বিয়ের পর স্বামীকে খুব ভালবাসে সে । খরচ বাঁচানোর জন্য কাজের মেয়ে রাখে না, এমনকি ছুটা বুয়াও না । একহাতে সংসারের সব কাজ করে । স্বামীকে বাচ্চার মতো যত্ন করে । কোন খাবারটা সে পছন্দ করে, কখন কোনটা খাবে, মাছের বড় টুকরা, মুরগির রান, সব আলাদা করে রাখে । মেয়ে দুইটাও তার কলিজার টুকরা । দুই রাজকুমারী তার । ঘড়ি ধরে খাওয়ায়, ঘুম পাড়ায়, গোসল করায় । মেয়েগুলা হয়েছেও বড় লক্ষ্মী । মায়ের অবাধ্য কখনো হয় না । মাকে খানিক ভয়ও পায় ।
তবে ইদানীং শ্যামা তার স্বামীর সাথে মাঝেমাঝেই ঝগড়া করে । কখনো সে তার শশুরবাড়ি নিয়ে তাকে খোঁচায় । কখনো স্বামী তাকে খোঁচায় তার বাপের বাড়ি নিয়ে । তার স্বল্প বিদ্যা নিয়েও স্বামী তাকে খোঁটা দেয় । প্রায়ই বলে, "আমার বন্ধুবান্ধব প্রায় সবার বউই মেট্রিক পাশ । একমাত্র তুমিই মেট্রিক ফেল ।" শ্যামা গালিগালাজ করে, "হারামজাদা, শুয়োরের বাচ্চা" যা মুখে আসে তাই । পেট-গাস ভাঙে । স্বামী মাঝে মধ্যে অসহ্য হয়ে তাকে মারধর করে । সেও পাল্টা থাপ্পড়, খামচি দেয় । আরো বেশি গালিগালাজ করে । মেয়েরা ভয়ে কাঁপে । বাড়াবাড়ি বেশি হলে স্বামী বাসা থেকে বেরিয়ে যায় । কোনো সংবাদ না দিয়ে প্রায় দুইদিন নিখোঁজ হয় । তার মা, ভাই ও ভায়ের বউ এসে তাকে জানায় তার স্বামী তাদের জানিয়েছে সে ডিভোর্স করবে । তারা তাকে বোঝায় সে যেন স্বামীর সাথে ভালো ব্যবহার করে । কারণ ডিভোর্স হলে তার সন্তানদের সহ কে দেখবে তাকে । শ্যামা শান্ত মুখে সব শোনে ।
প্রায় সাতদিন পর শ্যামার স্বামী বাড়ি ফেরে । শ্যামা এইবার আর ভাঙচুর, হইচই করে না, শান্ত থাকে । অনেকটা পোষা প্রাণীর মত শান্ত হয়ে যায় । বেশ স্বাভাবিক ব্যবহার করে । তার স্বামী মনে মনে খুশি হয়, যাক তার ট্রিটমেন্ত কাজে লাগছে । মাঝে মাঝে পাশের বাসার ভাই-ভাবিদের সাথে আড্ডা মেরে বাড়ি ফেরে রাত বারোটারও পরে । ফিরে এসে হয়তো দ্যাখে মেয়েদের নিয়ে স্ত্রী ঘুমিয়ে গেছে । লোকটা বুঝতে পারে তার স্ত্রী হেরে গেছে, এবং স্ত্রীকে হারিয়ে দেবার মন্ত্র তার হাতের মুঠায় । মাঝে মধ্যে মেয়েদের বলে, " তগো মা নতুন ভ্যাক ধরছে দ্যাখছস ! এহন আর কাইজ্যা লাগে না ! জায়গামত অষুধ পড়ছে তো ! এখন বুঝছে তালাক দিলে যে যাওনের জায়গা নাই কোনোখানে । বাপের বাড়িতে তো দুইদিনও খাওয়াইবোনা !" তবুও শ্যামা ঝগড়া করে না, শান্ত থাকে । স্বামী তার এই ক্ষমতা, এই স্বাধীনতা বেশ আত্মশাঘাসমেত উপভোগ করে । তবে আবার মাঝে মধ্যে শ্যামাকে সোহাগ ক'রে নতুন শাড়িটাড়িও কিনে দেয় । পাশের বাসার ভাবি এসে একদিন বলে, "কি ভাবি, কেমন আছেন ? ভাই তো আমাগো বাসায় গিয়া বলে যে, আপনেগো ভাবি এহন পুরা বদলাইয়া গেছে । কোনো অশান্তি করে না আর । আমরাও ওনারে বুঝাইছি যে, মানুষ তো সবসময় একরকম থাকে না ! একসময় বদলায় ।" শ্যামা কোনো মন্তব্য করে না । সে এদিকে আশেপাশের মানুষের সাথে মেলামেশা বন্ধ ক'রে দেয়, এমনকি বাবার বাড়িও প্রায় যায়ই না বলতে গেলে । শুধু মেয়েদের নিয়েই ব্যস্ত থাকে । মেয়েদেরও আশেপাশের বাচ্চাদের সাথে মেলামেশা বন্ধ ক'রে দেয় । দু' বোন পুতুল নিয়ে, ছোট হাঁড়িপাতিল নিয়ে ঘরের মধ্যেই খেলে । এক্সময় মেয়েদের নিয়েও তার আগ্রহ ক'মে আসে । মেয়েরা খেল কি না খেল, গোসল করল কি না করল, কোনোকিছু নিয়েই আর ভ্রুক্ষেপ করে না । কোনোরকম রান্নাবান্নাটি শুধু করে । এভাবেই কেটে যায় বেশ কিছুদিন ।
তারপর একদিন মেয়েরা ঘুমালে নিজের পেটিকোটের ফিতা খোলে ।
বড় মেয়ের মুখের কাছে যায় । আদর করে চুমু খায় । সে মরে গেলে কুকুর বিড়ালের মতো অযত্নে বাচ্চাগুলা বড় হবে এটা সে কল্পনা করতে পারে না । পেটিকোটের ফিতা দিয়ে মেয়ের গলায় ফাঁস চেপে ধরে । ছোট রাজকুমারীও মায়ের কোলে একইভাবে নিথর হয়ে পড়ে । তারপর সিলিং ফ্যান থেকে নিজে ঝুলে পড়ে ।
(পরবাস, অক্টোবর, ২০০৫)