বস্টন ইউনিভার্সিটি মেডিকেল স্কুলের ক্যাম্পাসের মধ্যে আমাদের বাড়িটাই সবচেয়ে উঁচু আর সব থেকে অদ্ভুত । সমস্ত লাল ইঁটের বাড়ির পাশে এটাই একমাত্র একহারা ধূসর রঙের, একেবারে বেমানান । আসলে এটা স্টেট মেন্টাল হেলথ্ সিস্টেমের অন্যতম হাসপাতাল । অনেক বছর আগে আমরা যখন এই বিল্ডিংটায় প্রথম আসি তখন ইউনিভার্সিটি একদম ওপরের দুটো-তলা লীজ্ নিত । দশতলার মধ্যে বাকি আটতলায় থাকত পেশেন্টরা । এখন অবশ্য পুরোটাই প্রায় ইউনিভার্সিটির দখলে । অধিকাংশই ছিল গরিব লোক ------- ইনস্টিটিউশনালাইজড্ মেন্টাল পেশেন্টস্ । প্রথম-প্রথম ভয়ই করত । এলিভেটরে দেখা হলে কেউ-কেউ চোখ পাকাতো, কেউ আবার বন্ধুত্বের হাসি টেনে ভাব জমানোর চেষ্টা করত । মনে আছে আমাদের এক সহকর্মীকে `প্রিন্সেস, প্রিন্সেস' বলে ধাওয়া করেছিল এরকম একজন পেশেন্ট । আসলে সুস্থ সমাজের সাথে হয়ত এটাই ছিল বোধহয় তাদের একমাত্র সংযোগ ।
জনাথান ছিল এদেরই একজন । এই বিল্ডিং-এ আসার সপ্তাহখানেকের মধ্যেই হঠাৎ দেখি আমার অফিসে একটা লোক ঢুকছে । চেহারা দেখে পেশেন্ট বলে চিনে নিতে কোনো ভুল হয় না । এ এখানে কেন ! আমার চোখে-মুখে ভয়-বিরক্তি-উদ্বেগের অকুন্ঠ প্রকাশ । আমার নামে সম্বোধন করে লোকটা বলল, `আমার নাম জনাথান সীফ্' । আমি ভাবছি, এ আমার নাম জানলো কি করে ? কিন্তু কোনো কিছু ভাবনার অবকাশ না দিয়ে সে বলল, `ওয়েলকাম্ টু আওয়ার বিল্ডিং'। বয়স আনুমানিক চল্লিশের কাছাকাছি । মাথায় খোঁচা-খোঁচা না-চিরুনি দেওয়া চুল । আর ততোধিক খোঁচা-খোঁচা মুখভর্তি গোঁফদাড়ি । তার মধ্যে দু-একটা রুপোলী চুল ঝিলিক মারছে । একহাতে বেশ কিছু বই । চোখে উঁচু পাওয়ারের চশমা । শ্যেন-দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে । আর অন্য হাত দিয়ে মাঝেমাঝেই নাকের ওপর নেমে আসা চশমাটা ঠিক জায়গায় ঠেলে দেওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছে ।
একটা অদ্ভুত মোনোটোনে কথা বলে চলল জনাথান । কোনোরকম অবতারণা না করেই সে বলল `থিয়োরী অফ্ রিলেটিভিটির সঙ্গে বর্তমান হেলথ্ কেয়ার ত্রক্রাইসিস্-এর গূঢ় সংযোগ আছে ।' এক বিখ্যাত জার্নালের নাম করে সে বলল যে কয়েকমাস আগের এক ইস্যুতে সে পড়েছে । বলতে-বলতে দেখলাম ওর চোখ দুটো একেবারে জ্বল-জ্বল করে উঠলো । নাকের ওপরে নেমে আসা চশমাটা ঠিক জায়গায় তুলে দিয়েই সে প্রসঙ্গ পাল্টালো । স্বাস্থ্যের ওপর ধূমপানের কি প্রতিক্রিয়া এবং তার সাথে অ্যামেরিকান অর্থনীতির কি সম্পর্ক ------- তা সে বলে গেল এক নাগাড়ে । আমি ওকে থামাবো না লেকচার শুনব, এ কথা ঠিক করতে-করতেই হঠাৎ সে কথা থামিয়ে যেমন এসেছিল তেমনিই চলে গেল । আমার বিস্ময়-উদ্বেগ কোনোটারই শেষ নেই । এই বিল্ডিং-এর বাসিন্দারা তো আপাতদৃষ্টিতে অশিক্ষিত বলে মনে হয় । তা জনাথান এসব জানলো কি করে ! তাছাড়া অভিমতগুলো বেশ সুচিন্তিত । আর উদ্বেগ এই জন্য যে পেশেন্টদের তো এখানে ঘোরাঘুরি করার কথা নয় । তা এ এখানে এল কি করে !
