• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৩৩ | এপ্রিল ২০০৪ | প্রবন্ধ
    Share
  • স্মরণ -- সুবিনয় রায় : অলকা দত্ত

    রবীন্দ্রসঙ্গীতের অনন্য ব্যক্তিত্ব সুবিনয় রায়কে আমরা হারালাম অল্প কিছুদিন আগে -- গত জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে । রবীন্দ্রসঙ্গীত জগৎ প্রকৃত অর্থেই দীনতর হল তাঁর প্রয়াণে । পরিশীলিত ও হৃদয়স্পর্শী রবীন্দ্রসঙ্গীত উপভোগের সুযোগ থেকে আমরা বঞ্চিত হলাম । এই অভাব বা ক্ষতি ত্রক্রমশ গভীরভাবে অনুভূত হবে আগামী দিনগুলিতে ।

    সুবিনয় রায়ের সাংগীতিক উত্তরাধিকার তাঁর পরিবার থেকে পাওয়া । ব্রাহ্মসমাজের সঙ্গীতময় পরিবেশে বড়ো হয়েছেন তিনি । শান্তিনিকেতনে তাঁর সঙ্গীতশিক্ষার শুরু । রবীন্দ্রনাথের কাছে গান শেখার দুর্লভ সুযোগ তাঁর হয়েছিল । শৈলজারঞ্জন মজুমদারের কাছে তিনি নিয়মিতভাবে সঙ্গীতশিক্ষা করতেন । রাগসঙ্গীতের চর্চাও তিনি করেছিলেন । বিষ্ণুপুর ঘরানার গুণী অশেষচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে ধ্রুপদ শিখতেন । এস্রাজ ও বাঁশি খুব ভালো বাজাতে পারতেন । এইরকম সাংগীতিক প্রেক্ষাপটে তাঁর সঙ্গীতজীবনের শুরু । শান্তিনিকেতনের শিক্ষা শেষ হলে কলকাতায় এসে বেশ অল্পবয়সেই তাঁর শিল্পীজীবন শুরু হয়ে যায় । তাঁর মতো উচ্চশিক্ষিত গায়ক খুব কম পাওয়া যায় । সারাজীবন তিনি অসংখ্য গান গেয়েছেন । একেবারে রবীন্দ্রনাথের নিজস্ব বৈশিষ্ট্যের গান -- যা তাঁর "আপন গান" -- থেকে শুরু করে ভারি তালের ধ্রুপদাঙ্গের গান সবই তিনি তাঁর নিজস্ব সাবলীল মর্মস্পর্শী গায়কিতে পরিবেশন করেছেন । রবীন্দ্রনাথের ধ্রুপদাঙ্গের গানের ক্ষেত্রে তাঁর অবদান অসামান্য । শাস্ত্রীয় রাগাশ্রয়ী সঙ্গীতে ব্যাকরণ ঠিক রেখে গায়নশৈলীতে রসসৃষ্টি করা সবচেয়ে কঠিন কাজ । কিন্তু সুবিনয় রায় গভীর অর্থপূর্ণ, রাগনির্ভর, কঠিন তালের গানগুলি তাদের ভাব অক্ষুণ্ণ রেখে অতি সহজেই গেয়ে যেতে পারতেন ও শ্রোতার অনুভবে এক অতীন্দ্রিয় ভাবের সৃষ্টি করতেন তা'তে মনে হ'ত তিনি সত্যিই গান দিয়ে তাদের মনে দ্বার খুলেছেন । অসম্ভব সুরঋদ্ধ, মার্জিত ছিল তাঁর কন্ঠ । ছাত্র সম্বন্ধে গুরু শৈলজারঞ্জনের মন্তব্য -- "যেমন ওর কন্ঠসম্পদ, তেমনি লাবণ্য ওর পরিবেশনে । ওর কন্ঠ তো লজ্জা দেয় সহযোগী যন্ত্রদের ।" রবীন্দ্রনাথের গান বাস্তবিকই সুরে ও ভাবে ব্যাখ্যার অতীত এক নান্দনিকতায় পূর্ণ হয়ে উঠত তাঁর কন্ঠে ।

    সুবিনয় রায়ের কর্মজীবনের পাশাপাশি তাঁর সঙ্গীতজীবন চলতে থাকে । গ্রন্থাগারিক বিদ্যা অর্জন করতে তিনি বিলাত যান ও সেখান থেকে ফিরে ইণ্ডিয়ান স্ট্যাটিসটিক্যাল ইনস্টিট্যুট-এ যোগদান করেন । কলকাতার প্রখ্যাত সঙ্গীত শিক্ষায়তন `গীতবিতান' ১৯৪১-এ প্রতিষ্ঠার শুরু থেকেই তিনি সেখানে শিক্ষকতা করতেন । `গীতবিতান' উত্তর কলকাতার শাখা এক সময় সরকার লেনে তাঁর নিজগৃহে স্থাপিত হয় । ১৯৪৮-এ `দক্ষিণী' স্থাপিত হলে সেখানে প্রথম থেকেই শিক্ষক ও পরিচালক হিসেবে যোগদান করেন । পরে `গীতবীথি', `গান্ধর্বী' ইত্যাদি প্রতিষ্ঠানেও তিনি সঙ্গীত শিক্ষকতা করেন । শিক্ষক হিসেবে তিনি ছিলেন আক্ষরিক অর্থেই আদর্শ । তাঁর শিক্ষাদান প্রণালীতে তিনি ছিলেন প্রবাদপ্রতিম । সঙ্গীত শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে স্বরপ্রয়োগে তিনি ছিলেন অতীব যত্নশীল এবং লয় তাল সম্বন্ধে নিখুঁতভাবে সতর্ক । তাঁর রচিত "রবীন্দ্রসঙ্গীত সাধনা" একটি অতি মূল্যবান গ্রন্থ -- শিক্ষার্থী, গায়ক এমনকি অন্য শিক্ষকদের পক্ষে অতি প্রয়োজনীয় । তাঁর ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে অনেকেই আজ বিখ্যাত শিল্পী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত -- অভিরূপ গুহঠাকুরতা, সংঘমিত্রা গুপ্ত, রীতা ঘোষ, সুরঞ্জন রায় প্রমুখ । অতি মননশীলতার সঙ্গে শিক্ষাদানের সময় প্রথমদিকে তাঁর শিল্পীসত্তা খানিকটা চাপা পড়ে যায় । জনপ্রিয়তা বা প্রচারের জন্য তিনি কোনোদিন ব্যস্ত হননি, স্বীকৃতির অপেক্ষাও রাখেননি । প্রধানত: সঙ্গীতের উত্কর্ষ সাধনেই ব্রতী থেকেছেন । কিন্তু অল্পদিনের মধ্যে সঙ্গীতের কাব্য-চেতনা, নিখুঁত স্বরক্ষেপণ, রাগ-বিশ্লেষণ, তাল লয় বোধ, মার্জিত মধুর কন্ঠ, পরিশীলিত গায়কির জন্য তিনি রবীন্দ্রসঙ্গীত জগতে সর্বোত্তম স্থান অধিকার করে নেন এবং সঙ্গীতাচার্য অভিধায় ভূষিত হন । আকাশবাণীতে পঞ্চাশ বছরের ওপর তিনি অনুষ্ঠান করেছেন । মনে হয় মঞ্চে একক অনুষ্ঠানের সংখ্যার ক্ষেত্রেও তাঁকে অতিক্রম কেউ করতে পারেনি । তাঁর গাওয়া গানের অগণিত রেকর্ড, ক্যাসেট ও সিডি রয়েছে । দেশে-বিদেশে হৃদয়স্পর্শী সঙ্গীত পরিবেশন করে শ্রোতাদের ও শিক্ষার্থীদের রুচিবান করেছেন, এ তাঁর অনন্য অবদান ; কারণ তাঁর গান মনের একেবারে ভিতরে নিয়ে যেতে দরকার কিছু উপলব্ধি ও পরিশীলনের ।

    ভারতীয় রাগরাগিণীর অন্তর্নিহিত ভাবরূপের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ তাঁর গানের কাব্যরূপটির এক অপরূপ সামঞ্জস্য-সাধন করেছিলেন । এইজন্য বলা হয় ভারতীয় সঙ্গীতের ঐতিহ্যের ইতিহাসে রবীন্দ্রসঙ্গীত একটি বিশেষ সঙ্গীতধারা হয়ে উঠেছে । সুবিনয় রায় মনে করতেন ও বলতেন "বাংলা কাব্যধর্মী সঙ্গীত রচনার উত্কৃষ্টতম নিদর্শন ও সম্পদ হলেও কার্যত রবীন্দ্রসঙ্গীতকে ভারতীয় সঙ্গীতের পরিপ্রেক্ষিতে গ্রহণ করতে হবে । সাংগীতিক মাপকাঠির সাহায্যেই রবীন্দ্রসঙ্গীতের মূল্যায়ন হবে এবং সুদূর ভবিষ্যতে ভারতীয় সঙ্গীতেরই একটি স্বতন্ত্র ধারা হিসাবে যুগে যুগে প্রবাহিত হয়ে চলবে ।" রাগসঙ্গীতে উচ্চশিক্ষিত ছিলেন তিনি । উচ্চাঙ্গসঙ্গীতে প্রগাঢ় পাণ্ডিত্য ও সঙ্গীতভাবনা তাঁকে রবীন্দ্রনাথের রাগনির্ভর ধ্রুপদী সঙ্গীতগুলি গাইতে উদ্বুদ্ধ করেছিল । তাঁর সময়ে এই পর্যায়ের গান খুব কম গায়কই এত বহুল সংখ্যায় গেয়েছেন । বস্তুত রবীন্দ্রনাথের এই গানগুলি শোনা ও শেখার আগ্রহকে তিনিই আমাদের মধ্যে জাগিয়ে দিয়েছেন । শান্তিদেব ঘোষ বলে গেছেন "গুরুদেবের হিন্দি ভাগ পূজা পর্যায়ের গানগুলিকে রসোত্তীর্ণ করে তোলা অতি কঠিন হলেও ঐ গানের রস প্রকাশে সুবিনয়ের দক্ষতা প্রশংসনীয় ।" রবীন্দ্রনাথের রাগাশ্রয়ী অনেক গান তিনি গেয়েছেন । ধ্রুপদ গানের মধ্যে হিন্দিভাঙা -- জগতে তুমি রাজা (কানাড়া, চৌতাল), জাগ জাগ রে (তিলক কামোদ, তেওড়া), পান্থ এখনও কেন (ললিত, সুরফাঁকতাল), হে মহাপ্রবল বলী (মিশ্র কানাড়া, চৌতাল), ভক্তহৃদিবিকাশ প্রাণবিমোহন (ছায়ানট, সুরফাঁকতাল), সুন্দর বহে আনন্দ (ইমনকল্যাণ, সুরফাঁকতাল) ইত্যাদি গানগুলিতে সঙ্গীতের যে রস পরিবেশিত হয়েছে তা এককথায় তুলনাহীন । রবীন্দ্রনাথের সেই কথাটি -- "সংগীত সুরের রাগরাগিনী নয়, সংগীত ভাবের রাগরাগিনী" -- যেন মূর্ত হয়ে ওঠে তাঁর গানে । ধামার তালেও তাঁর গাওয়া জাগে নাথ জ্যোত্স্নারাতে (বেহাগ), সুধাসাগর তীরে (নায়কী কানাড়া) ইত্যাদি গানে রাগ ও তালের দুরূহতাকে ছাপিয়ে সুর ও ভাবের এক অপূর্ব মায়াজাল সৃষ্টি হয়েছে । এইভাবে রবীন্দ্রনাথের খেয়াল, টপ্পা ও ঠুংরির অঙ্গের যে গানগুলি তিনি গেয়েছেন সেসবও অনুপম গীতরসে সিঞ্চিত হয়ে উঠেছে । হিন্দিভাঙা খেয়াল পর্যায়ের গানের মধ্যে আজি মম জীবনে (আড়ানা, ত্রিতাল), এ কী এ সুন্দর শোভা (ইমনভূপালি, ত্রিতাল), জগতে আনন্দযজ্ঞে (রবীন্দ্রনাথের নিজস্ব খেয়াল পর্যায়ের রচনা), হৃদয়নন্দনবনে (ললিতাগৌরী, ঝাঁপতাল), কোথা যে উধাও হল (মিঞা-মল্লার, ত্রিতাল) ইত্যাদি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য । রবীন্দ্রনাথের নিজস্ব হিন্দিভাঙা টপ্পা এ মোহ আবরণ (ইমন, আড়াঠেকা) বা এ কী করুণা, করুণাময় (বাহার, আড়াঠেকা) সুবিনয় রায়ের কন্ঠে অসামান্য নৈপুণ্যে পরিবেশিত হয়েছে । বিশেষ করে উল্লেখ্য এ মোহ আবরণ গানটি যে দক্ষতায় তিনি তালে গেয়েছেন তা বিস্ময়কর ও শিক্ষণীয় । এই পর্বের গানগুলির মধ্যে অধিকাংশই রবীন্দ্রনাথের ব্রহ্মসঙ্গীত পর্যায়ের, যেগুলির গায়নে আধ্যাত্মিক আর্তির ভাবিট গভীরভাবে পরিস্ফূট ।

    প্রখ্যাত সঙ্গীতব্যক্তিত্ব রাজ্যেশ্বর মিত্র বলেছিলেন, "আমার দীর্ঘজীবনে বহু দিগ্বিজয়ী ওস্তাদ এবং গায়কগায়িকা দেখেছি, কিন্তু সুবিনয় রায়ের মতন সঙ্গীতে এত শিক্ষিত ব্যক্তি আজও আমার চোখে পড়েনি । কনফারেন্সে ভারতবিখ্যাত ওস্তাদ গান গাইছেন, কিন্তু তার ঠিক সুরে বাঁধা নেই, এবং সেটা তাঁদের কানেও ধরা পড়েনি । পক্ষান্তরে সুবিনয়বাবুকে দেখেছি কয়েক সেকেণ্ডে নিখুঁতভাবে তানপুরা বেঁধে দিচ্ছেন এবং সুরের ইন্দ্রজাল ছড়িয়ে পড়ছে । রবীন্দ্রসঙ্গীতে সুবিদিত এই গায়ক -- ভারতীয় সঙ্গীতে ব্যুত্পন্ন এবং কাব্যসঙ্গীতের নানা ধারায় তাঁর গান অসামান্য, যদিও তিনি সবদিকে বিচরণ করেননি ।" রাজ্যেশ্বরবাবুর এই কথাগুলিতে সুবিনয় রায়ের বিরল সঙ্গীতপ্রতিভার রূপ পূর্ণ উদ্ঘাটিত হয় ।

    উচ্চাঙ্গের গানগুলির পাশাপাশি তাঁর গাওয়া রবীন্দ্রনাথের সহজ সুরের, সহজ ভাবের গানগুলি প্রাণকে আন্দোলিত করেছে -- মনে হয়েছে তারা "যেন রসের স্রোতে রঙের খেলা" । গানগুলির অন্তর্নিহিত বাণীকে রাঙিয়ে তুলেছেন সুরে -- উপলব্ধিতে তা হয়ে উঠেছে অনির্বচনীয় । ভুলতে পারি না -- নীল আকাশের কোণে কোণে, আমার আপন গান, শ্রাবণের পবনে আকুল, আমার প্রানের পরে, তুই রে বসন্ত সমীরণ, নিদ্রাহারা রাতের এ গান ইত্যাদি । গানগুলি কী অনায়াস স্বাচ্ছন্দ্যে গাওয়া -- কোনও চমক বা আবেগের বাহুল্যে তা ক্লিষ্ট হয়নি, অথচ মাধুর্যে ও তন্ময়তায় তা ব্যতিক্রমী হয়ে উঠেছে । সুবিনয় রায়ের গানে বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহার ছিল অত্যন্ত সংযত ও রুচিকর এবং গানের অর্থের সঙ্গে মানানসই । গানকে কখনোই ছাপিয়ে যেত না তাঁর `মিউজিক অ্যারেঞ্জমেন্ট' । তাঁর উচ্চারণ অতি স্পষ্ট, মধুর, ও সুখশ্রাব্য ।

    একসময় তিনি শচীনদেব বর্মণের গানও গাইতেন । যাঁরা শুনেছেন তাঁরা তাঁদের মুগ্ধতার কথা ব্যক্ত করেছেন সপ্রশংসভাবে । রবীন্দ্রসঙ্গীত ছাড়াও সুবিনয় রায় বিভিন্ন রচনাকারের লেখা অধুনা প্রায়বিস্মৃত রত্নভাণ্ডার সদৃশ ব্রহ্মসঙ্গীতও গেয়েছেন বেশ কিছু । রবীন্দ্রনাথের সুর দেওয়া দুটি বেদমন্ত্র -- শৃণ্বন্তু বিশ্বে (ঋগ্বেদ), যা আত্মদা বলদা (ঋগ্বেদ) এবং শ্বেতাশ্বেতর উপনিষদের তমীশ্বরাণাং পরমং মহেশ্বরাং তিনি গেয়েছেন । বিভিন্ন মাঙ্গলিক অনুষ্ঠানের শুরুতে এই সব বেদগান গীত হবার রীতি এ দেশে বহু প্রাচীন কাল থেকে চলে এসেছে । শ্রোতাদের অনুভবে এর আবেদন সুগভীর । এছাড়া দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিশ্বভুবনরঞ্জন, ব্রহ্ম পরমজ্যোতি, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের আজ আনন্দে প্রেমচন্দ্রে, গণেন্দ্রনাথ ঠাকুরের গাও হে তাঁহার নাম, যদুভট্ট রচিত বিপদ ভয় বারণ, সীতানাথ তত্ত্বভূষণের হরি হে এই কি তুমি, আবোলতাবোল ও হ-য-ব-র-ল'এর স্রষ্টা সুকুমার রায় রচিত প্রেমের মন্দিরে তাঁর আরতি বাজে, ইত্যাদি গানও গেয়েছেন, ব্রহ্মসঙ্গীতের অন্তর্নিহিত ভাবগম্ভীর রূপটিকে অসামান্য নৈপুণ্যে প্রকাশ করে ।

    অনেক সময়েই ভেবেছি কোথায় সুবিনয় রায়ের গানের এই মুগ্ধতা, এই নান্দনিক অনুভূতি, কেন তা আমাদের মনের মধ্যে একটা অব্যক্ত আকুলতা এনে দেয় -- সে কি শুধুই তাঁর কন্ঠনি:সৃত তুলির টানের মতো সুরের রেশ, না কথার অনির্বচনীয় প্রকাশ, না কি ভাবের অপূর্ব উন্মীলন -- সেভাবে আলাদা করে কোনো উত্তর পাইনি । আসলে তাঁর গান একটা সম্পূর্ণ, সামগ্রিক ব্যাপার -- যেন সেই "নানা সুরের আকুল ধারা, মিলিয়ে দিয়ে আত্মহারা" । কিশোর বয়স থেকে তাঁর ও তাঁর পরিবারের সঙ্গে বিশেষ পরিচয় ও নৈকট্যের সূত্রেই তাঁকে এভাবে দেখতে ও বুঝতে পেরেছি । সাংসারিক বা জাগতিক ব্যাপারে তিনি ছিলেন খানিকটা নিস্পৃহ, একমাত্র সঙ্গীতই ছিল তাঁর `প্যাশন' । বেশ লক্ষ করতাম, বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গানের চয়নের ক্ষেত্রে তাঁর মননশীলতা, এককথায় তাঁকে একজন গভীর ইন্টেল্যেক্চ্যুয়াল গায়ক বলা যায় । প্রয়াত শান্তিদেব ঘোষের এক সম্বর্ধনা অনুষ্ঠানে তিনি গাইলেন তোমায় যতনে রাখিব হে, হে মহাপ্রবল বলী । তাঁর অতি নিকট এক প্রিয়জনের মৃত্যুতে তিনি গাইলেন কেন বাণী তব নাহি শুনি নাথ হে -- কোনো স্মরণ-অনুষ্ঠানে এই ধরণের গান চয়ন করার জন্য যথেষ্ট মেধা ও অনুভূতির দরকার; আমাদের যা ভাবতে শেখায় । ঘনিষ্ঠ এক সহকর্মীর কাজ থেকে অবসর নেওয়ার বিদায়-অনুষ্ঠানে তিনি গাইলেন কে বলে যাও, যাও আমার যাওয়া তো নয় যাওয়া । সেদিনের অনুষ্ঠানের বিষাদময় পরিস্থিতি মুহূর্তে বদলে গেল এক সৌন্দর্যময় বিদায়ী সম্ভাষণের দিকে, এ-কথা তাঁর সুযোগ্য পুত্র সুরঞ্জনের কাছ থেকে আমি শুনি ও আনন্দ পাই খুব ।

    রবীন্দ্রনাথ একবার দিলীপকুমার রায়কে আলোচনা প্রসঙ্গে বলেছিলেন -- "গানে যে আলো মনের মধ্যে বিছিয়ে যায়, তার মধ্যে আছে এই দিব্যবোধ যে, যা পাবার নয় তাকেই পেলাম আপন করে, নতুন করে । এই বোধ যে, জীবনের হাজারো অবান্তর সংঘর্ষ, হানাহানি, তর্কাতর্কি - এ সব এর তুলনায় বাহ্য -- এই'ই হল সারবস্তু -- কেননা, এ হল আনন্দলোকের বস্তু ।" এই প্রেক্ষিতে মনে হয় সুবিনয় রায়ের গান নিরন্তর বয়ে যাওয়া অনন্ত আনন্দধারার বোধটিকে আমাদের মনের মধ্যে জাগিয়ে দিয়েছে, যা আমাদের জীবনকে এক অভাবনীয় সৌন্দর্য দান করেছে ।


  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments