এই দ্বিতীয় শ্রেণীর একটি পত্রিকার লেখাপত্তরের নির্বাচিত একটি সংকলন হাতে এসেছে সম্প্রতি । পত্রিকার নাম 'কৌশিকী'। বাঙলা পত্র-পত্রিকার জগতে এ নাম সুধীজনের কাছে হয়তো ততোটা পরিচিত নয়, যদি না পাঠক বাঙলা সংস্কৃতির একটি বিশেষ দিক সম্বন্ধে উত্সাহি হন । এটি একটি লোকশিল্প, সংস্কৃতি ও আঞ্চলিক-ইতিহাস বিষয়ক পত্রিকা । বাঙলা আকাদেমি প্রকাশিত 'বাঙলা লিটল ম্যাগাজিন তথ্যপঞ্জি' বলছে, নবপর্যায়ে এটি একটি বার্ষিক, আঞ্চলিক-ইতিহাস ও প্রত্নতত্ত্ব বিষয়ক পত্রিকা যার প্রকাশ শুরু হয়েছে ১৯৯৫ সাল থেকে । এই সংকলনটি তে কিন্তু গ্রন্থিত হয়েছে পত্রিকটির পূর্বপর্যায়ে প্রকাশিত ৩৮-টি সংখ্যার সব কটি লেখা । এই লেখাগুলির সময়সীমা ১৯৭১-১৯৮৮ অবধি । এই দীর্ঘ সময় ধরে পত্রিকাটির প্রাণপুরুষ স্বরূপ ছিলেন অধুনাপ্রয়াত বঙ্গসংস্কৃতির প্রখ্যাত গবেষক, শ্রীতারাপদ সাঁতরা । তিনি ছিলেন একাধারে সম্পাদক, লেখক ও কার্য-নির্বাহক । তারাপদ বাবুর অক্লান্ত প্রচেষ্টায় এই পত্রিকাটি প্রকাশিত হয়েছে প্রায় সত্তর-আশির দুটি দশক জুড়ে । এই সংকলনটি দু-খণ্ডে প্রকাশ করেছেন বর্নালি পাইন, `সেন্টার ফর আর্কিওলজিকাল স্টাডিজ অ্যাণ্ড ট্রেনিং, ইস্টার্ন ইণ্ডিয়া'-র অর্থানুকুল্যে । প্রথম প্রকাশ জানুয়ারি ২০০৪ । পরিবেশক পুস্তক-বিপণি । প্রাপ্তিস্থান পুস্তক বিপণি, ২৭ বেনিয়াটোলা লেন, কলকাতা- ৭০০০০৯ ।
সুন্দর পেপারব্যাক বাঁধাই-এ নিকষ-কালো প্রচ্ছদপটে সাদা অক্ষরে লেখা `কৌশিকী' নামটি প্রথমেই চোখে পড়ে । নামের তলায় রয়েছে কৌশিকীর পুরোন কিছু সংখ্যার প্রচ্ছদের ক্ষুদ্রায়িত অংশের কোলাজ দিয়ে লেখা পত্রিকাটির নাম -লম্বালম্বি ভাবে । বেশ নজর কাড়া সেই কোলাজ । শ্রদ্ধেয় পুর্ণেন্দু পত্রী মহাশয় এর নামলিপি ও প্রচ্ছদ এঁকেছেন এবং এর অলংকরণের ভারও ছিল তাঁর ওপর । নামলিপিতে বাঙলা মন্দিরের স্থাপত্যের ছাঁদ ভেতরের বিষয়বস্তুর হালকা আভাস দেয় । সে আভাস পাঠককে পাতা উল্টে দেখার জন্য আরো উদগ্রীব করে তোলে । মুখবন্ধে, বর্তমান সম্পাদক শ্রীদেবাশিস বসু জানিয়েছেন যে, হাসপাতালে অন্তিম শয্যা থেকে তারাপদবাবু স্বয়ং এই সংকলনের প্রকাশনায় সহায়তা করে গেছেন । অধ্যাপক অশোক ভট্টাচার্যের ভূমিকা পড়ে জানলাম যে, তেভাগা আন্দোলনের কর্মী হিসেবে তারাপদবাবু একসময় বাঙলার গ্রাম-গ্রামান্তরে ঘুরে বেড়িয়েছেন । বাঙলা সমাজ ও সংস্কৃতির বিস্তৃত ক্ষেত্রের সঙ্গে পরিচিতি সেই সময় থেকে । যদিও পরবর্তীকালে রাজনৈতিক আন্দোলন থেকে পুরোপুরি বেরিয়ে আসেন, তবুও ওনার লেখায় একজন সমাজসচেতন বুদ্ধিজীবীর ছাপ বরাবরই ছিল ।
এই সংকলনে কৌশিকী-র ১-৩৮তম সংখ্যার সবকটি, অর্থাৎ মোট ৩১৮-টি প্রবন্ধ স্থান পেয়েছে । অধিকাংশই লিখেছেন বাঙলার বিভিন্ন জেলা তথা গ্রামের বাসিন্দারা, যাঁরা বাঙলার নানান আঞ্চলিক ইতিহাসের, শিল্পের রসগ্রাহী অনুসন্ধানী । ফলে প্রতিটি লেখাতেই রয়েছে লেখকদের মমতাময় প্রযত্ন, যা কেবল গ্রামাঞ্চলের বাসিন্দাদের তাঁদের, বৃহত্তর অর্থে, বাসস্থানের প্রতি বিশ্বস্ততাতেই মেলা সম্ভব । এখানেই বোঝা যায় যে, সম্পাদক হিসেবে তারাপদবাবু কতটা দুরদৃষ্টি সম্পন্ন ছিলেন । লেখাগুলি ভাষা, সংস্কৃতি ও প্রত্নজিজ্ঞাসার নানাদিক নিয়ে লেখা । বিষয়বস্তুর বৈচিত্র্য বিস্ময়ের উদ্রেক করে । কয়েকটি উদাহরণ দিই -- হলদিয়া বন্দরের পূর্ব ইতিহাস, পূর্ব ভারতের আদিবাসী ধাতু শিল্প, বঙ্গসংস্কৃতির সঙ্কটময় মুহূর্তে, প্রাচীন দলিল ও হিসেবপত্রে গ্রামীণ সমাজচিত্র, মেদিনীপুরের লোকসঙ্গীতের একটি দিক, হাওড়াজেলার একটি লৌকিক দেবতা, কলকাতার অলি-গলির ঠিকুজি, উত্তরবঙ্গের গ্রামীণ প্রবচন, গ্রামনামে সাহেবসুবো, কাশুন্দি - পূর্ববঙ্গীয় আচার-অনুষ্ঠান, লোকঔষধ এবং লোকদেবতা, ডাকটিকিটে প্রত্নবস্তুর ব্যবহার, দুশোবছরের কুমোরটুলি, তেলকম চিরুনি, সুড়ঙ্গে প্রাচীন প্রাসাদ, বোড়োর বলরামের গাজন, উত্তর রাঢ়ের এক মাতৃকা দেবী ইত্যাদি আরো অনেক বিষয়ে লেখা প্রবন্ধ স্থান পেয়েছে এই সংকলনে । তারাপদবাবু নিজে বাঙলার বিভিন্ন গ্রামনামের উত্পত্তি বিষয়ে আলোচনা করে ধারাবাহিক ভাবে কিছু লেখা লিখেছেন, যেগুলি এখানে প্রকাশিত হয়েছে । যেমন, 'গ্রামের নাম কী করে হল -- নবঘরা, হাওড়া, `গ্রামের......-শিঙ্গেড়া', `গ্রামের....-কামারপুকুর-হুগলি' ইত্যাদি । কখনো ভাষাতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ দিয়ে, কখনও বা আঞ্চলিক ভূগোলের তথ্য ঘেঁটে আশ্চর্য দক্ষতার সঙ্গে তারাপদ বাবু গ্রামনামগুলির উত্পত্তি আলোচনা করেছেন । একটি উদাহরণ দিই -- গ্রামের নাম `শিঙ্গেড়া', হাওড়া জেলা । তারাপদবাবু লিখেছেন যে, এই নামটি হল, `শিং' ও `আড়া' এই দুটি শব্দের সন্ধি । `আড়া' শব্দের অর্থ, উঁচু জায়গা বা বাঁধ । আর `শিং' হল `সিংহ' শব্দর অপভ্রংশ । অর্থাত্, ঐ অঞ্চলটিতে কোন এক সিংহ-পদবীধারি পরিবারের বসবাস ছিল কোনসময়, এবং তাঁদের কাটানো পুকুর বা দিঘির উঁচু পাড়ে এই গ্রামটির পত্তন ঘটে । নাম বিশ্লেষণ থেকে কেমন আঞ্চলিক ইতিহাসের সন্ধান মিলে গেল !
এছাড়া কয়েকটি সংখ্যায় রয়েছে বঙ্গ-সংস্কৃতি ও শিল্পান্বেষণের সঙ্গে যুক্ত কোন উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিত্বের স্মরণ । যেমন, ২য় বর্ষ ২য়-৭ম সংখ্যা ডেভিড ম্যক্কাচ্চন সংখ্যা । পরবাসে যাঁরা ইতিমধ্যেই মীনাক্ষী দত্তের লেখাটি পড়েছেন তাঁদের কাছে ডেভিড ম্যাক্কাচ্চনের পরিচয় দেওয়া নিষ্প্র্রয়োজন । অন্যদের জ্ঞাতার্থে বলি, ইংলণ্ডের নাগরিক ও অক্সফোর্ডের এই ছাত্রটি বিশ্বভারতীর উপাচার্য শ্রীসুধীন ঘোষের আমন্ত্রণে শান্তিনিকেতনে আসেন ইংরেজির `লেকচারার' হিসেবে এবং পরবর্তিকালে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হয়ে কলকাতায় স্থায়ী ভাবে বসবাস শুরু করেন এবং হয়ে পড়েন বাংলার পোড়ামাটির মন্দিরের এক একনিষ্ঠ অনুগ্রাহী, তথ্য সংগ্রাহক ও গবেষক । ১৯৭২ সালের ১২ই জানুয়ারি পোলিও রোগের আক্রমণে তাঁর অকালপ্রয়াণ ঘটে কলকাতায় । এই সংখ্যাটিতে রয়েছে ডেভিডের বিষয়ে নানা স্মৃতিচারণ এবং তা করেছেন যাঁরা এই অসাধারণ মানুষটির প্রত্যক্ষ সান্নিধ্যে এসেছেন । তারাপদবাবুর দুটি লেখা পড়ে জানা যায় যে, ডেভিড কৌশিকী পত্রিকাটির ব্যাপারে কত উত্সাহি ছিলেন নিজে, এবং মন্দির সংক্রান্ত গবেষণার কাজে তারাপদবাবুর সঙ্গে কত চিন্তা ও তথ্যের আদানপ্রদান চলত, এমন কি তাঁরা বেশ কয়েকবার যুগ্ম সফরেও বেরিয়েছেন অজানা কোন মন্দির দর্শনে ও তত্সহ খুঁটিনাটি তথ্যানুসন্ধানে । তাঁদের দীর্ঘ বন্ধুত্বের স্মৃতিচারণায় সেই আশ্চর্য মানুষটির প্রতি তারাপদবাবুর সহমর্মিতা এবং বন্ধুর অকালপ্রয়াণে শোকের সুরটি পাঠকের মনকে ছঁংউয়ে যায় । এছাড়া আরো কয়েকটি সংখ্যায় বিনয় ঘোষ, অধ্যাপক নির্মলকুমার বসু প্রভৃতি কয়েকজনের স্মৃতিচারণা রয়েছে । সমগ্র সংকলনটিতে ছড়িয়ে রয়েছে বঙ্গীয় শিল্প ও সংস্কৃতির বিভিন্ন ধারার ত্রক্রমক্ষীয়মান স্রোতের এক মর্মস্পর্শী বিবরণ । সে অতি করুণ কাহিনি ! কলকাতার কাঁথা স্টিচ্ ও পোড়া মাটির গনেশ সমৃদ্ধ বুটিকের ঝলমলানির তুলনায় তা যথেস্ট ম্লান, কিন্তু অনেক বেশি সত্যি । সবশেষে বলি, আমার মতে, বঙ্গীয় শিল্প-সমাজ-সংস্কৃতির মনোযোগী পাঠকের পক্ষে এটি নি:সন্দেহে একটি সংগ্রহযোগ্য সংকলন ।
(পরবাস, মার্চ, ২০০৬)