পরের দিন জনাথান এল ------- হাতে তিনটে বই । একটা চোখের সামনে খুলে ধরে আমায় জিজ্ঞাসা করলে `মোহনদাস গান্ধী কোন সালে সাউথ অ্যাফ্রিকা ছেড়ে ইন্ডিয়া গিয়েছিল তা আমার জানা আছে কি না'-- আমি তো আম্তা-আম্তা করছি । জনাথান ইতিমধ্যে অন্য প্রসঙ্গে চলে গেছে । স্মোকিং যে একটা মস্ত বড় পাব্লিক হেলথ্ ইস্যু এই নিয়ে সার্জন জেনারেলের মতামত বলে গেল গড়গড় করে । তারপর হঠাতি চলে গেল দুম্ করে ।
শীগগিরই জানতে পারলাম যে জনাথানকে এই বিল্ডিং-এ সবাই চেনে । আমার মতই তার জ্ঞানের অত্যাচার সহ্য করে । এও জানলাম যে জনাথান আমাদের বিল্ডিং-এর জাঙ্ক্ মেলের বিতরক । অনেক ম্যানুফ্যাক্চারার-ই বাল্ক্ মেল পাঠায় ------- যা কেউই বিশেষ প্রয়োজনের চোখে দেখে না । জনাথান সিরিয়াস মুখ করে সেই জাঙ্ক্ মেলগুলো দিতে আসত । জনাথানের সামনে সেই মেলগুলো ফেলে দিতে মন চাইত না । ওকে বলতেও মন চাইত না যে ঐ মেলগুলো একেবারে অপ্রয়োজনীয় ।
একদিন দুম করে জনাথান বলে বসল যে ও হার্ভার্ড স্কুল অফ পাব্লিক হেলথ্-এর ডিরেক্টর-কে স্মোকিং অ্যাণ্ড পাব্লিক হেলথ্ নিয়ে ওর মতামত জানিয়ে একটা চিঠি দিয়েছে, এবং এও জানিয়েছে যে সে হার্ভার্ড স্কুল অফ পাব্লিক হেলথ্-এ গ্রাজুয়েট স্টাডি করতে উত্সাহী । ডা: ঊয়িলসন্ বিখ্যাত লোক । তাঁর এইভাবে সময় নষ্ট করার কোনো মানে হয় ?------- আমি ভাবলাম । কিন্তু ইতিমধ্যেই জনাথান ডা: ঊয়িলসন্-এর পাঠানো চিঠি বার করে ফেলেছে । তিনি জনাথানের হাইপথেসিস-এর প্রশংসা করেছেন । শেষে লিখেছেন জনাথান অ্যাপ্লাই করলে উনি সেই অ্যাপ্লিকেশন ফেবারেব্লি কন্সিডার করবেন ।
জনাথান পড়তে যাবে হার্ভার্ডে ! ব্যাপারটা আপাতদৃষ্টিতে একেবারে অবাস্তব মনে হলেও পুরোপুরি কাল্পনিক ছিল না । কারণ ও আমায় হার্ভার্ডে পাঠানো অ্যাপ্লিকেশন দেখিয়েছে কয়েক বছরের পুরনো । কিন্তু সেই অ্যাপ্লিকেশনের কি হল তার কোনো সঠিক উত্তর জনাথানের কাছ থেকে বার করতে পারিনি । আসলে জনাথানের কাছ থেকে কোনো প্রশ্নের উত্তর পাওয়া ছিল প্রায় অসম্ভব । ও এক নাগাড়ে বলে যেত । তোমার দায়িত্ব শুধু শুনে যাওয়ার । কোনো প্রশ্ন করার সুযোগ পাওয়ার আগেই জনাথান নিরুদ্দেশ !
যদিও জনাথান ছিল এই বিল্ডিং-এর পেশেন্টদের একজন, ওর হাবভাব ছিল অন্য সবাইয়ের থেকে একেবারে আলাদা । প্রতিদিনই সোশ্যাল ওয়ার্কাররা ওদের বাইরে নিয়ে যেত দল বেঁধে । এলিভেটরে দেখা হয়ে যেত মাঝেমাঝে । যদিও এরা সবাই-ই ছিল মানসিক রুগী, তাদের রোগের প্রতিফলন ছিল বিভিন্নরকম । কাউকে দেখে `ওয়ান ফ্লু ওভার কুকু'স নেস্ট'-এর চীফের কথা মনে পড়ত------- এক্কেবারে চুপ, মুখ ভাবলেশহীন, চোখের দৃষ্টি বহু দূরে । আবার কেউ কেউ দেখা হলে ভাব জমানোর চেষ্টা করত । জ্যাক নিকল্সন-এর চরিত্রের মতো । কেউ আবার মাটির দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করত -যেন ভীষণ জটিল এক সমস্যার সমাধানে ব্যস্ত । কেউ আবার দেখা হলেই গোল-গোল চোখ করে তাকিয়ে থাকত যেন চিড়িয়াখানার এক আজব জীব দেখছে । জনাথান কিন্তু ছিল একেবারে আলাদা । কোনো পেশেন্টের সঙ্গে ওকে কোনওদিন মিশতে দেখিনি । এমনকী আমার অফিসের বাইরে অন্যত্র কোথাও দেখা হলে মনে হত ও আমাকে যেন চেনেই না । একটা অদ্ভুত ধরনের অসামাজিকতা ওকে ঘিরে থাকত সবসময় ।
জনাথানের মনের আভাস পাওয়া ছিল প্রায় অসম্ভব । কিন্তু হঠাৎ একদিন আকস্মিকভাবে সে সুযোগ এসে গেল । একদিন একথা, সেকথার পর জনাথান হঠাতি তার মনের বন্ধ দরজাটা খুলে ধরল একটুখানি । বিনা ভূমিকায় ও বলল `আমি স্কুলে সবসময়ই হায়েস্ট গ্রেড পেয়েছি । এই নিয়ে আমার মা-বাবার গর্বের শেষ ছিল না ।' কিন্তু কে তার বাবা-মা সে প্রশ্নের আগেই জনাথান বলল `সবসময়ই আমি পড়াশুনোয় ডুবে থাকতাম । তাই কোনো ছেলেমেয়েই আমার ধারেকাছে বিশেষ আসতো না । এমনকী আমার ভাইও নয় ।' আমি চুপ করে শুনে যাচ্ছি । ও বলে চলল `একবার কোনো কারণে আমার গ্রেড ভাল হয়নি । জেনে আমার মা-বাবার মুখ তো একেবারে গম্ভীর । মা'তো বলেই ফেললেন এরকম গ্রেড পেলে তো হার্ভার্ডে যাওয়া যাবে না ।' এরকম আর একদিনও বলল যে ওর ঠাকুমা ছিলেন বস্টনের নামজাদা এক সোশ্যালাইট । তার এক ভাই বস্টন সিম্ফনি অরকেস্ট্রা-র ট্রাস্টি । এদিকে ওর মা এক নামকরা ফিজিসিয়ান, আর বাবা একজন প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী । এক কথায় ওর ধমনী দিয়ে বস্টন ব্রাহ্মীন-দের নীল রক্ত বইছে । কিছুটা ঔত্সুক্য, আর কিছুটা বিস্ময় নিয়ে আমি ওর কথা শুনে যাচ্ছি । বিশ্বাস করা সত্যিই মুশকিল - মাথাভর্তি বহুদিন চিরুনি না চালানো ঘন চুল, মুখে ক'দিন যে ব্লেড পড়েনি তা কে জানে, গায়ে আধাময়লা শার্ট, আর নিম্নাঙ্গে ততোধিক নোংরা ব্লু জীনস্ । ঠিক করলাম এর পরের বার ওকে চেপে ধরে সব খবর জেনে নেবো ।
