চাত্য চোখে বোধহয় খুব বেশি ঠেকেছিল (অবশ্য পাশ্চাত্যদেশেও একশ বছর আগে এটা খুব বিস্ময়কর ছিল না - আজও মার্কিন ক্যাথলিক সমাজে কোন বাড়িতে চোদ্দটি ছেলেমেয়ে খুব একটা বিস্ময়কর কথা নয়) ।

    আসল গল্প শরত্চন্দ্র ও সুভাষচন্দ্রকে নিয়ে । অন্যান্য দু-একজন ভাইএর কথা কখনো কখনো এসে পড়তে পারে - এখন তোলা থাক । শরত্চন্দ্র মেধা ও উত্সাহে দাদা সতীশচন্দ্রকে ছাড়িয়ে গেছিলেন খুব অল্প বয়সে । দু-ভাইই প্রেসিডেন্সি কলেজের ছাত্র । দুই ছেলে কলকাতায়, জানকীনাথ নিজে আইনসভার সঙ্গে সম্পর্কিত । বসুপরিবারের ভারকেন্দ্র বিংশ-শতকের গোড়া থেকেই কটক থেকে কলকাতায সরে আসতে লাগল । ১৯০৯ সালে সতীশ্চন্দ্র ও শরত্চন্দ্রের বিবাহের অল্প আগে ওদের এলগিন রোডের প্রথম বাড়ি তৈরি শেষ হয় ।

    শরত্চন্দ্রের স্ত্রীর নাম বিভাবতী । ১৯১০ সালে শরত্চন্দ্র বি.এল. পাস করেন দাদা সতীশচন্দ্রের এক বছর আগে । শরত্চন্দ্র কটকে ও সতীশচন্দ্র কলকাতায় ওকালতি শুরু করেন । বাবার সঙ্গে এক আদালতে কাজ করার সময় শরত্চন্দ্র ওখানকার ইংরেজ বিচারকদের সুনজরে পড়েন । তাঁরাই জানকিনাথকে বলেন ছেলেকে বিলাত পাঠিয়ে ওকালতি পড়াতে, এমন কথা চলিত আছে । বড়ছেলেকে ডিঙিয়ে মেজছেলেকে বিলাতে পাঠানোর এটা হয়তো কারণ । ১৯১২ সালে স্ত্রী ও সদ্যজাত পুত্র অশোককে রেখে শরত্চন্দ্র বিলাত গেলেন । তার এক বছর পরে সুভাষচন্দ্র কটকের রাভেনশ কলেজিয়েট স্কুল থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে দ্বিতীয় স্থান নিয়ে পাশ করেন । ১৯১৩ সালে অগ্রজদের পদানুসরণ করে প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হন । ১৯১৪ সালে শরত্চন্দ্র বিলেত থেকে পাশ করে এসে কলকাতাতে ওকালতি শুরু করেন । ওনার জীবনের সঙ্গে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ও সুভাষচন্দ্রের জীবনের নানা সংযোগ গর্ডন-সাহেব এ-বইতে প্রচুর আলোচনা করেছেন - আগেই বলেছি, বইটা ওনার সম্বন্ধেও ।

    সুভাষচন্দ্রের চরিত্রের বৈশিষ্ট্য তার আগের থেকেই স্পষ্ট হয় । দাদারা বংশের প্রথামতো ইংরেজি শিক্ষার ও ইংরেজরাজের অধীনে কাজ করার দিকেই এগোচ্ছিলেন । কিন্তু বসু পরিবারের র্ভিংইত্তগত শাক্তধর্ম ওদের মধ্যেও ছিল (শরত্চন্দ্রের গীতানুরাগের কথা পরে আসছে) । কিন্তু সুভাষ অল্পবয়স থেকে ধর্মানুরাগী হয়ে পড়েন ।

    রাভেনশ স্কুলে সুভাষচন্দ্র এসেছিলেন ১৯০৯ সালে - বারো বছর বয়সে । এর আগে সাহেব জানকীনাথের ছেলে পড়েছিলেন কটকের প্রটেস্ট্যান্ট য়োরোপিয়ান স্কুলে । ইংরেজি ভাষা থেকে ইংরেজি মতবাদে তখন তাঁর হাতেখড়ি । এদিকে বাড়ির হাওয়া দু-মিশালি । সকালে খাওয়া হয় মাটিতে, রাত্রে বাবা এলে টেবিলে । মা বাংলা ছাড়া বলেন না । বাড়িতে মহভারত রামায়ণ পড়াও হয় । সুভাষচন্দ্র বাংলা বলতেন, কিন্তু স্কুলের পথ্যের মধ্যে বাংলাও ছিল না, ভারতীয় ঐতিহ্যের সঙ্গে পরিচয়ের কোন পথও ছিল না । রাভেনশ স্কুলে এসে সব বদলে গেল । শিক্ষক বেণীমাধব দাসের আওতায় সুভাষচন্দ্র দেশের হাওয়া বেশি করে পেলেন । মাকে ভালবাসতেন - নিজের মধ্যে মাতৃধর্ম ছিল - বাড়িতে ফুলগাছের যত্ন নিতেন । বাবা ব্রাহ্মদের কথা বেশি ভাবেন, মা কালীভক্ত । সুভাষ ঝুঁকলেন মায়ের দিকে । রামকৃষ্ণের কথা জানলেন । বিবেকানন্দর মধ্যে ধর্ম আর সেবার সমন্বয় তাঁকে সেই ছোট বয়সেই টানল । দেশের কথা ভাবতে আরম্ভ করলেন । আনন্দমঠ পড়ে উদ্বুদ্ধ হলেন । স্কুলে মাষ্টারমশায়দের কাছে বেদ উপনিষদের খোঁজ পেলেন ।

    বইখানার দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ পড়ে আমার ধারণা হয়েছে যে সুভষচন্দ্র যদি নেতাজি না হতেন, তাহলেও আমাদের জাতীয় জীবনের কোথাও না কোথাও তাঁর বৃহৎ দান থাকতো । স্কুলে থাকতেই বাড়িতে লুকিয়ে গ্রামে গিয়ে কলেরা রোগীর সেবা করে এসেছেন । একটা ছুটিতে বাড়ি পালিয়ে উত্তরভারত ঘুরে গুরু খুঁজেছেন (ওরকম গভীর চিন্তাশীল মন যার, তার পক্ষে তথাকথিত গুরু পাওয়া শক্ত - উনি পাননি) । ভারতীয় ও য়ুরোপীয় দর্শনশাস্ত্র পড়তে আরম্ভ করেছেন ।

    কিন্তু আনন্দমঠ পড়া জ্যান্ত ছেলের সুখে থাকার পথ সরল নয় । প্রেসিডেন্সি কলেজের সাহেব অধ্যাপকরা সবাই যে ভারতের ঐতিহ্যকে চিনতেন বা শ্রদ্ধা করতেন তা তো নয় - ইতিহাসের অধ্যাপক ওটেন সাহেব একদিন ক্লাসে বললেন যে গ্রীকরা যেমন পুরাকালে যেসব অসভ্য জাতির সংস্পর্শে এসেছিল, তাদের গ্রীক সভ্যতার আলো দিয়েছিল, তেমনি ভারতীয়দের সভ্য করার ভার পড়েছে ইংরেজের ওপর । ছাত্রসমাজে এই নিয়ে যে বিক্ষোভ দেখা দিল, তার অন্যতম হোতা হলেন সুভাষচন্দ্র । তবে কলেজের সিঁড়িতে ওটেন সাহেবকে যাঁরা চটিপেটা করেছিলেন, তাঁদের মধ্যে সুভাষ ছিলেন কিনা সে সম্বন্ধে সাক্ষাৎ প্রমাণ কিছু নেই (পরবর্তী কালে ওটেন সাহেব আত্মজীবনীতে নাকি লিখেছেন ব্যাপারটার সম্বন্ধে সব কথা তাঁর মনে নেই, তবে এতবড় একটা লোকের কাছে যদি মার খেয়ে থাকতেন, তাহলে নিশ্চয় তিনি ভুলতেন না)। যাই হোক, উচক্কা ছাত্র হিসাবে আগেই নাম কিনে ফেলেছিলেন - এ-ব্যাপারে যাদের কলেজ থেকে ছাড়িয়ে দেয়া হোল, সুভাষ তার মধ্যে অন্যতম ছিলেন । এটা ১৯১৬ সালের ঘটনা ।

    সুভাষের কাণ্ডকারখানা সম্বন্ধে মেজদার কিছু সহানুভূতি ছিল, বৌদি বিভাবতীর সমর্থন তো ছিলই, মা প্রভাবতীর সঙ্গেও সুভাষ চিরদিন পত্রালাপ করেছেন, নিজের মনের কথা জানিয়েছেন । তাঁরও মত ছিল ছেলে সহজে অন্যায় কিছু করবে না । জনকীনাথকে বোঝাবার ভার মেজোছেলে (শরত্চন্দ্র) নিয়েছিলেন খুব সম্ভব ।

    সুভাষচন্দ্র কলকাতা ছাড়লেন কিছুদিনের জন্য । কিন্তু কটকেও ওনার চরিত্রের পরিচয় একই রকম রইল । কলেজে ভর্তি হওয়া ছেলেদের বাসস্থান পেতে অসুবিধা হয় দেখে বাবার কাছ থেকে ওনার একটা বাড়ি সেই কাজে ব্যবহার করার অনুমতি পেলেন । তথাকথিত অস্পৃশ্য বর্ণের ছাত্রের কলেজে ভর্তি হওয়া নিয়ে রাভেনশ কলেজের সঙ্গে তর্কে নামলেন এবং জিতলেন । আতুরের সেবার কাজ ঘাড়ে নিলেন ।

    এই করে দুবছর গেল । শরত্চন্দ্র ও জানকীনাথের ইংরেজ সমাজে প্রতির্পংইত্ত ছিল । তাঁদের ও ভাইস-চ্যান্সেলর স্যার আশুতোষের যুগ্ম চেষ্টায় কলকাতার কলেজ কর্তৃপক্ষ শেষ অবধি সুভাষকে স্কটিশ চার্চ কলেজে পড়বার অনুমতি দিলেন - প্রেসিডেন্সিতে পড়া আর সম্ভব হোল না । তাতে ক্ষতি খুব হোল না । কলেজের দার্শনিক সমিতিতে সুভাষ বস্তুতন্ত্রের সপক্ষে ও বিপক্ষে বক্তৃতা করে দুবারই প্রশংসা পেলেন ।

    এছাড়া আরো একটা কাজে ভিড়লেন যেটা ওনার পরবর্তী জীবনের আভাস দেয় । বিশ্বমহাযুদ্ধের শেষাশেষি সময়ে ইংরেজ সরকার ভারতীয় ছাত্রদের জন্য প্রথম সামরিক শিক্ষার ব্যাবস্থা করেন । সুভাষ এতে যোগ দিলেন এবং সসন্মানে উত্তীর্ণ হলেন । বি. এ. পরীক্ষায় দর্শনশাস্ত্রে প্রথম শ্রেণীতে পাশ করলেন । এম. এ.-তে ওনার ইচ্ছা ছিল পরীক্ষামূলক মনস্তত্বে পড়াশুনো করবেন । কিন্তু ওনার বাবা চাইলেন কৃতি ছেলে বিলেত গিয়ে আই. সি. এস. এর পড়া করে পরীক্ষা দিয়ে আসুক ।

    বাবার সব কথা ঠেলার ইচ্ছা বা সাহস তখনকার দিনের কম ছেলেরই থাকত (সব সময়ে থাকা ভালোও নয়) । সুভাষচন্দ্র বিলেত গেলেন । সেখানেও ইংলণ্ডের ভারতীয় ছাত্রমহলে নেতৃত্বের স্থান নিলেন - ওদের নানা সুবিধার জন্য সরকারে দরবার করলেন (নেতৃত্ব ও বিদ্রোহ ওনার স্বভাবের মধ্যে ছিল) । এবং এসব করেও আই. সি. এস পরীক্ষায় চতুর্থ স্থান নিয়ে পাশ করলেন । এর সঙ্গে সঙ্গে কেম্ব্রিজে ট্রাইপসের পড়া চলতে লাগল ।

    এইবার সুভাষের তৃতীয় বিদ্রোহ । ইংরেজ সরকারের অধীনে সসম্মান মোটা মাইনের চাকরিতে তাঁর মন কোনদিনই ছিল না । এবার ওটার মুখোমুখি দাঁড়াতে হোল । সে-সময়ের মানসিক দ্বন্দ্বের পরিচয় ওনার দাদা, মা বন্ধু-বান্ধবদের কাছে লেখা চিঠিতে প্রচুর পাওয়া যায় । শেষ অবধি তিনি লর্ড মন্টেগুকে চিঠি দিয়ে অনুরোধ করলেন যে আই. সি. এস. এর জন্য পরবর্তী শিক্ষার্থীদের তালিকা থেকে ওনার নাম সরিয়ে দিতে ।

    দেশে সেই সময়ে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন কাজে নেমেছেন । সুভাষ তাঁর কাছে উপদেশ চাইলেন । তিনি ওনাকে উত্সাহ দিলেন কেম্ব্রিজের পরীক্ষার পর দেশে ফিরে আসতে ।

    এইখানে সুভাষচন্দ্রের জীবনের প্রথম পরিচ্ছেদের (এবং বইয়ের দ্বিতীয় পরিচ্ছেদের) সব দ্বন্দ্বের শেষ । পুরোপুরি দেশের কাজে নামলেন এখন থেকে । বাড়িতে ফিরে শরত্চন্দ্রের ও বিভাবতী দেবীর বাড়িতে স্থান নিলেন । শরত্চন্দ্র তখনো পর্যন্ত নিজের ব্যাবসাতেই যুক্ত ছিলেন । উন্নতি করেছিলেন । কার্সিয়ংএ বাড়ি তিনি এই সময়েই কেনেন এবং এলগিন রোডের দ্বিতীয় বাড়িও এই সময়ে তৈরি হয় । কিন্তু বাংলার অসহযোগ আন্দোলনে তাঁর সহানুভুতি ছিল । পরিবার প্রতিপালন ছাড়া অর্থ সংগ্রহের কোন প্রয়োজন তিনি কোনদিন দেখেননি । তদানিন্তন ধনীলোকেদের মতো পুরো সাহেবিয়ানাও তাঁর কোনদিন ধাতস্থ হয়নি । পুরাকালের মতোই বাইরে ইংরেজি, বাড়িতে দেশি কায়দাই চলছিল । অর্থাৎ সুভাষচন্দ্রের পথে নামবার রাস্তা ততদিনে জানকীনাথ ও শরত্চন্দ্রের জন্যও তৈরি হয়ে ছিল ।

    সুভাষচন্দ্র বোম্বাইয়ে নেমে মহাত্মা গান্ধীর সঙ্গে সর্বপ্রথমে দেখা করেন । ওনার প্রযুক্তির প্রথম ধাপে কীভাবে কাজ শুরু হবে এবং শেষ ধাপে কীভাবে ইংরেজশাসন লুপ্ত হবে সে-সম্বন্ধে খুঁটিয়ে প্রশ্ন করেন । ওনার সব উত্তর সুভাষের মন:পূত হয়নি । অহিংসা শুধু স্বাধীনতার পথে পাথেয়মাত্র নয়, পথটাই ভবিষ্যতের জন্য মস্ত আরব্ধ, এ কথা মানতে তাঁর দ্বিধা ছিল । ওনার মধ্যে শাক্ত ও বৈষ্ণব প্রভাব দুইই ছিল, কিন্তু কালীভক্তের বৈষ্ণবতা বোধহয় ঠিক চৈতন্য-মার্কা হতে পারে না । গীতার কৃষ্ণ প্রেমময় যতই হোন - কংসবধ তাঁর হাতেই হয়েছিল । সুভাষচন্দ্র জানতেন যে গায়ের জোর না দেখালে ইংরেজ যাবে না ।

    মহাত্মার সঙ্গে এই মতদ্বৈধ ওনার একার নয় । এটা বোঝাবার জন্য এবং সুভাষচন্দ্রের সঙ্গে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জনের সৌহার্দের মূল দেখাতে গর্ডন-সাহেব তৃতীয় পরিচ্ছেদের প্রথমে ভারতের জাগরণের ইতিহাসের চুম্বক দিয়েছেন ।

    স্মরণ রাখতে হবে যে উনবিংশ শতাব্দির শেষাশেষি যখন ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের স্থাপনা হয়, তখন সেটা ইংরেজি-শিক্ষিত ভদ্রলোকেদের একটা আলোচনাসভা মাত্র ছিল । ইংরেজ সরকার নিজের থেকে যেটুকু স্বায়ত্ব-শাসন ক্ষমতা দিয়েছে সেটুকু ভাঙিয়ে কতটুকু সুবিধা করে নেয়া যায় বা দেশের লোকের কতটা সুবিধা করা যায়, কল্পনা তার বেশি তখন যায়নি (শ্রী সুনীল গঙ্গোপাধ্যয় মশায়ের প্রথম আলো -তে এই সময়টার আলোচনা আছে - রবীন্দ্রনাথের, আমায় বোলনা গাহিতে গানটির সঙ্গে এই ইতিহাসের একটা সম্বন্ধ আছে বলে অধুনা জেনেছি) । মনে থাকতে পারে যে জানকীনাথ নিজে ইংরেজের আইনমণ্ডলীতে ছিলেন এবং কাজ করেছেন । স্বাধীনতা সংগ্রামের কথা তখনো ওঠেনি । তবে ১৯০৫ সালে ইংরেজ সরকার যখন বাংলা প্রদেশকে দুভাগে ভাঙবার ব্যাবস্থা করলেন, সেই সময়ের জাগরণ ইংরেজের বিরুদ্ধে প্রকাশ্য বিদ্রোহের রূপ নেয় (ইংরেজের এই সিদ্ধান্তর মূলে কী ছিল সে আলোচনা পরে করার প্রয়োজন হবে) । বাংলায় সশস্ত্র বিপ্লব সেই সময়ে শুরু এবং দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জনের নাম তখন থেকেই ভারতের সংগ্রামের সঙ্গে জড়িয়ে যায় । ঐ সময়ে ইংরেজ সরকার অরবিন্দ ঘোষের (বিপ্লবী বারীণ ঘোষের ভাই, পরবর্তীকালে পণ্ডিচেরির শ্রীঅরবিন্দ) বিরুদ্ধে যে মামলা আনে, সেখানে অরবিন্দের পক্ষে সরকারের বিরুদ্ধে ওকালতি চিত্তরঞ্জন করেন । উকিল হিসাবে সুপ্রতিষ্ঠিত তিনি আগেই ছিলেন । এখন থেকে বিপ্লবীদের প্রতি সহানুভুতি এবং স্বাধীনতা সংগ্রামের সঙ্গে তাঁর প্রত্যক্ষ যোগের শুরু ।

    ভারতের রাজনৈতিক ক্ষেত্রে গান্ধীজির প্রবেশ ১৯১৫ সালে । ভারতে গণজাগরণ ও ভারতের স্বাধীনতার কল্পনা কংগ্রেসে সেইসময় থেকে চালু হয় । ১৯২০ সালের মধ্যে গান্ধীজির প্রভাব কংগ্রেসে দৃংঋঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হয় : প্রাদেশিক শাখার সংখ্যা অনেক বাড়ে । তবে এটাও স্বীকার্য যে কংগ্রেসের কাজের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ যেখানে অপরিহার্য, সেকালে এমন কিছু করা গান্ধীজির পক্ষে সম্ভব ছিল না যাতে ধনী লোকেদের তিনি উষ্মাভাজন হন । কাজেই কুলি-মজুরদের নেতৃত্ব থেকে কংগ্রেসকে দূরে থাকতে হয়েছিল । আমাদের গল্পে এর প্রভাব পড়বে কিছু পরে ।

    দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জনের সহানুভুতি যদিও সশস্ত্র-সংগ্রামের পক্ষে যথেষ্ট ছিল কিন্তু গান্ধীজির গণজাগরণ-প্রচেষ্টায় তিনি সম্পূর্ণরূপে যোগ দেন ; বাংলার কংগ্রেসের নেতৃত্ব তাঁর ওপরে স্বভাবত বর্র্তায় - বাগ্মিতায়, কর্ম-কুশলতায়, আদর্শবাদে উনি মহাত্মাজীর সমকক্ষ ছিলেন । ওনার দৃঢ় ধারণা ছিল যে স্বাধীনতার সঙ্গে পূর্ণ গণতন্ত্রের সম্বন্ধ অঙ্গাঙ্গী । প্রথম থেকেই তিনি গণজাগরণের পথে গেছিলেন । এবং এটা তিনি দেখতে পান যে বাংলার চাষীদের দলে পেতে হলে তাঁকে অনেকটা মন দিতে হবে বাংলার মুসলমান চাষীদের দিকে, কারণ বাংলার দরিদ্র চাষীদের মধ্যে মুসলমানের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি । হিন্দু-মুসলমানের একতা কংগ্রেসের আদর্শের মধ্যে পড়ে - কাজেই এই ব্যাপারে উনি কংগ্রেসের পূর্ণ সমর্থন পান ।

    বাংলার মুসলমানের ইতিহাস সহজ নয় । পূর্ব বাংলার চাষীরা মুসলমান - জমিদাররা হিন্দু । বাংলার নেতাদের মধ্যে অনেকেই উচ্চবর্ণের হিন্দু । উচ্চশ্রেণীর মুসলমান যাঁরা, তাঁরা নিজেদের বাঙালি না ভেবে আরব-তুর্কীদের উত্তরাধিকারী বলেই মনে করেন । উর্দু যারা বলে না, সে মুসলমান তাঁদের সমাজে ব্রাত্য । কাজেই এ ব্যাপারে চিত্তরঞ্জনের কাজ কঠিন হতে বাধ্য । ভারতের ইতিহাসে এর প্রভাব দূরপস্রারি, একথা আমরা আজ পুরোই উপলব্ধি করতে পারি - কিন্তু আমাদের গল্পে বর্তমানে এটুকু গৌণ রাখা যেতে পারে । পরে কিছুটা জানতে হবে নেতাজির গল্পের অঙ্গ হিসাবে । শুধুংউ এটুকু বলে রাখা ভাল যে বাংলার মুসলমানের সঙ্গে হিন্দুর একতার এই অভাবটাকে ইংরেজরা নিজেদের কাজে ভালই লাগাতে পেরেছিলেন (এবং সেটাকে সমদর্শিতার উদাহরণ বলে নিজেদের পিঠ প্রচুর চাপড়েছিলেন - দোষ দেয়া যায় না)। এ-প্রসঙ্গে বাংলাবিভাগ এবং মুসলিম লীগের প্রথম প্রতিষ্ঠার কথা ওঠে ।

    বাংলা-বিভাগের কারণ হিসাবে ইংরেজ সরকার দেখিয়েছিলেন শাসনকার্যের সুবিধা : কিন্তু হিন্দু পশ্চিম-বাংলা ও মুসলমান পূর্ব-বাংলাকে আলাদা করে দেয়ার ইচ্ছা এর পিছনে কিছুটা কাজ করেছিল, এ সন্দেহ করলে বোধহয় অবিচার হবে না । উর্দুভাষী মুসলমানদের হাতে বাঙালি মুসলমানদের নেতৃত্ব চলে গেল যখন ইংরেজ সরকার মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠায় সাহায্য করলেন ।

    এ সত্বেও ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস হিন্দু-মুসলিম মৈত্রীর ব্যাপারে অগ্রণী হতে পেরেছিল প্রথম বিশ্বমহাযুদ্ধের সময়ে । তুর্কীর সঙ্গে ইংরেজের যুদ্ধ বহু মুসলমানের চোখে ধর্ম-যুদ্ধের রূপ নিয়েছিল । এই `খিলাফত্‌' আন্দোলনের সঙ্গে ভারতের স্বাধীনতা প্রচেষ্টাকে এক করে কংগ্রেসের সঙ্গে খিলাফৎ নেতাদের চুক্তি বহুদিন স্থায়ী হয়েছিল । বাংলায় চিত্তরঞ্জনও কিছু মুসলমান কৃষক নেতাদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে কাজ করতে পেরেছিলেন । ফজলুল হক এঁদের মধ্যে নাম করা ।

    সুভাষচন্দ্র যখন দেশে ফিরলেন তখন বিশ্বমহাযুদ্ধ শেষ হয়েছে । ইংরেজরা দেশের স্বাযত্ব-শাসনের অধিকার (যা জানকীনাথের সময়েও অল্পবিস্তর চালু হয়েছিল) বাড়িয়েছেন মন্টেগু-সাহেবের শাসনসংস্কারের পরে । কিন্তু সেইসঙ্গে সন্ত্রাসবাদীদের দাবাবার নাম করে ভারতের স্বাধীনতা-কর্মীদের ধরপাকড়ও শুরু হয়েছে নতুন রাওলট আইনের আওতায় । এর প্রতিবাদে গান্ধীজীর প্ররোচনায় অহিংস অসহযোগ শুরু হয়েছে । এই সুত্রে পাঞ্জাবের কুখ্যাত জলীয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ড ও তার প্রতিশোধে সুদীর্ঘ বিশ বছর পরে ইংলণ্ডে জেনেরল ওডায়ারের হত্যার কথা হয়তো অনেকে শুনেছেন । এই সময়ে চিত্তরঞ্জন সুভাষচন্দ্রকে নিজের দলে নিলেন । তাঁর মতো কর্মক্ষম ও উত্সাহী লোক পেয়ে দেশবন্ধুরও যেমন লাভ হোল, সুভাষচন্দ্রও একজন যথার্থ গুরু পেলেন । পরবর্তীকালে সুভাষচন্দ্রের মা বলতেন যে দেশবন্ধুর স্ত্রী বাসন্তী দেবীই যেন সুভাষচন্দ্রের মায়ের স্থান নিয়ে নিয়েছেন (সুভাষচন্দ্রের জীবনে মায়ের স্থান মস্ত ছিল, সে নিজের মাই হোন, মা কালীই হোন, দেশমাতৃকাই হোন, গুরুপত্নীই হোন - বহুদিন অবিবাহিত, ব্রহ্মচারী সুভাষচন্দ্রের প্রথম জীবনে মেয়েদের প্রভাব এইভাবেই পড়েছিল) ।

    দেশবন্ধু নবাগত সুভাষচন্দ্রকে বহু কাজের ভার দিলেন । তাঁর প্রতিষ্ঠিত `বাংলার কথা' পত্রিকার সম্পাদনা সুভাষচন্দ্রের ওপর বর্তাল । `বেঙ্গল ন্যাশনাল কলেজ'এর অধ্যক্ষর কাজ শুরু করলেন । স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর পরিচালনার ভার পেলেন ।

    ১৯০৫-এর বঙ্গভঙ্গ সংক্রান্ত অসহযোগ আন্দোলনের সময়ে বহু ছাত্র ইংরেজের চালানো কলেজে পড়া ছেড়ে দিয়েছিল । ১৯১৯ থেকে যে অসহযোগ আন্দোলনের শুরু হয় মহাত্মা গান্ধীর নেতৃত্বে,, বাংলার নায়ক হিসাবে চিত্তরঞ্জন তার ভার নিয়েছিলেন । সেসময়েও ইংরেজি কলেজ ছেড়ে ছাত্ররা অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দেয় । তাদের শিক্ষার ভার নেয় `ন্যাশনাল কলেজ' । সুভাষচন্দ্র যখন অধ্যক্ষ হলেন, তখন সে-উত্তেজনায় ভাঁটা পড়ে এসেছে - ছাত্রসংখ্যা প্রায শূন্যের ঘরে । সুভাষচন্দ্র খালি বেঞ্চের সামনে পড়াতে বসে কলেজের আয়-ব্যায়ের হিসাব করতেন । `বাংলার কথা'র কাজ হোত । এইসঙ্গে স্বাধীনতা-আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত `আত্মশক্তি' ও ইংরেজি `ফরোয়ার্র্ড' কাগজের সঙ্গেও তিনি সংশ্লিষ্ট হয়ে গেছিলেন । বাংলার সন্ত্রাসবাদী ছেলেরা এইসময়ে চিত্তরঞ্জনের অনুরোধে নিজেদের কাজ বন্ধ রেখে অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন । তাঁদের এবং অন্যান্য অসহযোগী ছেলেরা `বেঙ্গল ভলান্টিয়র'এ যারা ছিল, সুভাষ তাদের নেতা হিসাবে বিদেশি জিনিংএংএষর দোকানে হরতাল করতেন, স্কুল কলেজে ছাত্রদের, আদালতে উকিলদের ইংরেজের সঙ্গে সহযোগিতা ছাড়তে অনুরোধ করতেন দল বেঁধে । অক্লান্ত কর্মী হিসাবে ওর নাম ছড়িয়ে পড়েছিল কংগ্রেসের লোকেদের মাঝে ।

    ১৯২১ সালে কলকাতায় ইংলণ্ডের যুবরাজের আগমনের সময়ে যে হরতাল হয়, সেইব্যাপারে জড়িত থাকার অপরাধে চিত্তরঞ্জন ও সুভাষ দুজনেই গ্রেপ্তার হন । ওদের আটমাস কারাদণ্ডের আদেশ হোল ।

    ওনাদের কারাবাসের পরের কাহিনী লিখতে হলে ভারতের রাজনৈতিক পরিবেশের কিছু পরিবর্তনের কথা বলতে হবে । ওনাদের জেলযাত্রার আগে থেকেই অসহযোগিতা আন্দোলনে ভাঙন ধরছিল । যে স্বাধীনতার আশ্বাস দিয়ে মহাত্মাজী আন্দোলনের শুরু করেছিলেন, তাঁর নিজের কাছে তার সংজ্ঞা ছিল রাজনৈতিক স্বাধীনতার চেয়ে অর্থনৈতিক স্বাধীনতার দিকে বেশি ঘেঁষা । চরকা ও তাঁতের ব্যাবহার ঘরে ঘরে এনে ইংরেজি কাপড়ের ব্যাবসায়ের হাত থেকে দেশকে বাঁচান তার বড় উদ্দেশ্য ছিল - রাজনৈতিক স্বাধীনতার সঙ্গে তার সম্পর্কটা তিনি নিজেও বোধহয় পুরো যাচিয়ে দেখেননি । চিত্তরঞ্জন বা নেতাজি প্রমুখ লোকেদের আরব্ধ ছিল সারা দেশের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বাধীনতা । কৃষাণদের দলে নেওয়ার চেষ্টা যে তাঁরা শুরু করেছিলেন, সেকথা আগে বলেছি । জমিদার গোষ্ঠি তাতে খুশি হননি । মহাত্মাজী নিজে মজুরদের জাগরণের দিকে মন দিলে টাকা তোলার অসুবিধা হোত - কাজেই তিনি এব্যাপার থেকে দূরে ছিলেন । তাঁর দলের অনেক লোক রাজনৈতিক স্বাধীনতা বলতে দেশের উচ্চস্তরের লোকেদের স্বাধীনতাই বুঝতেন । কিন্তু মহাযুদ্ধের পরে রাশিয়ার বিদ্রোহের খবর দেশে পৌঁছেছিল । একদল লোক স্বাধীনতার চেযে কৃষাণ-মজুরদের শক্তিবৃদ্ধিটাকেই বড় করে দেখতে আরম্ভ করেছিলেন । বাল্যবন্ধু হেমন্ত সরকারের থেকে সুভাষচন্দ্রের পথ এইসময়ে আলাদা হয়ে গেল । কিন্তু মজদুরদের সংগ্রামে সুভাষচন্দ্র তাঁর গুরু চিত্তরঞ্জনের মতো পুরো জড়িয়ে না-পড়লেও তাঁর সহানুভুতি ছিল পুরো । নানা জায়গায়, তাঁর নানা বক্তৃতায়, তার প্রমাণ পাওয়া যায় ।

    ইংরেজ সরকার এই সময়ে অসহযোগ আন্দোলনের সঙ্গে আপোশ করবার জন্য গান্ধীজিকে বৈঠকে ডাকেন । মহাত্মাজি সে আমন্ত্রণ অগ্রারহ্য করেন । দেশবন্ধু তখন জেলে । এজন্য তিরস্কার করে তিনি মহাত্মাজিকে চিঠি লিখেছিলেন । এমনিতেই ওনার নেতৃত্বে বাংলায় যথেষ্ঠ খাদি উত্পন্ন হয়নি বলে কেন্দ্রীয় কংগ্রেসের সঙ্গে মনোমালিন্য হচ্ছিল, এই ব্যাপারের পরে বিভেদ আরো বেড়ে গেল । মন্টেগু-সংস্কারের ফল হিসাবে প্রাদেশিক আইনসভায় ভারতীয়দের প্রতির্পংইত্ত বাড়ার কথা, কিন্তু গান্ধীজি সেখানেও অসহযোগ করলেন । কংগ্রেসের কিছু নেতা সেকথা অমান্য করতে চাইলেন । জেল থেকে বেরিয়ে দেশবন্ধু ও সুভাষচন্দ্রও নতুন স্বায়ত্বশাসনে ভাগ নিতে বদ্ধপরিকর হলেন । আইনসভায় যোগদান করবার পক্ষে বাংলা কংগ্রেস রায় দিল, কিন্তু জাতীয় কংগ্রেস বাধা দিল (মহাত্মার কথার বিরুদ্ধে দাঁড়াবার ক্ষমতা জাতীয় কংগ্রেসে বহুদিন জন্মায়নি) । এর প্রতিবাদে দেশবন্ধু কংগ্রেসের সভাপতিত্ব ত্যাগ করলেন, তাঁর পুর্বতন `এক গেলাসের ইয়ার' মোতিলাল নেহরু (পণ্ডিত জবাহরলালের পিতা) সম্পাদকের কাজ ছেড়ে দিলেন । এইখান থেকে বাংলায় স্বরাজপার্টির জন্ম হোল । দেশবন্ধু বাংলা কংগ্রেসের সভাপতি রয়ে গেলেন ।

    প্রাদেশিক আইনসভায় তখন সভ্যসংখ্যা বেড়েছে । দেশবন্ধু বাংলার মুসলমান নেতাদের কথা দিলেন যে ওনার অধীনে যেসব চাকরি থাকবে (ক্রমশ প্রকাশ্য), তাতে মুসলমানদের সমানুপাতিক সংখ্যা নেবার চেষ্টা করা হবে । হিন্দু ক্ষমতাশালী লোকেরা প্রতিবাদ করলেন, কিন্তু এব্যাপারে দেশবন্ধু গান্ধীজির আশীর্বাদ পেলেন । সুরাবর্দি-প্রমুখ মুসলমান নেতাদের সাহায্যে স্বরাজপার্টির আইনসভায় ঢোকার পথ পরিষ্কার হোল ।

    আইনসভায় ওরা ইংরেজদের আনা নানা আইনের বিরোধিতা করলেন - কখনো জিতলেন, কখনো জিতলেন না । একটা ব্যাপারে সুবিধা পেলেন । ইংরেজরা কলকাতা কর্পোরেশনে ভারতীয়দের প্রভাব বাড়াতে দিতে তৈরিই ছিল, ওরা সেটাকে বেশ পোক্ত করে নিলেন । নির্বাচন সম্ভব হোল । নির্বাচনে দেশবন্ধু মেয়রের পদ পেলেন । শরত্চন্দ্র অল্ডারম্যান নির্বাচিত হলেন । রাজনীতির ক্ষেত্রে শরত্চন্দ্রের এই প্রথম সরাসরি পদক্ষেপ ।

    কর্পোরশনের `চীফ এক্সেক্যুটিভ অফিসর' হিসাবে নানা লোকের কথা ভাবার পরে দেশবন্ধু চাইলেন সুভাষচন্দ্রকে । সুভাষ প্রথমে আর্পংইত্ত করেছিলেন, `আই সি এসের কাজ ছেড়ে দিলাম কি কর্পোরশনের চাকরির জন্য ?' কিন্তু দেশবন্ধু ওনাকে বোঝালেন যে এ-কাজও দেশসেবার অঙ্গ । উনি তাঁর স্বাভাবিক কর্মকুশলতার সঙ্গে কাজে নেমে পড়লেন । কর্মসূচি যা নেয়া হোল, তা বর্তমানকালেও পুরো শেষ হয়ে ওঠেনি - কিন্তু সে-যুগে লোকে ওগুলো কল্পনাও করতে পারত না ।

    স্বাধীনতা সংগ্রামে সুভাষচন্দ্র কোনদিনই সন্ত্রাসবাদের পথ ধরেননি -- পথটাকে উনি উচিত বলে দেখেননি ; কিন্তু সন্ত্রাসবাদীদের দেশভক্তি ও বীরত্বকে চিরদিনই প্রকাশ্যে শ্রদ্ধা জানিয়েছেন । ওনার মত এসময়ে ছিল মোটামুটি এইরকম : দেশকে অস্ত্রবলে ছাড়া স্বাধীন করা কঠিন, কিন্তু দেশের বর্তমান পরিপ্রেক্ষিতে সেটা সম্ভব নয় - দেশও দুর্বল, গান্ধীজীও বাদ সাধবেন । আর জনগণের জাগরণ ভিন্ন স্বাধীনতা অর্থহীন, কিন্তু সেটাও বর্তমান পরিপ্রেক্ষিতে পুরো হয়নি । কাজেই জনসেবা, জনজাগরণের সঙ্গে সঙ্গে স্বরাজপার্টিতে ও কর্পোরেশনে কাজ করাই তিনি উচিৎ বলে মনে করেছিলেন ।

    ইংরেজ কিন্তু ওনাকে অন্য চোখে দেখেছে সবসময়ে । উনি সন্ত্রাসবাদীদের শ্রদ্ধা করেন । অতীব কর্মঠ লোক - যা করেন তা সম্পূর্ণ করে তবে ছাড়েন (সামরিক শিক্ষা পর্যন্ত) । তাছাড়া জেল থেকে ছাড়া পাওয়া সন্ত্রাসবাদিদের আর্থিক সাহায্য করতে কর্পোরেশনে প্রচুর চাকরিও দেওয়া হচ্ছিল মুসলমানদের ছাড়াও । কাজেই ওটুকু সন্দেহের ওপর র্ভিংইত্ত করে ১৯২৪-সালে তারা আবার ওনাকে গ্রেপ্তার করল । ভারতরক্ষা আইনে ব্যক্তিস্বাধীনতার স্থান বিশেষ ছিল না (বর্তমান ভারতীয় ও মার্কিন আইন যাঁরা নিজের চোখে দেখেছেন - এবং যেটা রক্ষা করতে এদেশে সিভিল লিবরটি যুনিঅন খরদৃষ্টি রেখে থাকে - তাঁরা স্বাধীন ও পরাধীন দেশের পার্থক্যটা দেখতে পাবেন । যেদেশে এই ব্যক্তিস্বাধীনতা নেই, বিদেশিদের শাসনে না থাকলেও সেদেশকে আমি অন্তত স্বাধীন বলব না - আর সেরকম দেশ দুনিয়ায় প্রচুর আছে) । মোটকথা, যাঁরা ওনাকে প্রমাণের অভাববশত খালাশ করার চেষ্টা করলেন, তাঁরা সফল হলেন না । এক বছরের মধ্যে কলকাতা থেকে ওনাকে মান্দালয়ে সরিয়ে ফেলা হোল ।

    কলকাতার জেলে থাকা কালে কর্পোরেশনের কাগজপত্র দেখার কাজ ওনাকে জেলে বসে করবার অনুমতি দেওয়া হয়েছিল, কিন্তু মান্দালয়ে চালান হওয়ার পরে সে-কাজ তিনি স্বভাবতই করতে পারেননি ।

    এবারে নেতাজি জেলে রইলেন তিন বছর । বর্মায় থাকার কালে নানা চিঠি ও প্রবন্ধে নিজের চিন্তা ও মত প্রকাশ করেছেন, তাতে তাঁর চিন্তার বিকাশ দেখা যাবে । গর্ডন-সাহেব নানা উদ্ধৃতি দিয়ে তার আলোচনা করেছেন । এইসব চিঠি বাড়িতে মেজদা (শরত্চন্দ্র), বৌদি (বিভাবতী), গুরুপত্নী (বাসন্তীদেবী)-কে লেখা । এর চর্বিতচর্বণ না করে এই সময়ের গুটিকয় গুরুত্ত্বপূর্ণ ঘটনার কথা বলে এ পরিচ্ছেদে দাঁড়ি টানব ।

    মান্দালয়ের জেলখানা খুব স্বাস্য্থকর জায়গা ছিল না । দেওয়াল ছাদ কাঠের বেড়া দিয়ে তৈরি । শীতাতপ নিবারণ সেখানে ভাল হোত না । বৃষ্টির ঝাঁটও আসত । সুভাষচন্দ্রের স্বাস্থ্য ভাঙতে শুরু করল । প্রথমটা কষ্ট হয়নি খুব । জেলজীবনের বিরক্তি আটকাতে খেলাধুলোর ব্যাবস্থা করলেন তাঁর স্বভাবসিদ্ধ নেতৃত্বের সঙ্গে । জেলের কর্তৃপক্ষের কাছে দুর্গাপুজা করার অনুমতি পেলেন শুধু নয়, কর্তৃপক্ষ এতে আর্থিক সাহায্যের প্রতিশ্রুতিও দিলেন । বাঙালির ছেলেরা কদিন মনেপ্রাণে বাঙালি হবার আনন্দ পেল । কিন্তু প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বিবাদ বাধল - টাকা দেওয়ার প্রতিশ্রুতিটা তাঁরা রাখলেন না । এর প্রতিবাদে সুভাষচন্দ্র একটা গান্ধী-মার্কা পথ নিলেন : অনশন শুরু করলেন (এই সম্বন্ধে পরবর্তী-কালে তিনি গান্ধীর নাম করেননি কেন আমরা জানি না) ।

    জেলখানার কর্তৃপক্ষ খবরটা চেপে যাবার চেষ্টা করেছিলেন প্রথমে । সে চেষ্টা সফল কেন হোল না, গর্ডন-সাহেব সে কথা স্পষ্ট করে লেখেননি । কিন্তু খবরটা বেরিয়ে গেল এবং ছড়িয়ে গেল । কাগজে তাঁর স্বাস্থ্য সম্বন্ধে দৈনিক বুলেটিন বেরোতে শুরু করল । সরকার আপোশ করতে বাধ্য হোল । ধর্মকার্যের পোষকতায় মান্দালয়ের প্রতি কয়েদি বছরে ৩০ টাকা বাড়তি ভাতা পেলেন ।

    কর্পোরশনের অল্ডরম্যানের পদে শরত্চন্দ্রের বার বার সেখানকার ইংরেজ সভ্যদের সঙ্গে মতদ্বৈধ হচ্ছিল - শান্তিময় পথে ভারতের মঙ্গল করার সম্বন্ধে ওনার মত হয়ত সেই সময় থেকেই বদলাতে শুরু করল - স্বাধীনতা সংগ্রামের পথে সেইখানে ওনার পদক্ষেপ । ছোটভাইয়ের মত মতো তিনি স্বাধীনতার প্রয়োজনের দিকে উত্তরোত্তর ঝুঁকতে লাগলেন ।

    ১৯২৫-এ দেশবন্ধুর মৃত্যু হোল - উনি অনেকদিন থেকেই অসুস্থ ছিলেন, তারই ফাঁকে ফাঁকে কাজ করে যাচ্‌ংইছলেন । কিন্তু ওনার তিরোধানের আগে থেকেই ওনার কষ্টে রচিত হিন্দু-মুসলিম ঐক্যে ফাট ধরতে শুরু করেছিল । এবার সেটা দাঙ্গার রূপ যখন ধরল, বাধা দেবার মতো ক্ষমতা কারো রইল না । কলকাতার ডেপুটি মেয়র সহীদ সুরাবর্দি এ দাঙ্গার প্ররোচক ছিলেন বলে অভিযোগ হোল । উনি কর্পোরেশন থেকে পদত্যাগ করতে বাধ্য হলেন (১৯৪৭এর `ক্যালকাটা কিলিং'-এর কথা যাঁরা জানেন, তাঁরা সুরাবর্দির পরিচয় কিছু মনে রেখেছেন হয়ত - সেসময়ে গান্ধীজিওনাকে বুক দিয়ে রক্ষা না করলে তিনি খুব সম্ভব খুন হয়ে যেতেন । ফজলুল হকের সঙ্গে বিভেদ হয় আরো পরে, অনেক বেশি সঙ্গত কারণে ।) কিন্তু এইসময়ে শরত্চন্দ্র গ্রামে গ্রামে গিয়ে শান্তিস্থাপনের চেষ্টা করলেন । আইনের কাজের সঙ্গে প্রত্যক্ষ দেশের কাজ জুটল ।

    ১৯২৬এ শরত্চন্দ্র বাংলার আইনসভার জন্য দাঁড়ালেন এবং জেলে-থাকা অবস্থাতেই ভাইকেও দাঁড়াতে প্ররোচিত করলেন । দুজনেই নির্বাচনে জিতে আইনসভার সভ্য হলেন ।

    মান্দালয়ের জেলে সুভাষচন্দ্রের অসুস্থতাটা শুরু হয়েছিল বদহজম আর সর্দিজ্বরের রূপে - কিন্তু সেটার বাড়াবাড়ি হতে লাগল, দুর্বলতা বাড়তে লাগল । ওনাকে আর জেলে রাখার বিপদটা সরকার উপলব্ধি করলেন - নরহত্যার (বিশেষ করে শ্রদ্ধেয় দেশনেতার) বদনামটা ওরা নেন কী করে । সুভাষকে বলা হোল যে উনি যদি দেশ ছেড়ে সুইটজরল্যাণ্ড গিয়ে স্বাস্থ্য পুনরুদ্ধার করবেন বলে প্রতিশ্রুতি দেন, তাহলে ওনাকে ছেড়ে দেওয়া হবে । উনি রাজি হলেন না । সরকার ওনার যেসব কার্যকলাপের সন্দেহে তাঁকে ধরেছিল, তা যখন প্রমাণ হয়নি, তখন তিনি বাড়িতে আত্মীয়-স্বজন ছেড়ে দূর দেশে যাবেন কেন ?

    সরকার বলল যে আলমোড়ায যক্ষারোগগ্রস্ত বন্দীদের জন্য যে হাসপাতাল আছে, সেখানে তাঁকে বদলি করা হবে । জাহাজ চড়লেন, কিন্তু কলকাতা পৌঁছবার পরে কেন সরকার মত বদলে তাঁকে সরাসরি ছেড়ে দিল সেটা স্পষ্ট নয় । এটা ১৯২৭ সালের কথা ।

    দেশে ফিরে সুভাষচন্দ্র মেজদার বাড়িতে উঠলেন । তখন ওনার নিজের রোজগার কিছু ছিল না । আদালতে শরত্চন্দ্র ভালো রোজগার করছিলেন ; জানকীনাথের প্রতিষ্ঠিত বাড়ি ; আটকাল না কোথাও । দু-ভাই আইনসভায় স্বরাজপার্টির প্রতিভুরূপে কাজ করে গেলেন ; সরকারের সঙ্গে নানা ব্যাপারেই দ্বন্দ্ব্ব লাগল । সরকার মন্ত্রী নিয়োগ করলেন নিজের ইচ্ছামতো, তাঁরা বেতন পেতে লাগলেন সরকারি তহবিল থেকে । স্বরাজপার্টির লোক ও তাঁদের প্রতি সহানুভুতিসম্পন্ন দলের লোকেরা প্রতিবাদ করল - গণতন্ত্রমতে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মধ্যে মন্ত্রী নির্বাচনের কথা হওয়া উচিত্‌, নাহলে মন্ত্রীরা সরকারের ধামাধরা হতে বাধ্য ; যদিও মন্ত্রীদের মধ্যে বসুপরিবারের কিছু আত্মীয়ও ছিলেন । ইত্যকার নানা দ্বন্দ্বের মধ্যে দিয়ে আইন সভার কাজ চলতে লাগল । সুভাষ শ্রমিক-আন্দোলনের নেতৃত্ব নিলেন নানা জায়গায় । কোথাও জিতলেন, কোথাও মালিকদের সঙ্গে তাঁদের চুক্তি শ্রমিকদের মন:পূত হোল না । তাছাড়া কংগ্রেস কোনদিনই শ্রমিক আন্দোলনে ভাগ নিতে চায়নি - তাঁদের মত ছিল যে দেশের স্বাধীনতায় ধনিক-শ্রমিক দুই পক্ষেরই লাভ, কাজেই এই দুই দলের হাত মিলিয়ে কাজ করা উচিৎ । রাশিয়ার বিদ্রোহের পর দেশে কম্যুনিষ্ট দল তখন শক্তি সংহত করছে । তাদের মত হোল যে শ্রমিক-মালিকের দ্বন্দ্ব্ব চিরন্তন - সেখানে আপোষ চলে না, (`আমাদের দাবি মানতে হবে') ।

    কৃষকদের নানা অধিকার নিয়েও কংগ্রেসে ও আইনসভায় নানা মতানৈক্য দেখা দিল । বাংলায় এ দ্বন্দ্ব্ব প্রায় হিন্দু-মুসলমানের দ্বন্দ্ব্ব হয়ে দাঁড়ায় । কৃষকদের অধিকারের ব্যাপারে কংগ্রেস যথেষ্ট মন দিচ্ছে না, কৃষকদের নেতা হিসাবে এটা ফজলুল হককে বিরূপ করে তুলল । এটাকে ওনার মুসলমান সাম্প্রাদিকতা বলে মনে করা উচিৎ হবে না - কিন্তু ফলটা প্রায় তাই দাঁড়াল ।

    সাম্প্রদায়িক দ্বন্দ্বের আরেকটা চেহারা দেখা দিল যখন জবাহরলাল নেহরুর নেতৃত্বে ভারতের শাসনবিধির খসড়া তৈরি করার কাজ শুরু হোল । মুসলমানদের জন্য আইনসভায় ইংরেজি কায়দায় আলাদা আসন থাকবে অথবা সাধারণ নির্বাচনে মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চলে স্বাভাবিকভাবেই মুসলমন সভ্য আসবেন, এখানেও বিরোধিতা হোল ।

    কংগ্রেসের মধ্যেও তখন স্বাধীনতা নিয়ে মতৈক্য আসেনি : জবাহরলাল, সুভাষ-প্রমুখ লোকেরা বলছেন পূর্ণ স্বরাজের দাবিতে কাজ হোক, গান্ধীপন্থীরা বলছেন, আস্তে আস্তে অধিকার বাড়ান হোক । এর মধ্যে গান্ধীজিলবণ আন্দোলনের কাজ শুরু করলেন । সবাই তার সমর্থনে দেশে অসহযোগ আন্দোলন গড়লেন - বাংলায় তার অন্যথা হোল না । গান্ধী-আরুইন চুক্তিতে তার পরিণতি । সেটা সকলের মনে ধরল না । সন্ত্রাসবাদী যারা দেশবন্ধুর কথায় নিজেদের কাজ স্থগিত রেখেছিল, তারা আবার কাজ শুরু করল । বেশ কিছু ইংরেজ রাজকর্মচারি খুন হলেন । চট্টগ্রামের অস্ত্রাগার লুঠ হোল । চট্টগ্রামে কদিনের জন্য সূর্য সেনের অধীনে স্বাধীন সরকার বসল । কেউ পুলিশের সঙ্গে যুদ্ধে প্রাণ দিলেন, কেউ ধরা পড়ে ফাঁসি গেলেন । কিন্তু এই নিয়ে কংগ্রেসের সঙ্গে সুভাষের দলের একটা ভেদ সরকার দেখতে পেল । গান্ধীজীর দল সরাসরি বলল এরা অন্যায় করছে । সুভাষ, শরত্চন্দ্রের মত লোকেরা বললেন যে সন্ত্রাসবাদের পথ তাঁরা গ্রহণ করবেন না, কারণ অসহযোগের পথ বর্তমানে প্রকৃষ্ট পথ । কিন্তু সন্ত্রাসবাদীদের আত্মত্যাগ, বীরত্ব ও আদর্শবাদকে তাঁরা শ্রদ্ধা করেন । পরের বছর লাহোর ষড়যন্ত্রের অপরাধে যখন ভগত সিংহের ফাঁসি হয় তখন পাঞ্জাবে গিয়ে সুভাষচন্দ্র বলেছিলেন যে শিখ সম্প্রদায় যদি একশ জন ভগত সিংহের মতো আত্মত্যাগী দেশকে দিতে পারে, তবে ভারতের স্বাধীনতা অনেক এগিয়ে আসবে ।

    খানিকটা এই কারণে, খানিকটা কেন্দ্রীয় কংগ্রেসে গান্ধী ও নেহরু-সুভাষ প্রমুখ যুবক দলের সংঘাতের ছায়া হিসাবে, বাংলার প্রাদেশিক কংগ্রেসেও দলাদলি শুরু হোল । দেশবন্ধুর মৃত্যুর পরে (সুভাষ তখন মান্দালয়ে) যতীন্দ্রমোহন সেন বাংলার নেতৃত্বভার নেন, মহাত্মাজীর তাতে আশীর্বাদ ছিল । যতীন্দ্রমোহন আত্মত্যাগী সমাজসেবী ছিলেন, সুভাষচন্দ্রের দলের লোকেরা অনেক সময়েই তাঁর কাজে সাহায্য করেছেন - তিনি ও সুভাষ একসঙ্গে জেলও খেটেছেন । কিন্তু নেতৃত্বের অধিকার নিয়ে ও দুই দলের মধ্যে দ্বন্দ্ব্ব থেকেই গিয়েছিল । সেই কারণে কেন্দ্রীয় কংগ্রেসেও সুভাষচন্দ্রের মতামত জোর পাচ্ছিল না ।

    সুভাষ তবুও কংগ্রেসের কাজে অক্লান্ত কর্মী ছিলেন । ১৯২৮-সালের কলকাতা কংগ্রেসের অধিবেশনের সময়ে সুভাষ যে স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর সৃষ্টি করেছিলেন, তার চেহারাখানা সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল । ব্যাপারটা হয়েছিল পুরো জঙ্গি কায়দায় । পোষাক তৈরি করান হয়েছিল বিলেতি জঙ্গি পোষাকের দোকান থেকে । কুচকাওয়াজ পুরো জঙ্গি মতে হোত । এখানে সুভাষচন্দ্রের পূর্ববর্তী শিক্ষা কাজে লেগেছিল । ব্যাপারটা সবার চোখে ভাল অবশ্যই লাগেনি । ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের স্বরূপ সম্বন্ধে তাঁর ও গান্ধিজীর মতবিরোধটা যেন এখানে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখান হয়ে গেল (গান্ধিজী স্বয়ং জিনিষটাকে বলেছিলেন সার্কাস) । ইংরেজরাও লক্ষ করেছিল ব্যাপারটা ।

    ১৯২৯ সালে যতীন্দ্র সেনগুপ্ত, সুভাষ এবং আরো কযেকজনকে রাজদ্রোহিতার অপরাধে গ্রেপ্তার করা হোল । ১৯২৯এ কয়েকমাস সুভাষ জেলে রইলেন । যতীন্দ্রমোহনের শরীর অসুস্থ হচ্ছিল - ছাড়া পাবার পরেও ওনাকে কয়েকমাস চিকিত্সার জন্য অন্যত্র থাকতে হোল । এইসময়ে শরত্চন্দ্র ঠিক করলেন যে আইনসভার ১৯২৯এর নির্বাচনে তিনি দাঁড়াবেন না । কর্পোরশনের এবং প্রাদেশিক কংগ্রেসের বহু কাজের ভার নিলেন ।

    এরপরে যতীন্দ্রনাথ আর কাজে ফিরতে পারলেন না । বিদেশ থেকে ফেরার পর তিনি বারবার আবার গেপ্তার হলেন । ১৯৩২ সালে রাঁচীর জেলে তাঁর মৃত্যু হয় । সুভাষ জেলে থাকাকালীন কর্পোরেশনের মেয়র নির্বাচিত হন - জেল থেকে বেরিয়ে তিনি সেই কাজের ভার নিলেন । এ ছাড়া যুবকদলের নেতা হিসাবে নানা জায়গায় সংগঠনের কাজে ঘুরতে হোল । মেয়েদের দেশের কাজে নামাবার জন্য সচেষ্ট হলেন - নানা জায়গায় মহিলা সমিতি স্থাপিত হোল ।

    ১৯৩১ সালে সরকারি নিয়মের বিরোধে মালদায় কংগ্রেসের কাজে যাওয়ার জন্য সাত দিনের জন্য জেলে যান । ১৯৩১এর স্বাধীনতা দিবসে সরকারি নিষেধ ভেঙ্গে মিছিল বার করতে গিয়ে তিনি গ্রেপ্তার হন আবার । পুলিশের হাতে নির্মম ভাবে মার খান - জেল তো হয়ই । গান্ধী-আরউয়িন চুক্তির অংশ হিসাবে এর পরে তিনি ছাড়া পান । কিন্তু চুক্তির পরবর্তী বৈঠকে যাওয়া তাঁর হয়নি । পূর্ণ স্বাধীনতার কথা গান্ধীজি তুলতে রাজি হলেন না । তাছাড়া রাজনৈতিক বন্দীদের যারা ছাড়া পেয়েছিল, সন্ত্রাসবাদী বন্দীরা তার অন্তর্ভুক্ত হয়নি ।

    বিলেতের বৈঠক থেকে মহাত্মা প্রায় খালি হাতে ফিরলেন । কংগ্রেস আবার অসহযোগের কথা ভবতে আরম্ভ করল । ১৯৩২এর জানুয়ারি মাসে কংগ্রেসের কার্যকরি সমিতির সবাই গ্রেপ্তার হলেন । এবার দুই বসুভাইরাও বাদ গেলেন না । বাংলার সন্ত্রাসবাদীদের প্রতি তাঁদের সহানুভুতিকে সরকার কোনদিনই ভাল চোখে দেখেনি । সন্ত্রাসবাদের সঙ্গে তাঁদের প্রত্যক্ষ যোগ প্রমাণ করার দরকার হোল না । শুধু সন্দেহের ওপর ভর করে লোককে জেলে দেওয়ার ক্ষমতা সরকারের আইনগত ভাবে থাকুক আর না থাকুক, তাদের বাধা দেওয়া সহজ হোল না ।

    জানকীনাথ তখন অসুস্থ । বাড়ির মধ্যে সবচেয়ে রোজগেরে ছেলে শরৎ যখন আর কাজ করতে পারলেন না তখন পরিবারের ভার পড়ল বড় ভাই সতীশচন্দ্রের ওপর - একলা সে কাজের ক্ষমতা তাঁর ছিল না । সর্ম্পংইত্ত-আদির ওপর যা বাড়তি, দু ভাইয়ের কিছু গুণগ্রাহী ধনী বন্ধু সে-ভার বহন করলেন । ম্যুনিখে অশোকচন্দ্রকে চিঠি লিখে জানান হোল যে সে যেন মন দিয়ে পড়াশোনা করে যায় - খরচের ব্যবস্থা হয়ে যাবে ।

    দুই ভাইকে প্রথমে তোলা হোল মধ্যপ্রদেশের ছোট এক কারাগারে । মান্দালয়ের মতোই - ঘরে দরজা-জনালা নেই, শীতাতপ নিবারণ হয় না । সুভাষচন্দ্রের পুরোন অসুখ আবার চাড়া দিল । শরত্চন্দ্রের ডায়াবেটিস ছিল, এই অত্যাচারে সেটার উপসর্গ দেখা দিল । সরকার জব্বলপুরে দুজনকে এনে ডাক্তার দেখালেন । শরৎ সেখানেই রয়ে গেলেন । সুভাষের শরীরের জন্য আর দায়িত্ব নেওয়া সরকার উচিৎ বোধ করল না । বলা হোল উনি যদি দেশ ছেড়ে য়োরোপে গিয়ে থাকতে রাজি হন তো তাঁকে ছেড়ে দেওয়া হবে । ইংলণ্ডে যাবার অনুমতি দেওয়া হোল না (ওনার ব্রিটিশ পাসপোর্ট ছিল - বোধহয় ওনাকে আটকতে ওরা পারত না, কিন্তু উনি ব্যাপারটা এড়িয়ে গেলেন) । বিদেশে যাবার খরচ সরকার বহন করল না - ওনাদের নিজে ব্যাবস্থা করতে হোল । দেশ ছাড়বার আগে কলকাতাতেও যেতে দেওয়া হোল না । বোম্বাইয়ে গিয়ে বৌদি দেখা করে এলেন । ম্যুনিখে ভাইপো অশোক ছিলেন । কাকা উঠলেন ভিয়েনাতে । মাঝে মাঝে অশোকের সঙ্গে দেখা হতে লাগল ।

    শরত্চন্দ্র জব্বলপুরেই রয়ে গেলেন প্রথমে । সরকারের নানা স্তরে চিঠি দিতে থাকলেন । প্রায় ওকালতির ব্রীফ : ওনার বিরুদ্ধে যে অভিযোগগুলো কল্পনা করা যায়, সেগুলোর বিরুদ্ধে তর্ক তুললেন (অভিযোগ কিছু সরকারি ভাবে আনা হয়নি)। প্রথমে কোন উত্তর পেলেন না । শেষটা উনি বাংলার ছোটলাটকে চিঠি দিলেন । এবার কাজ এইটুকু হোল যে ওনাকে কার্সিয়ংএ নিজের বাড়িতে নজরবন্দী থাকতে অনুমতি দেওয়া হোল ।

    য়োরোপে সুভাষচন্দ্র সেখানকার বিভিন্ন দেশের ভারতীয় প্রবাসীদের সঙ্গে যোগস্থাপন করলেন । ভারতের সংগ্রামে সাহায্য করবার জন্য উদ্বুদ্ধ করলেন । প্রবাসীদের ওপর যেসব অন্যায় নিষেধাজ্ঞা ছিল (বিশেষ জার্মানিতে), সেগুলোর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে তাঁদের সাহায্য করতে লাগলেন । যখন লক্ষ করলেন যে ভারত সম্বন্ধে যোরোপীয়দের জ্ঞান অত্যন্ত সীমিত, তখন ভারতের সম্বন্ধে প্রচার শুরু করবার ব্যাবস্থা করতে লাগলেন । এ কাজ তাঁর আগেই দেশবন্ধুর পূর্বতন সহকর্মী বিঠলভাই পাটেল (সর্দার বল্লভভাইএর দাদা) শুরু করেছিলেন য়োরোপে (দেশবন্ধুর পরামর্শ এতে ছিল) । তিনি সুভাষকে নিজের পক্ষচ্ছায়ায় নিলেন । সুভাষচন্দ্রের সম্বন্ধে তাঁর স্নেহভাব এইসময়ে দৃঢ় হয় । মৃত্যুকালে তিনি সুভাষচন্দ্রকে কিছু অর্থের উত্তরাধিকারী করে গেছিলেন । বল্লভভাই মামলা করে সেটা বন্ধ করেন ।

    এছাড়া ওনার একটা বড় আরব্ধ হোল নানা দেশের সরকারের সঙ্গে যোগস্থাপনা করা - যাতে প্রয়োজনে সেখান থেকে সাহায্য পাওয়া যায় । ভিয়েনার নাগরিক সংস্থার কিছু লোক তাঁকে এ-ব্যাপারে সাহায্য করলেন । জার্মানিতে কিছু লোকের সঙ্গে হৃদ্যতা হোল । কিন্তু জর্মন সরকার তাঁকে আদৌ আমল দিল না । হিটলারের ক্ষমতা সেখানে বাড়ছে । ভারতীয়, তথা সারা এশিয়াবাসী ওদের চোখে ব্রাত্য । ইংরেজের মত আর্য জাতির হাতে যখন নীচজাতিয় ভারতীয়রা রয়েছে, তখন তাদের কোন সংগ্রামকে ভাল চোখে দেখা রীতির মধ্যে পড়ে না । (যুদ্ধের সময়ে উনি হিটলারের কাছে কিছু সাহায্য পেযেছিলেন অবশ্যই, কিন্তু সে অনেক পরে) ।

    কিন্তু য়োরোপের অন্যান্য দেশে তাঁর আদর হয়েছিল । মুসোলিনির সঙ্গে উনি দেখা করেছিলেন । (এর ফলে ও অন্যান্য পড়াশুনো করে ফ্যাসিষ্টনীতির সম্বন্ধে তাঁর যা মনোভাব হয়েছিল, সে-প্রসঙ্গে একটু পরে আসব)। মুসোলিনি ওনাকে উত্সাহিত করেছিলেন । প্রাগে মাসারিকের সহকর্মী ডা: বেনেশের সঙ্গেও দেখা হয়েছিল । পোল্যাণ্ড ও বল্কান দেশগুলো ছাড়া উনি তুর্কি পর্যন্ত গেছিলেন (আতাতুর্কের তুর্কি সম্বন্ধে যে আশা নিয়ে গেছিলেন, সেটা কিন্তু ওনার টেঁকেনি)। অস্ট্র্ত্রিয়ার কিছু লোকের মাধ্যমে ভারত ও মধ্য য়োরোপের সঙ্গে একটা বাণিজ্যিক সম্পর্কের পত্তনও তিনি করবার চেষ্টা করেছিলেন ।

    এর মধ্যেও ওনার অন্যান্য চিন্তা বাধা পায়নি । ধর্ম সম্বন্ধে চিন্তা ও ধ্যানধারণার অভ্যাস চিরকালই ছিল । কলেজের বন্ধু দিলীপ রায়ের সঙ্গে এ-সম্বন্ধে পত্রালাপ অব্যাহত ছিল (দিলীপ রায়কে লেখক হিসাবে যাঁরা না চিনবেন বা পণ্ডিচেরিতে অরবিন্দের সঙ্গে তাঁর ভক্তি-সম্পর্কের কথা যাঁরা নাও জানেন তাঁরা গায়ক হিসাবে তাঁকে বোধহয় চিনবেন - বর্তমান বাংলার চিন্তা এখন কী মুখো তার পুরো খোঁজ আমার নেই) । দেশে থাকতে নানা পুস্তিকা তিনি লিখেছিলেন, য়োরোপ থেকে মডার্ন রিভিউতে তিনি সোশিয়ালিষ্ট রীতি ও ফ্যাশিষ্ট রীতির একটা মিলনসাধন করে দেখাতে চেয়েছিলেন যে ভারতে এই যৌথ মতবাদের প্রয়োগ হলে ভাল হবে । ফ্যাশিষ্ট নীতির মধ্যে আদর্শবাদ ও শৃঙ্খলার সামঞ্জস্য ওনাকে প্রীত করেছিল । ওর অত্যাচারগুলোকে উনি কোন কারণে আমল দেননি । এটা বন্ধু নেহরু ও ভারতের অন্যান্য চিন্তাশীল লোককে বিচলিত করেছিল ।

    ইংলণ্ডের ভারতীয় ছাত্রসংস্থা ওনাকে নিমন্ত্রণ করেছিল । ব্রিটিশ পাসপোর্ট থাকায় ওখানে যাওয়া বোধহয় ইংরেজরা আটকতে পারত না । কিন্তু উনি সে ঝুঁকিটা নিতে চাইলেন না । একটা ভাষণ পাঠিয়ে দিলেন । সেই ভাষণে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে মহত্মাজীর এবং নিজের দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্য তিনি আলোচনা করেছিলেন ।

    সেই আলোচনা ও ভারতের স্বাধীনতা-সংগ্রামের সম্বন্ধে তাঁর মতামত ভাল করে প্রকাশ করার সুবিধা তাঁর হোল যখন ইংলণ্ডের প্রকাশক লরেন্স য়ুইশর্ট তাঁকে ওই সম্বন্ধে বই লিখতে অনুরোধ করলেন । সেই বই (দি ইণ্ডিয়ন স্ট্রাগল, ১৯২০-১৯৩৪) ভারত সরকার বেআইনি ঘোষণা করায় তদানীন্তন ভারতীয়রা সেটা পড়তে পারেনি, এখন নিশ্চয় পাওয়া যাবে ।

    এই বই লেখবার সময়ে তাঁর একজন সেক্রেটারির প্রয়োজন হয়েছিল । তাঁর ভবিষ্যৎ স্ত্রী এমিলি শেংকলের সঙ্গে এখান থেকে তাঁর যোগ । পরে একথা আবার উঠবে ।

    বই যখন শেষ হয়ে আসছে সেই সময়ে জানকীনাথের আসন্নমৃত্যুর খবর পেলেন । ইংরেজরা ওনাকে কলকাতা যাবার অনুমতি দিল এই সময়টুকুর জন্য (আগে স্বাধীনতা নিয়ে কথা বলেছিলম, কাজেই এখানে স্বীকার করতে হবে যে অন্য বিদেশি সরকার হলে এইটুকু বদান্যতা করত কিনা, আমার সন্দেহ আছে) । খুব তাড়াতাড়ি বইয়ের প্রুফ দেখা শেষ করে যখন বোম্বাই পৌঁছলেন, তখন জানকীনাথের মৃত্যু হয়েছে ।

    কার্শিয়ং থেকে শরত্চন্দ্র কলকাতা আসার অনুমতি পেয়েছিলেন । ভাইয়েরা একসঙ্গে পিতৃশ্রাদ্ধ করার পরে ওনারা চেষ্টা করতে লাগলেন যে পরিবারের অসহায়তার র্ভিংইত্ততে শরত্চন্দ্রকে স্বাধীনভাবে ওকালতি করার অধিকার দেওয়া হোক । দেশবন্ধুর পূর্বতন সহযোগী নলিনীরঞ্জন সরকার তখন প্রাদেশিক মন্ত্রী । প্রথমে কিছু দোনামনা করে তিনি শরত্চন্দ্রের জন্য গভর্নরকে অনুরোধ করলেন । তাঁকে নি:শর্তে মুক্তি দেয়া হোল ।

    সুভাষকে ভারতবর্ষে স্বাধীনভাবে বিচরণ করতে দিতে সরকারের ভয় অনেক বেশি ছিল । ফলে ১৯৩৫-সালের গোড়ায় উনি আবার দেশত্যাগ করলেন । য়োরোপে এসে খবর পেলেন যে তাঁর সদ্য-প্রকাশিত বই প্রচুর প্রশংসা পাচ্ছে । একজন ইংরেজ সমালোচক লিখেছেন, `বোসকে একজন সমাজবিরোধী সন্ত্রাসবাদী জেদী লোক বলেই পরিচয় দেওয়া হয় । কিন্তু এই বইয়ের লেখককে বরঞ্চ চিন্তাশীল, ধীরমতি লোক বলেই দেখলাম । ভারতীয় সংগ্রাম সম্বন্ধে লেখা সব বইয়ের মধ্যে এটাকে প্রথম স্থান দেওয়া যায় । তাঁর মতামত লেখক স্পষ্ট করে বলেছেন ও অত্যন্ত পরিষ্কার করে তার যুক্তি দেখিয়েছেন । এত অল্প বয়সে এ রকম পরিষ্কার চিন্তাশক্তি যার থাকে, সেরকম লোক তার দেশের রাজনৈতিক কাজে অতি মূল্যবান ।'

    এককালে সুভাষের ইচ্ছা ছিল রোমাঁ রোলাঁ ওনার বইয়ের ভূমিকা লিখুন ; ব্যাবস্থা করে উঠতে পারেননি । এ-ব্যাপারে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে ওনার কিছু মনোমালিন্যও হয়েছিল । কিন্তু রোমাঁ রোলাঁ স্বয়ং এই বই সম্বন্ধে ওনাকে পরে লিখেছিলেন, `ভারতীয় সংগ্রামের ইতিহাসের পক্ষে এ বই অমূল্য । ইতিহাস লেখকের যেসব গুণ থাকা দরকার, তা তোমার আছে । তোমার মত কর্মী লোকের মধ্যে এরকম সমদর্শিতা বড় একটা দেখা যায় না ।' ওনাদের দুজনের দেখা হয়েছিল - কথা হয়েছিল দোভাষীর মাধ্যমে ।

    ওনার পেটের অসুখের জন্য চিকিত্সার চেষ্টা উনি বরাবরই করছিলেন । মধ্য য়োরোপের কয়েকটি উষ্ণ প্রস্রবণে তিনি গতবারেই সময় কাটিয়েছিলেন, কিছু উপকারও পেয়েছিলেন, কিন্তু আরও কড়া চিকিত্সার প্রয়োজন আর এড়ান যাচ্ছিল না । এবারে য়োরোপে ফেরার পর ভিয়েনাতে ওনার গল ব্লডর-এ অস্ত্রোপচার হোল । সুস্থ হবার পর আবার তিনি পরিক্রমা শুরু করলেন । ডা: বেনেশের সঙ্গে আবার দেখা করলেন প্রাগে । তখন তিনি চেকোস্লোভাকিয়ার প্রেসিডেন্ট (অবশ্য সেটা হিটলারের কেরদানি শুরু হবার আগে - উনি বেশিদিন টেঁকেননি তার পরে) । হিটলার এশিয়াবাসী ও ভারতীয়দের সম্বন্ধে বিরূপ মন্তব্য করে বক্তৃতা দেন । সুভাষ জর্মনির ভারতীয় ছাত্র-সংস্থাকে তার প্রতিবাদ করতে উদ্বুদ্ধ করলেন । তারা ভয় পেল । উনি বললেন, `প্রতিবাদ না করলে অন্যায় কিছু কমবে না । জোর দেখালে বরঞ্চ কিছু সুফল হতে পারে - এখানকার ইতিহাসেই তার নজির আছে ।' জর্মন সরকারের লোকেদের সঙ্গে এবারেও দেখা করতে পারলেন না । স্টালিনের সরকারও তাঁকে উত্সাহ দিল না - হয়ত ইংরেজরা কিছু কলকাঠি নেড়েছিল । কিন্তু বেলজিয়মে উনি বেশ কিছুদিন কাটালেন ও বেলিজয়মের ধনী ভারতীয় নাগরীকদের তাঁর সৌহার্দয হোল । পরে তাঁদের একজনের বোম্বাইয়ের বাড়িতে তিনি বার-কতক অতিথি হয়েছিলেন ।

    আয়র্ল্যাণ্ড তখন স্বাধীন দেশ । আয়র্ল্যাণ্ডের ভারতীয়-আইরিশ সংস্থা বিঠলভাই প্যাটেল স্থাপনা করে গেছিলেন । তাঁরা সুভাষকে নিমন্ত্রণ করলেন । ইংলণ্ড হয়ে যাওয়া সহজ হবে না মনে করে তিনি ফ্রান্স থেকে সোজা কর্কে জাহাজ নিয়ে গেলেন । আয়র্ল্যাণ্ডের স্বাধীনতা-সংগ্রাম চিত্তরঞ্জন, সুভাষ, শরত্‌-প্রমুখ বহু বাঙালি নেতাকে এর আগে উদ্বুদ্ধ করেছিল । ভারতীয়দের আইরিশরা স্বধীনতা-পথে সহযাত্রী বলেই দেখত । কাজেই ওখানে সুভাষচন্দ্রের প্রচুর সমাদর হোল । শ্রমিক নেতা, সরকারের বাইরের নানা রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে দেখা হোল । প্রেসিডেন্ট ডি ভ্যালেরার সঙ্গে দেখা হোল তিনবার ।

    একটা মজার ঘটনা - এখানে মান্দালয় জেলের পূর্বতন কর্তৃপক্ষ কর্নেল স্মিথের সঙ্গেও তাঁর দেখা হোল । পুরোন দিনের গল্পও হোল কিছু ।

    এরচেয়ে দরকারি কথা, ওনার এই দ্বিতীয় য়োরোপ সফরের সময়ে পণ্ডিত জবাহরলাল স্ত্রীর চিকিত্সার জন্য য়োরোপে ছিলেন (এর অতি অল্পকালের মধ্যে শ্রীমতী কমলা নেহরুর মৃত্যু হয়) । সুভাষচন্দ্রের সঙ্গে বারকয়েক তাঁর দেখা হয় । ওদের মধ্যে হৃদ্যতা গভীরতর হয় । এর আগেও দেশে বহু ব্যাপারে ওনারা এক পক্ষে থেকে কংগ্রেস নেতাদের সঙ্গে তর্ক করেছেন । কিন্তু নেতাজি তাঁর বইয়ে পণ্ডিতজীর সমালোচনা করে বলেছিলেন যে তিনি নাকি বারবার কাজের সময়ে মহাত্মাজীর চাপে মত বদলান - এটা ভাল নয় । এনিয়ে দুজনের মধ্যে যদি মনোমালিন্য হয়েও থাকে, এই সময়ে সেটার কিছু উপশম বোধহয় হয়েছিল । পরেও এর প্রমাণ পাওয়া যাবে ।

    সুভাষচন্দ্রের কিছুদিন থেকেই মনে হচ্ছিল যে দেশের বাইরে থাকলে হাজার চেষ্টা করেও দেশের কাজ বেশি হয় না । ডি ভ্যালেরা এ কথা সমর্থন করলেন । কাজেই সুভাষ ঠিক করলেন যে নিষেধাজ্ঞা অমান্য করেই তিনি ভারতে ফিরবেন । ভিয়েনার ব্রিটিশ কন্সাল এ ব্যাপারে তাঁকে সাবধান করে চিঠিও দিলেন । শুনলেন না । ১৯৩৬-এ বোম্বাইয়ে জাহাজ থেকে নামলেন ও অবিলম্বে গ্রেপ্তার হলেন ।

    দু বছরের বেশি তাঁকে বন্দী থাকতে হয়নি । কিন্তু সেকথা বলার আগে একটু খবর দিয়ে নিই ওনার দুবছর বিদেশবাসের সময় শরত্চন্দ্র কী করলেন ও দেশে কী হোল ।

    শরত্চন্দ্র ১৯৩৫-সালে ছাড়া পাবার পরে আবার ওকালতিতে ফিরে গেলেন । পূর্বতন বন্ধুরা সাদর অভ্যর্থনা করলেন । পুরোন পশার ফিরতে খুব দেরি হোল না । সংসার আবার সচ্ছল হোল । মেয়ের বিয়ের ব্যবস্থা হোল । বাড়ির দিকটা সামলে গেল ।

    নতুন ভারতশাসন আইনে নির্বাচনের তোড়জোড় চলল । ওই বিধানে সরকার ঠিক করলেন যে মুসলমান ও অস্পৃশ্য জাতিদের স্বার্থরক্ষার জন্য আইনসভায় কিছু আসন তাঁদের জন্য আলাদা থাকবে । কংগ্রেসের এব্যাপারে আর্পংইত্ত ছিল - দেশ সম্পূর্ণ জাতি-নিরপেক্ষ হবে এটাই ছিল আদর্শ । কাজেই এই ব্যাপারে সরকারের সঙ্গে সহযোগিতা করা উচিৎ হবে কিনা, সে সম্বন্ধে দ্বন্দ্ব্ব দেখা দিল খানিকটা । পুরোন স্বরাজপার্টির সঙ্গে সহানুভূতি যাঁদের ছিল তাঁরা বললেন যে অন্য সবব্যাপারে যখন অসহযোগিতা অপাতত বন্ধ আছে তখন আইনসভায় ঢুকে সেখান থেকে কিছু প্রগতিশীল কাজ করার চেষ্টা করা উচিত্‌, পরে যদি সরকারপক্ষ বাধা দেয়, তখন ভেতর থেকেই আইনসভাকে বানচাল করা যাবে । বিধান রায় এব্যাপারে নেতৃত্ব নিলেন । শরত্চন্দ্র প্রাদেশিক কংগ্রেসের সভাপতি হিসাবে নির্বাচনের ব্যাবস্থাপনার ভার নিলেন । পুরোন হিন্দু-মুসলিম দ্বন্দ্ব্ব আবার স্পষ্ট হোল । ফজলুল হক কৃষক প্রজাপার্টির নেতা হিসাবে আগেই বর্ণ-হিন্দুদের কাছে ঘা খেয়েছিলেন । কাজেই তিনি অবাঙালি মুসলিম লীগের সঙ্গেই মোটামুটি হাত মেলালেন । শরত্চন্দ্র নানা আলোচনার চেষ্টা করলেন, ফল খুব একটা হোল না ।

    কম্যুনিষ্টরা কংগ্রেসকে কোনদিন ভাল চোখে দেখেনি । কংগ্রেসের মধ্যেও অনেকে ছিলেন যাঁরা সমাজতন্ত্রের প্রতি সহানুভূতিসম্পন্ন ছিলেন, কিন্তু কম্যুনিষ্টদের রাশিয়া-ভজনাকে ভালো চোখে দেখতেন না (তখন `কমরেড স্টালিনের' যুগ, `দলিতদের নেতা' হিসাবে তিনি তখন নিজের স্বেচ্ছাতন্ত্রকে বেশ গুছিয়ে নিয়েছেন, ট্রটস্কি মেক্সিকোয় নির্বাসিত - অথবা ততদিনে খুন হয়ে গেছেন, ঠিক মনে পড়ছে না । `চীনের চেয়ারম্যান' তখনো `আমাদের চেয়ারম্যান' হবার মতো শক্তি সংগ্রহ করতে পারেননি) । কিন্তু কংগ্রেসে থাকলেও মহাত্মাজীর ধনী-তোষণনীতি তাঁদের মন:পূত ছিল না । তাঁরা `কংগ্রেস সোশ্যালিষ্ট পার্টির' সৃষ্টি করলেন । এঁদের মধ্যে বিশিষ্ট ছিলেন জয়প্রকাশ নারায়ণ, মিনু মসানী, অশোক মেহতা, কমলাদেবী চট্টোপাধ্যায়, অচ্যুত পটবর্ধন, রামমনোহর লোহিয়া । এসময়ে ওরা সবাই নাসিক জেলে ।

    এত কথা উঠল দুটো কারণে । সুভাষচন্দ্র্রের অনুপস্থিতিতে দেশের হাওয়া কতটা বদলেছিল, তার একটা মোটামুটি চুম্বক দেয়া ও সেক্ষেত্রে শরত্চন্দ্রের দানের কথা বলা ছাড়া এমন কিছু নাম পঠকের কাছে তুলে ধরা, যাঁরা আমার কৈশোর ও যুবাবস্থায় আমার নমস্য ছিলেন । বর্তমান কালে এঁদের কথা লোকে কতটা মনে রেখেছে, আমি জানি না ।

    সুভাষের কথায় ফেরা যাক । ওনাকে বন্দী রাখার বিরুদ্ধে একটা জনমত গড়ছিল । পণ্ডিতজী একদিনের জন্য `সুভাষ ডে' ঘোষণা করলেন । কেন্দ্রীয় পরিষদে ওনার কারাবাসের সম্বন্ধে বিতর্ক উঠল । সরকার বলল, উনি বিপজ্জনক লোক ।

    সুভাষকে প্রথমে বোম্বাইয়ের জেলে রাখা হয়েছিল, পরে পুনার কাছে ইয়রবদায় বদলি করা হয় (একরকম `ফোল্ডিং' চরকার নাম ছিল `ইয়রবদা চরকা' - সেকথা এই যন্ত্রযুগে আর বোধহয় কারো মনে নেই) । কিন্তু ওনার শরীরের জন্যও বটে ও খানিকটা জনমতের জন্যও, ওনাকে এরপরে কার্সিয়ংএ শরত্চন্দ্রের বাড়িতে নজরবন্দী রাখা হয় । এখানে প্রথমটা উনি ভাল ছিলেন । এই সময়ে শ্রীমতী শেংকলের সঙ্গে তাঁর নিয়মিত পত্রালাপ হোত । দুজনেই পরস্পরের মঙ্গলার্থী ছিলেন - কথা হোত সেই নিয়েই । রাজনৈতিক কথা কইবার থাকলেও উপায় ছিল না - চিঠিপত্র কড়া সেন্সর করা হোত ।

    কিন্তু কোন কারণে ওখানেও ওনার স্বাস্থ টিঁকল না (আমার ধারণা ওনার শরীর কোনদিনই ভাল ছিল না - কাজে ব্যস্ত থাকলে উনি সেটাকে ভুলে থাকতেন অনেকটা) । বাংলার গভর্নর কেন্দ্রীয় সরকারকে জানালেন যে দেশের এবং ওনার বর্তমান অবস্থায় ওনাকে ছেড়ে দিলেও ওনার পক্ষে কোন ক্ষতিকর কাজ করা সহজ হবে না । শেষ অবধি ১৯৩৭ সালে উনি নি:শর্ত মুক্তি পেলেন ।

    পেলেই যে পূর্ণ উদ্যমে কাজে নামতে পারলেন তা নয় - শরীর করতে দিল না । কলকাতায় একদিন `সুভাষ ডে' পালন করা হল । স্বয়ং কবিগুরু অভিনন্দন পাঠালেন । ফুলের মালায় টেবিল ভরে গেল । ওনার বহুদিনের ইচ্ছা ছিল যে স্বাধীনতা-সংগ্রামীদের স্মৃতিতে একটা স্থায়ী প্রতিষ্ঠান তৈরি হোক, এই সময়কার উত্সাহে মহাজাতি সদনের গোড়াপত্তন হোল । কর্পোরশনে এবং প্রাদেশিক কংগ্রেসে ওনার নেতৃত্ব বাঁধাই ছিল, কিন্তু তার ভার নেবার আগে আরো কিছুদিন বিশ্রাম নেবার জন্য তিনি মাস পাঁচ ডালহাউসিতে গিয়ে রইলেন । ইংলণ্ডের ছাত্রজীবন কালে লণ্ডনের এক পাঞ্জাবি ডাক্তার-পরিবারের সঙ্গে ওনাদের হৃদ্যতা হয়েছিল, ডালহাউসিতে তাঁদের বাড়িতে রইলেন । পড়াশোনা চলতে লাগল । পুরোন বন্ধু দিলীপ রায়ের সঙ্গে পত্রালাপে আধ্যাত্মিক মতামতের আদানপ্রদান হতে লাগল । ইতিমধ্যে কলকাতায় মেজদা শরত্চন্দ্রের ওকালতি ও বাংলার আইনসভায় কংগ্রেসের প্রধান মুখপাত্র হিসাবে চিরাচরিত কাজ চলতে লাগল । এই দুটো জিনিষেরই প্রচুর আলোচনা গর্ডন-সাহেবের বইয়ে পাওয়া যাবে । বর্তমানে শরত্চন্দ্রের সম্বন্ধে এইটুকু বলি যে ওনার দেশসেবাটা চিরকালই সংগঠন, আইন ও বিতর্ক দিয়ে তৈরি হয়েছিল । সে সময়কার আইনসভায় সরকার পক্ষের সঙ্গে যে বাকযুদ্ধ হোত তা এখনকার আইনসভাগুলোর থেকে পৃথক কিছু নয় । বাজেট নিয়ে যে বিতর্ক হোত, সে আজও চলছে । সরকার চাইছে পুলিশ, সরকারি কর্মচারীদের বেতন, আইন-শৃঙখলা রক্ষাটাই আসল, বিপক্ষ দল বলছে শিক্ষা, গণসেবা এগুলোর বেলা এত গাফিলতি কেন ? অবশ্য বিতণ্ডার ভাষাটা মর্কিনের থেকে বেশি ইংরেজি হাউস অফ কমন্সের গা ঘেঁষা ।

    কেন্দীরয় কংগ্রেসে জবাহরলাল পরপর দু-বছর সভাপতি ছিলেন । গান্ধীজি বুঝতে পেরেছিলেন যে ওনার থেকে বাম-ঘেঁষা লোকেদের প্রাধান্য উনি রোধ করতে পারবেন না । জবাহরলালকে উনি অনেকটা বশে রাখতে পারতেন, সেদিক থেকে ওনার পরে কাকে সভাপতি করা হবে, সেটা চিন্তার কথা ছিল - সুভাষ জবাহরলালের বন্ধূ, সে হিসাবে পরোক্ষে হয়তো কিছুটা প্রভাব রাখা যাবে, কিন্তু পুরো বিশ্বাস করতে পারছিলেন না । তবু পরের কংগ্রেসে ওনাকেই সভাপতি করতে মনস্থ করলেন (কমিটির ভোট তখনো হয়নি - তবে ওয়ার্কিং কমিটি ওনাকে অমান্য বেশি করত না) । মহাত্মা সুভাষকে বললেন যে ওনার স্বাস্য্থটাকে হয়তো আরো একটু ভাল করা যাবে, যদি তিনি অল্প কিছুদিন আবার য়োরোপে গিয়ে থাকেন ।

    এবার উনি প্রধান ঘাঁটি করলেন সুইটজরল্যাণ্ড ও অস্ট্রিয়ার সীমার কাছে অস্ট্রিয়ার বাডগাস্টাইনে - ওখানের উষ্ণ প্রস্রবণে ওনার স্বাস্থ্য পুনরুদ্ধার হবার ভরসা ছিল (এর আগে জর্মানিতে থাকার কালেও উনি কতগুলি স্পা-তে সময় কাটিয়েছিলেন) । একটা আত্মজীবনী লেখার ইচ্ছ তাঁর ছিলই । সেকাজে সাহায্য করার জন্য উনি শ্রীমতী শেংকলকে বাডগাস্টাইনে আসতে অনুরোধ করলেন ।

    ওনার আত্মজীবনী `ইণ্ডিয়ান পিলগ্রিম'এ ওনার জীবনদর্শন ও এবারকার সফরের সময়ে ওনার রাজনৈতিক বিবর্তনের কিছু চুম্বক গর্ডন-সাহেব দিয়েছেন ; আরেকটা ব্যাপারের আলোচনারও সময় বোধহয় এসেছে, সেটা হোল এমিলি শেংকলের সম্বন্ধে নেতাজির বিবাহের কথা । গর্ডন-সাহেব ও-দুটোকে এক সুতোয় বাঁধবার একটু চেষ্টা করেছেন, আমার মত মেলেনি, বোধহয় সেকথাও এসে পড়বে ।

    এমিলি শেংকল গর্ডন-সাহেবকে বলেছিলেন যে বাডগাস্টাইনে ১৯৩৭ সালের ডিসেম্বর মাসে গোপনে ওদের বিবাহ হয় । তাঁর কথা ছাড়া এব্যাপারে কোন প্রমাণ নেই । যুদ্ধোত্তর য়োরোপে যুদ্ধপূর্ব সরকারি কাগজপত্র পাওয়া কঠিন । সুভাষচন্দ্রের আত্মীয়া শ্রীমতী কৃষ্ণা বসু ১৯৭২ সালে `ইলাস্ট্রেটেড উইকলি'তে লিখেছেন যে ওদের বিবাহ ১৯৪১ সাল নাগাদ যুদ্ধের সময়ে জার্মানিতে গোপনে হিন্দুমতে হয় । অন্যান্য জীবনীকার বলেছেন ১৯৪২ । তারিখটা বড় কথা নয় । যুদ্ধের সময়ে ওরা স্বামী-স্ত্রী হিসাবে বাস করতেন একথা ঠিক । ওনাদের মেয়ে অনীতার জন্ম ১৯৪২ সালে । নেতাজির মৃত্যুর পরে শরত্চন্দ্রর হাতে ওনার চিঠি এসেছিল, তাতে তিনি এমিলিকে নিজের স্ত্রী বলে পরিচয় দিয়েছেন ও কন্যা অনীতার কথা জানিয়েছেন । পরবর্তীকালে শরত্চন্দ্র সপরিবারে ভিয়েনাতে ওনাদের সঙ্গে দেখা করেছিলেন । ১৯৪৮ সালে ওনাদের গ্রুপ ছবি গর্ডন-সাহেবের বইয়ে আছে । আমি নিজে বারকতক ভিয়েনাতে গ্রীষ্ম কাটিয়েছি - একবার ওনাদের খোঁজবার চেষ্টাও করেছিলাম । শেংকল নাম তখন জানতাম না । এমিলি বেঁচে আছেন কিনা আমি জানি না । অনীতার বিবাহিত নাম যদি থাকে (তাঁর বয়স এখন ষাটের ওপর) সেটা বসু বা শেংকল কোনটাই নয় । কলকাতায় বসুপরিবারের কাছ থেকে ছাড়া বা হয়তো গর্ডন-সাহেবের কাছে ছাড়া ওদের বর্তমানের কথা জানা কঠিন ।

    বাডগাস্টাইনে ফিরে যাই । `ইণ্ডিয়ন পিলগ্রিম'এ ওনার জীবনদর্শনের বিস্তারিত বিবরণ সুভাষ দিযেছেন । তার সঙ্গে তাঁর `ইণ্ডিয়ান স্ট্রগল'এ লেখা রাজনৈতিক মতামতের সম্পর্ক দেখিযে উনি আরো লিখতে চেয়েছিলেন, কিন্তু তা আর করা হয়ে ওঠেনি । `ইণ্ডিয়ান পিলগ্রিম' ১৯৪৮ সালে কলকাতায় প্রকাশিত হয়েছিল । ঐ বইয়ের সবচেযে বড় মূল্য হোল তাঁর আত্মবিশ্লেষণে তাঁর জীবনদর্শনের ত্রক্রমবিবর্তনের ইতিহাস ।

    বাড়ির ছোটছেলের আত্মবিশ্বাস সচরাচর কম হয় - দাদা-দিদিদের ক্ষমতার ওপরেই বিশ্বাসটা বেশি থাকে । কিন্তু সুভাষের বিপ্লবী মন সেটা থেকে বেরোতে চাইছিল গোড়া থেকেই । ওনার ছেলেবেলার জনসেবা, তাঁর বাড়ি থেকে পালিয়ে গুরু খোঁজা, সবই শক্তি-সংগ্রহের চেষ্টা । কিন্তু ওর মনে ধর্ম-জিজ্ঞাসাও প্রথম থেকে ছিল । বিবেকানন্দর কাছ থেকে শিখলেন ধর্মক্ষেত্রে সেবার সার্থকতা । সাধকদের অনুকরণে কামিনী-কাঞ্চন-ত্যাগ তার সঙ্গে জড়িয়ে গেছিল । জনসেবার ক্ষেত্রে বিদেশি শাসন যে প্রতিবন্ধক, সেটা তিনি বুঝেছিলেন - ওনার বিদ্রোহী মনটা সেখান থেকে স্বরাজ-আন্দোলনে স্বভাবতই সরে গেছিল । কিন্তু আরো বড় বয়সে, নানা সময়ে যখন কর্ম থেকে বিরত হতে হোল তখন তিনি বিস্তর পড়াশোনা ও চিন্তা করারও সময় পেয়েছিলেন তখন থেকে ওনার কাছে ধর্ম, রাজনীতি, অর্থনীতি সব এক সুতোয় বাঁধা হয়ে গিয়েছিল । ঈশ্বরের সঙ্গে বিশ্বপ্রেমের সম্পর্ক তিনি উপলব্ধি করেছিলেন । নিজেকে কর্মযোগী হিসাবে দেখতে পেয়ে তিনি এটাও বুঝতে শুরু করেছিলেন যে ওনার প্রথম বয়সের ব্রহ্মচর্যের চেষ্টা (যেটা ওনাকে ছেলেবেলায় প্রচুর কষ্ট দিয়েছে) জ্ঞানযোগীর যতটা আরব্ধ, ওনার ততটা নয় ।

    আমার আন্দাজ এই যে শ্রীমতী শেংকলের নিকট সংসর্গে আসার ফলে উনি তাঁকে নিজের উত্তরসাধিকা পেয়েছিলেন । সেখান থেকেই বোধহয় তাঁর যৌনজীবনের পরিবর্তনের শুরু । কিন্তু এখানে গর্ডন-সাহেব ওটাকে ওনার বিশ্বপ্রেমের সঙ্গে এক করেছেন । আমার ধারণা যে বৈষ্ণবদের মধ্যে প্রেম শব্দটা যেখানে বিশ্বপ্রেম বা ঈশ্বরপ্রেম অর্থে ব্যাবহার হয়, সেটা গর্ডন-সাহেব তলিয়ে দেখেননি অথবা জানতেন না । প্রেম শব্দটার ইংরেজি প্রতিশব্দ `লভ' ধরে উনি শ্রীমতী শেংকলের সঙ্গে সুভাষের প্রেম-সম্পর্কটা সুভাষের ধর্মভাবের অংশ হিসাবে ধরেছেন (খনিকটা তান্ত্রিকদের মতো) । খুব একটা এসে যায় না অবশ্য - নিজের জীবনে দেখেছি ও দুটো প্রেমের মধ্যে জট ছাড়াবার খুব একটা প্রয়োজন নেই ।

    ওনার রাজনৈতিক মতের কিছু বিবর্তন এইবারকার য়োরোপ সফরের সময়ে কিছু বক্তৃতায় স্পষ্ট হয়েছিল । ওনার ছাত্রজীবনের পরে এই প্রথমবার তিনি ইংলণ্ড যান । ইংলণ্ড-প্রবাসী ভারতীয়রা এইসময়ে ওনাকে আমন্ত্রণ করেন আগেরবারের মতই । ব্রিটিশ পাসপোর্ট-ধারী লোকের ইংলণ্ড-যাত্রায বাধা দেবার ক্ষমতা ইংরেজ সরকারের ছিলনা - ওরা শুধুংউ ওনাকে এ ব্যাপারে হুমকি দিত । এবার উনি সেটা মানলেন না । ইংলণ্ডে প্রচুর সম্বর্ধনা পেলেন । ভারতীয় সংস্থাগুলোর সঙ্গে তো বটেই, নানা রাজনৈতিক দলের প্রতিভূদের সঙ্গে ছাড়া ভারতের পূর্বতন রাজপ্রতিনিধিদের সঙ্গেও দেখা হোল ।

    ওখানেই কোন একটা সভায় ওনাকে ফ্যাসিষ্টবাদ সম্বন্ধে প্রশ্ন করা হয় । মুসোলিনির সম্বন্ধে ওনার পূর্ববর্তী শ্রদ্ধাভাব আগেও কেউ ভালো চোখে দেখেনি । উনি তখন ফ্যাসিষ্টদের মধ্যে দেশপ্রেম ও নিয়মানুবর্তিতাটাই বড় করে দেখেছিলেন - সেই নিয়ম চালু করতে যে অত্যাচারটা হয়েছিল, সেটাকে তিনি আমল দেননি । কিন্তু এর মধ্যে ইটালি ও জার্মানির রাজনৈতিক চেহারাটা যা দেখা যাচ্ছিল, সেটা সুভাষকে মত পরিবর্তনে বাধ্য করে । এটা উনি সেই সভায় স্পষ্ট স্বীকার করেছিলেন ।

    য়োরোপ ছেড়ে দেশে ফেরবার সময় হয়েছে এবার । উনি এবার বিদেশে থাকার সময়েই কংগ্রেসের কেন্দ্রীয় কমিটি ওনাকে পরবর্তী সর্ব-ভারতীয় কংগ্রেস অধিবেশনের সভাপতি মনোনীত করে । স্বাস্থ্য অনেক ভাল হয়েছিল (শুধুংউ বাডগাস্টীনের হাওয়া নয়, শ্রীমতী শেংকলের সাহচর্য বোধহয় তার জন্য দায়ি ) । উনি দেশে ফিরে এলেন ।

    এবং দেশে ফিরেই কাজে ডুবে গেলেন । এক মাসের মধ্যে হরিপুরায় জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতিত্ব করতে গেলেন - বাংলার প্রাদেশিক কংগ্রেসের সভ্য হিসেবে শরত্চন্দ্র স্বভাবতই গেলেন । ট্রেনে গেলেন হিন্দি-উর্দূ শিখতে শিখতে ।

    কংগ্রেসের অধিবেশনে যা ধুম হয়, সে প্রায় দিল্লী দরবারের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে । দর্মার বেড়ায় ঘেরা প্রায় দু বর্গমাইল জুড়ে শহর তৈরি হয়েছিল এবার । স্বেচ্ছাকর্মী ইঞ্জিনিয়রদের সাহায্যে সেখানে জল, বিদ্যুত্‌, কিছুরই অভাব ছিল না । একজন `নেটিভ স্টেট'-এর রাজার ধার দেওয়া একান্ন বলদে টানা রথে সুভাষকে অধিবেশনে নিয়ে যাওয়া হোল ।

    তাঁর ভাষণে সুভাষ আবার পূর্ণ স্বরাজের দাবির কথা বললেন । বললেন ভারতের কনিস্টিট্যুশন ভারতকেই তৈরি করতে হবে । ভারতের অর্থনৈতিক কাঠামো সমাজনৈতিক না হলে দরিদ্র জনসাধারণের মঙ্গল হওয়া কঠিন । ইংরেজের সঙ্গে ফেডরেশন সম্ভব হোত, যদি ইংলণ্ড সমাজতান্ত্রিক দেশ হোত ।

    কংগ্রেসের দক্ষিণপন্থী দল অবশ্যই এতে খুশি হোল না । সর্দার বল্লভভাই পটেল (যাঁর দাদা বিঠলভাইয়ের দেওয়া টাকা সুভাষচন্দ্র কোনদিন পাননি) যে বক্তৃতা দিলেন -- স্বয়ং মহাত্মা বললেন তাঁকে একটু নরম হতে । বামপন্থীদের খুশি করতেই সুভাষকে যখন সভপতি করা হয়েছে, তখন তাদের কিছুটা আস্কারা না দিলে ক্ষতি হে, এট মহাত্মাজী জানতেন । ওনার ভরসা ছিল যে জবাহরলালকে উনি যেমন মিষ্টি কথায় বশে রাখতে পেরেছেন, এখনেও তার পুনরার্বৃংইত্ত হতে পারবে । মহাত্মার প্রতি সুভাষও শ্রদ্ধা রাখতেন - মতদ্বৈধ যতই হোক - উনি অহিংস পথে নিজেও চলেছিলেন ।

    কিন্তু ওয়র্কিং কমিটি তৈরি করার সময়ে বামপন্থীদের খুব সুবিধা হোল না । কম্যুনিষ্টদের সঙ্গে কংগ্রেস সোশ্যলিস্টদের খিটিমিটিতে বামপন্থীরা দুর্বল ছিল - দক্ষিণপন্থীরা মহাত্মার নেতৃত্বে সংহত ।

    কাজ চলতেই লাগল । সুভাষচন্দ্রের চিরদিনই ইচ্ছা ছিল যে একটা অর্থনৈতিক পরিকল্পনার কাজ শুরু করার সময় হয়েছে । জবাহরলালের নেতৃত্বে সে পরিকল্পনার কাজ আরম্ভ হোল (স্বাধীন ভারতের পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনাগুলোর র্ভিংইত্ত এইখানে) । প্রাদেশিক যে সব সরকারগুলো কংগ্রেসের অধীনে ছিল (বাংলার কথা পরে আসছে), তাদের মধ্যে দলাদলির সালিশি মহাত্মাজির দল যেভাবে করতে চাইলেন, সুভাষ একমত হলেন ।

    দ্বন্দ্ব্ব আরেকটা বাধল আন্তর্জাতিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে । সুভাষচন্দ্র যদিও ফ্যাসিষ্টদের সম্বন্ধে তাঁর মত বদলেছিলেন, কিন্তু তাঁর মনে এ কথাটাও ছিল যে ইংরেজের বিরুদ্ধতা করতে হলে ইংরেজের শত্রুদের সাহায্য কাম্য হতে পারে । ইটালি, জার্মানি, জাপান ভাল কাজই করুক বা মন্দ কাজই করুক, তারা ইংরেজের শত্রু বলে তারা আমাদের বন্ধু । কংগ্রেসের মধ্যে মহাত্মাজী যে ন্যায়বোধের প্রচার করেছিলেন, সেখানে এ-মত গ্রাহ্য হতে পারে না । কংগ্রেসের পক্ষ থেকে চীনাদের সাহায্য করবার জন্য একটা ডাক্তারি মিশন আগেই গিয়েছিল (চীন-জাপানের যুদ্ধ তখন শুরু হয়ে গেছে - এই মিশনের কাজ সম্বন্ধে রাশিযা থেকে `ডাকটর কোটনিসকী অমর কহানী' নামের হিন্দি সিনেমা আমরা ছেলেবেলায় দেখেছিলাম) । নেতাজির তাতে আর্পংইত্ত ছিল না, কিন্তু জাপানকে শত্রু ভাবা তিনি ভুল বলে ভাবতেন । বিপ্লবী রাসবিহারী বসু এর অনেক আগে দেশ থেকে পালিয়ে জাপানে বাস করছিলেন এবং সেখানকার ভারতীয়দের সঙ্ঘবদ্ধ করছিলেন । এঁনার সঙ্গে নেতাজির পত্রালাপ ছিল । তিনি জাপানের এশিয়া-সঙ্ঘের পরিকল্পনাতে বিশ্বাস করতেন । নেতাজির এই মতের প্রভাব পরবর্তীকালে অনেক পড়েছিল, কিন্তু যখনকার কথা বলছি, তখন তাঁর এই দৃষ্টিভঙ্গি ওনার সঙ্গে কংগ্রেসের একটা শক্তিশালী অংশের বিরোধই গড়ে তুলছিল । ইংরেজদেরও খুশি করেনি অবশ্যই ।

    কংগ্রেসের সঙ্গে দ্বন্দের আরও কারণ তৈরি হতে লাগল পুরো ১৯৩৭ সাল ধরে । সর্বভারতীয় কংগ্রেসে তিনি যা করছিলেন, সে-ছাড়া বাংলা প্রাদেশিক কংগ্রেসের সভাপতিত্ত্ব তাঁর ছিলই । এই সময়ে কলকাতা কর্পোরেশনেও ওকে অল্ডরম্যান করা হোল । কর্পোরেশনে প্রচুর দুর্নীতি ঢুকেছিল - সুভাষ আগে থেকেই সে-সম্বন্ধে সচেতন ছিলেন । এখন ভরসা করা গেল উনি এ-সম্বন্ধে কিছু করতে পারবেন ।

    এখানে যে সংঘাতগুলো বাধল, সেগুলো আগে থেকেই ধূমায়িত হচ্ছিল । বাংলার আইনসভায় শরত্চন্দ্র-প্রমুখ নেতারা কংগ্রেসের কথা ঠেলে ঢুকেছিলেন । কিন্তু ইংরেজের নতুন সাম্প্রদায়িক বিভাগনীতির ফলে মন্ত্রীসভায় তখন ফজলুল হকের মন্ত্রীত্বে সরকার গড়েছিল । হক তখন মুসলিম লীগে যোগ দিয়েছেন । বোধহয় লীগের কথটার কিছু আলোচনা এখন দরকার ।

    মুসলিম লীগে তখন মুহম্মদ জিন্নাহ (পাকিস্তানের কায়দ-এ-আজম) একচ্ছত্র । শুধু মুসলমানদের স্বার্থসংরক্ষণ তাঁর উদ্দেশ্য নয়, তাঁর আবদার যে ভারতের মুসলমানদের প্রতিভূ হিসাবে লীগ ছাড়া আর কাØউকে মানা চলবে না । কংগ্রেস ভারতের প্রতিজনের প্রতিনিধি একথা তাঁর কাছে গ্রাহ্য নয় । কংগ্রেসের সঙ্গে কোন বৈঠক হলে সেখানে কংগ্রেস পক্ষে কোন মুসলমান বসতে পাবে না । (কায়দ-এ-আজম ইংরেজি ছাড়া উর্দুও বলতে পারেন না, মৌলানা আজাদ ইসলাম দর্শনে বিদগ্ধ - তাতে কী হোল, জিন্নাহ সাহেব প্রকৃত মুসলমান, মৌলানা হিন্দুদের সংশ্রবে হিন্দু হয়ে গেছেন) । সুভাষচন্দ্র কংগ্রেসের সভাপতি হবার পর জিন্নাহ সাহেবের সঙ্গে পত্রালাপের চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু কংগ্রেস মুসলমানদের রাখলে জিন্নাহ সাহেব তার সঙ্গে কোন রকম চুক্তিতে রাজি নন । হিন্দু মহাসভার এতে আর্পংইত্ত ছিল না, কিন্তু কংগ্রেসের ছিল । কাজেই ও পত্রলাপে কোন কাজ হোল না ।

    অথচ বাংলার আইনসভায় তার ব্যতিক্রম হোল । শরত্চন্দ্র এবং তাঁর দলের লোকেরা হক মন্ত্রীসভাকে এমন কোন আইন করতে দিলেন না যাতে হিন্দু ও মুসলমানদের আলাদা করে দেখা হয় । কর্পোরেশনে কজন মুসলমান সভ্য থাকবেন, সেটা নিয়ে উভয পক্ষের চুক্তি হতে পারে, আইন করলে চলবে না । এদিকে হিন্দু মহাসভা আবদার করছেন যে মুসলমানদের কোন বিশেষ স্থান দিয়ে চুক্তি করার তাঁরা ঘোর বিরোধিতা করবেন । শরত্চন্দ্র দেশের লোকেদের কাছে গিয়ে বলছেন যে যে হিন্দু-মুসলমান জনতার মধ্যে তিনি কোনদিন কোন বিরোধ দেখেননি । ঝগড়া যেটা সেটা নেতাদের ব্যক্তিগত স্বার্থের ঝগড়া ।

    হক মন্ত্রীসভার বিরুদ্ধে কংগ্রেস ও কৃষক-প্রজা-পার্টির লোকেরা নো-কনফিডেন্স আনতে চাইলেন । কিন্তু জাতীয় কংগ্রেসের কাছে কোন সাহায্য পেলেন না । জাতীয় কংগ্রেসের পৃষ্ঠপোষক জমিদারেরা ফজলুল হকের কৃষক-প্রজা পার্টির দিনগুলোর কথা স্মরণ করে বুঝেছিলেন যে হক মুসলিম লীগে থাকলেই তাঁদের জমিদারির সুবিধা । এ-ব্যাপারেও বাংলার ও জাতীয় কংগ্রেসের বিরোধ জট পাকিয়ে উঠল । এর জন্যও জাতীয় কংগ্রেসে সুভাষচন্দ্রের শক্তি কমে যেতে লাগল ।

    ১৯৩৮এর মাঝামাঝি থেকেই বোঝা যেতে লাগল যে পরের বছরের নির্বাচনে সুভাষচন্দ্রের সভাপতিত্ব পাওয়া মহাত্মাজীর মন:পূত নয় । সুভাষচন্দ্রকে কংগ্রেসের বেশ কিছু শক্তিশালী সভ্য অনুরোধ করলেন এবারের নির্বাচনে না দাঁড়াতে - দাঁড়ালে কংগ্রেসে অন্তর্দ্বন্দ্ব বাড়বে । গান্ধিজী মৌলানা আজাদ ও জবাহরলালকে অনুরোধ করলেন নির্বাচনের জন্য দাঁড়াতে । দুজনের কেউই রাজি হলেননা । সুভাষ বললেন যে বামপন্থীদের পক্ষ থেকে আচার্য নরেন্দ্র দেব প্রমুখ কোন শক্তিশালী লোক দাঁড়াতে রাজি হলে তিনি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন না । নরেন্দ্র দেব রাজি হলেন না । গান্ধিজী পট্টভি সিতারামাইয়াকে দাঁড় করালেন । নেতাজি তার বিরোধিতায় নিজে নামলেন এবং ২৬০০ ভোটের মধ্যে ২০০ ভোটে জযী হলেন ।

    এইবারে সত্যিকারের বিরোধ শুরু হোল । মহাত্মাজী যে-ভাষায় পরাজয় স্বীকার করলেন সেটাকে অভিমানের ভাষা বলা উচিৎ না যুদ্ধ ঘোষণা বলা উচিৎ এ নির্ণয় করা কঠিন । তবে একটা কথা বললেন, সে হোল, `সুভাষ বাবু যখন কংগ্রেসের সভাপতি তখন `ওয়ার্কিং কমিটি' গড়ার পুরো ভার তাঁকেই দেওয়া উচিৎ । সেই কমিটির মধ্যে কোন মতদ্বৈধ দেখা দিলে ওনার কাজের অসুবিধা হবে । আমরা যারা কোন ব্যাপারে ওনার সঙ্গে একমত হতে পারব না, তখন সহযোগিতা করতেও পারব না হয়ত, কিন্তু কমিটির মধ্যে বাধা সৃষ্টি করা অন্যায় হবে ।' ওনার দল ইঙ্গিতটা বুঝল - কমিটির প্রায় পুরোটা (দুই বসুভ্রাতা বাদে, জবাহরলাল সুদ্ধ) পদত্যাগ করল । `ইণ্ডিয়ান স্ট্রগল'এ নেতাজি যাঁদের পুরাতনপন্থী গতিহীন বলেছিলেন, তারা শোধটা পুরোপুরি তুলল ।

    উগ্রপন্থী মানবেন্দ্র রায় নেতাজিকে বললেন, `ভাল হয়েছে, এবার কংগ্রেসের শাসনভার আমরাই নেব ।' কিন্তু `আমরা' কারা ? কংগ্রেস সোশিয়ালিস্টরা সুভাষের সঙ্গে সব ব্যাপারে একমত নন, কম্যুনিষ্টরা দেশটাকে রাশিয়ার ছাঁচে না ঢালতে পারলে খুশি নয়, গান্ধিজীর `একতাবদ্ধ কমিটি' গড়বে কে ? নেতাজি নিজে মহাত্মাকে শ্রদ্ধাও করতেন, আর এটাও জানতেন যে মহাত্মা না থকলে কংগ্রেসের আপামর জনতাও সঙ্গে থাকবে না । আচার্য কৃপালনি বললেন, `গাছেরও খাবে, তলারও কুড়োবে, সে হয় না । গান্ধীজীর প্রোগ্রাম তোমার পছন্দ হবে না আর তাঁকে দলে পাবে, এ আশা দুরাশা ।'

    সুভাষচন্দ্রের ১৯৩৮এর জয়লাভের পর পুরো কংগ্রেসের অধিবেশন হোল ত্রিপুরীতে । নেতাজি তখন অসুস্থ, কিন্তুংউ সে কারণেও সভা পেছানো হোল না । ১০৪ জ্বর নিয়ে নেতাজি ও সঙ্গে মেজদা ত্রিপুরী গেলেন ।

    মহাত্মা নিজে ত্রিপুরী গেলেন না, রাজকোটে একটা আন্দোলনের নাম করে রয়ে গেলেন । কাজেই ত্রিপুরীতে যা ঘটল সেটার জন্য তিনি দায়ভাগি রইলেন না । গোবিন্দবল্লভ পন্থ লিখিত-পঠি.ত প্রস্তাব আনলেন, `এতদিন মহাত্মা গান্ধীর অধীনে কংগ্রেস যে-পথে চলেছিল, সে-পথের পরিবর্তন করা হবে না । কমিটির পূর্বতন সভ্যদের সম্বন্ধে বিরূপ মন্তব্য করলে সেই পথকে ব্যাহত করা হবে । এই মতদ্বৈধের ফলে যে দু:সময় আসতে বাধ্য, সেই সময়ে মহাত্মা ছাড়া কারও নেতৃত্ব মঙ্গলকর নয় ।'

    নেতাজির দল ভাষায় কিছু পরিবর্তন আনার চেষ্টা করল, নেতাজি সুস্থ হওয়া পর্যন্ত প্রস্তাব মুলতুবি রাখার চেষ্টা করল, গান্ধীপক্ষ অনড় রইল । নির্বাচনের সময়ে বামপন্থীরা যে একতা দেখিয়েছিল, তাতে ততদিনে ফাট ধরে গেছে - কংগ্রেস সোশিয়ালিস্টদের জয়প্রকাশনারায়ণ পর্যন্ত গান্ধীজীর দিক নিলেন । অর্থাৎ দেখা গেল যে নতুন ওয়ার্কিং কমিটি গড়তে গেলে পুরোন মতেই গড়তে হবে । নেহরু চেষ্টা করলেন দু-দলের মধ্যে একটা মতৈক্য আনার (উনি এখন পর্যন্ত নেতাজির বন্ধুই ছিলেন, যদিও, `ইংরেজের শত্রুরা আমাদের বন্ধ'ংউ এ মত তিনি কোনদিন মানেননি) । সে চেষ্টা ফলপ্রসূ হোল না । গান্ধীজিঅনড় রইলেন, `তোমার জয় হয়েছে - তুমি যা ভাল বুঝবে কর - আমার মতের অপেক্ষা কোর না ।'

    নেতাজির পরিকল্পনা ছিল যে কংগ্রেসের পক্ষ থেকে ইংরেজ সরকারকে বলা হবে একটা বিশিষ্ট সময়ের মধ্যে ভারত ত্যাগ করতে (যেটা চার বছর পরে মহাত্মাজী স্বয়ং করেছিলেন) । গান্ধীপন্থিরা বলছিলেন দেশ এখনো তার জন্য তৈরি নয় । নেতাজি দেখলেন পুরো গান্ধীবাদি দলটার বিরুদ্ধে পুরো বামপন্থী সহায়ের অভাবে একা কিছু করা সম্ভব হবে না । নেহরু ও গান্ধিজী সম্বন্ধে হয়তো অভিমানও ছিল । উনি সভাপতিত্ব ত্যাগ করলেন । নেহরু ওনাকে পদত্যাগ করতে বারণ করেছিলেন (ওর হয়তো ভরসা ছিল এখনো একটা সমঝোতা দাঁড় করান যাবে) । এতে নেতজী রাজি হলেন না ।

    বামপন্থীদের সমবেত করে একটা সংস্থা গড়া হোল, ফরোয়ার্ড ব্লর্ক । তার কাগজ বেরোল, দেশে দেশে ঘুরে তার আদর্শের কথা বললেন, কিছু সাহায্য পেলেন, কিছু পেলেন না । দলটা কংগ্রেসের ভেতর থাকবে, এই চেষ্টা তিনি করছিলেন । ইংরেজরা ওকে সন্ত্রাসবাদী বিপ্লবী হিসাবেই চিরকাল দেখেছে - ফরোয়ার্ড ব্লকে ধরপাকড় শুরু হোল । কংগ্রেস তার বিরুদ্ধে কোন প্রতিবাদ করল না । ততদিনে বিশ্বমহাযুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে । কংগ্রেসে জার্মান, ইটালিয়ানদের ওপর কোন সহানুভুতি ছিল না । তাঁরা ইংরেজদের বললেন যে তাঁরা যুদ্ধ-প্রচেষ্টায় বাধা দেবেন না, বরঞ্চ পারলে সাহায্য করবেন, কিন্তু তার পরিবর্তে কী পাবেন সেটা জানতে চাইলেন । ইংরেজরা এ ব্যাপারে দেশিয় রাজাদের সঙ্গে ছাড়া কোন কথাই বলল না । নানা প্রদেশে কংগ্রেস সরকার যা ছিল, এর প্রতিবাদে পদত্যাগ করল । পুরোপুরিভাবে অসহযোগে না নেমে ঠিক হোল যে ব্যক্তিগত অসহযোগ ও সত্যাগ্রহ করা হবে । বাংলায় তখন ফজলুল হকের অধীনে মুসলিম লীগের রাজত্ব, সেখানে আইনসভায় কংগ্রেসের প্রতিভূ হিসাবে শরত্চন্দ্র এবং তাঁর সঙ্গীরা আইনসভায় থেকে লড়তে লাগলেন । কেন্দ্রীয় কংগ্রেস সেই সময়ে এমন কিছু প্রস্তাব আনল, যেগুলো সুভাষচন্দ্রের আদৌ মন:পূত হোল না । উনি তার প্রতিবাদে আন্দোলন গঠন করতে লাগলেন । এবার কংগ্রেস চরম আঘাত দিল । ওকে বঙ্গীয় কংগ্রেসের সভাপতিত্ব থেকে বরখস্ত করল এবং ফতোয়া দিল যে তিন বছর তিনি কংগ্রেসের কোন নির্বাচিত পদের জন্য দাঁড়াতে পারবেন না । বাংলার কংগ্রেসে সবাই এটা মেনে নিল না, সুভাষের দল আর কেন্দ্রীয় দলের মধ্যে রেশারেশি শুরু হোল । পরবর্তী নির্বাচনের আগে পর্য্যন্ত সাময়িক ভাবে মৌলানা আজাদ কেন্দ্রীয় দলের নেতৃত্ব পেলেন ।

    যুদ্ধ প্রচেষ্টায যোগদান সম্বন্ধে বাংলার মন্ত্রীসভাতেও কথা উঠল । জিন্নাহ সাহেবের মত হোল যে যদি ইংরেজরা মুসলিম লীগকে ভারতের মুসলমানেদের একমাত্র মুখপাত্র বলে স্বীকার করেন তাহলে লীগ যুদ্ধপ্রচেষ্টায় সাহায্য করবে । কর্পোরেশনে মুসলমানদের জন্য আলাদা আসন করার প্রস্তাব উঠল আবার, একথাও বলা হোল যে মুসলমান প্রতিনিধিদের জন্য শুধুংউ মুসলমানরাই ভোট দিতে পারবেন । শরত্চন্দ্রের দল ঘোর বিরোধিতা করলেন, কেন্দ্রীয় কংগ্রেস এই বিবাদে অংশ নিতে চাইল না । ব্যক্তিগত অসহযোগ এবং সত্যাগ্রহ চালু রইল ।

    এই সময়ে সুভাষচন্দ্র একটা নতুন আন্দোলনে নামলেন । কলকাতার পুর্বকালীন `হলওয়েল মনুমেন্ট'এর কথা এখন কজন জানেন জানি না, তাই বলতে হবে ।

    পলাশীর যুদ্ধের আগে বাংলার নবাব সিরাজুদ্দৌলা একবার কলকাতায় সৈন্য পাঠান (ঈষ্টইণ্ডিয়া কোম্পানি তখন বাদশাহী সনদ নিয়েই কলকাতায় রয়েছে) । কলকাতার ইংরেজ দুর্গে কয়েকজন ইংরেজকে আটক রেখে অনাহারে হত্যা করা হয় বলে জানা ছিল । `হলওয়েল মনুমেন্ট' তার স্মৃতিতে গড়া হয়েছিল । কিন্তু নেতাজির সময়ে অনেকে ঐ হত্যাকাণ্ডের কথা বিশ্বাস করত না, বলত ইংরেজের রটান কুত্সা । বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজদ্দৌলাকে ন্যায়বান বীর বলে বিশ্বাস করাটা ঐ সময়ে `পলিটিক্যালি করেক্ট' ছিল (স্বাধীনতার পরে ইতিহাসবেত্তারা অনেকে গল্পটাকে পাল্টেছেন বলে জানি) । সুভাষচন্দ্র বললেন যে সিরাজের নামে কলঙ্ক রটান ওই মনুমেন্টটাকে সরাতে হবে । সেখানে সত্যাগ্রহ করবার সময়ে ভারতরক্ষা আইন অনুসারে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হোল । আইনসভায় আন্দোলনের ফলে ফজলুল হক যদিও মনুমেন্টটাকে সরাতে রাজি হলেন, ইংরেজ কিন্তু সুভাষকে ছাড়ল না । উনি প্রেসিডেন্সি জেলে আটক রইলেন । এরপর থেকে ভারতীয় কংগ্রেসের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও নেতাজির সংগ্রাম সম্পূর্ণ ভিন্ন পথ নিল । মেজদা শরত্চন্দ্র ভাইয়ের সাথে রইলেন বাড়িতে, বসু পরিবার সর্বপ্রকারে সুভাষকে সাহায্য করলেন । কিন্তু সংগ্রামের ক্ষেত্র এবং ভঙ্গিটা শরত্চন্দ্রের নিজস্ব আইনগত রূপেই রয়ে গেল ।

    আজাদ হিন্দের গোড়াপত্তন এইখান থেকে । গর্ডন-সাহেবের বইয়ে শরত্চন্দ্রের সংগ্রামের কথা আমার এই চুম্বকের থেকে অনেক বেশি দেওয়া আছে । বাংলার নানা আইনের ব্যাপারে সরকারের সঙ্গে তাঁর বিরোধিতার কথা আমি কম বলেছি; গল্পটা সুভাষ সম্বন্ধেই প্রধানত বলছি ।

    বিদেশি সরকারের থেকে সাহায্য পাওয়ার কথা নেতাজি অনেকদিন থেকেই ভাবছিলেন - ওনার য়োরোপ সফরের কাহিনী থেকেই তার সন্ধান মিলবে । ফরোয়ার্ড ব্লকের মাধ্যমে উনি সেই চেষ্টা সচল রেখেছিলেন । ইটালি যদিও য়োরোপ সফরের সময়ে তাঁকে প্রচুর খাতির করেছিল, কিন্তু তাদের সামরিক ক্ষমতায় নেতাজির বিশ্বাস ছিল না । জার্মানি খুব একটা গা দেখায়নি সে কথা আগেই দেখা গেছে । উনি রশিয়া ও জাপানের সঙ্গে যোগ স্থাপন করবার চেষ্টা করছিলেন । শরত্চন্দ্রের মেজোছেলে অমিয় তখন য়োরোপে লেখাপড়া করছিলেন । একবার দেশ থেকে ফেরার সময়ে তিনি নেতাজির কাছ থেকে চিঠি নিয়ে য়োরোপের কমিন্টার্ন কর্মীদের কাছে নিয়ে গেছিলেন । কলকাতার জাপানি দপ্তরের সঙ্গে তিনি নিজেই দেখা করেছিলেন গোপনে, একজন বন্ধুর বাড়িতে । ফরোয়ার্ড ব্লকের সেক্রেটারি লাল শংকর লাল নেতাজির ভাইপো দ্বিজেশের সাহায্যে হীরালাল গুপ্ত ছদ্মনামে পাসপোর্ট নিয়ে জাপানি জাহাজে কলকাতা থেকে জাপান যান । সেখানে রাসবিহারী বসুর সঙ্গে ও জাপানের সরকারি দপ্তরে দেখা করেন । জাপান তখন `এশিয়াবাসীর জন্য এশিয়া' বলে আন্দোলন চালাচ্ছে । এশিয়ার নানা দেশের জাতীয়তাবাদীদের আশ্রয় দিচ্ছে ; লাল বোঝার চেষ্টা করছিলেন এর মধ্যে ভারতের স্থান কোথায় হবে । এর মধ্যেই তিনি ইংরেজের হাতে ধরা পড়ে যান ।

    এইসব চেষ্টা থেকে নেতাজি কতটা ফল পেয়েছিলেন বলা কঠিন । আর নেতাজির জেল হয়ে যাওয়ায় সব চেষ্টাতেই বাধা পড়ে গেছিল । উনি জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার চেষ্টা করতে লাগলেন । ওনাকে বিনা বিচারে আটক রাখার বিরুদ্ধে দরখাস্ত করে কোন লাভ হোল না যখন তখন তিনি চরম সিদ্ধান্ত নিলেন । আগে থেকে সরকারে চিঠি লিখে তিনি অনশন শুরু করলেন । এবারেও ফল হোল - ওনার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হোল - বলা হোল যে ওনার স্বাস্থ্য ফিরে এলেই ওনাকে আবার জেলে নিয়ে যাওয়া হবে । ইতোমধ্যে এলগিন রোডের বাড়িতে তিনি নজরবন্দী রইলেন ।

    এইবার দেশ ছাড়ার ষড়যন্ত্র শুরু হোল । নেতাজি এর আগে একবার নিজের সরকারি নথি দেখবার অবকাশ পেয়েছিলেন, তার থেকে জানা গেছিল যে কিছু জ্ঞাতি তাঁর সম্বন্ধে খবর সরকারের কাছে পৌঁছে দেয় । তাদের কাছ থেকে সব কথা গোপন রাখার ব্যবস্থা হোল । ১৯৪০ থেকেই উনি উত্তরপশ্চিম সীমান্ত দিয়ে দেশ ছাড়ার খবর করছিলেন - পাঞ্জাবের কীর্তি কিষান দল কম্যুনিষ্ট পার্টির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিল, ওদের গোপন কার্যক্রম বিস্তৃত ছিল । তারা ওনাকে সাহায্য করতে আগেই প্রস্তুত ছিল । তারা আফগানিস্তান ও রাশিয়ায় খোঁজ খবর করে ছিল (একজন এই চেষ্টায় প্রাণ দেয়)। ফরোয়ার্ড ব্লকের ওয়র্কিং কমিটির সভ্য মিয়াঁ আকবর শা এই সময়ে এলগিন রোডে আসেন এবং ফিরে গিয়ে ওনার যাত্রাপথের ব্যবস্থা শুরু করেন । ওই অঞ্চলে একটি পরিবারের ছেলে ইংরেজের হাতে ফাঁসি যায, তার ভাই ভগত রাম তলোয়ার এই দলে আসে । ওনাকে সীমান্ত পার করে দেবার জন্য সেখানকার ভাষা জানা বিশ্বস্ত একজন সহযাত্রীর প্রয়োজন ছিল ।

    ইতোমধ্যে সুভাষ যথারীতি রাজনৈতিক চিঠিপত্র গান্ধীজী, জয়প্রকাশ নারায়ণ ইত্যাদিকে লিখতে থাকেন । বড়লাটকে চিঠি লিখে বাংলার ধর্মীয় দলাদলির কথা জানান । বলেন যে বর্তমান মন্ত্রীসভাকে বাতিল করে এমন মন্ত্রীসভা গঠন করা দরকার যার ওপর হিন্দু ও মুসলমান দুই পক্ষের বিশ্বাস থাকবে (এই সব চিঠির ফল ভবিষ্যতে কিছু ফলেছিল) । এইসঙ্গে দেশত্যাগের প্রস্তুতি চলতে লাগল । ভাইঝি ইলা তাঁর সুশ্রুষা করছিল, সে জানল । শরত্চন্দ্রের সেজো ছেলে শিশির ওনাকে গাড়িতে বিহার অবধি পৌঁছে দেবেন সে ব্যাবস্থা হোল । বাড়ি থেকে লুকিয়ে বেরোতে দুই ভাইপো অরবিন্দ আর দ্বিজেশ সাহায্য করার প্রস্তুতি নিল । শরত্চন্দ্র ও বিভাবতীও জানলেন ।

    বাড়ির বাইরে দলের কিছু লোককেও জানান হোল সাহায্য পাবার জন্য । ফরোয়ার্ড ব্লকের শার্দুল সিং কবিশের ও সত্যরঞ্জন বক্সীর সঙ্গে এর আগেই তিনি দেশত্যাগের কথা আলোচনা করেছিলেন ।

    মিয়াঁ আকবর শা যখন এসেছিলেন, সেই সময়েই তিনি ও শিশির পশ্চিমা মুসলমানের উপযুক্ত পোষাক কিনে রেখেছিলেন । নেতাজির জন্য ভিজিটিং কার্ড তৈরি হয়েছিল `মুহম্মদ জীয়াউদ্দিন, এম্পায়র অফ ইণ্ডিয়া লাইফ ইন্স্যুরেন্স কম্পানি, সিভিল লাইন্স, জব্বল্পুর' । এই সময়ে নেতাজি দাড়ি রাখতে শুরু করলেন । ধানবাদে তখন ছিলেন শরত্চন্দ্রের বড় ছেলে অশোক, তাঁকে খবর দেওয়া হোল যে একজন বিশিষ্ট অতিথিকে নিয়ে শিশির শীঘ্রই যাবেন । বাড়ির বাকি লোক জানল সুভাষ নতুন যোগসাধনার জন্য প্রস্তুত হচ্ছেন ।

    ১৬ই জানুয়ারি (১৯৪১) যাত্রা ধার্য হয়েছিল (নেতাজি তিথি-নক্ষত্র মানতেন) । এর কিছুদিন আগে থেকে ঘোষণা করা হোল যে সুভাষ নির্জনবাস করবেন । ঘরের মধ্যে পর্দা টাঙ্গান হোল । কেউ যাবে না ওনার অংশে - পর্দার সামনে অরবিন্দ খাবার রেখে দেবেন ।

    যাত্রার রাতে দ্বিজেন বাইরে নজর রাখতে লাগলেন রাস্তার পুলিশেরা কখন ঘুমোবে । মাঝরাতে শিশির, অরবিন্দ ও সুভাষ গাড়িবারান্দায় হাজির হলেন । মাল আগে থেকে তোলা ছিল । গাড়ি দক্ষিণমুখো চলল । শিশির অনেকসময়েই রাতে বেরোতেন, পুলিশ কেউ যদি দেখেও থাকে, সন্দেহ করল না । কিছু দূর দক্ষিণে গিয়ে গাড়ি উত্তরমুখো হয়ে গ্রাণ্ড ট্রাঙ্ক রোড ধরল ।

    পথে সামান্য যা বাধা পড়ল, ধর্তব্য নয় - যদিও সে সময়ে ভীতিপ্রদ মনে হয়েছিল । ভোরবেলা গাড়ি অশোকের বাড়ির কাছে পৌঁছল । এক মাইল আগে সুভাষ তাঁর মুসলমানি পোশাকে গাড়ি থেকে নেমে গেলেন । শিশির দাদাকে গিয়ে বললেন আগন্তুক আসছেন; প্রস্তুতি কী হয়েছে দেখে রাখলেন । কিছুক্ষণের মধ্যে মুহম্মদ জীয়াউদ্দিন এসে গৃহস্বামীর কাছে নিজের কার্ড পাঠিয়ে দিলেন ।

    অশোক ভাইয়ের কাছে অতিথির পরিচয় পেয়েছিলেন - ছদ্মবেশ দেখে বিস্মিত হলেন - চিনতে পারলেন না । কথাবার্তা ইংরেজিতেই হোল ; চাকর বাকররা তার আগে সুভাষকে দেখেনি । বেলা হলে অশোক কাজে গেলেন, অতিথির জন্য বাইরের ঘর ঠিক করা ছিল - তিনি গিয়ে ঘুমিয়ে পড়লেন । বিকেলে অশোক বাড়ি এলে সন্ধ্যায় গোমো যাবার জল্পনা হোল । শিশির পথ চেনেন না বলে অশোক সঙ্গে যাবার জন্য প্রস্তুত হলেন । স্ত্রীকে বাড়িতে একলা রেখে যাওয়া সম্ভব ছিল না, কাজেই তাঁকেও সব কথা বলা হোল । সুভাষ আগে হেঁটে বাড়ি থেকে বেরোলেন (এখন পর্যন্ত চারপাশের কেউ তাঁকে শিশিরের সঙ্গে গাড়িতে দেখেনি) । এবারে শিশির, অশোক ও তাঁর স্ত্রী গাড়িতে বেরিয়ে তাঁকে পথ থেকে তুলে নিলেন । স্টেশনে তাঁরা গাড়িতেই রইলেন । দিল্লী-কালকা মেল দূর থেকে দেখা যেতে সুভাষ গাড়ি থেকে নেমে গেংএংএলন, বললেন, `আমি চললাম - তোমরা ফিরে যাও' । উনি ট্রেনে ওঠা পর্যন্ত অপেক্ষা করে বাকি সবাই বাড়ি ফিরলেন । এইটুকু জেনে গেলেন যে রাঙ্গাকাকা বার্লিন যাবেন, কিন্তু এখনো সব ঠিক হয়নি ।

    সুভাষ কালকা মেল থেক নামলেন দিল্লীর কিছু আগের স্টেশনে - তাই ঠিক ছিল মিয়াঁ আকবর শা'র সঙ্গে । ওখান থেকে সুভাষ ফ্রন্টিয়ার মেলে চড়লেন পেশাওয়রের পথে । মিয়াঁ আকবর শা সঙ্গে চললেন । পেশাওয়রে সুভাষ ট্রেন থেকে নেমে তাজমহল হোটেলে যাবার জন্য টঙ্গায় ওঠা পর্যন্ত নজর রাখলেন । রাত্রে হোটেলে তাঁর সঙ্গে দেখা করে সব ব্যবস্থার কথা জানিয়ে গেলেন । পরদিন ওনাকে একটা ভাড়া বাড়িতে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হোল । ২১এ জানুয়ারি ভগত রাম তলোয়ার তাঁর কাছে গিয়ে আত্মপরিচয় দিলেন ।

    কীর্তি কিষান পার্টি ভগত রামকে ওনার সঙ্গী হিসাবে ঠিক করে দিয়েছিল । ভগত রাম নাম নিলেন রহমত খাঁ । সুভাষ ওখানকার ভাষা জানেন না, উনি হলেন মূক-বধির ভদ্রলোক - আড্ডা-শরিফের তীর্থযাত্রী । নাম জীয়াউদ্দিন রইল । সাহেবি পোষাক ছেড়ে শালোয়র, কামীজ, পাঠানদের কোট, কুল্লা, পাগড়ি, পায়ে পেশাওয়রি চপ্পল পরা হোল - কাঁধে কাবুলী কম্বল । ভাড়া গাড়িতে ২২এ জানুয়ারি ওরা সীমান্তের দিকে রওয়ানা দিলেন ।

    মাইল দশ যাওয়ার পর গাড়ি ছেড়ে হাঁটা পথ ধরলেন । ইংরেজ সীমানা নিরাপদে পার হলেন । পথে থেমে সঙ্গের খাবার খেয়ে, বাকিদিন হেঁটে রাত্রে একটি গ্রামে আশ্রয় নিলেন । পাঠান অতিথি-বত্সলতা এখানে কাজে এল, নির্বিঘ্নে রাত কাটল । পরদিন ওরা খচ্চর ভাড়া করলেন । এইখানে আফগান রাজ্যে প্রবেশ । অনভ্যস্ত নেতাজি একবার খচ্চর থেকে পড়ে গেলেন । তবে অভ্যাস হতে দেরি হোল না । পরের রাতটা কাটল শিনোয়ারী জাতের এক গ্রামে । পরদিন পেশাওয়র-কাবুল রোড ধরলেন । এতদিন পর্যন্ত এরাস্তা না নিয়ে খাইবার গিরিবর্ত্মের দক্ষিণ দিয়ে এসেছিলেন - সীমান্ত পুলিশের পাল্লায় পড়তে হয়নি ।

    ওরা এখন হিন্দুকুশ পাহাড়ের পায়ের কাছে । নেতাজি তখনও পুরো শক্তি পাননি, কিন্তু উত্সাহে এই ঠাণ্ডা তিনি সহ্য করে নিতে পারলেন । এখন বড় রাস্তায় পৌঁছে ওরা একটা ট্রাকে আশ্রয় নিয়ে জালালাবাদ অবধি গেলেন । সেখানে একটা হোটেলে রাত কাটিয়ে পরদিন আড্ডা শরীফ পৌঁছোলেন । সেখানে ভগত রামের জানা লোক ছিল । সেখান থেকে কিছুটা টাঙ্গায় গিয়ে ওরা আবার ট্রাক পেলেন । লতাবন্দ গিরিবর্ত্মের শীতের মধ্যে দিয়ে কাবুল পৌঁছোলেন ২৭এ জানুয়ারি ।

    এপথের বিবরণ কিছু ফলাও করে দিলাম, কারণ এত কথা এতদিন আমি বা আমার চেনা কেউ কখনো শোনেনি । এদিকে কলকাতাতে ২৭ তারিখে আদালতে ওনার উপস্থিত থাকার কথা । ওখানে তাঁকে না পেলে বাড়িতে পুলিশের হাঙ্গামা যাতে না হয়, সেজন্য অরবিন্দ বসূ প্রমুখাৎ ইস্তাহার বার করা হোল যে সুভাষ বোসকে বাড়িতে পাওয়া যাচ্ছে না । বাড়ির লোকেরা খোঁজ করছে । সন্দেহ করা যাচ্ছে যে তিনি সন্ন্যাস গ্রহণ করে গৃহত্যাগ করেছেন । তিনি ছেলেবেলায় আরেকবার গৃহত্যাগ করেছিলেন - এটা ওনার স্বভাবের মধ্যে ছিল । কেউ বিশ্বাস করল কেউ করল না । সরকার তদন্ত করে কিছু পেল না ।

    পরবর্তীকালে কিছু লেখক লেখবার চেষ্টা করেছেন যে সরকার জেনে শুনে ওনাকে পালাতে দিয়েছিল - উনি দেশের বাইরে থাকাই ভাল মনে হয়েছিল । কিন্তু তখনকার নথিপত্র দেখলে এ কথা মনে হয় না ।

    কাবুলে রহমত খাঁ ও জীয়াউদ্দিন একটা সরাইখানায় উঠলেন । ২৮ তারিখ থেকে সোভিয়েট সরকারের সঙ্গে যোগ স্থাপন করার চেষ্টা হতে লাগল (কীর্তি কিষান পার্টির সেটাই আরব্ধ ছিল) । কিন্তু ভগত রাম একবার রুশ লীগেশনের সঙ্গে কথা বলা সত্তোংএ ওদিক থেকে কোন সাড়া এল না । ২রা ফেব্রয়ারি জার্মান লীগেশনে ভিসার কাজের ছল করে ঢুকে নেতাজি লীগেশনের একজন উচ্চপদস্থ কর্মচারীর সঙ্গে দেখা করতে পারলেন । বার্লিনে জিজ্ঞাসা করে পাঠান হোল এই দামি মালটিকে নিয়ে কী করা যায় । ঠিক করা হোল যে সুভাষের সঙ্গে কথাবার্তা স্থানীয় সিমেন্স কোম্পানির মাধ্যমে করা হবে । ওনাকে বলা হোল ৫ই ফেব্রুয়ারি ওখানে দেখা করতে ।

    এদিকে সরাইখানায় ঝামেলা হতে লাগল । একজন কাবুলি নিজেকে পুলিশ বলে পরিচয় দিয়ে ওদের জেরা করতে শুরু করল । বাবার দেওয়া একটি দামি হাতঘড়ি তাকে বখশিস দিয়ে তার মুখ চাপা দেওয়া হোল । কিন্তু ওখানে থাকা আর নিরাপদ মনে হোল না । ভগত রামের গ্রারমের লোকের এক আত্মীয় উত্তম চাঁদ মালহোত্রা কাবুলে ব্যাবসা করতেন, ভগত রাম তাঁর স্মরণ নিলেন । উত্তম চাঁদ পূর্বতন স্বাধীনতা সংগ্রামী ছিলেন । তিনি ওনাদের আশ্রয় দিলেন । কিন্তু পাড়ার লোকেরা কানাঘুষো শুরু করল । উত্তম চাঁদ পূর্বতন জাতীয়তাবাদী বন্ধু হাজী অ.ংআব্দুল সোভানকে সব কথা বললেন । ইতোমধ্যে সুভাষ অসুস্থ হয়ে পড়লেন, ওদের সাহায্যে এবং শ্রীমতী মালহোত্রার সুশ্রুষায় শারীরিক ও রাজনৈতিক বিপদ কিছু কমলো । ৫ই ফেব্রুয়ারি খবর এল যে বার্লিন এব্যাপারে মন দিয়েছে । সোভিয়েট রাশিয়ার ভেতর দিয়ে ওনাকে বার্লিন নিয়ে যাবার চেষ্টা শুরু হয়েছে - সময় লাগবে ।

    এতে দেরি হতে লাগল । সুভাষ এবং ভগত রাম ভাবতে শুরু করলেন যে গোপনে রাশিয়ায় ঢুকলে কেমন হয় । ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি খবর এল যে জার্মানি, জাপান ও ইটালি একসঙ্গে রাশিয়াকে অনুরোধ করেছে যে সুভাষচন্দ্রকে যেন রাশিয়ার ভেতর দিয়ে গিয়ে যোরোপে যেতে দেয় ।

    এত ব্যাপারের মধ্যেও সুভাষচন্দ্রের লেখা বন্ধ হয়নি । `ফরোয়ার্ড ব্লকের সার্থকতা' নামে একখানি প্রবন্ধ তিনি লিখে ফেলেছিলেন । ভরসা ছিল ওটা তিনি কলকাতায় পৌঁছে দিতে পারবেন ।

    জার্মান লিগেশনের সাহায্যে সুভাষ ইটালিয়ন লিগেশনের কর্তা শ্রী অলবের্টো করোনির সঙ্গে সংযোগ করলেন । করোনি দেশে খবর পাঠালেন যে সুভাষ যোরোপে একটি স্বাধীন ভারত সরকার প্রতিষ্ঠা করতে চান । ওনার জন্য ইটালিয়ান পাসপোর্টের ব্যাবস্থা হোল অর্ল্যাণ্ডো মজোটা নামে । ১৫ই মার্চ খবর এল যে ১৮ই ওনাকে যাত্রা করতে হবে । সুভাষ ভগত রামকে মেজদার নামে বাংলা চিঠি দিলেন । ফরোয়ার্ড ব্লক সংক্রান্ত প্রবন্ধটি ছাড়া আরেকটি ইংরেজি প্রবন্ধ ভগত রামকে দেশে নিয়ে যেতে বললেন । কাবুলের শেষ রাত সুভাষ ও ভগত রাম ক্রিশ্নিনি নামে এক ইটালিয়ান ভদ্রলোকের বাড়ি কাটালেন । পরদিন সুভাষকে সেখান থেকে তুলে নেওয়া হোল । ওকে গাড়ি ও রেলে মস্কো নিয়ে যাওয়া হবে, সেখান থেকে তিনি বার্লিন যাবেন । কাবুল ও কলকাতার মধ্যে যোগ রাখবার জন্য ভগত রাম কলকাতা রওয়ানা হয়ে গেলেন নেতাজির লেখা চিঠি ও প্রবন্ধ দুখানি নিয়ে ।

    নেতাজি যখন বার্লিনে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করছেন, সেসময়ে বাংলায় হিন্দু-মুসলমানের ঝগড়াটা ঢাকার দাঙ্গার রূপ নিয়েছে । শরত্চন্দ্র দুই দলের মধ্যে বোঝাপড়ার চেষ্টা করছেন । সাম্প্রদায়িক মৈত্রী না হওয়া পর্যন্ত কংগ্রেস গণসংগ্রামের বদলে শুধু ব্যক্তিগত সত্যাগ্রহে বিশ্বাসী । দেশের সকলের সেটা মন:পূত হচ্ছে না । শরত্চন্দ্র তখন আর জাতীয় কংগ্রেসের নেকনজরে নেই, কিন্তু বাংলা কংগ্রেসের সদস্য হিসাবে বাংলার আইন পরিষদে সরকারের বিপক্ষদলের প্রধান মুখপাত্র । সরকার চলছে মুসলিম লীগের পক্ষ থেকে ফজলুল হকের মন্ত্রীত্বে । মোটামুটি ইংরেজ সরকারের হুকুম মতই কাজ হচ্ছে - বাজেটে পুলিশের খরচ বাড়ছে (সুরাবর্দী তখন আন্তরীণ মন্ত্রী), বিশ্বভারতীর ভাগ কমছে । চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত তুলে দেওয়ার প্রশ্ন উঠলেই ধামাচাপা পড়ে যাচ্ছে । শরত্চন্দ্রের সমাজতান্ত্রিক মতগুলোকে জমিদারগোষ্ঠীর প্রতিভূরা বিদ্রূপ করছেন । এই সময়ে লীগের সঙ্গে ফজলুল হকের সংঘাত হোল ।

    যোরোপে তখন জার্মানি তুঙ্গে, প্যারিসের পতন হয়েছে । দেশের লোক বুঝতে পারছে না ইংরেজের সঙ্গে শত্রুতাটাকে জার্মানির সঙ্গে বন্ধুত্বের রূপ দেওয়া উচিৎ হবে কি না । হিন্দু মহসভা সরাসরি ইংরেজ সরকারকে সাহায্য করার দিকে ঝুঁকেছে । মুসলিম লীগ নিরপেক্ষ থাকবার চেষ্টা করছে ইংরেজদের চাপ দিয়ে আরো কিছু সুবিধা আদায়ের চেষ্টায় । কিন্তু ফজলুল হক লীগের সভ্য হওয়া সত্তোংএ ইংরেজের যুদ্ধ প্রচেষ্টার সহায়তা করছেন । এই মতদ্বৈধের ফলে ফজলুল হক লীগ থেকে পদত্যাগ করলেন ।

    শরত্চন্দ্র আবার ফজলুল হকের সঙ্গে বোঝাপড়ায় নামলেন । প্রগ্রেসিভ কোয়ালিশন দলের জন্ম হোল । জমিদারি উচ্ছেদের ও উচ্চশিক্ষা বিলের ব্যাপারে লীগ মন্ত্রীত্বের বিরুদ্ধে জমা রাগটাকে তাঁরা কাজে লাগালেন । লীগ মন্ত্রীসভার পতন হোল । ফজলুল হক আবার মন্ত্রী হলেন । কথা হোল সুরাবর্দীর দফতরটা শরত্চন্দ্র নেবেন । বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক মৈত্রীর গোড়াপত্তন হোল হয়তো । কিন্তু এর পরে যেটা ঘটল সেটা ইংরেজের ভেদনীতির প্রকাশ বলে মনে করা যায় হয়ত ।

    সুভাষচন্দ্রের দাদার ওপর ইংরেজ খরদৃষ্টি রেখেই ছিল । ভগত রামের মাধ্যমে কাবুলের জার্মান লীগেশনের কাছ থেকে সুভাষচন্দ্র সম্বন্ধে খবরাখবর শরত্চন্দ্র্রের কাছে পৌঁছচ্ছিল । এখবর ইংরেজরা পেত কিনা এবং পেয়ে থাকলেও বিদ্রোহীর সহায়তা করার জন্য শরত্চন্দ্রকে কেন গ্রেপ্তার করেনি আমি বুঝিনি । হয়ত জার্মানি রাশিয়া আক্রমণ করার পর ইংরেজের সঙ্গে একটা সন্ধি করার চেষ্টা হিটলারের মাথায় ছিল এবং ইংরেজ সেটা জানত - কূটনীতির পথ চিরকালই জটিল । এই সময়ে রুডল্ফ হেস ইংলণ্ডে এসে বন্দী হয়েছিলেন, কার মনে আছে জানি না (জার্মানির এই রাশিয়া আক্রমণের ফলে ভারতের কম্যুনিষ্ট দলের সঙ্গে ইংরেজের সম্পর্ক কিরকম বদলাল ও `সাম্রাজ্যবাদিক যুদ্ধ' কী করে রাতারাতি `জনযুদ্ধ' হয়ে গেল, সে খবর দেবার জায়গা এটা নয়, কিন্তু মনের তিক্ততাটা ঢাকতে পারলাম না) । যাহোক, এ সবের ফলে কাবুলের জার্মান লিগেশনের মাধ্যমে খবর আনার চেষ্টাটা কঠিন হয়ে উঠতে লাগল । এই সময়ে খবর পাবার একটা অপেক্ষাকৃত সহজ পন্থা ওরা পেলেন । সুভাষ বার্লিনের জাপানি রাজদুতাবাস ও কলকাতার জাপানি কমিশনের কনসালের মাধ্যমে খবর পাঠাতে শুরু করলেন । শিশির বসু কনসালকে কলকাতার নানা জায়গা থেকে তুলে রিষড়াতে নিয়ে আসতেন ও ফেরৎ দিংএংএতন । শরত্চন্দ্র সেই সময়ে রিষড়া গিয়ে দেখা করতেন । এত লুকোচুরি সত্ত্বেও ব্যাপারটা ইংরেজ গুপ্তচরদের চোখ এড়ায়নি । কিন্তু জাপানের সঙ্গে যখন ইংরেজের শত্রুতা হয়নি, সেজন্য তারা শরত্চন্দ্রকে গ্রেপ্তার করতে চায়নি - আইনসভায় বিপক্ষদলের নেতাকে গ্রেপ্তার করাটা আদৌ ভদ্র কাজ হোত না । কিন্তু ঠিক যেসময়ে শরত্চন্দ্র নতুন বাংলা মন্ত্রীসভার সভ্য হতে যাচ্ছেন, সেই সময়ে জাপান পার্ল হারবরে বোমা ফেলার ফলে একটা সম্পূর্ণ নতুন রাজনৈতিক পরিবেশের সৃষ্টি হোল । জাপান যখন পাকাপাকি বিপক্ষ দলে চলে গেল তখন শত্রুর সঙ্গে যোগসাজস করার অপরাধে শরত্চন্দ্রকে গ্রেপ্তার করা হোল । প্রগ্রেসিভ কোয়ালিশন কিছুটা দুর্বল হয়ে গেল - এক ঢিলে দু পাখি মারল ইংরেজ ।

    শরত্চন্দ্র এখন বেশ কিছুদিন কারাবাসে থাকবেন । সেখানে তাঁকে রেখে সুভাষচন্দ্রের কাহিনীতে ফেরা যাক । জার্মান সরকার যদিও তাঁর বসবাসের সুব্যবস্থা করে দিল, কিন্তু তাঁর সঙ্গে পুরো সহযোগিতা করতে টালমাটাল করতে লাগল । হিটলারের জাতিতত্বে আর্য বলতে স্যাক্সনেরা । একসময়ে দুনিয়াটাকে ইংরেজের সঙ্গে ভাগ করে নিতে হবে, একথা তাঁর মনে ছিল । এশিয়ার সব জাত হীন জাত, আর্র্যদের দ্বারা শাসিত হওয়াই তাদের ভাগ্যলিপি এবং তাতেই তাদের মঙ্গল । কাজেই ভারতের স্বাবধীনতাটা বড় কথা নয়, বোস ওরফে মোজেটাকে কতটা কাজে লাগান যাবে, এইটেই ছিল প্রধান বিচার্য্য । সুভাষচন্দ্রের একটা আরব্ধ ছিল জর্মন, ইটালিয়ান ও জাপানি সরকার ভারতের স্বাধীনতার অধিকারকে স্বীকার করে সর্বসমক্ষে একটা বিবৃতি দিক । কিন্তু ওই তিন সরকারের মধ্যে পারস্পরিক বিশ্বাস খুব বেশি ছিল না । অন্তত ওখানকার জাপানি রাজদূতাবাসের পক্ষ থেকে সুভাষের খবরাখবর দেশে পৌঁছে দেবার ব্যবস্থা সহজেই হয়েছিল । কিন্তু গোড়ার দিকে ওর চেয়ে বেশি সুবিধা তিনি করতে পারলেন না । এছাড়া ইটালিয়রা এর আগেই ইকবাল শিধাই নামের এক ভারতীয়ের সঙ্গে কথাবার্তা চালাচ্ছিল । কাজেই শিধাইয়ের সঙ্গে একটা বোঝাপড়া করা সুভাষের পক্ষে প্রয়োজনীয় ছিল । সেটা কিছুতেই সম্ভব হোল না । শিধাই তখন ভারতের কথার চেয়ে ভবিষ্যত পাকিস্তানের কথাই বেশি ভাবছিল । অখণ্ড ভারতের উপাসক সুভাষ সেটা কিছুতেই সহ্য করলেন না ।

    একটা ব্যাপারে জর্মন সরকারের সাহায্য সুভাষ পাচ্ছিলেন । স্বাধীন ভারত কেন্দ্র বলে একটা সংস্থা গোড়া বাঁধছিল । এর প্রধান কারণ এই যে যদিও জার্মান সরকারের উচ্চস্তরে (অর্থাৎ হিটলারের সাঙ্গোপাঙ্গদের মধ্যে) সুভাষের সম্বন্ধে কোন সহানুভুতি ছিল না, কিন্তু ঠিক সেই কারণেই অপেক্ষাকৃত অধস্তন কর্মচারিদের মধ্যে তাঁর সম্বন্ধে সহানুভূতি বিস্তৃত হচ্ছিল । এই কর্মচারিরা ছিলেন সাবেকি জর্মন সরকারের লোক । এককালে জর্মান সমাজের শীর্ষে তাঁরাই ছিলেন । হিটলারের মত একটা উচক্কা বিদেশি (হিটলারের জন্ম অস্ট্রিয়ায়) লোকের দম্ভ ও ক্ষমতা তাঁদের চক্ষুশূল ছিল, কিন্তু প্রকাশ্যে কিছু করবার ক্ষমতা তাঁদের ছিল না ।

    এছাড়া অরো একটা কাজ সুভাষ করতে পারছিলেন । যোরোপে ছড়ান ভারতীয়দের (এঁদের কেউ বিপ্লবী, কেউ ভূতপূর্ব ছাত্র বা পেশাদার লোক) উনি বার্লিনে নিজের চারদিকে জড় করতে চেষ্টা করছিলেন ও কিছু কিছু সফল হচ্ছিলেন । এরমধ্যে পূর্বতন সাংবাদিক এ. সি. এন. নাম্বিয়ার ও আবিদ হসানের নাম বর্তমানে করব - বাকি কিছু নাম পরে আসবে ।

    সুভাষের ব্যক্তিগত জীবনে আরেকটা সাফল্য শ্রীমতী শেংকেলকে ভিয়েনা থেকে নিজের সেক্রেটরি হিসাবে বার্লিনে নিয়ে আসা । এটা সরকারের সবার খুব মন:পূত হয়নি । শেংকেল উঁচু স্তরের লোক নন, অথচ সুভাষের সাহচর্যে রাজকীয় খাতির পাচ্ছেন, এটা অনেকের চক্ষুশূল হয়েছিল । কিন্তু ঐ পর্যন্ত । শেংকেল শুধুংউ কাজের ব্যাপারে সুভাষের ডান হাত হলেন না, ওদের পুরোন সম্পর্কটাও দানা বেঁধে উঠল । ওনাদের বিবাহ এর আগে হয়েছিল না এই সময়ে হয়েছিল, সে সম্বন্ধে আগে কিছু আলোচনা করেছি, এখানে সেটা নিষ্প্রয়োজন ।

    স্বাধীন ভারতের স্বীকৃতি সুভাষ কোনদিনই পেলেন না, কিন্তু স্বাবধীন ভারত কেন্দ্রের কাজ শক্তিশালী হয়ে উঠতে লাগল । `আজাদ হিন্দ' বলে একটি পত্রিকা বিভিন্ন ভাষায় প্রকাশ করা হতে লাগল । বেতার প্রচারের অয়োজন হোল । `আজাদ হিন্দ রেডিও' ছাড়া `ন্যাশনাল কংগ্রেস রেডিও' ও `আজাদ মুসলিম রেডিও' চালু হোল (এটা শিধাইকে খুশি করার জন্য কিনা আমি জানতে পারিনি) । ডা: ব্যাস গুজরাটি ভাষায়, পি. বি. শর্মা ও জে. কে. ব্যানার্জী ইংরেজিতে সংবাদ প্রচার ও আলোচনার ভার নিলেন, অ. ম. সুলতান আজাদ মুসলিম রেডিওর ভার নিলেন, কল্যাণ বসু বাংলায় সংবাদ পরিবেশন করতে লাগলেন ও ইংরেজি থেকে বাংলায় অনুবাদের ভার নিলেন । বি. বি. সি. থেকে ভারতীয় গান-বাজনা তুলে এই সংস্থাগুলো প্রচার করতে লাগল ।

    সুভাষের একটা স্বপ্ন চিরকাল ছিল, স্বাধীন ভারতের গেড়াপত্তন থেকেই নিজস্ব সৈন্যবাহিনী গড়ে তোলা । এই পথে ইটালিয়ানরা সাহায্য করল শিধাই নানাভাবে বাধা দেয়া সত্ত্বেও । সেকথা বলার আগে আমার একটা চিন্তা প্রকাশ করি, হয়তো গায়ের জ্বালায় । শিধাইয়ের সঙ্গে আমি কায়দ-এ-আজম মুহম্মদ জিন্নার একটা মিল দেখি । এই শ্রেণীর লোকেরা গড়ার চেয়ে ভাঙাটাই বেশি পছন্দ করে । বোধ হয় এই পথে আত্মগরিমা প্রচার অপেক্ষাকৃত সহজ বলে । মনে পড়ছে বহু পরবর্তী কালে (এ গল্প শেষ হবার কিছু পরে) ঠিক হয়েছিল যে নব-প্রতিষ্ঠিত ইংরেজ `ডোমিনিয়ন' হিসাবে ভারত ও পাকিস্তান দুই দেশের গভর্নর জেনারেলের পদে একা মাউন্টব্যাটেন থাকবেন ও দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক গঠনের কাজ করবেন । শেষ মুহূর্তে কায়দ-এ-আজম আব্দার করলেন পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল তিনি নিজে হবেন । পরের বছর স্বাধীন ভারতের রাষ্ট্রপতির হাতে মাউন্টব্যাটেন শাসনভার তুলে দিলেন, মুহম্মদ জিন্না নিজেই গভর্নর থেকে প্রেসিডেন্ট হয়ে গেলেন ।

    এর দু-এক বছরের মধ্যে কায়দ-এ-আজমের মৃত্যু হয় ক্যান্সার রোগে (অনেকে বলে যে কংগ্রেস যদি বছর দুই অপেক্ষা করত, তাহলে হয়তো পাকিস্তানের সৃষ্টি হোত না - কিন্তু ওনার রোগের খবর কেওই জানত না) । তাঁর রোগশয্যার পাশে পাকিস্তান ক্যাবিনেট-এর কাউকে দেখা যায়নি (তাঁরা ততদিনে নিজেদের কাজ গুছিয়ে নিয়েছেন) । আজ যখন পরভেজ মুশররফ কায়দ-এ-আজমের ছবির সামনে তাঁর নামের তুবড়ি ফোটান, তখন এ কথা কারো হয়তো মনে পডে ংআ (মুশররফ সাহেবের তো নয়ই - সে সময়ে তিনি শিশু) ।

    আজাদ হিন্দের গল্পে ফিরে যাই । যুদ্ধের সময়ে ইংরেজ সরকার নিজের সৈন্যবাহিনীতে ভারতীয়ের সংখ্যা অনেক বাড়াতে বাধ্য হয়েছিল । সেই সৈন্যরা ইংরেজের পক্ষে থেকে বহু যুদ্ধে নিজেদের বীরত্ব এবং বিশ্বস্ততার বহু পরিচয় দিয়েছিল, বিশেষ করে উত্তর আফ্রিকাতে ইটালিয়ানদের সঙ্গে যুদ্ধে । সে-সময়ে ইংরেজ পক্ষের যুদ্ধবন্দীদের মধ্যে বহু ভারতীয় সৈন্য ইটালিয়ানদের হাতে এসেছিল । সুভাষ বললেন যে সেই সৈন্যদের ভার তাঁকে দেওয়া হোক, তিনি তাদের স্বাধীন ভারতের সৈন্যবাহিনীতে যোগ দেবার জন্য প্ররোচিত করবেন । ইটালি জার্মানদের সঙ্গে পরামর্শ করল, দরদস্তুর কী হয়েছিল গর্ডন-সাহেব সব খবর দেননি । ঠিক হোল যে ভারতীয় যুদ্ধবন্দীদের জার্মান সরকারের হাতে দেওয়া হবে, তারা সুভাষের সঙ্গে রফা করবে তাদের কীভাবে নেওয়া হবে । জার্মানির হাতে যুদ্ধবন্দী থাকলে তাদের সম্বন্ধে আন্তর্জাতিক আইন একরকম, তারা ইংরেজের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে নিজেদের স্বাধীন ভারতের সৈন্য বলে ঘোষণা করলে আইন সম্পূর্ণ আলাদা । এ ব্যাপারে সৈন্যদের মতামত জেনে জার্মান সরকার সিদ্ধান্ত নেবে । সৈন্যদের কাছে নিজের আবেদন জানাবার অধিকার সুভাষচন্দ্রকে দেওয়া হোল ।

    অনেক সৈন্য তাঁর কাছ থেকে স্বাধীনতা যুদ্ধের আহবানে সাড়া দিল, কিন্তু আরো অনেকে দিল না । তারা যার নুন খেয়েছে তার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করতে চাইল না । প্রথম দল চলে গেল জার্মানদের কাছে সৈন্য প্রশিক্ষণে - বাকিরা বন্দী রইল ।

    যারা বন্দী রইল, তার মধ্যে অফিসরের সংখ্যা বেশি । কাজেই সৈন্যদের কুচ-কাওয়াজ করাবার লোক সুভাষের হাতে কম ছিল । জার্মানরাও বোধ হয় বাহিনীটাকে পুরোপুরি সুভাষের হাতে ছেড়ে দিতে প্রস্তুত ছিল না । এই সৈন্যরা জার্মান সৈন্যদের মতোই উল্টো স্বস্তিকা লাগান কুর্তা পরতে লাগল - শুধু তার সঙ্গে আজাদ হিন্দের স্মারক হিসাবে একটা পতাকা জোড়া হোল - কংগ্রেসের তিরঙ্গার ওপরে চরখার বদলে একটি আক্রমণোদ্যত বাঘের ছবি । (বিবিসি যে চলচ্চিত্র তৈরি করেছিল, তার নাম ছিল, `দি লীপিং টাইগার') ।

    এই সৈন্যদের ভারত আক্রমণ ছাড়া কোথাও ব্যাবহার হবে কিনা, এই বোঝাপড়াটা অস্পষ্ট রইল । তবে সাধারণ নিয়মে জার্মান সৈনিকদের যে শপথ নিতে হোত, সেটাকে কিঞ্চিৎ পরিবর্তন করে দাঁড়াল এইরকম : `আমি ঈশ্বরের সমক্ষে শপথ করছি যে জার্মান জাতির প্রতি ও তার একমাত্র অধিনায়ক অ্যাডল্ফ হিটলারের প্রতি বিশ্বস্ত থেকে ভারতের স্বাধীনতার জন্য সুভাষচন্দ্র বসুর অধীনে যুদ্ধ করব এবং প্রাণ দিয়ে এই শপথ রক্ষা করব' ।

    ভারতীয় বাহিনীর রক্ষনাবেক্ষণ করার পথে জার্মান সৈন্যাধ্যক্ষদের প্রথমটা কিছু বেগ পেতে হোল । হিন্দুরা গরু খাবে না, হালাল না হলে মুসলমান খাবে না । শেষ অবধি কিছু রফা হোল । ভেড়া কাটাবে জার্মানেরা - কী ভাবে কাটা হোল কেউ জানবে না । স্বাদেশিকতার মান রাখতে সবাই তাতে রাজি হোল ।

    সৈন্যেরা অবশ্যই স্যালুট করার সময়ে `হাইল হিটলার' বলবেনা - বলবেটা কী । মুসলমান বলে `সলাম অলৈকুম', শিখেরা বলে `সৎ শ্রী আকাল' । রাজপুতেরা বলে, `জয় রামজীকি', সেটাকেই বদলে চেষ্টা হোল, `জয় হিন্দুস্তান' - সেখান থেকে বদলে হোল `জয় হিন্দ' । ওই সম্ভাষণটা কারো আর মনে আছে কিনা জানি না, আমরা যুদ্ধোত্তর ও প্রাক-স্বাধীনতা যুগে ওটা ব্যবহার করে গৌরব বোধ করতাম, এটা মনে আছে - ইতিহাসটা গর্ডন-সাহেবের বই থেকে জানলাম ।

    সুভাষবাবুকে কি সৈন্যেরা `সুভাষবাবু' বলেই অভিহিত করবে, না `রাষ্ট্রপতিজী' বা `প্রধানজী' বলবে ? একজন সৈনিক পরামর্শ দিল, `হমারে নেতা' বললে কেমন হয় ? সেই থেকে ওনার নাম হয়ে গেল `নেতাজি' । আমি নিজে এখনো ঐ নামটা ব্যবহার করে আনন্দ পাই ।

    ভারতের স্বাধীনতাটার জন্য যুদ্ধটা খাইবার গিরিসংকটের মধ্য দিয়ে বা অন্য কোন পথে যাবে, সেটা নির্ণয় করা কঠিন ছিল, কিন্তু তার আগেই বিশ্বমহাযুদ্ধের চেহারাটা কিছু বদলে গেল । এতদিন যে জার্মান বাহিনীকে অজেয় মনে করে সবাই ভরসা পাচ্ছিল, রাশিয়ার রণাঙ্গনে তারা পর্যুদস্ত হতে লাগল । সেই সময়ে জাপান যখন পার্ল হারবর আক্রমণ করে মার্কিন ও ইংরেজের বিরুদ্ধে সরাসরিভাবে নামল, তখন আজাদ হিন্দের পক্ষে আরেকটা শক্তিশালী বল পাওয়ার কথা ভাবা হতে লাগল । নেতাজির ঝামেলাতে থাকতে হিটলারের সাঙ্গোপাঙ্গদের কোনদিনই উত্সাহ ছিল না । জাপানের সঙ্গে সমঝোতা শুরু করা হোল ।

    জাপানের কাছাকাছি বহু দেশ ইংরেজ, ফরাসি, ওলন্দাজদের উপনিবেশ । তাদের দলে টানতে জাপান আগেই `এশিয়া শুধুংউ এশিয়াবাসীদের' বলে ধুয়ো তুলছিল । সেইসব দেশের লোকনেতা অনেকে ইংরেজদের কাছ থেকে পালিয়ে জাপানে আশ্রয় নিয়েছিলেন । ভারতের পক্ষ থেকে রাসবিহারী বসুর নাম আগেই করেছি । শ্যামদেশে প্রীতম সিং ও অমর সিং কিছু আগে থেকেই `ইণ্ডিয়া ইণ্ডিপেণ্ডেন্স লীগ' গড়েছিলেন, তার শাখা এশিয়ার অন্যান্য দেশের প্রবাসী ভারতীয়দের মধ্যে ছিল । এরা ছিলেন ভারতের `গদর পার্টির' শাখা না হলেও তার দ্বারা প্রভাবান্বিত, সভ্যরা প্রধানত শিখ । এ ছাড়া `থাই ভারত কলচরল লজ' নামে একটি সংস্থা ছিল । জাপানি সৈন্য বর্মা পৌঁছনোর অনেক আগে থেকেই জাপান সরকার এদের সঙ্গে যোগ স্থাপন করছিল । এই কাজের ভারপ্রাপ্ত কর্মী ছিলেন মেজর ফুজিওআরা ইয়াইচি । প্রীতম সিং ইংরেজ বাহিনীর ভারতীয় সৈন্যাদের দলে টানার কথা ভেবেছিলেন, কিন্তু জাপান যুদ্ধে নামার আগে এদিকে কোন সাফল্য হয়নি ।

    সিঙ্গাপুরের ইংরেজ বাহিনীর ভারতীয় সৈনিকদের সঙ্গে মেজর ফুজিওআরাও যোগ স্থাপনের চেষ্টা করেছিলেন । মালয়ে এর পতনের আগে পর্যন্ত এ চেষ্টাও খুব একটা সফল হয়নি । মালয়ে ইংরেজদের হার হওয়ার পর কয়েক হাজার ভারতীয় সৈনিক জাপানিদের হাতে বন্দী হন । এঁদের নেতৃস্থানীয়দের মধ্যে ক্যাপ্টেন মোহন সিংএর নাম করব । জাপানিরা এঁকে আগেই দলে টানবার চেষ্টা করেছিল অন্য অনেক ভারতীয় সৈনিকের মতোই । তাদের মতো উনিও গা করেননি ; ইংরেজের ওপর সামরিক আনুগত্য তো ছিলই, তাছাড়া জাপানিদের মতলবও ভাল বোঝা যায়নি । এখন ইংরেজের সামরিক নির্বুদ্ধিতা সবাইকেই বিরক্ত করেছিল (ওরা সিঙ্গাপুরের রক্ষার জন্য শুধুংউ সমুদ্রের দিকেই নজর রেখেছিল ; কামান সব সমুদ্রের দিকে মুখ করে কংক্রিটে পোঁতা । যখন মালয দ্বীপ থেকে সরু `কজওয়ে' পেরিয়ে জাপানিরা হেঁটেই ঢুকে গেল তখন আর কামান ঘোরাবার সময় পাওয়া গেল না) ।

    মোহন সিং সরাসরি মেজর ফুজিওয়ারার সঙ্গে কথা কয়ে আশ্বাস পেলেন যে ভারতের স্বাধীনতার প্রতি জাপান সরকারের পূর্ণ সহানুভুতি আছে । মেজর ফুজিওয়ারা নিজেও জানতেন না যে এব্যাপারে জাপানের পক্ষ থেকে কোন অধিকার তাঁকে দেওয়া হয়নি । তবু মোহন সিং ইণ্ডিয়া ইণ্ডিপেণ্ডেন্স লীগের সঙ্গে হাত মিলেয়ে ইণ্ডিয়ান ইণ্ডিপেণ্ডেন্স আংইর্ম গড়বার কাজে নামলেন ।

    ১৯৪২এ অবস্থার কিছু পরিবর্তন হোল । জার্মানরা রুশদের হাতে কিছু নাজেহাল হতে লাগল (এই সময়কার লেনিনগ্রাদের যুদ্ধ নিয়ে রুশদের মধ্যে এখনো গৌরববোধ আছে - ওখানে যাঁরা গেছেন তাঁরা জানেন) । জাপানিদের অগ্রগতি ব্যাহত হোল পার্ল হারবরের পরে আমেরিকা যুদ্ধে নামার ফলে - জাপানি নৌ-বাহিনী প্রশান্ত মহাসাগরে মার্কিনদের কাছে হঠে যেতে লাগল । তখন ভারতের সত্যিকারের বন্ধুত্ব সকলের কাছেই কাম্য হয়ে উঠল । ইংরেজরা স্টাফোর্ড ক্রিপ্সকে ভারতে পাঠাল কংগ্রেসের সঙ্গে সন্ধি করতে । সাবমেরিনে করে সুভাষকে জাপানে পাঠাবার অয়োজন হোল ।

    নেতাজি ততদিনে মজোটার মুখোশ পুরোপুরি খুলে ফেলেছেন । হিটলারের সঙ্গে একবার কথা কয়ে এটা ভালোই বুঝে গেছেন যে ওখানে আর থেকে লাভ নেই । ত্রক্রীপ্স-দৌত্য ততদিনে নিস্ফল হয়েছে (না হলেই বিস্মিত হবার কারণ ছিল । যাযাবরের `দৃষ্টিপাত'-এ কিছু খোঁজ পাওয়া যাবে)। ইংরেজের কৌশলে না ভোলার জন্য দেশের লোকেদের অভিনন্দন করে নেতাজি বেতারে একটা বক্তৃতা দেন । নিজেকে তিনি চিরদিনই কংগ্রেসের লোক বলে মনে করে এসেছেন । কংগ্রেস এ ভালবাসার বিশেষ মূল্য দেয়নি । উনি যে ফ্যাসিষ্টদের সঙ্গে যোগ দিয়েছেন, এটা তাঁরা কোনদিন পছন্দ করেননি । `আমার শত্রুর শত্রুমাত্রেই আমার বন্ধু' এ নীতির নিষ্ফলতাটা তাঁরা বুঝতেন, নেতাজি সেটা বুঝেও হাল ছাড়েননি, ওদের কাছ থেকে যতটুকু পারেন সুবিধা আদায় করাই তাঁর উদ্দেশ্য ছিল । এটাও তিনি দেখছিলেন যে পশ্চিম থেকে ভারতে প্রবেশ করা সহজ হবে না । জাপান তখন ভারতের দরজা থেকে বেশি দূরে নয় ।

    ১৯৪৩এর ৮ই ফেব্রুয়ারি নেতাজি ও আবিদ হাসান য়োরোপ ত্যাগ করলেন । এর আগে অন্ত:সত্বা শ্রীমতী শেংকেলকে নেতাজি ভিয়েনায় বাপের বাড়ি রেখে আসেন । ১৯৪২এর ২৯এ নভেম্বর তাঁর কন্যা অনীতার জন্ম হয় । সে মেয়েকে চোখে দেখার ভাগ্য নেতাজির হয়নি । শরত্চন্দ্রের কাছে ওনাদের নিজের স্ত্রী-কন্যা বলে পরিচয় দেওয়া চিঠি তিনি পাঠিয়ে দিয়েছিলেন ।

    জার্মানিতে নেতাজি যে সংস্থাগুলির প্রতিষ্ঠা করে দিয়ে গেছিলেন, তাদের কাজ চলতে লাগল । বেতারবার্তা ও কাগজের মাধ্যমে যা প্রচার চলছিল, সেটাও অব্যাহত রইল । তবে তার ফল কতটা অর্শেছিল বলা শক্ত । ভারতীয় ফৌজের শিক্ষা জার্মানদের অধীনে যেমন ছিল রইল । কথা ছিল যে তাদের ইংরেজের বিরুদ্ধে ছাড়া আর কোন কাজে ব্যাবহার করা হবেনা । পরের বছর তাদের বেলজিয়ামে নিয়ে যাওয়া হয় ফ্রান্সে ইংরেজ ও আমেরিকান আক্রমণ প্রতিরোধ করতে । সেটাকে ঠিক সরাসরি ইংরেজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ বলে মনে করতে বহু সৈন্যের আর্পংইত্ত ছিল । কিছুটা সেই কারণে, কিছুটা অন্যান্য কারণে সেখানে ভারতীয় সৈন্যেদের মধ্যে শৃঙ্খলা রক্ষা করা দূরূহ হয়ে উঠল । ওদের আবার জার্মানি ফেরৎ আনা হোল । পরে যখন মিত্রশক্তি জার্মানিতে প্রবেশ করে তখন এই দল ভেঙে যায় - অনেকেই বন্দী হয় ।

    একটা গল্প এখানে অবান্তর কিনা বুঝতে পারছি না - গর্ডন-সাহেবের বইয়ে আছে । জার্মানিতে থাকাকালীন নেতাজিকে যেসব জার্মান সাহায্য করেছিলেন, তাঁদের সকলেই হিটলারের দলভুক্ত ছিলেন না । কিন্তু কোন কারণে নেতাজির সঙ্গে তাঁদের বন্ধুত্ব দানা বাঁধেনি । কিন্তু নাম্বিয়ার এঁদের ভাল চিনতেন । নেতাজি জার্মানি ছাড়ার পর এঁদের মধ্যে কয়েকজন হিটলারকে হত্যা করার ষড়যন্ত্র করে ব্যর্থ হন এবং ধরা পড়েন । নাম্বিয়ার এঁদের বন্দীদশায় এঁদের সাহায্য করার চেষ্টা করেছিলেন - শেষ অবধি জার্মান সরকারের শাসানিতে নিজের প্রাণ বাঁচাতে সরে যান । এই ষড়যন্ত্রকারীদের ওপর পরে সরকার কী অমানুষিক অত্যাচার করেছিল, গর্ডন-সাহেব সেকথা বলেছেন - আমি সেগুলো লিখতে দ্বিধা বোধ করছি ।

    আমার এদেশি কিছু বন্ধু আমাকে প্রশ্ন করেন যে নাজীদের মত একটা অন্যায়কারী দলের সঙ্গে নেতাজি কেন সম্পর্ক রেখেছিলেন । এমন হতে পারে যে হিটলারের সব অন্যায়গুলোর কথা নেতাজি জানতে পারেননি (যদিও ওখানকার ঈহুদি বন্ধুদের উনি দেশ ত্যাগ করার পরমর্শ দিতেন, এবং নিজেও বারবার বলেছেন যে নাজীদের সাম্প্রদায়িকতা তাঁকে বিচলিত করে) । কিংবা ওদের কাছ থেকে যেটুকু সুবিধা করে নিতে পারেন সেটুকু করতে গিয়ে কিছু মতদ্বৈধ চেপে রেখেছিলেন । জাপানিদের সঙ্গেও ওই টানাটানি তাঁর ছিল, সেটা দেখেছি । হয়ত একেই বলে রাজনীতি ।

    রাজনীতিকে সত্যসন্ধী মানবিক রূপ দেওয়ার চেষ্টায় পরবর্তীকালে প্রাণ দিয়েছেন মোহনদাস গান্ধী, মার্টিন লুথর কিং, অনোয়ার সাদাত, ইতসাক রাবিন । এঁরা আমাদের নমস্য ।

    জার্মানির গল্পের ইতি করার জন্য এখানে আমি কয়েক বছর এগিয়ে গেছি, এবার আবার নেতাজির কাছে ফিরে যাওয়া যাক । নেতাজির সাবমেরিন কোথা দিয়ে যাচ্ছে সে খবর খুব সম্ভব ইংরেজদের অবিদিত ছিল না । ততদিনে জাপানি ও জার্মানদের গুপ্ত লিপি পাঠের ক্ষমতা ইংরেজেদের হয়ে গিয়েছিল । ওরা যে কেন বাধা সৃষ্টি করবার চেষ্টা করেনি বা সে চেষ্টা কেন সফল হয়নি, সে কথা আমরা জানি না । সাবমেরিনের যাত্রা খুব আরামের ছিল না । ঐ সাবমেরিনটি একটি ইংরেজি বাণিজ্য জাহাজকে পথে ডুবিয়েও দিল - সেটা একটা আশঙ্কার কারণ অবশ্যই ছিল । খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা মনোহারি ছিল না আদৌ । আবিদ হাসান চেষ্টা করে কিছু ডাল জোগাড় করে নেতাজিকে ডাল-ভাত খাওয়াচ্ছিলন কখনো কখনো । জার্মান যাত্রাপথ এইভাবে গেল । এর মধ্যে নেতাজি `দি ইণ্ডিয়ান স্ট্রগল' এর দ্বিতীয় সংস্করণের কাজ কিছু করলেন । ২৪এ এপ্রিল ভারত মহাসাগরে একটি জাপানি সাবমেরিন এল । জার্মানদের প্রতি কৃতজ্ঞতা ও বিদায় সম্ভাষণ জানাবার পর ছোট ডিঙিতে করে সেই বিক্ষুব্ধ সমুদ্রেই সাবমেরিন বদল হোল ।

    জাপানি জাহাজটি অপেক্ষাকৃত বড় ছিল । কিছুটা হাত-পা ছড়ান গেল । পৌঁছে যা কর্তব্য সে-সম্বন্ধে খসড়া করা শুরু হোল । আবিদ হাসান লিখেছেন যে এশিয়াবাসীদের আওতায় এসে ওনারা দুজনেই কিছুটা সুস্থ ও নিশ্চিন্ত বোধ করলেন । য়োরোপের দুটো বছর প্রায় খরচের খাতাতেই রইল । ৬ই মে সাবান দ্বীপের বন্দরে ওরা প্রথম জাপানে পা দিলেন । ক্যাপ্টেন ইয়ামামোটো এর আগে বার্লিনের দফ্তরে ছিলেন - তিনি নেতাজিকে আগ বাড়িয়ে নিলেন । ওনার সাহায্যে এবং নেতাজির চেষ্টায় ভারতের প্রতি সহানুভূতিসম্পন্ন একটা দল জাপানিদের মধ্যেই গড়ে উঠল । জুন মাসে যখন নেতাজির সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী তোজোর দেখা হোল, তিনি নেতাজির সঙ্গে অনেক ব্যাপারেই একমত হলেন । ভারতের স্বাধীনতার ব্যাপারে তিনে সর্বতোভাবে সাহায্য করার আশ্বাস দিলেন । কিন্তু বর্মা দিয়ে ভারতীয় ফৌজকে ভারতে ঢুকতে দেওয়ার ব্যাপারে সোজা কিছু বলতে পারলেন না - সেনাপতিদের সঙ্গে বহু পরামর্শের প্রয়োজন হোল । কিন্তু তার বদলে ভারতীয় ব্যাপারের ভার ইয়াকুরোর হাত থেকে নিয়ে ইয়মামোটোকে দিতে জাপান সরকার রাজি হোল নেতাজির অনুরোধে ।

    ইণ্ডিয়া ইণ্ডিপেণ্ডেন্স লীগের প্রধান কর্মক্ষেত্র তখনো সিঙ্গাপুরে । কিন্তু ভাঙনদশা । মোহন সিংএর সৈন্যাধ্যক্ষদের মধ্যে ঝগড়া তখনো থামেনি । জাপানিদের সঙ্গেও মতদ্বৈধ । মোহন সিং সরাসরি পদত্যাগ করেছেন । নেতাজি যখন সিঙ্গাপুরে গেলেন, সেখানকার ভারতীয় সমাজের মধ্যে নতুন প্রাণসঞ্চার হোল । ইণ্ডিপেণ্ডেন্স আর্মির নেতারা উত্সাহভরে নেতাজির দলপতিত্ব স্বীকার করলেন । রাসবিহারী বসু প্রকাশ্য সভায় ইণ্ডিয়া ইণ্ডিপেণ্ডেন্স লীগের কর্তৃত্ব নেতাজির হাতে তুলে দিয়ে বললেন ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের গুরুভার সুভাষচন্দ্রের মতো শক্তিশালী নেতার হাতে তুলে দিয়ে তিনি নিশ্চিন্ত বোধ করছেন । নেতাজির অধীনে ইণ্ডিয়ান ইণ্ডিপেণ্ডেন্স আর্মির নাম বদলে পাকাপাকিভাবে আজাদ হিন্দ ফৌজ হোল । নেতাজি নিজের হাতে নতুন সৈনিক টানবার কাজে হাত দিলেন । ফৌজের জনসংখ্যা মোহন সিংএর পদত্যাগের পর ১২,০০০-এ নেমেছিল । বন্দী সৈন্যদের মধ্যে আরো ১০,০০০ শুধুংউ নেতাজির বক্তৃতা শুনে ফৌজে যোগ দিল । সাধারণ ভারতীয় লোকেদের মধ্যে থেকে পাওয়া গেল আরো ১৮,০০০ সৈনিক । তাদের শিক্ষার ভাগ পুরোন আজাদ হিন্দের লোকেদের হাতে রইল । নেতাজি নিজে উত্সাহ নিয়ে নারীবাহিনী গঠন করতে লাগলেন । লক্ষ্মী স্বামিনাথন ওখানে ডাক্তার ছিলেন, ইণ্ডিপেণ্ডেন্স লীগে বহু কাজ করেছিলেন । নেতাজির সঙ্গে তাঁর দেখা হওয়ার পর দুজনেই বুঝলেন যে নারীবাহিনী গঠন করা সম্ভব এবং প্রয়োজন । দেশে থাকতে নেতাজি যেভাবে চেয়েছিলেন যে মেয়েরা দেশের কাজে নামুক, সে-স্বপ্ন এখানেও সার্থক হতে চলল । আজাদ হিন্দ ফৌজের মধ্যে ঝাঁসি রানি ব্রিগেডের সৃষ্টি হোল । ইণ্ডিপেণ্ডেন্স লীগ থেকে প্রোভিশনাল গভর্নমেন্ট অফ ইণ্ডিপেণ্ডেন্ট ইণ্ডিয়ার (আর্জী হুকুমৎ এ আজাদ হিন্দ) সৃষ্টি হোল । অক্টোবর মাসে জাপান সরকার এই সরকারকে স্বীকার করে বিবৃতি দিল । অল্পকালের মধ্যে জার্মানি, ইটালি, মাঞ্চুকুও, ক্রোয়েশিয়া, ফিলিপিন, শ্যামদেশ ও বর্মা ঐ রাষ্ট্রকে স্বীকার করে নিল । আর্জী হুকুমত ইংলণ্ড ও আমেরিকার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করল ।

    এখানে একটা ব্যাপারে সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই । দেখতে পাওয়া যাচ্ছে যে এই নতুন ভারতীয় সরকারের গঠনের ব্যাপারে নেতাজি কাগজে কলমে উর্দূ ভাষার প্রাধান্য দিচ্ছিলেন । সরকারের ও বাহিনীর নাম উর্দূতে । আজাদ হিন্দ ফৌজের সামরিক সঙ্গীত `কদম কদম বঢ়ায়ে যা' উর্দু ভাষায় । তাঁর সাহায্যার্থী বন্ধুদের মধ্যেও মুসলমান ছিলেন অনেক । হিদু-মুসলিম মৈত্রীর মাধ্যমে ছাড়া যে স্বাধীন ভারত গড়া যাবে না, এটা উনি ভাল করে জানতেন ।

    তবু পথে বিঘ্ন ছিল অনেক । শ্রী হবীব প্রমুখ মালয় সিঙ্গাপুরের কিছু ভারতীয় নিজেদের যথাসর্বস্ব আজাদ হিন্দের কাজে দান করলেন যদিও, কিন্তু অনেক ভারতীয় এ ব্যাপারে নিস্পৃহ রইলেন । জাপানি সরকারের কাছে যতটা সাহায্য পাওয়া গেল, সৈন্যাধ্যক্ষরা প্রায় অনড় রইলেন তার বিরুদ্ধে । এইখানে নেতাজি দলে পেলেন বর্মার বা ম' কে ।

    জাপানিদের সঙ্গে এশিয়ার সব দেশের সম্পর্কের সম্বন্ধে নেতাজির চেয়ে বা ম' অনেক বেশি ওকিফহাল ছিলেন । এককালে উনি ভেবেছিলেন যে বর্মার স্বাধীনতা জাপানের সাহায্যে জয় করা সম্ভব । সেই বিশ্বাসের ওপর ভর করে তিনি নিজের দলের লোকেদের বলেছিলেন জাপানকে সাহায্য করতে । কিন্তু বর্মায় জাপান যখন জয়ী হোল, তখন দেখা গেল বর্মীজদের স্বাধীনতাটা কাগজে-কলমেই থাকবে । বর্মার `স্বাধীন' সরকারকে জাপানি সৈন্যাধ্যক্ষদের অঙ্গুলি-হেলনেই চলতে হবে । কাজেই যদিও নেতাজি জাপানিদের সাহায্য নিতে ও তাদের সাহায্য করতে প্রস্তুত রইলেন, কিন্তু প্রতিমুহূর্তে প্রতি ব্যাপারে তাদের সঙ্গে তর্কে নামতে হোল । জাপানিরা ওর নামের মাহাত্ম্যটা বুঝত, কাজেই যতটা পারল তুতিয়ে-পাতিয়ে রাখল । আর্জী হুকুমত্কে মুখে বলল স্বাধীন ভারতের সরকার, কিন্তু সরকারের সঙ্গে তার সম্বন্ধটার মাঝখানে কোন রাষ্ট্রদূতের পদ রইল না, নেতাজির বারবার অনুরোধ সত্ত্বেও, অর্থাৎ আর্জী হুকুমৎ জাপানের তাঁবেদার হিসাবেই রয়ে গেল । আন্দামান দ্বীপপুঞ্জ যখন জাপানিরা জয় করল, তখন আর্জী হুকুমত্কে তার ভার দেয়া হোল । দুটি দ্বীপের নাম বদলে `শহীদ' ও `স্বরাজ' করা হোল, আর্জী হুকুমতের পতাকাও উঠল, কিন্তু জাপানি সৈন্য সেখান থেকে নড়ল না ।

    সবচেয়ে খারাপ যেটা হোল সেটা এই যে দেশের লোকের কাছে এই খবরগুলো গুজব ছাড়া আর কোন রূপে প্রকাশ পেল না । ভারতে তখন ৪২এর বিপ্লব সবে শেষ হয়েছে, ৪৩এর মন্বন্তরে লাখ লাখ লোক মারা গেছে । নেতাদের মন সেই দিকে নিবদ্ধ । তাছাড়া কংগ্রেস কোনদিন সুভাষের দেশত্যাগকে ভাল চোখে দেখেনি, কাজেই খবরগুলোকে নিয়ে বেশি নাড়াচাড়া করবার ইচ্ছা তাদেরও ছিল না । আজাদ হিন্দ দলের লোকেদের একটা বিশ্বাস ছিল যে ভারতের কোন অংশে ভারতীয় অধিকার প্রতিষ্ঠিত হলেই ভারতের সৈন্যবাহিনী ও জনতা একযোগে ইংরেজের বিরোধিতা করবে, সেটা আন্দামানেও হোল না এবং পরে দেখাব যে বর্মার যুদ্ধের পরেও হোল না । হোল তার অনেক পরে - সে গল্পের এখনো একটু দেরি আছে ।

    রাশিয়ার সাহায্য নেওয়ার ইচ্ছা নেতাজির বরাবর ছিল - উনি জানতেন যে প্রয়োজনে ইংরেজের পক্ষ যদি তাদের নিতেও হয়, ওদের সংগ্রাম সারা পুঁজিবাদি সমাজ-ব্যবস্থার সঙ্গে । তাই তিনি প্রথম থেকে তাদের সঙ্গে সংযোগ করতে চেয়েছিলেন - একমাত্র বার্লিন আসার সময়ে ছাড়া কোন সাহায্য তিনি কোনদিন পাননি । জাপান সম্বন্ধে মনে সন্দেহ থাকায় এই সময়ে কখনো জাপানের সাহায্যে, কখনো আলাদা ভাবে তিনি বারবার রাশিয়ার সঙ্গে যোগ স্থাপন করতে চেয়েছেন । এতদিন পর্যন্ত সফল হননি ।

    বর্মা পেরিয়ে চিন্দুইন নদী পর্যন্ত এসে জাপান থেমেছিল ১৯৪২এ, ইংরেজ বাহিনী পর্যুদস্ত হয়ে পিছু হটে গেছিল । কিন্তু ইতোমধ্যে চাকা ঘুরে গেছে । ১৯৪৪ নাগাদ যোরোপে ইটালির ফ্যাসিষ্ট সরকারের পতন হয়েছে, মুসোলিনি মৃত । ইংরেজ ও আমেরিকান বিমান জর্মানির সমর প্রচেষ্টাকে বোমা ফেলে ধ্বংস করার মুখে, শহরগুলো তছনছ হয়ে যাচ্ছে । জাপানের মন তখন প্রশান্ত মহাসাগরের যুদ্ধের দিকে ঘুরেছে । তবু কিছুটা নেতাজির চাপে, কিছুটা সৈন্যাধ্যক্ষদের আত্মাম্ভরিতার ফলে চিন্দুইন নদী পেরিয়ে ভারতে ঢোকার কথা ঠিক হোল । কিন্তু তখনও দেখা গেল জাপানিরা চাইছে নিজেদের সৈন্য নিয়ে ঢুকতে । শা' নওয়াজের নেহেরু ব্রিগেডকে তারা ভার দিল পিছন থেকে রসদ সরবরাহের পথ পরিষ্কার রাখতে ।

    ভারতে যুদ্ধে জাপানিদের শেষ অবধি যে পরাজয় হয়েছিল, তার মূলে অনেক কারণের মধ্যে জাপানি সৈন্যাদ্ধ্যক্ষদের মনোর্বৃংইত্ত একটা । বা ম' এবং নেতাজি দুজনেই দেখেছিলেন জাপানিরা কতটা একদেশদর্শী হতে পারে । জাপানের গৌরব ও জাপানিদের শ্রেষ্ঠত্ব ছাড়া তাদের মন কোনদিকে যেত না । একটা সিদ্ধান্ত নিলে প্রয়োজনে সেটা বদলাবার মতো মানসিক তত্পরতাও তাদের কম ছিল । ইংরেজ যেখানে নিজের সৈন্যদের সরবরাহের ব্যবস্থা ভালভাবে করেছে, সেখানে জাপানিরা নিজেদের প্রথামতো সৈন্যদের নিজের রসদ নিজে নিয়ে যুদ্ধ করার প্রথা অপরিবর্তিত রেখেছিল । ওদের ধারণা ছিল যে যুদ্ধে ইংরেজকে হারিয়ে তাদের সরবরাহগুলো দখল করাটাই যুদ্ধ চালাবার শ্রেষ্ঠ উপায় হবে । ইংরেজ ডিমাপুরে মালপত্র রেলযোগে এনে সেখান থেকে কোহিমা ও ইম্ফলে রাস্তা দিয়ে সরবরাহ করছিল । কোহিমা জাপানিদের অপেক্ষাকৃত কাছে । তাছাড়া কোহিমা পেরিয়ে ইম্ফলের মত একটা বড় শহর অধিকার করবার গৌরবটাই জাপানিদের কাছে বড় মনে হয়েছিল । কাজেই কোহিমার সুরক্ষিত ইংরেজ সৈন্যদের এড়িয়ে আগে ডিমাপুরে যাওয়ার কথাটা তারা ভাবলই না ।

    একবছরে ইংরেজের চেহারা পাল্টেছে । গতবারের পরাজয় থেকে অনেক কিছু শিখে নিয়েছে তারা । বিমানশক্তি বেড়েছে অনেক । বর্মা-আসামের অস্বাস্থকর পরিবেশে যুদ্ধের অভিজ্ঞতা থেকে তারা আগে থেকে স্বাস্থ্য-সংক্রান্ত সাবধানতা নিয়েছে - যা জাপানি এবং আজাদ-হিন্দের করা হয়নি । এ যুদ্ধ সহজ হোল না । প্রশান্ত মহাসাগরে জাপানি সৈন্য নিয়ে যাওয়া হতে লাগল । শা' নওয়াজ সৈন্য চালনার অধিকার পেলেন । তিনি সসৈন্যে কোহিমাতে আজাদ হিন্দের পতাকা প্রোথিত করলেন । কিন্তু সে অতি অল্পদিনের জন্য । ভারতীয়েরা জানল জাপানিরা আসাম অক্রমণ করেছে । অচিরে ইংরেজরা পাল্টা আক্রমণ করল - আজাদ হিন্দ ফৌজ বর্মায় ফিরে যেতে বাধ্য হোল ।

    জাপান নিজের এই বিপত্কালে নেতাজির কথা শুনে ভারতের দিকে আর কোনমতেই মন দিতে চাইল না । আজাদ হিন্দ ফৌজ পিছু হটে আসতে বাধ্য হোল । প্রায় এক বছর ধরে ধীরে ধীরে বর্মা ছেড়ে পেছিয়ে মালয় দিয়ে সিঙ্গাপুর অবধি এসে কিছুটা স্থৈর্য হোল । ১৯৪৪ সালের বাকি দিনকটায় জাপানি ও আজাদ হিন্দ ফৌজ রেঙ্গুন অবধি পৌঁঁছেছিল এবং একটা ঘাঁটি হয়েছিল । সেখানে নানা বক্তৃতায় নেতাজি বারবার বলতে লাগলেন যে অক্ষশক্তি জিতুক বা হারুক, আজাদ হিন্দ শেষ অবধি সংগ্রাম চালিয়ে যাবে । বারবার তিনি `পরবর্তী যুদ্ধের' কথা বলতে লাগলেন । সেটা যুক্তিযুক্ত হয়েছিল কিনা সেটা এখন আমাদের পক্ষে বিচার করা সম্ভব নয় । কিন্তু এই সময়ে রেঙ্গুনে বহু ভারতীয় আজাদ হিন্দে যোগ দেয়, ফলে ফৌজের সংখ্যা প্রায় ৫০,০০০এ উঠেছিল । সরকারের খরচের জন্য তখনও লোকে টাকা, গয়না দিয়ে সাহায্য করেছে ।

    জাপানিদের দুর্বল অবস্থার সুযোগ নিয়ে আরও কিছু সুবিধা নেতাজি আদায় করতে পেরেছিলেন । আজাদ হিন্দ সরকারের স্বাধীন সত্তার স্বীকৃতি হিসাবে একজন জাপানি রাজদূত আরজী হুকুমতে থাকুন, এটা নেতাজির বহুদিনের চাহিদা ছিল । এবারে জাপানিদের ইংরেজদের বিরুদ্ধে এক ডিভিশন সৈন্য দেবার প্রতিশ্রুতিতে উনি শেষ অবধি একজন রাজদূত পেলেন । কিন্তু সেখানেও তিনি জাপানিদের ভাঁওতায় ভুললেন না । বললেন, `এ রাজদূত সম্রাটের সনদ নিয়ে যখন আসেননি, তখন এঁকে সরকারি ভাবে রাজদূত হিসাবে গ্রহণ করা যায়না ।' শেষ অবধি সেটাও হোল । আরজী হুকুমত্‌-কে সকলে একটি প্রকৃত রাষ্ট্রের স্বীকৃতি দিক, এইটেই ওনার ইচ্ছা ছিল । উনি তখনো পরবর্তী যুদ্ধের কথা ভাবছেন । ততদিনে জাপানিরা প্রশান্ত মহাসাগরে নিজেদের বাঁচাতে ব্যস্ত ।

    ১৯৪৫ সালের গোড়াতেই ইংরেজরা রেঙ্গুনের দিকে এগোল । আজাদ হিন্দ জাপানিদের সঙ্গেই আরো পেছিয়ে গেল । নেতাজির জন্য এরোপ্লেন ছিল, কিন্তু তিনি নিজের সৈন্যদের সঙ্গে পায়ে হেঁটে যাওয়া ঠিক করলেন । বিশেষ করে তাঁর চিন্তা ছিল, এই বিশৃঙ্খলার মধ্যে ঝাঁসি রানি রেজিমেন্টের কোন বিপদ না হয় । লক্ষ্মী স্বামিনাথন রেঙ্গুংউনে ডাক্তার হিসাবে রয়ে যেতে চাইলেন । বাকিরা নেতাজির সঙ্গে অন্য সৈন্যেদের মতো কষ্ট সয়ে মৌলমেন গেল । সেখান থেকে ট্রেনে সবাইকে ব্যাংকক নিয়ে যাওয়া হয় । সেখানে নেতাজি সকলকে তাদের ত্যাগের জন্য ধন্যবাদ দিয়ে বিদায় জানালেন । তাদের অনেকেই ঐ অঞ্চলের মেয়ে - কাজেই বাড়ি ফেরা সম্ভব ছিল । এদের মধ্যে অনেকে পরবর্তী জীবনে অনেক উন্নতি করেছিল - গর্ডন-সাহেব তার কিছু বিবৃতি নিজের বইয়ে দিয়েছেন । পথের কষ্টের কথাও বলেছেন অনেক, কয়েকজনের মৃত্যুও হয়েছিল - অনেক কথা আমি বাদ দিলাম । সে কষ্ট নেতাজি পুরো ভাগ করে নিয়েছিলেন ।

    এটা ঘটছিল মে মাসে । তখন থেকে জুলাই মাস অবধি সিঙ্গাপুরে আর্জী হুকুমতের কাজ হোল টাকাকড়ি জোগাড় করা, সৈন্যবাহিনীর উত্সাহে ভাঁটা পড়তে না দেওয়া । কিন্তু ইংরেজ তখন বর্মা থেকে জাপানিদের প্রায় পুরো বার করে দিচ্ছে, ওকিনাওয়াতে আমেরিকানরা হামলা করছে - নেতাজি বুঝতে পারলেন জাপানিরা আর তাঁর কোন কাজে লাগবে না । আশার আলো দেখলেন যখন রাশিয়া মাঞ্চুরিয়া আক্রমণ করে জাপানের সঙ্গে যুদ্ধে নামল । উনি জাপানি সরকারকে অনুরোধ করলেন তাঁকে জাপানি বাহিনীর সঙ্গে মাঞ্চুরিয়ায় পাঠাতে - তিনি সেখানে গিয়ে রাশিয়ানদের কাছে আত্মসমর্পণ করে তাদের সাহায্যপ্রার্থী হবেন । এতে জাপানিরা রাজি হোল । উনি ছাড়া বাকি আর্জী হুকুমৎ কোথায় থাকবে ও কীকরে ওনার সঙ্গে যোগ দেবে সে নিয়ে জল্পনা শুরু হোল । সিঙ্গাপুরের পতনের আগে সেখানে আজাদ হিন্দের যোদ্ধাদের জন্য একটি স্মারক স্তম্ভ স্থাপন করা হোল । লেখা রইল, `ভারতের স্বাধীন নাগরিকেরা একদিন জানবে মনিপুর, কোহিমায় এদের আত্মদান ওদের পথিকৃত হয়েছিল' ।

    ১৬ই আগস্ট নেতাজি সিঙ্গাপুর থেকে ব্যাংকক গেলেন । সেখান থেকে সদলবলে সাইগন গেলেন তার পরদিন । কিন্তু সেখানে খবর পাওয়া গেল যে আর্জী হুকুমতের সবাইকে নিয়ে যাবার যন্য যে এরোপ্লেন পাওয়ার কথা ছিল, তা পাওয়া যায়নি । নেতাজি ছাড়া মাত্র একজন সঙ্গীর জায়গা হোল এক জাপানি বন্ধুর সহায়তায় । মালের জায়গা নিয়েও সমস্যার সৃষ্টি হোল । নেতাজির সঙ্গে বেশ কিছু সোনাদানা যাচ্ছিল । অনেক জিনিষ পেছনে ফেলে শুধুংউ দুটো সুটকেসে তাই নেওয়া হোল । নেতাজির সঙ্গে রইলেন মেজর হবিবুর রহমান । প্লেন ছাড়ল বিকেল সাড়ে পাঁচটায় । সে রাতটার জন্য ভিয়েতনামে দা-নাং বিমানবন্দরে নেমে ওনারা হোটেলে রাত কাটালেন ।

    আগের দিন সাইগন থেকে ওঠবার সময়ে প্লেনের অসুবিধা হয়েছিল ভারের জন্য । তাই এবার যাত্রার আগে বেশ কিছু অস্ত্রশস্ত্র নামিয়ে দেওয়া হোল (জাপানিদের মধ্যে নেতাজির গুণগ্রাহী বন্ধুর অভাব ছিল না - `ভারতীয় সামুরাই'কে অনেকেই শ্রধা করত), নেতাজির সুটকেসে হাত পড়ল না । ভোর পাঁচটায় যাত্রা করে প্লেন তাইপেই পৌঁছাল দুপর বেলায় ।

    এঞ্জিনে কিছু একটা গণ্ডগোল হচ্ছিল বলে সন্দেহ করা গেছিল, কিন্তু কলকাঠি ঘেঁটে খুব একটা সুরাহা হোল না । এদিকে খবর পাওয়া গেল যে মানচুরিয়ার দরিএন ঘাঁটিতে তাড়াতাড়ি পৌঁছন দরকার রাশিয়ানরা এসে যাবার আগে, নইলে নেতাজির যাওয়া হয় না ।

    আড়াইটের সময় প্লেন উঠল । ভার বেশি - পুরো রানওয়ে ১৫০০ মিটার - পুরোটাই ওঠবার জন্য প্রয়োজন হোল । প্লেন আকাশে উঠলা মাত্র ৩০ মিটার । তারপরে প্রচণ্ড বিস্ফোরণ । বাঁদিকের এঞ্জিন খসে গেল । প্লেন মাটিতে আছাড় খেয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে সামনের দিকটায় আগুন ধরে গেল । জাপানি মেজর কোনো উপরের `ক্যানপি' খুলে লাফিয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে খানিকটা পেট্রলের ছিটে তাঁর ওপর পড়ে জামায় আগুন লেগে গেল । তিনি মাটিতে গড়িয়ে সেটা সামলালেন, কিন্তু আহত হলেন । রহমান ও নেতাজি তখনো ভেতরে । পেছন দিকটা মালে ভর্তি, সেখান দিয়ে বেরোন অসম্ভব । ওরা দুজনে সামনের আগুন ঠেলে বেরোলেন - অনেকটাই পুড়ে গেলেন । বেরোবার সাথে সাথে পেট্রলের ছিটে নেতাজির গায়েও লাগল - ওনার কাপড়ে আগুন লাগল । মেজর রহমান ওনার কাপড়্গুলো বহু কষ্টে ছাড়িয়ে দিলেন ।

    আহত সবাইকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হোল যথাশীঘ্র সম্ভব । নেতাজির মুখ ও শরীর খুব পুড়ে গেছিল । কিন্তু সেসত্ত্বেও ডাক্তারেরা বিস্মিত হয়ে দেখলেন যে তাঁর জ্ঞান ও চিন্তাশক্তি অক্ষুন্ন আছে । হাসপাতালে রাত ৯টার সময়ে নেতাজির মৃত্যু হোল । মৃত্যুর অল্পকাল আগে পর্যন্ত তিনি মেজর রহমানের সঙ্গে কথা বলে তাঁকে উপদেশ ও উত্সাহ দিয়েছিলেন । যখন তাঁর সংজ্ঞা প্রায় লোপ পেয়ে এসেছে, তখন তিনি একবার বলেন `মেজু' । কাছের লোকেরা আন্দাজ করে তিনি জল চাইছিলেন । গর্ডন-সাহেব সন্দেহ করেছেন যে তিনি একবার মেজদাকে স্মরণ করেছিলেন । ওনারা দুই ভাই কতখানি ঘনিষ্ঠ ছিলেন, সেটা আমরা বারবার দেখেছি ।

    আমার গল্পের এই অংশটা আমি ইচ্ছা করে বিস্তৃত ভাবে লিখলাম, কারণ নেতাজির মৃত্যু সম্বন্ধে পূর্ণ বিবরণ বড় একটা পাওয়া যায় না । তিনি বেঁচে আছেন, এ গুজব এককালে মাঝে মাঝেই ছড়াত (গর্ডন-সাহেবের বইয়ে তার বিস্তৃত আলোচনা আছে) । এখন বোধহয় আর ছড়ায় না, কারণ তিনি বেঁচে থাকলে তাঁর বয়স হোত ১০৫ বছর । এখন জাতীয় নেতা হবার ইচ্ছা বা ক্ষমতা বোধহয় তাঁর থাকত না - আর যাঁরা ওনাকে জীবন্ত চান, তাঁরা নেতা হিসাবেই চান ।

    কংগ্রেসের সকলের জেলে থাকাকালীন মুসলিম লীগের প্রতির্পংইত্ত বেড়ে যায় । পাকিস্তানের দাবি তখন থেকেই জোর পেয়েছিল । বাংলায় হক মন্ত্রীসভার পতন হয় শরত্চন্দ্র জেলে যাবার অব্যবহিত পরেই । খাজা নাজিমুদ্দিনের হাতে নতুন মন্ত্রীসভা প্রতি ব্যাপারে সাম্প্রদায়িক প্রশ্ন তুলে জল ঘোলা করছে । সহীদ সুরাবর্দি অসাম্প্রদায়িক দলগুলির সঙ্গে সব চুক্তি ভুলে তার সঙ্গে সুর মিলিয়েছেন (নিজের ক্ষমতা ছাড়া আর কোন আদর্শের প্রতি কোনদিনই তাঁর শ্রদ্ধা ছিল না) ।

    নেতাজির সম্বন্ধে বহু খবর সরকার এতোদিন চেপেই যাচ্ছিল, তাঁর মৃত্যুর খবরটা ছাড়তে আর দেরি করল না । ২৫এ আগস্ট কলকাতার কাগজে শরত্চন্দ্র ভাইয়ের মৃত্যুসংবাদ পেলেন । তাঁর সে সময়ের চিঠি বা ডায়ারি এখানে উদ্ধৃত করলাম না ।

    এ-সময়ে কংগ্রেসের বেশিরভাগ নেতাই জেল থেকে ছাড়া পেয়ে গেছেন । শরত্চন্দ্রকে রেখে দেবার কারণ প্রধানত তিনি নেতাজির ভাই বলে । জাপান ও জার্মানি থেকে আজাদ হিন্দের গুপ্তচর দেশে যেত - তাদের যোগ ছিল বেঙ্গল ভলান্টিয়ার ও ফরোয়ার্ড ব্লকের লোকেদের সঙ্গে । শরত্চন্দ্রের সঙ্গে এই দুই দলের সৌহার্দের কথা সরকার জানত - কাজেই কংগ্রেসের লোকেরা ছাড়া পেলেও তিনি পাননি । নেতাজির মৃত্যুর পর সরকার তাঁর নামের গ্রেপ্তারি পরোয়ানা তুলে নেয়, এবং অল্প পরে শরত্চন্দ্রকেও মুক্তি দেয় । বড়লাট ওয়াভেল সাহেবের সঙ্গে কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের নেতারা যখন কোনভাবেই একমত হতে পারলেন না, সেইসময়ে ইংলণ্ডে চার্চিল মন্ত্রীসভার পতন হোল, এবং প্রধানমন্ত্রী অ্যাটলী-সাহেব ভারতে সর্বজনীন ভোটের ব্যাবস্থা করলেন কেন্দ্রীয় আইনসভার জন্য । শরত্চন্দ্র কংগ্রেসের অন্যতম প্রতিনিধি হিসাবে নির্বাচিত হন ।

    ওয়াভেল-সাহেবের ব্যার্থতার পরে ইংরেজ সরকার ভারতে পাঠিয়েছিলেন স্যর স্টফোর্ড ত্রক্রীপ্স, স্যর আলেক্সান্দর ও স্যর পেথিক লরেন্সকে । সেই দলের সঙ্গে ভারতীয় নেতাদের আলোচনা ও তার ফলের কথা বিশদভাবে বর্ণনা কর হয়ত উচিৎ ছিল, কারণ আমার পাঠকদের অনেকেই সে সময়ে জন্মাননি । গর্ডন-সাহেবের বইয়ে সেসব কথা আছে, কিন্তু আমার গল্পের সঙ্গে তার সম্পর্ক কতটা জানি না । এটা বলতেই হবে যে এইসব আলোচনার ফলে যে অন্তর্বর্তি মন্ত্রীসভা গঠন হয়, শরত্চন্দ্র সেই সভার সদস্য হিসাবে কাজ করেছিলেন ।

    তবে একটা গল্প না বলে পারছি না - নিজের স্মৃতির মধ্যে আছে বলে আর কিছু গায়ের ঝাল ঝাড়ার প্রলোভন সামলাতে পারছি না বলে । চার্চিল-সাহেব ভারত ত্যাগ করার ঘোর বিরোধী ছিলেন র্‌(ইংরেজ সাম্রাজ্যের পতন ঘটাবার জন্য আমি মহমান্য সম্রাটের মন্ত্রী হইনি') । গান্ধীজীকে চিরকাল `অর্ধ-উলঙ্গ ফকির' বলে বিদ্রূপ করে এসেছেন । কাজেই পেথিক লরেন্স ত্রযীর ভারতে আসায় তাঁর ঘোর আর্পংইত্ত ছিল । পার্লামেন্টে তখন তিনি বিরোধী দলের সদস্য - একদিন বললেন, `ভারতীয়দের মঙ্গল করা যে কঠিন, সেটা আমার প্রতিভূ হিসাবে স্যর স্টাফোর্ড নিজেই দেখেছেন' । ত্রক্রীপ্স উষ্মাভরে জবাব দেন, `তখনকার কাহিনী সর্বসমক্ষে বলার ইচ্ছা যদি মাননীয় সদস্যের হয়ে থাকে, তাহলে আশাকরি তিনি পুরো কাহিনীটাই বলবেন' । চার্চিল-সাহেব চুপ করে গেছিলেন ।

    আজাদ হিন্দের কথা প্রচার হবার পরে ভারতের হাওয়া বদলে গেছিল । ফৌজের শা নওয়াজ প্রমুখ ক'জন নেতাকে দেশদ্রোহিতার অপরাধে যখন সরকার বিচার করার সিদ্ধান্ত নিল, তখনকার দেশজোড়া বিক্ষোভের কথা আমার মনে আছে । শক্তিশালী উকিল ও অন্যতম দেশনায়ক বুলাভাই দেশাই বিবাদী পক্ষের উকিল হিসাবে প্রমাণ করার চেষ্টা করলেন যে ওরা আসলে এক স্বাধীন সরকারের সৈনিক - তাঁদের বিচার যদি করতে হয়, আন্তর্জাতিক আইন অনুসারে করতে হবে, ইংরেজি আইনে নয় । অবশ্যই একথা গ্রাহ্য হোল না - ওনারা সবাই দণ্ডিত হলেন - কিন্তু দেশের অবস্থা দেখে সরকার সে দণ্ড মকুব করল । আজাদ হিন্দের খবর তখন সারা দেশ জেনে গেছে । জব্বল্পুরের ছাউনিতে সৈন্যেরা বিদ্রোহ করল । করাচির বন্দর থেকে নৌবাহিনীর একটা জাহাজ বেরিয়ে গিয়ে শহরের ওপর কামান দাগল । ইংরেজি পার্লামেন্টে এটলি সাহেব ঘোষণা করলেন, `ভারতে আমাদের খেলা শেষ হয়েছে' র্‌(দি গেম ইন ইণ্ডিয়া ইজ আপ')।

    একটা হয়ত অবান্তর কথা মাথায় এল । বুলাভাই দেশাই এই ঘটনার অল্পকাল পরে মারা যান । তখন ছবিতে খবর দেখানো হোত সিনেমায় (টেলিভিশন সে যুগে ছিল না - অনেকে বিশ্বাস করবে না) । আমার শম্ভুদার সঙ্গে সিনেমা দেখতে গেছি । শম্ভুদা কাঠখোট্টা লোক - অল্পে কখনো কাতর হয় না । সিনেমায় দেখলাম বুলাভাই দেশাইয়ের শবযাত্রা । লাখ লাখ লোক, ফুলের মালার ছড়াছড়ি শবাধারের ওপর । হঠাৎ শম্ভুদা বলল, `একেই বলে মরা হে, একেই বলে মরা' । গলাটা কেঁপে গেল একটু যেন ।

    এরপরের স্বাধীনতা সংক্রান্ত ঘটনা গর্ডন-সাহেবের বইয়ে সবিস্তারে আছে, আমি আর তার পুনরুক্তি করলাম না । নেতাজির গল্প শেষ হয়েছে । ১৯৪৬-৪৭এর কাহিনী যাঁরা জানেন না তাঁদের কোথাও পড়ে নিতে বলব (বলেছি তো, আমার পাঠকদের মধ্যে অনেকেরই তখন খুব অল্প বয়স) । তবু স্মরণ করিয়ে দিই, কলকাতার রক্তগঙ্গার পরে যখন সবাই পাকিস্তানের অস্তিত্ব মেনে নিল, তখন শরত্চন্দ্র আন্দোলন করলেন যে বাংলাকে পুরো পাকিস্তানে ফেললে চলবে না - বাংলাকে আবার ভাগ করা হোক । সে আন্দোলন সফল হয়েছিল ।

    এই সময়কার দুটো কাহিনী মনে পড়ছে - তখনকার হাওয়ার কিছু পরিচয় পাওয়া যাবে । কলকাতার `প্রতিশোধ' হিসেবে বিহারের গ্রারমদেশে তখন হিন্দুরা মুসলমানেদের ওপর অকথ্য অত্যাচার করছে । মুসলিম হস্টেলের সহপাঠিরা আমাদের কাছে আশ্রয় নেওয়ার কথা ভাবছে । জবাহরলাল তখন দিল্লীতে মন্ত্রীসভায় - খবর পেয়ে ছুটে এলেন । সেই সময়ে পাটনার ময়দানে তাঁর বক্তৃতার প্রথমটা মনে আছে, `ভাইসব, কাল সন্ধ্যা পর্য্যন্ত আমি দিল্লীতে ছিলাম । ভাবছিলাম, ভবিষ্যতে যাতে আর যুদ্ধ না হয়, তার জন্য স্বাধীন ভারতবর্ষ কী উপায় করে সারা পৃথিবীর সাহায্য করতে পারে । আর আজ এখানে এসে আমাকে বলতে হোল - ভাই হয়ে ভাইকে আঘাত করতে নেই । এ লজ্জা কোথায় রাখি ?' দুনিয়া তখন হয়তো শুনেছিল কয়েক দিনের জন্য - কিন্তু আজ পর্যন্ত তাঁর সে লজ্জা রয়েই গেল ।

    এর বোধহয় দু-দিন পরের ঘটনা । পাটনার সেনেট ঘরে পণ্ডিতজী বলতে এসেছেন । একদিন আগে বলেছিলেন, `সরকারের কথায় যদি কাজ না হয় আমাদের বাধ্য হয়ে বিহারের শাসন সৈন্যবাহিনীর হাতে দিতে হবে । তারা কী করবে না করবে তা সামলাবার অধিকার তখন আমাদের থাকবে না' । এতে লোক ক্ষুব্ধ হয়েই ছিল । আজ তাঁর বক্তৃতার মাঝখানে একদিক থেকে কেউ বলল, `মুজফফরপুরমে কেঁও গোলি চলি ?' একটা গোলমালের সৃষ্টি হোল - থামান যায় না । কতগুলো গোরা গোলমাল শুনে বন্দুক উঁচিয়ে ছুটে এল । বিশৃঙ্খলা চরমে উঠল । এমন সময়ে হঠাৎ দেখি সামনের বেঞ্চির পিঠের ওপর একটা পা । জয়প্রকাশ নারায়ণ স্টেজ থেকে বেঞ্চি টপকে মুহূর্তে পেছন দিকে চলে এসেছেন, `বৈঠ যাইয়ে, বৈঠ যাইয়ে - কৈসে ডরপোক হঁয় সব আপ' । ততক্ষণে একজন সার্জেন্ট ভেতরে এসে পণ্ডিতজীকে দেখতে পেয়েছে । `নো মেন - গেট আউট, গেট আউট' । ব্যাপারটা ঠাণ্ডা হোল । জয়প্রকাশ মাইক্রোফোন তুলে নিলেন । তারপর বিহারী হিন্দিতে গালাগাল, `কৌন হাল্লা মচায়া - আগে আইয়ে, দেখুঁ ম্যয় কৈসা বাপকে বেটা হ্যয় ।' কিছুক্ষণ পরে পণ্ডিতজী আবার কথা শুরু করলেন । ১৯৪২এর বীর জয়প্রকাশের রূপটা সেদিন দেখেছিলাম ।

    পূর্ব পাকিস্তান সফল হয়নি । ১৯৭১এর কাহিনী বাঙালির ইতিহাসে আরেকটি গৌরবময় কাহিনী । কিন্তু সেও এখন তোলা থাক - নইলে বাংলাদেশের ইতিহাস নাড়তে হবে । সেটা আমার পক্ষে আনন্দজনক হবে না । শেখ মুজিবকে আমি আজও শ্রদ্ধা করি ।



  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments