• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৩৩ | এপ্রিল ২০০৪ | গল্প
    Share
  • অমৃতের সন্ধানে : ইন্দ্রনীল দাশগুপ্ত





    সরযূ নদীর জলে সন্ধ্যাবেলা নেমেছিলেন এক প্রৌঢ় ঋষি। গৌরবর্ণ এই ঋষির ঋজু এবং বলিষ্ঠ দেহে কোনো চিহ্ন ছিল না বার্ধক্যের। তাঁর কেশ ও শ্মশ্রুও সম্পূর্ণ পলিত নয়। কিন্তু মন্ত্রোচ্চারণের পর জলে নিজের প্রতিবিম্ব দেখে হঠাৎ ঋষির মনে হল যে তাঁর মৃত্যু ঘনিয়ে এসেছে। জীবনের অসম্পূর্ণ সব কাজ করে যাবার জন্য হাতে আছে মাত্র কয়েকটি দিন।

    এই ঋষির নাম যাজ্ঞবল্ক্য।

    চিন্তিত মুখে বাড়িতে ফিরলেন ঋষি। যাজ্ঞবল্ক্যের দুই স্ত্রী বর্তমান। পড়ে আছে একটি অসম্পূর্ণ গ্রন্থও। সেটির দিকে মন দিতে পারলেন না। বারবার তাঁর মনে হতে লাগল যে মৃত্যুর আগে যা কিছু সম্পত্তি রয়েছে সেগুলি যোগ্য উত্তরাধিকারীদের হাতে তুলে দেওয়া প্রয়োজন।

    পরের দিন প্রত্যুষে ঋষি তাঁর দুই স্ত্রীকে ডেকে বললেন - আমার মৃত্যু আসন্ন। এবার গৃহত্যাগ করে বাণপ্রস্থে যাবার সময়। যা কিছু ভু-সম্পত্তি আছে তা তোমাদের মধ্যে ভাগ করে দিয়ে যাব। কিন্তু কার ভাগে কী দেওয়া উচিত সেটা ঠিক করতে পারছি না। তোমরা সংসারের সমস্ত কাজে এতদিন আমাকে সাহায্য করে এসেছ। আজ এই কাজেও তোমাদেরই সাহায্য চাই।

    প্রথমা স্ত্রী কাত্যায়নীর কিছুটা বয়স হয়েছে। যাজ্ঞবল্ক্যের যখন নাম-ডাক হয়নি তখন স্বামীর সঙ্গে অর্ধভুক্ত থেকে কাটিয়েছেন বহুদিন। জীবনধারণের সেই সংগ্রাম তার চিহ্ন রেখে গেছে কপাল ও মুখের রেখায়। কয়েকটি পুত্র-কন্যাও হয়েছে তাঁর।

    দ্বিতীয়া স্ত্রী মৈত্রেয়ী সদ্যযুবতী। কয়েক বছর আগে যাজ্ঞবল্ক্য হঠাৎ দ্বিতীয়বার দারপরিগ্রহ করে ফেলেছিলেন। তখন মৈত্রেয়ী তরুণী হলেও সাধারণ অনূঢ়া ঋষিকন্যাদের তুলনায় বয়সে বড়ই ছিল। বিবাহে তার বিন্দুমাত্র রুচি ছিল না। যাজ্ঞবল্ক্যের খ্যাতির জন্য কৌতুহলবশতই বোধহয় এ বিবাহে সম্মত হয়। তারপর থেকে সে আপন মনে থাকে। খুব কম কথা বলে। তার মধ্যে একটা উদাস ভাব আছে। কিসে তার আসক্তি বোঝা যায় না। হয়ত এমন সুদূর কিছুর প্রত্যাশায় সে আছে কোনোদিন যার নাগাল পাওয়া যাবে না। যাজ্ঞবল্ক্য টের পান যে অনেক চেষ্টা করেও তিনি মৈত্রেয়ীর মন জয় করতে পারেননি।

    কাত্যায়নীও ঋষিকন্যা। কোনোমতেই তাঁকে লোভী বলা যায় না। কিন্তু এ সংসারে সবকটি প্রাণীর সুখ ও স্বাচ্ছন্দ্যের ভার এতদিন ধরে তাঁর হাতেই রয়েছে। তিনি জানেন যাজ্ঞবল্ক্য বা মৈত্রেয়ী কারোই অভিজ্ঞতা নেই গৃহ, ভূমি এবং গো-সম্পত্তি রক্ষা করার। একমাত্র তিনিই পুত্রদের সহায়তায় এ কাজটি চালাতে পারবেন। তাই আলগোছে তিনি বললেন - সম্পত্তি তো আর স্বর্গে নিয়ে যাব না। তোমার ছেলেপুলেদের মানুষ করতেই লাগবে সেটা। সুতরাং তাদের যাতে চলে যায় সেরকম ভূমি আর গো-ধন আমাকে দিও। বাকিটা মৈত্রেয়ীকে দিলেও তার দেখাশোনাও তো আমাকেই করতে হবে।