সে সুযোগ আমি পাইনি । পরের দিন অফিসে বসে কাজ করছি হঠাৎ আমাদের বিল্ডিং-এর ম্যানেজার গারশন এসে হাজির । ঘরে ঢুকেই সে চেয়ার টেনে দুম করে বসে পড়ল । তারপর বিবর্ণ মুখে বলল `একটা খারাপ খবর দিতে এসেছি । কাল রাতে জনাথান মারা গেছে ।' আমি বোবার মত তাকিয়ে আছি । গারশন বলে গেল `মেন্টাল ডিপ্রেশানের জন্য একটা ওষুধ খেত জনাথান । তারই সাইড এফেক্ট-এর বলি হয়েছে সে । হার্টঅ্যাটাক হয়েছে বোধহয় মাঝরাতে, সকালে আর জাগেনি ।' জনাথানকে এই বিল্ডিং-এর সবাই চিনত । তাই গারশনের ওপরে ভার পড়েছে সবাইকে খবরটা দেওয়ার । তাছাড়া আগামী বুধবার লাইব্রেরিতে জনাথানের স্মরণে এক সভা হবে । সে খবরও সবাইকে জানানোর দায়িত্ব গারশনের ।
বুধবার নির্দিষ্ট সময়ে লাইব্রেরিতে গিয়ে দেখি লোকে লোকারণ্য । জনাথানকে সবাই ভালবাসত, তাই সবাই এসেছে, খালি পেশেন্টরা ছাড়া । একটা কোণে শোকেসের মধ্যে জনাথানের অল্পবয়সী একটা ছবি সুন্দর করে সাজানো রয়েছে । সদ্য-যুবক জনাথান নিবিষ্ট মনে গীটার বাজাচ্ছে । কে বলবে যে এই জনাথানই মাথায় খোঁচা-খোঁচা চুল, মুখে এবড়ো-খেবড়ো দাড়ি নিয়ে ঘুরে বেড়াতো ।
লাইব্রেরিতে ঢোকার মুখে এক ভদ্রলোক ও এক ভদ্রমহিলা দাঁড়িয়ে সবাইকে অভ্যর্থনা জানাচ্ছিলেন । পাশে দাঁড়িয়ে গারশন সবাইয়ের সাথে এদের পরিচয় করিয়ে দিচ্ছে । আমার সময় আসতে গারশন আমার পরিচয় দিল `ইনি দশতলার বাসিন্দা । জনাথান ছিল এঁর খুব প্রিয়পাত্র ।' তারপর আমার দিকে ফিরে বলল `এঁরা জনাথানের বাবা-মা ।' চকিতে জনাথানের কথা মনে পড়ে গেল । ও যখন বলেছিল ওর উচ্চ বংশ-পরিচয়ের কথা, তখন সেকথা বিশ্বাস করা ছিল কঠিন । আর এখন তার জাজ্জ্বল্য পরিচয় সামনে দাঁড়িয়ে । এঁদের বেশভূষা, হাবভাব, কথার উচ্চারণে পরিষ্কার বোঝা যায় যে তারা সমাজের উঁচুস্তরের মানুষ ।
আমি পিছনের লোককে জায়গা ছেড়ে এগিয়ে গিয়ে চেয়ারে বসলাম । ইতিমধ্যে মেমোরিয়াল সার্ভিস আরম্ভ হয়ে গেছে । জনাথানের ভাই এরিক জনাথানের এক অজানা দিকের পরিচয় আমাদের দিল । মিউজিকের সাথে ছিল জনাথানের নিবিড় সংযোগ । ক্লাসিকাল পিয়ানো দিয়ে হাতেখড়ি । খুব ভাল পিয়ানো বাজাতে পারত জনাথান । কিন্তু যত দিন গেছে সেই উত্সাহ দ্বিগুণ ভাবে বর্তেছে গীটার বাজনায় । অসম্ভব ভাল গীটার বাজনার হাত ছিল জনাথানের । বহু জায়গা থেকে ডাক পেত বাজানোর জন্য । এমনকী একটা ব্যাণ্ডেও ঢুকেছিল কিছুদিন । তবে ওর এক্সেন্ট্রিক ব্যবহারের জন্য সেটা বেশিদিন টেঁকেনি । এরিকের পর এল জনাথানের দুজন বন্ধু । তার মধ্যে মেয়েটি একথা-সেকথার পর কবুল করল যে জনাথানের বাজনা শুনে সে তার প্রেমে পড়েছিল । কিন্তু জনাথান তাকে খুব বেশি পাত্তা দেয়নি ।
এসব কথা শুনতে শুনতে হাইস্কুলে পড়া, গীটার বাজানো, মেয়েদের হৃদয়কাড়া জনাথানের একটা রূপ মনে-মনে আঁকার চেষ্টা করছিলাম । আমার চিন্তার স্রোতে বাধা পড়ল, দেখলাম জনাচারেক মাঝবয়সী লোক গান-বাজনা করতে প্ল্যাটফর্মে উঠেছে । আনুষঙ্গিকগুলো আগেই সাজানো ছিল । পরিচয় করে দেওয়া হল জনাথানের পুরোনো ব্যাণ্ড । বীটল্সের কতগুলো পুরোনো গানের সাথে-সাথে অনুষ্ঠান শেষ ।
অনুষ্ঠানের শেষে ছিল কিছু রিফ্রেশমেন্টের ব্যবস্থা । আমার হাতে বিশেষ কিছু কাজ ছিল না । তাই বেশ কিছুক্ষণ নানা লোকের সাথে আলাপ করার পর যখন জনাথানের বাবা-মা'র সামনে ফিরে এসেছি তখন অধিকাংশ লোকই চলে গেছে । অল্প প্রীতিসম্ভাষণের পর জনাথানের বাবা বললেন `জনাথানের ওপরে আমাদের ছিল অনেক উচ্চাশা । ও পড়াশুনোয় ভাল ছিল চিরকাল । একেবারে বইয়ের পোকা ।' আমি বললাম যে তার কিছুটা পরিচয় আমার হয়েছে । উনি বলে চললেন `ও থাকত একেবারে নিজের জগতে । তাই বন্ধুবান্ধব বিশেষ কিছু ছিল না । সত্যি কথা বলতে কি লোকের সাথে ওর হাবভাবই ছিল কিছুটা অদ্ভুত । ওর এই অসামাজিকতা নিয়ে যে আমরা একেবারেই চিন্তিত ছিলাম না সে কথা সত্যি নয় । কয়েকবার সাইকিয়াট্রিস্টও দেখানো হয়েছে । কিন্তু কিছু পাওয়া যায়নি । তা ছাড়া পড়াশুনোয় ছিল ভাল । সুতরাং এ নিয়ে আমরা খুব বেশি মাথা ঘামাইনি ।'
আমি জিজ্ঞাসা করলাম `ওর মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলার কোনো ইঙ্গিতই কি আপনারা পাননি ?' প্রশ্ন শুনে ওঁরা দুজনেই চুপ করে রইলেন কিছুক্ষণ । তারপর জনাথানের মা আস্তে-আস্তে বললেন `একটা ঘটনা ঘটেছিল । আমরা যার কোনো গুরুত্ব দিইনি । কিন্তু সেটাই ছিল বোধহয় প্রথম ইঙ্গিত । জনাথান পড়াশুনোয় চিরকালই ভাল । কিন্তু আরও ভাল কেন করবে না সে নিয়ে আমরা চাপ কম দিইনি । আমরা বংশ-পরম্পরায় বস্টনের বাসিন্দা । আর আমাদের পরিবারের রক্তে হার্ভার্ড মিশে আছে । সুতরাং তাকে হার্ভার্ড-এ যাওয়ার মত গ্রেড পেতেই হবে । এটা শুধু আশাই ছিল না, ছিল এক্স্পেক্টেশন ও ডিম্যাণ্ড । তাছাড়া কলেজে গিয়ে মিউজিক নিয়ে পড়বে - একথাও সে বলতে আরম্ভ করেছিল । এ নিয়ে আমাদের উদ্বেগ আর ওর সাথে কথা কাটাকাটিরও কোনো অভাব ছিল না । কোথায় মেডিকেল স্কুলে পড়ে মা'র পথ অনুসরণ করবে, তা না মিউজিক !'
জনাথানের বাবা স্ত্রীকে থামিয়ে দিয়ে বলে উঠলেন `তখন জনাথান গ্রেড নাইন-এ পড়ে । সবই ঠিকমতো চলছিল । হঠাৎ তার গ্রেড খারাপ হতে আরম্ভ করল । যে জনাথান `এ' ছাড়া কিছু পায়নি, সে কোনো কারণ নেই হঠাতি ইংলিশে `সি' পেল । অন্য সাবজেক্টেও গ্রেড নামতে আরম্ভ করল একেবারে অকারণে ।'
এই বলে জনাথানের বাবা একটু থামলেন । আলতো করে চেপে ধরলেন পাশে দাঁড়ানো স্ত্রীর হাত । দেখলাম জনাথানের মা রুমালে চোখ মুছছেন ।
`স্টুডেন্ট কাউন্সেলর, প্রিন্সিপ্যাল, ক্লাশের টিচার্স - কেউই এই রহস্যের কোনো কারণ দেখাতে পারেনি । মজার কথা হল যে মাসকয়েকের মধ্যেই সব আবার ঠিকঠাক । জনাথান ফিরে গেল নিজের জায়গায়, অর্থাৎ ওর পড়াশুনো নিয়ে সমস্যার শেষ । সুতরাং পুরো ব্যাপারটাই ধামাচাপা পড়ে গেল শীগ্গিরই ।'
জনাথানের বাবা স্ত্রীর হাত ছাড়িয়ে বললেন `খুব ভাল গ্রেড পেয়ে হাই স্কুল পেরোলো জনাথান । কিন্তু আমাদের অনুরোধ, রোষ, চাপ -- এ সব না মেনে ও গেল পড়তে কলাম্বিয়ায় । বলল হার্ভার্ড-তো আছেই ওখানে গ্রাজুয়েট স্টাডি করব ।'
আমরা জনাথানের কথায় একেবারে মগ্ন । মাথা তুলে দেখি লাইব্রেরি একেবারে ফাঁকা । ব্যাণ্ডের লোকেরা তাদের জিনিসপত্র গুছিয়ে নিয়ে চলে গেছে । আর বাইরে দুপুর গড়িয়ে বিকেল । বিকেলের তেরচা রোদ্দুর লাইব্রেরির জানলার ফাঁক দিয়ে ভিতরে এসে করেছে আলো-ছায়ার নক্সা । অন্যদিকে পাশের ক্যাথলিক চার্চের কার্নিশে চলেছে এক পায়রা দম্পতির গলা ফুলিয়ে সখ্য । আর সবকিছু উজিয়ে জনাথানের গীটার বেজে চলেছে অবিশ্রান্ত ভাবে ।
একটা লম্বা নীরবতার পর জনাথানের বাবা একটা দীর্ঘনি:শ্বাস ফেলে বললেন `সবই ঠিক চলছিল । অন্তত তাই মনে হত । হঠাৎ এরকম এক দিনে খবর এল যে জনাথান তার মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে কলাম্বিয়ার প্রেস্বিটারিয়ান্ হসপিটালে ভর্তি হয়েছে । আমরা সঙ্গে সঙ্গে ছুটলাম নিউইয়র্কে । কিন্তু ততক্ষণে ক্ষতি যা হওয়ার তা হয়ে গেছে । জনাথানের তখন শোচনীয় অবস্থা ।'
জনাথানের বাবা একটু থেমে আবার আরম্ভ করলেন `এরপর থেকে ওর অবস্থা ত্রক্রমশই খারাপের দিকে যায় । আমরা চেষ্টার কোনো ত্রুটি করিনি । কিন্তু কিছুই লাভ হয়নি । মাঝে-মাঝে ও ভাল হত । তারপর আবার যে-কে-সেই । অনেক সাইকিয়াট্রিস্ট, অনেক ক্লিনিক ঘুরে ও এখানে এসে থেমেছিল । আমরা চেয়েছিলাম ও ম্যাকলীন হস্পিটালের মত একটা ভাল জায়গায় থাক । কিন্তু কিছুতেই আমরা ওকে ম্যাকলীনে পাঠাতে পারিনি । শেষের দিকে আমাদের দেওয়া কোনো জিনিসই সে নিতে চাইত না । মনে হয় আমাদের বিরুদ্ধে একটা চাপা ক্ষোভ যেন ওর মনে ছিল সবসময় ।'
জনাথানের মা প্রায় অনুচ্চারিত স্বরে বললেন `ও আমাদের ক্ষমা করেনি ।' এর পর জনাথানের বাবা প্রচণ্ড আবেগে স্ত্রীর হাতটা নিজের হাতে টেনে নিলেন । ঘনিষ্ঠভাবে দাঁড়িয়ে ওঁরা চেয়ে রইলেন জনাথানের দিকে । পড়ন্ত বেলায় বাজতে লাগল গীটারের অবিশ্রান্ত সুর ।
জনাথান লিভিংস্টন সীগাল বংশগৌরবের দাবি করতে পারতো না । কিন্তু সে অসাধারাণত্ব অর্জন করেছিল নিজের চেষ্টায় । আর আমাদের জনাথানের মুখে ছিল রুপোর চামচ । কিন্তু ইকেরাসের মত তার মোমের পাখা গলে যায় প্রখর সূর্যের তেজে । মুখ থুবড়ে পড়ে আমাদের জনাথান লিভিংস্টন সীগাল ।
(পরবাস, মার্চ, ২০০৬)