দিন দিন কত মানুষ জীবিকা হারাচ্ছেন তার ইয়ত্তা নেই । আমি এখন কলকাতার নাগরিক । সত্তরের গোড়ায় উত্তর শহরতলিতে তিনশো টাকা কাঠার জমিতে বাড়ি হয়েছে আমার । তখন বিটি রোডের ধার দিয়ে অসংখ্য কলকারখানা আর কাপড়ের মিল ছিল । বন্ধ হতে হতে সেগুলো এখন হাতে-গোনার পর্যায়ে । এই সব জমির গড় দাম দু-তিন লাখ কাটা । কাজ-হারানো সেই হাজার হাজার শ্রমিকের মিছিল আর তাঁদের পরিবার-পরিজন কী ভাবে বেঁচে আছেন কিছুটা জানি আমি ।
উত্তরবঙ্গের নয়াবাজারের ঘাসবাজার এলাকার শ-খানেক পরিবারের ঘাসবিক্রির জীবিকা যদি হারিয়ে যায় তা নিয়ে মাথা ঘামানোর দরকার ছিল না । কিন্তু পরিবার পরিজন-সহ ঘাসের বোঝা নিয়ে বাজারে ওই অপেক্ষার ছবি আমাকে কাঁদিয়ে দিল ।
ষাটের দশকে বর্ষাঋতুর ক'টা মাস ওই ঘাস-বিক্রেতাদের মতো আমাদের বাড়িও একটু আনন্দময় হয়ে উঠত । ঘাস বিক্রি করে দশ আনা সেরের চাল কিনতে পারতাম । বাজারে কচুর পাতায় ভাগা-দেওয়া কানকো-ফুলনো রামেশ্বর ট্যাংরা দরাদরি করে কিনতে পারতাম । ওই মাছ কেনা মানে বেশ একটা বড়লোকি-ভাব কিন্তু । ঢেঁকিছাটা আউস-চাল আর ট্যাংরা মাছের থলে নিয়ে ফেরার সময় পিঁটবিলের জলাভূমি চষে ঘাস-কাটা পিতা-পুত্রের খাটনি নিমেষেই মুছে যেত ।
জল-কাদায় ভেজা প্যান্ট । গামছা দিয়ে মালকোচা-মারা আমি, চোখে তখন চেয়ারে-শোওয়া মা । চিরদিনের মতো অসুস্থ মায়ের কাছে বাজারের সদাই মেলে ধরলে খুশির চোখদুটো দেখতে পাই । বাবাকে পিছনে ফেলে আমার হাঁটা কী ! সন্ধের মুখে মেঠোপথ আর ভূত-জঙ্গল পেরিয়ে গ্রামে-ঢোকা । `ভূত আমার পুত, পেত্নী আমার ঝি / মা-বাবা সঙ্গে আছে করবি আমায় কী !'
তখন ফাইভ । গ্রাম-সমাজে নিয়ম ছিল পাঁচ বছর না হলে হাতেখড়ি দেওয়া যায় না । আমাদের একটা পারিবারিক জীবিকা ছিল, সে রোজগারের কাহিনী আরও বেদনার । সুতরাং বাবাকে মাঝে মাঝেই অন্য কাজের সন্ধান করতে হয় । যেমন ঘাস বিক্রি ।
ধানজমি ছিল না, পুকুর ছিল না । ছিল না কিছুই । একটুখানিক ভিটেমাটি । দু'খানা শনের ঘর । বাঁশ-খুঁটির অপেক্ষায় দীর্ঘকাল তাদের মাটিমুখো ঝুঁকে-থাকা । মাথা নিচু করে ঘর-বাহির ।
দিন-শেষে হাটের খড়-বিচালি-মাখা ঝোলাগুড়ই আমাদের পরম-খাদ্য । গরম গরম রুটি সেঁকত বাবা । রুটি সেঁকার ফাঁকেই পা দু'খানা বাড়িয়ে গরম করে নেওয়া । দেখাদেখি আমিও । এই ক'মাস জল-কাদায় ঘাস কাটতে কাটতে হাজা হয়ে-যাওয়া হাত-পায়ের আঙুলগুলো দিয়ে গন্ধ বেরোত । শুকনো পাতার আগুনে ঘুম-চোখের আরাম যেন ।
গ্রামেই তো সত্যিকারের রাত দেখা যায় ! চড়বড় করে পাতা পোড়ার শব্দ, শেয়াল কিংবা কেঁদোর ডাক । তার মধ্যেই আমরা, চার ভাই মিলে নিশ্চিন্তের দিনরাত । মাটির দেওয়ালে লম্ফের আলো এঁকেবেঁকে যায় । সেই আলো আমাদের মুখে, থালার উপর । কড়াইতে ঝোলাগুড়, কিছুক্ষণের মধ্যেই পাতে পড়বে ।
স্কুল কামাইয়ের জন্য বার বার মিথ্যে বলা যায় না ! আঁশশ্যাওড়ার বেতে হাত ফেটে কত যে রক্তপাত ঘটেছে ! আমি কাউকে বলতাম না । বার বার স্কুল কামাই হলে কে চিঠি লিখে দেবে ?
ক্লাশঘরে প্রায়ই শোনা যেত - `একটা পচা গন্ধ না !' আমি দুই হাতের মুঠো চেপে রাখতাম । বন্ধুদের কথাগুলো যেন কিছুই শুনিনি, যেন স্যারের পড়াতেই মন আমার । বর্ষাঋতু আমাকে বন্ধুহারা করে দিত । বাবার ওপর রাগ হত । অভাবের ওপর রাগ হত । কিন্তু সেই রাগই জল, যখন মনে পড়ত মায়ের মুখখানা ।
বাড়ি থেকে পাঁচ মাইল হেঁটে পুঁটিবিলের মাঠ । বিক্রি আরও ছমাইল দূর বাজারের ওহিদ মোল্লার দোকানের পাশে বসে । বাবার আঁটি বড় তাই দশ আনা, আমার বোঝা এক সিকি । জলে-ধুয়ে ঘাস সাজানোর কায়দা বাবা-ই আমাকে শিখিয়ে দিয়েছিল । বাজারে নিলেই যে বিক্রি তার কিন্তু ঠিক নেই । কখনও কখনও হতও না । আবার হত যদি, ক্রেতার দাবি - ঘাসের বোঝা বাড়ি পৌঁছে দাও তো নিতে পারি ।
অসহায় পিতা আর তার ছোট পুত্র ।
বাবা আর আমার দৃষ্টি-বিনিময় । আবার তিন-চার মাইল ? কিন্তু বিক্রিটা জরুরি যে ! আটা কিনতে হবে, দুই পোয়া চাল । পয়সায় কুলোলে মাছ । মায়ের কবিরাজি-পাঁচন তো সবার আগে !
আমরা কিন্তু বেঁচে আছি । আমাদের কোনও দু:খ নেই । ঘাস কাটতে গিয়ে যতই হাতে-পায়ে ঘা হোক, গন্ধ বেরোক ! স্কুলের মতো এখনও কিছু বলব না । - এমন কিছু দেখলে কেন যে মনে পড়ায় আমার শৈশবকে, ঢেউ-আছড়ানোর মতো কাঁদায় !
এই বৃদ্ধপথেও শিশুর মতো অমন কান্না জমা থাকে ? কে জানে !