    যাজ্ঞবল্ক্য মৈত্রেয়ীর দিকে চাইলেন। মৈত্রেয়ীর দৃষ্টি সবসময়েই দূরের কোনো বস্তুর উপর নিবদ্ধ থাকে। যেন সে এই পৃথিবীর মানুষ নয়, অন্তরীক্ষ থেকে বেড়াতে এসেছে। যাজ্ঞবল্ক্য বললেন - মৈত্রেয়ী, তোমার কী চাই বলো। মৈত্রেয়ী বলল - আমার কিছু চাই না। এসব গরু-বাছুর আপনি দিদিকেই সব দিয়ে যান। আমি তো দিদির আশ্রয়েই আছি।

    যাজ্ঞবল্ক্য শুনে খুশি হলেও এরকম অসমবন্টনের ব্যবস্থা পুরোপুরি মানতে পারছিলেন না। যদি পরে কলহ হয় তাহলে মৈত্রেয়ীকে কে দেখবে? তাছাড়া মৈত্রেয়ীর কোনো সন্তানও হয়নি।

    যাজ্ঞবল্ক্য বললেন - কিছুটা ভূমি অন্তত তুমি নাও।

    মৈত্রেয়ী বলল - ভূমি পেলে কি আমি অমর হতে পারব?

    যাজ্ঞবল্ক্য বললেন - না।

    মৈত্রেয়ী বলল - তাহলে ভূমি নিয়ে আমি কী করব?

    এরপর যাজ্ঞবল্ক্য যতবারই কিছু দিতে চাইলেন মৈত্রেয়ীকে ততবারই মৈত্রেয়ী তা প্রত্যাখ্যান করল। যা দিয়ে মানুষ অমর হয় না এমন কোনো কিছুরই তার প্রয়োজন নেই।

    সেদিনকার মত আলোচনা সাঙ্গ হল।




    যাজ্ঞবল্ক্য একটি কঠিন সমস্যায় পড়ে গেলেন। জনকরাজকে তিনি ব্রহ্মণের স্বরূপ ব্যাখ্যা করে যে উপদেশগুলি দিয়েছিলেন সেগুলি বৃহদারণ্যক উপনিষদে সংকলিত হয়েছে। লোকেরা তার কিছুটা পড়ে এবং অনেকটাই না বুঝে চাউর করে দিয়েছে যে ঋষি যাজ্ঞবল্ক্যের কাছে এমন একটি মৃত্যুঞ্জয় বিজ্ঞান আছে যা লাভ করলে মানুষ অমর হয়। একমাত্র তাঁর বহুকালের সহধর্মিণী কাত্যায়নী এসব উড়ো কথায় কান দেন না। নিশ্চয়ই মৈত্রেয়ীর কৌতুহল উদ্দীপিত করেছে এইসব রটনা। এবং সে অমরত্বের বিজ্ঞানটিই উত্তরাধিকারসূত্রে লাভ করতে চায় স্বামীর কাছ থেকে।

    দুটো দিন যাজ্ঞবল্ক্য স্ত্রী-পুত্রদের এড়িয়ে গ্রন্থ রচনার কাজে ব্যয় করে দিলেন। প্রকৃতপক্ষে কোনো কাজ হচ্ছিল না। কেবলমাত্র মৈত্রেয়ীর মুখোমুখি যাতে না হতে হয় সেই চেষ্টাই করে যাচ্ছিলেন। কিন্তু তৃতীয় দিনের দিন সরযূর জলে অবগাহন করার সময় যাজ্ঞবল্ক্য দেখলেন তাঁর গাত্রের রঙ যেন দগ্ধ সমিধের মত হয়ে গেছে। তাঁর হাতের চেটো দুটি রক্তাভ ছিল - সেগুলিও হয়ে গেছে দাহের পর পড়ে থাকা ভস্মের মত সাদা। মৃত্যু আরো এগিয়ে এসেছে অনুমান করে যাজ্ঞবল্ক্য অতি দ্রুত ফিরে এলেন গৃহে। পরদিন ভোর হবার বেশ খানিকটা আগে জাগালেন মৈত্রেয়ীকে।




    উষার প্রথম আলো ফোটার আগে সরযূর কূলে বসিয়ে মৈত্রেয়ীকে ব্রহ্মণের স্বরূপ বোঝালেন যাজ্ঞবল্ক্য। বললেন - মনে করো এই বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ডে তুমি একা একটি সত্তা। বিশ্বকে তুমি দেখবে, উপলব্ধি করবে কীভাবে?

    মৈত্রেয়ী বলল - চোখ দিয়ে।

    যাজ্ঞবল্ক্য বললেন - মনে করো চক্ষুদুটি কেড়ে নেওয়া হয়েছে তোমার।

    মৈত্রেয়ী বলল - শুনব। কান দিয়ে।

    যাজ্ঞবল্ক্য বললেন - মনে করো শ্রবণ ইন্দ্রিয়ও বিনষ্ট হয়ে গেছে তোমার।

    নদীর শীতল সুগন্ধ হাওয়ায় নি:শ্বাস নিয়ে মৈত্রেয়ী বলল - গন্ধ নেব। হাত দিয়ে স্পর্শ করে দেখব।

    যাজ্ঞবল্ক্য তখন বললেন - স্পর্শ, গন্ধ, স্বাদ - সব ইন্দ্রিয়ই যখন লুপ্ত তখন জগৎকে কীভাবে উপলব্ধি করবে তুমি?

    মৈত্রেয়ী চোখ বন্ধ করে বসে ছিল। সে উত্তর দিতে পারল না।

    উষার প্রথম কিরণ এসে স্পর্শ করল তার কপাল। যাজ্ঞবল্ক্য নিজের দুটি আঙুল ঠেকালেন মৈত্রেয়ীর বন্ধ দুচোখের পাতায়। তড়িত্স্পৃষ্টের মত চমকে উঠে মৈত্রেয়ী বলতে গেল - তুমি কে? কিন্তু কোনো কথা বেরোলো না তার গলা দিয়ে। তার শরীর ঋজু অবস্থাতেই শিথিল হয়ে গেল। মাথার খোঁপাটা খুলে পড়ল কোলে। দুই অপাঙ্গ দিয়ে গড়িয়ে পড়তে লাগল এক এক ফোঁটা জল।




    মৈত্রেয়ী দেখল কালো অন্তরীক্ষে একটি তারার ছায়াপথের মধ্যে কোনো আকাশযানের ভিতর ভাসছে সে। তাকে ঘিরে রেখেছে আরো তিনটি আলোর অবয়ব। লক্ষ লক্ষ তারা দিয়ে গঠিত হয়েছে তাদের শরীর। জ্যোতিষ্কগুলির মধ্যবর্তী আলোর তরঙ্গগুলি যেন তাদের স্নায়ু।  কোনো ভাষার ব্যবহার ছাড়াই তারা মৈত্রেয়ীর মস্তিষ্কে মুহূর্তের মধ্যে পাঠিয়ে দিচ্ছে অসংখ্য বিজ্ঞান, অসীম দর্শন ও অজস্র করুণা। মৈত্রেয়ী দেখল যেন বিশ্বের কোনো ভাবনা, কোনো স্মৃতিই ধ্বংস হয়নি। আলোর অবয়বগুলো তাকে নিয়ে গেল একটি মাঠের মধ্যে, যেখানে বহুদিন আগে তার দেখা একটি ঘটনা যেন আবার ঘটতে লাগল তার চোখের সামনে।

    মৈত্রেয়ী দেখল একজন যুবক ঋষি একটি কিশোরী মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে গাছের তলায় বসে কিছু লিখছেন। মেয়েটি মাঝে মাঝে উত্তেজিত হয়ে ছিঁড়ে দিচ্ছে ঋষির ভুর্জপত্রগুলি। ঋষি তখন তার কপালে হালকা করে আঙুল বুলিয়ে দিয়ে শান্ত করছেন তাকে। একটু ভালো করে লক্ষ করার পর মৈত্রেয়ী বুঝল মেয়েটি শুধু অন্ধ নয়, কথাও বলতে পারছে না। আঙুল বুলিয়ে দেবার সময় তার কপালে দ্রুত হাতে কিছু লিখে দিচ্ছেন ঋষি। মৈত্রেয়ীর মনে হল ঋষি যেন লিখলেন - জল। মেয়েটিও শান্ত হয়ে গেল। একটু পরে ঋষি উঠে চলে গেলেন আশ্রমের ভিতর। মৈত্রেয়ী গাছের আড়াল থেকে বেরিয়ে মেয়েটির পাশে গিয়ে বসল। মেয়েটি সত্যিই মূক। সে মৈত্রেয়ীর উপস্থিতি অনুভব করে অস্থির হয়ে উঠেছিল, কিন্তু কিছু বলতে পারছিল না। সে হাতড়ে হাতড়ে মৈত্রেয়ীকে খুঁজে বের করল এবং তার চোখ মুখ স্পর্শ করতে লাগল। মৈত্রেয়ী নিজের দুচোখ বন্ধ করে নিল। মনে মনে ভাবল তারও বাক্‌, চক্ষু এবং শ্রোত্র অবলুপ্ত। মেয়েটি তার বাহুতে কী লিখছে মৈত্রেয়ী তা বুঝতে পারছিল না। মৈত্রেয়ীর মনে হচ্ছিল যে তার ইন্দ্রিয়গুলো আর কোনোদিন ফিরে আসবে না। বহুযুগ আগের অতীত থেকে উত্থিত হয়ে অনেকগুলি অপূর্ণ ইচ্ছে যেন তার মধ্যে জন্ম নিচ্ছে। অন্ধ ঋষিকন্যাটি আবার লিখল - তোমার নাম কী? তুমি কে?

    এবার কিছু না ভেবেই মৈত্রেয়ী মন্ত্রমুগ্ধের মত মেয়েটির বাহুতে যে নামটি লিখল সেটি তার নিজের নামই নয়। কেউ যেন তাকে দিয়ে লিখিয়ে নিল - আমি তমসা।

    নামটি মনে আসা মাত্র মৈত্রেয়ীর মাথা ঘুরতে লাগল এবং তার মনে হল চক্রাকারে ঘুরতে ঘুরতে সে প্রচণ্ড বেগে নিক্ষিপ্ত হচ্ছে সেই রহস্যময় আকাশযান থেকে। নিজের অতি পুরাতন একটি পরিচয় তার মনে এক নিমেষের জন্য কোলাহলের মত উদিত হয়েই আবার তলিয়ে গেল বিস্মৃতির অতলে।




    যাজ্ঞবল্ক্য হাত সরিয়ে নিয়ে বললেন - আমার পক্ষেও এই বিজ্ঞান ধারণ করা সম্ভব নয়। সে জন্য মৃত্যুকেই বেছে নিয়েছি আমি।

    মৈত্রেয়ী বলল - এই বিজ্ঞান কি আমায় অমর করে দেবে?

    যাজ্ঞবল্ক্য বললেন - যদি তাই চাও। তাহলে ওই অমর মস্তিষ্কগুলির সঙ্গে অন্তরীক্ষে অবস্থান করতে হবে একদিন।

    - ওরা কারা? কী করে? জিজ্ঞেস করল মৈত্রেয়ী।

    যাজ্ঞবল্ক্য বললেন - প্রকৃতই সবকিছু জানি না আমি। হয়ত বহুযুগ আগে কোনো জ্যোতিষ্ক থেকে একটি মহান সভ্যতা অবলুপ্ত হয়ে যাবার সময় মহাকাশে লক্ষ লক্ষ তারা ও আলোর কণার সাহায্যে গঠিত একটি প্রকাণ্ড মস্তিষ্ককে অমর করে রাখার উপায় উদ্ভাবন করেছিল। সেই অমর মস্তিষ্ক অনাদিকাল থেকে বিশ্বের সমস্ত বুদ্ধিমান প্রাণীজগত্কে লক্ষ করছে। কখনো কখনো একটি করে সঙ্গী আহরণ করে সে। তারা সবাই একত্র হয়ে জটিল থেকে জটিলতর চিন্তায় গমন করে। একদিন নক্ষত্রগুলি যখন স্তিমিত হয়ে আসবে, প্রকাণ্ড থেকে প্রকাণ্ডতর হয়ে শীতল হয়ে যাবে সমস্ত আকাশ তখন ওই চিন্তার কেন্দ্রগুলি বৃহৎ হতে হতে এক একটি নীহারিকার মত বিরাট হয়ে যাবে। ওরা নিজেরাও হিমশীতল হয়ে নিভে যাওয়ার পথে ক্রমশ শ্লথ ও ধীরগতিতে আরো গণিত, বিজ্ঞান, দর্শন ও শিল্পের চর্চা করে যাবে। ওদের এক এক জনের মনের জগৎ পৃথিবীর সমস্ত মানুষের সব চিন্তা, ভাবনা, অভিজ্ঞতা, আনন্দ ও বিষাদ একত্র করলে যা হয় তার চেয়েও বিচিত্র। যে বিজ্ঞান আজ তুমি পেলে তা কালস্রোত পেরিয়ে ওই অমরবৃন্দের দলে যোগ দেবার মন্ত্র।

    মৈত্রেয়ী তখনও চোখ খুলতে পারেনি। তার অপাঙ্গ দিয়ে দুই ধারায় প্রবাহিত হচ্ছিল জল।

    যাজ্ঞবল্ক্য বললেন - তোমার চোখে জল কেন? অমরত্বের প্রকৃত মানে তো বোঝো? কখনো কখনো আমরা কী চাই সেটা ভালো করে বুঝে উঠবার আগেই আমাদের নশ্বর মানবজীবন ফুরিয়ে যায়। অমরতা সেই সীমার বন্ধন থেকে তোমাকে মুক্তি দিতে পারে। তুমি কি সেটাই চাইছিলে না?

    মৈত্রেয়ী মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানাল। কিন্তু তার চোখের জল থামল না। প্রৌঢ় ঋষিকে সে বলল - তুমিও যাবে কি আমার সঙ্গে?

    যাজ্ঞবল্ক্য বললেন - অনেকদিন আগে কাত্যায়নী আর আমার একটি কন্যা হয়েছিল। বেঁচে থাকলে তোমার বয়সীই হত। তার হাতে আমি আমার সমস্ত জ্ঞান ও সমস্ত কর্ম তুলে দিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু সে ছিল আজন্ম মূক, বধির এবং অন্ধ। অথচ কিশোর বয়সেই কী অদম্য কৌতুহল ছিল তার বিশ্বকে জানার! শুধু স্পর্শ দিয়েই সে চিনত কে বাবা, কে মা, কোনগুলি তার ভাই-বোন। বুঝত কাকে বলে জল, কাকে বলে ফুল, কাকে বলে হরিণের শিশু। এই মহাজাগতিক বিজ্ঞান তো আমি তার জন্যই আয়ত্ত করতে চেয়েছিলাম। দুর্ভাগ্য যে সে যতদিন বেঁচেছিল ততদিন আমার সাধনা সার্থক হয়নি। তাকে হারাবার দু:খ বড় গভীর। মহাকালের ভার বহন করা এই শোকজর্জর বৃদ্ধের সাধ্য নয়।

    মৈত্রেয়ীর চোখের জল কেন থামছে না যাজ্ঞবল্ক্য বুঝতে পারলেন না।




    প্রভাতের আলো যখন আশ্রমে ফুটেছিল তখন ঋষিপুত্রেরা নদীকূল থেকে ধরাধরি করে নিয়ে আসে যাজ্ঞবল্ক্যের নিষ্প্রাণ দেহ। কেউ যেন মায়াবলে ঋষির শেষ রক্তবিন্দুটি শুষে নিয়েছে। সমস্ত দেহটি ভস্মের মত শ্বেত হয়ে গেছে তাঁর।

    সন্ধ্যায় সেই সরযূরই তীরে ঋষিকে যখন দাহ করা হচ্ছিল তখন সাদা কাপড় পরা মৈত্রেয়ী এসে বসেছিল সকলের থেকে দূরে। তার দৃষ্টি তখনও নিবদ্ধ ছিল আকাশ যেখানে মিশেছে মাটির সাথে। মৈত্রেয়ীর সংসার বৈরাগ্যের কথা জানত সকলেই। যাজ্ঞবল্ক্য বেঁচে থাকলে হয়ত অমৃতের প্রতিও তার ঔদাসীন্য দেখে অবাক হয়ে যেতেন।  

    মৈত্রেয়ী এর পর আশ্রম ত্যাগ করে চলে যায় অন্যত্র কোথাও। তার লেখা কয়েকটি বিখ্যাত সূক্ত পরে কানেও এসেছিল কাত্যায়নীর। কিন্তু কতদিন সে অমৃতের পথে হেঁটেছিল তা জানা যায় না। সে কি শেষ পর্যন্ত চিনতে পেরেছিল নিজেকে? এবং বুঝেছিল সত্যি সত্যি তার মনের ইচ্ছে কী?  

    মৃত্যু থেকে অমৃতের পথে যাত্রার জন্য সে একটি মনের মতো সঙ্গী পেয়েছিল কিনা তাও জানে না কেউ।





    (চরিত্র পৌরাণিক, কাহিনী লেখকের)





    অলংকরণ (Artwork) : রাজর্ষি দেবনাথ
  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments