তসলিমার এই বই নিষিদ্ধ করে পশ্চিমবঙ্গ সরকার যে দূরদর্শিতার পরিচয় দিয়েছেন তা প্রশংসার যোগ্য । লুপ্তপ্রায় মার্কসবাদের এই শেষ সরকারের নাম কস্মিনকালে শুনতে পেত না যারা তাদের কাছে নামের প্রচার হয়েছে । কিন্তু ভুললে চলবে না যে মহারাষ্ট্রের ঠাকরে-পন্থীরা ইতিহাস নতুন করে লিখবে বলে ভাণ্ডারকর লাইব্রেরি পুড়িয়ে ছাই করে দিয়ে মাত্র কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই আরো এক ধাপ এগিয়ে গেছে । পশ্চিমবঙ্গ সরকারের উচিত এই কঠিন প্রতিযোগিতায় এগিয়ে থাকার জন্য তাঁদের পছন্দ নয় এমন কয়েক হাজার গ্রন্থ অবিলম্বে পোড়ানো । সঙ্গে কিছু সরকারী বাস ও বাড়ি যোগ করলে আরো ভালো । তসলিমার বইটা ভারতের অন্য প্রদেশে কাটছে । সেখান থেকে কপি পশ্চিমবাংলায় যাতে না ঢুকে পড়ে এর জন্য প্রশাসনের চাই একটা গুপ্ত পুলিশ বিভাগ । যার চোখ থাকবে শহর, গ্রাম ও মফস্বলের সমস্ত বইয়ের তাকে । পোটা, পোকো ইত্যাদি আইনের লাঠি একটু নেড়েচেড়ে কারো পিঠে ভাঙতে চাইলে এই তার উপযুক্ত সময় ।
তসলিমা নাসরিন নিজের ওয়েবসাইটে যে বইয়ের ফ্রি ডাউনলোড রেখে দিয়েছেন সেটা আমার মনে হয় এ যুগের আরো বড় ও বিপজ্জনক সমস্যা । আশা করি পশ্চিমবঙ্গ সরকার আপত্তিকর ওয়েবসাইটগুলো আটকাবার কিছু একটা ব্যবস্থা করবেন । কিছুদিনের জন্য পুরো ইন্টারনেটই ব্যান করে দেওয়া বাঙ্ছনীয় । কেননা ইন্টারনেট প্রায় মানুষের চিন্তার মত কদর্য ও অবাধ । সমস্ত নিষিদ্ধ জায়গায় তাকে যেতে দেখা যায় । বাঁচোয়া এই যে দেশটা এত গরীব ইন্টারনেট আর কটা লোকে হাতে পায় ? যারা পায় - তারা ভাগ্যিস শিক্ষিত এবং ভদ্র পরিবারের সন্তান । যারা দুধ ভাত খায় এবং দাঙ্গা ফাঙ্গা করে না । সেন্সরশীপ আইনের মূল উদ্দেশ্য কী ? মূল উদ্দেশ্য হল গরীব, স্বল্পশিক্ষিত জনতা, যারা চিন্তাভাবনা করে বলে ধরে নেওয়া উচিত নয়, তাদের নোংরা বা কঠিন চিন্তা, বদ অভ্যেস ইত্যাদির হাত থেকে বাঁচানো । শিক্ষিত, সমৃদ্ধ, সমাজের ত্রক্রীমকে এই গুরুদায়িত্ব পালন করার জন্য প্রতি পাঁচ-বছর অন্তর সেই অর্ধশিক্ষিত দায়িত্বজ্ঞানহীন জনতার সুচিন্তিত ভোট ভিক্ষা করে অ্যাসেম্ংইব্ল, পার্লামেন্ট ইত্যাদি আইন বানাবার জায়গাগুলোতে সুট করে ঢুকে পড়তে হয় ।
পরবাসের সৌজন্যে `দ্বিখণ্ডিত'র একটা ছাপানো সংস্করণই পেয়ে গেছি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বসে । পাঠকদের মনে করিয়ে দিই যে `আমার মেয়েবেলা'র প্রথম খণ্ড আনন্দ পুরস্কার পেয়েছিল । এটা তসলিমার দ্বিতীয় আনন্দ পুরস্কার । এর আগে `নির্বাচিত কলাম' ১৯৯২ সালে পেয়েছিল একই পুরস্কার । `নির্বাচিত কলাম' এবং `লজ্জা'র পর তসলিমার এই একটা বই সমূহ বিতর্কের সৃষ্টি করেছে । `দ্বিখণ্ডিত'-র এই আলোচনায় আমি তিনটে প্রশ্ন ছুঁয়ে যেতে চাই যার উত্তর পরবাসের পাঠক জানতে উত্সুক হবেন বলে আমার মনে হয় । এক - কেন এই বই নিষিদ্ধ করার জন্য আবেদন ? দুই - এই বইতে বিতর্কের উপাদান কোথায় ? তিন - বইটা কতটা পড়ার যোগ্য ?
প্রথম প্রশ্নের উত্তর কঠিন নয় । এই চারশো পৃষ্ঠার বইতে সলমান রুশদির `স্যাটানিক ভার্সেস'এর কথা মনে পড়িয়ে দেয় এমন গোটা দুয়েক পাতা আছে । পয়গম্বর মহম্মদ ও ইসলামের উত্পত্তির ইতিহাসকে একটা রাজনৈতিক ঘটনা হিসেবে দেখতে চেয়েছেন তসলিমা । লিখেছেন - `মানুষের অজ্ঞানতা আর মৃত্যুভয় থেকে জন্ম নিয়েছে ধর্ম । একেশ্বরবাদী পুরুষেরা ধর্ম তৈরি করেছে তাদের আনন্দের জন্য, ইহলোকে সুখভোগের জন্য ।' পয়গম্বরের সিদ্ধান্তগুলোর পিছনে নিজস্ব সুখসুবিধার কামনা আছে এরকম একটা দু:সাহসী কথা বলে ফেলেছেন । এটা যে তসলিমার একার বিশ্বাস তা নয়; বহু নাস্তিক একমত হবেন । দক্ষিণপন্থী হিন্দুদের তো উল্লাসই হবে এসব শুনে । কিন্তু হিন্দু ও মুসলমান পরস্পরকে যত না সন্দেহের চোখে দেখে তারও চেয়ে বেশি সন্দেহের চোখে দু-দলই দেখে নাস্তিকদের । ইসলাম ঠিকঠাক মেনে চলতে গেলে তো হিন্দুদের দেবদেবীর মূর্তিগুলো ভেঙ্গে দেওয়াই বিধি । তা সত্ত্বেও ভারত উপমহাদেশে হিন্দু ও মুসলমান জনসম্প্রদায় একটা কাজ চালানো সমঝোতা করে চালিয়ে নিচ্ছে না ? অন্যের ধর্ম বিশ্বাসের সঙ্গে নিজের ধর্ম বিশ্বাসের পূর্ণ বিরোধ থাকলেও তা মেনে নিচ্ছে - কারণ দুটোই চোখ বুজে বিশ্বাস করার ব্যাপার - ওদলের বিশ্বাস যে অন্ধবিশ্বাস সেটা এদলের কাছে দিনের আলোর মত স্পষ্ট । দুদলই মাথা উঁচু করে গর্বের সঙ্গে সহাবস্থান করে যাচ্ছে । কিন্তু অত্যন্ত ধর্মভীরু মানুষেরও বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ছাড়া চলে না এবং ত্রক্রমশ আরোই চলবে না মনে হচ্ছে । এর থেকে বহু হিন্দু ও মুসলিম ধর্মভীরু মানুষের মনে একধরনের হীনমন্যতার জন্ম হচ্ছে - তার ঈশ্বর যেন আর সব ঈশ্বরের চেয়ে বড় হয়েও পদে পদে প্রযুক্তির কাছে অবান্তর হয়ে যাচ্ছে । কৃত্রিম বুদ্ধির কি আত্মা আছে ? সে কি স্বর্গে যাবে না নরকে ? এইসব জটিল প্রশ্নের উত্তর পেতে গেলে ধর্ম গ্রন্থগুলোকে বাঁকিয়ে চুরিয়ে এমন সৃষ্টিশীলভাবে ব্যবহার করতে হচ্ছে যে তাদের নিজের কাছেই অর্ধেক উত্তর বিশ্বাসযোগ্য হচ্ছে না । এরকম একটা অবস্থায় বিজ্ঞানে যে ঈশ্বর বা অন্যান্য ধর্মীয় সংস্কারের কোনো জায়গা নেই এই কথাটা যারা সোজাসুজি বলে - সেই নাস্তিকদের সহ্য করা কঠিন । নাস্তিকদের সংখ্যা যদি ভারতের দশ শতাংশ হত, যদি তাদের একটা আলাদা ভোটিং কনস্টিটুয়েন্সি থাকত, যদি সরকার তাদের জন্য বছরে দুটো আলাদা ছুটির দিন মঞ্জুর করে দিত তাহলে হয়তো হিন্দু ও মুসলিম উভয় সম্প্রদায় তাদের সমীহ করে চলত । যতদিন না এইসব হচ্ছে ততদিন ধর্মভীরু হিন্দু ও মুসলমান ভাইদের কষ্টকর চিন্তাভাবনার হাত থেকে বাঁচাতে গেলে সরকারের পক্ষে `দ্বিখণ্ডিত'র মত বই নিষিদ্ধ করা ছাড়া উপায় কী ?
`দ্বিখন্ডিত' বিতর্কিত হবার আরেকটা প্রধান কারণ এই - তসলিমা যে এক আধ ডজন বিখ্যাত বা অখ্যাত ব্যক্তির চরিত্রের দুর্বলতা টেনে এনেছেন আত্মজীবনীতে তার মধ্যে দুজন দশ দশ কোটি টাকার দুটো মানহানির মোকদ্দমা করেছেন বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গে । বইটা পড়ার আগেই এই প্রসঙ্গে কিছু অভিযোগ কানে আসছিল এমন কয়েকজন পরিচিত ও বন্ধুবান্ধবদের মুখে যাঁদের রুচি ও অভিমতের উপর সাধারণত আমার আস্থা থাকে । প্রথমে অভিযোগগুলো সূচীবদ্ধ করা যাক ।
১) তসলিমা চাঞ্চল্য ও বিতর্ক সৃষ্টি করার জন্যই লেখেন ।
২) তসলিমা পুরুষ বন্ধু ও পরিচিতদের বিষয়ে যে সব কাহিনী বলেছেন তা কেচ্ছা বা গসিপ
গোত্রীয় । এর অন্য কোনো মূল্য নেই । সাহিত্য মূল্য তো নয়ই ।
৩) যে মানুষটার সমালোচনা করা হচ্ছে তার আত্মপক্ষ সমর্থন করার সুযোগ নেই বলে
এরকম ব্যক্তিগত সমালোচনা দায়িত্বশীল লেখকের পক্ষে বর্জনীয় ।
৪) তসলিমার অভিযোগগুলো সত্যি হলেও তা আত্মজীবনীতে প্রকাশ করা একধরনের
বিশ্বাসঘাতকতা ।
আমি এক এক করে সবকটা অভিযোগ নিয়ে খানিকটা আলোচনা করব । অভিযোগগুলোর
জবাব দিতে যাচ্ছি না । বরং বলব যে এইসব অভিযোগ অংশত সত্যি হলেও তার জন্য বইটাকে
উপেক্ষা করার বা বয়কট করার কোনো প্রয়োজন নেই । অভিযোগগুলো সত্যি মেনেও
বইটা কোনো পাঠকের ভালো লাগতে পারে ।
প্রথমেই ধরা যাক এই প্রশ্নটা : তসলিমা কী শুধু বিতর্ক সৃষ্টির জন্যই লেখেন ? এর একটাই উত্তর - তসলিমা নিজে ছাড়া কেউ তা জানেন না । কিছু কিছু লেখক আছেন, যেমন ধরা যাক অ্যান কুলটার, যাঁদের লেখায় তথ্যের গোঁজামিল ও নির্ভেজাল মিথ্যাভাষণের অকুন্ঠভাবে আত্মপ্রকাশ । মহৎ কোনো সত্য উদ্ঘাটনের জন্য লেখক বইগুলো লিখেছেন এটা বিশ্বাস করা শক্ত । তসলিমার এই বইতে এমন কোনো ধোঁয়ানো বন্দুক নেই যাতে প্রমাণ হয় লেখাটা অনুসন্ধিপ্রণোদিত । লেখক যদি বিতর্ক সৃষ্টি করার জন্যই লেখেন তাহলে প্রশ্ন ওঠে যে বিতর্ক থেকে লেখকের কী লাভ ? বইয়ের বেশি কাটতি ? জনপ্রিয়তা ? `দ্বিখণ্ডিত'র অনেক জায়গায় লেখক তো নিজের প্রতিই বেশ কঠোর মন্তব্য করেছেন । এক জায়গায় এও লেখা আছে যে `আমি যা কিছু লিখেছি তা হয় টাকা কামাবার জন্য, না হয় নাম কামাবার জন্য ।' প্রসঙ্গের তোয়াক্কা না করলে বলা যায় বা: - লেখক তো একটা গোলমেলে উদ্দেশ্য নিজেই স্বীকার করেছেন । প্রসঙ্গটা মনে রেখে পড়লে পাঠকের অন্যরকম ধারণা হতে পারে - তো সে নিয়ে আমি আর কিছু বলছি না - পাঠক নিজেই ওয়েবসাইট থেকে বইটা নিয়ে পড়ে নিতে পারেন । এটা আলাদা কথা যে লিখে আর কটা লোক সমাজ বদলাতে পারে - টাকা আর নাম পাওয়ার জন্যই হয়ত বেশির ভাগ লেখকেরই কলম-পেশা । তসলিমা একা সেটা স্বীকার করে ফেলেছেন বলে কি অন্যদের বেকসুর খালাস করে দিতে হবে ?
তসলিমার লেখা কী গসিপ গোত্রীয় ? তার কী কোনো সাহিত্য মূল্য নেই ? এই প্রসঙ্গে প্রথমে বলা উচিত যে আত্মজীবনীমূলক লেখা বা সাংবাদিক লেখায় জীবিত ও সমকালীন ব্যক্তিত্বের সমালোচনা কী নতুন ? নীরদ চৌধুরির মত দীর্ঘদিন অপেক্ষা আর কজন করতে পারে ? এ নিয়ে কিছুটা আপত্তি ওঠাও স্বাভাবিক । স্বয়ং সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে ধরা যাক, যাঁকে বাংলার বিবেক বললে অত্যুক্তি হয় না । `দেশ' পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে আত্মজীবনীমূলক লেখা লিখতে গিয়ে তাঁরও হাত ফস্কে একটা অসাবধানী মন্তব্য বেরিয়ে গেলে আপত্তির কড়া চিঠি এসে জমা পড়ত বলে মনে পড়ছে । গসিপের সঠিক সংজ্ঞা কী আমি জানি না তাই শুধু এটুকু বলব - সমালোচনা যখন অতিরিক্ত প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে ওঠে, বা কারো এমন দুর্বলতা নিয়ে উপহাস করে যে দুর্বলতাকে কাটিয়ে উঠতে মানুষটা নিরুপায় তখন সাধারণ পাঠকের কাছে সেটা আর উপাদেয় থাকে না । তসলিমার এই লেখার অধিকাংশ সমালোচনা এই গোত্রীয় কিনা তার বিচার পাঠকদের হাতেই ছেড়ে দিচ্ছি । আমার মনে হয়েছে যে কিছু কিছু জায়গায় লেখকের ধৈর্যচ্যুতি ঘটেছে - বিশেষ করে শারীরিক দুর্বলতার বর্ণনায় - যেখানে আরেকবার সম্পাদনা না করার ফলে বইটার (এবং তার লেখকের ভাবমূর্তির) ক্ষতি হয়েছে । কিন্তু তসলিমার লেখার শেষ কথা হল যে তা প্রতিবাদের লেখা । প্রতিবাদের পিছনে সত্যিকারের অন্যায় থাকুক আর না থাকুক একটা অন্যায়ের বোধ তো থাকে । সেই অন্যায়ের ঘটনাগুলোই এই চারশো পাতার বইয়ের অধিকাংশ পাতা ভরিয়ে রেখেছে । অন্যায়গুলো যদি অন্যায় বলে পাঠকের মনে হয়, তাহলে তার সমালোচনাকে কী গসিপ বলা যায় ? সেটাই তো প্রতিরোধ । বরং সমালোচনা না করাই চেপে দেওয়াটাই সহনশীল সমাজের প্রকৃত কেচ্ছা ।
সাহিত্যমূল্যর দিক দিয়ে `আমার মেয়েবেলা'র সঙ্গে `লজ্জা'র কোনো তুলনা হয় না । `আমার মেয়েবেলা'র তিন খণ্ড শুধুমাত্র সাহিত্যের বিচারেই উঁচুদরের লেখা । তসলিমার উপন্যাসে যা নেই, এবং আত্মজীবনীতে যা আছে, তা হল গল্পের বৈচিত্রের সঙ্গে সঙ্গে তার একটা অখণ্ড সমগ্রতা এবং উদ্দেশ্য । বিখ্যাত মার্কিন লেখক জন আর্ভিং মাঝে মাঝে বলেন যে সাধারণত লেখকদের প্রথম বইটাই সবচেয়ে ভালো । বাকিসব ভূষিমাল । কথাটা এক হিসেবে কিছুটা সত্যি । উপন্যাসের লেখকরা জীবনে একটাই ভালো গল্প লেখেন - সেটাতে তাঁদের জীবনের অভিজ্ঞতা ও দর্শন পুরোটা বলা হয়ে যায় । বাকি যা লেখেন সব কষ্টকল্পিত গল্প । তাতে ম্যাজিক যদি থাকে তো ম্যাজিকাল রিয়্যালিটির নকল ম্যাজিক । বাস্তবের সাবালকত্ব এবং ঘটনার নতুনত্ব দুটো একসঙ্গে সংসর্গ করলে যে ম্যাজিক হয় তা একবারই আসে । তসলিমার ক্ষেত্রে এটা আমাদের চোখের সামনে ঘটছে `আমার মেয়েবেলা'য় ।
সব আত্মজীবনী ইতিহাসের ছাত্রদের কাছে সমান মূল্যবান নয় । তসলিমা তো শুধু সাহিত্যিক নন - তাঁর খোদ জীবনই ভারত-বাংলাদেশের সমাজ ও রাজনীতির একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় । এই বইতে তসলিমা নিজের পরিচিতদের কথা লেখার সময় কখনো কখনো পিছিয়ে এসে রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের চমত্কার বর্ণনা করেছেন । মৌলবাদের প্রসঙ্গে বাংলাদেশের রাজনীতির অকপট বিশ্লেষণের সঙ্গে ভারতের বিজেপি ও বামপন্থী দলগুলোর বা ভারতীয় বুদ্ধিজীবিদের প্রতিক্রিয়া একই বইতে সচরাচর পাওয়া যায় না । এই বই ভারত ও বাংলাদেশ দুই দেশের মানুষকেই উপমহাদেশের রাজনীতির একটা সমগ্র ছবি দেখতে সাহায্য করবে । তবে উপন্যাসের মত লেখা এই বইয়ে সন ও তারিখের উল্লেখ খুব কম । যেমন বইয়ের শুরু যে আশির দশকের মাঝামাঝি কোনো সময়ে, যখন তসলিমা একটা হাসপাতালে ডাক্তারি করছেন, এটা পরোক্ষভাবে বোঝার জন্য আমাকে বইয়ের জ্যাকেটে দেওয়া তথ্যের সাহায্য নিতে হয়েছে । কিন্তু সেটা '৮৬ সন কিনা এ বিষয়ে পুরোপুরি নিশ্চিত হতে পারিনি । গল্পের শেষ হয়েছে বোধহয় '৯৪ সালে । তসলিমার বাজেয়াপ্ত করা পাসপোর্ট সবে ফেরত এসেছে - কিন্তু তখনও দেশত্যাগ করতে হয়নি তাঁকে । সন ও তারিখের উল্লেখের উপর যদি পরবর্তী কোনো সংস্করণে একটু জোর দেওয়া যায় তাহলে যেসব পাঠক `দ্বিখণ্ডিত'র বিভিন্ন ঘটনার স্থান ও কাল নির্দিষ্ট করতে আগ্রহী তাদের সুবিধে হবে ।
তসলিমার কলমের পদচিহ্ন হল লম্বা এক একটা প্যারাগ্রাফ । হয়ত পাতার পর পাতা ধরে চলেছে । এত আগ্রহ, এত সনির্বন্ধতা নিয়ে, মনে যে ভাষায় চিন্তা আসে প্রায় সেই অ-সম্পাদিত ভাষায় লেখা এই বই পড়ে মনে হয় যে লেখার তোড়ে লেখক অনুচ্ছেদ শেষ করার ফুসরত পাননি । এরকম স্বতস্ফুর্ত লেখা কমই দেখা যায় । এক একটা বাক্য চার পাঁচটা কমা ডিঙিয়ে চলেছে তো চলেছেই - নি:শ্বাস ফুরোবার আগে দাঁড়ি নেই । ঘটনার রুদ্ধশ্বাস প্রবাহে মনে হয় যেন একটা যুদ্ধের বই পড়ছি । এবং বইটা তো সত্যিই এক অন্তহীন যুদ্ধের । তসলিমার খ্যাতি তাঁর যোগ্যতার তুলনায় অতিরিক্ত বলেন যাঁরা তাঁদের ভেবে দেখা উচিত যে ফতোয়া কুড়োবার পথ সাধ করে যাবার পথ নয় । অনেকগুলো দুর্ঘটনা ও দুর্ভোগের মধ্যে দিয়ে গিয়ে, তার অর্ধেক সহ্য করে এবং অর্ধেকের সঙ্গে সংগ্রাম করে তবে কোনো লেখক এরকম যশ বা অপযশের অধিকারী হন । তাঁর উপর মৌলবাদীদের রাজনৈতিক আক্রমণ যেমন হয়েছে তেমনই ঘরের লোকজনের অত্যাচার কিছু কম হয়নি । এম বি বি এস পাশ করা একটা প্রাপ্তবয়স্ক ডাক্তার মেয়েকে তার বাবা ও দাদা মারধোর করে চাকরি ছাড়িয়ে দেশের বাড়িতে নিয়ে গিয়ে বন্দী করে রাখতে কসুর করেনি । `লজ্জা' প্রকাশের পর তাঁর বাড়িতে গুণ্ডাদের আক্রমণের ঘটনা আরো ভয়াবহ । পদে পদে লাঙ্ছনা ও নির্যাতনের যে বর্ণনা এই বইতে আছে তার কিছু শুধু মেয়ে হয়ে জন্মানোর জন্যই হয়তো উপহার পাওয়া যায় - মেয়ে হয়ে জন্মানোটা কোনো বিরাট কীর্তি নয় - কিন্তু সেই দুর্ভাগ্য ও সহ্যশক্তি উপেক্ষার বস্তু নয়, তার সামনে দাঁড়িয়ে মানুষের মাথা নিচু হয়ে যায় । বাকি লাঙ্ছনাটা আসে প্রকাশ্যে ছাপার অক্ষরে এসবের প্রতিবাদের জন্য । এত যাকে সহ্য করতে হয়েছে তার অভিজ্ঞতাকে ফেলনা বলা যায় না । তার যশ ও অপযশ আর যাই হোক, যথেষ্ট মূল্য দিয়ে অর্জিত ।
অভিজ্ঞতার তিক্ততা `দ্বিখণ্ডিত'র কিছু কিছু জায়গায় যে একটা অভিমান আর আক্রমণের ভাব
নিয়ে এসেছে - আত্মজীবনীর এই খণ্ডগুলোতে তারও প্রয়োজন ছিল বলে আমার মনে হয় ।
একটা অধ্যায়ের নাম `মানবরূপী শয়তান' । সেটার নাম `পুরুষরূপী শয়তান'ও দেওয়া যেত ।
তাতে এক এক জায়গায় মনে হয় পুরুষ জাতটার উপর একেবারে ভরসা হারিয়ে ফেলেছেন
লেখক ।
"... পুরুষ এমনই এক জন্তু বিশেষ যে দাঁত নখ চোখের হিংস্রতা দিয়ে সে তার পুরুষত্ব জাহির করতে চায় । মনুষ্যত্ব, আমি সবসময়ই দেখেছি পুরুষের মধ্যে খুব কম । মনুষ্যত্বের সঙ্গে পুরুষত্বের বোধহয় চিরকালীন এক বিরোধ আছেই । ..."
আমাদের দেশের পরিপ্রেক্ষিতে কথাটা খুব মিথ্যে নয় । সে দেশে জোর যার মুলুক তার এবং পুরুষদের বদ হবার সুযোগ মেয়েদের চেয়ে অনেক বেশি । জলবায়ুর দোষ কিনা জানি না, কিন্তু অনেকেই সেই সুযোগের সদ্বব্যবহার করে । তসলিমার বইতে পুরুষ জাতের প্রতি যতটুকু আক্রোশ প্রকাশ পেয়েছে তা ঘটনার গুরুত্ব বিচার করে দেখলে বলতে হয় মোটের উপর অল্পই । এইসব ঘটনা ভয়ংকর না হাস্যকর সেটা বার বার বোঝা কঠিন - এটাই লেখকের বিরাট কৃতিত্ব । এক জায়গায় রয়েছে
"... এখন আর জীবনের ঝুঁকি নিয়ে খোলা রিক্সায় চড়তে হয় না । চড়ে অনেক ধেয়ে আসা লোকের তারস্বরে চিত্কার শুনেছি ।
ওই দেখ দেখ তসলিমা যায় ।
মাগীরে দেখ । মাগীরে দেখ ।
ওই ধর ধর ।
টাইন্যা নামা রিকসা থেইকা । ধোলাই দে ।
নাস্তিক যায় রে নাস্তিক যায় ।
ওই খানকি !
..."
এই চিত্কারগুলো যে কোনো মহিলার মুখ থেকে বেরোয়নি সে কথা লেখককে বলেও
দিতে হয়নি । এরকম কাপুরুষের মত আচরণ আমরা পুরুষদের কাছ থেকেই পেতে অভ্যস্ত ।
তা বলে পুরুষদের একেবারে খরচের খাতায় ফেলে দিয়েছেন লেখক তা নয় । বরং পুরুষদের
প্রতি একাধিকবার ভালোবাসা ও শ্রদ্ধার স্বীকারোক্তি আছে তাঁর । আমাদের
সমসাময়িক মেয়েদের মধ্যে যাঁরা নিজেদের অধিকারের প্রতি সচেতন তাঁদের সকলেরই মনে
হয়তো ভালোবাসা ও ঘৃণার দ্বৈত অনুভূতি রয়েছে পুরুষদের প্রতি । ভারত-বাংলাদেশের
পুরুষদের এই মূল্যায়ন সম্পূর্ণ ন্যায্য । তার মানে যে ব্যতিক্রমী পুরুষ নেই তা নয় । আমার পরিচিতদের মধ্যেই এমন বাঙালি ছেলে আছে যাদের মত গভীর ও সংবেদনশীল নারীবাদী মেয়েদের মধ্যেও খুঁজে পাওয়া যাবে না । (তাদের নাম প্রকাশ করার ইচ্ছে থাকলেও পরবাস সম্পাদকের অনুমতির অভাবে করা গেল না) । তসলিমার সমালোচনাও যে শুধু পুরুষদের তা নয় । বাংলাদেশের
সবচেয়ে বড় নারী সংগঠন মহিলা পরিষদের নেত্রী মালেকা বেগমকে কেন্দ্র করে যে
ঘটনার বর্ণনা আছে তাতে সাংগঠনিক নারীবাদের অকল্পনীয় রাজনৈতিক যাথার্থ্যের অভাব
দেখে আমি হতবাক হয়েছি । মুনির বলে একটা লোক তার স্ত্রীকে খুন করায় মহিলা
পরিষদ মুনিরের সঙ্গে খুকু বলে একটা মেয়েরও ফাঁসির দাবি করেছিল । খুকুর কী
অপরাধ ? না তার সঙ্গে মুনিরের সম্পর্ক ছিল । মহিলা পরিষদের মত আলোকপ্রাপ্ত সংগঠনও যদি এভাবে উদোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে চাপায়
তাহলে মৌলবাদীদের বর্বরতার আর কী দোষ ? তাহলে তো খুকুর বাবা-মা-কে বা তার
স্কুলের হেডমাস্টারকে এই বলে মারধোরের হুকুম দেওয়া উচিত যে তাদের শিক্ষাও
পরোক্ষভাবে খুকুর পদস্খলনের জন্য দায়ী । শুনতে যতটা অবাস্তব লাগছে আসলে আদপে তা
নয় - ভারত পাকিস্তানের গ্রামগুলোতে স্থানীয় মুরুব্বিরা এরকম হাতে হাতে বিচার
আকছার করে দিচ্ছে ! এই মহিলা পরিষদের নেত্রী শেষ পর্যন্ত `দ্বিখণ্ডিত'র লেখককে
জানান
"...
`তিরিশ বছর ধরে নারী আন্দোলন করছি, আর দেশে বিদেশে নারীবাদী হিসেবে নাম হয়
তোমার !'
..."
তারপর জানান যে মহিলা পরিষদে যোগ দিলে লেখকককে তাঁরা সমর্থন করতে পারেন -
নয়ত নয় ।
"...
`সংগঠনে ? মহিলা পরিষদের সদস্য হতে বলছেন ?'
`হ্যাঁ ।'
আমি হাঁ হয়ে থাকি কিছুক্ষণ ।
`মালেকা আপা, আমি মহিলা পরিষদে যোগ না দিলে বুঝি আমাকে যে ফতোয়া দেওয়া
হল, এই যে আমার বিরুদ্ধে মোল্লারা আন্দোলন করছে, এর প্রতিবাদ করতে পারেন না !'
..."
এই ধরণের একই সঙ্গে ভয়ংকর ও হাস্যকর ঘটনা একটার পর একটা আসতে থাকে তসলিমার
এই অদ্বিতীয় নারীবাদী বইয়ে । একটা ভয়াবহ মৌলবাদী ছাত্রদলের নাম বেরিয়ে যায়
`তসলিমা নাসরিন পেষণ কমিটি' । লেখককে ঢাকার বইমেলায় বিবস্ত্র করে পিষে মারবে
বলে তাদের এই নাম । এরকম অসুস্থ ও বিদঘুটে হাস্যরস ভালো গল্পকারদের কল্পনাতেও
আসে না । `মুণ্ডু চাই' হাঁকের মধ্যেও একটা করুণ হাস্যরস দেখাতে পেরেছেন তসলিমা ।
যেমন এক জায়গায় আছে ।
"...
দ্বিতীয় অভিযোগটি হল আমি `র'-এর এজেন্ট । গুজবের মত সংক্রামক আর কিছু নেই
বোধহয় । `ইনকিলাব' আজ লিখল আমি `র' এর এজেন্ট, পরদিন দশটি পত্রিকায় লিখে
ফেলে আমি `র' এর এজেন্ট ।
``র' কি ?' এই প্রশ্নটি মনে উঁকি দেয় । মিলনের কাছে জিজ্ঞেস করি, `মিলন `র' কি
?' মিলন বলে, `বুবু আপনে `র' মানে কি বুঝেন না ! `র' তো হইল .. '
``র' তো হইল কি ?'
`মানে ধরেন `র' চা । দুধ না মিশাইয়া চা বানাইলে বলে না আমরা বলি `র' চা । ধরেন
আমগর কোম্পানিতে `র' মাল আমদানি করে, পরে এই `র' মালগুলা দিয়া প্রসেস কইরা
কেমিকেল প্রডাক্ট বানানি হয় ।'
`কিন্তু `র' এর এজেন্ট মানে কি ?'
`মনে হয় বিদেশ থেইকা `র' মাল টাল আনার এজেন্ট ।'
`কিন্তু আমি তো কোনও মাল আনার এজেন্ট না !'
`লেখেছে আর কী ! আজাইরা আপনেরে নিয়া কত কথাই লেকতাছে ওরা ।'
`কিন্তু মিলন `র' এর এজেন্ট বইলা আমারে গালি দিব কেন ? মানুষ তো বিদেশী কত
জিনিস পত্র আনে, তারা ত গালি খায় না !'
`দিছে আপনেরে গালি । মনে করছে নিষিদ্ধ কোনও `র' মাল আনেন ।'
`নিষিদ্ধ মাল ?'
`এইটা বুঝেন না বুবু ।' মিলন বিজ্ঞের মত মাথা নাড়ে । `বাংলাদেশে কি বিদেশের সব
`র' মাল আসা লিগাল নাকি ? কিছু ত নিষিদ্ধ মাল আছেই !'
`যেমন ?'
`ধরেন ফেনসিডিল, কাশির ওষুধ । ফেনসিডিল খাইয়া পুলাপান নেশা করে । ইণ্ডিয়া
থেইকা ফেনসিডিল আনে চুরাকারবারিরা । এহন যদি আপনি ফেনসিডিল আনেন, তাইলে
কি তা নিষিদ্ধ না ?'
`কিন্তু ফেনসিডিল তো কোনও `র' জিনিস না । ওষুধ । বোতলের ওষুধ ।'
..."
বাঙাল ভাষার ব্যবহারের জন্য এসব সংলাপ আমার কানে আরো মজার মনে হয় । এরকম
আরো কিছু অংশ আছে শুধু `দ্বিখণ্ডিত'-তে নয় `আমার মেয়েবেলা'র আগের খণ্ডগুলোতেও ।
এইখানে তসলিমা তাঁর বিরোধীদের ছাড়িয়ে উপরে উঠে যান । তসলিমা গুরুতর বিষয়ের
বর্ণনা যখন এরকম লঘুভাবে করেন তখন তার অভিঘাত হয় আরো বেশি ।
এই বইতে সাহিত্যিক অপকর্ষ কি কিছু নেই ? অসংখ্য আছে । বাক্য গঠন কোথাও
কোথাও ঠিক নয় । কোথাও পুনরাবৃত্তি । আরো অনেক দোষ খুঁজলে পাওয়া যাবে
নিশ্চয়ই । কিন্তু ভালো লেখার গুণ হল যে দোষগুলো গৌণ - আরেকবার ভালো করে সম্পাদনা করলে এসব সহজেই ঠিক করে
দেওয়া সম্ভব । উপন্যাস বা আত্মজীবনীতে যা প্রধান - একটানা গল্পের প্রবাহ যা থেকে
চোখ সরানো হবে দু:সাধ্য - তা তসলিমা এই বইতে আনতে পেরেছেন । এছাড়া রয়েছে
প্রতিবাদের একমুখী যাত্রা । এই উদ্দেশ্য এবং একাগ্রতা অন্য বইয়ের থেকে এই বইকে
আলাদা করে ।
তসলিমার লেখার সবচেয়ে বড় গুণ হল তাঁর সাহস । নির্ভীক হওয়া যদি পৌরুষের লক্ষণ হত
তাহলে হয়ত বলা যেত তসলিমাই জীবিত বাঙালিদের মধ্যে একমাত্র পুরুষ ।
ঈশ্বর-আল্লা-ভগবান ইত্যাদির ভয়ে যুক্তি ও বিশ্লেষণের পথ সবসময় ধরে রাখতে পারে না
পৃথিবীর পনেরো আনা মানুষ । বাঙালিদের মধ্যে বাকি এক আনাও প্রহারের ভয়ে নিজের
বিশ্বাসগুলো জোর গলায় বলতে অক্ষম । আমি তো নিজেই তসলিমা যা বলেছেন তার কিছু
কিছু বিশ্বাস করলেও ছাপার অক্ষরে বলতে ভয় পাই, যে কারণে এ বইয়ের রাজনৈতিক
বিষয়গুলো নিয়ে মন খুলে আলোচনা করা আমার সাধ্যের বাইরে ।
অনেকে আমাকে বলেছেন যে চুমু-খেয়ে-বলে-দেওয়া আত্মজীবনীর একটা ঘোরতর অপরাধ
কারণ তাতে যদি কারো মানহানি হয় তাহলে আদালতে যাওয়া ছাড়া তাঁর আত্মপক্ষ
সমর্থন করার উপায় থাকে না । বা আদালতে যাওয়া এমনিতেই ব্যয়সাপেক্ষ একটা শাস্তি
হয়ে দাঁড়ায় । বা সে ব্যয় বহন করলেও পুরোপুরি কলঙ্ক ঘোচে না । বা সবচেয়ে বড়
কথা - এসব কথা আত্মজীবনীতে লিখলে একধরনের বিশ্বাসঘাতকতা হয় । এইসব অভিযোগের
কিছু উত্তর তসলিমা নিজেই দিয়েছেন আনন্দবাজারে । লেখাটা তাঁর ওয়েব-সাইটে রয়েছে
এবং তসলিমার পাঠকদের কাছে অবশ্যপাঠ্য । এ বিষয়ে আমি যা বলতাম তসলিমা নিজেই
অত্যন্ত পরিষ্কারভাবে বলেছেন । মোদ্দা কথা এই যে পুরুষদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হবার বা ঘনিষ্ঠতা
এড়াবার যে গল্পগুলো তসলিমা বলেছেন সেগুলো হয় প্রতিবাদের গল্প - যে ক্ষেত্রে
বিশ্বাসঘাতকতার প্রশ্নই অবান্তর, অথবা তার মধ্যে অন্য কারো সম্মানহানির কারণ
তসলিমা দেখতে পাননি । `দ্বিখণ্ডিত'কে কেন্দ্র করে যে দুটো মানহানির মামলা ঝুলছে
তা তসলিমার বিরুদ্ধে গেলে বইটাতে কিছু রদল বদল করতে হতে পারে । তাতে এই বইয়ের
মূল্য কমবে বলে আমার মনে হয় না - কেননা আপত্তিকর অংশগুলো এই বইয়ের এক শতাংশও
নয় । গুজবের উপর বিশ্বাস করে যাঁরা ভেবে নিয়েছেন যে বইটা আগাগোড়া বাংলার পুরুষ
সাহিত্যিকদের সরস যৌন বিকারের গল্পে বোঝাই তাঁরা এক্ষুনি সে ভুল ধারণা ত্যাগ
করুন নইলে আমার মত নিরাশ হবেন । যে দুটো মামলা রয়েছে তার একটার ক্ষেত্রে আপত্তির
কারণ কোনো যৌন বিকৃতি হতে পারে না - হয় যৌন সংসর্গেই বাদীর মানহানি হয়েছে
অথবা বাদী আনন্দবাজার পত্রিকার সমালোচনা করেছেন বলাতে তাঁর মানহানি হয়েছে ।
দ্বিতীয়টার ক্ষেত্রে বাদী স্বনামধন্য কবি সৈয়দ শামসুল হক । ঘটনা বিশেষ কিছু ঘটেনি
- মানহানির ভিত্তি বোধহয় কবির চরিত্র বিষয়ে তসলিমার সন্দেহপ্রকাশ । বইতে যা বলা
আছে তা পড়ে মনে হয় তসলিমার সন্দেহ অমূলকও হতে পারে । বইয়ের এই অংশে কবির
চরিত্রের চেয়ে তসলিমার যুক্তিই হয়ত বেশি দুর্বল । তসলিমার অভিযোগগুলো সত্যি হতে পারে
- কিন্তু পাঠকের জুরির কাছে তা গ্রাহ্য হওয়ার মত যথেষ্ট প্রমাণ দাখিল করা হয়নি ।
`আমার মেয়েবেলা'র আরো খণ্ড বেরোবে । ধারবাহিকভাবে দীর্ঘদীন চলুক । মৈমনসিংহ
থেকে শুরু করে মেডিক্যাল কলেজ হয়ে দেশ ত্যাগ করতে বাধ্য হওয়ার এই অনন্য গল্প কটা
লোক শোনাতে পারে ? নানারকম বিতর্কের ঝড় তসলিমার জীবনকে করেছে বিচিত্র এবং
ঘটনাবহুল । ভবিষ্যতে যাঁরা তসলিমার সংস্পর্শে আসবেন তাঁরা কি `আমার মেয়েবেলা'র
পরের খণ্ডে তসলিমা তাঁদের কী ছবি আঁকবেন এই ভেবে ভয়ে ভয়ে থাকবেন ? এই প্রশ্নের
প্রধান উত্তর - ইউ বেট । কিন্তু আমি অপেক্ষা করে আছি সেই দিনের জন্য - এবং তসলিমার
বিরুদ্ধে যাঁরা মামলা করেছেন তাঁদের বিন্দুমাত্র অশ্রদ্ধা বা অসম্মান করে বলছি না এ
কথা - তাঁদের বা তসলিমাকে আমি ব্যক্তিগতভাবে চিনি না - তসলিমা যা লিখেছেন তার
কিছুই প্রমাণ ছাড়া অভ্রান্ত সত্য বা সর্বৈব মিথ্যে বলে সত্যিই মানি না । কিন্তু আমি
অপেক্ষা করে আছি সেই দিনের জন্য যেদিন কোনো স্বনামধন্য বাঙালি পুরুষ বা
সাহিত্যিকের সঙ্গে একটা মেয়ের দৈহিক মিলন হবে, মেয়েটা সে সব গল্প তার
আত্মজীবনীতে লিখবে, এবং পুরুষ তাতে কোনো লজ্জা বা অপমান বোধ করবেন না । বা
যদি কোনো দুর্বল মুহূর্তে তিনি নিজের ক্ষমতার অপপ্রয়োগ করে থাকেন তো সেটা
প্রকাশ হয়ে গেলে তিনি সবল হয়ে সেই শাস্তি চুপচাপ মেনে নেবেন । আমি এরকম - এবং
আরো নির্ভীক - একজন পুরুষ বাঙালি তারকা দেখতে চাই । কেননা তসলিমাই বাংলার
একমাত্র পুরুষ যদি হন তাহলে তার অবিলম্বে একটা বিহিত দরকার ।