• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৩২ | জানুয়ারি ২০০৪ | ভ্রমণকাহিনি, প্রকৃতি, বাকিসব
    Share
  • সিংকা পেরিয়ে কিন্নরে : অমরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী

    ॥ ৩ ॥


    ভিলেজ সার্ভে ওয়ার্কসের খুঁটিনাটি নানা পর্বের প্রস্তুতি গুটিয়ে তুলতে না পারার জন্যে পরের দিন গ্রামে ঢুকতে একটু বেলা হয়ে গিয়েছিল । যদিও ঘুম ভেঙেছিল সাতসক্কালে । চা-পর্ব মিটিয়ে সুধাংশু, রবীন আর আমি কাগজপত্র, নানা ফরমের বাণ্ডিল নিয়ে গ্রামের পথে পাড়ি দিয়েছিলাম । কুন্দন সিং-এর পিঠে চাপিয়ে দিয়েছিলাম ওষুধের বাক্স । জয়দীপ অনেক আগেই এসে হাজির । তাকে নিয়েই পাড়ার মধ্যে ঢুকি ।

    পঁয়ত্রিশ-ছত্রিশ পরিবার নিয়ে নীচলা-পাঁও গ্রাম । এবড়ো-খেবড়ো পথ । ঘিঞ্জি সব বাড়িঘর । গায়ের ওপর গা । পিঠোপিঠি । বেশিরভাগ বাড়ি কাঠের তৈরি । পাথরের বাড়িও কিছু পড়লো চোখে । বাড়ির মধ্যে উঠোনে ছাগল ভেড়ার খোঁয়াড় । মুরগীর জাল-ঘেরা খাঁচাও কিছু কিছু দেখলাম । পশুদের মলমূত্রে একাকার হয়ে আছে বাড়িঘর । নোংরা, অপরিষ্কার । দুর্গন্ধে টেঁকা দায় । অজস্র মাছি ভন ভন করছে ।

    গতকাল রাতেই রটে গিয়েছিল যে সকলকে ওষুধ দেওয়া হবে । জয়দীপ জানিয়ে দিয়েছিল । তারপর এ-কান সে-কান হয়ে গাঁ ময় । মানুষের ঢল নেমেছিল পাড়ার গ্রামপ্রধানের বাড়ির চৌহদ্দি জুড়ে । বুড়ো-বুড়ি, তরুণ-তরুণী, কচি-কাঁচা শিশুদের ভিড় । পুরুষের চেয়ে মহিলাদের ভিড়ই বেশি । কোলে-কাঁকালে, পিঠে-বাঁধা শিশু নিয়ে মেয়েদের উপস্থিতি দেখবার মতো । রঙিন জোব্বা, শালোয়ার কামিজ পরা একটু বিত্তবান, বড়ঘরের মেয়েরাও এসেছে ।


    নিচলাপাঁও গ্রামের মানুষদের ওষুধ বিতরণ পর্ব
    সুধাংশুর তত্পরতায় জিজ্ঞাসাবাদ পর্ব শুরু হল । পরিবারের কর্তাব্যক্তিকেই মূলত প্রশ্নোত্তর পর্বের মধ্যে আনা হচ্ছিল । গ্রাম নিরীক্ষাকরণ (Local village Survey Proforma ) ও পরিবারগত/ব্যক্তিগত নিরীক্ষাকরণ (Family Unit Proforma) কাজের এই দুটি ছক, যেমন গ্রামের নাম, জেলার নাম, থানা, তহশিল, ডাকঘর, পেশা, ধর্ম, ভাষা ইত্যাদি নিয়ে গ্রাম নিরীক্ষাকরণ আর নাম, বয়স, জাতি, শিক্ষা, পেশা, আয়, পোশাক, অলংকার, আহার্য, আসক্তি, অভ্যাস, আয়ের উত্স, বিবাহিত/অবিবাহিত, শিশুর সংখ্যা, সম্পত্তি, পশুর সংখ্যা, পরিবারের সংখ্যা, উপার্জনকারীর নাম, দায়বদ্ধতা, ফ্যামিলি প্ল্যানিং ইত্যাদি নিয়ে ব্যক্তিগত/পরিবারগত নিরীক্ষাকরণের ক্ষেত্রে ছাপানো প্রোফর্মা পুরণের কাজের দায়িত্বে আমি ছিলাম । জয়দীপ সবদিক থেকে আমাদের খুবই সাহায্য করেছিল ।

    সুধাংশুর যে এতবড় অভিজ্ঞতা আছে আমার জানা ছিল না । সে খুবই বিচক্ষণতার সঙ্গে অসুস্থ পাহাড়ি মানুষজনের পরীক্ষা নিরীক্ষা শুরু করেছিল । মোটামুটি তাদের অসুস্থতা কষ্ট কী, এইসব জেনে ওষুধ নির্বাচন করে লিখে প্রেসক্রিপসন তৈরি করে দিচ্ছিল । রবীন ওষুধ দেখে অসুস্থ মানুষজনের হাতে তুলে দিচ্ছিল । খুব ভাল লাগছিল আমাদের । রোগজর্জর, শীর্ণ, ক্লান্ত মুখে এতটুকু হাসি ফোটাবার এ-প্রয়াস কতটুকু তাদের উপকারে আসবে জানি না কিন্তু সামান্য এই ওষুধটুকু পেয়ে তারা যে দু'টো দিন শান্তি ও নিশ্চিন্তে থাকবে সেটা অস্বীকার করার উপায় নেই । রোগে এক ফোঁটা ওষুধ এদের জোটে না । ডাক্তার, কবিরাজ, হেকিম বলতে এখানে কিছুই নেই । রোগ ভোগ করে করে অনেকে এরা সর্বশান্ত নি:শেষ হয়ে যাচ্ছে । বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বুকের, ফুসফুস-জনিত অসুস্থতা আর পেটের গণ্ডগোল । সর্দি, কাশি, জ্বর, উদরাময় এদের নিত্য সহচর । শুদ্ধ পানীয় জলের অভাব, পুষ্টির অভাব । পুষ্টির অভাবে বহু শিশুমৃত্যু এখানে ঘটে । কিন্তু সন্তান জন্মের হার কমে না । এমন বহু পরিবার দেখলাম - তাদের শিশুর সংখ্যা মাত্রাতিরিক্ত । মায়ের স্বাস্থ্যের দিকে চাওয়া যায় না । রক্তাল্পতায় ভুগছে সবাই । বহু পরিশ্রম জনিত কাজ আর ক্ষুধায় অল্পাহার, অনাহার ও পুষ্টির অভাবে ফুসফুসের রোগ বেশিরভাগ ক্ষেত্রে পুরুষ ও রমণীদের । বহু স্বামীর স্ত্রী ও বহু শিশুর জননী হওয়ায় আক্ষরিক অর্থে এদের কাছে পরপারের ডাক আসতে খুব বেশি দেরি হয় না । সেদিন জয়দীপ আমাদের সঙ্গে করে এরপর সব পরিবারের বাড়িতে নিয়ে গিয়েছিলেন । সুধাংশুর কর্মকুশলতা ও ধৈর্যে আমাদের গ্রাম-নিরীক্ষাপর্ব মোটামুটি বেশ ভালই হয়েছিল । নিরীক্ষাকরণের প্রোফর্মার ছকগুলো পূর্ণ করে আমিও আমার দায়িত্ব সম্পূর্ণ করেছিলাম । ওষুধপত্রের ঝুলি খালি করে দিয়েছিল রবীন ও কুন্দন সিং । কুন্দন এ-ব্যাপারে বেজায় খুশি । সে বলেছিল, "বাঙালি বাবুদের সঙ্গে বহু দলে বহু জায়গায় ঘোরাঘুরি করেছি, কিন্তু এমনটি কোথাও দেখিনি । বাবুজী, বয়স আমারও বড় কম হল না ।"

    নীচলা-পাঁও গ্রামের বিভিন্ন পরিবার বর্গের বাড়ি ঘুরে সেদিন ফিরতে বেশ বেলা হয়েছিল । জয়দীপের আন্তরিক সহায়তায় কাজটা খুব সহজ ও সুন্দরভাবে শেষ হয়েছিল । ফেরার পথে তাকে জড়িয়ে ধরে অসংখ্য ধন্যবাদ জানাই আমি ও সুধাংশু । শিক্ষার লেশমাত্র আলো যেখানে প্রবেশ করেনি সেখানে এমন একজন শিক্ষিত, সংস্কৃতিশীল যুবকের এমন মার্জিত আচরণ ও সামাজিকতার কথা ভাবাই যায় না । হতদরিদ্র গ্রামের মানুষদের এই হাল, এই দুর্গতি না দেখলে বাইরে থেকে কিছুই অনুভব করা যায় না । পঞ্চায়েত রাজের কল্যাণধর্মী কাজের স্পর্শ এতটুকু যে পড়েনি গ্রামে সেটা বেশ বোঝা যায় গ্রামের ভেতরে প্রবেশ করলে । গ্রামের মানুষের সঙ্গে মিলেমিশে কথা কইলে । তারা কী বলতে চায় তা শুনলে । <Þ> মূর্তিরাম আমাদের তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে বেরিয়ে পড়তে বলে । দু'জন পোর্টারকে এখানে রেখে দিয়ে তরুণ সকলকে নিয়ে পথে নেমে পড়লো । উদ্দেশ্য আর কিছু নয়, খানিকটা এগিয়ে থাকা । এমনিতে বার হতে কিছুটা বেলা তো হয়েছেই ।

    বাইরে পড়ে থাকা জয়দীপের কাঠের ঘরের মালপত্র কুলিকে দিয়ে যথারীতি তুলিয়ে রেখে গেছে তরুণ । মনে মনে তার প্রশংসা না করে পারেনি রবীন, এটা আমি বেশ অনুভব করেছি তার চোখ মুখ দেখেই । শুধু তার মুখ থেকে একটা কথাই শুনেছি, "তরুণদাকে সত্যিই তারিফ করতে হয় ।" গতকাল রাতে রবীন ঘর থেকে বহু মালপত্র বার করে সেটাকে বাসের যোগ্য করে তুলেছিল ।

    আমাদের খাবার তৈরি ছিল । খাওয়ার পাট চুকিয়ে নিয়ে আমরাও বেরিয়ে পড়ি । ঝকঝকে রোদে রাস্তা ভেসে যাচ্ছিল । পথ ত্রক্রমশই নেমে যাচ্ছে গ্রামের মধ্যে । গ্রাম ছাড়তেই পথ আবার চড়াইয়ের মুখ নিল । পথের ধারেই পাহাড়ের ঢাল । তার গা বেয়ে এঁকে বেঁকে পথ উঠে গেছে পাহাড়ের মাথায় । কুন্দন সিং বলে ওঠে, "বাবুজী, এই পথ উঁচলা-পাঁও গাঁয়ে গিয়ে মিশেছে ।" চেয়ে দেখি ফিতের মতো পথ ওপরে উঠে গেছে । মানুষ চলে কী করে নিত্য এপথে, শীতে ও বর্ষায় ভেবেই পাই না । বিশেষ করে শিশু, মহিলা, পশুর পাল । চলতে চলতে কুন্দন আবার বলে ওঠে, "উঁচলা-পাঁও গাঁয়ের হাল আরও খারাপ বাবুজী ।" শুধুই খেতিবাগান আর চাষবাস । জলের অভাব । ঝরনার জলের উপর নির্ভর করতে হয় । ফসল ভাল হয় না । তাই ওদের কষ্ট আরও বেশি ।" বুঝতে অসুবিধা হয় না । কৃষিনির্ভর দেশ এখানের । ফসলের ফলন না হলে এরা বাঁচবে না । এই ফসল সারা বছর খায়, বিক্রি করে দু'টো পয়সা সঞ্চয় করে । তাতেই তাদের সংসার, সামাজিকতা, পুজো, পার্বণ, উত্সব আনন্দ সব কিছুই চলে ।

    এগোতে থাকি । পাহাড়ের ঢালে ঢালে সব জায়গায় ঝুম চাষ । সোয়াবিন, মাড়ুয়া, রামদানা, শশা, কুমড়ো, লাউ, ভুট্টা । দূরে পাহাড়ের মাথায় দু'একখানা ঘর চোখে পড়ে । কুন্দন সিং আঙুল তুলে বলে ওঠে, "সুনকুড়ি গ্রাম দেখা যাচ্ছে বাবুজী ।" নীচলা-পাঁও গ্রাম থেকে মাত্র ৩ কি. মি. । ছ'হাজার ফুট মাথার ওপর । সারা গ্রামখানা একেবারে সবুজে ডোবা । সরু লিকলিকে পথ পাহাড়ের গা বেয়ে ওপরে উঠে গেছে । এসব অঞ্চলে পাহাড়ের মাথায় বা ঢালে গ্রামবসতির কারণ হল একমাত্র জলের মুখ চেয়ে । যেখানে ঝরনার ধারা বা উত্স আছে সেখানে লোকবসতি বা গ্রাম গড়ে ওঠে । জলের জোগানের ওপর কৃষির নির্ভরতা বা সাফল্য । পাহাড়ের গায়ে টুকরো টুকরো জমিতে লাঙ্গল দিচ্ছে কেউ । মেয়েরা ঝুড়ি ভর্তি করে সার ফেলে যাচ্ছে কোথাও । সারাদিনের কাজকর্মের দিনলিপি এটাই ।

    পাহাড়ের কোল ধরে এবড়ো খেবড়ো পথ । বর্ষার জলে কোথাও কোথাও সেটুকুও প্রায় নিশ্চিহ্ন । বর্ষার মুখে ঝোপঝাড়, গাছ-গাছালি যেন উদ্ধত, দুর্বিনীত । রাস্তার ওপর এসে ঝাঁপিয়ে পড়েছে । পথের ধারে খুব পুরনো এক বটগাছ । জীর্ণ, শীর্ণ বয়সের ভারে । তার তলায় এসে দাঁড়াই । দু'মিনিট থাকি । আবার চলা শুরু করি । রবীন ও সুধাংশু এগিয়ে গেছে । আমি আর কুন্দন । কুন্দনের পিঠে আমার রুকস্যাক ।

    জাকোল গ্রামের কাছে এসে পৌঁছেছি । কুন্দন বলে, "বেশ নামকরা গ্রাম বাবুজী এ পথের । কী নেই বলুন, দোকান আছে, বাজার আছে, ডাকঘর আছে, স্কুল আছে । মন্দির আছে গাঁয়ের মাঝখানে । পুজো হয়, মেলা বসে । সেই সময় খাইখাওয়া লোক কুটম্বুতে ঘরদোর বোঝাই হয়ে যায় । গাঁয়ের মানুষের অবস্থা বেশ ভাল, সচ্ছল ।"

    পথ ছেড়ে একটু ওপরে গ্রামের চৌহদ্দি । অনেক বাড়িঘর চোখে পড়লো । সুনকুড়ি থেকে ৬ কি. মি. পথ জাকোলের । গ্রামের বাইরে পাহাড়ের ধস-নামা অঞ্চল বেশ খানিকটা । নুড়িনাড়া, পাথর ছড়ানো । ভিজে ভিজে জায়গাটা । জলের অনেকগুলো ক্ষীণ ধারা ওপর থেকে নেমে এসেছে, এদিক সেদিক দিয়ে লুকিয়ে চুরিয়ে ।

    তরুণের দলবল, কুলিরা কোথায় এখন ঠিক বুঝতে পারছিলাম না । আমাদের জন্যে হয়ত কোথাও অপেক্ষা করছে ।

    একরাশ পাথরের টুকরোর ওপর দিয়ে পা-ভেজান ঝরনার জল বয়ে যাচ্ছিল ঝিরঝির করে । জুতো খুলতেই হল । প্যান্টের তলা গুটিয়ে নিয়ে জুতো হাতে করে ঝরনা পার হই । ঠাণ্ডা কনকনে জল । চোখে মুখে জল একটু দিই । পরম তৃপ্তি !

    সড়ক ছেড়ে নেমে আসা সরু পথ আবার উঠে গেছে ঝরনার মাথায় মস্ত এক কংক্রীটের ব্রিজের ওপর । ব্রিজের ওপর আসি । বেশ চওড়া ব্রিজ । ডানদিকে চোখ ফেরাতেই নজর আসে আর একটা ঝরনার ধারা ডান দিকের পাহাড় থেকে নেমে এসেছে নিচে । ধারা দুটি ওখানে মিলে মিশে একাকার হয়ে আরও নিচে নেমে গেছে, কোথায় কে জানে ? বর্ষায় ঝরনা যে এখানে সংহারিণী মূর্তি ধরে তা বেশ বুঝতে পারলাম ব্রিজের একদিকের থামের অবস্থা দেখে । থাম ফেটে চৌচির, আরো কয়েক জায়গায় বেশ ফাটল ধরেছে দেখলাম । অবস্থা যে কাহিল বুঝতে অসুবিধা হয় না । এপারের গ্রামের সঙ্গে ঐ ব্রিজই যোগাযোগের মেলবন্ধন ঘটিয়েছে । কতদিন এ বন্ধন থাকবে কে জানে ?


    জাকোল গ্রাম ফেলে ধারা গ্রামের পথ বেয়ে ওঠা
    ব্রিজের এ পারে `ধারা' গ্রাম শুরু । জাকোল থেকে মাত্র ২ কি. মি. দূরে । গ্রামের উচ্চতা সমুদ্রতল থেকে মাত্র ৬,৪০০ ফুট । পাহাড়ের মাথা বেশ সমতল মতো করে সেখানেই গ্রামের পত্তন হয়েছে । সমতল অংশটুকু জুড়ে ঘরবাড়ি, দোকান সব কিছুই । গ্রামের মাঝখানে বেশ খানিকটা জায়গা জুড়ে সোমেশ্বর শিবের কাঠের মন্দির । মাথায় টিনের চালা । কাঠের দেওয়ালের গায়ে দক্ষ মিস্ত্রির হাতের নিপুণ নকসার কাজ । জোড়া মকর, জোড়া মীন, জোড়া সাপ, ময়ূরের নিখুঁত খোদাইয়ের কাজ । প্রবেশদ্বারে গোলাকার সূর্যের নক্সা । রঙিন কাপড়ের ঝালর কুঁচি দেওয়া কাঠের ফ্রেমের মাথায় । ঘরের এক কোণে কাঠের চৌকির ওপর মস্ত এক দামামা । পাথরের শিবমূর্তির সামনে অসংখ্য ত্রিশূল, রঙিন সূতো, শুকনো ফুলপাতা, পোড়া ধূপের কাঠি ছড়ানো ।

    মন্দিরের সামনে ফাঁকা জায়গায় টিনের একটা আটচালা ঘর । লম্বা চওড়ায় ত্রিশফুটের মতো হবে । আমাদের গ্রামে যেমন আটচালা বা চণ্ডীমণ্ডপ আছে এদেরও গ্রামে আছে তেমনই এক আটচালা ঘর । একে এরা বলে "তেবারী"। আমাদের গ্রাম্য চণ্ডীমণ্ডপের মতন এখানেও প্রবীণ, পরিণত অধিবাসীরা আসেন, বসে গল্পসল্প করেন এবং সেইসঙ্গে গ্রামের মানুষজনের নানা সমস্যার বিচার, বিশ্লেষণ ও মীমাংসা করে থাকেন ।

    সুন্দর পরিষ্কার, পরিচ্ছন্ন আটচালা । মোটা মোটা গোলাকার কাঠের খুঁটির রেলিং দিয়ে চারদিক ঘেরা । সামনে আটচালায় ঢোকবার বেশ খোলামেলা পথ ।

    তরুণের দলবল, মূর্তিরাম ও কুলিদের সঙ্গে ওখানেই দেখা হল । ওরা এই তেবারীতে বসে আমাদের জন্যে অপেক্ষা করছিল । আজকের `পাড়াও' সামনে ফতারি গ্রামে শেষ করার ইচ্ছে ছিল মূর্তিরামের ; সেরকমই মনে হল । কেননা সে আর একদম দেরি করতে চাইছিল না । বেলা এখনও ভালই আছে । কুলিদের সে উঠিয়ে দিল । তরুণ আর দ্বিরুক্তি করেনি । অবশ্য না করাই স্বাভাবিক । কেননা কর্তার ইচ্ছেয় তো কর্ম হয় ।

    ধারা গ্রামের মাথার ওপর দিয়ে পথ চলে গেছে । গ্রামের অবস্থান অনেকটা রিজের ওপর । মানে দু'পাশে ঢাল পাহাড়ের । মাথায় গ্রাম, পাহাড়ের সমতল অংশে । পাড়ার মধ্যে দিয়েই চলেছি । মানুষের বাড়িঘর, উঠোন, আনাচ-কানাচ মাড়িয়ে মাড়িয়ে । ছাগল-ভেড়ার খোঁয়াড়, জাল-ঘেরা মুরগীর খাঁচা প্রায়ই প্রতি বাড়িতে । গাধার চালাঘরও নজরে এল । মোটামুটি বেশ সমৃদ্ধ গ্রাম । আবার এখানে নতুন এক প্রকল্পের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে দেখে বেশ ভাল লাগলো । উদ্যোক্তা গ্রামপঞ্চায়েত সমিতি । সৌরশক্তিতে গ্রামে আলো জ্বালাবার ব্যবস্থা হয়েছে । লাইটপোস্ট রাস্তার ধারে ধারে । গ্রামে প্রাথমিক স্কুল ছাড়া উঁচু মানের স্কুল নেই । তাই ছাত্রদের পাশের গ্রাম জাকোলে গিয়ে পড়তে যেতে হয় । কষ্টের একশেষ শীতে, বর্ষায় । বাড়ির মেয়েরাই দেখলাম পুরুষের প্রায় সব দায়িত্বই পালন করছে । চাষবাস থেকে শুরু করে পশুপালন, ফসল সংরক্ষণ, সন্তান পালন, পরিচর্যা ছাড়াও সংসারের নানা খুঁটিনাটির সবটুকু । বাড়ির উঠোনে পাথর বসানো খামার । কারো বা গোবর নিকানো । ফসল ঝাড়ছে মেয়েরা, ক্ষেতিবাগান থেকে ফসল মাথায় করে আনছে মেয়েরা, কুলো দিয়ে ঝাড়াই বাছাই করছে মেয়েরা আবার শস্য পিষছে মেয়েরা । এছাড়া সন্ধ্যায় পালিত পশুদের নিত্য মাঠে ছেড়ে দিয়ে আসা, নিয়ে আসা । ঘাস পাতা কেটে সংগ্রহ করে আঁটি বেঁধে পিঠে ফেলে আনা, পশুদের খেতে দেওয়া, জল দেওয়া । একাধারে সব কাজেই মেয়েরা । অসম্ভব পরিশ্রমী । এছাড়া সংসারে গৃহস্থালি কাজকর্ম, রান্নাবান্না, সন্তানপালন, সন্তানধারণের কাজও তো আছে ।

    বেলা বাড়ছিল । রোদের বেশ উত্তাপ । গ্রামের শেষ সীমা একসময় ফেলে চলে আসি । গ্রামের মাথার পথ আমরা ধরিনি, ছেড়ে দিয়েছিলাম পথ সংক্ষেপ করার জন্যে । মূর্তিরামের নির্দেশেই নিচের পথ ধরি । কিন্তু এপথ পুরোপুরি জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে । কুন্দন সিং প্রথমে রাজি হয়নি এ-পথে আসতে, কিন্তু মূর্তিরাম ও অন্যান্য পোর্টারদের চাপে পড়ে সে আর কিছু বলেনি ।

    গ্রামের কিনারা ছাড়তেই শুরু হল জঙ্গল । প্রথম প্রথম কিছুই বুঝতে পারিনি কিন্তু যতই এগোতে থাকি ততই জঙ্গলের নিবিড়তা অনুভব করি । কী গাছ নেই এই জঙ্গলে ? চীর, পাইন, ওক, দেওদার, চিহর, কাচনার, ব্লু-পাইন, ট্রি-রোজ, সাইপ্রাস, স্ট্রবেরি, হর্স চেস্টনাট ছাড়া অজানা, অচেনা বহু জাতের গাছের হয়েছে সমাবেশ । আর জঙ্গলের মাথায়, গাছের গাংএয় উঠেছে অজস্র অজানা লতা । লাফিয়ে লাফিয়ে, পাকিয়ে পাকিয়ে উঠেছে সব । পাতার জালে, অজস্র ফুলের স্তবকে, মনে হচ্ছে যেন অরণ্যতোরণ তৈরি হয়ে আছে । কোথাও হয়ে আছে পাতার গম্বুজ, কোন অংশকে মনে হচ্ছে পাতার প্রাসাদের অলিন্দ । প্রকৃতির কোলে, প্রকৃতির নিজের হাতে গড়া অপরূপ অরণ্যমহল । শোভায় দুটি চোখ জুড়িয়ে যায় । প্রকৃতির এ নিভৃত অলংকরণের দর্শক বা সমজদার কারা হবে ভেবে পাই না । বনের ফুল রাশি রাশি নিত্য ফোটে আবার বনেই ঝরে যায় । দেখবার কেউ নেই, নেবার কেউ নেই, উপভোগ করার কেউ নেই ।

    এগিয়ে যাই সঙ্কীর্ণ বনপথের রেখা ধরে । কিন্তু এগোবো কী ? যাবো কোথায় ? গাছের ডালপালা, কাঁটা চারদিক থেকে ঘিরে ধরছে মুহূর্মুহু । পোশাক থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে নিজেকে মুক্ত করে দু'পা এগোলেই আবার আক্রান্ত হচ্ছি ঠিক সেই একইভাবে । বিমলবাবুর অবস্থা চোখে দেখা যায় না । কুন্দনকে বলি, "তুমি বিমলবাবুকে পথ চলতে একটু সাহায্য কর ।" কুন্দন বলে ওঠে, "গ্রামের মাথার পথ অনেক ভাল ছিল বাবুজী ; দেরি একটু হত কিন্তু এত কষ্ট হত না । এসব পথে আসতে হলে দা-কাটারির দরকার হয় ।" কুন্দনের কথাগুলো যে ধ্রুব সত্যি তা হাড়ে হাড়ে বুঝতে পারছি । -- "কী নেই এই জঙ্গলে বাবুজী, ভরল, হিরণ, চিতা, গিধ্ধাড়, তেন্দুরা, লোমড়ি, বানর শুধু কী তাই ; বিষাক্ত সাপ, গিরগিটি, বিচ্চু - বাকি কিচ্ছু নেই ।" কুন্দন সিং বলতে বলতে এগিয়ে চলে বিমলবাবুর হাত ধরে । -- "পাখি নেই ?" বলে উঠি । "নেই আবার ! বহু পাখি আছে । পাখির রাজত্ব তো এই জঙ্গলে বাবুজী । জঙ্গলময়না, সোয়ালো, ঘুঘু, প্যাঁচা, ঈগল, শকুন, টিয়া, হিরামন, সোনাল, পিজন আরও কত কী ।" কুন্দনের কথাগুলো শুনতে খুব ভাল লাগছিল । কিন্তু ভয়ঙ্কর দুর্গম এই বনের ভয়াবহতা মনকে সবসময় আচ্ছন্ন করে রাখছিল । কেবলই মনে হচ্ছিল, কখন কী ঘটে !

    নিচের দিকে নেমে যাচ্ছিলাম ত্রক্রমশই ঢালু পথ ধরে । ঝোপঝাড়, আগাছায় পা কেবলই জড়িয়ে যাচ্ছিল । পথের এক জায়গায় নামতে হঠাৎ গভীর জলগর্জনের শব্দ কানে এল । সুপিনের কলমূর্চ্ছনা । পথ ত্রক্রমশই নেমে যাচ্ছে জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে । পথ এক সময় শেষ হল । সামনেই সুপিনের সংহারিণী মূর্তি ! মনে হল প্রবল জলোচ্ছ্বাসে সে নি:শেষ করে দিতে চায় সবই । পাথরের বিরাট বিরাট চাঙড়ের আগল ভাঙা জলস্রোত ভীমগর্জনে ভেঙে ভেঙে পড়ছিল । কলগর্জনে জায়গাটা সব সময় মুখর হয়ে থাকে ।

    সুপিনের বুকে লোহার সাসপেনশন ব্রিজ । দুপারকে বেঁধেছে শক্ত লোহার বাঁধনে । ব্রিজ সব সময়ই কাঁপছে থরথর করে ।

    একে একে সবাই ব্রিজ পার হয়ে আসি এপারে । ভয়, বিস্ময় মিলেমিশে যেন একাকার হয়ে গেছে । করালমূর্তি সুপিনের ভয়াল সে রূপের ছবি সুধাংশু অনেকগুলো তুলো রাখলো তার ক্যামেরায় ।

    বুক শুকিয়ে গেল এপারে এসে ! পথের চিহ্ন নেই কোনখানে ! সামনে উঠে গেছে খাড়াই পাহাড়ের দেওয়াল । পেছনে রুদ্রমূর্তি সুপিন । পথ কোন দিকে ? মূর্তিরামকে জিজ্ঞাসা করতে সে শুধু হাত তুলে দেখায় পাহাড়ের ঢালই হচ্ছে পথ । ও কি পথ ? সত্তর-পঁচাত্তর ডিগ্রি ঢালে খাড়াই ধস নেমে গেছে গভীর নিচে সুপিনের কোল বরাবর । পাথর গড়িয়ে গড়িয়ে পড়ছিল জলে । ওদিকে চাইতে পারি না । বুক কেঁপে ওঠে ! এই ঢাল ধরে ওপারে যাব কী করে ? চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকি ।

    পোর্টাররা মাল পিঠে তুলে নিয়ে সার দিয়ে একে একে সেই ধস ধরে চলে যাচ্ছে দেখলাম । বিমলবাবু মূর্তিরাম ও তরুণের হাত ধরে ধসের ওপর উঠেছে । পার্থ নীলাদ্রির হাত ধরে মূর্তিরামকে অনুসরণ করে চলেছে । মূর্তিরাম যেখানে পা ফেলে ফেলে যাচ্ছিল সুধাংশু, স্বপনও ঠিক সেখানেই পা ফেলে ফেলে এগোচ্ছিল । রাজাকে দেখছি না । তার কথা আলাদা । শুনলাম সে আগেই পোর্টারদের সঙ্গে চলে গেছে । অসহায়ের মতো শুধু আমি চেয়ে থাকি রবীনের মুখের দিকে । আমার মনের অবস্থা যে কী তা বোধ হয় বোঝাতে হয়নি রবীনকে । বুদ্ধিমান রবীন চট করে আমার পিঠের স্যাকটা খুলে নিয়ে তার পিঠে নিয়ে নিল । নিজস্ব স্যাকও ছিল তার কাঁধে । আমাকে একরকম জোর করে হাত ধরে টেনে তুলে নিল ধসের ওপর । তারপরের অবস্থার কথা আর চিন্তা করতে পারি না । দমবন্ধ করে রবীনের হাত শক্ত করে ধরে সেই খাড়াই ঢালের ধস পার হয়েছিলাম । চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে এ ধসের কথা । আধ কিলোমিটারের মতো দীর্ঘ ছিল এ ধস । ঝুরো পাথরের টুকরো, বালি আর শুকনো আলগা মাটি । পা রাখা যায় না ঢালের গায় । পা রাখলেই পা নিচে সরে যায় । মুহূর্তের অসাবধানতার ফল যে কী হতে পারে তা চিন্তা করা যায় না । চার পাঁচশো ফুট গভীর নিচে সুপিনের সলিল গহ্বর !

    কষ্টের পরই বোধ হয় সুখের মুখ দেখা যায় । জগতের এটাই নিয়ম । ধসের পর মিলেছিল সুন্দর পথের হদিশ । সমতল মতো পথ এগিয়ে গেছে সামনে হনহনিয়ে । পাশে সবুজ ঘাসে ঢাকা পাহাড়ের ঢাল একদিকে ; অন্যদিকে সুপিনের খাদ নেমে গেছে জলের কিনারা ছুঁয়ে ।

    আকাশে মেঘে মেঘে কানাকানি । সূর্য অস্ত গেছে । যতদূর এগোতে থাকি সুপিন উপত্যকার রূপ ত্রক্রমশ উন্মীলিত হচ্ছিল । এ এক বিশাল উপত্যকা ভূমি । পাহাড়ের ঢেউ সরে গেছে দূরে । জঙ্গলের ঘনত্ব নেই বললেই চলে । শুধু সবুজ ঘাসের কার্পেট সারা অঞ্চল জুড়ে । তারই মধ্যে ফসলের সমারোহ । ধান, যব, রামদানা ।

    আকাশের অবস্থা ভাল নয় । কালো মেঘে আচ্ছন্ন সারা আকাশ । মনে হচ্ছে বৃষ্টি এল বলে । দমকা হাওয়ার দাপট শুরু হল । প্রমাদ গণলাম ! তরুণ আর এগোতে চাইল না । যদি বৃষ্টি নেমে যায় নাস্তানাবুদের একশেষ হতে হবে । তার চেয়ে এখানেই তাঁবু ফেলা ভাল । মুক্তিরাম অনুরোধ করে সামনেই ফতারি গ্রাম দশ মিনিটের পথ । ওখানেই যাওয়া ভাল । কিন্তু অভিজ্ঞ তরুণ আকাশের অবস্থা দেখে আর এক পা এগিয়ে যেতে চাইল না । বাধ্য হয়েই মূর্তিরাম বললো, "এক কাজ করুন, তাঁবু ফেলার দরকার নেই । সামনেই পাহাড়ের গায়ে এক ক্ষেতিবাড়ি আছে । ওখানেই রাতটা কাটানো হোক ।" সবাই সম্মতি দিই ।

    পাহাড়ে বৃষ্টির যে কী দামালপনা শুরু হয় তার প্রত্যক্ষ রূপ আমরা সেদিন দেখেছিলাম । বৃষ্টি নামার আগেই আমরা পৌঁছে গেলাম `বেড়া' গ্রামের সেই পরিত্যক্ত ক্ষেতিবাড়িতে । সত্যিই বিরাট কাঠের তৈরি বাংলো মতন ঘর একখানা । লোকজনশূন্য পড়ে আছে । মাথায় কাঠের তক্তার আচ্ছাদন । চারধারে কাঠের বারান্দা, কাঠের রেলিং । নির্মাণ শৈলীতে শিল্পীর সুন্দর রুচির পরিচয় পাওয়া যায় । ঘরখানা কেন যে পরিত্যক্ত তা বুঝতে পারি না । পরে অবশ্য জেনেছিলাম ফতারি গাঁয়ের বৈভবশালী এক কৃষক পরিবার এই ঘর তৈরি করেছিল । চাষবাসের কাজ দেখাশোনা ও সেইসঙ্গে ফসল সংরক্ষণের জন্যে । তার মৃত্যুর পর এ ঘর পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে ।

    আকাশভাঙা বৃষ্টি শুরু হল একটু বাদেই । বৃষ্টির তাণ্ডবলীলা চললো পুরোপুরি এক ঘন্টার মতো । পাহাড়ে বৃষ্টি যে কী প্রচণ্ড তা সেদিন হাড়ে হাড়ে বুঝেছিলাম । সারা আকাশ জুড়ে মনে হয়েছিল যেন দৈত্যের পাল ঢুকে পড়েছে । ঘন ঘন মেঘগর্জনে কানে তালা লাগার উপক্রম । সেইরকম বিদ্যুতের ঝলক । মনে হচ্ছিল সারা আকাশকে যেন চাবুক মেরে মেরে গুঁড়িয়ে দিচ্ছিল । জলের ঢল নামলো পাহাড়ের গা বেয়ে । কল-কল, ছল-ছল শব্দ চারদিকে । আমাদের ঘরের পাশেই পাহাড়ের ঢাল খাড়াই উঠেছিল । সেই ঢাল বেয়ে জলের স্রোত বারান্দার এক প্রান্ত ভাসিয়ে দিচ্ছিল । পথঘাটের দিকে চাওয়া যাচ্ছিল না । ধোঁয়ার মতো সব ঝাপসা ।

    এরপর এক সময় বৃষ্টির চাপ কমে আসে । আকাশ পরিষ্কার হতে শুরু করে । চাঁদ ওঠে মাঝ আকাশে । জ্যোত্স্নায় ভেসে যায় সব । বৃষ্টির দামালপনা শেষ । শান্ত হয় শিশুর মতো ।

    হাত-পা গুটিয়ে বারান্দার এক কোণে এতক্ষণ বসেছিলাম সবাই । কেননা করার তো তখন কিছুই ছিল না । এবারে কর্মযোগের পালা শুরু হল । পোর্টাররা বারান্দার একধার পরিষ্কার করতে লেগে গেল । পিট্টু খুলে রান্নার সাজ-সরঞ্জাম বার হল । যৌথভাবে শুরু হল সবার রান্না । পোর্টারদের আনা রেশন আর সেইসঙ্গে আমাদের আনা রেশন নিয়ে বড় করে খিচুড়ি তৈরির উদ্যোগ শুরু করেছিল কুন্দন সিং । সেই সঙ্গে পাঁপর সেঁকা আর মাংসের টিন কেটে সুস্বাদু এক আহার্য বস্তু । শীতল বৃষ্টি-স্নিগ্ধ রাতের সে উপাদেয় ভোজ্যবস্তুর তুলনা কেউ তুলতে পারবে না, এটা একাবারেই অনস্বীকার্য ।

    তরুণের সঙ্গে মূর্তিরামের কত কথাই না হচ্ছিল । কানে আসছিল তাদের কথার রেশ । `পোর্টাররা এরপর আরও বেশি পাড়াওয়ের দাবি করছে । তারা এ রেটে কাল থেকে আর যাবে না বলে দিয়েছে । তাই সে ভাবছে, আগামি কাল কিছু পোর্টারকে বাদ দিয়ে ফতারি গাঁ থেকে নতুন পোর্টার নিয়ে নেবে ।' অভিজ্ঞ তরুণ এতদূর আসার পর আর দ্বিরুক্তি করতে চায় না । কারণ সে জানে ভালভাবেই, পথের মাঝখানে পোর্টার-বিভ্রাট এক বাস্তব ঘটনা ও দগদগে সমস্যা । কত অসুবিধায় না পড়তে হয় এর জন্যে । এমনও হয় যে মাঝে মাঝে অভিযান পর্যন্ত বাতিল হয়ে যায় । সুতরাং তরুণ যে সে পথ মাড়াবে না সেটা জানাই আছে । পথের নির্দেশকের ওপর ভাল মন্দর সব কিছু ভার তুলে দিয়ে সে নিশ্চিন্ত হতে চায় । কেননা এখুনি পাল্টা অভিমত পোষণ করতে গেলেই সমস্ত পর্বটা তেতো হয়ে যাবার পর্যায়ে আসতে পারে । তাই অতিরিক্ত কথা ব্যয় করা আর উচিত নয় ভেবে তরুণ সেদিনের পর্ব সেখানেই মিটিয়েছিল সহজ, শান্ত ভাবে । হৈ-চৈ করে বাদ প্রতিবাদের ঝড় তোলা হয়ত যেত এখুনি, কিন্তু তাতে ফল ভাল হবে না ভেবেই তরুণ নিজেকে সংযত করে নেয় ।

    কাঠের তক্তার বারান্দা জুড়ে ঢালাও বিছানা পেতেছিল পার্থ, নীলাদ্রি, রাজারা । গত রাতের নীচলা-পাঁও গ্রামের কনট্রাকটরের ঝুপড়ির অপরিসরতা ছিল না এখানে । যেখানে খুশিমতো বিছানা পেতে শুয়ে পড় । মাঝখানের ঘরের মধ্যে প্রবেশের উপায় ছিল না । ঘর তালাবন্ধ । ঘরের মালিকানাসত্ব এখনও যে বজায় আছে এর থেকেই বেশ বোঝা যায় ।

    সবাই পথ হাঁটার পরিশ্রমে ক্লান্ত । একে একে সবাই শুয়ে পড়ে ঘুমকাতুরে চোখ নিয়ে । আমি শুধু বারান্দার এককোণে আস্তে আস্তে এসে বসি । বৃষ্টিভেজা ঠাণ্ডা বাতাস চোখে মুখে লাগছিল । বাতির কাঁপা কাঁপা আলোয় দেখলাম পোর্টারদের নিয়ে গোল হয়ে বসে মূর্তিরাম হাত পা নেড়ে কী সব বলছিল । তার কথার প্রতিবাদও কেউ কেউ করে উঠলো । মনে হল ওদের পারিশ্রমিক, পাড়াওয়ের টাকাকড়ি থেকে বঞ্চিত করছে মূর্তিরাম । পোর্টারদের গলার একটা প্রতিবাদী ক্ষুব্ধ সুর শুধু কানে আসে ।

    দৃষ্টি ফিরিয়ে নিই । ধূ ধূ করছে সামনে রাতের উপত্যকা । দুধসাদা জ্যোত্স্নায় ভেসে যাচ্ছিল তার কোলে ভরন্ত ফসলের শ্যামলিমা । দূরে সুপিনের ঝুমঝুমির রেশ কানে আসে অস্পষ্ট । নিস্তব্ধ প্রকৃতি, নি:শব্দ রাত । শুধু ঘরের চালার মাথায় কোথাও বৃষ্টির জমা জলের টুপটাপ ঝরার শব্দ । স্তব্ধ পরিবেশে যেন নিজেও মিশে যাই । হারিয়ে যায় যেন সব সত্বা, নিজস্বতা ।

    উঠে আসি বারান্দার সে কোণ ছেড়ে । রাত অনেক হয়েছে । দেরি করি না । ছোট্ট বিছানায় এসে আশ্রয় নিই । মুখ পর্যন্ত টেনে নিই গরম কম্বলখানা ।



    ॥ ৪ ॥



    পরের দিন ।
    পরিচ্ছন্ন সকাল ।

    নির্বিঘ্ন ঘুমে মনের প্রফুল্লতা যে বাড়ে এটা বুঝতে অসুবিধা হয় না । সেই মতো একটা পবিত্র ভাবও সারা মনটাকে যেন ঘিরে থাকে । মনের সঙ্গে দেহের যে একটা নিবিড় সম্পর্ক আছে এটা বেশ বোঝা যায় । শরীরের সুস্থতাই মনের স্বাস্থ্যকে সুন্দর করে গড়ে তোলে ।

    সুধাংশুর সঙ্গে এক প্রস্থ আলোচনা করে নিই ফিতারি গ্রামের সার্ভে সম্পর্কে । অনেক আগেই সে উঠেছিল । রোজ ওঠেও তাই । স্বভাব-সুন্দর যুবক । নিয়মের টেনে ধরা রাশকে সে আলগা দিতে চায় না সহজে । তাই নিয়মমাফিক গড়ে ওঠা চরিত্রটি বড় সুন্দর ওর । ও চিকিত্সক । ফিতারি পৌঁছে সেখানের সার্ভে ওয়ার্ক কী করে হবে প্রশ্ন তুলতেই সে স্বভাব-সুন্দর ভঙ্গিতে বলেছিল, "অবশ্যই হবে, অমরদা ।" বলেছিলাম, "সময় পাওয়া যাবে তো ?" -- "সময় করে নিতে হবে ওরই মধ্যে দিয়ে । ওষুধগুলো তো বিলি করতে হবে ?" সে বলে ওঠে । "অবশ্যই" আমিও বলে উঠি । --"দু:স্থ মানুষদের যেটুকু উপকার করা যায় এরই মধ্যে দিয়ে । কি বলেন ?" সুধাংশু বলে ফেলে । বলিনি কিছুই । শুধু ভাবি, সেবার মধ্যে দিয়ে জীবনের ছোটখাট মাপের উত্সর্গীকরণ । এও কম কথা কী ? ক'জনেই বা তা করে ?

    চা খাওয়ার পর্ব চুকিয়ে নিতে রবীন ডাকছিল । বিছানা ছেড়ে উঠে পড়ি । জ্বলন্ত স্টোভের মাথা থেকে কেটলি নামিয়ে কাপে চা ঢালতে ঢালতে রবীন বলে ওঠে, "অমরদা, ধারাতে সার্ভে ওয়ার্কের সুযোগ পাওয়া যায়নি, আজ কিন্তু ফিতারিতে করতে হবে ।" মাথা নেড়ে সম্মতি জানিয়ে বলি, "অবশ্যই হবে, তোমাদের সংস্থার জয়যাত্রা হোক, এ প্রার্থনা কী আমারও নয় ?" বহু চিঠিপত্র লিখে, অনেক তাগাদা-তদ্বির করে, পায়ে পথে হেঁটে, `হিম-আলয়' সংস্থার সম্পাদক "কলকাতা দে'জ মেডিক্যাল" ঔষধ কোম্পানির মালিকের কাছ থেকে প্রচুর ওষুধ-পত্র সংগ্রহ করেছিল পাহাড়ি দু:স্থ পরিবার পরিজনদের দেবার জন্যে । অভিযাত্রী ও অভিযানের সংস্থাগত মানের ওপর বিবেচনা করে তাদের মাধ্যমে এইজাতীয় প্রতিষ্ঠানগুলি অনেক সময়েই ওষুধপত্র বা অন্যান্য সাহায্য দান করে থাকে । এছাড়া গ্রাম নিরীক্ষাকরণ (ফ্ঠত্ত্ছভং নণ্ণশটংষ্‌ ঘধশূয), ব্যক্তিগত/পারিবারিক নিরীক্ষাকরণ (ণধস্‌ং ফ্ঠযঠঞ/ ঝত্ররুঠটঠরুণ্ণছত্‌/ যছস্ঠত্ষ্‌ লত্রঠঞ শৈধীধশস্ছ) বিষয়ে ছাপানো ফর্ম ও কাগজপত্র সংগ্রহ করে আমাদের দিয়েছিল গ্রাম নিরীক্ষার কাজের জন্যে । এতে অবশ্য দেশের এইরকম প্রত্যন্ত অঞ্চলের স্বাস্থ্য পরিষেবার হাল ও ওষুধপত্রের চাহিদা কীরকম সেটাও জানা হয়ে যায় ।

    কুন্দন সিংয়ের দলবল অনেক আগেই রাস্তায় নেমে পড়েছিল । আমরাও এক এক করে নেমে পড়ি । একরাতের কল-কোলাহলে জেগে ওঠার পরে ক্ষেতিবাড়ি নতুন করে আরও একবার পরিত্যক্ত হল । গতরাতের বৃষ্টির জলে রাস্তার খানা-খন্দ, গর্ত সব ভরে গিয়েছিল । মাঝে মধ্যে হয়েছে থকথকে কাদা । পা বাঁচিয়ে চলছিলাম । পরিষ্কার সকাল । রোদ উঠেছিল উপত্যকা আলো করে । রাস্তার কোলজোড়া ফসলের ঢেউয়ের আবিলতায় চোখ জুড়িয়ে যায় । ফিতারি গ্রামের দূরত্ব বেশি নয় । পাহাড়ের মাথায় গ্রামের থাক থাক ঘরবাড়ির সারি চোখে পড়লো । বাঁক নেওয়া পথের শেষাংশ গ্রামের মাথায় গিয়ে মিশেছে । রাস্তার দু'পাশে দলবদ্ধ পাইনশীর্ষে রোদের স্পর্শ । হাওয়ার সঞ্চালনে পাতার ছায়াও দুলছিল রাস্তার ওপর । তার ওপর পা ফেলে ফেলে গ্রামের মাথায় গিয়ে পৌঁছই ।

    তুলনামূলক ভাবে বলতে হয় গ্রামের জনবসতি বেশি । ঘরবাড়ি অধিকাংশই কাঠ ও পাথরের । মাথার ছাওন বা ছাদও কাঠের । আবার পাথরের টালির ছাদও আছে অনেক বাড়ির । ঘুলঘুলির মতো চৌখুপি সব জানালা । একটাই দরজা । দোতলা ঘরই বেশিরভাগ চোখে পড়লো । এসব অঞ্চলে গৃহনির্মাণ কৌশলে একটা স্থাপত্যশৈলীর বৈশিষ্ট্য আছে যা কোনওভাবেই চোখ এড়াতে পারে না । প্রতিটি কাঠের বাড়ির দরজা, জানালার মাথায় দক্ষ শিল্পীর নিপুণ হাতের কাজ মিশে আছে । কাঠ ও পাথরের ওপর সূক্ষ্ম খোদাই কাজ এত মনোরম যে চোখে না দেখলে তা বিশ্বাসই করা যায় না । তমসা এবং সুপিন উপত্যকার বেশিরভাগ অঞ্চলে বাড়িঘর নির্মাণশৈলীর এ কুশলতা দেখা যায় । নক্শার পরিকল্পনায় জোড়া মকর, জোড়া মীন, জোড়া হস্তি, জোড়া সর্প, জোড়া ময়ূর এসব তো আছেই, এছাড়াও ফুলের তবক ফলের গুচ্ছ জড়ানো লতাপাতা, ফুল সুদ্ধ ফুলদানি, গোলাকার সূর্য-চন্দ্র এসবও খোদাই কাজের মধ্যে আছে । এ সব থেকে বুঝতে খুব একটা অসুবিধা হয়না, এসব অঞ্চলের মানুষজনের মনে শিল্পবোধ ও সেইসঙ্গে রুচির একটা সমন্বয় সাধন ঘটেছে ।

    সুধাংশু আগেই কুন্দনকে বলে দিয়েছিল সে যেন গ্রামে পৌঁছেই খবরটা দিয়ে দেয় গাঁয়ের অসুস্থ মানুষজনকে বাইরে থেকে আসা বিদেশি ডাক্তার সাহেব এসে পরীক্ষানিরীক্ষা করবেন এবং সেই সঙ্গে বিনামূল্যে দাওয়াই দেবেন । তারা যেন গাঁয়ের এক জায়গায় এসে হাজির হন ।

    হাওয়ায় আগুন ছড়িয়ে পড়ার মতো কথাটা গাঁময় রটেছিল । অসুস্থ মানুষের কভিড় উপচে পড়েছিল গাঁয়ের ঠিক মাঝখানে ফাঁকামতো চারকোনা এক মাঠে । সামনেই তার বিশাল দুর্যোধনের মন্দির । ওষুধের পিট্টু নিয়ে রবীন ও আমি হাজির হলাম ।

    সুধাংশু এসেই রোগীদেখা শুরু করে দিয়েছিল । নীচলা-পাঁও গ্রামের মতোই সেই একই রকম রোগের লক্ষণ ও রোগীর মুখের ফিরিস্তি । বুকের রোগ, পেটের রোগ, জ্বর, সর্দি, কাশি, গলাব্যাথা, অম্বল, আমাশয়, অজীর্ণ । এছাড়া কিছু কিছু যৌনরোগের হদিশও মিলেছিল । নেশা ভাঙ করা মানুষের দলও কম নয় । রবীন সুধাংশুর লেখা প্রেসক্রিপশন দেখে দেখে ওষুধ বিতরণ করে । আমি ছাপান ফর্মে গ্রামবাসীদের নাম, ধাম ইত্যাদির ফিরিস্তি জেনে নিয়ে ফর্ম পূর্ণ করি । গ্রামবাসীদের ব্যক্তিগত ও পরিবারগত নিরীক্ষাকরণ ।

    ঘন্টা দুইয়ের মতো সময় নিয়েছিল রোগী পরীক্ষা ওষুধ বিলি ও গ্রাম নিরীক্ষা করতে । মানুষের আগ্রহ, কৌতূহল ও সহযোগিতায় আমরা মুগ্ধ হয়েছিলাম । সমস্ত পর্বটাকে কি সুন্দর সহজভাবে তারা নিতে পেরেছিল দেখে আমরা অবাক । কোনও রকম চেঁচামেচি তো ছিলই না বরং সংযত সংহত ও পরস্পরের প্রতি একটা সহমর্মিতার রেশ সমস্ত ব্যাপারটাকে ঘিরে ছিল ভেবে আশ্চর্য হই । সুধাংশু তো বলেই ফেললো, "সভ্যতার আলোয় ছোঁয়া মানুষদেরও শিক্ষা নিতে হবে এদের কাছ থেকে ।"
    - "আপনি কোন গ্রামে থাকেন ?"
    - "ফিতারি গাঁয় ।"
    - "আপনার নাম ?"
    - " যমুনা দেবী ।"
    - "বয়স কত হল ?"
    - "ষাট, পঁয়ষট্টি তো হবেই ।"
    - "আপনার শরীরের কষ্ট কি ?"

    - "দমের কষ্ট ডাক্তার বাবুজী । শুধু কাশি, সারা রাত ঘুমোতে পারি না । কাশতে কাশতে মনে হয় জীবনটা বুঝি শেষ হয়ে গেল ।"

    সুধাংশু স্টেথো বসিয়ে বুকটা একবার দেখে নেয় মহিলার । আঁটো সাঁটো জোব্বা বৃদ্ধ মহিলার । গলায় মোটা রুপোর হাঁসুলি । নাকে নাথলি । চুলে পাক ধরেছে ।

    - "ওষুধটা রাতে দু-চামচ করে খাবেন অল্প জল দিয়ে, কেমন ?" সুধাংশু বলে যায় খস খস করে প্রেসক্রিপসন লিখতে লিখতে । বৃদ্ধা মাথা নাড়ে । রবীন ওষুধের ফাইল বৃদ্ধার হাতে তুলে দেয় ।
    - "পরে কে আছে আসুন ।" সুধাংশু আবার ডেকে ওঠে ।
    সার দিয়ে দাঁড়িয়েছে মহিলারা লাইনে । পুরুষের লাইন আলাদা । কুন্দন সিং লাইন তদারকি করে ।

    অন্ত:সত্বা মহিলা । বয়স ত্রিশ উর্দ্ধে । চোখের দুটো কোল ভাল করে দেখে সুধাংশু । দেখতে দেখতেই প্রশ্ন করে, "আর কটা বাচ্ছা আছে ঘরে ?" মহিলা চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে । কোনও কথা বলে না ।
    - "বলুন, না ? লজ্জা করছে ।"
    - "চারটে ।" মহিলা শান্ত কন্ঠে বলে ওঠে ।

    -"ফ্যামিলি প্ল্যানিং করে ফেলুন না স্বামীকে বলে ।" সুধাংশু মহিলাকে বলেই ফেলে । মহিলা নীরবে দাঁড়িয়ে থাকে । মস্ত এক বোতল টনিকের ব্যবস্থা লিখে দেয় সুধাংশু তার জন্যে ।
    - এ লাইনটা রোগীদের নয় । এখানের গ্রামবাসীদের । লাইন ঠিক করতে হচ্ছিল কুন্দনকে মাঝেমধ্যে ।
    - "আপনার নাম ?" প্রশ্ন করি । "বয়স কত, শিক্ষাই বা কী ?"
    - "রাজেন্দর সাকলানি । পঁচিশ বছর, মাধ্যমিক ।" যুবক বেশ স্বচ্ছন্দে কথাগুলো বলে যায় ।
    - "আপনার গ্রামের, তহশিলের, ডাকঘর, জেলার নাম বলুন ?" আবার প্রশ্ন করি ।
    যুবক আবার বলে, "গ্রামের নাম ফিতারি, তহশিল পুরৌলা, ডাকঘর জাকোল, আর জেলা - উত্তরকাশি ।
    মাঠের ওপর প্লাস্টিক বিছিয়ে বসে ছাপান ফর্ম পুরণ করি এক এক করে ।
    - "গ্রামের লোক সংখ্যা কত ?" আবার জিজ্ঞাসা করি ।
    - "দেড়শোর মতো ।"
    - "পুরুষ ও মহিলার মোটামুটি সংখ্যা বলতে পারবেন ?"
    - "পুরুষ - নব্বুই, মহিলা - ষাট ।"
    - " গাঁয়ের সব থেকে বয়স্ক মানুষ কে ?"
    - "দানিরাম রানা পঁচানব্বুই বছর হবে ।"
    - "বয়স্ক মহিলা কে আছেন ?"


    ফিতারি গ্রামের সব থেকে বর্ষিয়সী মহিলা
    - নাতি-নাতনি সহ যশোধারা দেবী
    - "যশোধরা দেবী - ছি'আশি বছর, আমার মা ।"

    ফর্ম আবার পুরণ করি । পাড়ার ভিতর থেকে স্টিলের গ্লাসে চা আসে । সেই সঙ্গে সেঁকা ভুট্টা কয়েকটা থালায় করে । চায়ে চুমুক দিয়ে আবার জিজ্ঞাসা করি ।
    - "প্রাথমিক বিদ্যালয় আছে ?"
    - "হ্যাঁ ।"
    - "কোথায় ?"
    - "এই গাঁয়ে ।"
    - "মাধ্যমিক স্কুল ?"
    - "নেই ।"
    - "ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা কত প্রাথমিক স্কুলে ?"
    - "উনিশ জন ।"
    - "শিক্ষকের সংখ্যা কত ? পুরুষ না মহিলা ? পাশ করা শিক্ষক আছেন কেউ ?"
    - "দুজন । দুজনেই পুরুষ । ইন্টারমিডিয়েট ।"
    - "বাড়িঘর সব কেমন ? পাথরের না কাঠের ?"
    - "কাঠের বাড়ি বেশি । পাথরের কম ।"
    - "কি ধর্ম আপনাদের ? কোন কোন ধর্মের লোক বাস করেন এখানে ?"
    - "আমি হিন্দু, ব্রাহ্মণ । রাজপুত, হরিজন এসব ধর্মের লোকও আছেন এখানে ।
    - "ধর্মীয় স্থান কি আছে এখানে ?"
    - "সোমেশ্বর শিব, দুর্গা ও কর্ণের মন্দির আছে ।"

    যতটুকু সম্ভব জ্ঞাতব্য বিষয়গুলি জেনে নিতে আপ্রাণ চেষ্টা করি । শিক্ষিত কিছুটা ও সেইসঙ্গে বেশ সপ্রতিভ, বুদ্ধিমান প্রতিবেশি বা ছাত্র পেলে কাজটা খুব সুন্দর ভাবে করা যায় এবং খুব বেশি সময়ও অপচয় হয় না । ভাল লাগে । হিমালয়ের এমন এক গভীর অন্ত:পুরে এসে এক অখ্যাত, অজ্ঞাত গ্রামের মানুষজনের সঙ্গে মিশে তাদের জীবনের, সমাজের, সংসারের সংক্ষিপ্ত তথ্যপরিচয় ও জীবনপঞ্জী রচনার এ প্রয়াস বা প্রচেষ্টা সত্যিই ভাল লেগেছিল । আর কিছু না হোক, সেসব অঞ্চলের কিছু তো জানা যায়, কিছুর সঙ্গে তো পরিচয়ের একটা নিবিড় সম্পর্ক গড়ে ওঠে ।

    সমীক্ষা সেরে ফিরে আসি সবাই । এসেই দেখি একরাশ অপরিচিত মুখ । বেশিরভাগই যুবক, একধারে বসে রয়েছে । মূর্তিরাম তাদের সঙ্গে হাত পা নেড়ে কী সব কথাবার্তা বলছে । তরুণ একটু আড়ালে আমাকে যা জানালো তার সারমর্ম হল বেশিরভাগ পোর্টার আর একপাও যেতে চাইছে না আমাদের সঙ্গে ; তারা ফিরে যেতে চায় । আর যে-কদিনের পাড়াও হয়েছে প্রত্যেককে পাড়াও পিছু দেড়গুণ করে টাকা বেশি দিতে হবে । স্তম্ভিত হই ! এখন বুঝতে আর অসুবিধা হয় না কেন এইসব নতুন মুখের আমদানি । এরাই হবে আমাদের পথের নতুন পোর্টার । এদেরও দিতে হবে আগের পাড়াওয়ের মজুরি । এখন বুঝতে পারছি কেন গতকাল রাতে পোর্টারদের নিয়ে মূর্তিরামের কথাবার্তা ও কৌশল অবলম্বন । ন'জন পোর্টারের জায়গায় দশজনের দল তৈরি হয়েছে এখন । প্রশ্ন করতেই সে বলে ওঠে, "রেশনের পিট্টু অনেক, কুলি বেশি না হলে মাল পড়ে থাকবে ।" এখন এও বুঝতে অসুবিধে হল না ওদের রেশনও বইবে আমাদের কুলি । তারও মজুরি আমাদের গুনতে হবে ।

    প্রশ্ন বেশি বাড়াতে চায় না তরুণ । এমনিতেই সে কথা কম বলে । এসব ক্ষেত্রে তো সে নীরবতা অবলম্বন করবেই । বেলা বেড়ে যাচ্ছে দেখে আর বসে থাকা সমীচিন বলে মনে হল না । তরুণ পুরনো কুলিদের পাড়াওয়ের মজুরির হিসেব-নিকেশ করে সব টাকা মূর্তিরামের হাতে দিয়ে দেয় । নতুন কুলিরা যে যার মতো মালপত্র ভাড়া বাঁটরা করে পিঠে তুলে নিল । ওরাই পথে নামলো সবার আগে ।

    রোদে বেশ ধার উঠেছে । ময়ূরকন্ঠী-নীল আকাশ । উদাসী মেঘ উড়ে যাচ্ছে কোন উদ্দেশ্যে কোথায়, কে জানে ; গ্রামের বুক চিরে নেমে গেছে সরু পথ । দু'পাশে বেড়া দেওয়া প্রতিবেশিদের ফলের বাগান । আপেল মুসাম্বি লেবুর গাছ । ফলে ভর্তি । নুয়ে পড়েছে ডালপালা ফলের ভারে । পাকেনি এখনও, সবুজ হয়ে আছে । গ্রামের বাইরে দূরে উঁচুতে পাথরের এক চাঙড়ের মাথায় দেখলাম বিরাট টিনের এক জলের ট্যাঙ্ক । চতুর্দিকে পাইপ ও নলের ছড়াছড়ি । জলের সরবরাহ না থাকায় ট্যাঙ্ক এখন জলশূন্য । ঝরনার উত্সমুখ নাকি শুকিয়ে গেছে । তাই আর জল এসে পড়ে না ট্যাঙ্কে ।


    গাঁয়ের রূপসী - এরা ঘরও সাজায় আবার মাঠেও কাজ করে
    বাড়িঘর, খামারের আনাচ-কানাচ মাড়িয়ে গ্রামের বাইরে এসে উপস্থিত হই । রাস্তার ধারের গাছ-গাছালির ছায়া দুলছিল রাস্তার ওপর । চারদিকে অচেনা গাছপালার ঝোপঝাড় । তারই মধ্যে অজানা ফুল-ফলের ইশারা । দু'পা এগোতেই বাঁ-ধারে নজরে এল এক পথের রেখা । এঁকেবেঁকে ঝোপ-ঝাড়ের মধ্যে হারিয়ে গেছে । এখান থেকে যাওয়া যায় পাশের গ্রাম কাসলাতে । গ্রাম নাকি বেশ সমৃদ্ধ । তারও পিঠোপিঠি আরও একটি গ্রাম আছে তার নাম রালা । গ্রাম দুখানা এখান থেকে দেখা যায় পাহাড়ের গায়ে । মনে হয় যেন ক্যানভাসে তুলি দিয়ে আঁকা একখানা ফ্রেমে বাঁধান ছবি । রোদে ঝকঝক করছিল ।

    পথ ধীরে ধীরে নেমে যাচ্ছিল নিচে । দূরে সুপিনের অস্পষ্ট সুর আসছিল কানে । পথে দেখা হল এক বৃদ্ধ পথচারির সঙ্গে । লাঠি হাতে, মাথায় ছাতা । পিঠে বাঁধা কাপড়ের পুঁটুলি । পথশ্রমে শ্রান্ত । প্রশ্ন করতেই বলে ওঠেন, "লেয়ারি গাঁ থেকে আসছি । মেয়ে জামাইয়ের বাড়ি এই গাঁয়ে । মেয়ের বড় অসুখ । খবর পেয়ে দেখতে যাচ্ছি ।" কন্যাগত প্রাণ পিতার । অসুস্থতার কথা কানে আসতেই থাকতে পারেনি ঘরে । বেরিয়ে পড়েছে । পিঠের পুঁটুলিতে বেঁধে নিয়েছে গাছের দুটো পাকা ফল । চাল, মধু, ঘি । সংসারের সঞ্চয় থেকে । মনে মনে ভাবে মেয়ের মুখখানার কথা । তপ্ত রোগক্লিষ্ট মুখ, হয়ত রাঙা হয়ে উঠেছে । শীর্ণ দু'খানা হাত নিয়ে বাপের কন্ঠলীন হবে ।

    সুপিনের কল্লোল ত্রক্রমশই স্পষ্ট হতে থাকে । যদিও তার রূপ এখনও চোখে পড়েনি । জানি না সে ভৈরবী মূর্তির সাক্ষাত এখানে আবার পাব কিনা । এবড়ো খেবড়ো পাথুরে পথ । শুধু নেমেই চলেছে সুপিনের গর্ভগামী হয়ে । একসময় নদী নজরে আসে । না, নদীর সে সংহারিণী রূপ আর নেই এখানে । অনেক শান্ত, অনেক সংযত । সমতলে তার রূপ এক আবার পাথরের কারাগারে তার আর এক রূপ । প্রবলা -- প্রমত্তা !

    উপত্যকার মধ্যে দিয়ে প্রবহমান বলে সুপিন এখানে চণ্ডমূর্তি ধরেনি । স্বচ্ছল গতিতে বয়ে চলেছে । নানা আকারের নুড়ি-নাড়ার মধ্যে দিয়ে এলানো চুলের মতো নানা শাখা, উপশাখায় বিভক্ত হয়ে নিচে বয়ে যাচ্ছে । অগভীর খাদ । নদীর ওপারে শুরু হয়েছে গভীর জঙ্গলের বেষ্টনী । ওপারে অনুচ্চ পাহাড় থাকে থাকে মাথায় উঠে গেছে । গাঢ় সবুজ বনের ঘন আস্তরণ লেপে আছে পাহাড়ের সারা অঙ্গে অঙ্গে ।

    কাঠের সেতু । মোটা মোটা পাইনের গুঁড়ির ওপর পাইন কাঠেরই তক্তার পাটাতন । মোটামুটি নি:শঙ্ক পারাপারের ব্যবস্থা । গ্রাম-পঞ্চায়েতের কল্যাণে তৈরি । মানুষ চলে, গবাদি পশুর পাল চলে নিশ্চিন্তে ।

    ফিতারি গ্রামের সীমা-বিভাজক সুপিনকে যখন পার হচ্ছি, তখন মনে পড়ছিল এমনই সময় আর এক সুপিনকে পার হওয়ার কথা -- ধারা গ্রামের নিচে সেই লোহার সাসপেনশন ব্রিজে । এই দুই অভিজ্ঞতা একেবারে দুই বিপরীত মেরুতে । সেখানে ভয়ের কারণ ছিলো খুব । বিশেষ করে পাহাড়ের গায়ে ধসের সম্ভাবনার জন্যে ।

    সেতু পার হয়ে ভিন্ন গ্রামের চৌহদ্দিতে পা ফেলি । গ্রামের নাম লেয়ারি । এ পথের নাকি শেষ গ্রাম । কুলিরা বেপাত্তা । শুধু কুন্দন সিং আছে আমাদের দলে । কি জানি, কেন দলত্যাগী হয়নি সে বুঝলাম না । মূর্তিরামের মনোগত ইচ্ছা কি তার ভাল লাগেনি ? নাকি সে আপোষ করে নিতে পারেনি মূর্তিরামের অভিরুচি ? নি:শব্দে আমার পিছন পিছন সে সমানেই আসছিল । প্রশ্ন করি, "কী কুন্দন তুমি কেন ফিরে গেলে না নিচে তোমাদের গাঁয়ে ?" -- "না বাবুজী, না, সেটা ঠিক হবে না ।" কুন্দন যেমন আসছিল তেমন আসতে আসতেই বলে উঠলো । আশ্চর্য হয়ে বলি, "সে কী ! কাজ কাম না করে দেড়া পাড়াও পেতে ।" কিছু বলে না সে । শুধু নীরবে পিঠের বোঝা নিয়ে পা ফেলে ফেলে ওপরে উঠতে থাকে । কিছু বলি না আর । আমিও চুপ করে পথ ধরে চলি ।

    জঙ্গলের গভীরতা বাড়তে থাকে । পথের গা-ঘেঁষা পাহাড়ের মাথার গাছগুলো যেন আকাশ ছুঁতে চায় । পথ পাক খেয়ে খেয়ে ওপরে উঠে গেছে । রবীন,স্বপন, রাজাদের আর দেখাই যায় না । অনেক ওপরে উঠে গেছে তারা । বিমলবাবুকে নিয়ে তরুণের যত অস্বাচ্ছন্দ্য । বয়স্ক মানুষ, সাবলীল গতি নেই হাঁটায় । কেবল পিছিয়ে পড়ছেন । তরুণের সাহচর্য ওঁর একান্তই প্রয়োজন । পার্থ, নীলাদ্রির কৌতূহলের শেষ নেই । এই প্রথম পাহাড়ে আসা । সবই নতুন, চোখে সবই অদ্ভুত । একরাশ গাছের ডালপালা, ফলফুল সংগ্রহ করতে করতে চলেছে । হিমালয়ের ফুল, ফল পাতা দিয়ে নাকি এযালবাম বানাবে । সুধাংশুর স্বভাবসিদ্ধ গতি । হই-হল্লার মধ্যে যেতে নারাজ । শুধু ক্যামেরায় চোখ দিয়ে প্রকৃতির রূপ নিরীক্ষণ করা আর মাঝে মাঝে তাকে ধরে রাখা ফিল্মের পাকে পাকে ।

    পথের দূরত্ব বোঝার উপায় নেই । কেউই পথের দূরত্ব মাপকাঠি দিয়ে মেপে রেখে যায়নি । শুধু সময়ের মাপকাঠি ধরে পথের দূরত্বের অঙ্ক কষতে হয় ।


    `নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ' - লেয়ারি গাঁয়ের পথে যেতে যেতে
    পথ যেন ত্রক্রমশ নির্মম হয়ে উঠছে । সঙ্কীর্ণ পথরেখা । এক জায়গায় এসে মনে হল যেন হারিয়ে গেছে । পথ আর নেই । পাহাড়ের গায়ের কী বীভত্স চেহারা হয়েছে । দেখলেই আঁত্কে উঠতে হয় ! পথের এক অংশের রূপ দেখে চমকে উঠি ! এ পথে যাব কেমন করে ? ধস নেমে পথের অস্তিত্ব নি:শেষ হয়ে গেছে । পাহাড়ের পাথুরে মসৃণ ঢাল শুধু হাঁ হাঁ করছে । ঢালের গা বেয়ে ধসা মাটি, পাথর, নুড়ি, বালি গড়িয়ে নিচে নেমে গেছে সুপিনের গভীর গর্ভে । গাছপালা শাখা-প্রশাখা সবশুদ্ধ উপড়ে পড়েছে জলের মধ্যে । এগোতে পারি না । বসে পড়ি পথের ওপর পিঠের রুকস্যাক নামিয়ে । রবীন, স্বপন, রাজাদের দল অনেক সাহস জুগিয়ে কসরৎ করে পার হল ধসা রাস্তাটুকু । ধস খুব বড় নয় । বিশ-পঁচিশ ফুট হবে । কিন্তু অসম্ভব বিপজ্জনক । ৭০-৭৫ ডিগ্রির মতো ঢাল হবে । শুধু এতটুকুর অসাবধানতার ফল কী হবে জানি না । জানি না বলা ভুল, জানতে চাই না বলাই সঙ্গত । কুলিদের হাত ধরে পার্থ, নিলাদ্রি, সুধাংশুরা ওপারে চলে গেছে অনেকক্ষণ । আমার সাহসে কুলোয় না । ঠেকে গেলাম আমি আর বিমলবাবু । বিমলবাবুর হাত ধরে নিয়ে যাবার জন্যে তরুণের সাধাসাধি । কিন্তু বিমলবাবু অনড় । পাদমেকং ন গচ্ছামি । তরুণ শেষ পর্যন্ত আশা ছেড়ে দিয়ে রবীনকে দড়ি আনার কথা বলে দিল । কুলিদের পিট্টুতে তাঁবুর সঙ্গে দড়ি ছিল । কুলিরা ওপারে কেউ বসে ছিল না । এগিয়ে গেছে । রবীন দড়ি আনতে ছোটে ।

    কাদের যেন কথোপকথন শুনতে পাই পিছন থেকে । চেয়ে দেখি দু'জন স্থানীয় পথচারি । মনে হল ফিতারি গ্রাম থেকেই আসছে । বিদেশিদের এ হাল দেখে তারা তো হেসেই অস্থির । ব্যাপারটা বুঝে নিতে তাদের এতটুকু অসুবিধে হয়নি ।

    মুহূর্তও লাগেনি । বিমলবাবুকে দেখলাম এক পথচারির কাঁধে উঠতে । কয়েক সেকেণ্ডের মধ্যে তিনি ধসের ওপারে পৌঁছে গেলেন । বাকি রইলাম আমি । আমার হাত ধরে একরকম টানতে টানতে আর এক পথচারি নিয়ে ফেললো ওপারে । ভাবতে অবাক লাগে, কী দুর্জয় সাহস নিয়ে এরা চলাফেরা করে পাহাড়ের এই সব দুর্লঙ্ঘ অংশে ! হঠকারিতাকে এরা গ্রাহ্যের আনে না ।

    রবীন দড়ি নিয়ে এসেছিল । কোমরে আমাদের আর বাঁধতে হল না । বেচারাকে আবার দড়ি হাতেই ফিরতে হল । রোপিংয়ের ক্রিয়াকৌশল কিছুই তাকে আর করতে হল না ।

    পথ এবার নেমে যাচ্ছে নিচের দিকে । দুপায়ে ফিরে পেলাম আবার সেই স্বাভাবিক গতি । শুকনো গাছের পাতায় পথ যেন বুজে আছে । পায়ে পায়ে শুধুই মচ মচ শব্দ । শীর্ণ জলের ঝরনা নেমে এসেছে ওপর থেকে । পথ ভিজিয়ে দিচ্ছিল । মাঝে মাঝে আঠালো কাদা পথে । জোঁকের উত্পাত আছে বলে মনে হল । কেন না থাকাই স্বাভাবিক এসব অঞ্চলে । হিমালয়ের পাঁচ-ছ'হাজার ফুটের মাথায় জঙ্গলাকীর্ণ, জলো, স্যাঁত্সেঁতে অঞ্চলে জোঁকের উপদ্রব হয় ।

    জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে পথ ত্রক্রমশই নামতে নামতে সুপিনের কূলে এসে মিশে গেল । উপলভাঙা নদী এখানে বেশ চওড়া । তবে জল কম, মন্দগতি । আছে শুধু মাঝে-মধ্যে নদীর স্রোতধারা । সুরের একটানা খঞ্জনী বাজিয়ে নেচে নেচে নেমে যাচ্ছে নিচে, আরও নিচে ফিতারি গাঁয়ের মাটি ছুঁয়ে, ধারাগ্রামের কূল ভেঙে ভৈরব তাণ্ডবে ।


    লেয়ারি গ্রামের পথে গাছের গুঁড়ির সাঁকো দুরন্ত সুপিনের বুকে
    নদীর সংকীর্ণ স্রোতের বুকে কাঠের জীর্ণ সাঁকো চোখে পড়ে । পাইনের গুঁড়ি ফেলা । কতকাল ধরে গুঁড়িখানা পড়ে আছে কে জানে ? নদীর স্রোতের দুপাশে পড়ে থাকা বিশাল বিশাল দুখানা বোল্ডারের মাথায় চাপানো পাইনের গুঁড়ি । এই হল সাঁকো । কিছু ধরে পার হবার কোনও ব্যবস্থাই নেই । না রেলিং- না কিচ্ছু । অথচ গ্রামের মানুষ-জন, পশুর পাল সবাই পারাপার হচ্ছে । মনে হল যুগ যুগ ধরে ।

    গাঁয়ের ছোট একটি মেয়ে ছাগল চরাতে এসেছিল নদীর এপারে ওবেলায় । বিকেল শেষে বাড়ি ফিরছে । মেয়েটি তার ছোট্ট ছাগলছানাকে বুকে করে নিয়ে সাঁকো ধরে পার হচ্ছিল । নিচে প্রচণ্ড জলের স্রোত । মনে হচ্ছিল ভাসিয়ে নিয়ে যাবে সাঁকো । কেমন সাবধানে সে সাঁকো পার হয়ে ওপারে নেমে নুড়ি পাথর ভেঙে গ্রামের পথ ধরে । অবাক হয়ে যাই ! দিন রাত গাঁয়ের কত মানুষ ছাগল ভেড়া এই সাঁকো ধরেই তো আসে যায় । এভাবেই তাদের কাটে দিন, কাটে মাস, বছর ।

    কুলিরা মাল নিয়ে কেমন একে একে গুঁড়ির ওপর পা ফেলে ফেলে ওপারে চলে গেল । আমাদের দলেরও সকলে সাঁকো পার হল । কেউ সহজে কেউ বা হাত ধরে । শেষে পড়ে রইলাম - আবার সেই আমি ও বিমলবাবু । বিমলবাবুকে রবীন হাত ধরে পারাপার করলো । আমি তরুণের হাত ধরে এপারে আসি । এই দুর্গম পাহাড়ে এমন সাঁকো বা সেতু কত যে আছে দুর্বার নদী, ঝরনা, প্রপাতের জলধারার ওপর হিমালয়ের পথের অলিতে গলিতে তার ইয়ত্বা নেই । কিন্তু সব সেতুই কী সুগম ? সংস্কারের অভাবে, অবহেলায় বহু দুর্ঘটনা ঘটে । লোকচক্ষুর অন্তরালে আমরা তার কতটুকু সংবাদ পাই ?



    [ক্রমশ:]


  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments