সঞ্জীব জানেন মূর্তিসাহেব শুধু শুধুই টিপ্স দেবার মত উদার মানুষ নন । কত মানুষকে সিঁড়ির এক এক ধাপ হিসেবে ব্যবহার করে হেড অফ ডিজাইন হয়েছেন তা চোখকান বন্ধ করেও বলে দেওয়া যায় । কর্পোরেট অফিসের সাপলুডো খেলার নিয়মে পোক্ত না হতে পারলে তিনি নিজেই আজ এই রকম প্রেস্টিজিয়াস প্রোজেক্টের একচ্ছত্র জ্যোতিষ্ক হতে পারতেন না । মূর্তির প্রধান ভয় এখন এটাই । আপনমনেই হেসে ফেললেন সঞ্জীব । দুজনেরই প্রোমোশন হবার কথা দু-এক মাসের মধ্যে । এখন এম ডি-র নেকনজরে পড়ে মুখার্জির ভাগ্য যদি মূর্তির ভাগ্যকে টপকে এগিয়ে যায় ! তাই কায়দা করে ওঁর প্রেজেন্টেশন ফাইলটা দেখে নেবার ইচ্ছে । তা সঞ্জীবও ওঁকে চটাবেন না । কে বলতে পারে ভবিষ্যতের কথা । শোনা যাচ্ছে, চেয়ারম্যান নাকি মূর্তিকে বেশ পছন্দ করেন । ই ও টি ক্রেনের পঞ্চান্ন লাখ টাকার অর্ডারটা কুমুদ স্টীলের হাত থেকে প্রায় ছিনিয়ে এনে মূর্তি নিজের ভাবমূর্তি বেশ উজ্জ্বল করে ফেলেছেন সম্প্রতি । ঠাণ্ডা মাথায় ভেবেচিন্তে প্রতিটি পদক্ষেপ নিতে হয় । নইলেই প্রতিযোগিতা থেকে আউট ।
সামনের সিটে নবদম্পতি এতক্ষণ ফিসফিসিয়ে প্রেমালাপে ব্যস্ত ছিলেন, সঞ্জীবের আপনমনের হাসিটা দেখেই বুঝি সন্ত্রস্ত হয়ে সরে বসলেন । সঞ্জীব ওঁদের দেখেই হেসেছেন, এমনটা ভাবলেন কিনা কে জানে । বিয়ের পর শর্মিলাকে নিয়ে হানিমুনে যাবার সময় সামনের সিটের এক বয়স্ক দম্পতি এইরকমই সারাক্ষণ চোখ দিয়ে শাসন করছিলেন । কি রাগ করেছিলেন শর্মিলা । `এই হল মাঝবয়েসী লোকেদের দোষ । সঙ্গে বৌ রয়েছে তবু চোখ দ্যাখো !' পরে বুঝেছিলেন প্রায়-অন্ধ স্বামীকে নিয়ে চোখের চিকিত্সার জন্যে চেন্নাই যাচ্ছিলেন ভদ্রমহিলা । কি লজ্জাই পেয়েছিলেন দুজনে ।
কতদিন শর্মিলাকে নিয়ে একসঙ্গে বেড়াতে যাওয়া হয় না । অফিসের কাজে প্রতিমাসেই এ মুলুক সে মুলুক ঘুরে বেড়াতে হয় যদিও । ঊর্মিকে একা রেখে বেড়াতে যেতে রাজি হন না শর্মিলা । ঊর্মিকে নিয়ে যাবার জো নেই, রোজই এ-পরীক্ষা সে-পরীক্ষা - কবে যে মেয়েটা বড় হয়ে গেল ! শর্মিলা একাই সামলেছেন সব । মেয়ের স্কুল, তারপর কলেজ, হোস্টেলে গিয়ে থাকা, নিজের বাড়ি সঞ্জীবের বাড়ির লোকজন, আত্মীয়স্বজন, পারিবারিক সব অনুষ্ঠান, সব জন্মদিন-বিবাহবার্ষিকী মনে করে করে যোগাযোগ রাখা, এমনকি বিমু-ইন্দ্র-বাবুন ... সঞ্জীবের সব বন্ধুদের সঙ্গে সম্পর্কটা যে এখনও আছে, সব শর্মিলারই জন্যে । নিজেও একটা বেশ ভালো চাকরি করেন, তবু শর্মিলা যে কীকরে সব একা-হাতে সামলান কে জানে ।
ভ্যালু ইঞ্জিনীয়ারিং-এর পার্টিটায় এইচ-আর-ডি র মিস্টার লাম্বা একটা ভাল কথা বলেছিলেন । কোম্পানির রেকারিং কস্ট হিসেবে বছর বছর প্রায় আট কোটি টাকা সাশ্রয় করেছিলেন সঞ্জীব সেবার । দারুণ প্রোজেক্ট ছিল, নিজের সৃজনশীল ক্ষমতা বেশ কাজে লাগিয়ে ক'মাস খেটে সঞ্জীব মাত্র চারজন টিম মেম্বারের সহযোগিতায় শেষ করেছিলেন প্রোজেক্ট । এ-কোম্পানিতে কাজের লোকের প্রাপ্য পেতে বাধা নেই । পার্সি মালিক ব্যবসা বোঝেন । প্রতি বছরই ভ্যালু ইঞ্জিনীয়ারিং টিমের জন্যে বিশেষ আর্থিক অনুমোদন বরাদ্দ থাকে । সে-বছর সঞ্জীব ছিলেন সেই প্রাপ্যের সবচেয়ে বড় দাবিদার । পুরস্কার দেবার দিনের বিশাল পার্টিতে লাম্বা বলেছিলেন কথাটা । `প্রতিটি সফল পুরুষের পেছনে একজন নারী অনুপ্রেরণার কাজ করেন, এ আমরা সবাই জানি । আজকের এই অনুষ্ঠানে আমি তাই মাননীয় এম ডি মহোদয়কে অনুরোধ করব, স্বামীর পুরস্কারের প্রাপ্য চেকটি স্ত্রীর হাতে দেওয়া হোক । কোম্পানির ব্লাস্ট ফার্নেসের গনগনে আগুনের মুখে দাঁড়িয়ে দিনে আঠারো-উনিশ ঘন্টা কাজ করতে পারছেন যে মানুষেরা, তা তাঁরা এই জন্যেই পারছেন কারণ বাড়িতে তাঁদের অবর্তমানে শ্রী ধরে রাখছেন এই মহিলারাই ।'
প্রবল করতালির মধ্যে সত্যিই সেদিন স্ত্রীদের সম্মানিত করা হয়েছিল । এ কোম্পানির এই সব ছোট ছোট মানবিক স্পর্শগুলোর জন্যেই সঞ্জীব এত বছর রয়ে গেলেন এখানে ।
এই বয়সে এসে বোঝেন, সত্যিই শর্মিলার অবদান অনেক । যদিও আজকাল প্রায়ই দুজনের মধ্যে মতের অমিল হয়, বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে শর্মিলা খিটখিটে হয়ে গেছেন খুব, মাঝে মাঝে রীতিমতো বিরক্ত হন সঞ্জীব । তবু বিয়ের পর নতুন শহরে ভাড়াবাড়িতে সংসার সাজানোর সেইসব দিন থেকে আজ পর্যন্ত শর্মিলা সবচেয়ে বড় সহায় । কোনদিন ছোটোখাটো চাহিদার কথাও বলেননি মুখ ফুটে, পরম সহিষ্ণুতায় আগলে রেখেছেন সঞ্জীবের সব জেদ, রাগ, অস্থিরতা, অসহিষ্ণুতা । নিজে চাকরি করে সঞ্জীবের যথাযোগ্য কমরেড হয়ে একত্রে সামলেছেন সব ।
অল্পবয়সী দম্পতির দিকে আবার চোখ না পড়ে যায়, সঞ্জীব চোখ ফেরালেন । দেখবেনই বা কি । এ সি কামরা এমনিতেই বড় নির্জন, এই ছেলেমেয়ে দুটি একত্রে বসে গুনগুন করছে, তাই একটু যা শব্দ .... মোটা কাচের জানলা দিয়ে বাইরে দেখারও উপায় নেই । এদিক ওদিক তাকিয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলাই ভাল মনে করলেন । মেডিটেশন গুরু সত্যস্বামী বলেছেন, `দিনে একবার অন্তত চোখ বন্ধ করে নিজের সঙ্গে একা হবে । আত্মচিন্তন করবে ।'
আজকাল শর্মিলাও বলেন কথাটা । কোনদিনই দর্শনের ছাত্রী ছিলেন না শর্মিলা, তবু আজকাল মাঝে মাঝেই বেশ দার্শনিক সংলাপ বলে ফেলেন । এই এবারেই তো । ঊর্মিকে ভুবনেশ্বরে নতুন কাজে যোগ দিতে যেতে হবে, অথচ শর্মিলার অফিসে অডিট-এর কাজ চলছে, ছুটি নেবার উপায় নেই । `আরে এত টেনশন করো কেন, ঊর্মি তো বড় হয়ে গেছে, একা তো আর যাচ্ছে না । ঐ পরমীত মেয়েটাও তো একই দিনে জয়েন করবে । একসঙ্গে চলে যাক ।'
-`একা একা ! পরমীতের বাবা-মা দুজন যাচ্ছেন, জানো ? আমার মেয়েটার কি একেবারেই কেউ নেই যে, ওকে পৌঁছে দিয়ে থাকার জায়গা, খাওয়া দাওয়ার ব্যবস্থাগুলো দেখে আসে ?'
শর্মিলার সব ভাল, এই এক `মেয়ে-মেয়ে' করে সর্বক্ষণের টেনশন আর যাবে না । মেয়ে যেন আর কারো হয় না । আরে, এখন বড় হয়ে গেছে মেয়ে, নিজেকে চরে খেতে দাও । আঁচল আলগা করো ! শর্মিলা বড় বেশি বাঙালি মা রয়ে গেছেন । `মেয়েকে ছাড়ো, বড় হতে দাও - দুদিন পর বন্ধুরা মজা করবে ওকে নিয়ে - রেখেছ বাঙালি করে মানুষ করো নি' বলে বেশ রসিকতাও করেছিলেন সঞ্জীব ।
- `আমি মাঝে মাঝে সত্যিই অবাক হয়ে যাই সঞ্জীব । একটু ভেবে দেখো তুমি । আত্মচিন্তন করো । ইন্ট্রোস্পেক্ট করো । আত্মবিশ্লেষণ । কিসের জন্যে এত কাজ কাজ, আর কাজ ! সংসারের জন্যেই তো । সবাই মিলে ভালো থাকার জন্যেই তো । কি লাভ এমন কাজ করে যাতে তোমার নিজের লোকেদের সঙ্গেই মানসিক সংযোগ না থাকে ? সংসারের প্রয়োজনে তোমাকে একটু পেতে ইচ্ছে হয় না আমার ? কার জন্যে এত করছ সঞ্জীব ? কোম্পানির প্রফিট ? কোম্পানির কাছে তোমার দাম ঐ রিটায়ারমেন্ট পর্যন্ত । আর একজন তুলে নেবে তোমার কাজের জোয়াল । কিন্তু সংসারে ? ঊর্মির বাবার জায়গাটা নেবার লোক পাওয়া যাবে ?
শেষ পর্যন্ত রাজি না হয়ে উপায় রইল না । `মেয়ে সন্তান - কদিন আর `আমার' হয়ে থাকবে ? সেই তো স্কুল ছাড়ার পর থেকেই বাইরে, এই কাজ শুরু হল, এর পর তো বিয়ে হয়ে পরের ঘরে চলে যাবে । তখন তুমি তোমার কাজ নিয়েই থেকো ।' ঊর্মিকে নিয়ে এই একটা কথায় সঞ্জীব বশ, শর্মিলার চেয়ে ভাল কে জানে ? টিভিতে সিনেমা কি সিরিয়ালে কন্যাদান, বিদায়ের দৃশ্য দেখলেই ছোট্ট ঊর্মিকে কোলে তুলে নিতেন সঞ্জীব । `আমার মেয়েটাকে বিয়ে দেব না কোনদিন ।'
কোথায় যে হারিয়ে গেল সেসব দিন ! ঊর্মির সঙ্গে মুখোমুখি বসে কতদিন গল্প হয় না । কাজ কাজ আর কাজ ! খানিকটা লোভে পড়েই রাজি হয়ে গেলেন । তা, এই দু-তিন দিন কাটল বেশ । যাবার দিন সারা রাত ঘুমোয়নি ঊর্মি । কত যে গল্প তার । নতুন চাকরি, সেই নিয়ে একটু একটু উত্কন্ঠা .... বাবার কাছে তার কত প্রশ্ন । সেই ছোট্ট ঊর্মির মত । সত্যি, এই ব্যাপারে শর্মিলা তাঁকে হারিয়ে দিয়েছেন । ঊর্মির বড় হওয়াটা শর্মিলার মত করে উপভোগ করা হয়নি ।
উপভোগ করা হয়নি আরও কত কিছু । বর্ষার ঘন মেঘ আকাশ ঢেকেছে, আবার শরতের আলো-আলো নীল আকাশ হেসে উঠেছে, সঞ্জীবের সেসব সময় কেটেছে ফাইল-কম্পিউটার-মিটিং নিয়ে । কতদিন ভালো করে একটা বই পড়া হয়নি । শীতের দুপুরে শর্মিলা-ঊর্মিকে নিয়ে লম্বা ড্রাইভে বেরিয়ে পডা. হয়নি । বন্ধুবান্ধব নিয়ে খোলামেলা আড্ডা হয়নি । শর্মিলার সঙ্গে শুধুই কাজের কথা ছাড়া কথা হয় না ।
এমন করে কোনদিন এত কথা মনেও হয়নি । ট্রেনজার্নিটা বড় অলস করে তুলছে মনকে । ল্যাপটপটা খুলে কাজের মধ্যে ডুবে গেলেই হয় । নাকি মোবাইলে একবার শ্রীধরকে ধরবেন ! কালকের প্রেজেন্টেশনের সময় প্রোজেক্টর-এ স্লাইড দেখানোর কাজটা ও-ই করবে । ছেলেটা চটপটে, ওপরে উঠবে একদিন ।
ঘুমিয়ে পড়েছিলেন, মনে হল ট্রেনটা অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে আছে । কোথায় এল ! এমনিতেই রাত তিনটের সময় গিয়ে পৌঁছবে, তার ওপর লেট করলে মুশকিল । জানলা দিয়ে বাইরে দেখার চেষ্টা করলেন । ঘন কালো রং ছাড়া কিছুই নজরে এল না । ভেতরে মুখ ফেরালেন । আরে, ছেলেমেয়ে দুটো নেমে গেছে নাকি ! পরদা সরিয়ে মুখ বাড়ালেন করিডরে । কেউ নেই । একজন মানুষও নয় । অন্তত অ্যাটেণ্ডেন্ট ছেলেটা তো থাকবে । এত বড় কম্পার্টমেন্টটায় একদম একলা তিনি ! তা আবার হয় নাকি ! স্লিপারটা পায়ে গলিয়ে একবার দেখে আসার জন্যে উঠে দাঁড়ালেন । তখনই চোখে পড়ল মানুষটাকে । সামনের সিটে জানলা ঘেঁষে বসে তাঁকেই দেখছেন । যাক, একজন লোক আছে ! মুহূর্তের জন্যে হলেও ভয় পেয়েছিলেন বলে একটু লজ্জাও হল । সব বয়সের দোষ । জলের বোতল খুলে একসঙ্গে অনেকটা জল খেয়ে নিলেন । আহ্, শান্তি । মানুষটা চেয়ে আছে, অথচ কথা বলছে না - অস্বস্তি হচ্ছে । তা, অচেনা মানুষকে স্বমতে স্ববশে আনার কায়দা মার্কেটিং করতে গিয়ে কম শেখেননি সঞ্জীব ।
- `কোথায় এলাম বলুন তো ?' প্রশ্ন করলেন নিজেই ।
পরিষ্কার বাংলায় ভদ্রলোক জবাব দিলেন, `আমি জানি না । জানতে তেমন কৌতূহল বোধ করছি না । জানাটা কি সত্যিই খুব জরুরী আপনার কাছেও ?'
চমকিত হলেন সঞ্জীব । ঠিক এইরকম করে কথা বলত কেউ ।
কে ? চেনা কেউ ? না:, মনে তো পড়ছে না ।
তবু আহ্লাদিত হলেন । বাঙালি, গল্প করে সময়টা কাটিয়ে দেওয়া যাবে ।
- `বা । দারুণ বলেছেন তো । ঠিক কথা । গন্তব্যটা জানাই জরুরী, মাঝখানে কোথায় এলাম না-ই জানলাম ।'
- `ঠিক বলেছেন সঞ্জীববাবু । চিরকালই আপনি একটা গন্তব্য স্থির করে চলা পছন্দ করেন আমি জানি ।'
- `নাম বললেন আমার ? আমাকে চেনেন আপনি ? আশ্চর্য, তাই আমারও চেনা চেনা লাগছিল । কোথায় দেখেছি বলুন তো ! দেখা নয়, অনেক কথা বলেছি এমন চেনা লাগছে আমার । ।'
- `চেনা তো বটেই । সেই আপনার জন্ম থেকেই তো আমি সঙ্গে রয়েছি । আমি আপনার জীবন । কতদিন পর আপনাকে এমন একলাটি পেলাম, তাই কটা কথা জিজ্ঞেস করতে এলাম ।'
মস্করা হচ্ছে ! বেশ, সঞ্জীবও কথায় কম যান না ।
- `ও । বুঝলাম । তা, আপনার নামটা কি মিস্টার জীবন ?'
হো হো করে হাসলেন মানুষটি । বা, হাসিটা খুব খোলা তো । সেই কলেজের দিনগুলোয় সঞ্জীবও এমন করেই হাসতেন । শর্মিলা আজকাল মাঝে মাঝেই বলেন, `কতদিন খোলা গলায় হাসো না তুমি ।' সত্যিই, কর্পোরেট দুনিয়ার নিয়ম মেনে মাপা হাসি, নিচু গলায় মার্জিত উচ্চারণে কথা বলে বলে বুঝি সঞ্জীব বদলেই গেছেন ।
- `তেরা নাম ক্যা হ্যায় বসন্তী ? ... আপনার প্রশ্নটা সেইরকম শোনালো সঞ্জীববাবু । আমার নাম সুজন ।'
হাসলেন সঞ্জীবও । `আচ্ছা । সুজন, আপনি মানুষটা ইন্টারেস্টিং । কথা বলতে ভাল লাগছে বেশ । আপনিই বলুন । কি বলতে চান আমায় ?'
- `আমি কি বলব ? বলবেন তো আপনি । আমি শুনব । সেই জন্যেই তো এলাম । কেমন আছেন সঞ্জীববাবু ? বাড়ি-গাড়ি-ব্যাঙ্ক ব্যালান্স- সাজানো সংসার-কর্মজীবনে সর্বময় কর্তৃত্ব সবই তো পেলেন । যা যা চেয়েছিলেন সব । আজ আপনার চেয়ে সুখী কে ? তবু আজ আমি, আপনার জীবন, আপনাকে কিছু দিতে চাই । আর কি চান আপনি, সঞ্জীববাবু ?
যা যা চেয়েছিলাম ! এই বাড়ি-গাড়ি-ব্যাঙ্ক ব্যালান্স এই সবই চেয়েছিলাম ! ঠিকই তো । সেল্ফমেড ম্যান বলতে যা বোঝায়, সঞ্জীব তো তাই-ই । নিজের চেষ্টায় মেধা-বুদ্ধি-বিদ্যা-শ্রম লগ্নী করে আজ এই যে জায়গায় এসে পৌঁছেছেন, একেই তো সুখ বলে ! আর কিই বা চাহিদা আছে জীবনের কাছে !
বাবা বলতেন, জীবন হল বহতা নদীর মত । নিজের মত করে বয়ে যায়, সমুদ্রে গিয়ে মেশার আশায় । তবু .... সব নদী কি সমুদ্রে মেশে ? কত নদী মাঝপথে শুকিয়ে যায়, কত নদী দিকবদল করে অন্য খাতে বয়ে যায় । আবার কত নদী তার শাখাপ্রশাখা ছড়িয়ে দিয়ে কত আবাদী জমি তৈরি করে এগিয়ে যায় । কেমন নদী হতে চাও, কেমনভাবে এগোতে চাও সেটা তোমাকেই ঠিক করতে হবে । সঞ্জীবের জীবননদী শাখাপ্রশাখা না ছড়িয়েও মসৃণ পথ দিয়ে বয়ে চলেছে এতদিন ধরে । এগিয়ে চলেছে সমুদ্রে মেশার আশায় ।
- `আচ্ছা সুজন, সমুদ্রে গিয়ে মেশাই কি নদীর ভবিতব্য ?' অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে বলে ফেলেন ।
- `কি জানি । বোধ হয় তাই । একটা তো গন্তব্য চাই । কিন্তু সমুদ্রের পরিভাষার বদল হয় যে । নইলে এককালের বাম-রাজনীতি করা সঞ্জীবের গন্তব্য বদলে গেল কি করে ?
ছটফট করে ওঠেন সঞ্জীব । লোকটা তাঁর সব খবর রাখে । সত্তরের দশকের সেইসব রক্ত গরম করা দিন । স্বপ্ন দেখার দিন । মানবিকতা, যুক্তিবোধ ও মুক্তচিন্তার সেইসব দিনে সঞ্জীব ছিলেন পার্টির একজন অ্যাসেট । অথচ সাতাত্তরের বিপুল জয়ের পর একরৈখিক মতাদর্শের বন্ধতার যন্ত্রণায় ছটফট করেছেন কতগুলো দিন, যে স্বপ্ন বা ইউটোপিয়াকে বিশ্বাস করে নিজের পড়াশোনা কেরিয়ার পর্যন্ত বিসর্জন দিয়েছিলেন সেই মতাদর্শ দৃষ্টবাদী জীবনবোধে আক্রান্ত হলে এককথায় ছেড়ে এসেছেন । তাঁর কাছে সততার অর্থ একটাই । নিজের কাছে সৎ থাকা । ঠিক যে-সময় পার্টির হোলটাইমার হিসেবে ক্ষমতার সিংহাসন উপভোগের সময়, তখন নিজের মানবতাবাদী আদর্শবোধটি মূলধন করে ছেড়ে এসেছেন সব আকর্ষণ । সেই আপোষ না করা ছেলেটা কোথায় হারিয়ে গেল !
কেন গন্তব্য বদলে গেল সব কি বলা যায় !
- `জানেন সুজন, নিজের কাছে সৎ থাকার জন্যে কত কিছু ছাড়তে হয় ? হয়ত পথটা ছেড়েছি, কিন্তু কাজ তো করছি । যা করছি, মানুষের জন্যেই তো করছি । ত্রক্রীতদাসের মত খাটছি, শেষ পর্যন্ত সমাজের কাজেই না লাগছে সেটা !'
- `সমাজের কাজে, নাকি ধনীর নিয়ন্ত্রিত পুঁজিবাদে ? মনকে চোখ-ঠারা হয়ে যাচ্ছে না তো সঞ্জীববাবু ?'
একটু রাগই হয় সঞ্জীবের ।
লোকটা তাঁর ভদ্রতাকে দুর্বলতা মনে করে উপহাস করছে নাকি !
- `শুনুন সুজন । আপনাকে তাহলে একটা কথা বলি । আমার কোন অনুশোচনা নেই । যা করেছি তা বুঝে শুনে সিদ্ধান্ত নিয়েছি । চিরকালই আবেগের থেকে লজিক আমার কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ জিনিস । আবেগের দাসত্ব না করে এইযে আজ এখানে এসে পৌঁছেছি, তাতে কারও কোন ক্ষতি হয়নি । বরং আমার পরিবার আমার হাত ধরে স্বস্তিতে বাঁচার রসদ পেয়েছে ।'
- `পরিবার ! সব সাধারণ মানুষের মত কথাটা বললেন তা হলে ? পরিবারের লাভটুকু দেখতে গিয়ে কত আদর্শের মৃত্যুই যে দেখলাম ! সেই যে নতুন সমাজ গড়ার স্বপ্নে অনেক পরিবারের বাঁচার রসদ জোগাড় করার কথা ছিল, সেটার সঙ্গে আপোষ করতেই হল ?'
- `সুজন, আপনি কি করে আমার সব কথা এত ডিটেলে জানেন, আমি জানি না । তবু কথাটা যখন বললেন, তাহলে শুনুন । ষোলবছর বয়সে স্বপ্ন দেখা হয়েছিল । সবই যখন জানেন, এ কথাও জানেন যে সেই স্বপ্ন দেখার কাজটা নিষ্ঠার সঙ্গে করেছিলাম বলেই পড়াশোনা-কেরিয়ার কোন কিছুর তোয়াক্কা করিনি । নিম্ন মধ্যবিত্ত বাড়ির ছেলে আমি । দিনের পর দিন বাড়িতে রান্না করার রসদটুকুও থাকত না । এমনও হয়েছে .... মা শুধু ভাতটুকু ফুটিয়ে দিয়েছেন । ফ্যানা ফ্যানা সেই গরম ভাত নুন দিয়ে খেয়েছে বাড়ির সবাই, আর মা ? মা শুধু সেই ফ্যানটুকু খেয়ে পেটের জ্বালা মিটিয়েছেন । সেই অবস্থায় নতুন সমাজ গড়ার স্বপ্ন দেখা বিলাসিতা ছিল না কি ? আমার সমবয়সীরা যখন টপাটপ ভাল কলেজে প্রফেশনাল পড়াশোনায় ব্যস্ত, আমি তখন পালিয়ে বেড়াচ্ছি এখান থেকে সেখানে, গ্রামে-গঞ্জে হাটে-বাজারে । সাধারণ মানুষকে উদ্বুদ্ধ করছি রাজনৈতিক চেতনায় । করেছি ..... কারণ, তখন সেই কাজটায় বিশ্বাস করেছি ভেতর থেকে । চিরকালই আমি যা করি, তা নিজের হাণ্ড্রেড পার্সেন্ট দিয়ে করি । পার্টি যখন পাওয়ারে এল, মনের মধ্যে সে কি উত্তেজনা । কিছুদিন পর থেকেই স্বপ্ন ভাঙা শুরু । সে যন্ত্রণা বোঝেন ? সুজন ?'
অনেকদিন পর বুকের মধ্যে সেই যন্ত্রণা অনুভব করলেন সঞ্জীব । শুভময়দা ডেকে পাঠিয়েছিলেন, `শোন সঞ্জীব, সুখপুকুর হাইস্কুলে আগামী মাস থেকে ফিজিক্স টিচার হিসেবে জয়েন করছিস তুই । এই নে কাগজ, একটা অ্যাপ্লিকেশন লিখে দে এখনি ।'
- `আমি ? আমি তো গ্রাজুয়েশনটাও পাশ করিনি, আমার যোগ্যতা কি ?'
- `আরে ওসব তুই আমার ওপর ছেড়ে দে । তোর বাড়ির অবস্থা জানি আমি । পার্টি থেকেই তাই এই ডিসিশন নেওয়া হয়েছে । সরকারি স্কুল, মাঝে মাঝে যাবি, মাইনে পাবি, পুরো সময়টা পার্টির হয়ে খাটতে পারবি । এই এলাকায় তোর ওপর পার্টি কতটা নির্ভর করে জানিসই তো ।'
স্বপ্নভঙ্গের সেই শুরু ।
যুক্তিনিষ্ঠ মানবতাবাদী নীতিবোধাশ্রয়ী আদর্শবোধের সঙ্গে পদে পদে সংঘাত । মনের সঙ্গে গোপন লড়াই । যেদিন বুঝেছিলেন, নতুন সমাজ গড়ার স্বপ্ন ভোগলালসার রসে জারিত হয়ে একটি কদর্য বিকৃতির পথে পা বাড়াতে চলেছে, সেদিন এক কথায় পার্টি ছেড়েছিলেন । সহজ হয়নি কাজটা । তিনি চাইলেও পার্টি তাঁকে ছাড়তে চায়নি । এলাকার মানুষের অত্যন্ত প্রিয়, আদ্যন্ত সত্, তীক্ষণধী, কর্মক্ষম যুবকটিকে ধরে রাখার জন্যে চেষ্টার ত্রুটি ছিল না । কি করে যে সর্বত্যাগী সন্ন্যাসীর মত সব প্রলোভন জয় করেছিলেন, তা কি কাউকে বলে বোঝানো যায় ?
তারপর কঠিন জীবন সংগ্রাম । অনেক অনেকগুলো বছর চলে গেছে । নতুন করে পড়াশোনা শুরু করা, চাকরিজীবনে ধাপে ধাপে এগোনো - আহ্, সেইসব দিনগুলো ! সংসারে স্থিতি এসেছে, ভাইদের হাত ধরে দাঁড় করিয়েছেন, বোনেদের বিয়ে, বাবামায়ের মাথা গোঁজার জন্য সংস্থান - সবই তো করেছেন একে একে । আপোষ করেননি কোথাও । না, কোথাও নয় । আজ এই লোকটা তাঁকে দ্বিচারিতার অভিযোগে কাঠগড়ায় তুলতে চাইলেই হবে নাকি ?
- `না, ঠিক দ্বিচারিতার অভিযোগ নয় । আমি জানতে চাইছিলাম, এই যে এমনভাবে বদলাতে হল জীবনধারা, তার জন্যে কষ্ট হয় না আপনার ?'
লোকটা কি থট-রিডার ? এমনভাবে সঞ্জীবের মনের কথাগুলো পড়ে ফেলছে কি করে ?
তবু ... প্রশ্নটা শুনে থমকালেন ।
- `কষ্ট ? না, কষ্ট ঠিক নয় । .... একটা অভাববোধ ... না, ঠিক অভাববোধও নয় .... কি যেন একটা । কি যেন করার ছিল, হল না ! ঠিক এইরকম ছকে-বাঁধা জীবন চাইনি আমি । .... একটা প্রশ্ন মাঝে মাঝেই মনে ঘুরপাক খায় ... জীবননদীর ধারা নিজে নিজে নিয়ন্ত্রণ করা হয় না কেন ? কেন দিক বদল হয় ?'
-`মনখারাপ করবেন না সঞ্জীববাবু । আপনি তো ভাগ্যে বিশ্বাস করেন না । নইলে বলতাম, ভাগ্য এইভাবে দিক বদল করায় ।'
- `না, ভাগ্য ভুত ভগবান কোন কিছুতেই বিশ্বাস করি না আমি । আমার জীবন আমাকে বারবার দিক বদল করতে বাধ্য করেছে । আমি নিজের জোরে, নিজের চেষ্টায় জীবনের মোড় ঘুরিয়েছি । বারবার ।'
- `অদৃষ্টবাদীরা সেটাকেও ভাগ্যের ফের বলে প্রতিষ্ঠা করে ফেলবেন । যাকগে .... আমি জানি আপনি পুরুষকারে বিশ্বাস করেন । আমি জানি, আপনি মিথ্যে বলেন না । যা হয়েছে, ভাল হয়েছে । আজ আপনি একজন সফল তৃপ্ত মানুষ । তবু ..... কেমন একটা অহঙ্কারের সুর শুনছি আপনার গলায় । পুঁজিবাদী অহঙ্কার ।'
- `হতে পারে । আমি অহঙ্কার করাকে খারাপ বলে মনে করি না । যা করেছি নিজের চেষ্টায় করেছি । কেউ সাহায্য করেনি । একজনও না । অনেক বছর পর্যন্ত আমি অত্যন্ত স্ট্রেট-ফরোয়ার্ড মানুষ ছিলাম । সমাজ সংসার আমাকে বারাবার আঘাত করেছে । আমি জীবন থেকে শিখেছি কিভাবে কৌশলে কার্যসিদ্ধি করতে হয় । ম্যানিপুলেশন । নানা মূল্যবোধের ভাঙাগড়া । এই মানিয়ে নেওয়া জীবনে অহঙ্কার আত্মরক্ষার অস্ত্র ।'
অনেকক্ষণ চুপচাপ । মধ্যবয়সে পৌঁছে এইভাবে জীবনকে ফিরে দেখার নামও কি জীবন ?
নদীরও কি ইচ্ছে করে এইরকম, উত্সমুখ পর্যন্ত উল্টোপথে বয়ে গিয়ে দেখে আসার ?
সুজন, নাকি জীবনই কথা বলে ওঠেন, `আপনার সব কথা বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করছে । বুঝতে পারছি, আপনি নিজের প্রতি সত্, বিশ্বস্ত । বেশ না হয় তাই হল । আমার খুব জানতে ইচ্ছে করছে, আজকের দিনে ... জীবনের এমন পরিতৃপ্তির ক্ষণে এসে আপনার কেমন লাগে ? জীবনের কাছে আপনার চাহিদা কি ?'
জীবনের কাছে চাহিদা !
মনের ভেতর ডুব সাঁতার । না:, তেমন কোন চাহিদা তো নেই আর ।
শর্মিলা ঠিকই বলেন । কাজের নেশা । নিজের হাণ্ড্রেড পার্সেন্ট দিয়ে কাজটা তোলা । এইটুকুই । প্রোজেক্ট, প্রোমোশন, অফিস - কোনটার জন্যেই টান নেই সত্যিই । এই মুহূর্তে সুজনের প্রশ্নের মুখোমুখি হয়ে নতুন করে উপলব্ধি করেন সঞ্জীব - এই এতগুলো বছর কর্পোরেট দুনিয়ার রন্ধ্রে রন্ধ্রে বিচরণ করেও একাত্ম হওয়া হয়নি ।
সত্যিই কারো কিচ্ছুটি এসে যায় না । জীবনে আরো দুটো প্রোমোশন, কটা বিদেশ ট্যুর, কিছু টাকা - না:, সত্যিই আর এসব নিয়ে ভাবছেন না সঞ্জীব । কেমন ঠাণ্ডা নীলচে সাদা আলোয় ভেতরটা ছেয়ে গেল ।
চোখ তুলতেই দেখেন, হালকা হাসিমুখে চেয়ে আছেন সুজন, নাকি জীবন ।
- `বললেন না তো সঞ্জীববাবু ? কি চান আপনি ? যা চাইবেন, তাই দেব আজ ।'
- `আপনি কে সুজন ? সত্যি করে বলুন তো !'
- `বললাম তো । আমি আপনার জীবন । বেশ ভাল করে ভেবে বলুন সঞ্জীববাবু, জীবনের কাছে আপনার চাহিদা কি !'
শির শির করে উঠল ভেতরটা । চোখ বন্ধ করে ফেললেন সঞ্জীব ।
এমন করে ভাবেননি সত্যিই । তন্ন তন্ন করে খুঁজে চললেন নিজেকে ।
তারপর কেমন ঘুমঘুম গলায় বলতে লাগলেন নিজেকেই, `বড় ক্লান্ত লাগে । বড় ক্লান্ত । একান্ত স্বাধীনভাবে বাঁচতে ইচ্ছে করে কদিন । একেবারে নিজের মত । নিজের ইচ্ছেমত । ঊর্মিকে নিয়ে এই স্বপ্নটা দেখি মনে মনে । কেউ জানে না, ঊর্মিও না । আমার চাহিদা বলতে এইটুকুই । ঊর্মির জীবন যেন স্বচ্ছন্দ স্বনির্বাচিত গতিপথ বয়ে চলতে পারে । আমার মত প্রতিপদে মানিয়ে চলার কষ্ট আমার মেয়েটাকে যেন না পেতে হয় ।
বলতে বলতেই লাল কম্বলে মোড়া টুকটুকে ছোট্ট ঊর্মিকে দেখতে পান সঞ্জীব । এতদিন পর । ওঁরা দুজনে মেয়েই চেয়েছিলেন । সেদিন সকাল থেকে মাতৃসদনের লেবাররুমে কিন্তু পরপর ছেলে হচ্ছে । মোটাসোটা সেই নার্স মহিলা বলে গেলেন, `আজ ছেলে হওয়ার দিন ।' দুই মা-ই খুব খুশি, `আমাদের ঘরেও নাতিসাহেবই আসছেন ।' কিন্তু ওঁদের দুজনের আশা পূরণ করে ঊর্মি এল । অপারেশনের পর শর্মিলা তখনও অচেতন, সঞ্জীব প্রথম দেখেছেন মেয়েকে । শর্মিলারও আগে । খুব অসুস্থ হয়েছিলেন শর্মিলা । তারপর কমাস পর অফিসে জয়েন করতেই হল । রাতে জাগতে পারেতেন না । ছোট্ট ঊর্মিকে সারা রাতে দেখাশোনা করতেন সঞ্জীবই । অনেকদিন পরে বুকের মধ্যে কেমন গলে গলে পড়তে লাগল সব ।
`খুব ভাল থাকুক ঊর্মি । ঊর্মির সব ভাল হোক । সব স্বপ্নপূরণ হোক, সব ইচ্ছে পূরণ হোক ।'
পিতৃহৃদয় আলোড়িত করে শব্দ কটা বেরিয়ে এল ।
- `আর কিছু চাই না সুজন । মেয়েটা খুব ভাল থাক । সুখে শান্তিতে থাক ।
.... আর .... খুব ইচ্ছে করে .... মাকে নিজের কাছে এনে রাখি । বাবা চলে গেছেন, মা এত একলা !'
কতদিন মায়ের সঙ্গে প্রাণ খুলে কথা হয় না । দূরভাষের কথায় শুধু বার্তাটুকুই থাকে, প্রাণের আলাপহয় কই ! মা ..... ফর্সা টুকটুকে মুখে পানপাতায় রাঙানো লাল দুটো পাতলা ঠোঁটের মায়া .... কতদিন মায়ের কোলে মাথা রেখে ঘুমোনো হয়নি ! মা, মা গো !
- `আমার একটু সময় চাই । সময় । নিজের জন্যে নিজের মত করে বাঁচার সময় ।'
কত কিছু করার আছে । অনেক গোপন স্বপ্ন !
কাউকে বলা হয়নি ।
রিটায়ার করে একটা এন জি ও তৈরি করার গোপন ইচ্ছে আছে । স্বপ্ন .... ছোট্ট স্বপ্ন । খানিক আগে সুজন বলছিলেন না ? পুঁজিবাদের দাসত্ব করার কথা ? কে জানে সঞ্জীবের গভীর গোপন মনে ঐ কথাটা বাসা বেঁধে আছে কিনা ! এই জন্মেই একবার সেই দাসত্ব থেকে মুক্তি চান সঞ্জীব । সে কথা কি খুলে বলা যায় কাউকে ? মনে মনে ভেবে রেখেছেন, শেষ জীবনটা আর দাসত্ব করবেন না কারও । মানুষের কাজ করবেন । মানুষের জন্যে কাজ । দাসত্ব কি শুধু একরকমের ? সেই কোন অবোধ বয়স থেকে ছুটে চলেছেন .... জীবনের দাসত্ব .... সমাজ সংসার পরিজনের প্রতি দায়িত্বপালনের দাসত্ব .... ঘুণ ধরা সমাজের নানা নিয়মের দাসত্ব .... একবারের জন্যে স্বাধীনভাবে বাঁচতে চান সঞ্জীব । নিজের জন্যে বাঁচা । নিজের ইচ্ছেমত বাঁচা ।
বড় ক্লান্ত লাগে । সেই কবে থেকে মনে হয় ... এই কাজটা হয়ে গেলেই কদিন মুক্ত নি:শ্বাস নেবার ক্ষণ আসবে বুঝি ... না:, কাজ আর শেষ হয় না । খুড়োর কলের পেছনে ছুটে ছুটেই সময় চলে গেল অনেক । একবার ... শুধু একটিবারের জন্যে.... একেবারে মুক্ত হয়ে বাঁচতে চান সঞ্জীব ।
জীবন সেই সময়টুকু দেবে তো ? নিজের মত করে কদিনের জন্যে বাঁচতে পারবেন তো ? দু চোখ বন্ধ করেই ব্যাকুল দু হাত বাড়িয়ে আশ্বাস খোঁজেন সঞ্জীব ।
দূর থেকে কাদের কথা বলার শব্দ, মৃদু নড়াচড়া - গন্তব্য এসে গেল বুঝি । চোখ খুলে দেখেন, সামনের সিটে তো কেউ নেই ! চলন্ত ট্রেন থেকে কোথায় গেলেন জীবন, নাকি সুজন ? মাথাটা অসম্ভব হালকা লাগছে, কেমন একটা আলো-আলো ভাব । কথা বলে সত্যিই ভাল লাগল । কৃতজ্ঞতা জানানো হল না সুজনকে ।
`আচ্ছা, আমার জীবনের নাম `সুজন' কেন ?'
ভাবনাটা মাথায় নিয়েই ট্রেন থেকে নেমে পড়ার ব্যস্ততায় শামিল হলেন সঞ্জীব ।
(পরবাস, ডিসেম্বর, ২০০৬)