• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৭৯ | জুলাই ২০২০ | প্রবন্ধ
    Share
  • এ পৃথিবী তেমন বদলায়নি : শুভময় রায়


    ‘পৃথিবী তোমাকে বলি,
    আমি বিশ্বাস করি না!
    যদি সহস্র প্রতিদ্বন্দ্বীও তোমার পদদলিত হয়ে থাকে,
    আমাকের সহস্রের পরে আরও এক জন গণ্য কোরো।

    আমি বিশ্বাস করি না আকাশ নীল;
    আমি বিশ্বাস করি না বজ্রের প্রতিধ্বনিতে;
    আমি বিশ্বাস করি না স্বপ্ন মিথ্যে হয়;
    আমি বিশ্বাস করি না মৃত্যুর প্রতিশোধ হয় না।

    যদি নিয়তি এমনই হয়, যে সমুদ্রের বাঁধ ভাঙে,
    যদি লবণাক্ত জলে আমার হৃদয় প্লাবিত হয়;
    যদি ভূমির উত্থান ঘটে,
    তাহলে মানবতা যেন তার অস্তিত্বের জন্য
    একটি পাহাড় চূড়া বেছে নিতে পারে।

    এখন অবারিত আকাশ এক নতুন বিচিত্র সন্নিপাত
    আর অসংখ্য তারার ক্ষীণ আভাসে সেজে উঠেছে;
    তারা যেন পাঁচ সহস্র বৎসর পূর্বের আদিম চিত্রলিপি।
    তারা যেন ভবিষ্যৎ প্রজন্মের সতর্ক নজর।’

    -- [উত্তর - বেই দাও]

    জেলে থাকাকালীন বাবা স্বপ্ন দেখেছিলেন যে তাঁর এক সন্তান জন্মাবে, আর নতুন চিন রাষ্ট্রের অভ্যুত্থান ঘটবে। সেই শিশু বড় বড় পাথরের মধ্যে লুকোচুরি খেলছে, গুলি খেলা তার ভীষণ পছন্দের। সব্জি বাগানে সে তার বাবাকে সাহায্যও করে। মাঝে মাঝে মায়ের সঙ্গে তার দাদুর বাড়ি যায়। বেই দাও (আসল নাম ঝাও ঝেনকাই; জন্ম ১৯৪৯) এর গল্পের এই দৃশ্যাবলীতে যেন বর্তমান চিনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি ও লেখকের শৈশবের কাহিনিচিত্র ফুটে উঠেছে।

    দরজাগুলো খুলে শহর নিজেই যেন পথপ্রদর্শকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। পিকিং এর সন্তান বেই দাও এর লেখনী সেই যন্ত্র যা শহর পুনর্নিমাণের কাজে ব্যাপৃত। ‘আমি আমার কলমের সাহায্যে বেজিং শহরকে গড়ে নিতে চেয়েছি, আজ সে শহর যা হয়ে উঠেছে তাকে অগ্রাহ্য করে।’ ২০০১ সালে অসুস্থ পিতার শিয়রে বসার জন্য প্রত্যাবর্তন ছাড়া ১৯৮৯ থেকে বেই দাও সেই শহরে ফিরে যাননি যেখানে তাঁর জন্ম। একবার যে গিয়েছিলেন, সে শহর তাঁর অচেনা ঠেকেছিল। বিমান অবতরণের সময় তাঁর মনে হল ‘বেজিং যেন একটি বিশালকায় আলোকোজ্জ্বল স্টেডিয়াম’। কবির শৈশব তেমন আলোয় উজ্জ্বল ছিল না। ফ্ল্যাটে জ্বলত তিন ওয়াটের বাল্ব, রাস্তায় ছিল না কোনও বাতি। সাইকেলের হাতলের ডায়নামো চালিত আলোটি অন্ধকার সড়কে টিমটিম করে জ্বলত।

    ‘ছায়া আর আলো’, ‘গন্ধ’, ‘শব্দ’, ‘খেলনা আর খেলা’ -- বিষয় ধরে ধরে বেই দাও তাঁর কাব্যগ্রন্থে বর্ণনা করেছেন ৫০ আর ৬০-এর দশকের চিনকে। সেই বাড়ি যেখানে অতীতের সহজ সরল জীবনের চিহ্ন রয়ে গেছে -- সেই প্রতিবেশী, সেই সরু গলি। সেই সময় ‘যখন বেজিং ছিল একটি সুবিশাল গ্রামের মত শান্ত’। যখন সাংসারিক কাজে সুদক্ষ বাবা টেবিল, ড্রয়ার, আলমারি অতি নিপুণভাবে কুৎসিত প্লাস্টিকের আস্তরণে ঢেকে শ্লাঘা বোধ করতেন। বাড়িতে বাইরের মিস্ত্রির প্রবেশ নিষেধ ছিল। ‘রোজকার খাবার জোগাড় করাই তো সহজ ছিল না।’ বাবা কী আনন্দই না পেয়েছিলেন যখন একটি কোম্পানির বিজ্ঞাপনে জানা গেল যে তারা বিছানার মাদুরের একেকটি স্প্রিং পাঁচ ইউয়ান দরে কিনে নেবে। বাবা খুশিতে ডগমগ হয়ে সপ্তাহান্তের ছুটির দিনগুলো কাজে লাগিয়ে মাদুরের স্প্রিং খুলে নিয়ে তক্তা লাগিয়ে দিলেন। সব মিলিয়ে আঠাশটা স্প্রিং পাওয়া গেল। পরে জানা গেল যে সব স্প্রিংগুলোর বিনিময়ে পাওয়া যাবে মাত্র পাঁচ ইউয়ান। ব্যালকনিতে পড়ে থেকে থেকে অবশেষে মরচে ধরা স্প্রিং ছাঁট-লোহার কারবারির কাছে পাঠিয়ে যা মিলল তাতে ‘আমাদের তিন ভাইবোনের জুটল ফলের সুগন্ধি দেওয়া কয়েকটি লজেন্স’।

    চিনের দারুণ দুর্ভিক্ষের সময় বেই দাও দশ বছরের বালক। সন্তানদের আধপেটা খাইয়ে রাখতে বাধ্য হওয়া, তাদের অপুষ্টির শিকার হতে দেখা বাবা-মায়ের কাছে ছিল অসহ্য। ‘আমরা তাঁদের বেশি খরচ করতে বারণ করতাম, অনেকক্ষণ ঘুমোতাম যাতে খিদে কম হয়।’ যখন খিদের বোধ চরমে উঠত, তখন যা পেতেন তাই খেতেন – অ্যাকোয়ারিয়াম-এর শ্যাওলা, গ্লুটামেট, বুনো ন্যাসপাতি। সেই সংকটময় বছরগুলোতে স্কুল হত আংশিক সময়ের। হোমওয়ার্ক শেষ করে বেই দাও বন্ধুদের নিয়ে ছুটত কমিকস্‌-এর বইয়ের দোকানে। ছবি দেওয়া বইয়ের সেই ছোট দোকানগুলোর প্রধান ক্রেতা ছিল শিশুরা, তার তুলনা যেন হতে পারে আজকের ইণ্টারনেট কাফে-র সঙ্গে। হুগোসি স্ট্রিট এর দোকানটিতে ঢুকলে বালকের হৃদয়ের প্রজাপতিটি যেন উড়তে শুরু করে। দোকানে বসে বই পড়লে এক ফেন, বই বাড়ি নিয়ে গেলে দুই ফেন খরচ হয়। সবুজ-নীল মণির কণ্ঠহারের মত দোকানের দেওয়ালে ঝুলত অগণিত কমিকস্‌-এর বই।

    আরেকটু বড় হয়ে প্রবেশ করা গেল পারিবারিক গ্রন্থাগারে। বইয়ের আলমারির সর্বোচ্চ তাকগুলোতে গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্য -- মার্ক্স থেকে মাও -- ‘সনাতনপন্থী’ কেতাবের সম্ভার। তার নিচের তাকে বিভিন্ন অভিধানের সমাহার। সবচেয়ে নিচের শেল্ফগুলোতে পত্রপত্রিকা, বিশেষত সিনেমার পত্রিকা। ভবিষ্যতের লেখকের অতি প্রিয় তাক ছিল সেটি। ‘চিত্রনাট্য পড়া যেন এক পয়সাও খরচ না করে সিনেমা দেখার আনন্দ পাওয়া। হয়ত তার চেয়েও ভালো যেখানে মুদ্রিত শব্দ রূপান্তরিত হয় চিত্রে। কল্পনার অবাধ বিচরণ সেখানে।’ কিন্তু কিশোর বালক অচিরেই আবিষ্কার করে মই বেয়ে উঠে নাগাল পেতে হয় এমন নিষিদ্ধ বইয়ের তাকটি। চিকিৎসাশাস্ত্র, নারী শরীরের বর্ণনা আছে এমন অ্যানাটমি-র বই এবং লিবারেশন এর আগে লেখা উপন্যাস যা কিশোরের দেহে-মনে প্রথম যৌন অনুভূতির সঞ্চার ঘটিয়েছিল। সেই সব বই যা ১৯৬৬-তে সাংস্কৃতিক বিপ্লবের সময় পোড়ানো হয়। ‘জনসাধারণের মধ্যে কিন্তু ওই বইগুলোর আদানপ্রদান চলত যা পরবর্তীতে সরকারি অনুমোদনহীন সাহিত্যের বিনিময়ের ভিত তৈরি করেছিল।’

    বেই দাও বলছেন: ‘সাংস্কৃতিক বিপ্লবের সূচনাটি আমার কাছে একটা উৎসবের মত ছিল।’ সতের বছরের কিশোর রেড গার্ড-এ নাম লেখায়। হাই স্কুলে যারা শিক্ষকদের গলায় দোষারূপমূলক প্ল্যাকার্ড ঝোলাতে বাধ্য করেছিল, শিক্ষকদের বিদ্রূপে ভরিয়ে দিয়ে সারি দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা ‘বিপ্লবীদের’ মধ্যে দিয়ে লাথি-ঘুঁষি সহ্য করতে করতে যেতে বাধ্য করেছিল, তার মধ্যে তিনিও ছিলেন। ‘উৎসব’-এ ততদিনই আচ্ছন্ন থাকা গেল যতদিন সেটি একটি রক্তাক্ত ট্র‌্যাজেডিতে পর্যবসিত না হল। মাও-এর সাংস্কৃতিক বিপ্লবের পরে ১৯৬৯ সালে তাঁকে বেজিং থেকে ৩০০ কিলোমিটার দক্ষিণে নির্মাণকর্মে যোগ দেওয়ার জন্য আদেশ করা হয়। পরবর্তী ১১ বছর ধরে তিনি ওই ধরনের বিভিন্ন নির্মাণস্থলে শ্রমিকের কাজ করতে থাকেন। রেড গার্ড এর এই পূর্বতন সদস্য, যিনি একদা গ্রন্থাগারের বইপত্র তছনছ করেছিলেন, সেই সময় থেকে গোপনে রাষ্ট্রের অননুমোদিত বই পড়তে আর কবিতা লিখতে শুরু করেন।

    ইংরেজিতে বেই দাও-এর অধুনা প্রকাশিত আত্মজীবনী ‘সিটি গেট; ওপেন আপ’ মাও জে দং এর চিনের রুক্ষতা-শুষ্কতা-নৃশংসতার চিহ্ন বহন করছে। সরাসরি মাও-এর সমালোচনা না করলেও তিনি বুঝিয়েছেন যে তাঁর কাছে ব্যক্তিজীবনের গুরুত্ব রাজনৈতিক জীবনের তুলনায় অনেক বেশি। কমিউনিজ্‌ম্‌ যে ব্যক্তিবৈচিত্র‌্যের শ্বাস রুদ্ধ করে তার সাক্ষ্যপ্রমাণ বেই দাওয়ের লেখায় খুঁজে পাওয়া কঠিন নয়। কিশোর বয়সে ‘হুতং’ অর্থাৎ বহু শতাব্দী প্রাচীন, জালের মত ছড়ানো, ইঁট-পাথরের গলিতে অন্ধকারে দাঁড়িয়ে তাঁদের বাড়ির দিকে তাকালে কবির মন অস্পষ্ট এক বিদ্বেষে ছেয়ে যেত। কৈশোরের সেই দুর্বিনীত দিনগুলোতে বহুতলবিশিষ্ট অট্টালিকা অবলোকন করে কবির মনে হত সেটি যেন তাঁর বাবার ক্ষমতা আর আদেশের প্রতীক। ক্ষমতার প্রকাশ কত নির্দয় হতে পারে বেই দাও তার আঁচ পেলেন মধ্যজীবনে। চিন রাষ্ট্র ভয় পেয়েছিল তাঁর ব্যক্তিগত কণ্ঠস্বরকে, মানুষের পরিস্থিতির প্রতি তাঁর সুগভীর মমতাকে। এই কারণেই হয়ত অধুনা চিনের গণতান্ত্রিক আন্দোলনে অংশগ্রহণকারীদের কাছে তাঁর কাব্য এত গুরুত্ব পায়। তাঁর কাব্যে সুনিয়ন্ত্রিত আবেগের প্রকাশধ্বনি বিস্ফোরণের থেকে কম নয়।

    তাঁর সহমর্মী তিরিশ জন বুদ্ধিজীবীর সমর্থন নিয়ে বেই দাও যখন ১৯৮৯ সালে রাজনৈতিক বন্দীদের মুক্তি চেয়ে চিনের সরকারকে চিঠি লেখেন, তখন যে শহরে তাঁর জন্ম সেই শহরের দরজা কবির জন্য চিরতরে বন্ধ হয়ে যায়। তিনি দেশান্তরী হতে বাধ্য হন। তাই বোধহয় কবি তাঁর পিতার উদ্দেশে কবিতায় লেখেন:

    ‘দেওয়ালের ভেতরে স্লোগান লুকিয়ে আছে এখনও,
    এ পৃথিবী তেমন বদলায়নি।’




    অলংকরণ (Artwork) : আন্তর্জাল থেকে

    Tags: Bei Dao, Bengali book review, Subhamay Ray
  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments