- জর্জ ডবলু বুশ, অক্টোবর ১১, ২০০১
প্রথম মহাযুদ্ধের কথাই ধরা যাক । ১৯১৪ সালের গ্রীষ্মকাল -- ইওরোপ জুড়ে বিরাজমান কয়েক দশকের শান্তি : বিপদ ঘটলো ২৮ জুন ১৯১৪ --
বসনিয়া-বাসী একজন সার্ব কবি ও উগ্র জাতীয়তাবাদী, নাম গাভ্রিলো প্রিন্সিপ -- তিনি একটি নাশকতামূলক কাজ করে বসলেন । আর্চডিউক ফার্দিনান্দ এবং তাঁর পত্নী সরকারি কাজে ভ্রমণ করতে এসেছেন অস্ট্রো-হাংগেরিয়ান সাম্রাজ্যের অন্তর্গত বসনিয়া রাজ্যের রাজধানী সারায়েভো শহরে । গাভ্রিলো ও তার দলবল ষড়যন্ত্র শুরু করলেন আর্চডিউক দম্পতিকে খুন করার জন্যে এবং প্রথম দফায় ব্যর্থ হলেও দ্বিতীয় দফায় ভাগ্যের ফেরে সফল হলেন । এই হনণের পর ইওরোপে যে খুব একটা শোকের ছায়া পড়লো তাও নয় । অস্ট্রো-হাংগেরিয় সাম্রাজ্যের সম্রাট ঠিক করলেন যে আনুগত্যহীন সার্বদের একটা উচিত শিক্ষা দিতে হবে । বন্ধুরাষ্ট্র জার্মানির কাইজার উইলহেলমও তাঁর সঙ্গে একমত, বিশেষ করে মৃত মানুষ দুজন যখন জার্মান রাজপরিবারের আত্মীয় । দুজনেরই উদ্দেশ্য সার্বদের খানিকটা ধমক ধামক দেওয়া বা আচ্ছা করে কড়কে দেওয়া, যাতে ভবিষ্যতে এমনটি আর না ঘটে । কারুরই উদ্দেশ্য ছিল না দেশটিকে আক্রমণ করা বা দখল করা, বিশেষ করে যখন রাশিয়ার জার সার্বদেশের ঘনিষ্ঠ বন্ধু, ফ্রানসের সঙ্গে রাশিয়ার সম্প্রতি সামরিক চুক্তি হয়েছে আর কান টানলে যেমন মাথা আসে ফ্রানস যুদ্ধে নামলে খালের ওপার থেকে ব্রিটেনও তার পক্ষ নিয়ে হৈ হৈ করে তেড়ে আসবে ।
এই সব কথা মনে রেখেই অস্ট্রিয়া লম্বা লম্বা নানান শর্তের লিস্টি বানিয়ে চরমপত্র দিল সার্বিয়াকে ; জার্মানি সমর্থন করলো অস্ট্রিয়াকে ; আর গুঁইগাই করলেও সার্বিয়া মেনে নিল অনেক শর্ত । কিন্তু তখন জুলাই মাস, ইওরোপের রাজারাজড়াদের লম্বা ছুটিতে যাওয়ার কথা -- এই সামান্য কারণে তো আর পরিকল্পিত ছুটিছাটা বাতিল করা যায় না । তাদের তখন "প্রমোদে ঢালিয়া দিনু মন" অবস্থা -- কেউ পাহাড়ে, কেউ সমুদ্রের ধারে, কেউ জংগলে, কেউ বিলাসবহুল জাহাজে -- খেয়ে দেয়ে, প্রচুর মদ্যপান করে, স্পা-তে গা পুড়িয়ে, উষ্ণ প্রস্রবণে সিনান সেরে, রক্ষিতা-উপপত্নী সংসর্গ করে দেশশাসকেরা যখন ফিরলেন তখন জুলাই মাস শেষ । তাঁদের অমাত্য-পারিষদ-সেনাপতিরা কিন্তু ততদিনে যুদ্ধের ব্যবস্থা সম্পূর্ণ করে ফেলেছেন, সেনাবাহিনী, অস্ত্রশস্ত্র, গোলা-বারুদ, রসদসামগ্রী পৌঁছে গেছে সীমান্তে । দ্রুতগতির ট্রেন থাকার ফলে যোগাযোগ ব্যবস্থা চমত্কার এবং একবার যুদ্ধের সাজ-সরঞ্জাম প্রস্তুত হয়ে গেলে যুদ্ধ না করে সম্মান বাঁচানো মুশকিল । সশস্ত্র, উদ্যত সেনাবাহিনীকে একবার যুদ্ধের নাম করে পাঠিয়ে খালি হাতে ফিরিয়ে আনা অসম্ভব । অতএব যুদ্ধ শুরু হল ২রা আগস্ট, চললো সাড়ে চার বছর, মৃতের সংখ্যা আশি লক্ষ (তার মধ্যে প্রায় আট লক্ষ ভারতীয় সৈন্য)। ঐতিহাসিকেরা এখনো মাথা চুলকে ভাবেন কী সামান্য কারণে শুরু হয়েছিল সেই দীর্ঘ ভয়াবহ যুদ্ধ এবং রাজা-রাজড়াগণ সেই সময় ছুটিতে না গেলে রক্তক্ষয়ী প্রথম মহাযুদ্ধ সত্যি সত্যিই বাধতো কি না ।
এবার যাওয়া যাক সাতাশি বছর পেরিয়ে -- ২০০১ সালের গ্রীষ্ম ; সেই
রাজা-রাজড়াও নেই, রাজত্বও নেই -- পৃথিবী জুড়ে হয় গণতন্ত্র, কিংবা নানান রঙের একনায়কতন্ত্র । তবে সারা পৃথিবীর রাজা বলতে গেলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি -- সেখানে রাষ্ট্রপতির নির্বাচন হয়েছে নভেম্বর ৭, ২০০০ এবং ১০৫ মিলিয়ন ভোটদাতার মধ্যে এক সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ নির্বাচিত করেছেন ডেমোক্র্যাট প্রার্থী অ্যাল গোরকে । কিন্তু ফ্লোরিডা নামক একটি রাজ্যে ভোট গোনাগুনতি এবং ভাগ বাঁটোয়ারা নিয়ে বাধলো গণ্ডগোল -- সেখানে রিপাবলিকান প্রার্থী জর্জ ডবলু বুশ শ'পাঁচেক ভোটে এগিয়ে, কিন্তু বেশ অনেক হাজার ভোট তখনও হয় গোনা হয়নি নাহয় অবৈধ বলে ঘোষণা করা হয়েছে । বিষয়টি নিষ্পত্তির এবং সুষ্ঠু সমাধানের ভার যে দুজনের হাতে তাঁরা হলেন ফ্লোরিডা রাজ্যের গভর্নর জেব বুশ, জর্জের আপন সহোদর আর সেক্রেটারি অফ স্টেট ক্যাথারিন হ্যারিস, যিনি ওই রাজ্যে জর্জের নির্বাচনী প্রচার-কমিটির সহ-সভানেত্রী । ফলে নিরপেক্ষ বিচারের কোন প্রশ্নই নেই -- অনেক জল ঘোলা হওয়ার পর সুপ্রিম কোর্ট ১২ই ডিসেম্বর ৫-৪ ভোটে জর্জ ডবলু বুশকে রাষ্ট্রপতি মনোনীত করলেন । পরের বছর বিশে জানুয়ারি তাঁর শপথ গ্রহণ -- তার আগে যখন ক্ষমতার হাতবদল এবং কাজ বুঝিয়ে দেবার পালা চলছে তখন পূর্ববর্তী প্রশাসনের জাতীয় নিরাপত্তা বিভাগের ভারপ্রাপ্ত কর্মীরা, নতুন প্রশাসনের কর্মীদের ভালোভাবেই তথ্যপ্রমাণ সহযোগে সমঝে দেবার চেষ্টা করেছিলেন দেশের মানুষের নিরাপত্তার বা পৃথিবীর নিরাপত্তার ক্ষেত্রে প্রধান সমস্যাগুলি কি কি । এক নম্বরে ছিল ওসামাবিন লাদেন ও তার সন্ত্রাসবাদী আল-কায়দা গোষ্ঠী ; তারপর উত্তর কোরিয়া, ভারতীয় উপমহাদেশের আনবিক যুদ্ধের সম্ভাবনা এই সব । এবং লিস্টির অনেকটা নীচে ছিল ইরাক ও সাদ্দাম হোসেনের গণবিধ্বংসী মারণাস্ত্র । ঘুণাক্ষরে শোনা যায় যে নতুন প্রশাসন ক্ষমতায় এসেই তালিকাটিকে এলোমেলো করে দেন -- ইরাক চলে আসে প্রথম স্থানে এবং আল-কায়দা সন্ত্রাসবাদ-এর গুরুত্ব নেমে যায় অনেক নীচে । পূর্ববর্তী এক দশকে সন্ত্রাসবাদ বিরোধী মার্কিন সরকারের প্রয়াসের প্রধান স্থপতি রিচার্ড এ ক্লার্ক তাঁর "সব শত্রুর বিরুদ্ধে" (
সে যাই হোক দেশনায়কদের ছুটি কাটানোর কথায় আসা যাক । আগস্ট ৬, ২০০১ -- রাষ্ট্রপতি বুশ ছুটিতে গেছেন টেক্সাস রাজ্যের ত্রক্রফোর্ড শহরে তাঁর নতুন কেনা খামারবাড়িতে -- তার পাত্রমিত্র অমাত্য পারিষদবর্গও গিয়েছেন তাঁর সঙ্গে । সেদিন প্রত্যূষে তাঁর
এমনিতেই মসনদে বসার পর থেকে সন্ত্রাসবাদবিরোধী কাজকর্মে বিশেষ উত্সাহ বা তত্পরতা ছিল না বুশের । ক্লিনটনের আমলে "ড্রোন" নামক এক ধরনের চালকবিহীন গুপ্তচর বিমান দিনরাত নজর রাখতো ওসামা ও তার দলবলের ওপর -- প্রতিরক্ষাসচিব রামসফিল্ড বন্ধ করে দিয়েছেন সেইসব কাজকর্ম । সন্ত্রাসবিরোধী কাজকর্মের বাজেট ৮০০ নিযুত ডলার কম করে দিয়ে সেই টাকা ঢালা শুরু হয়ে ক্ষেপণাস্ত্র নিরোধকারী প্রযুক্তিতে । কয়েকমাস আগেই আক্রান্ত হয়েছে (১০ অক্টোবর ২০০০) এডেন বন্দরে মার্কিন যুদ্ধজাহাজ ইউ এস এস কোল, খুন হয়েছেন ১৭ জন মার্কিন নাবিক । সেই ঘটনায় আল-কায়দার হাতের ছাপ স্পষ্ট এবং বিন লাদেন চতুর্থবার সাঙা করেছে ইয়েমেনের যুবতী আসোয়ার-আল-সর্দারকে, শ্বশুরমশাইকে ৫০০০ ডলার তোফা দিয়ে রাজী করিয়েছেন সেই নিকেতে -- তার আরেকটি উদ্দেশ্য ইয়েমেনের সঙ্গে আল-কায়দার রাজনৈতিক সম্পর্ক জোরদার করা ।
কিন্তু সেই সকালে ওই ভয়াবহ সংবাদ পেয়ে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সন্ত্রাসবাদী আক্রমণের কালান্তক আভাস পেয়ে বুশ কি করলেন ? মন্ত্রিসভার জরুরি বৈঠক ডেকে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করলেন ? ছুটি কাটানো বন্ধ করে সাত তাড়াতাড়ি ওয়াশিংটন ডিসিতে ফিরে এলেন ? সি আই এ, এফ বি আই আর এন এস সির প্রধানদের ডেকে ভালো করে দাবড়ে দিলেন এবং যেভাবেই হোক
সন্ত্রাসবাদকে দমন করতে নির্দেশ দিলেন ? কোনোটাই না । সকাল সকাল কাজকর্মের পাততাড়ি গুটিয়ে তিনি মহা আনন্দে ছিপ নিয়ে মাছ ধরতে বেরুলেন -- দেশের কথা, মানুষের কথা ভাববার তাঁর সময় কোথায় ? নিউ ইয়র্ক টাইমস সংবাদপত্রের রিপোর্ট অনুযায়ী বুশ সারাদিন কাটান মাছ ধরে এবং ঘুরে বেড়িয়ে বিশ্রাম করে সন্ধেবেলা বাড়ি ফিরে রাত দশটার মধ্যে ঘুমিয়ে পড়েন । স্টেটসান টুপি মাথায়, বেড়ায় হেলান দিয়ে তাঁর সেদিনকার একটি ছবিও বেরিয়েছিল । প্রথম উদাহরণের মতন এক্ষেত্রেও রাষ্ট্রপ্রধান ছুটির ফাঁদে দিন না কাটিয়ে রাষ্ট্রশাসনে ও শান্তিরক্ষার কাজে মন দিলে শেষ পর্যন্ত কি ঘটতো কে বলতে পারে ?
- ওসামা বিন লাদেন, ১৯৯৮
এইভাবে রাজপরিবারের নেকনজরে পড়লেন মহম্মদ এবং তাঁর ভাগ্যও খুলে গেল । আসির পর্বতমালার পাদদেশে তাইফ গ্রামে রাজপরিবারের বিশ্রাম প্রাসাদ -- সেখান থেকে মক্কা পর্যন্ত হাইওয়ে নির্মাণের বরাত পেলেন তিনি ; বিন লাদেন কনস্ট্রাকশন কোম্পানির প্রথম প্রজেক্ট । সেই থেকে শুরু -- আস্তে আস্তে এলো আরো অনেক নতুন কাজের ভার -- বলতে গেলে, আধুনিক সৌদি আরবের পরিকাঠামো গড়ে তুলেছে বিন লাদেন কোম্পানি । মক্কা এবং মদিনার দুটি পুণ্য মসজিদ, বিভিন্ন রাজপ্রাসাদ, বিমানবন্দর, বহুতল বাণিজ্যকেন্দ্র, রাস্তাঘাট বানিয়ে তিনি নিজে হয়েছেন কোটিপতি এবং রাজপরিবারের সঙ্গে সম্পর্ক হয়েছে ঘনিষ্ঠ থেকে ঘনিষ্ঠতর ।
রাজপরিবারের সঙ্গে ব্যবসায়িক সম্পর্ককে দৃঢ়তর করার জন্যে মহম্মদ তাদের সঙ্গে ব্যক্তিগত ও বৈবাহিক সম্পর্ক গড়ে তোলায় ব্রতী হলেন । তাঁর প্রথম তিনটি বিবিই সৌদি আরবের নারী -- রাজপরিবারের সদস্য অথবা ঘনিষ্ঠ ; তাঁদের একজন, অন্তনাম আল-খলিফা, আবার পয়গম্বর মহম্মদের বংশধর । অর্থনৈতিক রমরমা বাড়লেও পারিবারিক সূত্রে সামান্য অসুবিধে হয়ে দাঁড়ালো মহম্মদের ইচ্ছেমত নিকে/তালাক করার কাজে । তিনটি বিবিই রাজপরিবারের আশীর্বাদধন্য, অতএব তাঁদের অবস্থা মার্কিন বিশ্ববিদ্যালয়ের টেনিওরপ্রাপ্ত, অভিজ্ঞ পূর্ণঅধ্যাপকদের মত, অর্থাৎ কোন দু:সহ অপরাধ না করলে চাকরি যাওয়ার ভয় নেই । আবার শরিয়া মানলে একসঙ্গে চারটির বেশি পাণিগ্রহণের পথে দুস্তর বাধা । এবং চতুর্থ বিবির অবস্থান দাঁড়ালো চূড়ান্তভাবে দু:সহ এবং অনিশ্চিত -- অনেকটা সদ্য পি এইচ ডি সমাপ্ত করা নবীন, অস্থায়ী, সহকারী অধ্যাপকের মতন -- আজ বাদে কাল কি হবে তার স্থিরতা নেই । এক নয়, দুই নয়, তিন নয় -- চতুর্থ বিবিটির পদ অলংকৃত করেছেন আঠারো জন যুবতী -- কারুরই স্থায়িত্ব হাতে গোনা কয়েক বছরের বেশি নয় । মহম্মদের দীর্ঘ ও ফলবান জীবনে সব মিলিয়ে একুশজন পত্নী এবং চুয়ান্নটি সন্তান -- চব্বিশটি পুত্র ও তিরিশটি কন্যার জনক এই ধনী ব্যবসায়ী ও গোষ্ঠীপতি ।
পূর্ব জেরুসালেমের আল-আকশা মসজিদ ইসলাম ধর্মের আর একটি প্রধান উপাসনা কেন্দ্র -- তার রক্ষক জর্ডনের হাশেমাইট রাজা । পঞ্চাশের দশকে তিনি টেণ্ডার ডাকলেন মসজিদের আপাদমস্তক সংস্কার ও মেরামতির জন্যে ; কন্ট্রাক্ট পেল মহম্মদের কনস্ট্রাকশান কোম্পানি -- মসজিদ বানানোর কাজে তাদের খ্যাতি ছড়িয়েছে আরব দুনিয়ায় । সেই কাজের সূত্রে তাঁর বারবার জর্ডনে আসা যাওয়া -- তাঁর নজরে পড়লেন আলিয়া ঘেনেম এক উদ্ভিন্নযৌবনা সিরিয়ান নারী । আলিয়া হলেন মহম্মদের নুতনতম চতুর্থ বিবি -- একটিই সন্তান জন্মালো তাদের -- পুত্রসন্তান, পিতার সপ্তদশ পুত্রসন্তান -- নাম রাখা হল "ওসামা" । ওসামার শৈশব কেটেছে গোঁড়া মুসলমান পরিবারের কড়াশাসনে, কিন্তু স্বাচ্ছন্দে ও স্নেহে ; মা বাবার বিবাহবিচ্ছেদের পরেও মা ছেলেকে থাকতে দেওয়া হয় প্রাসাদের হাতার ভেতরেই একটি আলাদা বাড়িতে । ওসামার অল্প বয়েসের জীবন সম্বন্ধে তথ্যাদি খুবই স্বল্প এবং তার মধ্যে গল্পগাছা ও গুজবের পরিমাণও কম নয় । তাঁর মা আসলে সুন্নি মুসলমান নন, কিন্তু আলোয়াইট (সত্যি), তাঁর মা বাবার নাকি কোরানসম্মত ভাবে বিয়েই হয়নি বা ক্ষণিক যৌনসুবিধের জন্যে মুতা বিবাহ হয়েছিল (মিথ্যে), যুবক ওসামা অপরিমিতভাবে মদ্যপান করতেন এবং স্কার্ট বা বোরখা দেখলেই ধাওয়া করতেন (মিথ্যে), বেইরুট এবং পশ্চিম ইওরোপের নানান শহরের নাইটক্লাবে প্রায়ই তাঁকে সবান্ধব দেখতে পাওয়া যেত (মিথ্যে) । এমনকী বেল-বটম পরা স্কুলের ওপরের দিকের ক্লাসের ছাত্র ওসামার পাটল বর্ণের ক্যাডিল্যাকের গায়ে হেলান দেওয়া অতিপরিচিত, বিখ্যাত ছবিটিও আসলে তাঁর নয় তাঁর এক বৈমাত্রেয় ভাই-এর । এইসব গুজবে ওসামা নিজেও ইন্ধন জুগিয়েছেন তাঁর পশ্চিমবিরোধী, বিপ্লবী পরিচিতিটিকে শাণিয়ে নেবার জন্যে । ১৯৯৮ সালে সিরিয়ার এক সাংবাদিকের সঙ্গে সাক্ষাত্কারে তিনি বলেছিলেন,
মাত্র কয়েক-দশকের মধ্যে পাঁচ বিলিয়ন ডলার মূল্যের নির্মাণ ব্যবসার
১৯৭৭ সালে জেড্ডা শহরের আবদুল আজিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া শুরু করেন অর্থনীতি ও বাণিজ্য পরিচালনা শাস্ত্র ; সেই সময় থেকেই তাঁর রাজনৈতিক চিন্তাভাবনার শুরু । দুজন মৌলবাদী মুসলিম নেতার প্রভাব পড়েছিল তাঁর চিন্তাধারায় -- মুসলিম ব্রাদারহুড গোষ্ঠীর আবদুল্লা আজ্জাম এবং মিশরের ধর্মপ্রচারক মহম্মদ কুতুব । ত্রয়োদশ শতাব্দীর সুন্নি ধর্মপ্রচারক ইবন টেমিয়া (১২৬৩-১৩২৮) তাঁকে বিশেষভাবে অনুপ্রাণিত করেন । ওসামার প্রধান শত্রুতা তখন আরবজগতের তুলনামুলকভাবে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রনায়কদের (মিশরের সাদাত, লিবিয়ার গদ্দাফি, ইরানের পহেলভি) সঙ্গে, আমেরিকার সঙ্গে নয় । সৌদি আরবেও নতুন সিংহাসনে বসেছেন রাজা খালেদ, খুব পরিমিতভাবে হলেও তাঁর তুলনামুলক ভাবে উদারপন্থা ওসামা ও তাঁর দলবলের একেবারেই পছন্দ নয় । এমন সময় ১৯৭৯ সালে ইরানে ক্ষমতায় এলেন ইমাম আয়াতুল্লা খোমেইনি এবং রাজতন্ত্র সমাপ্ত করে গোঁড়া মোল্লাতন্ত্রের সূত্রপাত হল সেখানে । সৌদি আরবেও একদল সন্ত্রাসবাদী সাময়িকভাবে দখল করে ফেললো মক্কার প্রধান মসজিদ । রাজা তখন ফরাসি প্যারাট্রুপার ডেকে শান্তি ফিরিয়ে আনলেন -- অনেক রক্তস্রোত বইয়ে পুর্নদখল হল মসজিদ । ওই বছরের ডিসেম্বর মাসে আবার অঘটন -- সোভিয়েত লাল ফৌজ ক্ষমতা দখল করলো আফগানিস্তানে ; তরুণ জেহাদি বিপ্লবী ওসামার সামনে প্রথম সুযোগ এলো ধর্মযুদ্ধের । কয়েকদিনের মধ্যেই তিনি রওনা দিলেন সেখানে ।
সৌদি আরবের দুটি প্রধান সম্পদ : এক, ইসলাম ধর্মের দুটি পুণ্যতীর্থ -- পয়গম্বর মহম্মদের জন্মস্থান, মক্কা এবং তাঁর সমাধিস্থান, মদিনা ; প্রতিবছর দু মিলিয়ন মানুষ সেখানে আসেন হজ তীর্থদর্শনে ; এবং দুই, খনিজ তেল -- এখন অবধি জ্ঞাত ২৬০ বিলিয়ন ব্যারেল এবং খুব সম্ভব তার চেয়েও বেশি অজানা । দুই সম্পদেরই চমত্কার ব্যবহার হল আফগানিস্তানে । ইসলাম বিপন্ন বলে দলে দলে স্বেচ্ছাসেবী আসতে শুরু করলো বিধর্মী, ঈশ্বরবিহীন সোভিয়েত সৈন্যদের সঙ্গে লড়াই করার জন্যে ; সৌদি আরব থেকেই দশ হাজারের বেশি, অন্য আরব দেশ মিলিয়ে প্রায় পঁচিশ হাজার "আফগান আরব" । সৌদি এয়ারলাইনস অবিশ্বাস্য রকমের কম ভাড়ায় উড়ান শুরু করলে জেড্ডা থেকে পেশোয়ার । অর্থনৈতিক সাহায্য আসতে শুরু করলো সৌদি তৈলডলারের মাধ্যমে -- দশ বছরে আনুমানিক ২ বিলিয়ন ডলার । এসে জুটলো আমেরিকার গোয়েন্দাসংস্থা সিয়া, পাকিস্তানের আই এস আই ; আফগানিস্তানের সাতটি বিচ্ছিন্ন যোদ্ধাগোষ্ঠীকে একত্র করে গড়ে তোলা হল মুজাহিদিন (ঈশ্বরের যোদ্ধা) বাহিনী ; আমেরিকা থেকে প্লেন বোঝাই আসতে শুরু করলো অস্ত্রশস্ত্র -- প্রায় কয়েক লক্ষ টন -- শুরু হল সোভিয়েত বিরোধী জেহাদ । বাইশ বছর বয়েসি ওসামা হয়ে দাঁড়ালেন তার প্রধান অর্থ সরবরাহকারী । সিয়া, পাকিস্তান, সৌদি আরব, ওসামা সবাই তখন গলায় গলায় বন্ধু, যদিও সিয়ার আঞ্চলিক প্রধান মিল্টন বিয়র্ডেন পরবর্তীকালে তোরা/তালমুদ/বাইবেল ছুঁয়ে শপথ করে বলবেন তাঁদের সঙ্গে ওসামার কোনরকম সম্পর্ক ছিল না । আশির দশকে মুজাহিদিনের একটি দলকে রাষ্ট্রপতি রেগান হোয়াইট হাউসে ডেকে এনে আপ্যায়িত করেছিলেন এবং তাদের তুলনা করেছিলেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা "জাতির পিতা"দের সঙ্গে । সেই দলে ওসামা ছিলেন কিনা আমার জানা নেই ।
যুদ্ধে সোভিয়েত রাশিয়া আস্তে আস্তে পিছু হটতে শুরু করলো ; আফগান যোদ্ধারা, যাদের সম্পর্কে রাডইয়ার্ড কিপলিং লিখেছিলেন,
১৯৯১ সাল থেকে আল-কায়দার কার্যকলাপের কেন্দ্র হয়ে উঠলে সুদানের খার্তুম শহর -- পরিকল্পনা ও প্রশিক্ষণ শুরু হল আমেরিকার বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবাদী আক্রমণের । প্রথম আঘাত ১৯৯৩ সালের ২৬শে ফেব্রুয়ারি ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের পার্কিং গ্যারাজে বোমা বিস্ফোরণ -- নিহত ৬, আহত ১০৪২ । তারপর ওই বছরের অক্টোবর ৩ এবং ৪ -- সোমালিয়ার মোগাদিশু -- নিহত ১৮ জন মার্কিন সেনা, আহত ৭৫ ; যদিও মহম্মদ ফারা আইদিদের সঙ্গে আল-কায়দার যোগাযোগের কথা জানতে পারা যায় কয়েক বছর পরে । ১৯৯৫ সালের ১৩ই নভেম্বর রিয়াদে বোমা ফাটলো -- নিহত ৫ জন মার্কিন সৈন্য এবং ২ জন ভারতীয় । ১৯৯৬ এর জুন মাসে ধ্বংস হল দাহরান শহরে মার্কিন সেনানিবাস খোবার টাওয়ারস -- নিহত ১৯ জন মার্কিন সৈন্য, আহত অনেক । ১৯৯৬ সালে ওসামা সুদান ছেড়ে নতুন ঘাঁটি গাড়লেন আফগানিস্তানে -- মার্কিন সরকার সুদান সরকারকে চাপ দেবার জন্যই তাঁকে দেশটি ছাড়তে হল, কিন্তু আখেরে লাভই হল তাঁর -- ঠিক যেমন ১৯১৭ সালে জার্মানি ছেড়ে সেন্ট পিটার্সবার্গে এসে অসম্ভব সুবিধে হয়েছিল লেনিনের । একটি ছোট দলের নেতা ওসামা হয়ে উঠলেন তালিবানের সঙ্গে মিলে আস্ত একটি দেশের নেতা । বন্ধু হয়ে সঙ্গে ভিড়লো পাকিস্তানের মৌলবাদী জঙ্গী মিলিটারি -- জমে উঠলো সন্ত্রাসবাদের রমরমা । ১৯৯৮ সালের ৭ই আগস্ট একই সঙ্গে কেনিয়ার নাইরবি এবং তানজানিয়ার দার-এস-সালামের মার্কিন দূতাবাসে বিস্ফোরণ ; ২০০০ সালের ১০ই অক্টোবর ইউ এস এস কোল যুদ্ধজাহাজে আক্রমণ । এইভাবে ছোট ও মাঝারি সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপে হাত পাকিয়ে নিয়ে চললো সবচেয়ে বড় সন্ত্রাসবাদী কাজকর্মের প্রস্তুতি । অসংখ্য বিচ্ছিন্ন তথ্য, প্রমাণ, বিপদসংকেত, ভয়াবহ ইঙ্গিত থাকা সত্ত্বেও আমেরিকার নতুন সরকার তখন গভীর নিদ্রায় ।
- জন এফ কেনেডি, ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ে বক্তৃতা
চারটি বিমান, ২৪৫ জন যাত্রী, ১৯ জন সন্ত্রাসবাদী ; যাত্রীবাহী বিমানকে গণবিধ্বংসী অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার ; খুব সংক্ষেপে ঘটনাগুলির বর্ণনা :
১) আমেরিকান এয়ারলাইনসের ১১ নং উড়ান (বোয়িং ৭৬৭-২০০) ; সকাল ৭:৫৯ মিনিটে বস্টনের লোগান বিমানবন্দর ছেড়ে লস এঞ্জেলস যাত্রার পথে ছিনতাই এবং ৮:৪৬:৪০ সেকেণ্ডে বিশ্ববাণিজ্য কেন্দ্রের উত্তর টাওয়ারে গিয়ে ধাক্কা । পাঁচজন ছিনতাইকারী -- মহম্মদ আতা (পালের গোদা এবং বিমানচালক), আবদুল আজিজ আল-ওমারি, সাতাম আল-সুকামি, ওয়েল আল-শেহরি, ওয়ালিদ আল-শেহরি ।
২) ইউনাইটেড এয়ারলাইনসের ১৭৫ নং উড়ান (বোয়িং ৭৬৭-২০০) ; সকাল ৮:১৪ মিনিটে বস্টনের লোগান বিমানবন্দর ছেড়ে লস এঞ্জেলস যাত্রার পথে ছিনতাই এবং ৯:০৩:১১ সেকেণ্ডে বিশ্ববাণিজ্য কেন্দ্রের দক্ষিণ টাওয়ারে গিয়ে ধাক্কা । পাঁচজন ছিনতাইকারী -- মারোয়ান আল-শেহি (পালের গোদা ও বিমানচালক), ফায়েজ বেনিহামাদ, মোহান্দ আল-শেহরি, আমেদ আল-ঘামদি, হামজা আল-ঘামদি ।
৩) আমেরিকান এয়ারলাইনসের ৭৭ নং উড়ান (বোয়িং ৭৫৭-২০০) ; সকাল ৮:২০ মিনিটে ওয়াশিংটন ডিসির ডালেস বিমানবন্দর ছেড়ে লস এঞ্জেলস যাত্রার পথে ছিনতাই এবং ৯:৩৭:৪৬ সেকেণ্ডে পেন্টাগনের বিল্ডিঙে গিয়ে ধাক্কা । পাঁচজন ছিনতাইকারী -- খালিদ আল-মিধার, মাজেদ মোকেদ, হানি হানজোর (পালের গোদা এবং বিমানচালক), নওয়াফ আল-হাজমি, সালেম আল-হাজমি ।
৪) ইউনাইটেড এয়ারলাইনসের ৯৩ নম্বর উড়ান (বোয়িং ৭৫৭-২০০) ; সকাল ৮:৪২ মিনিটে নিউ জার্সির নেওয়ার্ক বিমানবন্দর ছেড়ে সান ফ্রানসিসকো যাত্রার পথে ছিনতাই ; উদ্দেশ্য ছিল খুব সম্ভবত ক্যাপিটল বিল্ডিং বা হোয়াইট হাউসে গিয়ে ধাক্কা, কিন্তু যাত্রীদের প্রতিরোধে প্লেনটি ভেঙে পড়ে ১০:০৩ মিনিটে পেনসিলভানিয়ার শ্যাংকসভিল গ্রামে ; চারজন ছিনতাইকারী -- জিয়াদ সমীর জারা, সইদ আল ঘামদি, আমেদ আল-নামি, আমেদ আল-হাজনাউই । তখনো পর্যন্ত সরকারি কর্তৃপক্ষ বা আমেরিকার বিমান প্রশাসন সংস্থা
এরকম একটি অভূতপূর্ব, ভয়াবহ ও ভয়ংকর ঘটনার পর সকলেই আশা করেছিলেন যে নিরপেক্ষ, উচ্চপদস্থ, সর্বদলীয় একটি তদন্তকমিশন বসিয়ে পুরো বিষয়টি ভালো করে ভেবে চিন্তে, বিশ্লেষণ করে খতিয়ে দেখা হবে । কী করে এমন সন্ত্রাসবাদী আক্রমণ ঘটলো ? কোথায় কোথায় ভুল হয়েছে এবং অপদার্থতা দেখা গেছে ? সরকারি, বেসরকারি কোন বিভাগ তাদের কাজকর্মে অবহেলা করেছে কিনা ? এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল, ভবিষ্যতে এই ধরণের আক্রমণ বন্ধ করতে কি কি ব্যবস্থা নিতে হবে । ১৯ জন বিমান ছিনতাইকারী এবং তাদের সাহয্যকারীদের আমেরিকায় অনুপ্রবেশ বন্ধ করা সম্ভব কিনা, বিশেষ করে এদের বেশ কয়েকজন মৌলবাদী আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত এবং আল-কায়দার প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে বিশেষভাবে শিক্ষাপ্রাপ্ত ! আমেরিকার বিভিন্ন বিমান চালানো শিক্ষার বিদ্যালয়ে এতগুলি আরব যুবক মাসের পর মাস বিমান চালালো, কিন্তু কারুর কোন সন্দেহ হল না কেন ? বা যেখানে সন্দেহ হয়েছিল, যেমন ফিনিক্স শহরের এফ বি আই সদস্য কেন উইলিয়ামস, তাঁর পাঠানো রিপোর্ট ধামাচাপা পড়লো কিভাবে ? বিংশতিতম (?) বিমান-ছিনতাইকারী জ্যাকারিয়া মুসাওই যখন গ্রেফতার হলেন, তখনও হাতে সাড়ে তিন হপ্তা সময় ছিল বিষয়টি যথাযোগ্য তদন্ত করার কিন্তু তা করা হল না কেন ? এমন কি জ্যাকারিয়ার কমপিউটারে কি তথ্যাদি আছে সেগুলিও কেউ খুলে দেখেননি বা তাঁর ফোন কলের রেকর্ডগুলিও কেউ সংগ্রহ করেনি । বরং সাহসিনী এফ বি আই সদস্যা কলিন রাউলি বিষয়টি নিয়ে বাড়তি তদন্ত সমাপন করতে গিয়ে বড়বাবুদের ধমকধামক খেলেন ।
১১ই সেপ্টেম্বরের পর পরই রাষ্ট্রপতি বুশ বললেন, তদন্তকমিশনের কোন প্রয়োজন নেই, যা ব্যবস্থা নেওয়ার সরকার নিজেই নেবেন । আমেরিকার মূল ভূখণ্ডে শত্রুপক্ষের এতবড় আক্রমণ খুব কমই ঘটেছে -- একমাত্র ১৯৪১ সালে জাপানিদের পার্ল হারবারে বোমাবর্ষণের কথাই মনে পড়ে ; তার আগে আমেরিকা আক্রান্ত হয়েছিল সেই সুদূর অতীতের ১৮১২ সালে এবং আগের দুই উদাহরণেই লোকক্ষয় হয়েছিল এবারের থেকে কম । অনেকদিন বুশ প্রশাসনের নড়ন চড়ন নেই দেখে ১১ই সেপ্টেম্বর এর মৃত মানুষদের পরিবারদের পক্ষ থেকে তীব্র প্রতিবাদ এবং তদন্ত কমিশনের পক্ষে জনমত গড়ে তোলার চেষ্টা শুরু হল । শেষ পর্যন্ত ২০০২ সালের নভেম্বর মাসে মার্কিন কংগ্রেস আইন পাস করলে তদন্ত কমিশান গড়ে তোলার এবং বুশ সই করলেন সেই আইনে । কমিশনের উদ্দেশ্য --
কমিশনের কাজ পুরোদমে শুরু হল বটে, কিন্তু খিটিমিটি লেগেই রইলো বুশ প্রশাসনের সঙ্গে ; কমিশন যা গোপন দলিলপত্র দেখতে চান তা দিতে সরকারের আপত্তি, কারণ তাতে নাকি জাতীয় নিরাপত্তা ক্ষুণ্ণ হবে ; কমিশন সিয়া বা এফ বি আই এর যে সব কর্মচারীদের সাক্ষ্য নিতে চান, সরকারের আপত্তি তাঁদের কমিশনের সামনে হাজির করতে ; জাতীয় নিরাপত্তার ভারপ্রাপ্ত পরামর্শদাত্রী কণ্ডোলিজা রাইস কমিশনের সামনে শপথগ্রহণ পূর্বক সাক্ষ্য দেবেন কিনা তাই নিয়ে চাপান উতোর চললো ; বুশ নিজেও প্রথমে কমিশনের সামনে সাক্ষ্য দিতে গররাজি ছিলেন, কিন্তু জনরোষের ভয়ে শেষ পর্যন্ত রাজী হন । তবে তিনি একা এলেন না, সঙ্গে এলেন উপরাষ্ট্রপতি ডিক চেনি ; আর আগে থেকে অঙ্গীকার রইলো যে তাঁরা এক ঘন্টার বেশি সময় দিতে পারবেন না । তিন হাজার মৃত মানুষের জন্য রাষ্ট্রপতির বরাদ্দ ৩৬০০ সেকেণ্ড !
কমিশনের সদস্যেরা তাঁদের কার্যসূত্রে পঁচিশ লক্ষেরও বেশি পৃষ্ঠার দলিল পত্র পড়েছেন ; দশটি দেশের ১২০০ জন মানুষের সাক্ষাত্কার নিয়েছেন -- তাঁদের ভেতর বর্তমান প্রশাসন এবং প্রাক্তন প্রশাসনের উচচপদস্থ কর্মচারীরা রয়েছেন । তাঁরা ১৯ দিন ধরে প্রকাশ্য শুনানির ব্যবস্থা করেছেন এবং ১৬০ জনের মুখোমুখি সাক্ষ্যগ্রহণ করেছেন । চেয়ারম্যান ও সহকারী তাঁদের যৌথ ভূমিকায় জানিয়েছেন --
বর্তমান রাজনৈতিক পরিবেশে এই কমিশনের সদস্যরা একসূত্রে তাঁদের কাজকর্ম সম্পন্ন করতে পেরেছেন এবং এককন্ঠে, সমবেতভাবে তাঁদের রিপোর্ট প্রকাশ করতে পেরেছেন -- সেটা খুবই ভাল কথা । তাঁদের সুপারিশগুলিও বিচক্ষণ ও সুবুদ্ধিপূর্ণ -- বিশেষ করে ছড়ানো ছিটানো এক ডজন গোয়েন্দা সংস্থার এলোমেলো গোয়েন্দাকর্মকে ঢেলে সাজিয়ে একটি জাতীয় গোয়েন্দা ডিরেক্টারের শাসনাধীনে আনা এবং বিভিন্ন বিভাগের মধ্যে যোগাযোগের প্রভূত উন্নতি করার চেষ্টা । জানি না এতে সরকারের টনক নড়বে কিনা বা শুভবুদ্ধির উদয় হবে কিনা ।
- ফ্লোরিডার সেনেটার বব গ্রাহাম
একেবারেই তদন্তকমিটির রিপোর্টের মত নীরস, বিরক্তিকর গদ্য নয়, যাঁরা বছর ছয়েক আগের কেনেথ স্টার কমিটির জঘন্য রিপোর্টটি পড়েছেন তাঁরা তফাত্টি অতি সহজেই বুঝতে পারবেন । অনেক কম খরচে, অনেক ভাল সাহিত্যসৃষ্টি, অনেক বেশি যুক্তিপূর্ণ, তথ্যসমৃদ্ধ এবং টু দ্য পয়েন্ট । চারটি বিমানের যাত্রাপথের বিবরণের পর রয়েছে যে-দুটি সংস্থার হাতে আমেরিকার আকাশপথের সুরক্ষার ভার সেই
ক্ষেপণাস্ত্র হিসেবে যাত্রীবাহী বড় বিমানের ব্যবহার কোন নতুন আইডিয়া নয় । ১৯৯৪ সালের ডিসেম্বর মাসে আলজিরিয়ার সন্ত্রাসবাদী দল জি আই এ আলজিয়ার্সে এয়ার ফ্রান্সের ৮৯৬৯ নম্বর উড়ানের বিমানটি ছিনতাই করে এবং প্রাণের ভয় দেখিয়ে পাইলটকে আদেশ দেয় বিমানটি প্যারিসে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে । ছিনতাইকারিদের পরিকল্পনা ছিল যাত্রী সমেত বিমানটিকে নিয়ে সোজা আইফেল টাওয়ারে ধাক্কা মারা । কিন্তু বিমানের পাইলট বুদ্ধি খেলিয়ে ছিনতাইকারিদের ঠকান এবং বিমানটিকে নিয়ে যান মার্সেই বিমানবন্দরে । সেখানে ফরাসী আধাসামরিক বাহিনী বিমানটি আক্রমণ করে ছিনতাইকারিদের নিহত করে যাত্রী ও কর্মীদের উদ্ধার করে । খুব সম্ভবত এই ঘটনার পরই ওসামা ভাবতে শুরু করেন যে সফল ছিনতাই ও আক্রমণের জন্যে বিমান চালাতে জানা সন্ত্রাসবাদীর প্রয়োজন ।
দ্বিতীয় অধ্যায়ের নাম "নুতন সন্ত্রাসবাদের ভিত্তি" ওসামা বিন লাদেন ও তাঁর দলবলের গড়ে ওঠা ও হয়ে ওঠার কাহিনি । আমেরিকার বিরুদ্ধে প্রথম উল্লেখযোগ্য সন্ত্রাসবাদী হামলা ঘটে ১৯৮৩ সালে বেইরুটে মার্কিন মেরিন সেনানিবাসে ট্রাক-বোমার আক্রমণে -- ২৪১ জন মেরিন নিহত হয়েছিলেন সেবার । রাষ্ট্রপতি রেগান সন্ত্রাসবাদীদের বিরুদ্ধে কোন আক্রমণাত্মক ব্যবস্থা নেননি -- মার্কিন মেরিনদের লেজ গুটিয়ে চলে আসতে হয়েছিল লেবানন ছেড়ে । সেই সন্ত্রাসবাদীরা ছিল ইরান-সমর্থিত শিয়া হিজবোল্লা গোষ্ঠী -- ওসামা অবশ্য ঘটনাটির পরে উত্সাহিত হন ট্রাক-বোমার ব্যবহার শিক্ষণে । পরবর্তীকালেও শিয়া-সুন্নি সন্ত্রাসবাদীদের মধ্যে যোগাযোগ ও সহযোগিতার সংবাদ পাওয়া গেছে । ১৯৮৯ সালে (প্রথম) রাষ্ট্রপতি বুশের শাসনকালে লিবিয়ার সন্ত্রাসবাদীরা স্কটল্যাণ্ডের লকারবি গ্রামে ধ্বংস করে দিল প্যান অ্যামের ১০৩ নম্বর উড়ানকে -- ২৫৯ যাত্রীর অকালমৃত্যু হয়েছিল সেদিন । বুশও কোনরকম সামরিক ব্যবস্থা নেননি লিবিয়ার সন্ত্রাসবাদীদের বিরুদ্ধে । দুটি ঘটনা থেকেই ওসামার মনে বিশ্বাস জন্মে যে আমেরিকা দুর্বল এবং তাঁর বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবাদী কাজকর্ম চালিয়ে প্রত্যক্ষ শাস্তির সম্ভাবনা কম । তাই ছোট থেকে শুরু করে মাঝারি সন্ত্রাসবাদী কাজ করে তিনি ও তাঁর দল আল-কায়দা হাত পাকিয়ে নিতে এবং অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে বড় কোন প্রকল্পের জন্যে প্রস্তুতি নিতে লাগলেন ।
তৃতীয় অধ্যায় জুড়ে মার্কিন সরকারের সন্ত্রাসবিরোধী পরিকল্পনা গুলির বিশদ বিবরণ, ১৯৯৩ সালের বিশ্ব বাণিজ্য কেন্দ্রের বোমা বিস্ফোরণ থেকে শুরু করে । সেবার অবশ্য অপরাধীরা ধরা পড়েছিল তাদের নিজের বোকামিতে -- চারশো ডলার আমানত জমা রেখে ট্রাক ভাড়া নিয়েছিল মহম্মদ সালামেহ এবং ট্রাক দিয়ে বোমা ফাটিয়ে তারপর সেই দোকানে ফিরে গিয়েছিল আমানত ফেরত নিতে ; সেখানে ওত পেতে অপেক্ষা করছিল এফ বি আই । কিন্তু সেই সাফল্যের জন্যেই পুরো ব্যাপারটি সন্ত্রাসবাদ বিরোধী তীব্র যুদ্ধ না হয়ে আইন-শৃংখলা রক্ষাকারী পুলিশি কাজকর্ম হয়ে দাঁড়ায় । সরকারের প্রতিটি শাখার প্রতিটি বিভাগের কার্যকলাপের বিশদ আলোচনা রয়েছে এখানে । চতুর্থ অধ্যায়ে আলকায়দার ১৯৯৩ থেকে ৯৮ প্রতিটি সন্ত্রাসবাদী প্রজেক্টের প্রতিক্রিয়ার সরকারের নেওয়া ব্যবস্থাগুলির পুংখানুপুংখ বিবরণ ; ২০ আগস্ট ১৯৯৮-এর আফগানিস্তানে খোস্ত অঞ্চলে বিন লাদেন এর ট্রেনিং শিবিরে মিসাইল আক্রমণের কথা আছে ; সেই সঙ্গে রয়েছে কাশ্মীর ও কারগিল যুদ্ধের কথা -- কিন্তু ২৬ ডিসেম্বর ১৯৯৯ এর ইণ্ডিয়ান এয়ারলাইনসের ৮১৪ নম্বর উড়ানের ছিনতাই এর কথা নেই । থাকা উচিত ছিল, কারণ সেখানেও ব্যবহৃত হয়েছিল বাক্স-কাটা ধারালো ছুরি, কন্ঠনালী চিরে হত্যা করা হয়েছিল যাত্রীকে, ছিনতাইকারীরা আফগানিস্থানে সন্ত্রাসবাদী ট্রেনিং শিবিরে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত এবং আল-কায়দার ঘনিষ্ঠ । এই অপরাধটির প্রতি উদাসীন থেকে আমেরিকার আদতে ক্ষতিই হয়েছে ।
পঞ্চম অধ্যায়ে ১১ই সেপ্টেম্বরের জন্যে ছিনতাইকারিদের প্রাথমিক প্রস্তুতি ২০০০ সালের মাঝামাঝি পর্যন্ত । ষষ্ঠ অধ্যায়ে নতুন সহস্রাব্দের থেকে শুরু করে ১০ই সেপ্টেম্বর অব্দি বিভিন্ন সন্ত্রাসের খবর এবং সরকারের সন্ত্রাস-বিরোধী প্রতিক্রিয়া । ওয়াশিংটনে সরকার বদলের পর সন্ত্রাসবাদ দমনের কাজে যে ভাঁটা আসে, তার কথা কমিশন বলেছেন বেশ আলগোছে --
অষ্টম অধ্যায়ের সুপ্রযুক্ত নাম "দপদপ করছিল লাল বিপদ সংকেত"-- কতরকমের বিপদ সংকেত পাওয়া গিয়েছিল এবং অগ্রাহ্য করা হয়েছিল, সেই অক্ষমতা ও
দীর্ঘসূত্রীতার কাহিনি ।
নবম অধ্যায়ে ধ্বংসস্তূপ থেকে উদ্ধার -- পুলিশ বাহিনী, ফায়ার ব্রিগেড ও সাধারণ মানুষের বীরত্ব ও আত্মত্যাগের কাহিনি ; সেখানেও নানান মাপের বিভিন্ন ভুলভ্রান্তি এবং বিভিন্ন সংস্থার মধ্যে সহযোগিতার করুণ অভাব । তবুও বিশ্ববাণিজ্য কেন্দ্রের দুটি টাওয়ারের যে যে তলায় বিমানদুটি এসে আঘাত করে, তার নীচের তলার বেশির ভাগ মানুষজনকে যথাসময়ে অপসারণ করা সম্ভব হয়েছিল । দশম অধ্যায়ে যুদ্ধের আখ্যান -- যদিও ওসামা এবং মোল্লা ওমরের কেশাগ্রও পর্যন্ত স্পর্শ করতে পারলো না পৃথিবীর একমাত্র মহাশক্তির অমিতবিক্রম সেনাবাহিনী । যদিও প্রথমে এই সামরিক অভিযানের নাম দেওয়া হয়েছিল "অন্তহীন ন্যায়বিচার", পরে মুসলমানদের ধর্মবিশ্বাসে আঘাত লাগবে বলে পাল্টে নতুন নাম রাখা হয় "দীর্ঘস্থায়ী স্বাধীনতা"। শেষ তিনটি অধ্যায়ে অতীতের ভুলভ্রান্তি -- তাদের পর্যালোচনা ও বিশ্লেষণ ; ভবিষ্যতের জন্যে সুপারিশ -- "কী করতে হবে" এবং "কীভাবে করতে হবে"। তাঁদের দেওয়া পরামর্শগুলি সব অক্ষরে অক্ষরে মেনে নেওয়া হবে এমন দুরাশা কমিশনের নেই --
সন্ত্রাসবাদী বিরোধী সমরে আমেরিকার দুই তথাকথিত বন্ধুরাষ্ট্রের অবদান ও
কার্যকলাপ সম্পর্কে আরো খতিয়ে এবং তলিয়ে দেখা উচিত ছিল কমিশানের । প্রথমত : সৌদি আরব --
কিন্তু বিষয়টির এখানেই শেষ হল না, বিশেষ করে ওই দলের অন্তর্গত তিনজন সৌদি যুবরাজের ক্ষেত্রে । ২৮শে মার্চ ২০০২, পাকিস্তানের ফয়জালাবাদে এফ বি আই এর হাতে ধরা পড়লেন আল-কায়দার নেতা আবু জুবেয়দা । জিজ্ঞাসাবাদের সময় তিনি কবুল করলেন তাঁর সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ সৌদি প্রিন্স আমেদ বিন সালমান বিন আবদুল আজিজের যিনি সৌদি রাজার আপন ভাইপো এবং স্মৃতি থেকে বলে দিলেন তাঁর বাড়ির ফোন নম্বর এবং সেল ফোনের নম্বর । আরো দুজনের সঙ্গে তার যোগাযোগ -- রাজার আরেক ভাইপো, প্রিন্স সুলতান বিন ফয়জল বিন টার্কি আল সৌদ এবং এক দূর সম্পর্কের আত্মীয় প্রিন্স ফহদ বিন টার্কি বিন সৌদ আল-কবির । ওই বছর জুলাই মাসের শেষে এক সপ্তাহের ভেতর রহস্যময়ভাবে মৃত্যু ঘটলো তিন জনেরই । ২২শে জুলাই হৃদরোগে মৃত্যু হল ৪৩ বছর বয়েসি প্রিন্স আমেদের ; পরের দিন তাঁর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় যাবার পথে গাড়ি দুর্ঘটনায় মৃত্যু প্রিন্স সুলতানের ; ৩০শে জুলাই মরুভূমিতে মৃতদেহ খুঁজে পাওয়া গেল প্রিন্স ফহদের । (তথ্যসূত্র -- ক্রেগ আংগার রচিত গ্রন্থ "বুশ গৃহ, সৌদিগৃহ", প্রকাশ ২০০৩ ।) ওই তিনজন মানুষকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে পারলে হয়ত পাওয়া যেত গুরুত্বপূর্ণ তথ্য, সন্ত্রাসবাদ বিরোধী যুদ্ধের জন্যে ।
দ্বিতীয়ত পাকিস্তান -- তালিবান ও আল-কায়দার ঘনিষ্ঠ বন্ধুদেশ । যখন আফগানিস্থানের পাহাড় বন্দরে মার্কিন সেনাবাহিনী ঘিরে ধরেছিল তালিবান যোদ্ধাদের, তার মধ্যে ছিলেন বেশ কিছু পাকিস্তানি সামরিক ও আই এস আই এর অফিসার । তাঁরা ধরা পড়লে পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতির জীবন ও চাকুরি দুইই বিপন্ন হবে এই বলে তিনি মার্কিন প্রশাসনের কাছে আবেদন করেন পাকিস্তানিদের ছেড়ে দেবার । আবেদন মঞ্জুর হয় এবং পাকিস্তানি এয়ারফোর্সের বিমান পাঠিয়ে তাঁদের তুলে আনা হয় -- খুব সম্ভবত: কিছু তালিবান সদস্যও তাঁদের সঙ্গে পালিয়ে যান । (তথ্যসূত্র -- ২০০২ সালে ন্যুইয়র্কার পত্রিকার সেমুর হার্শের প্রবন্ধ) এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টিরও কোন উল্লেখ নেই কমিশনের রিপোর্টে । এ ছাড়া, আবু জুবেয়দা তাঁর স্বীকারোক্তিতে কবুল করেন পাকিস্তানের বিমান বাহিনীর প্রধান এয়ার মার্শাল মুশাফ আলি মীর আগে থেকেই জানতেন ৯/১১ এর কথা । মীরেরও মৃত্যু ঘটে একটি রহস্যময় বিমান দুর্ঘটনায় ২০০৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ।
এছাড়া মার্কিন জনসাধারণের ভেতর ৯/১১ এর প্রতিক্রিয়া নিয়েও রিপোর্টে কিছু উল্লেখ থাকলে ভাল হত -- কিভাবে পৃথিবীর দেশগুলির সম্বন্ধে সাধারণ মার্কিন জনগণের জ্ঞানের অভাবের জন্যে উদোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে চড়ে যায় । একটি উদাহরণ -- অ্যারিজোনা রাজ্যের মেসা শহরে বলবীর সিং সোধির পেট্রল পাম্প (গ্যাস স্টেশান) । শনিবার সেপ্টেম্বর ১৫, ২০০১ তিনি কস্টকো দোকানে গেলেন বড় একটা মার্কিন জাতীয় পতাকা কিনে তার গ্যাস স্টেশানে ঝোলাবেন বলে । দোকান থেকে বেরিয়ে তিনি দেখলেন ওয়ার্লড ট্রেড সেন্টারের ক্ষতিগ্রস্থ পরিবারদের ত্রাণ তহবিলে চাঁদা তোলা হচ্ছে -- বলবীর ৭৫ ডলার দান করলেন তাঁর সাধ্যমত । এর কয়েক ঘন্টা পরে তাঁকে তাঁর দোকানঘরে গুলি করে মারলো
এক শ্বেতকায় বন্দুকধারী । পুলিশের কাছে খুনীর স্বীকারোক্তি --
সব মিলিয়ে তথ্য ও বিশ্লেষণে সমৃদ্ধ একটি রিপোর্ট ; উপরিলাভ যে গ্রন্থটি সুলিখিত ও সুপাঠ্য । তাই গ্রন্থটির বেস্টসেলার হওয়ার ঘটনায় আশ্চর্যের কিছু নেই । আধুনিক মার্কিন ইতিহাস নিয়ে যাঁরা আগ্রহী তাঁদের কাছে বইটি অতীব গুরুত্বপূর্ণ । ইতিহাস থেকে সমুচিত শিক্ষা গ্রহণ করতে না পারলে ঐতিহাসিক ভুলগুলির পুনরাবৃত্ত হবার সম্ভাবনা থেকেই যায় । একমাত্র ভবিষ্যতই বলতে পারবে এক্ষেত্রেও তা হবে কিনা । কিন্তু বর্তমান তদন্ত কমিটি তাঁদের দায়ভার সুচারুভাবে সম্পন্ন করেছেন, এ কথা বলতে কোন বাধা নেই ।
(পরবাস, মে, ২০০৫)
"মচ্ং ছঞঞছবূ ঞধধূ ংঋত্ছবং ধত্র স্ংংইশঠবছত্র যধঠত্, ঢণ্ণঞ ঠঞ গছয ছত্র ছঞঞছবূ ধত্র ঞচ্ং চ্ংছশঞ ছত্ররু যধণ্ণৎ ধী ঞচ্ং বঠটঠত্ঠজ়্ংরু গধশত্রু.... মচ্ঠয ংঋছশঞঠবণ্ণত্ছশ ঢছঞঞত্ংংঈশধত্রঞ গঠত্ৎ ত্ছযঞ ছয ত্ধত্রভ ছয ঠঞ ঞছূংয ঞধ ঢশঠত্রভ ছত্-ক্ষছংরুছ ঞধ এণ্ণযঞঠবং."
॥ ১ ॥
ইতিহাস থেকে অনেক বহুমূল্য তথ্য জানতে পারি আমরা -- কিন্তু একটি মূল্যবান তথ্য অনেক পণ্ডিত ঐতিহাসিকেরই চোখ এড়িয়ে গেছে । সেটি হল, শীত শেষ হয়ে বসন্তের মৃদুমন্দ বাতাস বইতে শুরু করলেই পশ্চিমের আপামর জনসাধারণের মনে ছুটির মেজাজ আসে -- তাঁরা কাজকর্ম শিকেয় না হলেও, শেল্ফের ওপরের দিকের তাকে তুলে দিয়ে মাছ ধরা, স্কি করা, সাঁতার কাটা বা নিদেনপক্ষে পেছনের উঠোনে স্বল্পবাস বসে রোমান্স নভেল পড়ার কথা ভাবেন । আপিশে-কাছারিতে-স্কুলে-কলেজে শীতল জলের প্রস্রবণের পাশে দাঁড়িয়ে তখন "ভেকেশন" এর মুগ্ধ আলোচনা । তারপর জুন মাসের মাঝামাঝি স্কুল কলেজের দীর্ঘ দু-আড়াই মাসের গ্রীষ্মাবকাশ এবং তখন ছুটি নেওয়ার শুরু । ইওরোপের মানুষেরা ভাগ্যবান -- চার থেকে ছ সপ্তাহ ছুটি তাঁদের ; মার্কিন মুলুকে দু থেকে তিন হপ্তা, পরিমাণে একটু কম । কিন্তু অতলান্ত পুকুরের দুইপারেই কাজকর্ম মাথায় ওঠে আর উত্পাদনশীলতা (ংঋশধরুণ্ণবঞঠটঠঞষ্) এবং কার্যকরতা (ংংঈংঈঠবঠংত্রবষ্) -- দুইই নেমে যায় পাতালে - সরকারি এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে । আর ভুলভ্রান্তিও ঘটে চলে পদে পদে ।
॥ ২ ॥
পুরো নাম ওসামা (কিংবা উসামা) বিন মহম্মদ বিন লাদেন, জন্ম হিজিরা সন ১৩৭৭ অর্থাৎ ইংরেজি হিসেবে ১৯৫৭ সালের ১০ই মার্চ । বাবা মহম্মদ আওয়াদ বিন লাদেন ইয়েমেনের সৌদি আরবের সীমান্তবর্তী ওয়াডি হাড্রামোট অঞ্চলের দরিদ্র দিনমজুর । আধুনিক সৌদি আরব রাষ্ট্রের সৃষ্টি ১৯০২ সালে এবং তার অবিসংবাদিত নেতা আবদুল-আজিজ ইবন সৌদ (১৮৮০-১৯৫৩) । ১৯২৬ সালে তাকে স্বীকৃতি দেওয়া হয় স্বাধীন রাষ্ট্রের, যদিও সামরিক ও তেল সংক্রান্ত বিষয়ে ছিল একচেটিয়া বৃটিশ একাধিপত্য । কথিত আছে ওই একই সময় মহম্মদ প্রায় হাজার মাইল পায়ে হেঁটে ইয়েমেন থেকে উত্তরে সৌদি আরবে আসেন কাজের খোঁজে এবং নতুন রাজপ্রাসাদ নির্মাণের কাজে মিস্ত্রি হিসেবে নিযুক্ত হন । একসময় রাজা অসুস্থ হয়ে পড়লে, তাঁর চলাফেরার অসুবিধে ঘটে এবং মহম্মদ এমন ব্যবস্থা করে দেন যাতে হুইলচেয়ারে বসেই রাজা বিশাল প্রাসাদের একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে ঘোরাফেরা করতে পারেন ।
          ঠৈবূয ধীংঈ ধণ্ণশ স্ংযযস্ছঞংয ত্ংংঈঞ ছত্ররু শঠভচ্ঞ."
তারা মার্কিন স্টিঙার ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করে সোভিয়েত হেলিকপ্টার একের পর এক উড়িয়ে দিতে লাগলো । ১৯৮৯ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি সোভিয়েত সেনাবাহিনী জেনারেল বরিস গ্রোমভের নেতৃত্বে আমুদরিয়া নদীর ওপর বন্ধুত্বের সেতু পার হয়ে ফিরে গেল উজবেকিস্তানে । পনের হাজার সেনা নিহত আর এক লাখেরও বেশি আহত ও পঙ্গু । যুদ্ধজয়ী বীরের বেশে ওসামা দেশে ফিরে গেলেন ; অনেক শতক আগে সালাদিন জেরুসালেমকে বিধর্মীমুক্ত করেছিলেন -- ওসামা নিজেকে তাঁর যোগ্য উত্তরাধিকারী বলে ভাবতে আরম্ভ করলেন । ইতিমধ্যে ১৯৮৭ সালে ওসামা গোড়াপত্তন করেছেন "আল-কায়দা" ("ভিত্তি" অথবা "ঘাঁটি") দলের ; আফগানিস্তানের আল-আনসার ("সিংহের বাসা") মিলিটারি ক্যাম্পে তার শুরু -- খুব শিগগির পৃথিবীময় ছড়াবে তার নাম । আফগান-যুদ্ধের শেষে ওসামা স্বদেশে ফিরে এলেন এবং জেড্ডা শহরে তাঁর পারিবারিক ব্যবসায়ের কাজকর্মে মন দিলেন । এইভাবেই হয়তো কেটে যেত তার বাকি জীবন, কিন্তু ১৯৯০ সালের ২রা আগস্ট ইরাকের রাষ্ট্রপতি সাদ্দাম হুসেন আক্রমণ করলেন কুয়েত এবং সহজেই দখল করে বসলেন দেশটি । সৌদি আরবের রাজারও আসন টলোমলো, ভয়ে কম্পমান তার শাসকগোষ্ঠী । ওসামা গেলেন রাজপুত্র প্রিন্স আবদুল্লার কাছে এবং আফগান-আরব সৈন্যদের নিয়ে কুয়েতে গেরিলা যুদ্ধ শুরু করতে চাইলেন ইরাকি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে । রাজপুত্র বিনয়ের সঙ্গে প্রত্যাখ্যান করলেন ওসামার প্রস্তাব কিন্তু সাড়া দিলেন আমেরিকার ডাকে । দাহরান বিমানবন্দরে ঝাঁকে ঝাঁকে নামতে শুরু করলো মার্কিন সি১৩০ পরিবহণ বিমান ; আর লাখচারেক লালমুখো মার্কিন সৈন্য এসে ঘাঁটি গাড়লো তার মরুভূমিতে । ওসামা ও তার দলবল রেগে আগুন । যুদ্ধ তো মিটে গেল সহজেই, কিন্তু মার্কিন ফৌজ দেশ ছাড়লো না । এক মুসলিম শাসকের আক্রমণ থেকে আরেক মুসলিম শাসককে রক্ষা করতে এসেছে বিধর্মী মার্কিন সেনা, তাদের মধ্যে খৃষ্টান, ইহুদি তো রয়েছেই, এমনকি কৃষ্ণকায় ও মহিলা সৈনিক পর্যন্ত । সম্পূর্ণ শরিয়াবিরোধী আচরণ ; স্বয়ং পয়গম্বর মহম্মদ বলে গেছেন "ত্ংঞ ঞচ্ংশং ঢং ত্রধ ঞগধ শংত্ঠভঠধত্রয ঠত্র শিছঢঠছ." ওয়াহাবিরা এতটাই গোঁড়া মনোভাবাপন্ন যে অষ্টাদশ শতাব্দীতে মক্কা ও মদিনা জয় করার পর তারা ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়েছিল মহম্মদের স্ত্রী এবং অসংখ্য মুসলিম ধর্মপ্রচারক ও পণ্ডিতদের সমাধি । যদিও এবারে রাজা সৌদি আরবের প্রধান মুফ্তিকে দিয়ে কবুল করে নিয়েছেন যে মার্কিন সৈন্যরা ধর্মীয় অনুশাসন থেকে এককালীন ছাড় পেতে পারে, ওসামা তাতে সন্তুষ্ট হলেন না । রাজপরিবারের বিরোধিতা করে গরম গরম বক্তৃতা দিতে লাগলেন । তার ফলও ফললো সঙ্গে সঙ্গেই -- বিন লাদেন পরিবারের সমস্ত ব্যবসা-বাণিজ্য থেকে হঠিয়ে দেওয়া হল তাঁকে ; সরকার দখল করে নিলেন তাঁর সব সম্পত্তি ও ব্যাংক অ্যাকাউন্ট । ওসামা কোনমতে পালিয়ে গেলেন প্রথমে আফগানিস্তান -- সেখানে তাঁর পুরানো দলবল এবং নতুন যোগ দেওয়া জেহাদিদের সঙ্গে নিয়ে সুদানে ডক্টর হাসান আল-তুরাবির নিরাপদ আশ্রয়ে । শুরু হল তাঁর ভবঘুরে সন্ত্রাসবাদী জীবন ।
॥ ৩ ॥
এই নিয়ে তৃতীয়বার একটি বিশেষ ঘটনা ঘটলো ১১ই সেপ্টেম্বর তারিখে -- প্রথমটি শুভ এবং পরের দুটি অশুভ । ১৮৯৩ সালের ১১ই সেপ্টেম্বর শিকাগোর মহাধর্ম সম্মেলনে তাঁর অবিস্মরণীয় বক্তৃতাটি করেছিলেন স্বামী বিবেকানন্দ, "আমেরিকার ভ্রাতা ও ভগিনীগণ" বাক্যাংশটি দিয়ে যার শুরু -- ভারতবর্ষের সনাতন, বৈদিকধর্মের সঙ্গে সারা পৃথিবীর পরিচয় ঘটেছিল সেদিন । দ্বিতীয়বার, ১৯৭৩ সালের ১১ই সেপ্টেম্বর সিয়ার প্ররোচণায় ও প্রণোদনায় চিলিতে সামরিক অভ্যুথ্থান ঘটে এবং গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত ও জনপ্রিয় রাষ্ট্রপতি সালভাদর আইয়েন্দে ক্ষমতাচ্যূত হন ও প্রাণ হারান । তৃতীয় বারের ১১ই সেপ্টেম্বর ২০০১ সালের সেই অন্ধকার, ভয়ংকর মঙ্গলবার । ৭০টি দেশের ৩১০০ জনের ও বেশি নাগরিক মৃত, আহতের সংখ্যাও প্রচুর, কোটি কোটি টাকার সম্পত্তি ধ্বংস ।
॥ ৪ ॥
ঢাউস এই গ্রন্থটির প্রথমে ভূমিকা দিয়ে শুরু, তারপর ৪৩৮ পৃষ্ঠার ১৩টি অধ্যায়ে ঠাসবুনোট বিবরণ ও বিশ্লেষণ ; সাবলীল, নির্মেদ গদ্য -- পড়লে মনেই হবে না একটি কমিটির দ্বারা রচিত । প্রথম অধ্যায়ের নাম "আমাদের দখলে কয়েকটি বিমান" এবং শুরু হয়েছে জনপ্রিয় উপন্যাসের মত -- "মণ্ণংযরুছষ্, নংংঋঞংস্ঢংশ ১১, ২০০১ রুছগত্রংরু ঞংস্ংঋংশছঞং ছত্ররু ত্রংছশত্ষ্ বত্ধণ্ণরুত্ংযয ঠত্র ঞচ্ং ংছযঞংশত্র লত্রঠঞংরু নঞছঞং. ংঔঠত্ত্ঠধত্রয ধী স্ংত্র ছত্ররু গধস্ংত্র শংছরুঠংরু ঞচ্ংত্র যংত্টংয ংঈধশ গধশূ. নধস্ং স্ছরুং ঞচ্ংঠশ গছষ্ ঞধ ঞচ্ং মগঠত্র মধগংশয..."
ব্যাস, প্রথম থেকেই কাহিনি জমে উঠলো ; পাদটীকাগুলিতে চোখ না ফেলে তরতর করে পড়ে গেলেই হল । কিন্তু মঙ্গলবার কেন ? ছিনতাইকারিদের গবেষণা অনুযায়ী, পাঁচটি কাজের দিনের মধ্যে মঙ্গলবার সকালের দীর্ঘপথের উড়ানগুলিতেই যাত্রীসংখ্যা সবচেয়ে কম থাকে ।
উনিশজন বিমান ছিনতাইকারির মধ্যে পনের জনই সৌদি আরবের নাগরিক, কিন্তু তার জন্যে যেন দেশটির কোন দায়-দায়িত্বই নেই । আফগানিস্থানের তালিবান সরকারকে যে মুষ্টিমেয় কয়েকটি রাষ্ট্র স্বীকৃতি জানিয়েছিল সৌদি আরব ও পাকিস্তান তাদের মধ্যে অন্যতম । আল-কায়দার সঙ্গেও তাদের গলায় গলায় ভাব । ১১ই সেপ্টেম্বরের যে মুহূর্তে যাত্রীবাহী বিমান এসে ভেঙে পড়ছিল বিশ্ববাণিজ্য কেন্দ্রে, ঠিক তখন (প্রথম) রাষ্ট্রপতি বুশের দুই ঘনিষ্ঠ সহযোগী জিম বেকার এবং ফ্রাংক কারলুচি ওয়াশিংটনের একটি হোটেলে শলাপরামর্শ করছিলেন ওসামার ভাই শফিগ বিন লাদেনের সঙ্গে । শোনা যায়, টিভিতে ঘটনাটি দেখে শফিগ সাত তাড়াতাড়ি নিজের নেমট্যাগটি খুলে লুকিয়ে রাখেন । ওই একই সময়ে সৌদি আরবের প্রায় দেড়শো জন ধনী ও বিশিষ্ট নাগরিক আমেরিকায় বসবাস করছিলেন -- তাদের মধ্যে অনেকেই সৌদি রাজপরিবারের এবং বিন লাদেন পরিবারের সদস্য । তড়িঘড়ি করে তাঁদের হয় ব্যক্তিগত বিমানে বা ভাড়া করা বিমানে করে স্বদেশে ফেরত পাঠানো হয় । আমেরিকার সৌদি আরবের দীর্ঘস্থায়ী রাষ্ট্রদূত প্রিন্স বান্দর বিন সুলতান বিন আবদুল আজিজ বুশ পরিবারের, বুশ প্রশাসনের বহুকালের ঘনিষ্ঠ বন্ধু । তাঁর স্ত্রী প্রিনসেস হাইফা দুয়েকটি দাতব্য প্রতিষ্ঠানে অর্থদান করেছেন যারা অপ্রত্যক্ষ ভাবে হলেও সন্ত্রাসবাদের সঙ্গে যুক্ত । আমেরিকার আকাশপথ উন্মুক্ত হবার সঙ্গে সঙ্গে ন'টি চার্টার্ড বিমানে ১৫০ জন সৌদি আরবের নাগরিকের দেশত্যাগ নিয়ে অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন । কমিশন বিষয়টি বিবেচনা করেছেন এবং আপত্তিকর কিছু পাননি ।