লোপামুদ্রা চিরকাল সিরিয়াস ধরনের । একটু চুপচাপ, অন্তর্মুখী । সেইজন্যেই বোধ হয় ওর দ্বারা আর প্রেম করা হয়ে উঠল না ।
তবে প্রেম এল বৈকি । সম্বন্ধ করা বিয়েতেও যে প্রেম এত তীব্র হতে পারে তা লোপামুদ্রা সত্যিই জানত না । ধ্রুব আর লোপামুদ্রা । চমত্কার জুটি । দেখলে চোখ জুড়োয় । লোপামুদ্রার জীবনের ধ্রুবতারাই বটে । ধ্রুবরও তাই । চক্ষে হারায় লোপাকে । ভারি আশ্চর্য হয়ে যায় দুজনে এই দেখে যে, খাওয়া-বেড়ানো-বই পড়া-সিনেমা দেখা নিয়ে দুজনের পছন্দ একেবারে একরকম । এমনকী কবিতা পড়ার নেশাও দুজনের একইরকম । লোপার ঠাকুমা জনে জনে বলেন, `একেই বলে রাজযোটক ।' মা বলেন, `বড় চিন্তা ছিল আমার শান্ত মেয়েটাকে নিয়ে । জামাই আমার সব ভয় ভুলিয়েছে ।'
ওদের বন্ধুরাও বলে । `মেড ফর ইচ আদার ।' ধ্রুব হাসি হাসি মুখে গল্প করে, `জানো, অফিসে বোসদা বলছিলেন আমাকে দেখলেই নাকি সুখী বলে বোঝা যায় ।'
লোপা হেসে বলে, `এই চুপ । টাচ উড ।'
দুজনেই হাসে ।
হেসে ফেলেই লোপামুদ্রা একটু শান্ত হয়ে চকিত চোখে দরজার দিকে তাকায় । শাশুড়িমা শুনে ফেলেননি তো ?
কি যে হয়েছে ওঁর ! ধ্রুব আর লোপা একত্র হলেও ওঁর মুখ গম্ভীর হয়ে ওঠে ।
সেদিন দুজনে আইনক্সে সিনেমা দেখতে গেল, যাবার আগে মাকে কত সাধাসাধি, কিছুতেই গেলেন না `কাজ আছে' বলে, অথচ বাড়ি ফেরার পর লোপার সঙ্গে একটা কথাও না বলে ধ্রুবকে ডেকে `এত সিনেমার নেশা ছিল তোর জানতাম না তো' বলে ঘরে ঢুকে পড়লেন । সেদিন বাইরের ঘরে খবরের কাগজ নিতে এসে লোপা শোনে ফোনে বলছেন, `হ্যাঁ, ওই দুজনে ঘরে বসে হাসাহাসি করছে ... অফিসের পর আর মায়ের খোঁজ করার সময় নেই ।'
ধ্রুব একমাত্র ছেলে বলেই কি কোন ইনসিকিউরিটি বোধ ? লোপা কেড়ে নেবে ওঁর ছেলেকে ! অথচ ধ্রুব ওকে পছন্দ করার আগেই মণিকাদেবী ওকে পছন্দ করেছেন । শ্বশুরমশাইও ভারি সজ্জন । সুবিমলবাবু আর মণিকাদেবীকে দেখে আর আলাপ করেই লোপার বাবা-মা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলেছিলেন । `ভারি সজ্জন ।' বাবা লোপার মাথায় হাত রেখে বলেছিলেন ।
`খুব অভিজাত । শিক্ষিত পরিবার । মণিকাদি নিজে ডক্টরেট, ইউনিভার্সিটিতে পড়ান, অথচ এত নম্র এত ভদ্র ...' মা কথা শেষ করার আগেই বাবা আর লোপা চোখাচোখি করে হেসে ফেলেছিল । একদিনের আলাপেই উনি মায়ের `মণিকাদি' হয়েছেন । বোঝাই যাচ্ছে, মায়ের খুব পছন্দ হয়েছে ওঁদের ।
পছন্দ হয়েছিল লোপামুদ্রারও । তখনও তো ধ্রুবকে দেখেইনি । কিন্তু আলাপ করতে এসেই মণিকাদেবীর ওকে এত পছন্দ হয়ে গেল, যাবার আগে একেবারে `তুই' বলে কথা বলতে লাগলেন ... তারপর রোজ ফোন .... `আমার ভ্যাবলা ছেলেটা যদি তোকে পছন্দ নাও করে, তবু তোর সঙ্গে আমার সম্পর্ক থাকবে রে ।'
দুজনের পড়ার অভ্যেস প্রায় একই । দুজনেরই প্রিয় গদ্যকার শীর্ষেন্দু, প্রিয় কবি জয় -- সমুদ্র বেশি পছন্দ, বেশি সোনার গয়না পরা পছন্দ নয়, -- এমনকী দুজনেরই পছন্দের শাড়ি কাঞ্জীভরম সিল্ক ।
বিয়ের পরও লোপামুদ্রা যাতে রিসার্চের কাজ এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে সেই নিয়েও কত পরামর্শ । আবার মাঝে মাঝেই কেমন গলায় বলতেন, `ধ্রুব যদি তোকে পছন্দ না করে ... কি হবে !'
ধ্রুবর বিদেশ থেকে ফিরতে তখনও একমাস দেরি । `এই নে আমার ছেলের ই-মেল ঠিকানা । তোরা আলাপ কর লোপা । দেখ কম্পাটিবিলিটি কেমন । আমরা তোদের জোর করব না । ধ্রুবকেও বলেছি । ও রাজী হয়েছে ।'
লোপার বাবা বলতেন, `অনেক ভাগ্যে এমন এমপ্যাথেটিক শাশুড়ি হয় ।'
ঠাকুমা সঙ্গে সঙ্গে বলতেন, `চুপ চুপ । নজর লেগে যাবে । দেখো ঠাকুর । বিয়েটা যেন হয়ে যায় ।' বলে হাত জোড় করে কপালে ছোঁয়াতেন ।
সবই তো ঠিকঠাক হল । দুপক্ষেরই বাবা-মা যেমন চেয়েছেন, সেইমতই মসৃণপথে । ই-মেলে আলাপ করতে গিয়েই ধ্রুব-লোপা খুঁজে পেল নিজেদের, যেমনটি ওঁরা চাইছিলেন ।
তারপর এই বিয়ে ।
`আমাদের শুধু মেয়েটিকেই চাই' বলেছিলেন সুবিমলবাবু ।
ভারি কৃতজ্ঞ লোপা । বাবা-মা-ঠাকুমা সবাই খুশি । মনের মত জামাই, মনের মত শ্বশুরবাড়ি ।
(২)
প্রথম প্রথম লোপাও তেমন খেয়াল করেনি । ধ্রুব অফিস বেরিয়ে গেলে মায়ের সঙ্গে এক কাপ চা খেয়ে স্নানে ঢুকত । ধ্রুবর ছেলেবেলার গল্প, ওঁদের দুজনের বিয়ের গল্প, ধ্রুবর ঠাকুমা ওঁকে কত ভালোবাসতেন সেইসব গল্প করতেন মা । বাবাও এসে বসতেন মাঝে মাঝে । খবরের কাগজ থেকে খবর পড়ে শোনাতেন আর তারপর সেই নিয়ে কথার চাপান-উতোর । বেশিরভাগই মা-লোপা একজোট হয়ে বাবাকে কথার ফাঁদে ফেলে মজা । কবে থেকে যে সেসব বন্ধ হয়ে গেল !
বিয়ের পর পরই ধ্রুব-লোপা হানিমুনে যেতে পারেনি । ধ্রুবর অফিসে কি একটা কাজে খুব ব্যস্ত থাকতে হয়েছিল । সেই নিয়ে মা-ই ধ্রুবকে কম বলেছেন ! `ওরে, সারা জীবন কাজ থাকবে ... বিয়েটা একবারই হয় .... যা না বাবা, বেড়িয়ে আয় তোরা ....'
সেই বেড়িয়ে আসার পর থেকেই তো এইরকম বদল হল মায়ের । উটি গিয়েছিল ওরা । ফেরার পথে ম্যাড্রাসের নামী দোকান থেকে কাঞ্জীভরম শাড়ি কিনেছিল লোপা । নিজের জন্যে কালো শাড়িতে সোনালি পাড় আর মণিকাদেবীর জন্যে কাঁচা হলুদ শাড়িতে গাঢ় বেগুনী পাড় ।
বাড়ি ফিরে `মা, এই দেখো কি এনেছি' বলে উত্সাহে বাক্স খুলে বসেছিল লোপা । উত্সাহে জল ঢেলে দিয়ে মণিকাদেবী `আমার অনেক কাঞ্জীভরম আছে' বলে চলে গিয়েছিলেন ।
ধ্রুবকে কিছু বলতেও বাধোবাধো লাগে লোপার ।
`লোপা, আমার সবচেয়ে বড় পাওয়া হলে তুমি । বিয়ের আগে কত চিন্তা হত কেমন মেয়ে আসবে । মা-বাবার একমাত্র ছেলে আমি .... যদি বউ এসে মা বাবাকে ঠিকমত অ্যাক্সেপ্ট না করে ! ... তুমি আর মা এত সুন্দর মানিয়ে নিয়েছ ... এমন আইডিয়াল সংসার কজনের হয় !.... আমি খুব লাকি । আমি তোমার কাছে গ্রেটফুল লোপা ।'
কিই বা বলবে ধ্রুবকে ।
`আমরা একসঙ্গে বসে হাসি গল্প করি, মা পছন্দ করেন না ?' নাকি `মা আমার সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেন ?' দুর্ব্যবহার বলতে যা বোঝায় তার কিছুই তো দেখা যায় না আপাত দৃষ্টিতে । ধ্রুবর মাসিরা এলেন সেদিন, মণিকাদেবী দিব্যি `লোপা' `লোপা' করলেন সর্বক্ষণ । `লোপা খুব ভালো বিরিয়ানি রাঁধে', `লোপা, বেশ এলাচ দিয়ে চা করো তো', `এবার পুজোয় সবাই একসঙ্গে ঠাকুর দেখতে গেলে বেশ হয়, না লোপা ? তুমি বলো মাসিদের তবে সবাই ঠিক যাবে' .... রঞ্জুমাসিও বেশ `দিদি রে, আমার বুলানের জন্যে লোপার মত একটা মেয়ে দেখে দিবি তো ?' বলতেই শাশুড়িমায়ের একমুখ হাসি, `আমাদের লোপার মত ? তেমন মেয়ে লাখে একটা ।'
এই মায়ের নামে কিছু বললেই বা কেউ বিশ্বাস করবে কেন ? কিই বা বলবে লোপা ?
ওই রঞ্জুমাসি-সন্ধ্যামাসিরা চলে যাবার পরপরই তো এক কাণ্ড । চায়ের বাসনগুলো ধোবার জন্যে সিঙ্কে নামিয়েছে লোপা, শাশুড়িমা এসে লাল লাল মুখে `অনেক কষ্ট করে এক একটা সেট কিনেছি, বুঝলে ? এই লা-ওপালার একটা কাপ ভাঙ্গলে পুরো সেটটা নষ্ট জানো তুমি ? তোমার এই সংসারের জিনিসে মায়া হবেই বা কি করে ?' শুরু করে একঘন্টা ধরে কত কিই যে বললেন । কি যে ভুল করেছে লোপা ভয়ে জিজ্ঞেস করতেই পারল না ।
সেখান থেকে সরে এসে অন্যঘরে ঢুকলেই বলে উঠবেন, `গুরুজনদের সম্মান দিতে শেখাননি বাবা মা' ... আবার দাঁড়িয়ে থাকলে `ঢের ঢের বেহায়া দেখেছি, এইরকম দেখিনি ।'
সেদিন ধ্রুব তাড়াতাড়িতে একটা জরুরী ফাইল ফেলে গেছে, অফিস পৌঁছে ফোন করেছে, `লোপা, তুমি ইউনিভার্সিটি বেরোবার সময় ফাইলটা নিয়ে এসো, আমি মোহনকে পাঠিয়ে তোমার ডিপার্টমেন্ট থেকে কালেক্ট করে নিচ্ছি ।' সে কি রাগ মায়ের ।
`ছেলের মাকে ফোন করার কথা মনে থাকে না, অফিস পৌঁছেই বউকে ফোন করা চাই ।' মোহনকে পাঠিয়েই যদি ফাইল নিয়ে যাবে, তো বাড়ি থেকেই নিয়ে যাক না ।' সুবিমলবাবুও বোঝাতে চেষ্টা করলেন ওটাই সুবিধে, ইউনিভার্সিটি আর ধ্রুবর অফিস কাছাকাছি । কে শোনে কার কথা ।
স্বামীকে তো বশ করেছেই, শ্বশুরকেও বশ করে ফেলেছে -- এমন কথা শুনেও লোপার চোখে জল আসবে না ?
কিন্তু ধ্রুব ফিরতেই তাঁর অন্য রূপ । `ও ধ্রুব, আজ তাড়াতাড়ি ফিরেছিস, লোপাকে নিয়ে ইন্দ্রনীলের বাড়ি ঘুরে আয় না । সংসার আর পড়া-পড়া করে যে মেয়েটার মুখ শুকিয়ে গেল ।'
লোপা কিছু বললেও কি আর ধ্রুব বিশ্বাস করতে পারে ?
আর লোপা বলবেই বা কি ?
ভারি লজ্জা করে লোপার । কলেজে থাকতে বন্ধুদের সঙ্গে কত তর্ক করেছে এই নিয়ে । `সব সংসারে এই অশান্তি কে বলল ?... যারা বলে তারা এসকেপিস্ট' .... বি এস সি পড়তে পড়তেই মধুরিমার বিয়ে হয়ে গিয়েছিল । অমন ব্রিলিয়ান্ট মেয়ে, ক্লাস করতে আসতেই পারত না -- শাশুড়ি নাকি মধুরিমার কলেজে যাওয়া পছন্দ করেন না । কলেজে মধুরিমার পক্ষে সব মেয়েরা তর্ক তুলত, নারীস্বাধীনতা নিয়ে কত কথা । সঙ্গীতা একটা দামি কথা বলেছিল, `মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোয় মেয়েদের বিয়ের পর আর কিছু না পাওয়া হোক, কতগুলো সম্পর্ক আর সেই সব সম্পর্কের দাবিতে নিজেকে ভুলে যাওয়া অবশ্যই পাওনা হয় ।'
লোপা অত নেতিবাচক ভাবতে পারত না । ওর মনে হত, শাশুড়ি-বউমা সমস্যা একটি ইউনিভার্সাল সমস্যা বলে যতই প্রচলিত থাক -- সব সমস্যার একটা সমাধান আছেই । এই তো লোপার নিজের বাড়িতে, -- মা-ঠাকুমা একসঙ্গে একটা ইউনিট নয় ? মা আর ঠাকুমার স্বভাবে বিশ্বাসে কম অমিল আছে ? তবু অত বছর কাটিয়ে দিয়েছেন তো একসঙ্গে ।
`আমরা এ যুগের মেয়েরাই সহনশীল নই ... আমাদের ধৈর্য কম' এই বলে লোপামুদ্রা শাশুড়িদের তরফে যুক্তি তুলত ।
আজ কি করে লোপা ?
সেই চিরকালীন শাশুড়ি-বউ ঝগড়ায় নেমে পড়বে ?
ছি । ছি ।
তার শিক্ষা-দীক্ষা সংস্কার এই শেখাল তা হলে ?
জোরে জোরে ঘাড় নাড়ে লোপা ।
`কি হল তোমার ? অমন মাথা নাড়াচ্ছ কেন ?' ধ্রুবর ডাকে সম্বিত ফেরে । তোমার কি হয়েছে লোপা ? মনখারাপ ? মায়ের কাছে যাবে ? কোথাও বেড়াতে যাবে ?'
লোপা মাথা নাড়ে । না, কোথাও যাওয়া নয় । এইখানে থেকেই লড়াইটা লড়তে হবে ওকে । নি:শব্দ লড়াই । জিততেও হবে ।
হবেই ।
আহা, ওঁরও তো একমাত্র ছেলে ।
সারাজীবনের শ্রম, সারাজীবনের ভালোবাসার সংসার ।
গভীর প্রত্যয়ে ঠোঁটদুটো শক্ত হয় লোপামুদ্রার । ওঁকে বিশ্বাস করতেই হবে । লোপার প্রতি বিশ্বাস ।
(৩)
সকালবেলায় বিছানা ছেড়ে উঠে বাইরে আসতেই মণিকাদেবী দেখেন, লোপা মুখ শুকনো করে বাইরের ঘরের সোফায় বসে আছে । রোজ এতক্ষণে তার ধ্রুবর অফিসের খাবার তৈরি হয়ে যায় । সকাল সকাল হলটা কি ! `ছেলেটা কি না খেয়ে অফিস যাবে নাকি' বাতাসে কথা ছুঁড়ে দিয়ে মণিকাদেবী রান্নাঘরে ঢোকেন । আড়চোখে তাকিয়ে দেখেন, লোপা একইভাবে সোফায় বসে । যাক, আজ আর এদিকে আসবে না । মনের আনন্দে মণিকাদেবী ধ্রুবর পছন্দের পাঁচ-সাতটা পদ বানিয়ে ফেলেন । কতদিন ছেলেটার পছন্দের রান্না করা হয়নি ! মনেই পড়ে না, এর জন্যে লোপাকে দোষ দিয়ে লাভ নেই । `ছেলের বউ এসেও আমার বিশ্রাম নেই ... সেই রোজকার রান্না আমাকেই করতে হবে' বলে বলে লোপা রান্নাঘরের কাজ নিজে থেকে তুলে নিতে নিতে নিজেই হাঁফ ছেড়েছিলেন । আর লোপা সত্যিই রাঁধে ভাল । ওই যে মেজাজি বড় ননদ, সুবিমলের দাপুটে বড়দি, তিনি পর্যন্ত লোপার পরিপাটি রান্নার গুণে মুগ্ধ ।
ধ্রুব খেয়েদেয়ে অফিস চলে গেল, লোপা নির্বিকার মুখে সাংসারিক কথাবার্তা সেরে স্নান করে খেয়ে `বাবা, সময়মত ওষুধ খেও' বলে সুবিমলের ওষুধ গুছিয়ে রেখে `মা আসি' বলে বেরিয়ে গেল । মুখে একটুও কষ্ট নেই, চোখে কান্না নেই । হলটা কি ! মণিকাদেবীর মনটা সারাদিনই অস্বস্তি ।
মারলেও কাঁদে না -- তাকে কাঁদাবার উপায় কি । লোপার ওপর খুব রাগ হয় আজকাল । কেমন নিরীহ শান্ত মুখখানা, ওই ভিজে ভিজে চোখ দেখেই যে নিজেও ভুলেছিলেন তা মনে করলেই নিজের ওপর রাগ হয় । মেয়েটা যে এমন ধ্রুবর মনপ্রাণ জুড়ে বসবে কে ভেবেছিল ।
ভেবেছিলেন, ছোট একটি মেয়ে আসবে বাড়িতে, `মা-মা' করে ঘিরে থাকবে, তা নয় । তাঁর ছেলেটাই যে আঁচলছাড়া হয়ে গেল । এখন শুধু `লোপা-লোপা' ছাড়া মুখে কথা নেই । `মা, লোপার চিংড়িমাছে অ্যালার্জি, তাই চিংড়িমাছ আনিনি' ... `মা, লোপাকে ভ্যালেন্টাইন ডে-তে কি সারপ্রাইজ গিফট দিই বল তো' ... `মা, লোপার ঠাকুমার শরীর খারাপ, ওকে ও বাড়ি পাঠিয়ে দিও' - কেন রে ? শুধু লোপা আর লোপা !
এই যে মণিকাদেবীর মা গ্রামের বাড়িতে একলা পড়ে আছেন, ছেলের তো মনে হয় না দিদিমাকে দেখে আসি ? চিংড়িমাছের মালাইকারি খেতে কি ভালবাসত ধ্রুব, বউ এর জন্যে চিংড়িমাছই আনবে না ? বিয়ে তো তাঁরও হয়েছিল, সুবিমলও বড় চাকরি করতেন, তবে তিনি তো প্রথম বিবাহবার্ষিকীতে বউকে হিরের আংটি কিনে দেবার কথা ভাবেননি ! ধ্রুব নিজেই বা অত জানত নাকি ? বিয়ের সময় তিনি নিজে বলে বলে লোপার জন্যে সব জিনিস কিনিয়েছেন । এখন ছেলের আর মাকে দরকার নেই ।
দীর্ঘশ্বাস পড়ে একটা ।
ওই মেয়ে এসেই ধ্রুব বদলে গেল এমন । সবচেয়ে রাগ হয় সুবিমলের ওপর । `ও লোপা, খেয়েছ মা ?' বলে এমন আদিখ্যেতা করবেন রোজ ! সবার কাছে এত সোহাগ পেলে সে মেয়ের আর শাশুড়ির দিকে নজর থাকে ! শাশুড়ি তো দাসী-বাঁদীর মত !
কিন্তু সত্যিই অবাক হন মণিকাদেবী ।
লোপা যেন কিছুতেই দু:খ পাবে না পণ করেছে ।
রান্নাঘরের পাট শাশুড়ির হাতে তুলে দিয়ে বেশ নিশ্চিন্তেই আছে । শেষপর্যন্ত নিজেই রান্নার কাজে ডেকে নিতে বাধ্য হলেন । আজকাল একা হাতে অত পারেন নাকি !
তাতেও মেয়ের কোন তাপ উত্তাপ নেই ।
সেদিন `তোমার মা বাবাকে বলেছিলাম মেয়ে ছাড়া কিছু চাই না, তাই এমন শুধু হাতে মেয়ে পাঠিয়ে দিলেন' বলতে লোপার মুখে কালো ছায়া পড়তে দেখে ভেতরটা আনন্দে খলবল করে উঠল । এই তো মোক্ষম দাওয়াই । কিন্তু আধঘন্টা পরেই `মা, মিলুবউদি তোমাকে ফোনে ডাকছেন' বলে হাসি হাসি মুখে উঠে এল মেয়ে । আচ্ছা বেহায়া তো !
মিলু ওঁর ছোট জা-এর ছেলের বউ । সুবিমলের ভাই সুশোভনের একটিমাত্র ছেলে ওই বিমান । জা-টিকে তো চেনেন, সবিতা ছেলের বিয়ে দিয়ে ইস্তক বউটাকে রোজ কাঁদিয়ে ছাড়েন । শুনেছেন সবিতা মিলুকে রাগের মাথায় চড়-চাপড়ও মারেন । মেয়েটা আবার ওঁকে বড় আপন ভাবে । `কি হল আবার' ভাবতে ভাবতে কড়ায় একটা ঢাকা দিয়ে গ্যাসটা কমিয়ে বাইরের ঘরে আসেন ।
ঢুকতে গিয়ে থমকে দাঁড়াতে হয় । চাপা গলায় ফোনে কথা বলছে লোপামুদ্রা । মিলুকে কিছু বদ বুদ্ধি দিচ্ছে নিশ্চয় । মুখের রেখা কঠিন করে কান খাড়া করেন মণিকাদেবী ।
..... `না না মিলু, অত ভেঙে পড়ার কিছু নেই' ... `বিমানের সঙ্গে কথা বলব আমি' .... ঠিকই সন্দেহ করেছিলেন তিনি । নিজে যেমন ধ্রুবকে বশ করেছে, সেই মন্ত্রই শেখাচ্ছে মিলুকে । মাথায় চড়চড়িয়ে রাগ উঠে আসে মণিকাদেবীর । এগিয়ে গিয়ে ফোনটা কেড়ে নেবেন ভাবার সঙ্গে সঙ্গেই শোনেন লোপার গলা, `ও রকম বলতে নেই মিলু, কাকিমা বিমানের মা .... বিমান ওঁর একমাত্র ছেলে .... তোমরা ছাড়া ওঁরই বা কে আছে বল ? .... হ্যাঁ মিলু, তুমি ঠিক বলেছ, আমার মত শাশুড়িভাগ্য কজনের হয় .... এ বাড়ির মা নিশ্চয় বিমানের সঙ্গে কথা বলবেন, কাকিমার সঙ্গেও .... কেঁদো না তুমি .... হ্যাঁ, মাকে বলেছি .... ধর একটু, দেখে আসি মা এখনও এলেন না কেন' -- নি:শব্দে সরে আসেন মণিকাদেবী ।
কদিন কেমন ঘোরের মধ্যে থাকেন মণিকাদেবী ।
সুবিমলের প্রেশার হঠাৎ বেড়ে গিয়ে মাথা ঘোরা, সঙ্গে জ্বর । ধ্রুব অফিসের কাজে বাইরে । একা হাতে লোপা কেমন সামলে নিল সব । অজান্তেই `ও লোপা, ডাক্তার কি বললেন', `ও লোপা, তোমার শ্বশুর তো ঘুমোচ্ছেন, এসে দুটো মুখে দিয়ে যাও, - লোপাও এসে শান্ত বাধ্য মেয়ের মত খেয়ে উঠে যায় ।
না, অতটাও খারাপ নয় মেয়ে । মা-বাবার শিক্ষা-দীক্ষা আছে ।
তারপর আজ রবিবার । খুব ভোরে উঠে ধ্রুব আর লোপা বেরিয়েছে । কোথায় গেছে ঠিক পরিষ্কার করে বলেনি । সারাদিন আউটিং শেষে বিকেলের মধ্যেই ফিরবে এইটুকু বলে গেছে ।
আজ যে তাঁর জন্মদিন তাও কারও মনে নেই ।
আট বছর বয়স থেকে ধ্রুব নিজে কার্ড এঁকে তাঁকে প্রথম `হ্যাপি বার্থডে' বলত, সে তো বলেইনি, সুবিমলও মনে রাখেননি ।
একটু বেলায় মিলু ঠিক মনে করে ফোন করেছে । তবু ভালো, কেউ তো মনে রেখেছে । ষাট বছর বয়স হয়ে গেল বলে কি জন্মদিন গুরুত্ব হারিয়ে ফেলে !
মিলুর সঙ্গে কথা বলে ফোন রেখে বেরোতেই দরজায় আওয়াজ ।
দরজা খুলতেই অবাক বিস্ময় ।
মা ! মেমারি থেকে এই অশক্ত শরীর একলা এসেছেন !
ইস, আজই লোপা-ধ্রুব নেই ! লোপাকে তো মা দেখেনইনি । বিয়েতে মাকে আনতে পারেননি মণিকাদেবী, মা খুব অসুস্থ ছিলেন । বিয়ের পর থেকে ধ্রুব-লোপাকে সঙ্গে করে একবার গিয়ে উঠতেও পারেননি ।
এক লহমায় এতকথা ভেবে ফেলেন মণিকাদেবী । মা মিটিমিটি হেসে বলেন, `হ্যাপি বার্থডে । অ লোপা, ঠিক ঠিক কইসি ত ?'
লোপামুদ্রা মায়ের পেছনে এসে দাঁড়ায় -- মায়ের মাথা ছাড়িয়ে আরো একহাত লম্বা মেয়েটা । `হ্যাপি বার্থডে মা । বার্থডে গিফট পছন্দ তো ?'
মা ততক্ষণে থুপথুপ করে ঢুকে এসেছেন, `ভারি লক্ষ্মী মাইয়া ... তরে খুব মানে গনে রে ... মা সাথে না থাকলে আর ঘর কি ... আমরা তোমাকে আর একলা থাকতে দিমু না .... ঠিক ধইর্যা আনল' মণিকাদেবী লোপামুদ্রাকে জড়িয়ে ধরেন ।
ঠিক মেয়ে । ধ্রুবর বউ চিনতে ভুল হয়নি ওঁর । বড্ড উঁচুতে উঠে গেল মেয়েটা । সব রাগ গলে গলে জল হয়ে ঝরে পড়ে দু চোখ দিয়ে । মায়ায় ভরে ওঠে বুকের মধ্যেটা ।
লোপামুদ্রা মায়ের বুকে মুখ গুঁজে হাসে ।
ভালোবাসা ।
এই একটি মন্ত্রে সবাই বশ ।
(৪)
আহা, লোপার লড়াই বুঝি শেষ হল । তৃপ্তির নিশ্বাস ফেলেন মণিকাদেবীও । কি যে সব ভুলভাল ভাবনায় শুধু শুধু ভুল হয়ে গেল কতগুলো ! নতুন করে বাগানে মাটি কোপাতে বসেন । শুকিয়ে যাওয়া গাছগুলো তুলে ফেলে নতুন নতুন গাছ লাগান, মাটি কুপিয়ে ফিরে শ্রান্ত হয়ে বসে পড়েন সোফায়, `ও লোপা, একটু জল দে তো মা ।'
লোপা সাড়া দেয় না ।
শুনতে পায়নি বুঝি, জল নিতে উঠে দেখেন লোপা দিব্যি পাশের বারান্দায় দোলনায় বসে রয়েছে । কিছু বলেন না অবশ্য ।
মা হতে চলেছে লোপা ।
এ সময় একটু মেজাজি হয় অনেকে ।
বাবা-মা এসে ভারি খুশি হন, শ্বশুরবাড়িতে লোপার যত্ন দেখে । মণিকাদেবী লোপাকে কোন কাজ করতে দেবেন না, `শুধু ভাল ভাল বই পড়', `গান শোনো', `সবসময় আনন্দে ভরে থাক' -- একটু অবাক হন লোপার ব্যবহারেই । কেমন ছাড়া-ছাড়া ভাব । মণিকাদেবীর কোন প্রশংসা করলেই, `ছাড়ো তো, ওনার যত লোকদেখানি' -- বাড়ি এসে বাবা একটু দু:খই করেন এই নিয়ে ।
মাও বলেন, `লোপা কেমন বদলে যাচ্ছে, না ?'
--`সব ঠিক হয়ে যাবে ।' ঠাকুমা বলেন ।
--`সব ঠিক হয়ে যাবে', সুবিমলবাবুও বলেন মণিকাদেবীকে ।
--`হ্যাঁ গো, আমি জানি । আসলে আমিও তো অকারণে লোপার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেছি । শোধবোধ হয়ে গেলেই ভাল', কেন যে অমন করতেন ভাবলে নিজেরই লজ্জা লাগে এখন ।
গর্ভিণী লোপা, সন্তানসম্ভাবনায় উজ্জ্বল মুখ, শ্রান্ত মাতৃমুখ -- মুগ্ধ হয়ে যান মণিকাদেবী । কি সুন্দর লাগছে লোপাকে ! তিনিও ঠিক এমন করেই একদিন প্রতীক্ষা করেছিলেন ধ্রুবর জন্যে ।
শাশুড়িমা কেমন মায়ার হাতে তেলমালিশ করে দিতেন, রোজ রান্না করতেন তাঁর পছন্দের খাবার ... মায়া মায়া সেই চাউনি মনে পড়ে মনটা নরম হয়ে যায় ।
`আয় লোপা, চুলটা তেল মাখিয়ে বেঁধে দিই', তিনিও লোপাকে তেমন করেই ভালবাসায় ভরিয়ে রাখবেন, ঠিক শাশুড়িমায়ের মত করেই ।
--`না, থাক ঠিক আছে, আমার চুলে আজ শ্যাম্পু করব ।' লোপা কাছে আসে না ।
এইসময় মায়ের কাছে থাকতে ভাল লাগবে বুঝি ওর ! `মায়ের কাছে যাবি লোপা ?' বলতেই লোপা ধ্রুবর সামনেই মুখের ওপর বলে ওঠে, `তাতে কি তোমার সুবিধে হবে ?'
ধ্রুব অবাক চোখে তাকায়, `কি হল লোপা ? মা তো তোমার ভালোর জন্যেই বলছেন ।'
--`আমার ভাল আমাকেই বুঝতে দাও', লোপা রাগ করে উঠে যায় ।
ধ্রুবকে বোঝান মা-ই, `কিছু বলিস না ওকে । এ সময় মেয়েরা মেজাজি হয়ে যায় । সব ঠিক হয়ে যাবে ।'
সব ঠিক হয় না কিন্তু ।
ছোট্ট রূপকে কোলে নিয়ে লোপা বাড়ি ফেরার পর সুবিমল মণিকাকে দেখে রোজ নতুন করে মুগ্ধ হন । আবার যেন ছোট্ট ধ্রুবকে ফিরে পেয়েছেন মণিকা । লোপার স্বাচ্ছন্দ্যের দিকে তেমনই নজর, লোপা নিজেও মাঝে মাঝে ভাবে -- এমন শাশুড়ি সত্যিই অনেক ভাগ্যে হয় ।
কিন্তু, কি যে হয় লোপার, কিছুতেই সেই যন্ত্রণার দিনগুলো ভোলা হয় না । কি না করেছে মণিকাদেবীর মন পেতে । ধ্রুব ওঁর ছেলে, একমাত্র ছেলে -- লোপা এসে যেন সেই ছেলেকে কেড়ে নিয়েছে ওঁর কাছ থেকে -- এমন ভাব । লড়াইটা হয়ত সত্যিই জিতেছে লোপা, কিন্তু বড্ড দাম দিয়ে । লোপার ব্যক্তিত্বটাই বদলে গেছে আজ । অনেকগুলো দিন বড় ইনসিকিউরিটিতে ভুগেছে বলেই কি !
ও:, কি সব দিন গেছে ।
ছোট্ট রূপকে বুকের ওম দিয়ে জড়িয়ে ধরে লোপা ।
রূপ, আমার রূপ, আমার সোনামণি !
এই রূপ নাম নিয়েই কি কাণ্ড । শাশুড়িমা নাম রেখেছিলেন ঋষি, লোপারও পছন্দ ছিলই নামটা । কিন্তু কি যে হল, যেই না ধ্রুব বলেছে, `বা: দারুণ...ফ্যান্টাস্টিক নাম', অমনি লোপা বলে উঠেছে, `আমি ওর নাম রেখেছি রূপ ।'
একটু থমকে গেলেও শাশুড়িমাই তখন সবার আগে, `খুব ভাল নাম, ঋষি বড্ড কমন নাম, এই নামটাই বেশি ভাল' বলে খুশি হয়েছিলেন । তখন একটু খারাপ লেগেছিল লোপারও । বিশেষত ধ্রুবর চোখে আহত দৃষ্টি, অবাক চোখে লোপাকে দেখা -- বেশ অস্বস্তি হয়েছিল সেদিন ।
তবু, রূপই ওর জোর ।
রূপ আমার । এক্কেবারে আমার ।
ধ্রুব ওঁর ছেলে বলে ওঁর যত জোর, রূপের জন্যে এই সংসারে লোপারও ততখানিই জোর ।
আনমনে একটা নিশ্বাস পড়ে লোপামুদ্রার ।
কিছুতেই কেন যন্ত্রণা ভোলা হয় না ! এই তো শাশুড়িমা রূপকে কত ভালবাসেন, ওঁরও একমাত্র নাতি যে । তবু রূপের ওপর ওর দাবি যে সবচেয়ে বেশি সেটা লোপা কিছুতেই ছাড়তে পারবে না ।
রূপ আমার । একেবারে আমার ।
সমান্তরাল দুটো রেলের লাইন, একের অন্যকে ছাড়া চলবে না, একে অন্যের পরিপূরক । তবু দুজনে কোনদিনই এক বিন্দুতে মেলা হয় না ।
সংসারেও কি তাই ?
লোপা আর মণিকাও কি ওইভাবেই শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান করে চলবে আজীবন ? সংসার মানেই কি সমান্তরাল রেখায় চলা দুই জীবনের গল্প ?
কে জানে ।
(পরবাস, মার্চ, ২০০৬)